ফায়ার আইল্যান্ড
রূপা মজুমদার

গ্রীষ্মকাল উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারীদের কাছে বড়ই আদরনীয়, গ্রীষ্ম পরলেই তারা আনন্দে ও উৎফুল্লতায় ভেসে বেড়ায়। পত্রবিহীন শুকনো গাছগাছালি আবার যেন নবযৌবনে পদার্পন করে, কত রং কত জাতের ফুল জেসমিন লিলি ওক আর আছে নানা রংয়ের গোলাপ। সে যে আমেরিকার জাতীয় ফুল, তার কদরই আলাদা৷ এই সময় আমেরিকায় হয় চেরি ফুলের উৎসব৷ এখানে বসন্ত আর গ্রীষ্ম মিলেমিশে থাকে, এই আবহাওয়ায় হালকা গোলাপি চেরি ফুল ছেয়ে যায় সারা শহরে৷
মেঘমুক্ত নীল আকাশে, এই দেশেও কাশফুল ফোটে দেখে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। রকঅ্যায়ে বীচ আর কুনি আইল্যান্ড ঘুরতে গিয়ে, চোখে পরল ঝারে ঝারে কাশবন৷ কাশের ঝার সমুদ্রের হাওয়ায় দোল খাচ্ছে৷ বেশ কয়েকবার আসা হয়ে গেল আমেরিকায় বিভিন্ন রাজ্য ঘোরাও হয়ে গেছে। ইস্ট কোস্টের ওয়াশিংটন ডিসি, ভার্জিনিয়া, ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভেনিয়া, কানেকটিকাট, নিউজার্সি, বাফেলো আর এদের সাথে নিউইয়র্ক তো আছেই।
আজ আমরা চলেছি লংআইল্যান্ডে দ্বীপ দর্শনে, নিউইয়র্ক শহরের সঙ্গে এই জায়গার সুন্দর রেল যোগাযোগ আছে, আমরা অবশ্য যাচ্ছি গাড়িতে। লংআইল্যান্ড নিউইয়র্ক শহরের উপকূলবর্তী একটি দ্বীপ৷ দ্বীপটি হাডসন নদীর মোহনা নিউইয়র্ক উপসাগর থেকে শুরু হয়ে উত্তর পূর্বে কানেকটিকাট সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত৷ আমেরিকার কিছু ধনী সম্প্রদায়ের বাস এখানে, অনেকটা জমি নিয়ে এদের কটেজগুলি, বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে দামি দামি গাড়ি অডি, বিএমডব্লিউ আর নানা রঙের রেসিং কার, ঘোড়া বাঁধা আছে কিচেন গার্ডেনের একধারে৷ চোখ জুড়িয়ে যায় ফুলের বাগান দেখলে৷ বাড়ির মাচাতে আঙুরলতা আর টুকটুকে লাল আপেল ঝুলছে৷ এই অঞ্চলের বাড়ির দামও অনেক, সরকারী ট্যাক্স রেটও হাই৷
লং আইল্যন্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কয়েকটি দ্বীপ৷ আমরা এখন চলেছি একেকটি দ্বীপের সন্ধানে, রাস্তাঘাট মসৃন রাস্তার দুধারে পাইন ওক ম্যাপেল গাছের হালকা বোন, এদেশের মানুষরা গাছ কাটে না বরং বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে এখন এদেশে সামার তবু আবহাওয়া বসন্তের রেশ, গাছে ভরা ফুল হাওয়ায় দোল খাচ্ছে,চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে।
এখন আমরা এসে পৌঁছেছি ম্যাসহোম্যাক বনভূমিতে, এটি শেল্টার আইল্যান্ড বা আশ্রয় দ্বীপের একটি অংশ৷
ম্যাসহোম্যাক কথাটির মানে ‘জলপথে যেখানে যেতে হয়’, এই বনভূমির প্রথম আদিবাসী উইলিয়াম নিকেল৷ বনভূমিটির আয়তন ১১ মাইল, যাকে ঘিরে আছে বিস্তীর্ণ তটরেখা জলাভুমি আর খাঁড়ি৷ বনভূমির পথে আছে একটি অতিথিশালা, অতিথিশালার সংলগ্ন একটি ছোট্ট সংগ্রহশালা, তাতে সাজানো আছে নানারকম পাখি ও জন্তুজানোয়ারে ছবি ও কিছু বন্যপ্রানীর নমুনা৷ এই বনভূমিতে ঢুকতে কোন প্রবেশ মূল্য লাগে না, গাড়ি রাখারও সুবন্দোবস্ত আছে৷
এই বনভূমির বিশেষত্ব হল বন পথে হারিয়ে যাওয়া, চারিদিকে শূনসান মানুষের মুখ খুব কমই দেখা যায়। একটু এগোলেই জলাশয়। আসলে এটা একটা খাঁড়ি। দূরে দেখা যাচ্ছে আটলান্টিক বে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেসে উঠেছে কয়েকটি দ্বীপ৷ এদিক সেদিক ঘুরে আমরা বেড়িয়ে এলাম ম্যাসহোম্যাক বনভূমি থেকে৷
এবার আমাদের গন্তব্য শেল্টার আইল্যান্ড বা আশ্রয় দ্বীপ৷ নিউইয়র্ক শহর থেকে নব্বই মাইল দূরে অবস্থিত এই দ্বীপটি, আয়তন ২৭ স্কোয়ার মাইল, তটভূমি আর জলাভূমি ঘিরে রেখেছে এই দ্বীপটিকে৷ পাসেই ডারনিং হারবার। এখানকার বিশাল এগ ফার্ম, নাম ক্যাকল হিল৷ দক্ষিণে আছে সন্টক্লেয়ার কলনির গা ঘেঁষে পিকোনিক উপসাগর, ঢেউ আছড়ে পড়ছে তটভূমিতে৷ এই অঞ্চলে এক সময় বিখ্যাত প্লাই মাউথ কোম্পানির প্রচুর জমি জায়গা ছিল৷ তটভূমিতে ছড়িয়ে আছে নানা রঙের ঝিনুক, যা কুড়ানোর আনন্দই আলাদা৷ শেল্টার আইল্যান্ডে হিস্টরিকাল সোসাইটিতে রাখা আছে অসংখ্য মানচিত্র ইতিহাসের জীবন্ত দলিল আর অচেনা স্থাপত্য৷

আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে সামনেই পিকোনিক উপসাগর, নানা রঙের নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে সাগরের বুকে, চলেছে নৌ দৌড়ের প্রতিযোগিতা। নানা বয়েসের ছেলেমেয়েরা অংশ গ্রহণ করেছে, তাদের পোশাক-আষাকও রংবাহারী। জলে একটি লঞ্চ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার কাজ জলে কোন অঘটন ঘটলেই ত্রাণকর্তার মতো পৌঁছে যাবে সেখানে৷ আমরা এখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি অদূরে কানেকটিকাট শহরতলী। ফেরি সার্ভিস আছে এপার ওপার করার জন্য৷
এবার আমরা চলেছি অন্য আরেকটি দ্বীপের সন্ধানে। ফায়ার আইল্যান্ড। পাইন আর চেরির জঙ্গলে লুকিয়ে আছে এই দ্বীপটি। নিউইয়র্ক শহরের ব্যস্ত জীবনের চাপ এড়িয়ে অনেকেই শান্তির খোঁজে চলে আসে এই দ্বীপটিতে। পাশেই আছে রবার্ট মোসেস ষ্টেট পার্ক ও সানকিন অরণ্য আর আছে কয়েকটি পিকনিক স্পট৷ এই দ্বীপটির আকর্ষণ ক্যানো ট্যূর। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নানান দ্বীপে ঘুরিয়ে আনে। চারজন বসতে পারে এই নৌকায়৷ স্থানীয় উপকূলবাসীরা বছরের নানা সময় নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে থাকে৷ থ্যাঙ্কস গিভিং ডে তে বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা বের হয়৷
এই দ্বীপটির আরেক আনন্দের উৎস অতি আধুনিক এক নাইট ক্লাব৷ নাইট ক্লাবটির পাশেই আছে ছোট ছোট রেস্তোরা। ভোজন রসিকদের কাছে বড়ই প্রিয়। সেখানে খুব উচ্চমানের ও সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করা হয়, চেরি গ্রোভে বসে ওয়াইন বা স্কচ পান করতে করতে আতলান্তিকের বুকে সূর্যাস্ত দেখার আমেজই আলাদা।
বছরে কিছু সময় ফায়ার আইল্যান্ডে ফেরি সার্ভিস বন্ধ থাকে। সেই সময় উপকূলবাসীরা মাছ ধরায় মেতে ওঠে। এখানে শিশু ও কিশোরদের মাছ ধরা শেখানোর ক্লাব আছে৷ নানা জাতের মাছ পাওয়া যায় এই উপসাগরে৷ নামও তাদের বিচিত্র সামার ফ্লাউন্ডার, উইন্টার ফ্লাউন্ডার, ব্লু ফিস, উইক ফিস, টাউট, ব্লাকসি বাসা আরো কত রকমের মাছ আতলান্তিকের অতলে ঘুরে বেড়ায়৷ এদেশের মানুষজনের মাছ খাওয়ায় কোন বাদবিচার নেই। ফ্রাই বা গ্রিল করে নানা রকম সস্ ঢেলে পানীয়র সঙ্গে টপাটপ খেয়ে নেয়৷
এটি এমন একটি দ্বীপ যেখানে সুদীর্ঘ গাড়ি পথ আছে তবু আমরা গাড়ি পার্কিং জোনে রেখে পদব্রজে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য ফায়ার আইল্যান্ড লাইট হাউস দর্শন। যে পথ দিয়ে আমরা চলেছি সেটি কাঠের পাটাতন দিয়ে নির্মিত ,বলা হয় বোর্ডওয়াক,মাইলের পর মাইল হাঁটার রাস্তা। কাঠের পথে দুদিকে হালকা জঙ্গল। নানা জাতের হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ জঙ্গলের ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি উপসাগরের জলোচ্ছাস। মৃদুমন্দ হাওয়ায় এই দুলকি চালে চলার আনন্দই আলাদা। আমাদের আগে পিছে স্টলার চেপে চলেছে শিশুরা বাবা মায়ের সঙ্গে। কোন স্টলারে একাধিক ক্ষোপ আছে। যাদের একের বেশী সন্তান একেকটি শিশুকে একেক ক্ষোপে বসিয়ে দিয়েছে৷ পাশ দিয়ে কিশোর কিশোরীরা হুস হুস করে সাইকেল চালিয়ে চলে যাচ্ছে। তাদের ট্র্যাক আলাদা৷ এই বোর্ডওয়াক দিয়ে আমরা যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই যেন লাইট হাউসটি কাছে চলে আসছে। এখন আমাদের নাগালের মধ্যে৷
১৮২৬ সালে এই লাইট হাউসটি নির্মিত হয়। উচ্চতায় ৭৪ ফুট। কানেকটিকাট নদীর নীলপাথর ব্যবহার করা হয়েছে এর নির্মাণকাজে। বহু ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই লাইট হাউসটি। পরে আবার এটি নবনির্মিত হয়। তখন এর উচ্চতা বাড়ানো হয় ১৬৪ ফিট। খরচ হয়ে ছিল কয়েক লক্ষ ডলার। এর গম্বুজে ফ্রেসলেন লেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। তার থেকে বিচ্যুত হয় আলোক রশ্মি। সেই আলো উপসাগরের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়৷
ফায়ার আইল্যান্ডের বিস্তীর্নতা দেখতে গেলে এই গম্বুজে উঠলেই টপভিউ পাওয়া যায়৷ ১৮২টি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে হয়৷ ইউরোপ থেকে যে সব জাহাজ জলপথে নিউইয়র্ক বন্দরে আসতো ফায়ার আই্ল্যান্ডের লাইট হাউসটি ছিল প্রথম তটভূমির নির্দেশিকা। আমেরিকার ইতিহাস বলে এইটি আমেরিকার প্রথম লাইট হাউস৷
লাইট হাউসের সীমানা পেরিয়ে একটু হাঁটলেই তটভূমিতে জলোচ্ছাস আছড়ে পড়ছে। তার পাস দিয়ে সুন্দর বালির পথ। দূরে দেখা যাচ্ছে একটি ছোট টাউন। সাগর ঘিরে রেখেছে তাকে। বাড়ি ঘর হোটেল রেস্তোরা সব রংই সাদা। এর নাম কিসমেট আইল্যান্ড, রহস্যময় এক দ্বীপ।
এখন অস্তমিত সূর্য সাগরের জলে সান্ধ্য স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আস্তে আস্তে সাগরে ভাসমান ফেরি আর জাহাজের গায়ে আলো জ্বলে উঠলো। লাইট হাউস থেকে আলোক রশ্মি বিচ্যুত হলো সাগরের জ্বলে৷ আলো আঁধারীতে হয়ে উঠলো এক মায়াময় পরিবেশ৷ আমরাও বিদায় জানালাম এই মোহময় দ্বীপটিকে। আমাদের গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল শহর অভিমুখে৷

ভাল লাগল