ডেবরা গোপীবল্লভপুর থেকে কাজাখস্তান

ডেবরা গোপীবল্লভপুর থেকে কাজাখস্তান
অমর মিত্র

দেশটির নাম কাজাখস্তান। সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র ভে গেলে ১৯৯১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই দেশের কথা যতটুকু জানি তা রুশ সাহিত্যে। আলেকজান্ডার পুশকিনের ক্যাপ্টেনের মেয়ে উপন্যাসের কথা মনে পড়ে, তুষারাবৃত সেই স্তেপভূমিতে পথ হারিয়েছিল সেনাবাহিনিতে যোগ দিতে যাওয়া প্রাক্তন সামরিক কর্তার তরুণ পুত্র। তাকে সেই তুষারপাতের ভিতর থেকে পথ চিনিয়েছিল এক কশাক। সেই স্তেপভূমি এই দেশে। কাজাখস্তান দেশটি ইউরেশিয়ার হৃদয় যেন। আছে এশিয়াতে, ইওরোপ রাশিয়ার গায়ে। এই দেশে তুষারচ্ছাদিত পর্বতমালা, সির দরিয়া আরো কত নদী, উরাল হ্রদ, যাযাবর উপজাতি নিয়ে অপূর্ব। কাজাখস্তান দেশেই ছিল সাবেক সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ যান উৎক্ষেপণ কেন্দ্র বৈকানর। স্পূটনিকে চেপে লাইকা এখান থেকেই মহাকাশে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। ইউরি গাগারিন গিয়েছিলেন মহাকাশে।
আমি ধ্রুবপুত্র লেখার সময় মানচিত্রে চিনেছিলাম প্রাচীন এই রেশম পথ, অক্সাস নদী, হিন্দুকুশ পর্বতমালা, বাহ্লিক দেশ, বালখ অঞ্চলে গ্রিক উপনিবেশের কথা। তা ছিল উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশ হয়ে এই দিকে। ভাবিনি কোনোদিন সেই দেশে যাব। স্বপ্ন ব্যতীত তা কী করে সম্ভব হবে? কিন্তু হয়েছে। জীবনে কী ঘটে কী ঘটে না, তার ব্যাখ্যা দেবে কে?

আমার ফেসবুকের অথরস পেজ আছে একটি। কালেভদ্রে খোলা হয়। সেখানে দূর কাজাখস্তান থেকে একটি মেসেজ এসেছিল গত ২০১৯ এর এপ্রিলের ৩ তারিখে। কাজাখস্তান রাইটার্স ইউনিয়নের সিনিয়র লিটারারি অ্যাডভাইসর দুমান আতাইবেক আমাকে জানিয়েছিলেন, যে কাজাখস্তানের রাজধানী নূর-সুলতান শহরে আগস্টের ১৪, ১৫, ১৬ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য প্রথম এশিয়ান লিটারারি ফোরামে আমি অংশগ্রহণ করতে সম্মত কি না। আমি সেই বার্তাটি দেখেছি জুন মাসের ২০ তারিখে আচমকা ঐ পেজটি খুলে। বার্তাটি আড়াই মাস আগে এসেছে, আমি দেখিনি, সেই মত দুঃখ প্রকাশ করে উত্তর দিয়েছিলাম। সঙ্গে আমার ই-মেইল ও ফোন নম্বর জানিয়ে দিই সেখানেই। ভেবেইছিলাম ততদিনে সব কিছুই স্থির হয়ে গেছে। আমন্ত্রণ এসেছিল, কিন্তু তা গ্রহণ করতে পারলাম না। সুতরাং আমার ইন-বক্সের উত্তরের কোনো মানে নেই। দুঃখ করেছিলাম বন্ধুদের কাছে, একটি বিদেশি আমন্ত্রণ, নিতে পারলাম না। আবার সংশয় ছিল, নূর সুলতান শহরে লেখক সম্মেলন, আমাকে ডাকছে, কিন্তু আমার ফোন নং, মেইল ঠিকানা কিছুই জানে না ওরা? ফেসবুকে আমন্ত্রণ? এর ভিতরে কোনো প্রতারণা আছে কি? নূর সুলতান নামে কোনো শহরের নাম আমি শুনিনি। আমেরিকার লস এঞ্জেলস, রিভার সাইড মোরেনো ভ্যালিতে থাকেন আমার বন্ধু দীপেন ভট্টাচার্য। তিনি মহাকাশ বিদ্যার অধ্যাপক। রাশিয়ায় ছিলেন অনেকদিন। তাঁকে বললাম হোয়াটস আপ কল করে, খোঁজ এনে দিন তো, ঘটনাটি সত্য কি না। তিনি দিন পনেরর ভিতর খবর দিলেন, সবই সত্য। ওই শহরে অমন সম্মেলন হচ্ছে। তাঁর রাশিয়ান বন্ধু তাই বলেছেন। কিছুটা স্বস্তি। কিন্তু আমি তো আড়াই মাস বাদে উত্তর দিয়েছি, নিশ্চয় আমি আমন্ত্রিত হব না। এপ্রিল থেকে জুলাই এসে গেল, আমি ১৯শে জুন উত্তর দিয়েছিলাম। তার জবাব আর আসেনি। এল জবাব। ঠিক এক মাস বাদে ২২শে জুলাই আমার কাছে মেইল আসে কাজাখস্তান রাইটার্স ইউনিয়নের সভাপতির। দেরিতে লিখিত আমন্ত্রণ জানানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তিনি জানান যে সম্মেলনের তারিখ বদল হয়েছে। ৪, ৫ ও ৬-ই সেপ্টেম্বর ২০১৯, কাজাখস্তানের রাজধানী নূর সুলতান শহরে (পূর্বতন নাম ‘আস্তানা’) প্রথম এশীয় রাইটার্স ফোরাম অনুষ্ঠিত হবে। যাওয়া আসা, সেখানে থাকার সমস্ত দায়িত্ব তাঁদের, এমন কি ভিসার ব্যবস্থা তাঁরা করবেন দিল্লিস্থ কাজাখ হাইকমিশনের ব্যবস্থপনায়। এই উদ্যোগে কাজাখস্তান সরকার এবং তাঁদের বৈদেশিক দূতাবাসের সক্রিয় অংশগ্রহণ আছে। আমি বন্ধু কবি যশোধরা রায়চৌধুরীর একটি ফেসবুক পোস্ট দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে, মনে পড়ল, তিনি কাজাখস্তানের কথা লিখেছিলেন ছবি সহ। কাজাখস্তান গিয়েছিলেন সরকারি কাজে। মাস তিন ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, সে এক রূপকথার দেশ। যান অমরদা, ঘুরে আসুন। আমি মনে মনে তৈরি হতে লাগলাম। ভেবেই পাই না কে আমার নাম প্রস্তাব করেছে ওঁদের। আমি তো অনূদিত হইনি ইংরেজিতে যে সকলে চিনবে। বাংলা ভাষায় লিখি। যিনি প্রস্তাব করেছেন তিনি আমার কোনো ফোন নং বা ইমেইল ঠিকানা জানেন না। আশ্চর্য। চিঠির পর চিঠি চালাচালি হতে থাকে। মেইলের পর মেইল। আমি আমার পাসপোর্টের ছবি পাঠিয়ে দিলাম টিকিট এবং ভিসার জন্য। দিল্লিতে কাজাখ দূতাবাস, আমি যেতে পারব না। অনস্পট ভিসা হবে। এরপর একে একে যাওয়া এবং ফেরার টিকিট এল। ই-মেইল-এ এল দূতাবাসের চিঠি। আমাকে বলা হল মূল আমন্ত্রণ ও দূতাবাসের চিঠির রঙীন প্রতিলিপি নিয়ে রওনা হতে। নূর সুলতান এয়ারপোর্টে নেমে পাসপোর্টে ছাপ মেরে মূল ভিসা দেবে কাজাখ সরকার। যাত্রা শুরু হলো গত ৩-রা সেপ্টেম্বর। সকাল ৯-৪৫ এ এমিরেটস এয়ারলাইন্স বিমানে দুবাই যাত্রা। সেখান থেকে উড়ান বদল করতে হবে। আমি ভাবছিলাম, সেই কৈশোর যৌবনের স্বপ্ন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল এমন এক দেশে আমি যাচ্ছি, যেখানে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। লন্ডন আমেরিকা যায় মানুষ, বাঙালিদের বঙ্গ সম্মেলনে যায়, অস্ট্রেলিয়া যায় বঙ্গ সম্মেলনে, কিন্তু আমি একা এমন এক সম্মেলনে যাচ্ছি, যে দেশে সচরাচর যাওয়া হয় না। সেই দেশের মানুষের ভাষা আমার জানা নেই। সেখানে বাঙালি থাকলেও তাদের কাউকে আমি চিনি না। উদ্যোক্তাদের ফোন করে জেনেছিলাম, আমিই ভারতের একমাত্র প্রতিনিধি। বহু অনুসন্ধান করে, বিচার বিবেচনা করে, তাঁরা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আগের দিন ভেবেছিলাম এ কখনো হতে পারে? সেই ৪৫ বছর আগে অবিভক্ত মেদিনীপুরের ডেবরা থানার করন্ডা নামের এক গ্রামে গিয়েছিলাম সেটেলমেন্ট কানুনগো হয়ে। কংসাবতী পার হয়ে ১ ঘন্টা ২০ মিনিট পায়ে হাঁটতে হত। সেই ১৯৭৪-এর এপ্রিলে একটি গল্প লিখি, ‘মেলার দিকে ঘর’। সেই গল্প লেখার পর মনস্থির করে নিই, লিখব। হ্যাঁ, লিখব। লেখা ব্যতীত আর কিছু হবে না আমার দ্বারা। সেই গল্প ছাপা হয়েছিল স্থানীয় ‘একাল’ পত্রিকায়, মুদ্রণ সংখ্যা ছিল ২০০। বড় চাকরি করার এলেম আমার ছিল না। মানসিকতাই ছিল না। ক্যাম্প অফিসে অধস্তন কর্মচারী, ডি-গ্রুপ পিয়ন, আমিন কিংবা মোহরার পেশকার বাবুর সঙ্গে মেস করে থেকেছি। কারো জ্বর হলে শিয়রে বসে মাথায় জলপট্টি দিয়েছি। আমাকেও তারা শুশ্রুষা দিয়েছে, মনে পড়ে। যাই হোক, সেই গল্প সন্তোষকুমার ঘোষ, কবি আলোক সরকার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অধ্যাপক অমলেন্দু বসুর ভালো লেগেছিল কবিপত্র পত্রিকায় পুনর্মুদ্রণ হওয়ার পর। ৪৫ বছর কেটে গেছে, জীবনে এত বিস্ময় থাকে? মা বাবা কেউ এখন নেই। আমার জন্য তাঁদের দু:খ ছিল। তাঁদের কনিষ্ঠ পুত্রটি কোন হাটে মাঠে চাকরি করে বেড়ায়, মফসসলে ঘুরে বেড়ায়, জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারল না। এখন বৃদ্ধ হয়ে আসা দুই দাদা, স্ত্রী ও দুই সন্তান, আত্মজন মৈনাক যখন শুনেছে এই আমন্ত্রণের কথা, আনন্দ করে বলেছে, ঘুরে এস, ঘুরে এস, তুমি তো ডেবরা, গোপীবল্লভপুরে, হাটে মাঠে হেঁটে বেড়ান মানুষ, তুমি ঠিক পারবে একা, ভয় নেই। বড়দা মনোজ, মেজদা উদয়ণ বললেন, যা জয় করে আয়। মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করে আয়। মা বাবা মানে দেশ, মা বাবা মানে বাংলা ভাষা, মা বাবা মানে রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিতের এই শহর।

যাওয়ার পথে দুবাইয়ে আট ঘন্টার অপেক্ষা ছিল। এখান থেকে ভারতীয় সময় সকাল ৯-৪৫-য়ের উড়ান দুবাইয়ের সময় ১২-৩০টায় নামল। সময়ের তফাৎ ২ ঘন্টা। একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয় এমিরেটস এয়ারলাইনসে ঘোষণা বাংলায় হয়, খাদ্যতালিকায় বাংলা ভাষা আছে। ভারতীয় কোনো উড়ান কি হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষা ব্যবহার করে? বাংলাদেশের জন্যই তা হয়েছে স্বীকার করতে হবে। দুবাই এয়ারপোর্টের বিস্তার বিশাল, এক টার্মিনাল থেকে বাসে অন্য টার্মিনালে যেতে মিনিট চল্লিশ। বাসের গতি অবশ্য কম। আমি ভীতু মানুষ। দুবাই থেকে কাজাখস্তানের রাজধানী নূর-সুলতানের উড়ান রাত ৯-১০-এ। আমার নির্দিষ্ট গেটে আমি পৌঁছেছি বেলা ১-৩০ (দুবাই টাইম) নাগাদ। কাঁধে ঝোলা, কেবিন ব্যাগ নিয়ে বসেই আছি কলিকাতার সামান্য মানুষ। ক্ষুধার্ত হয়ে সঙ্গে আনা বিস্কুট, শোনপাপড়ি খেয়েছি। বসেই আছি বসেই আছি। সময় আর পারই হয় না। ঐ গেট থেকে মধ্য এশিয়ার নানা দেশের নানা শহরের উড়ান ছেড়ে যাচ্ছে, রিয়াধ, জেদ্দা, ইস্তাম্বুল, বাগদাদ, বেইরুট, বাস্তান-উড়ে যাচ্ছে নানা পোশাকের নানা রকম মানুষ। সকলেই খুব লম্বা, স্বাস্থ্যবান। আমার মতো ৫ফুট ২ইঞ্চি নয়, দুবলা নয়। সপরিবারে কত মানুষ কত শহরে ফিরছে। আমি ঘুমিয়ে নিই বরং। ঘুম কি হয়? এসি-র তাপমাত্রা মনে হতে লাগল খুব কম। দেখলাম যারা বসে আছে, কেউ কেউ শীতবস্ত্র গায়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার বেশ শীত করছে যে। কেবিন ব্যাগ থেকে হাতকাটা সোয়েটার বের করে গায়ে দিলাম। মাফলার বের করে মাথায় জড়িয়ে নিলাম, উঁহু শীত যাচ্ছে না। হি হি করে কাঁপছি। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। ভয় লাগছে। একা বিদেশবিভুয়ে। হায়! তখন হাফ হাতার উপর ফুল হাতা ভারি সোয়েটার চাপালাম। মাথায় টুপি। গলায় মাফলার। কেউই আমার মতো এত চাপায়নি। কিন্তু কারো তেমন কৌতুহলও নেই। বিদ্রুপাত্মক হাসিও নেই মুখে। আমি কাঁপতে কাঁপতে উঠে একটি কফি শপে গিয়ে ৫ ডলারে বড় এক গ্লাস কফি নিয়ে এলাম। ধীরে ধীরে শরীর শান্ত হচ্ছিল। কিন্তু শীত ছিলই। কাঁপুনি কমেছিল মাত্র। আমার পাশে মস্ত চেহারার এক ব্যক্তি এসে বসলেন। প্রবীণ। কী জানি কেন, সন্দেহ হওয়ায় জিজ্ঞেস করলেন, হেলো, হাউ আর ইউ। ফাইন বলতে, জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে আসছি, যাব কোথায়? উত্তর পেতে তিনি বললেন, তিনি লেবাননের মানুষ, বেইরুট যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে উঠে গেলেন। তাঁর উড়ানের বোরডিং আরম্ভ হচ্ছে তখন। রাত ৮-৪০ নাগাদ আমার উড়ানের বোরডিং শুরু হলে ভিতর থেকে বেরিয়ে এলাম রানওয়েতে। নেমেই টের পেলাম গরম হাওয়া। সারাদিন দুবাইয়ে ৪৫ ডিগ্রি ছিল। তখনও গরম হাওয়া বইছে। আহ, কী আরাম। টুপি মাফলার সোয়েটার খুলে মাথা ও গা গরম করে উড়ানের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা বাসে গিয়ে উঠলাম।

নামতে রাত ৩-৩০ (কাজাখস্তান সময়, ভারতের চেয়ে ৩৫ মিনিট এগিয়ে)। নূর সুলতান এয়ারপোর্টে নেমে অন অ্যারাইভাল ভিসা হলো। তখন চিনলাম শ্রীলঙ্কার পি বি জয়সেকারা, অশোক ফেরারা, ইয়েমেন, কম্বোডিয়ার লেখকদের। এক মুহূর্তেই আমরা বন্ধু। ভিসা করতে এক ঘন্টা সময় লাগল। উদ্যোক্তাদের চিঠিতে জেনেছিলাম এশিয়ার ৪৩টি দেশের ১০০জন লেখক, কবি আসবেন। আর থাকবেন রাশিয়ান, কজাখ, সমরখন্দ, উজবেক লেখকরা। আমরা বাইরে এসে দেখি দাঁড়িয়ে আছে দুমান আতাইবেক। সুদর্শন এক তরুণ। আর আছেন কয়েকজন তরুণ তরুণী। তরুন কজাখ লেখক টাংশু। হোটেলে এলাম ভোর ৫টা নাগাদ। ঝকঝকে অতি আধুনিক এক শহর। গাড়ির বাম দিকে ড্রাইভার বসেন, যেমন দেখেছিলাম মার্কিন দেশে। এসেছি প্রথম এশীয় লেখক ফোরামে। সাড়ে আটটার ভিতর প্রাতরাশ সেরে হোটেলের লাউঞ্জে আসতে দেখি দুমান আতাইবেক আর কত সব ভল্যান্টিয়ার তরুণ তরুণী অপেক্ষা করছেন। সব দেশের লেখক এই পাঁচতারা হোটেলে। বাস দাঁড়িয়ে। আমাদের যেতে হবে সম্মেলনের কংগ্রেস হলে। বাসের পর বাস আসছে। আরব, ইরাক, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, ওমান, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানামার, ভারত……বাস নিয়ে চলল কংগ্রেস হলে। সেই হলের নির্মাণ শৈলী দাঁড়িয়ে দেখতে হয়। অতিকায় এক রুপোলি কাছিম কিংবা অর্ধবৃত্তকে এক দিকে টেনে দীর্ঘ করে দেওয়া হয়েছে। দালির ঘড়ি। আমার গলায় ফার্স্ট ফোরাম অফ এশিয়ান রাইটার্স এর নাম এবং নেমের নিচে স্পিকার লেখা মালা। বাস থেকে নামতেই এক তরুণী, তিনি যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, ওয়েলকাম স্যার বলে আমাকে নিয়ে চললেন ভিতরে। দ্বিতীয় সারিতে আমার নাম লেখা চেয়ারে বসালেন। আমাকে একটি যন্ত্র দিলেন। অনুবাদ যন্ত্র। চ্যানেল ঘুরিয়ে ভাষা নির্বাচন করতে হয়। আমি ইংরেজিতে শুনতে পারব অন্য ভাষার বক্তৃতা। কিন্তু যন্ত্রটিকে আমি প্রথম দিন বাগে আনতে পারিনি। সেই সময়ই পাইনি। কাজাখস্তান রাইটার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট এক দোভাষী নিয়ে আমার কাছে এলেন। পরিচয় করলেন। বললেন, আমার প্রতিবেদন ‘মিথিকাল লাইফ’ তাঁদের পছন্দ হয়েছে (দশ দিন আগে মেইল করে পাঠিয়েছিলাম)। এই প্রসঙ্গে বলা যে আমাকে আগে, আগস্টের প্রথমে বলা হয়েছিল ১০-১২ মিনিটের লিটারারি টক অনুষ্ঠানে বলতে হবে। ইংরেজিতে এবং লিখিত প্রতিবেদন ব্যতীত সাহিত্য বিষয়ে যা মনে হবে আমি বলতে পারি। সেই প্রস্তাব আগস্টের ১৫ তারিখে বদল করে মেইল করা হয়, এশীয় সাহিত্যে পুরাণের ব্যবহার নিয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে। সময় পাঁচদিন। আমি তখন ফোন করে বলেছিলাম, পাঁচদিন সময়ে আমি ভারতীয় পুরান, যার ভিতরে আদিবাসী পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত নিয়ে লিখতে পারি, এশীয় মিথোলজি নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। আমি ভারতীয় পুরাণ, মিথোলজি নিয়ে লিখিত প্রতিবেদন পাঠাতে পারি। ওঁরা সম্মতি দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, কৌতুহলবশত ফোনে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার নামটি তাঁদের কাছে প্রস্তাব করেছিল কে? দুমান আতাইবেক বলেছিলেন, আমার সম্পর্কে দু’বছর হোম ওয়ার্ক করেছেন তাঁরা, তারপর প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। সত্য, না হলে মিথোলজি নিয়ে আমাকে বলতে বলবেন কেন? আমি সারাজীবন ধরে মিথ ভাঙার চেষ্টা করে গেছি। মিথ ব্যবহার করেছি আমার লেখায়। ধ্রুবপুত্র, অশ্বচরিত, ধনপতির চর থেকে কুমারী মেঘের দেশ চাই… উপন্যাসে এবং অনেক গল্পে মিথ, লোককাহিনি ব্যবহার করেছি। তাঁরা না জানলে এই বিষয়ে আমাকে বলতে বলবেন কেন?

রাইটার্স ইউনিয়নের সভাপতি আমাকে বললেন, উদ্বোধনী প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন দেশের রাষ্ট্রপতি, পাঁচজন এশীয় লেখক মঞ্চে থাকবেন তাঁর সঙ্গে, তাঁর ভিতরে দক্ষিণ কোরিয়ার কবি কো উন, মঙ্গোলিয়ার ঔপন্যাসিক ডি, উরাঙ্খাই, কাজাখ লেখক, আজারবাইজানের লেখকের সঙ্গে আমিও থাকব। সামনে মঞ্চ, দেখতে পাচ্ছি মঞ্চ সেজে উঠেছে। প্রত্যেক লেখকের নাম ফলক সাজানো রয়েছে। আমার নাম দেখতে পাচ্ছি। হ্যাঁ, কো উন এবং ডি, উরাঙ্খাই, দক্ষিণ কোরিয়ার কবি এবং মঙ্গোলিয়ার ঔপন্যাসিক এবছর নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন শুনলাম। সেইভাবে ঘোষণা করা হলো মঞ্চে আহ্বানের সময়। আমরা পাঁচজন মঞ্চে গিয়ে বসেছি। ভাবছি একি স্বপ্ন না বিভ্রম! এই লেখক ভারতের কোনো লিটারারি মিট চোখে দ্যাখেননি। তা কলকাতা, মুম্বই, জয়পুর কিংবা দিল্লিতে হোক। এখানে যে লিটারারি মিট হয় সেখানে চলচ্চিত্র অভিনেতা, অভিনেত্রী্দের ডাকা হয় পরম আদরে। এশিয়ান লিটারারি ফোরামে সকলে কবি এবং ঔপন্যাসিক, সৃজনশীল মানুষ। কোথা থেকে কোথায় এলাম? ওরা অনেকদিন অনুসন্ধান করে আমাকে নির্বাচিত করেছেন। আমার ফোন নং কিংবা ইমেইল ঠিকানা জানতেন না। তখন ফেসবুকে খুঁজে বের করেন। অবাক অবাক। আমি নিজের উপর আস্থাবান হয়ে উঠতে লাগলাম মঞ্চে বসে। সেই ডেবরা, গোপীবল্লভপুর, হল্কা ক্যাম্প, মফসসলে দীর্ঘ ১৭ বছর বাস—— সবের পরিণতি এই! মায়ের কথা, বাবার কথা, মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল। মা আমার মাথায় হাত রেখে বলছেন, বাবুজি তোর সঙ্গে এসেছি। বাবুজি তুই স্থির হয়ে বস। চোখের কোণের দু-এক বিন্দু অশ্রু সামলাম। রাষ্ট্রপতি এলেন সঠিক সময়ে। বসলেন মধ্যমণি হয়ে। উদ্বোধন হলো তাঁর বক্তৃতায়। বক্তৃতার মূল সুর ছিল এক ঐতিহ্য, এক বিশ্ববীক্ষা, এক সভ্যতা। এশিয়া এশিয়া এশিয়া। আমি ভারতীয় পুরাণ, আদিবাসী পুরান, রামায়ণ মহাভরত থেকে উদ্ভুত মিথ, গ্রাম বৃদ্ধদের গল্পকথন, মা-ঠাকুমাদের বলা লোককাহিনি, মেঘের জন্ম, যে মেঘে বলাকারা গর্ভবতী হয় সেই মেঘের কথা, পাহাড়ের ছিন্ন ডানা মেঘের কথা, প্রাচীন উজ্জয়িনীর কথা, রাজপুত্র সিদ্ধার্থর সারথী ছন্দক এবং তাঁর ঘোড়া কন্থকের কথা বললাম। ঘোড়াটির পলায়নের কথা বললাম। অনুবাদ যন্ত্রের মাধ্যমে সকলের মাতৃভাষায় সকলের কাছে তা পৌঁছতে লাগল। করতালি। মা রাধারানিকে দেখতে পাচ্ছি আমার নামাঙ্কিত আসনে দর্শকের ভিতর বসে আছেন। মা হাততালি দিচ্ছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে কো উন এবং ডি উরাঙ্খাই আমার হাত ধরে ভেরি গুড ভেরি গুড বলতে লাগলেন। ওঁরা ইংরেজি জানেন না। নিজের মাতৃভাষায় আমার কথা শুনেছেন। সেই মুহূর্ত থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার বৃদ্ধ কবি আমার বন্ধু হয়ে গেলেন। ৪, ৫, ৬ সেপ্টেম্বর–তিনদিন দেখা হলেই হাসি, হাত মেলান, ওর সঙ্গের এক দোভাষী মহিলার মাধ্যমে কথা বলা চলতে লাগল। সেদিন দুই অধিবেশন হলো। মাঝের কফি ব্রেক এ অনেক কথা বলতে হলো তরুণ প্রজন্মের কাছে। নানা টিভি চ্যানেল এবং খবরের কাগজের প্রতিনিধি ছিলেন তাঁরা। শেষ যে সাক্ষাৎকার দিলাম তাঁর ব্যবস্থা করেছিলেন প্রধান এক টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক এক কাজাখ কন্যা। জানতাম না সকলে চলে গেছেন তখন, ক্যামেরা ম্যান দুজন, সাক্ষাৎকার নিচ্ছে যে যুবক এবং সেই কাজাখ কন্যাই রয়েছে তখন। আমি তাঁর নামটি জিজ্ঞেস করে করে বুঝতে না পেরে বললাম, তাহলে জয়িত্রী? তিনি হেসে বললেন, তাইই। তিনিই আমাকে সেই তাঁর গাড়িতে পৌঁছে দিলেন হোটেলে। দূরের শহর আলমাতা থেকে এসেছিলেন নূর সুলতান শহরে এই সম্মেলন উপলক্ষে।

সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের হোটেল রিক্সস-এ ছিল ডিনার পার্টি। ডিনার পার্টিতে আফগানিস্তান, ইরান, সমরখন্দের লেখকরা তাঁদের টেবিলে নিয়ে গেলেন। বেশিরভাগ তরুণ। রেজা মহম্মদ এসেছেন কাবুল থেকে। অসামান্য তারুণ্য তাঁর। আমি তাঁর ওস্তাদ। রেজা ইন্ডিয়া সম্পর্কে অনেকটা জানেন। রবীন্দ্রনাথ, কলকাতা, সত্যজিৎ…। পথের পাঁচালীর কথা বললেন। কথা বলতে বলতে খাওয়া। ভদকা, ঘোড়ার মাংসের ফিলেট, চিকেন, আঙুর, স্যালাড-ই খাদ্য। আমাদের ডানদিকের মঞ্চে শুরু হলো কাজাখ সঙ্গীতের আসর। সেই বাদ্যে কত রকম যে বাদ্যযন্ত্র। আমি মূর্খ সব চিনি না। লৌকিক অচেনা বাদ্য যন্ত্রই বেশি। গান ছিল না, শুধু বাদ্য ছিল। মঞ্চে যেন পরীরা নেমে এসেছিল। তাদের কত রঙের পোশাক। তাদের গান আর আবহ সঙ্গীত শুনতে শুনতে কম বয়সে শোনা রুশী ছবির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল চাইকোভস্কি বাজাচ্ছেন অন্তরাল থেকে। মনে পড়ে গেল একটা ছবির কথা, কতকাল আগে দেখেছি, জিপসি ক্যাম্প ভ্যানিশেস ইনটু দ্য ব্লু ছবির কথা। ম্যাক্সিম গোর্কির গল্প নিয়ে সেই ছবি সাবেক সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে নির্মাণ করা হয়েছিল। সে ছিল এক হৃদয় বিদারক প্রেমের কাহিনি। সুন্দরী জিপসি কন্যা রাডা এবং এক ঘোড়া চোর জোবারের প্রেম আমাদের ২৬-২৭ এ মুগ্ধ করেছিল। সেই ছবির সঙ্গীত যেন ফিরে ফিরে আসছিল। মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন তিনজন। ইয়েজিন ডোগা, ভ্যালেরি জুবকভ, ইসিডোর বারডিন। আহা হারিয়ে যাওয়া সোভিয়েত। রাশিয়ান সাহিত্য পড়েই তো বড় হওয়া। গ্রেট রাশিয়ান লিটারেচর। গ্রেট ফিল্ম। চোখের সামনে সেই জিপসি ক্যাম্প আর সেই জিপসি কন্যা ভেসে উঠতে লাগল। মাথার ভিতরে ভদকা ছিল তো। পরেরদিন সকালে লিটারারি টক। অনুবাদ যন্ত্রের মাধ্যমে শুনলাম সকলের কথা। রাশিয়ান কবি মিউজিক এবং কবিতার সংশ্লেষ ঘটাতে চান। তুরস্কের লেখক বললেন গল্পই লিখবেন। গল্পই নিঃসঙ্গ মানুষের কথা বলতে পারে। তরুণ প্রজন্ম কত প্রথা বিরোধী কথা বলতে লাগলেন। আর প্রবীণরা তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। লেখার ফর্ম এবং কন্টেন্ট নিয়ে বললেন। দুপুরে আড্ডা। কাজাখ লেখক বলছেন রাজকাপুরের কথা। বললেন এক ইরানি নায়িকার কথা। আমাদের কথা চালাচালি হচ্ছে এক কলেজ ছাত্রীর মাধ্যমে। ইরানি নন, তিনি গান্ধার দেশের কন্যা মধুবালার কথা বলছেন। ইয়েস ইয়েস। মধুবালার হৃদপিন্ডে ছিদ্র ছিল। অকাল প্রয়াণ হয়েছিল শুনে তিনি হায় হায় করতে লাগলেন। তিনি রাজকাপুর রবীন্দ্রনাথ চেনেন। ইন্দিরা গান্ধীর কথা বললেন। তাঁকেও মনে আছে তাঁর। বয়স সত্তরের উপরে। তিনি কত কথা বলতে লাগলেন কলকাতার ইন্ডিয়ান লেখকের সঙ্গে। এর ভিতরে ফোন বাজল। তিনি বললেন তাঁর স্ত্রী। স্ত্রীকে বললেন, আমার মিতরার সঙ্গে কথা বলছি। আমার মিতরা আমার বন্ধু হয়েছে। ফ্রম কলকাতা। সেদিন সন্ধ্যায় অপেরা হলে গেলাম সকলে আস্তানা অপেরার এক সঙ্গীত নাট্য দেখতে। সারা এবং বীরজাঁ, লৌকিক প্রেম কাহিনি। সেই অপেরা সাবেক সোভিয়েতের স্মৃতি আবার ফিরিয়ে আনল। গানে গানে ভরা এক আশ্চর্য উপস্থাপনা ছিল তা। মঞ্চে শাদা ঘোড়া, কালো ঘোড়া, বাদামি ঘোড়া, হাট বাজার, বাদ্যাদি, ঘোড়ায় টানা গাড়িতে ক্ষমতাবান মোড়লের আবির্ভাব, সে ভোলা যায় না।

৬-ই সেপ্টেম্বর বিকেলে অনুষ্ঠান। সারা সকাল আড্ডা। নুর সূলতান শহরের পথে হাঁটা। এদেশে আমেরিকার মতো বাম দিকে বসেন গাড়ির চালক। তবে সে দেশের মতো ডিরেক্ট কারেন্ট, তাপমাত্রা সেলসিয়াসের পরিবর্তে ফারেনহিটে মাপা হয় না। বার্মিজ লেখিকার সঙ্গে আলাপে আমি শরৎচন্দ্রের কথা বললাম, পথের দাবী উপন্যাসের কথা। বললাম সুভাষচন্দ্রর কথা। বার্মা যা এখন মায়নামার থেকে আজাদহিন্দ বাহিনীর মণিপুরে প্রবেশের কথা। তিনি সমস্তটা জানেন না, কিছুটা জানেন। তবে আমি যখন বলেছি রেঙ্গুন এক সময় বাঙালির উপনিবেশ ছিল, তিনি তা জানেন, বললেন। ইরানের কবি ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের অনুরাগী। তিনি কৌশিকী চক্রবর্তী অবধিও জানেন। আর রবীন্দ্রনাথ। কলকাতায় যদি আসতে পারেন, রবিন্দ্রনাথের বাড়িও যাবেন বললেন। জাতিটিই আনন্দময়। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমান অধিবাসীর দেশ কিন্তু খোলা মনের। শিল্প বোধের চূড়ান্ত প্রকাশ দেখলাম সেই থিয়েটারে। এখানে যত্রতত্র দেবালয় তা মসজিদ হোক, গির্জা হোক নির্মাণে নিষেধ আছে। সরকার অনুমতি দিলেই করা যায়। ব্যালে, থিয়েটার, অপেরা, গান নিয়ে সে দেশ যেন শান্তির দেশ। কদিন ধরে দোভাষীর মাধ্যমে আলাপ করেছি কাজাখ, রুশ, বার্মিজ, ইরান, শ্রীলঙ্কার লেখকের সঙ্গে। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের শহর, সত্যজিৎ রায়ের শহর থেকে গিয়েছি বলে আমাকে বাড়তি খাতির করেছে। টেগোর বলতেই কপালে হাত। আর রাজকাপুরের ছবির স্মৃতি মেলে ধরেছেন প্রবীণ রুশ এবং কাজাখ লেখকরা। হ্যাঁ, জয়িত্রীও জিজ্ঞেস করেছে রবীন্দ্রনাথের শহর নিয়ে। রামায়ণ মহাভারত নিয়ে। মেঘের জন্ম নিয়ে। শেষদিনে হোটেল আল ফারহাতে ডিনার ছিল। তার আগে ঘন্টা দুই ধরে এই সাহিত্যোৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠান হলো। সেই অনুষ্ঠান ছিল বর্ণময়। গান বাজনা আর ব্যালেতে। অংশগ্রহনকারী লেখকদের সম্মানিত করা হলো স্মারক দিয়ে। স্মারক দিলেন দুই মন্ত্রী। তাঁদের নাম ধরে ডাকা হলো। তাঁরা উঠে এলেন মঞ্চে। আমি ভাবছি আমাদের দেশ হলে কী হত? মন্ত্রী দর্শকাসনে বসে আছেন মাঝের কোনো সারিতে। আমি বসে আছি, আমার সঙ্গী লেখকরা বসে আছে সামনের সারিতে। মন্ত্রী আর সাধারণ দর্শকে বিশেষ তফাৎ নেই। সমাপ্তি অনুষ্ঠানের নৈশভোজে আমার সঙ্গী ওমান, আরব, জর্ডনের লেখকরা। মাঝরাতে এয়ারপোর্ট যেতে হবে, আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম ঘুম হবে না ভেবে। তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরব। নানা কথা হচ্ছিল। কার্ড বিনিময় হচ্ছিল। এক তরুণ কাজাখ লেখক এসে আলাপ করলেন। কী ভাবে গল্প লিখি তা জিজ্ঞেস করলেন তিনি। বয়স হবে বছর পঁয়ত্রিশ। চমৎকার গল্প হলো তাঁর সঙ্গে। তখন আমার নাম ধরে ডাকা হলো। হ্যাঁ, আমার নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। আমাকে আহ্বান করা হচ্ছে। আমি গেলাম একটি টেবিলের সামনে। আমার জন্য চেয়ার। একটি কাগজ এবং কলম রয়েছে। বলা হলো আমার প্রতিক্রিয়া লিখে দিতে। আমিই প্রথম লিখলাম। জনা পনের লেখকের প্রতিক্রিয়া নেওয়া হলো। প্রতিক্রিয়া লেখার পর আমি ফিরতে চাইলাম। নিচে নেমে এলাম। দেখলাম একটি বাস চলে যাচ্ছে। হোটেলের নিরাপত্তারক্ষী আমাকে লাউঞ্জে বসতে বললেন। পরের বাস এলে আমি যাব। কিন্তু আমি দেখছি কে যেন ছুটে আসছে। বাসটি দাঁড়িয়েছে। জয়িত্রী। অমর দাঁড়িয়ে আছে তা দেখেছে সে। সে আমাকে বাসে তুলে দিল। সে উঠল না। তার জায়গাটিই আমাকে দিয়ে নেমে গেছে। আমি বিদেশি অতিথি। বাস চলতে আরম্ভ করল। জয়িত্রী যেন মিলিয়ে গেল নীলের ভিতর। সে ছিল যেন এক জিপসি কন্যা। ৭ তারিখ শেষ রাতে, রাত সাড়ে চারটের উড়ানে আমরা নিজ নিজ দেশের দিকে যাত্রা করেছিলাম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *