travel-day-outing

ডে আউটিং- চালশা পোলো ক্লাব
হিমি মিত্র রায়

হাতী ও লেপার্ডের বেড়াতে আসার প্রিয় জায়গা

একটু অক্সিজেনের জন্য যখন চারিদিকে হাহাকার তখন নিজেদের অবাক জলপানের পথিকটির দুর্দশার কথা মনে হয়। ‘ একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?’ এখানে ওই ‘জল’ এর জায়গায় ‘ অক্সিজেন’ শব্দটা বসিয়ে নিতে হবে শুধু, ব্যাস। গাঢ়,হাল্কা, শ্যাওলা রঙের বিভিন্ন প্যাস্টেল শেডের সবুজ ক্লোরোফিল থেকে প্রাণভরে অক্সিজেন পেতে গেলে অক্সিজেন সিলিন্ডারের প্রয়োজন পড়ে না যে-সব জায়গায়, সেই জায়গাগুলো আমাদের খুব কাছে। ঘর থেকে শুধু দুই পা ফেললেই মিলবে এমন স্থান।

প্যান্ডেমিক পরিস্থিতিতে ঘরে থাকতে থাকতে যখন দমবন্ধ অবস্থা, তখন প্রকৃতির কাছে গিয়ে নালিশ জানাতে ইচ্ছে করত। মনে হত প্রকৃতিকে জাপ্টে ধরে বলি, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও না, এবার প্রাণ খুলে বাঁচতে দাও না!

উত্তরবঙ্গের মানুষদের অনেক অসুবিধে ভোগ করতে হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট,যোগাযোগ ব্যবস্থা, সবেতেই ভোগান্তির শেষ নেই। একটাই মাত্র সুবিধে যদি বলতে হয়, তা হল বাড়ির কাছেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবুজের বাহার। পাহাড়, নদী, জঙ্গল। মন খারাপ, ভালো সবেতেই ছুটে চলে যাওয়া যায় যত্রতত্র। নিজের মনের কথা বলতে বা নালিশ জানাতেও পাথুরে নদীটির বড় পাথরটায় চুপচাপ বসে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। গলা ছেড়ে গান গাইলেও বাঁধা দেয় না কেউ, জলের শব্দ শুনতে শুনতে মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ এখানে।

হঠাৎই এমন একটি দিন এলো। মেটেলির বিডিও সাহেব বিপ্লবদা একটি নির্জন জায়গার সন্ধান দিলেন আমাদের, যেখানে কেউ যায় না। সোশাল ডিস্ট্যান্সিং এর কোনো ব্যাপার নেই। নিজেদের মতো ঘুরে চলে আসা যাবে। আমরা তো এক পায়ে খাড়া, একটা দিন টিভিতে ভয়াল খবরের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক থেকে দৃষ্টি ঘোরানো যাবে। করোনায় কত মৃত্যু হল, অক্সিজেনের কত ঘাটতি হল, ভ্যাকসিনের অপ্রতুলতা এই সমস্ত কিছু থেকে পালিয়ে বাঁচা যাবে সারাটা দিন।
মূর্তি নদীকে আগলে রেখেছে গভীর অরণ্য

যেহেতু ওখানে বাইরের খাবার খাব না তাই আমরা নিজেরাই বাড়ি থেকে রান্না করে নিলাম ফয়েল প্যাকে। ফ্রাইড রাইস আর ঝাল ঝাল করে আলুর দম সঙ্গে এক গ্লাস ভর্তি লিকার চা। ওই লিকার চা-এ আবার করোনা স্পেশাল ‘কাঢ়া টি’ বানানোর জন্য লেবু, মধু, আদা, দারচিনি, এলাচ যা পারা যায় মণিমুক্তো দিয়ে অমৃতসম বানিয়ে ফেলা হলো প্রায়। যখন খুশি পাথরে বা সবুজ ঘাসে কাগজের কাপে চা নিয়ে বসে পড়বো, খাব আর ভাইরাসকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেবো, ভাব এমনটাই।

আমাদের গন্তব্য চালশা পোলো ক্লাব।

এই পোলো ক্লাবটিতে একসময় পোলো, গলফ এ সমস্ত খেলা গুলো হত। এখন সে সবকিছু হয় না, তবে পারমিশন নিয়ে ঘুরে আসা যায় একটি বেলার জন্য। চালশা ছাড়িয়ে ডান দিকে চলে গেছে ইনডং চা বাগান। আমরাও ঠিকানা জেনে নিয়ে সেদিকেই ঢুকলাম। গেটম্যানের কাছে খবর ছিল আগে থেকেই, উনি বাগানের বাইরের বাঁশটা টেনে উপরে তুলে দিলেন অর্থাৎ গেট খুলে দিলেন।

ঢোকা মাত্রই সবুজ কাঁচা চা পাতার গন্ধ ভুরভুর করে আসতে লাগল নাকে, এই গন্ধটা ছোটবেলার কথা বারবার মনে করায় বড্ড। চা বাগানে কর্মরত ছিলেন আমার কাকা, তাই ছোট থেকেই চা বাগানের কোয়ার্টারে যাতায়াত। এই গন্ধটার মধ্যে এক অদ্ভুত সতেজতা আছে যেটা খুব প্রিয়, যার মধ্যে একটুও শহুরে খাদ মেশানো নেই, আছে শুধু বন্য নির্জনতা আর টিং টিং শব্দ করে গলায় ঘন্টা বেঁধে গরুদের বাড়ি ফেরার দৃশ্য দেখা।

কিছুক্ষণ চোখ বুঝেই প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম আর তার পরেই চলে গেলাম যথাস্থানে।

অপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য। চারিপাশে বিস্তৃত ঝকঝকে সবুজ ঘাসের মাঝখানে লাল রংয়ের বিরাট আকারের পুরনো ধাঁচের বানানো এই পোলো ক্লাব। অপার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে আমাদের চারচাকা গিয়ে দাঁড়ালো ক্লাবের পাশে।

কেয়ারটেকার ভদ্রলোক মাস্ক ও যাবতীয় দূরত্ব বিধি মেনে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। বিরাট বড় এই ক্লাবের ভেতরে রয়েছে টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট। আমরা পুরোটাই ঘুরে দেখলাম। বাথরূমের বাইরে লেখা ‘সাহাব’ আর মহিলাদেরটাতে ‘মেমসাব’। এরকম সম্বোধন আমি আগে কোথাও দেখিনি। বাথরুম তো নয় এক একটা ডিলাক্স রুমের মত। সাদা ঝকঝকে ক্রুশের কাজ করা পর্দা, গদিযুক্ত সোফা, বিরাট বিরাট পুরনো দিনের আয়না, একবার ঢুকলে আর বেরোতে মন চাইবে না। ঝট করে মনে হয় বিরাট আয়নায় এক্ষুনি কোন সত্যিকারের ব্রিটিশ মেমসাব এক ঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
প্রকৃতির পেলব পরস

কিন্তু আমরা ঘরে থাকলাম না বেশিক্ষণ। আমাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল সবুজের মাঝে সময় কাটানো। তাই ক্লাবটি দেখে নিয়ে চললাম এগিয়ে। সামনেই মূর্তি নদী, তারপরেই চাপড়ামারি অভয়ারণ্য। হাঁটতে হাঁটতেই মাঝপথে আকাশ কালো করে এল। জঙ্গলের এই এক ব্যাপার, এই বৃষ্টি এই রোদ, ঝির ঝিরে হাওয়ায় আমাদের অপূর্ব অনুভূতি হচ্ছিল প্রত্যেকেরই।

খাবারের ব্যাগ আর ফ্লাস্ক সহ আমরা নদীর পাশে গিয়ে বসলাম।

নিজের আপন ছন্দে পাথরে ধাক্কা লেগে বয়ে চলেছে মূর্তি নদী। কোথাও দুধ সাদা ফেনা বা কোথাও স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল, তার মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ছোট ছোট মাছ। আমরা এক একটা পাথরের ছড়িয়ে বসলাম পা ভিজিয়ে। নিজেদের মধ্যে জল নিয়ে খেললাম কিছুক্ষণ। মনে পড়ল না শেষ কবে এমন বাঁধনছাড়া আনন্দে মেতেছি। কিছু সময় ভুলে গেলাম করোনার কথা। হঠাৎ কে যেন বলল ‘হাতি’!!

চমকে গিয়ে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হল। তারপর দেখলাম পেছনে হ্যাট হ্যাট শব্দ। অর্থাৎ মাহুত আছে সঙ্গে, ও ই বাবাজীবনকে নিয়ে বেরিয়েছে ওপাশের জঙ্গল পরিদর্শনে।

হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা। আর একটু হলেই পড়ি কী মরি করে খাবার ফেলে দৌড়তে হত, তা না করে হাসির রোল উঠল।

কাগজের কাপে গরম গরম আদা দেওয়া লিকার চা খেতে খেতে হালকা বিদ্যুতের রেখা দেখা দিল আকাশে। বুঝলাম যে বেশিক্ষণ এই ফাঁকা মাঠে বসে থাকা যাবে না। এদিকে এ সমস্ত কিছু ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। আমরা আমাদের খাবার নিয়ে খেতে শুরু করে দিলাম। এ এক অদ্ভুত পিকনিক, অন্য কোনো লোকজন নেই, শুধু নির্জনতা সঙ্গী আর আমরা পরিবারের পাঁচ জন। প্রকৃতিকে যেন সাধারণের চেয়ে আরো বেশি মাত্রায় ভালো লাগছিল ওদিন। বড় বেশি সবুজ ছিল চোখের সামনে, যেতে মন চাইছিল না। কিন্তু ফিরতে তো হবেই আবার সেই দমবন্ধ জীবনে। এটাই তো জীবনের নিয়ম।
ইতিহাসের নানান ঘটনার সাক্ষী এই কাঠের ইউরোপীয়ান ক্লাব

আমরা একটি প্যাকেটে সমস্ত খাবারের উচ্ছিষ্ট গুলো জড়ো করে গাড়িতে তুলে নিয়ে কেয়ারটেকারকে বলে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। রেখে গেলাম প্রকৃতির কাছে আমাদের এক মুঠো ভালোবাসা।

শুধু প্রকৃতির কাছে ভালোবাসা দিয়ে গেলাম এমনটা নয়। এই জায়গা থেকে নিয়ে গেলাম ভূত এবং রহস্য গল্প লেখার রসদ। এই জায়গার প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে রয়েছে অলৌকিক আবহ। যারা আমার মত অল্পস্বল্প লেখালেখি করেন তাদের জন্য একটি আদর্শ অবসর যাপনের স্থান। আমি হলফ করে বলতে পারি ভূতের গল্পেরা লাইন দিয়ে আপনার কলমে ধরা দেবে। আবার গল্পের ভুতেরাও বাংলোর বিভিন্ন কোনে দেখা দিতে পারে, ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে।

এমন নয় যে করোনা যদি আবার কখনো আমাদের কব্জা করে (ভগবান করেন যেন আর কখনো অমন দিন দেখতে না হয়) তখনই শুধুমাত্র এখানে যাওয়া যাবে, ঘুরে আসা যাবে যে কোনও দিন। মন খারাপ থাকলে ভালো হয়ে যাবে এইটুকু গ্যারান্টি দিতে পারি অনায়াসেই। এত বিস্তৃত খোলা মাঠ, সবুজ প্রকৃতি, প্রাণ ভরে অক্সিজেন নেওয়ার এমন সুন্দর একটা জায়গায় আগে কেন কখনও যাইনি তাই শুধু ভেবে গেছি আসার পথে।

কিভাবে যাবেন- জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ি থেকে দু আড়াই ঘন্টার মত লাগবে। এখানে রাতে থাকার ব্যবস্থা নেই। সারাদিনের জন্য পিকনিক অথবা ডে আউটিংয়ে যাওয়া যেতে পারে। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, মালবাজার, চালশা যে কোন জায়গা থেকেই ঘুরে আসা যাবে এই সুন্দর পোলো ক্লাবটি তে। ক্লাবের আশেপাশের জায়গাগুলিতে যে কেউ যেতে পারেন। কিন্তু ক্লাবের ভেতরে দেখার জন্য রেকমেন্ডেশনের প্রয়োজন হয়, ক্লাবের চাবি থাকে বাগানের ম্যানেজার এর কাছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *