কল্যানী মিত্র ঘোষ
কথা ছিল সকাল সকাল বেরিয়ে Bristlecone Pine এর জঙ্গলে যাওয়া হবে পৃথিবীর প্রাচীনতম গাছেদের সঙ্গে মোলাকাত করতে। এদের একেক জনের বয়স চার হাজার বছরেরও বেশী। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগো থেকে গরমের ছুটিতে বেড়াতে যাবার পক্ষে অতি উত্তম জায়গা হলো ম্যামথ লেক অঞ্চল। Inyo National Forest এর মধ্যেই এই অঞ্চলটি অবস্থিত, এর প্রধান আকর্ষণ হলো অসংখ্য হ্রদ। যেগুলো বরফ গলা জলে পুষ্ট, চারদিক সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা আর সব থেকে বড় কথা হলো জায়গাটি সমুদ্রতল থেকে প্রায় আট হাজার ফুট উঁচুতে। কাজেই গরমে যে ভারী মনোরম আবহাওয়া পাওয়া যাবে তা বলাই বাহুল্য।
আমরা থাকি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের দক্ষিণে স্যান ডিয়েগো কাউন্টির অন্তর্গত ভিস্তা শহরে। মেয়ের স্কুলের ছুটি পড়তেই আমাদের ম্যামথ লেক যাওয়ার পরিকল্পনা পাকা হয়ে গেল। আমাদের চার জনের সংসার, কর্তা, গিন্নী ও সপ্তদশী কন্যা ছাড়াও আমাদের সঙ্গে থাকেন আমার মা, যিনি আশির কোঠা পেরিয়ে একটু নড়বড়ে হয়ে পড়েছেন। আমাদের জন্য তাই গাড়ি করে লং ড্রাইভে যাওয়াই সব থেকে সুবিধাজনক। যেতে প্রায় আট ঘণ্টা লাগল। মাঝে দু’বার থেমে মধ্যাহ্নভোজন ও চা পর্ব সেরে নেওয়া হয়েছিল। ম্যামথে যে বাড়িটি এক সপ্তাহের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল সেখানে পৌঁছতে প্রায় রাত বারোটা হয়ে গেল। আসার পথে রেস্টুরেন্ট থেকে তুলে নেওয়া পাস্তা খেয়ে সে রাত্রে সকলের ক্লান্ত, অবসন্ন দেহ বিছানায় এলিয়ে পড়ল।
পরদিন ঘুম ভাঙল ঝর্ণার কুলুকুলু শব্দে, ছুট্টে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বিশাল পর্বত রাজির তুষার ধবল শৃঙ্গ আর সেই পর্বতমালার কোনো একটা থেকে বরফ গলে ঝর্ণা হয়ে নেমে এসেছে ঠিক আমাদের বারান্দার সামনে, কোথাও না বেরিয়ে সারাদিন এই বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। ঝর্ণার ওধারে রহস্যময় ঘন জঙ্গল। সেখানে অজস্র পাখি ডাকছে, পাশের গাছে দুটো কাঠঠোকরা ব্যস্ত সমস্ত ভাবে ঠক ঠকা ঠক করেই চলেছে। এক কথায় সকালটা ঝলমল করে উঠল। সেদিন আমরা একটু ধীরে সুস্থে এদিক ওদিক ঘুরবো ঠিক করলাম। চারিদিকেই ছড়িয়ে আছে ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের নমুনা, সব দেখতে হবে একে একে। ভূগোল বইয়ের পাতা থেকে যাবতীয় বিস্ময় আমাদের চোখের সামনে।
প্রায় ৭৮০০ বছর আগে নেটিভ আমেরিকানদের দুই পূর্ব প্রজাতি Paiute এবং Shoshone এখানে বসবাস করতে শুরু করে। এর বহু যুগ পরে ম্যামথ খনি কম্পানি ব্যবসা শুরু করে কিন্তু প্রবল তুষারপাতের জন্য তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অবশেষে খনির কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। পরে কিছু খুচরো খাচরা খনি এদিক সেদিকে গড়ে ওঠে এবং একসময় খনিতে সেই “সোনা ও রূপো” লাভের আশায় প্রচুর শ্রমিক এসে জড়ো হয়। সেই খনিও দেখতে যাবো আমরা। ধীরে ধীরে এই ম্যামথ অঞ্চল কিভাবে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ালো সেটা সত্যিই গল্পের মতো। বর্তমানে এই অঞ্চলটি স্কি, স্নো বোর্ডিং ইত্যাদি বরফের ওপর খেলাধুলার জন্য বিখ্যাত। দ্বিতীয় দিনে আমরা গণ্ডোলা চেপে ১১০০০ ফুট উচ্চতায় উঠে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে এলাম। আগের দিন এখানে একটি জঙ্গলে আগুন লাগে (দাবানল) দেখলাম তার ধোঁয়া বরফ আর মেঘের মধ্যে স্তম্ভের মতো বিরাজ করছে, বিস্ময়ে হতবাক হলাম প্রকৃতির এই ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ দেখে। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আর তেমন কিছু করার থাকে না, আমরা তখন বাজারে টুকটাক কেনাকাটা করি এবং রাতের খাবার কিনে বাড়ি ঢুকে আসি। তৃতীয় দিন আমরা যাবো পৃথিবীর প্রাচীনতম গাছের জঙ্গল দেখতে।
সকালের জলখাবার আমি বাড়িতেই বানিয়ে নিলাম। দু কামরার বিশাল বাড়ি আর সুন্দর সাজানো রান্নাঘর, এমন একটা জিনিস নেই যা সেখানে পাওয়া যাবে না। তবে প্রতিদিন নিজেদেরই সব ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখতে হবে, ভ্যাকুম ক্লিনার, ডিশ ওয়াশার এবং ওয়াশার ড্রায়ার সব রয়েছে, বেড়াতে এসেও বাড়ির সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্য মজুত। পেটভরে জলখাবার খেয়ে দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলের উদ্দেশ্যে কিন্তু হঠাৎ মাঝপথে কর্তার তাগাদায় আমাদের নেমে পড়তে হলো গাড়ি থেকে, উনি এই বিশেষ স্থানটি আমাদের কন্যাকে দেখাতে চান, বললেন খুব জরুরী। আমি একটু অবাক হয়েই ওঁকে অনুসরণ করলাম, একটু বিরক্তও হলাম হঠাৎ প্ল্যান বদলে যাওয়ায়, এর ফলে পাহাড়ে চড়তে দেরী হয়ে যাবে এবং জঙ্গলে একটু অন্ধকার হলেই আর কিছু দেখা যায় না।
গাড়ি পার্ক করেই সামনে একটা ভিজিটর সেন্টারের মতো কিছু দেখতে পেলাম। কাছে গিয়ে পড়তে পারলাম সেটার নাম Manzanar National Historic Site. এই জায়গার নাম আমার জানা ছিল না, ভেতরে ঢুকলাম আগ্রহের সঙ্গে আর সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করলাম এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। এমনিতেই এদেশে যে কোনো মিউজিয়াম বা দ্রষ্টব্য স্থানে কোনো কোলাহল থাকে না তবু একটু মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়, পরিবারের সকলে নিজেদের মধ্যে কথা বলে কিন্তু এই হলের ভেতরে যেন একটা ছুঁচ পড়লেও আওয়াজ হবে। পর্যটকদের বেশিরভাগ দেখলাম এশীয়। পড়তে শুরু করলাম বিস্তারিত বর্ণনা এবং শিউরে উঠলাম। এই জায়গায় ১৯৪২ সালের এক বসন্তকালে দশ হাজার জাপানিকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু আগে থেকেই রাজনীতিক এবং শ্রমিক নেতারা এশীয় বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মতবাদ প্রচার করতে শুরু করে। এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের আমেরিকান নাগরিকত্ব প্রদান করতে অস্বীকার করে, এমন কি তাদের জমির অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। ১৯৪১-এ জাপান যখন পার্ল হার্বারে আক্রমণ করে তখনই আমেরিকান সরকারের পুঞ্জীভূত ক্রোধের শিকার হয় ওই জাপান থেকে আসা অভিবাসী ও তাদের বংশধরেরা। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রোজাভেল্ট ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২-এ আদেশ জারি করেন কোনো একজন বা সমস্ত ব্যক্তি (any or all persons) যাঁরা জাপানি বংশোদ্ভূত তাঁদের যেন আমেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে অবিলম্বে উৎখাত করা হয়।
নিমেষের মধ্যে সেনাবাহিনী ক্যালিফোর্নিয়ার মানজানার শহরটিকে একটি ক্যাম্পে পরিণত করে ফেলে যেখানে দশ হাজারেরও বেশি জাপানি আমেরিকান এবং অভিবাসী জাপানিদের বন্দী করে রাখা হয়। তাদের মা বাবা জাপানে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এই অপরাধে আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী আমেরিকান নাগরিকদেরও সেখানে বন্দী করা হয় যা পুরোপুরি সংবিধান বিরোধী। সব থেকে অপমানজনক উক্তিটি করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল L DeWitt, তাঁর আদেশে পশ্চিম উপকূল থেকে প্রায় প্রতিটি জাপানিকে তুলে নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দী করা হয়, আনুমানিক সত্তর হাজার জাপানি ছিলেন জন্মসূত্রে আমেরিকান। তাঁদের বন্দী করার স্বপক্ষে ডেউইট যুক্তি দিয়েছিলেন, “you just can’t tell one Jap from another .. they all look the same .. A Jap’s a Jap.’
এর চেয়ে ঘৃণ্য ও অমানবিক মন্তব্য বোধকরি আর কিছুই হতে পারে না।
সেই সব অসহায় মানুষেরা এসে ছিলেন শহর বা ক্ষেত খামার থেকে, বৃদ্ধ অথবা যুবক, ধনী অথবা দরিদ্র, সকলে। রাতারাতি তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল, স্কুলের ক্লাসরুম শূন্য করে ছেলেমেয়েদের তুলে আনা হলো, পরিবার ও বন্ধুবর্গ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমেরিকার তদানীন্তন সরকার শেষ অবধি প্রায় ১,২০,০০০ মানুষকে তাদের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করল যাদের মধ্যে অর্ধেক ছিল শিশু এবং কিশোর। এই মানজানার ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল দশ হাজার বন্দীকে এবং তাদের প্রত্যেকের বন্দীদশা বলে চলে দশ হাজার গল্প।
আমরা তিনজন নিঃশব্দে হেঁটে চললাম এক ঘর থেকে অন্য ঘরে। বড় হল ঘরটির ভেতরে অনেকগুলো ঘর, তাতে সেই দুঃসময়ের অসংখ্য ছবি বর্ণনা সহ। একটি ঘরে ঢুকে কান্না চেপে রাখতে পারলাম না, সেটি শিশুদের খেলার ঘর, দেয়ালে নিষ্পাপ কয়েকটি দেবশিশুর মুখ, ঘরে কয়েকটি ছোট বিছানা, পুতুল এবং বইপত্র। যা কিছু তারা এক দিনে নিজেদের সঙ্গে আনতে পেরেছিল। সব কিছুই ঠিক সে ভাবেই সংরক্ষিত রয়েছে। স্পিকারের ভেতর থেকে ভেসে আসছে তাদের কন্ঠস্বর, কাশির শব্দ, চাপা কান্না ও মায়েদের সান্ত্বনা। টাইম মেশিনে চেপে পৌঁছে গেলাম সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকার সময়ে। গোটা হল ঘরের আলোগুলো ম্রিয়মান, যেন অশ্রুসিক্ত। একটা চেয়ারে বসে রইলাম অনেকক্ষণ।
বাইরে বেরিয়ে একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল, পঁচানব্বই বছর বয়সী শ্রীমতি ফুমিকো হায়াশিদা “let not happen again” প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন ওয়াশিংটনে, তিনি তাঁর কন্যাকে নিয়ে ১০০ বছর বয়সে মানজানারে ফিরে আসেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম বার, সেই ছবিটির পাশে ইনসেটে রয়েছে ১৯৪২-এ এই ক্যাম্পেই তাঁর শিশুকন্যা কোলে নিয়ে ১৯৪২ সালের একটি ছবি। এই ছবিটি পরে একটি প্রতীকী ছবি হয়ে দাঁড়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি আমেরিকানদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে। এই ক্যাম্পে যত পর্যটক আসেন তাঁরা কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে আছেন এই জায়গার সঙ্গে। শুধু জাপানিরাই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জাতিভেদ ও নানাবিধ বৈষম্যের শিকার এমন অসংখ্য মানুষ ফিরে ফিরে আসেন এই ক্যাম্পে যেখানে তাঁরা ওই দশ হাজার অসহায় জাপানি আমেরিকানদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন।
১৯৮০ সালে আমেরিকান কংগ্রেস অনুমোদিত একটি কমিশন এই জঘন্য ঘটনাটিকে জাতি বিদ্বেষ, উন্মাদোচিত আচরণ এবং রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতা বলে অভিহিত করে। আমেরিকান সরকার তাঁদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত লাগাতার প্রায় ৮২০০০ চিঠি পাঠান সমস্ত জাপানি আমেরিকান পরিবারদের, প্রায় ২০০০০ ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় প্রতিটি ব্যক্তি কে। জর্জ বুশের স্বাক্ষরিত সেই চিঠি পেয়ে অনেকেই তাঁদের মনের ভার কিছুটা হলেও লাঘব করতে পেরেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন কিন্তু মানজানার তাঁদের মনে এবং আমেরিকান সরকারের রাষ্ট্রনীতিতে একটি দগদগে ঘা হিসেবেই ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে রইল।
রোদ পড়ে আসার কিছুক্ষণ আগে আমরা বেরিয়ে এলাম ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায় থেকে। ফেরার সময় আমরা তিনজনই নিশ্চুপ। এরপর আমরা যাবো প্রায় পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন কিছু মহাবৃক্ষের জঙ্গলে যার নাম আগেই বলেছি, Bristlecone Pines, কিন্তু সে গল্প আরেকদিন হবে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
ট্র্যাভেলগের প্রথম পর্বে ভৌগলিক বর্ণনা র আস্বাদ পেয়ে খুব পুলকিত হচ্ছিলাম কিন্তু শেষের দিকে অমন করুণ, যন্ত্রণাদায়ক কাহিনীতো স্তব্ধ হয়ে গেলাম রে,এ-ই বোধহয় হরিষে বিষাদ..