তিলোত্তমা মজুমদার
শশীকান্ত আর নিশিকান্তর নাম শুনতে একরকম হলেও তারা ভাই নয়। একসময় দু’জনে খুব বন্ধু ছিল। এখন ব্যবসার অংশীদার। বহুকাল ধরেই তারা সন্ধ্যার পর একত্রে মদ্যপান করতে অভ্যস্ত। যখন ব্যবসা শুরু করেনি, শুধুই বন্ধু ছিল, তখন থেকেই।
ব্যবসার অংশীদার হয়ে গেলে বন্ধুত্ব আর শর্তহীন থাকা সম্ভব হয় না। তখন বন্ধুত্বের অতীত বর্তমানের অংশীদারীর মুখপত্র হয়ে যায়। তাই সবাই জানে, শশীকান্ত আর নিশিকান্ত প্রাণের বন্ধু, কিন্তু মদের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করা মাত্র দু’জনের দাঁত বড় হয়ে যায়, নখ হয়ে ওঠে সূচালো ও লম্বা। ভাষাতেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। একজন বলে ঘ্রাউ ঘ্রাম। অন্যজন বলে ঘোগর ঘোগ ঘেঁয়াও। নতুন কেউ শুনলে তার পক্ষে খুব অস্বস্তিকর, কিন্তু দুই বন্ধু এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পরস্পরের প্রতি যতই জান্তব রোষ প্রকাশ করুক, কতিপয় যৌথ পাপাচার তাদের সম্বন্ধ অক্ষয় করেছে।
দিনকয়েক হল শশীকান্ত চিন্তান্বিত। মদের উপকরণ ও অনুপান সাজিয়ে দামি বোতল থেকে পানীয় ঢালতে ঢালতে নিশিকান্ত তার কারণ জিজ্ঞেস করল।
শশী বলল, ‘কী বলব। তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করবি?’
‘কেন করব না?’ নিশি আশ্বাস দিল।
শশীকান্ত বলল, ‘পলাশপুরের যে জমিটা আমরা নিয়েছি, ওখানে সেদিন গিয়ে আমার কীরকম অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছে।’
‘কীরকম?’
‘মনে হয় কিছু একটা আছে, যা দেখা যায় না।’
‘ভূত প্রেত আছে বলছিস?’
‘ঠিক তা বলছি না। তবে মনে হচ্ছে ওটা বেচে দিয়ে অন্য কোথাও জমি দেখি।’
‘অনেকদিন ধরে পড়ে আছে জমিটা। যা লগ্নি করা হয়েছিল, সেটা এখন হিসেব করলে যা দাঁড়ায়, বিক্রি করলে ওই দাম পাবো না।’
‘হয়তো পাবো না, কিন্তু নিবারণের ওপর জোর করা হয়েছিল তো, জমি বিক্রির ইচ্ছে ওর একদম ছিল না। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছে।’
‘নিবারণ বেঁচে থাকলে তো দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। ওর ছেলেকে আমরা প্রস্তাবিত দামের সবটাই দিয়েছি। বঞ্চিত করিনি তো। আমার কাছে নিবারণের অনেক ঋণ ছিল। সেইসব ওর ছেলের থেকে নিইনি। মরে নিবারণের লাভ হয়েছে।’
‘মরে গেলে লাভ কী, লোকসানই বা কী। নিবারণের ছেলে সব টাকা ফুকে দিয়ে এখন পলাশপুর স্টেশনে চায়ের দোকান দিয়েছে। টাকা পেলেই তো হল না, রাখতে জানতে হয়।’
‘সে তো ঠিক কথাই। ওই জমি যদি আমরা না নিতাম, ওই ছেলে ওটারও সর্বনাশ করত।’
শশীকান্ত খানিক অন্যমনস্কভাবে একমুঠো কাজুবাদাম মুখে ফেলে বলল, ‘আমরা নেওয়ার পর থেকে জমিটায় চাষ হয় না, পড়ে আছে, কিন্তু একটা টাটকা কাকতাড়ুয়া লাগানো।’
‘কেউ মজা করেছে। কিংবা গ্রামের লোক অনেক ঝাড়ফুঁক টুক করে, সেজন্যও লাগাতে পারে।’
‘তোর মনে আছে, নিবারণকে ঠিক কোথায় পুঁতে দেওয়া হয়েছিল?’
‘এখানে বসে সেটা কী করে বোঝাব?’
‘আমার মনে হচ্ছে, যেখানে নিবারণকে রাখা আছে, ঠিক সেখানেই কাকতাড়ুয়াটা গজিয়েছে। বাঁশের হাতায় লটকানো ল্যাগব্যাগে শার্ট, মাটির হাঁড়িতে কালি লাগানো মাথা, সাদা রং দিয়ে আঁকা গুলি গুলি চোখ আর দাঁত বের করা হাসিমুখ।’
‘একেবারে নিখুঁত কাকতাড়ুয়া।’
‘কিন্তু মেটে হাঁড়ির মাথায় একটা পুরোন বাঁশের টুপি। আমি টুপিটা খুলে মাটিতে ফেলে দিলাম। জমিটায় হাঁটছি তো হাঁটছি, শেষ মাথায় যে ইটের পাঁচিল করা হয়েছিল, সেটা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই পৌঁছতে পারছি না। আমি এগোই, জমিটাও বেড়ে চলে, পাঁচিলটা পিছিয়ে যায়। আমি যেন একজায়গায় দাঁড়িয়ে পা নেড়েছি।’
‘কী খেয়ে গিয়েছিলি রে ভাই? শুকনো নেশা করেছিলি কিছু? তোর গাঁজা চরসে আকর্ষণ ছিল না তো।’
‘আরে না। সূর্য না ডুবলে আমরা নেশা করি? ব্যবসার কাজে গেছি, ফালতু নেশা কেন করব?’
‘ইটের পাঁচিল কখনো পেছু হটে যেতে পারে?’
‘গিয়েছে, সত্যি বলছি। কিছুতেই যখন ওটার কাছে যেতে পারলাম না, মনে হল আমার মাথায় কিছু হয়েছে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, কিংবা কোনও মানসিক বিভ্রম। খুব ক্লান্ত লাগছিল। আমি ফিরতে শুরু করলাম। দেখি, কাকতাড়ুয়াটাকে কত ছোট লাগছে। মানে আমি সত্যি অনেক দূর হেঁটেছি। জমিটা বেড়ে চলেছে। কোথাও কেউ নেই, ধু ধু মাঠ, কিন্তু ওই হাঁড়িমাথায় টুপিটা ফিরে এসেছে।’
‘কেউ তুলে বসিয়ে দিয়েছে।’
‘কে দেবে? কেউ ছিলও না।’
‘হয়তো ছিল, তুই দেখিসনি। ওখানে কোথাও চা-টা খেয়েছিলি? কেউ কিছু মিশিয়ে দেয়নি তো?’
‘সে তো ওই জমিতে পৌঁছবার অনেক আগে, একটা ধাবায় থেমেছিলাম। তারপর অতখানি রাস্তা গাড়ি চালিয়ে গেলাম।’
‘হয়তো ক্লান্ত ছিলি, ভুলভাল দেখেছিস।’
‘আমি জানতাম তুই বিশ্বাস করবি না।’
‘আরে বিশ্বাস করব না কেন? আমি বলছি, তোর অনুভূতি সব সত্যি, কিন্তু ঘটনাগুলো মনগড়া। হয় এমন।’
‘তুই চল একদিন। দু’জনে গিয়ে দেখব।’
‘তা তো যাবই। সেদিন তোর সঙ্গে শিবেন রায়ের যাবার কথা ছিল না?’
‘সেদিন সকালে শিবেনের পা ভেঙেছে, জানিস না?’
‘রৌরকেল্লা থেকে ফিরে অত সবার খবর নেওয়ার সময় হয়নি। তুই অন্য কাউকে নিয়ে গেলি না কেন? অতখানি রাস্তা একা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।’
‘কী আর এমন রাস্তা? এই শহর থেকে একশো তেইশ কিলোমিটার। আমার কী মনে হয় জানিস? নিবারণের ব্যাপারটা খুব ভুল করে ফেলেছি আমরা। আর একটু সময় নিয়ে বোঝালেই হতো।’
‘তোর জন্যই তো। যেমন রগচটা স্বভাব তোর। একটু কড়কে দিলেই হতো।’
‘কড়কে? তোর মনে হয় ওকে কড়কানো যায়? আমাদের কলা দেখিয়ে দিল না মুখের ওপর? প্রথম ঘুষিটা তো তুইই মেরেছিলি। ও ঝট করে কাস্তে বাগিয়ে তোর দিকে যাচ্ছে দেখে…’
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। আমাকে বাঁচানোর জন্যই তুই ওকে জানে মেরে দিয়েছিস। আমিও ফেঁসে আছি, তুইও আছিস। কী করা যাবে? মনে অত দুর্বলতা থাকলে ওরকম কাকতাড়ুয়া দেখে ভয় লাগে। আমাকে বাঁচানোর জন্য খুন, অর্থাৎ আমি মরে গেলে তোকেও ও মেরে ফেলতে পারে এই ভয় থেকে, মানেই আত্মরক্ষার জন্য মারা। ওতে অপরাধ নেই।’
‘অপরাধ আছে কি নেই ও নিয়ে ভাবছি না। কিন্তু আজকাল তোদের এই সন্ধ্যেবেলার পাহারাদারকে দেখে আমার নিবারণ মনে হয়।’
‘ফিয়ার সাইকোসিস। মনে ভয় পুষে রেখেছিস, সেই থেকে স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে যাচ্ছে।’
‘আমি তোকে বলছি শোন, যদি পলাশপুরের জমি তুই না ছাড়িস, আমি ওই প্রোজেক্ট থেকে সরে যাব। আমাকে আমার টাকা দিয়ে দে।’
‘তোর টাকা? তোর কোন টাকা?’
‘ওই জমি কেনার টাকা। এখনকার হিসেবে যা হবে, আমাকে দিয়ে দে, আমি তোকে পুরো ছেড়ে দিচ্ছি।’
‘একদিন কী ভুল দেখলি, না দেখলি, তাইতেই এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছিস। তুই বাড়ি যা। তোর নেশা হয়ে গেছে।’
‘আমার কিছু নেশা হয়নি। আরেকবার ঢাল। নিশি, ভাই, আমাকে রেহাই দে। ব্যবসাপাতি আমার আর ভাল লাগছে না। চল আমাদের যা আছে, সব হিসেব করে যার যার বুঝে নিই। তোর দম আছে, তুই চালিয়ে যা। আমার মধ্যে ক্লান্তি এসে গেছে।’
নিশিকান্ত আরও একবার প্রিয় পানীয় ঢালল। ব্যবসা তার নেশার মতো। সে একা মানুষ। প্রভূত অর্থসম্পদের অধিকারী। আর একটি টাকাও যদি লভ্যাংশ না আসে, তার কিছুই যায় আসে না। কিন্তু সব কিছুই শুধু টাকার জন্য করে নাকি লোকে? সে ব্যবসা ভাগাভাগি নিয়ে আর কথা বলল না। শশীকান্ত আরও চিন্তাভাবনা করুক। মদ্যপানের আবেগজাত কথা চূড়ান্ত বলে ধরতে নেই। তবে পলাশপুরের জমি যদি ছেড়ে দেয় শশী, তাকে পুরোন দাম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। বিনিয়োগের বর্তমান মূল্যায়নে নিশিকান্ত টাকা ফেরত দেবে না।
শশীকান্ত একটা সিগারেট ধরালো। যতটুকু পানীয় ছিল, এক চুমুকে শেষ করে বলল, ‘কতদিনের বন্ধু আমরা বল?’
‘চল্লিশ বছর।’
‘তুই আমাকে পাক্কা বিশ্বাস করিস?’
‘তুই করিস?’
‘না। তোর বৌ মারা যাবার পর থেকে তোকে আমি একদিনও বিশ্বাস করিনি। খুব ভাল মেয়ে ছিল বিদিশা। তুই ওকে মেরে দিলি।’
‘আমি মেরেছি? বিদিশাকে? এরকম একটা বাজে অভিযোগ তুই করিস কী করে? বিদিশা আত্মহত্যা করেছে। সবাই জানে সেটা।’
‘তুই ওকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছিলি।’
‘আমি কি বলেছিলাম, যাও, মরো? তুই বিদিশাকে চুমু খাচ্ছিলি, সেটা আমি দেখে অন্যায় করেছি? এই তোর যেমন নিবারণকে নিয়ে পাপবোধ আছে, ওরও তোর সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করে এবং ধরা পড়ে বিবেকের জ্বালা ধরেছিল।’
‘তুই একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা, তাই না? আমাকে যদি আমার পাওনা ঠিকমত না দিস, আমি তোর মুখোশ খুলে দেব।’
খট খুশ খুট করে হালকা শব্দ হল। বাঁশের তৈরি রোদে পরার চওড়া টুপি উড়ে এসে পড়ল মেঝেতে। শশীকান্তর মুখখানা হাঁ হয়ে গেল। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে বুঝল গ্লাসে কিছু নেই। ঠক করে গ্লাস রেখে খসখসে গলায় বলল, ‘এটা কী। কোত্থেকে এল?’
‘টুপি। ওদিকের দেওয়ালে ঝোলান ছিল।’
‘আমি আসি ভাই। কাল কথা হবে।’
তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল শশীকান্ত। অনেক রাতে শশীর বৌ নিশিকান্তকে ফোন করে জানতে চেয়েছিল শশী ওখানেই আছে কিনা। কিন্তু নিশিকান্ত ফোন তোলেনি।
দু’দিন খোঁজ করার পর শশীকান্তকে পাওয়া গেল পলাশপুর রেল স্টেশনে। একেবারে উন্মাদ। নিবারণের ছেলে চিনতে পেরে শশীর বাড়িতে খবর দেয়। শশীকান্ত নিবারণের ছেলেকে চিনতে পারেনি। চোখেমুখে ত্রাস, আতঙ্ক। শুধু বলছে, ‘ওই ওই ওই যে চলে যাচ্ছে।’
‘কে চলে যাচ্ছে? কে?’
নিশিকান্তকে পাওয়া গেল শহরের বড় হাসপাতালের মুর্দাঘরে। হাসপাতালের পুকুরপাড়ে শায়িত ছিল। যে কেউ দেখলে নিদ্রিত ভাবতে পারত। কিন্তু নিশি ও শশী উভয়েরই চেহারায় ভোগী লোভী আত্মসর্বস্ব ধনবানের চকচকে পালিশ থাকায় ওই জায়গায় নিশির শয়ন ও নিদ্রা যাওয়া আমজনতার চোখে অস্বাভাবিক ঠেকেছিল। তার ওপর নিশিকান্তর পাশে ছিল একটা কাকতাড়ুয়া। দু’জনের মাথাতেই একরকম টুপি। কাকতাড়ুয়াটা সাদা দাঁতে হাসছিল। আর নিশিকান্তর শুকনো ঠোঁটে মাছি ভনভন করছিল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন