short-story-trisiminar-paharadar

ত্রিসীমানার পাহারাদার
অনুষ্টুপ শেঠ


ঘরে ঢুকেই পিঠের ব্যাগ, গলার ক্যামেরা, মাথার টুপি সব ধপাধপ ছোট্ট দুজন বসার মতো সোফাটায় ফেলে দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকল পাপিয়া। সারাদিন ধরে ঘুরেছে, এবার একটু গরম জলে আচ্ছাসে সাফ না হলে আর চলছে না!

সকালে বেরোনোর তাড়ায় স্নান হয়নি। এই এতক্ষণ লেগে যাবে সেটাও বোঝেনি। ভেবেছিল ভারি তো তিনটে পয়েন্ট, ফটাফট সেরে এসে স্নান করে এখানের বাহারি ডাইনিং রুমে বসে আয়েস করে লাঞ্চ করবে। কিন্তু পাহাড়ি জায়গায় যে যেকোনো সময়েই সময়ের হিসেব গুলিয়ে যায়, সেটা এতবার দেখা সত্ত্বেও খেয়াল হয়নি।

তাছাড়া, পুরোনো মঠটা হিসেবে ছিলও না!

তবে দেরি হয়েছে বলে আফসোস কিছুমাত্র নেই পাপিয়ার। এমন চুটিয়ে ঘুরেছে যে মন কানায় কানায় ভরে আছে। প্ল্যান অনুযায়ী সকালে রিসেপশন ডেস্কে বসা মহিলার দেখিয়ে দেওয়া শর্টকাট রাস্তা ধরে পাহাড়ের অন্য পিঠে গিয়ে পৌঁছেছে সে। গাছে ঢাকা, উঁচুনিচু, সরু পায়েচলা পথটা অপূর্ব! প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগেছে তার আবার বড়ো রাস্তায় এসে পড়তে – তার মধ্যে একজন মাত্র মানুষের মুখ দেখেছে, স্থানীয় এক বয়স্ক মানুষ বড়ো দুধের পাত্র নিয়ে হনহন করে উলটো দিক থেকে এসে তাকে পেরিয়ে চলে গেলেন। যেন পাহাড়ি সুঁড়িপথ তো না, পরিষ্কার জগিং ট্র্যাকে হাঁটছেন! এছাড়া সারা পথ সে একাই… এক যদি না পথের আশপাশে চরা গরুগুলোকে হিসেবে ধরা হয়!

রাস্তায় নেমে, বলতে কী, হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল পাপিয়া। সে এমনিতে যথেষ্ট ফিট, কিন্তু ওই নুড়ি গড়গড়ে রাস্তায় পা টিপে টিপে নামা ভারি ভজকট ব্যাপার! তায় আবার জায়গায় জায়গায় গোবর ছড়ানো!

তারপর যেমন বলে দিয়েছিলেন মহিলা, ডানদিকে খানিক গিয়েই ছোট্ট মিউজিয়ামটা, এক প্রায় ঘুমন্ত পাহারাদার ছাড়া কোথাও কেউ নেই তাতে। কাচের মোড়কে স্থানীয় আদিবাসীদের খানিক বাসন, গয়না, অস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র আর অঞ্চলের একটা বড়োসড়ো ম্যাপ। ব্যস! মিনিট কুড়ির মধ্যেই দেখা শেষ।

তারপর একটা ভিউপয়েন্ট—সে এমনই এক পয়েন্ট, যেটা পাপিয়া হয়তো আলাদা করে লক্ষই করত না! নেহাৎ ওই একগাড়ি ট্যুরিস্ট উলটো দিক থেকে এসে ঘ্যাঁচ করে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল, তাই! আসলে পুরো রাস্তাটা থেকেই তো অমন ভিউ সে দেখতে দেখতে নেমেছে, ছবিও তুলেছে গুচ্ছের!

তারপর দিনের সবচেয়ে বড়ো পয়েন্টটা। এখানের নামকরা বৌদ্ধ মঠ। সেটা সত্যিই যেমন সুন্দর জায়গায়, তেমনি জমকালো। দেওয়াল জোড়া কী অপূর্ব সব হাতে আঁকা ছবি! ঝুলন্ত থাঙ্কা, বিশাল সব ঢাকের মতো বাজনা, সোনার মতো ঝকঝকে পিতলের বুদ্ধমূর্তি। ঘুরে ঘুরে দুচোখ ভরে দেখছিল পাপিয়া। না, একা না, সঙ্গে ওখানকার লামা ছিলেন।

বয়স্ক। গাঁট্টাগোঁট্টা শক্তিশালী চেহারা। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। মুখ দেখে মনে হচ্ছে সারাক্ষণ হাসছেন।

ওকে দেখেই, গলায় ঝোলা ক্যামেরার দিকে ইশারা করে বললেন, “ফোটো নট অ্যালাওড!”

পাপিয়া তাড়াতাড়ি আশ্বস্ত করল, এই নিয়ম ও জানে এবং মানে, ভিতরে কোনো ছবি তোলেনি। লামা খুশি হলেন শুনে।

গল্প জমে উঠেছিল। মঠের সামনের উঠোন মতো জায়গার ধারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ওরা। সামনে বিশাল উপত্যকা ধাপে ধাপে নেমে গেছে।

আঙুল তুলে সেই উপত্যকার একদিকে দেখিয়ে লামা বলেছিলেন, “আদি মঠটা ওইখানে… জায়গায় কুলোচ্ছিল না বলে এটা বানানো শুরু হয়েছিল।”

সেদিকে চেয়ে আনমনে বলে ফেলেছিল পাপিয়া, “ইশ! দেখা হল না! আগে জানলে আসার দিন গাড়িতে করেই দেখে আসতাম!”

লামা ওর দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললেন, “সে আর এমন কী কথা? চলে গেলেই হয়! দিব্যি আলো আছে, আরামসে হয়ে যাবে। আজ পুজোও আছে, ভালো দিন। চলে যান!”

পাপিয়া হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। পাহাড়ি লোকেরা দিনে দিনে বিশাল দূরত্ব পায়ে হেঁটে পার করে ফেলতে পারে ও জানে, তাই বলে ও এখন চার কিলোমিটার হেঁটে যাবে, ফিরবে… সম্ভব!

কিন্তু সম্ভব হয়ে গেল। সে এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। লামা ওকে রাস্তার পিছনদিকের এমন একটা শর্টকাট সিঁড়ি দেখিয়ে দিলেন… আধঘন্টায় পুরোনো মঠে পৌঁছে নিজেই অবাক হয়ে গেছিল সে। ফেরার পথে ওই স্বর্গের সিঁড়ি মার্কা চড়াই উঠতে অবশ্য প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেল… সব মিলিয়ে দেরিও হল, লাঞ্চটাও বাদ চলে গেল।

যাক গে! ওর মন খুশি, ব্যস!

এইসব ভাবতে ভাবতেই ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল পাপিয়া। এইবার দরকার একটা কড়া করে কফি আর কিছু খাদ্য। খাটের পাশের ফোনটা তুলে বলতে যাবে রুম সার্ভিসের জন্য, হুট করে ঘরের আলোটা দপদপ করে নিভে গেল।

একই সঙ্গে মনে হল, ওর খুব কাছেই কেউ যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

পাপিয়া শক্ত মেয়ে, ভয়ডর কম। একা একা ঘোরে এমনি নাকি! কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ওর ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেল।

তারপরই আলোটা আবার জ্বলে উঠল, খুব মিটমিট করে। সেইসঙ্গে বাইরে থেকে আসা গোঁ গোঁ আওয়াজটা বুঝিয়ে দিল, জেনারেটর চালু হয়েছে।

ভাগ্যিস স্নানটা হয়ে গেছে!

ফোনটা আবার কানে লাগাল পাপিয়া। অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে একটা।

বার কয় চেষ্টা করেও ডায়ালটোন এল না। দুত্তোর! মোবাইল থেকে কল করল সে, বাজছে।

বেজে বেজে থেমে যেতে ভারি বিরক্ত হয়ে পাপিয়া আবার জ্যাকেটটা গলিয়ে বেরোল ডাইনিং-এর উদ্দেশে।

সেখানে গিয়ে অবশ্য রাগটা উবে গেল তার। একে তো ওই মিটমিটে আলোয় ভূতের মতো বসে একা একা কফি খেতে একটুও ভালো লাগত না, এখানে সোলার লাইট, বেশ কিছু লোক হইহল্লা করছে। তায় সোনু বলে রিসেপশনের ছেলেটাকে অসুবিধের কথা বলতেই বার বার ক্ষমা চেয়ে নিল। আজ কাজের লোক কম আছে তাই ও এদিকে হাত লাগিয়েছে, রিসেপশনে থাকতে পারছে না।

আজকের দিনটায় কীসব নাকি আছে, স্থানীয় মতে। কী ভালো বুঝল না পাপিয়া। আদি মঠেও এক লামা এরকম কী যেন বলছিলেন। ভাষার সমস্যায় ধরতে পারেনি সে।

“কী আছে বলো তো?”

“এক লামার মৃত্যুদিন, ম্যাডাম। খুব বড়ো লামা ছিলেন। দয়ালু আর শক্তিশালী। মঠ আগলে রাখতেন বুক দিয়ে। তো এই দিনে, কোথা থেকে ডাকুর দল এসে চড়াও হল মঠে। দামি জিনিস কম? এখানকার লোক না। এখানকার লোক মঠের অসম্মান করবে না। বাইরের দল।”

“তারপর?”

“তারপর ম্যাডাম খুব লড়লেন। কিন্তু ডাকাতদের সঙ্গে পারলেন না। মেরে ফেলল। তবে বাঁচতে পারল না, সব পালানোর পথে খাদে পড়ে মরে গেল। জিনিস কিচ্ছু খোয়া যায়নি, সব পাওয়া গেছিল।”

“আচ্ছা! আজ সেই জন্য অত পুজো হচ্ছিল মঠে?”

“পুরোনো মঠ গেছিলেন ম্যাডাম? হ্যাঁ, ওখানে আজ পুজো হয়। সারাদিন। মূর্তিও আছে ওখানে, দেখেছেন না?”

দেখেছে পাপিয়া, মনে পড়ল। পুরোনো মঠের দোতলায়, বুদ্ধমূর্তির পাশের দেওয়ালের মাঝামাঝি, এক বসে থাকা লামার মূর্তি আছে বটে। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি তখন, কেউ ছিল না বলে। ওটাই হবে।

“ও লামা এখনও আছেন, ম্যাডাম। এখনও মঠকে আগলে রাখেন! ও মঠের ক্ষতি করে ত্রিসীমানায় কেউ পার পাবে না, হ্যাঁ! উনি পাহারা দিচ্ছেন।”

উফ্‌! পাহাড়ে কত রকমের যে বিশ্বাস!

মোমো আর দুবার করে কফি খেয়ে, ওখানেই বসে বসে ছবিগুলো খানিক এডিট করে সময় কাটিয়ে একেবারে ডিনার সেরে ফিরল পাপিয়া।

কারেন্ট আসেনি, আজ আর আসবে বলে মনে হচ্ছে না! কাল চেক আউট করবে। ব্যাগ মোটামুটি গুছিয়ে রেখে রাত্রে শুতে যখন গেল, মনটা একটু বাড়তিই উৎফুল্ল তার।

ঘুমটা গভীর হয়ে এসেছিল। স্বপ্ন দেখার পর্যায় পেরিয়ে সেই গভীর নিঃস্পন্দ ঘুমের দিকে ভেসে যাচ্ছিল পাপিয়া। ঠোঁটের কোণের মৃদু হাসির রেশ লেগে ছিল স্বপ্নের শেষ গুঁড়ো হিসেবে।

পাশ ফিরতেই সে নিশ্চিন্ত ঘুম ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। আঁতকে উঠে বসল পাপিয়া, গলা দিয়ে বোবাধরা আওয়াজ বেরিয়ে এল একটা।

নিঃস্তব্দ ঘর, যেমন ছিল তেমন। পর্দা পুরো টানেনি ইচ্ছে করেই, সে ফাঁক দিয়ে ক্ষীণ চাঁদের আলো এসে পড়েছে সোফাটায়। জ্যাকেটটা লটকে পড়ে আছে।

আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ফেলল সে। হাত বাড়িয়ে সন্তর্পণে ছুঁয়ে দেখল বিছানাটা।

যেমন হয়, বিছানা।

হাতের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে ছিল পাপিয়া।

কী হল ব্যাপারটা? একটু আগেই ওখানে তার হাত গিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মনে হয়েছিল, জমা জলের মধ্যে গিয়ে পড়ল।

বরফের মতো ঠাণ্ডা জল!

যেন … যেন…

দূর, কী আজেবাজে ভাবছে। ঘুমের ঘোরে কী না কী মনে হয়েছে। বিছানায় জল আসবে কোথা থেকে, আর এত তাড়াতাড়ি উবেই বা যাবে কেন!

আশ্চর্য, হাত এখনও ঠাণ্ডা হয়ে আছে!

এমনি, শীত করছে বলে নিশ্চয়। লেপটা ভালো করে মুড়ি দিয়ে আবার চোখ বুজল পাপিয়া।

এবার ঘুম ভাঙল হাওয়ার শব্দে। ঘরের চারটে কাঠের দেওয়ালের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে তাপমাত্রা নেমে গেছে আগের চেয়ে অনেকখানি নিচে।

পাপিয়া কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসল।

বসতেই বুঝল, কেন এমন হাওয়া বইছে। কাল ঘরে ঢুকে স্ট্যান্ড ফ্যানটা দেখে মুচকি হেসেছিল সে। নেহাত বাতিকগ্রস্ত না হলে এই ঠাণ্ডায় কারো পাখা লাগে না।

সে ফ্যানটা এখন টপ স্পিডে ঘুরছে। সাঁই সাঁই শব্দ হচ্ছে, পর্দাগুলো উড়ে উড়ে সরে যাচ্ছে, কাচের ওপারে মরা চাঁদের আলোয় সব যেন কালো কুচকুচে অপ্রাকৃত দেখাচ্ছে…

আহ্‌, জমে যাবে পাপিয়া এ জিনিস চলতে থাকলে। চোখে আঠার মতো ঘুম লেগে আছে, তবু হিঁচড়ে নিজেকে টেনে তুলল সে। কয়েক পা দূরত্ব পেরিয়ে ঝুঁকে পড়ল সুইচটার দিকে।

তারপর ওইভাবেই থমকে থেমে গেল। চোখ দুটো আস্তে আস্তে বড়ো হয়ে উঠতে লাগল তার।

সুইচ অফ করাই আছে। শুধু তাই নয়, প্লাগ পয়েন্টে প্লাগও লাগানো নেই।

ওই তো, খোলা প্লাগটা পাখার পিছনেই মাটিতে পড়ে আছে।

অথচ, পাখাটা ঘুরছে।

পাপিয়ার মাথাটাও ঘুরতে শুরু করেছিল।

এসব কী হচ্ছে তার সঙ্গে? এসব কেন…।

তবে কি…

তবে কি…

কি যেন বলছিল সোনু? ত্রিসীমানায় কেউ পার পায় না…

হাওয়াটা মুখে এসে লাগছিল সোজা। কিছু কি গন্ধ পেল পাপিয়া তার মধ্যে?

নেশা ধরানোর মতো, ঝিমঝিমে গন্ধ? ধূপ?

না না! ওসব মনের ভুল। ওর নিশ্চয় সারাদিনের ধকলে শরীর খারাপ হয়েছে। ভুল স্বপ্ন… হ্যাঁ স্বপ্নই হবে…

ওর চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে ঘর কেঁপে উঠল টেলিফোনের শব্দে।

‘ক্রিং ক্রিং ক্রিং… ক্রিং ক্রিং ক্রিং…’

আমূল কেঁপে উঠল পাপিয়া। এ শব্দ এখনকার ফোনে হয় না। ছোটোবেলায় ওর মামাবাড়ির ফোনটা অমন করে বাজত।

ইচ্ছের বিরুদ্ধেই পাপিয়ার পা দুটো ওকে টেনে নিয়ে গেল খাটের পাশে স্ট্যান্ডে রাখা ফোনের কাছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হাত বাড়িয়ে তুলে নিল রিসিভার।

কানে ঠেকানোরও আগে ও যেন জানত কী শুনবে। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রপাঠের আওয়াজ।

এ আওয়াজ ও আজই প্রথম শুনেছে, দুপুরে। অদ্ভুত টেনে টেনে বলা সুর। যেন আকাশ কাঁদছে, বাতাস কাঁদছে। সে সুর উঠছে ধাপে ধাপে, রিন রিন করে কেঁপে উঠছে বিনতির ভঙ্গিমায়।

মঠের অল্প কজন সন্ন্যাসী সবাই-ই যোগ দিয়েছেন এই উপাসনায়। সবাইকে সুরক্ষিত রাখার প্রার্থনা উচ্চারিত হচ্ছে ওই অজানা ভাষায়।

পাপিয়া যখন পুরোনো মঠে গিয়ে পৌঁছেছিল, তখন পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে এই পূজাপাঠ। মঠের সবাই-ই নিচে, হলে। সারি সারি, হাঁটু মুড়ে বসে। কেউ ওর দিকে তাকায়ওনি, একা একাই ঘুরে পিছনদিকে সিঁড়ি দেখে উঠে গেছিল পাপিয়া।

দোতলা খালি ছিল। দরজাও খোলা। শুধু…

এক বুড়ো শুকিয়ে যাওয়া চেহারার লামা নিচে যাচ্ছিলেন। উপরে এসেছিলেন কিছু নিতে মনে হয়।

ওকে দেখে এক পলক ইতস্তত করলেন। ভাঙা হিন্দিতে বললেন, ‘এখন তো বন্ধ। পরে আসুন।”

পাপিয়া কাকুতিভরা গলায় জানিয়েছিল, তার হাতে সময় নেই। চলে যাবে কালই। ফিরতেও হবে আজ অনেকটা।

উপরের নতুন মঠের লামাই যে তাকে পথ দেখিয়ে পাঠিয়েছেন, সেটাও বলেছিল।

হয়তো সে জন্যই, কথা আর বাড়াননি লামা।

‘ঠিক আছে। দেখুন নিজের মতো। ছবি তুলবেন না।”

তড়িঘড়ি নেমে গেছিলেন তিনি।

পাপিয়া ঘুরে ঘুরে দেখছিল। কত পুঁথি, হাতে লেখা। প্রদীপ। পিতলের অচেনা সব মূর্তি। ওই লামার মূর্তির সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল। পাহাড়ি ভাবলেশহীন মুখ, সামনে ধূপদানি। তার পাশে একটা তামার বাটিতে জল, তাতে অপূর্ব কারুকার্য করা ছোট্ট ছোট্ট রুপোর পদ্ম ভাসছে।

বরফের মতো ঠাণ্ডা সে জল।

পাপিয়া কাঁপছিল।

হুট করে ধূপের গন্ধটা আবার ভেসে এল ওর নাকে। সেই সঙ্গে দেখল, জানলার পর্দার উজ্জ্বল লাল আর সোনালী ড্রাগন ওর দিকে একাগ্র চোখে চেয়ে আছে।

ড্রাগন?!

একরঙা নীল পর্দা ছিল ঘরে। কোথায় ও এখন তবে? ঘরেই তো? ওই তো সোফা…

ওই তো স্ট্যান্ড ফ্যান, এখনও ঝড় তুলে যাচ্ছে…

এই যে ওর কানে ফোনের রিসিভার… মন্ত্রধ্বনি ভেসে আসছে সেখান থেকে।

ড্রাগনটা এবার ঘাড় ঘোরাল।

যন্ত্রের মতো ওর ঘাড়ও ঘুরে গেল।

ওর গুছিয়ে রাখা ব্যাকপ্যাকের দিকে প্রাণীটার ক্ষুধিত দৃষ্টি।

ঠাণ্ডা বাড়ছিল ঘরে। সেইসঙ্গে একটা অদ্ভুত অন্ধকার নেমে আসছিল ওর চোখের উপর। চাঁদ কি মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে?

না। ড্রাগনটা ডানা মেলে ধরেছে। পর্দা থেকে জানলার কাঠে নেমে এসেছে তার শরীর। ডানার ধাক্কায় ছিটকিনির তোয়াক্কা না করে কাচ খুলে গেছে। হু হু করে কুয়াশার মতো কিছু এসে ঢুকে পড়ছে ঘরে। ঢুকছে, কুণ্ডলী পাকাচ্ছে…

পাপিয়ার বুকের মধ্যেও কুণ্ডলী পাকাচ্ছে আতঙ্ক।

মন্ত্রধ্বনি ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে ফোনে, এবার সেসব চাপা দিয়ে জোরে জোরে ঘন্টা বেজে উঠল।

ঠিক যেমন দুপুরে উঠেছিল। কেঁপে উঠেছিল পাপিয়া, হাত সরিয়ে নিয়েছিল। তারপর মুহূর্তে মন শক্ত করে আবার হাত বাড়িয়ে তামার পাত্রে জলের মধ্যে ভেসে থাকা রুপোর ফুল একটা তুলে ব্যাগে ভরে ফেলেছিল।

অমন ইউনিক কারুকাজ… লকেট হিসাবে যা মানাবে না!

দিল্লি হাট বা বিভিন্ন এক্সিবিশনের স্টলে খুচখাচ এরকম হাতসাফাই কতই তো করেছে ও!

তাছাড়া অতগুলো আছে। একটা মাত্র কমে গেলে কেউ নিশ্চয় খেয়াল করবে না। করলেও ততক্ষণে ও বহু দূরে।

বেরিয়ে এসেছিল তার পর পরই। ফেরার পথে বার বার কান করে শুনেছিল, কেউ পিছু করছে কিনা।

কেউ করেনি।

“মঠের ক্ষতি করে কেউ পার পায়নি।”

কথাগুলো কানে বেজে উঠল। সত্যি সত্যিই সেই বুড়ো শুকনো লামা যেন বললেন ফোনের ওপার থেকে।

পাপিয়ার হাত কেঁপে রিসিভারটা পড়ে গেল। বুকের উপর দশমণ চাপ। শ্বাস নিতে পারছে না কেন ও? গলায় ডেলা হয়ে কিছু জমে যাচ্ছে। আওয়াজ বেরোচ্ছে না… আঃ! একটু, একটু সময় দাও… ভুল শুধরোতে দেবে না একবার… একটু?

কাঁপা কাঁপা পায়ে পাপিয়া প্রায় ডাইভ খেয়ে পড়ল ব্যাকপ্যাকটার দিকে।

ও জানে, কী করতে হবে।

বুকের সব হাওয়া ফুরিয়ে গেছে মনে হচ্ছিল। তবু ব্যাগের ভিতরের লুকোনো পকেট থেকে কাগজে মোড়া জিনিসটা বার করল ও। জানলার কাঠে রাখল কাগজ খুলে। ঝকঝক করে উঠল পাপড়িগুলোর ফিলিগ্রির মতো সূক্ষ্ম কারুকার্য।

মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে পাপিয়া দেখতে পেল, পদ্মটা থাবায় তুলে নিয়ে, সামনের উপত্যকা পেরিয়ে ডানা ছড়িয়ে উড়াল দিয়েছে লাল-সোনালী অপার্থিব এক প্রাণী। সে উপত্যকা ভরে উঠছে দূরাগত ঘন্টাধ্বনিতে। উল্লাসের সুর বাজছে এখন সেগুলোয়।

ওর বুকের উপরের চাপও আস্তে আস্তে কমছে।

নীল পর্দা আবার দুলে উঠে থেমে গেল। কাচ কখন বন্ধ হয়ে গেছে, দূর আকাশে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে গোলাপির ছোপ।

রাত কেটে আলো আসছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *