short-story-tobuo-manob-theke-jay

…তবুও মানব থেকে যায়
জাকির তালুকদার



এখন আর বিয়েতে রাজি না হয়ে করার আছেটাই বা কী!

চাঁদের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে হেরে গেছে বলে সোডিয়াম বাতিগুলোর মুখে চুনকালি মাাখিয়ে দেওয়ার জন্য ভনভনিয়ে এসে বসেছে শ’য়ে শ’য়ে রাতপোকা। তবুও রাতটা কেমন যেন ঘোলা ঘোলা। মনে হচ্ছে শ্রীমায়ের মন্দিরের ঘুলঘুলি থেকে বেরিয়ে আসা ধূপের গন্ধমাখা ধোঁয়া রাতটাকে পুরো ঘোলাটে-ধোঁয়াটে বানিয়ে ছাড়বে। নুপুর দাসের ঠেকের স্যালাইন ব্যাগের বাংলা চোলাই, নৃপেনের চপ-বেগুনি, স্টেশন বাজারের রুটি-গরুর পায়ার নেহারি, যাকে অরুণ ঘোষ ভদ্রলোকি ভাষায় বলত বোন-স্যুপ, পেটের মধ্যে দলামোচড়া পাকিয়ে গলা বেয়ে অম্বল হয়ে উঠে আসতে থাকলে সে অস্বস্তিটাকে ভোলার জন্য নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশ জোরে জোরেই বলে – ‘নাহ, বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।’ কিন্তু বিয়ের চিন্তা পেটে গ্যাসের বুড়বুড়িকে থামাতে পারে না। তখন একবার ভাবে বমি করলে কেমন হয়। বসেও পড়ে রেললাইনের ধারে উবু হয়ে। বার ছয়েক গলার মধ্যে আঙুল ঠেসে ওয়াক ওয়াক করে, কিন্তু বমি হয় না। তখন বাড়ি পৌঁছে যাহোক একটা কিছু করা যাবে ভেবে উঠে দাঁড়াতেই রাত্তিরের পুরো আকাশটা সহ মেট্রোপলিটন শহর তার চোখের ওপর একবার চক্কোর দিয়ে ওঠে। ফলে চোখ বন্ধ করে ফেলা সত্বেও নিজের ভেতরে ভূমিকম্পের মতো কিছু একটা টের পাওয়া যায় অন্তত মিনিটখানেক ধরে। সেটা কেটে গেলে, চোখ খোলার পরে দেখা যায় নুনজল বেরিয়ে এসে চোখের পাতা স্যাঁতলা করে দিয়েছে। ফলে রাতটাকে তখন আরো বেশি ধোঁয়াটে মনে হতে থাকে। হাতে ময়লা আছে কি না খেয়াল না করেই সে হাত দিয়ে চোখ ডলে। তারপর ভূমিকম্পের পরে সবকিছু ঠিক-ঠাক আছে কি না দেখার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অন্তত তিনদিকে তাকায়। এবং তখনই সবিস্ময়ে খেয়াল করতে পারে যে পুরো দৃষ্টিসীমার মধ্যে সে একবারেই একা। যেমন কয়েকদিন আগে আবিষ্কার করেছে সে এই শহরে এখন প্রায় পুরোপুরিই একা। আত্মীয় আছে, স্বজন নামীয় কিছু মানুষও আছে, চেনা-পরিচিত লোকজন আছে, কিন্তু যাদের সঙ্গে থাকলে মনে হবে যে হ্যাঁ সঙ্গে কেউ আছে, তেমন কেউ-ই এখন তার সন্নিহিতে নেই। এই একাকীত্ব হঠাৎ আবিষ্কৃত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয়েছে। কারণ হঠাৎ করে একা হয়নি সে। একটু একটু করে হয়েছে। অনেকদিন ধরে একটু একটু করে হয়েছে। পৃথিবীর বিবর্তনের মতো ধীরে ধীরে, কিন্তু অমোঘতার সঙ্গে। ষোল বছর ধরে। প্রথমে তল্পিতল্পা নিয়ে বিআরটিসি কোচে উঠে ঢাকা পাড়ি দিল মনিরুল। কী কারণ? পেইন্টিং এর পৃষ্ঠপোষকতা নাকি ঢাকা ছাড়া আর কোথাও নেই। কাজেই ছবি আঁকতে হলে রাজধানীতে যেতে হবে। তো ষোল বছর ঢাকাবাসে তার ছবি আঁকা হয়েছে কয়টা! খুঁজলে দেখা যাবে একটাও না। বিস্কুট-সিগারেট-চানাচুর-ম্যাংগোজুস কোম্পানির প্যাকেটের ডিজাইন করে এখন মনিরুল। ফাঁকে ফাঁকে বাণিজ্যিক এলাকায় ঘুরে ঘুরে কিছু ছাপার কাজের অর্ডার বাগায়। তো ছবিই যদি আঁকা না হয়, তাহলে ঢাকায় বস্তিবাসীর মতো থাকা কেন! এখানে তো বাচ্চাদের স্কুলে ছবি আঁকা শেখানোর পাশাপাশি কিছু কিছু আঁকার কাজ চলছিল। এখন! আর শফিক চাকরি নিয়ে চলে গেল পাবনা ক্যাডেট কলেজে। হামীম স্যার, মতিন স্যার রিটায়ারমেন্টের পরে বাড়ি তুলেছে সিটি কর্পোরেশনের আরেক প্রান্তে। সেখানে যেতে গেলে দেড় বেলা অন্তত হাতে নিয়ে বেরুতে হবে। ডাক্তার প্রদীপ মেডিক্যাল কলেজের মাস্টারিতে ঢুকল। তারপর ছাত্র পড়ানো-পরীক্ষা নেওয়া-হাসপাতাল ডিউটি-প্রাইভেট প্র্যাকটিস মিলিয়ে একই শহরে থাকলেও দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে দূরে বাস করে সে-ই। আকরাম কবিতা লেখা আর আবৃতি ছেড়ে এখন পুরোদস্তু ধান-চালের আড়তদার। শেষ পর্যন্ত অসিতও কবিতা লেখা-বাংলা খাওয়া-অড্ডা দেওয়া ত্যাগ করে শ্রী অরবিন্দের ছবির সামনে ধূপ জ্বালিয়ে ধ্যানের মাধ্যমে জীবনের পরমার্থ সন্ধানে নিমগ্ন হয়ে পড়ায় এখন অলোক সম্পূর্ণ একা।

অথচ রুহুল ভাই মেঝেতে চকখড়ির দাগ কেটে বুঝিয়ে দিয়েছিল এমনটি হতে পারে না। পাশাপাশি দুই জ্যামিতি। একটাতে গোল দাগ। নিখুঁত বৃত্ত। এটা হলো সাধারণ গৃহী মানুষের জীবনবৃত্ত বুঝলি। পুনরাবর্তনে অভ্যস্ত। অচেনা বিন্দুতে যেতে ভয় পায়। কেননা অ্যাডভেঞ্চার তাদের রক্তে নেই। নিজের জীবন, নিজের পরিবারের জীবন, নিজের পেশা, নিজের একটু আরামে থাকার বাইরে আর কিছু ভাবতে তারা শেখে না। কেউ শেখাতে গেলেও ভয় পায়। তাকে এড়িয়ে চলে। নিখুঁত বৃত্ত, মানে গণ্ডি কেটে বিন্দুমাত্রও সরে যেতে অনিচ্ছুক। অন্য জ্যামিতি হার্টের রোগীর ইসিজি-র মতো লম্বা-বাঁকা-ত্যারছা দাগের। কোনো মাথা সাঁই করে উপরে উঠেছে, কোনোটা নেমে গেছে কয়লাখনির লিফটের মতো সটান নিচে। এটি হলো ক্রিয়েটিভ মানুষের জীবনরেখা। উত্থান ও পতনময়, ঘটনাবহুল, অনিশ্চিত। এবং বর্ণাঢ্য। এই দুটো জ্যামিতি, মানে, দুই ফিগারকে মিলিয়ে দেখা তো কেমন পারিস। কস্মিনকালেও মিলবে না।

কিন্তু দুই বিপরীত জ্যামিতিকে সঙ্গিদের জীবনে মিলে যেতে দেখতে দেখতে অলোক হতবিহ্বল এবং বিমূঢ়। রুহুল ভাইয়ের দুই বিপরীত জ্যামিতি পরস্পরের সঙ্গে মিশ খাওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। শুধু সে, অলোক, যে কিনা কোনোদিন একলাইন পদ্য লেখেনি, ছবি আঁকার নামে কাগজে-পেন্সিলে ঘষাঘষি করেনি, নাটকের মঞ্চে ওঠেনি, গানের সা রে গা মা করেনি, সেই অলোকই এখন পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক কোনটি তার জীবনরেখা। নিখুঁত বৃত্ত নাকি হৃদরোগীর ইসিজি। প্রবাল বার কয়েক খ্যাঁক খ্যাঁক করেছে — তুই কি শালা ক্রিয়েটিভ নাকি? ক্রিয়েটিভিটির আছেটা কী তোর?

উত্তর দেওয়া মুশকিল। আসলে অলোক তো বিশেষ কোনো কিছু হতে চায়নি। ক্রিয়েটিভ হতেও না। তবে যারা একটা কিছু হতে চাইছে, হতে যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল। সৃষ্টি করতে না পারুক, সৃষ্টি করতে দেখাটাও তো কম বড় ব্যাপার নয়। এ তো শুধু বীজ পুঁতে দেওয়া আর মাটি ফুঁড়ে চারা বেরিয়ে আসতে দেখা নয়। বরং একবিন্দু একবিন্দু করে বীজ তৈরি করা, মাটি তৈরি করা, জলবায়ু তৈরি করা, চারা তৈরি করা এবং সবশেষে সেই চারাতে ফুল ফোটানো। সবকিছুই তো করে শিল্পী নিজে। সেই শিল্পকর্মের প্রত্যক্ষ সাক্ষী, তার সৃষ্টিকর্মের প্রতিবিন্দু তৈরি হতে দেখা কী কম গুরুত্বের কাজ! আর তাছাড়াও অলোক অনুভব করেছিল, ওদের সঙ্গে থাকা মানে পৃথিবীর সর্বশেষ নন্দনভাবনার সাথে থাকা। সক্রেটিস, প্লেটো, রুশো, হেগেল, মার্কস, আইজেনস্টাইন, পিকাসো, গ্রামসি, এডওয়ার্ড সাঈদের সঙ্গে থাকা। মায়াকোভস্কির অন্তহীন জীবনজিজ্ঞাসা, ব্রেখট-এর অতলান্ত গভীরতা,পাভলভের জ্ঞানস্বভাব, লালনের ভালোবাসাময় নির্লিপ্তত — এসবের সাথে হৃদয়ের সখ্য কীভাবে সম্ভব ছিল অলোকের ওদের সঙ্গে না থাকলে!

প্রবাল আবার মনে করিয়ে দিয়েছে — তুই যা: সেইভাবে না থাকলে ধাক্কা তো খেতেই হবে বাবা! হাওয়ার উপর দিয়ে বেশিক্ষণ হাঁটা যায় না। ধপ করে পড়ে যেতে হয়। একেবারে দ্রাম-ম-ম করে আছাড় খেতে হয়।

সমস্যা তো সেখানেই। অলোক বুঝে উঠতেই পারছে না কোনটা তার আসল জীবন। বুঝতে পারছে না আসলে সে ঠিক কী।

বাপ মরার পরে সম্পত্তি নিয়ে যে কামড়াকামড়ি শুরু হয়ে গেল, তাতে মাথা গলায়নি সে একবিন্দুও। বড়ভাই, মেজোভাই, বোনেরা নিয়ে-থুয়ে যা ছিল, তার ভাগে পড়েছে এই দুই ঘরের বাড়ি। পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথনির ওপর টিনের চালা। সংসারি ব্যাপারে খুব হিসাবি না হলে ঠকতে হয়ই। অলোক যে ঠকছে তা নিজে ঠিকই বুঝেছিল। কিন্তু গা করেনি। এই বাড়ি বাপ কেন বানিয়েছিল কে জানে। পুলিশের চাকরি করেছে। যখন যা পেয়েছে ঘুষ হিসাবে, উপরি হিসাবে, তা সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে সম্পত্তি বানিয়ে। এই বাড়ি ভাড়া দেওয়া ছিল নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে। অন্য ভাই-বোনেরা এই বাড়িকে ভদ্রলোকের বাসযোগ্য মনে করত না। প্রথমত বাড়িটা ভদ্রগোছের নয়। দ্বিতীয়ত এই পাড়াটাও, যদিও তাদের আদি পৈত্রিক নিবাস এই পাড়াই, ঠিক ভদ্রলোকের পাড়া নয়। তাই অলোক এই বাড়ি ভাগে পেয়েছে। সঙ্গে কিছু টাকাও। বাপ কত টাকা ব্যাংকে জমিয়েছিল, জানে না অলোক। পেনসন, গ্রাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, সঞ্চয়পত্র, জীবন বীমা সব মিলিয়ে অনেক টাকাই হবে। কিন্তু কোনোদিন সে সম্পর্কে ধারণা ছিল না তার। বোনেরা নিজেদের ভাগে কম পড়েছিল মনে করে বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে দল ভারি করার জন্য বারকয়েক অলোকের কানের কাছে গুজুরগুজুর করার চেষ্টা করেছিল। তখন অলোক জেনেছিল তার ভাগে নাকি অনেক বেশি টাকা পড়ার কথা এবং বড়ভাই সবার অংশের টাকা শকুনের মতো খামচি দিয়ে কেড়ে খেতে চাইছে, তাই তাদের সবার উচিত একজোট হয়ে বড়ভাইয়ের এই প্রতারণা প্রতিহত করা। কিন্তু দিনকয়েকের মধ্যে বড়ভাই বোনদের ম্যানেজ করে ফেলতে পারায় কেউ আর অলোকের ভাগের টাকার যাথার্থ্য নিয়ে মাথা ঘামায়নি। অলোকের নিজের তো সে অবকাশই ছিল না। ফলে যা পাওয়া গেল তা-ই সই। তো অলোক সেই টাকা দিয়ে বানিয়েছে মুদির দোকান। দড়িখড়বোনা রেলক্রসিং-এর কাছে। সেই দোকানও চালায় তার দূরসম্পর্কের ভাই মান্নান। তার বেতন একটা ধার্য করা আছে বটে। কিন্তু হাবে-ভাবে সে-ই মালিক। বুঝতে পেরেও রা কাড়ে না অলোক। দরকারটাই বা কী! মান্নান চালাচ্ছে চালাক। বুড়িছোঁয়ার মতো করে চব্বিশ ঘণ্টায় বারদুয়েক বসে অলোক। তাহলে পরিস্থিতি দাঁড়াল কী? সে তাহলে আসলে কী? নেহায়েত এক মুদি দোকানি। এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এতদিন ছিল না। যতদিন তার সঙ্গীরা ছিল, যতদিন তাদের আড্ডা নামক পাঠচক্র ছিল, যতদিন পেশাকে বাদ দিয়েও অন্যকিছু ভাবার অবকাশ ছিল, কোনো না কোনো সৃজনশীল কাজের সঙ্গে সংযুক্তি ছিল, ততদিন কেউ নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তিক কাজের ধরন নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কিন্তু এখন! এখন তাহলে অলোক নেহায়েতই এক মুদি দোকানি। তার রোজকার রুটিন হবে সকালে উঠে দোকান খুলে ক্যাশবাক্সে আগরবাতি গুঁজে দেওয়া, আধা কেজি আটা কি আড়াইশো চিনি কি এক প্যাকেট লবণ কি আধা লিটার কেরোসিন তেল কি বিড়ি-সিগারেট দিয়ে খদ্দেরের কাছ থেকে পয়সা বুঝে নেওয়া, কিংবা মাসকাবারি বাকির খাতায় লিখে রাখা, ফাঁকে ফাঁকে ময়েনুদ্দির দোকান থেকে হাঁক দিয়ে চা আনিয়ে সুরুৎ সুরুৎ খাওয়া, খদ্দের না থাকলে বসে বসে পেপার পড়া। কুণ্ডুদের জীবন নিয়ে যেসব হাসি-তামাশা তারা করেছে, সেগুলি সবই এখন অলোকের জীবনে ঘটতে থাকবে। একটা দিনের কথা মনে পড়তে নিজে নিজেই শিউড়ে ওঠে অলোক। সেদিন ছিল বিরোধী দলের ডাকে অর্ধদিবস হরতাল। সকাল এগারোটার দিকে আড্ডার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে অলোক। বাজারে সারি সারি বন্ধ দোকান, এখানে-ওখানে মিছিল-পিকেটিং। চোত মাসের রোদে বেশিক্ষণ সূর্যের নিচে দাঁড়োনো যায় না বলে পিকেটাররাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছায়ার নিচে নিচে। আর তখন অলোক দেখতে পায় কুণ্ডুদের তিন ভাইকে। নিজেদের বন্ধ দোকানের সামনে রোদের মধ্যেই বেঞ্চি পেতে বসে আছে। ছোট জন স্কুলে পড়ত অলোকের সাথে। তাদের এই অবস্থায় দেখে অলোক জানতে চাইল ব্যাপারটা কী? তোরা এই রোদের মধ্যে বসে আছিস কেন? উত্তরে সে বলল হরতাল শেষ হলে দোকান খোলার জন্য তারা বসে আছে। হরতাল শেষ হতে তখনো বেশ কয়েক ঘণ্টা বাকি। এতক্ষণ এখানে বসে না থেকে অন্যকিছু করলেই তো হয়। কিন্তু নির্বিকার সুরে সে যা বলল, তার সোজা-সাপ্টা অর্থ হচ্ছে, অন্য কিছু করা যায় কিনা তা তারা ভাবে না। রুহুল ভাই কোনো কিছুতেই অবাক হয় না। তার মতামত, এরকমই তো হবার কথা। ওরা জীবনকে এইভাবে ছকে নিয়েছে। এখন চাইলেও এই বৃত্ত ছেড়ে বেরুতে পারবে না। ওদের বাড়তি একটা ছুটির দিন কাটানোর আলাদা কোনো পরিকল্পনা তারা এখনো করে উঠতে পারেনি। তাই চেনা রুটিনের খোঁজেই বসে আছে। অলোক মেনে নিতে দ্বিধা করে — তাই বলে রোদের মধ্যে এসে বসে থাকবে হরতাল কখন শেষ হবে তার অপেক্ষায়! ওরা তো বউ-বাচ্চাকে আজ একটু বেশি সময় দিতে পারত, কিংবা অন্য কিছু করার না থাকলে টিভিতে চোখ রেখে বিছানাতে গড়াগড়ি দিতে পারত। রুহুল ভাই তারও জবাব দিতে পারে। ওরা পারবে না অন্য কোনো রকমভাবে ভাবতে। আসলে কেউ-ই পারে না। মানুষ তার আচরণ নির্ধারণ করে নেয় শ্রেণী অনুসারে, পেশা অনুসারে, জীবনযাপনের ধরন অনুসারে। তুই যদি কারো সম্পর্কে এই তথ্যগুলি জানতে পারিস, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলে দিতে পারবি কোন পরিস্থিতিতে সে কেমন আচরণ করবে। তবুও অলোকের সেদিন অনেকটা সময় লেগেছিল স্বাভাবিক হতে। একটা মানুষ নিজের দোকান এবং বাড়ি ছাড়া আর কিছু জানে না, হরতালের মতো একটা হঠাৎ কর্মহীনতার দিনে আর কী করবে খুঁজে পায় না! এমনও সম্ভব! আর আজ সেই রকম জীবনই বেছে নিতে হচ্ছে অলোককে।

তা সেই টিপিক্যাল জীবনেই যদি সেঁধোতে হয়, তাহলে বছরবিয়ানো একটা বউ-ই বা বাকি থাকে কেন! সেক্স জিনিসটিকেও তো তুষ্ট রাখতে হবে। সেক্স তার কাছে মনে হয় ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো একটা জিনিস। ঘুমিয়ে আছে তো আছে। ভালোই আছে। কিন্তু হঠাৎ কোনো নোটিশ না দিয়ে যখন জেগে ওঠে, তখন সেই আগুন সারা দেহে বয়ে বেড়ানো যে কী কষ্টের! তাকে সন্তুষ্ট করার আগ পর্যন্ত তখন শিল্প মিথ্যে, নন্দনতত্ত্ব মিথ্যে, দর্শন মিথ্যে, ভদ্রলোকিও প্রায় মিথ্যে। চাপা দিতে গিয়ে অবদমনের কষ্ট সইতে সইতে মর্ষকামী হয়ে পড়তে হয়। এই দেশে বিয়ে ছাড়া যৌনজীবন অসম্ভব কষ্ট এবং ঝুঁকির ব্যাপার। সেটাও আবার সময়মতো পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দেখা যাবে যখন চাহিদা সবচেয়ে বেশি তখনই কোনো সুযোগ নেই। আবার সুযোগ যখন জুটল, দেখা গেল ডাক পড়েছে অন্য জায়গা থেকে। সে-ও তো সম্ভব হয় এই মাহেলা মেয়েটা জুটে গিয়েছিল বলে।

খলিল চোরের অন্য কোনো পদবীর কথা তারা শোনেনি কোনোদিন। আগেকার দিনে নাকি গ্রামে-শহরে এই রকম পেশাদার চোর থাকত একজন-দুইজন করে। লোকে তাদের নামের সঙ্গে চোর পদবী জুড়ে দিয়ে ডাকতে ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ত। তারাও সেই পদবী শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ত। সেই খলিল চোরের ব্যাটা দুলু বোধহয় স্কুলে পড়েছিল কিছুদিন অলোকদের সাথে। বোধহয় বলতে হচ্ছে কারণ, দুলুদের মতো ছেলেরা স্কুলে বেশিদিন পড়ে না। আসলে পড়তে পারে না। কিছুদিন স্কুলে যায়, কিন্তু পড়াশোনার লাইনটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না, বাড়িতে পড়ার কোনো পরিবেশ নেই স্কুলে যেতে বলা ছাড়া, টুকটাক পড়া দেখিয়ে দেবার মতো কেউ নেই কারণ জীবিত পূর্বপুরুষরা কেউ অক্ষর চেনে না, ফলে স্কুলে নিয়মিত মাস্টারকর্তৃক বেতানো, এবং অচিরেই স্কুল থেকে ঝরে পরা। তবে একই পাড়ায় বাড়ি। এটুকু পরিষ্কার যে দুলু বয়সে তাদেরই সমসাময়িক। সেই দুলুর মেয়ে মাহেলা সদাই নিতে আসে দুলুর দোকানে। দুলু যদি কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে করে থাকে, আর মাহেলা যদি তার প্রথম সন্তান হয়ে থাকে, তাহলে তার বয়সও এখন কুড়ির এদিক-ওদিক। গায়েগতরেও যথেষ্ট বড়। মান্নান মাঝে মাঝে ‘মালিকের হুকুম ছাড়া বাক দেওয়া নিষেধ’ বলায় দোকানের কোণে মালিক অলোকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত মাহেলা। সমবয়সী এককালের সহপাঠী দুলুর মেয়েকে বাকি তো কিছু দিতেই হবে। দুলু সময়মতো কিছুটা শোধ দিতে পারে, কিছুটা পারে না। তারপর অলোককে যখন আলাদা করে দেওয়া হলো, মা কিছুদিন রেঁধে দেয়, কোনোবেলা হোটেলে খাওয়া হয়, কোনোবেলা নিজে খিঁচুড়ি কিংবা ভাত-আলুভর্তা ফুটিয়ে খাওয়া হয়, তখন দুলুর বউ দুইবেলা রান্নার দায়িত্ব নিয়ে অলোকের সমস্যার সমাধান করল, সেইসাথে নিজের সংসারের সাশ্রয়ের ব্যাপারও কিছুটা রইল। মাসকয়েকের মধ্যে দুলুর বউয়ের কামাই শুরু হওয়া, নিজের আসতে থাকা কমে যাওয়া এবং তার বদলে মাহেলার সেই বেলার মতো দায়িত্বপালন চলতে চলতে একসময় মাহেলাই পুরোপুরি নিযুক্তি নিয়ে নেয়। শুধু রান্নাই নয়, আরো বেশকিছু দেখাশোনা সে করতে থাকে অলোকের। বয়স চল্লিশ ছাড়ালে মানুষ বুঝুক না বুঝুক, তার শরীরের অনেক কলকব্জা আর আগের মতো নিয়ম মেনে চলতে পারে না। মাথাধরা, অম্বল, অল্পস্বল্প জ্বর-জারি, হাত-পায়ের গাঁটে গাঁটে ব্যথা-বেদনা — এসব নিত্য ভোগা তখন দস্তুর হয়ে দাঁড়ায়। চিরকালের অশক্ত অলোকের তো বেশি বেশি হয় এসব। তাকে কাতড়াতে দেখলে মমতাপরবশ এগিয়ে আসা মাহেলা ও অলোকের মধ্যে এক কাকডাকা খাঁ খাঁ রোদ্দুরের নিচে পুড়তে থাকা দুপুরে ঘটে যায় ব্যাপারটা।

উত্তেজনা নিভে যাওয়ার পরে মাহেলাকে বিদায় করে দিয়ে নিজের প্রতি ঘৃণায় এবং আত্মধিক্কারে ঘরের দরজা বন্ধ করে কেঁদেছিল পর্যন্ত অলোক। নিজের শিক্ষার অহঙ্কার, সংস্কৃতিবানতার অহঙ্কার, উঁচু রুচির অহঙ্কার এক ফুঁয়ে নিভে যেতে দেখে সে নিজেই হতবাক হয়ে পড়েছিল। মাহেলার যে ক্ষতি সে করে ফেলেছে, তার প্রায়শ্চিত্ত চুকানোর জন্য সারাদিন ধরে ভাবল নানান পথের কথা। একবার এই সন্দেহও মনে এলো যে ক্ষতিপূরণের আদৌ কোনো সুযোগ মাহেলা তাকে দেবে কিনা। কেননা এই ঘটনার পরে মাহেলা আর হয়তো তার সামনে কখনোই আসবে না।

কিন্তু পরের বেলাতেই দেখা গেল মাহেলা ঠিক ঠিক রান্না করতে চলে এসেছে। অলোক তাকাতে পারছিল না তার দিকে। কিন্তু মাহেলার মধ্যে কোনো জড়তা তো নেই-ই, বরং তার আচরণে অনেকটা ফুরফুরে ভাব। রুহুল ভাইকে জিজ্ঞেস করলে এই আচরণেরও নিখুঁত ব্যাখ্যা পাওয়া যেত নিশ্চয়ই। কিন্তু এমন ঘটনার কথা কাউকে বলা সম্ভব হয়নি অলোকের পক্ষে। বরং সে প্রতিজ্ঞা করল নিজের কাছে যে একবার যা ঘটেছে, তার আর পুনরাবৃত্তি হবে না কোনোদিন। কিন্তু সেটাও রক্ষা করা সম্ভব হয়নি অনিবার্য কারণেই। এবং ঘটনা ঘটে চলেছে মাঝে মাঝে সময়-সুযোগ এবং অলোকের চাহিদা বুঝে।

অলোক বিয়েতে রাজি হয়েছে জানামাত্রই যেন পুরো পরিবার আবার একত্রিত হয়ে পড়ে। তার মা, তার দুই ভাবি, তার বোনেরা, এমনকী তার কলেজ-ভার্সিটিপড়–য়া ভাতিজিরা পর্যন্ত একটা কাজের মতো কাজ পাওয়া গেছে ভাব করে কোমড় বেঁধে নেমে পড়ে পাত্রী খুঁজতে। মেয়ের খোঁজ আসতে থাকে রোজ। কোনোদিন আসে একাধিক মেয়ের খোঁজ। জুড়ি মেলানোর আলোচনা চলে অবিরাম। সবার চাইতে এগিয়ে যায় পাবনায় থাকা মেজোবোন। সে নাকি এমন পাত্রী প্রায় ঠিক করে ফেলেছে যাকে অপছন্দ করতে পারবে না কেউ। তাছাড়া বয়স মিলিয়ে জুটি হিসাবে এর চাইতে ভালো আর হতেই পারে না কিছু। অতএব দেরি না করে সবাই চলে এসো পাত্রী দেখতে এবং কথা পাকাপাকি করতে। মোবাইল বাজে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে খুঁটিনাটি সব জানাতে থাকে মেজোবোন। দেরি কেন, কালই পাবনায় চলে আসুক না সবাই! ভাবি-ভাতিজিরা অলোককে জানাতে বসলে সে কিছুটা শোনে, কিছুটা শোনে না। বলে দেয় — তোমরা যা করবে তাই হবে। যাকে বিয়ে করতে বলবে, করব। শুধু একটাই অনুরোধ, মেয়েপক্ষের কাছে আমার কোনো কথা গোপন করো না। মানে আমার অযোগ্যতার কথা সব জানিয়ে দিয়ো। সব শুনে কোনো মেয়ে যদি নিজের কপাল পোড়াতে রাজি হয়, মানে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়, আমার আপত্তি করার কিছু নেই।

ভাবিরা কলকলিয়ে ওঠে — বাদ দে তো অমনধারা কথা। যে মেয়ে তোকে স্বামী হিসাবে পাবে, তার কপাল ভালো বলতে হবে। আমরা কি জানি না তোর মনটা কত ভালো? আর যার মন ভালো, তার সবকিছুই ভালো।

ভাবিদের আশ্বাসে মন দিতে পারে না অলোক। তার মাথা থেকে কিছুতেই সরতে চায় না রুহুল ভাইয়ের জ্যামিতি। একটা বৃত্ত, আর একটা এলোমেলো ছুটে চলা রেখা। বিড়বিড় করে অলোক — কীভাবে সম্ভব হয়! কীভাবে হয়! অথচ সেটাই ঘটে গেছে প্রায় প্রত্যেকের জীবনে!

তারপরে আছে অ্যাডজাস্টমেন্টের কথা। পারস্পরিক অভিযোজন। একদিন দুইদিন নয়, বাকি পুরোটা জীবন একসাথে থাকার ব্যাপার। নিজেকে পুরোপুরি না বুঝলেও অলোক অন্তত এটুকু বোঝে যে তার মধ্যে বেহিসাবি একটা ছেলেমানুষ রয়ে গেছে, দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকতে গেলে যার সঙ্গ বেশিরভাগ মানুষের কাছেই বিরক্তিকর ঠেকবে। একই ঘটনা ঘটে অলোকের ক্ষেত্রেও। অল্প কিছু মানুষ ছাড়া বাকিদের সঙ্গ তার কাছে খুবই বিরক্তিকর। যে ভয়ে এতদিন প্রেম-বিয়ে কিছুই করা হয়ে ওঠেনি, শেষ পর্যন্ত যদি সেটাই ঘটে! এমনিতেই তার নিজের কাছে এখনকার জীবন নেহায়েত বস্তি বা রাস্তার জীবনের সমতুল্য, সেই জীবনে যদি ভুল মেয়ের পদার্পণ ঘটে তাহলে তো জীবন পুরোপুরি নরক হয়ে উঠবে। তখন জীবনানন্দের ‘মরিবার হলো তার সাধ’ ছাড়া আর কোনো পথই থাকবে না। এদিকে আবার বাড়িতে বিয়ের সম্মতি জানানো হয়ে গেছে। বিয়েটাও করতেই হবে। তাহলে কী উপায়? উপায়সন্ধানে পাগলের মতো মনের দশদিক হাতড়ায় অলোক। তখনই চোখে পড়ে মাহেলাকে।

দরজার পাল্লা ঠেলে উঠোনে ঢুকছে মাহেলা। এই প্রথম তার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় অলোক। আরে, এ তো যথেষ্ট সুশ্রী! সুশ্রী, তন্বী এবং পরিচ্ছন্ন। এতদিন মাহেলার সঙ্গে শুয়েছে বটে অলোক, কিন্তু তা ছিল নেহায়েত তাড়নার মিলন। শেষ হতেই ঘর থেকে তখনকার মতো বিদায় করে হাঁফ ছেড়েছে। নিজের চাহিদা মিটলেই হলো। এর বেশি কোনোদিন এক সেকেন্ডও ভাবেনি অলোক। যেন তার ও মাহেলার মতো দুই শ্রেণীর দুইজন নরনারীর পারস্পরিক আচরণ এই রকমই হওয়ার কথা। এখন, এই মুহূর্তে অলোকের মনে হয়, আরে এই তো সেই মেয়ে যে তার সব কথা নির্বিবাদে মেনে চলে, এবং চলবে সারাজীবন! মনস্থির করে ফেলে অলোক। ডাকে — মাহেলা এদিকে আয়!

অলোকের বসে থাকা চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়ায় মাহেলা। তার চোখের সাথে দৃষ্টি একবার মিশিয়েই ফের নিচু করে ফেলে মুখ। শোনা যায় কি যায় না এমনভাবে বলে — কহেন।

এর মধ্যেই দেখে ফেলেছে অলোক, মেয়েটার চোখে বিষণ্ণতা। কিছুটা সজলাভাও কি!

গলা খাঁকারি দেয় অলোক — শুনেছিস বোধহয়, বাড়ির সবাই… মানে আমার বিয়ে আর কী!

কথাও বলে না, মাথাও নাড়ায় না মাহেলা। আবারও এক পলক তার চোখে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফের।

এবার আর একটু জোরে, বেশি সময় ধরে খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে অলোক — আমি যদি তোকে বিয়ে করতে চাই, আপত্তি আছে তোর?

জিজ্ঞেস করে বটে, কিন্তু অলোক নিশ্চিত জানে যে মাহেলা আপত্তি তো করবেই না, তার বাপ-মায়েরও কোনো আপত্তি থাকবে না। বরং তারা হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো বর্তে যাবে।

মাহেলা চোখ তুলে তাকিয়েছে। তার চোখে অবিশ্বাস। নিজের ধারণা সত্যি হতে দেখে ভেতরে একটু পুলক জাগে অলোকের। উদার আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে হাসে মাহেলার দিকে তাকিয়ে — না, ঠাট্টা নয়, আমি সত্যি সত্যি তোর মত জানতে চাইছি।

দৃষ্টি আবার নত হয়ে গেছে মাহেলার। এটাই কি তার সম্মতির চিহ্ন? তবে সঙ্গে দুইটি শব্দও শুনতে পাওয়া যায় — আব্বাকে কহেন।

সে না হয় বলা যাবে। কিন্তু এদিকে একটা সমস্যা আছে বুঝলি। সমস্যা আছে অন্য জায়গায়।

মাহেলা যথারীতি জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকায়।

মানে বুঝলি কিনা, মানে দুই বাড়ির সম্মতি, মানে কথা চালাচালির মাধ্যমে কাজটা করা যাবে না। মানে কাজটা সেভাবে হবে না। বুঝিসই তো আমার বাড়ির লোক রাজি হবে না। মানে আমাদের ক্লাস তো ঠিক এক না।

ক্লাস না বুঝলেও মাথা দোলায় মাহেলা। এটুকু সে বোঝে যে তাকে বিয়ে করতে স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সম্মতি পাবে না অলোক।

তাহলে?

তখন তখনই মাহেলার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সিগারেট ধরায় অলোক। গাল ফুলিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলে — একটু কায়দা করতে হবে বুঝলি! মানে নরমাল পথে তো হবে না। তাই একটু কায়দা করতে হবে।

কী?

তুই রাজি কিনা আগে বল।

তড়িঘড়ি মাথা ঝাঁকায় মাহেলা। হ্যাঁ।

তাহলে প্ল্যানটা বলি শোন। ধর কাল দুপুরেই ঘটনাটা ঘটানো যায়। তোদের বাড়ির পাশে তো চেনাজানা বখাটে ছোঁড়া-টোঁরা আছে তাই না?

ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না মাহেলা। তবে উত্তর দেয় — আছে।

তাহলে কাল দুপুরেই করে ফেলব আমরা কাজটা। ধর তোকে নিয়ে আমি ঘরের দরজা আটকালাম। তুই আগে থেকে বলে রাখবি। ছোঁড়ারা এসে ঘিরে ফেলবে ঘর। মানে আমাদের ধরে ফেরবে হাতে-নাতে। তারপর একটু হইচই করবে। পাড়ার লোক আসবে। মানে, তুই আর আমি, ধর একটা কেলেঙ্কারি করতে গিয়ে ধরা পড়লাম আর কী। তখন ওরাই নওশের কাজিকে ডেকে এনে বিয়েটা পড়িয়ে দিল। তখন তাহলে আর আমার বাড়ির লোকেরও বলার কিছু থাকবে না। তুই কী বলিস?

না!

যেন ঠিকমতো শুনতে পায়নি, এতই অবিশ্বাস্য ঠেকেছে উত্তরটা অলোকের কাছে। কী বললি!

না!

না কেন শুনি? এভাবে না ঢুকলে তুই কীভাবে এবাড়িতে বউ… মানে ঢুকবি?

না।

যে মেয়ে তার মাতলামির বমি পরিষ্কার করতে না করে না, তার নোংরা অন্ডারগার্মেন্ট ধুতে না করে না, তার নেহায়েত জৈবিক কাম চরিতার্থ করতে চাইলে না করে না, সেই মেয়েরও যে আত্মসম্মান বলতে কোনো জিনিস থাকতে পারে, এই রকম ক্লাসের মেয়ের, তা একবারও মাথায় আসেনি ক্রিয়েটিভদের সঙ্গে বছরের পর বছর কাটানো অলোকের। তাই মাহেলার এখনকার আচরণটা তার হিসাবের সাথে একেবারেই মেলে না। সে তাই আবারও মাহেলাকে বোঝানোর জন্য উদ্যোগী হয় — আরে অসুবিধাটা কোথায়? হ্যাঁ, পাড়ার লোকে নাহয় জানবে তোর-আমার কেলেঙ্কারির কথা। কিন্তু তুই কি ভেবেছিস এখনো পাড়ার লোকে ঘুসঘুস করে না তোকে-আমাকে নিয়ে? তাছাড়া বিয়েটা হয়ে গেলে কেলেঙ্কারির কথা কে আর মনে রাখতে যাবে!

অলোক সবিস্মযে খেয়াল করে, তার কথা পুরোপুরি শোনার জন্য অপেক্ষা পর্যন্ত করেনি মাহেলা। বারান্দা থেকে নেমে উঠোন পেরিয়ে প্রায় পৌঁছে গেছে দরজার কাছে। অলোক ভেবেছিল দরজা পেরোনোর আগে একবার অন্তত ফিরে তাকাবে মেয়েটা। কিন্তু তার এই ধারণাটিও ভুল। একবারও না তাকিয়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল মাহেলা।

আর অলোক, কিছুক্ষণ আগে তার নিজের বলা কথাগুলির জন্য, নিজের করা আচরণের জন্য লজ্জিত যতখানি হয়, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আশ্বস্ত হয় তার চেয়েও বেশি — নাহ মানুষ এখনো অতোটা নীচে নেমে যায়নি!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “short-story-tobuo-manob-theke-jay

  1. অপূর্ব! মনের কতটা গভীরে গেলে এমন লেখা সম্ভব তাই ভাবছি। জীবনানন্দের পঙক্তির ব্যবহারও অনবদ্য। ❤

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *