তাপস কুমার রায়
জাপানী উপকথার এক বিশাল পাখির নাম ফেঙ। ফেঙ সারা গায় রোদ ঢেলে সূর্য কে শুষে নিয়ে পৃথিবীকে কালো করে শুয়ে থাকে শান্ত নীল ভারত মহাসাগরের ঘোর পশ্চিমে জেঙ্গু নামে এক দ্বীপে। এই জেঙ্গু প্রাচীন আরবদের কাছে হল ঝিন্দ। ওরা এক নিঃশ্বাসে বলত হিন্দ সিন্দ আর ঝিন্দ। এই ঝিন্দ আবার এক কালের ভাস্কোদাগামার মতো ইউরোপিয়ানদের কাছে জাঙ্গি বারা। সেই জেঙ্গু বা ঝিন্দ বা জাঙ্গি বারা হল আজকের জানজিবার। জাঙ্গি মানে কালো আর বারা মানে যেখান থেকে দেখা যায়। মানে যেখান থেকে কালোদের জমি বা আফ্রিকা দেখা যায়। অন্ধকার মহাদেশ আফ্রিকার পূব-কোল ঘেঁষে শুয়ে থাকা ছোট্ট দ্বীপ জানজিবার। আর জাঞ্জিবারের পেটের কাছে সবুজ ঢেউয়ের গা ঘেঁসে পাথরের দেওয়ালের ছোট কেল্লা শহর পাথর টুলি।
এখন গাঢ় রাত। ম্লান চাঁদ উঠে বসে আছে এই পাথুরে শহরের মাথায়। পূর্ণিমা গেছে কদিন আগে। দুশো তিনশো এমনকি চারশো বছরের পাথরের বাড়ি গির্জা ফোর্ট দাঁড়িয়ে আছে একে অপরের গায়ে গা লাগিয়ে। ঘুম আসেনা আমার। জেট-ল্যাগ নাকি পাথরের নিচে চাপা পড়া কান্নারা আমাকে জাগিয়ে রাখে। মহাসাগরের ছন্নছাড়া হাওয়া আর মৃদু ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে বেড়ায় কান্নাগুলোকে। হাজার বছরের হাহাকারের ইতিহাস বুকে নোঙ্গর ফেলে। ছপ ছপ দাঁড় ভাঙে কান্না ভরা ধউগুলো ঢেউয়ের তালে এ অনন্ত রাতে।
একেকটা মানুষ তার জীবনে কতো কিছুই না দেখে। একটা দেশ নিজের জীবনে দেখে আরও অনেক বেশি। আর তা যদি দেশ না হয়ে হয় ভূখণ্ড তাহলে তার অনুভব অন্যরকম ব্যাপ্তি পায়। ভূখণ্ডের দেশ-কাল-পরিচয়-মানুষ বদলাতে থাকে। ভূখণ্ড শুয়ে থাকে দারুচিনি বনানীর ফাঁকের নির্জনতা বুকে নিয়ে – নির্বিকার। অনন্ত আকাশের নিচে শুয়ে শুয়ে ভাবে – এ পৃথিবীর রনরক্ত সফলতা সত্য তবু শেষ সত্য নয়। আরও এক অপার বিস্ময় অপেক্ষা করে থাকে – ইতিহাস যার কিছুটা জানে, কিছুটা পর্যটক সময় জানে, আর বাকিটা হয়ত কেউ জানেনা। জানবেও না কোনোদিন। কিছু কিছু ভূখণ্ডের জীবন সত্যিই অন্যরকম। অনেকগুলো ছোটো আর দুটো বড় দ্বীপ নিয়ে জানজিবার। দুটো বড় দ্বীপের একটা উজুঙ্গানি আরেকটা পেম্বা। এই উজুঙ্গানির কথা মেগাস্থেনিস লিখেছিলেন, হয়তো বা লেখেননি। উজুঙ্গানি আর পেম্বা একসাথে দেখলে মনে হয় একটা গোটা দ্বীপ।
মানুষের ইতিহাস একটা টানেলের মত। প্রস্তর যুগ এলো আর গেলো। ঘর খোঁজা মানুষ ঘর বানাতে শিখল। যেসব আফ্রিকান মানুষ হাজার হাজার বছর বসবাস করতো পেম্বা উজুঙ্গানিতে তারা গাছের ডাল মাটি আর সমুদ্রের ঝিনুক জড়ো করলো। সেই দিয়ে একদিন ঘরও বানাল। রাতের আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে তারা গোনা বন্ধ হল। আরেকদল অন্য কোথাও এই তারা গোনা রাতের আকাশের নিচে নিজেদের ঘর বাড়ি ফেলে ডিঙ্গা ভাসাল। সাগরের জলের ঢেউ গুনতে গুনতে ক্লান্তি এলে আকাশের তারা গুনত। একদিন বর্ষার কালো মেঘ তারাদের ঢেকে দিলো। সেইসব ক্লান্ত নাবিকরা ভারতের, সেইসব ক্লান্ত নাবিকরা আরবের, বর্ষায় তারা না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ভেসে এলো। কেউবা এলো বাণিজ্য বা বন্দরের খোঁজে। সারাটা বর্ষাকাল এই মাটি গাছ ঝিনুকের ঘরগুলো হয়ে উঠলো ওদের আশ্রয়। কেউ কেউ আবার পুরো বর্ষাকালটা কাটিয়ে দিতো আফ্রিকান বান্টু বলা নরম মহিলাদের গা ঘেঁষে। বর্ষা চলে গেলো, সাথে নিয়ে গেলো নীল-সবুজ ভারত মহাসাগরের ওপর আকাশের ছাই কালো মেঘ। আর নিয়ে গেলো সেইসব নাবিকদের। নীল আকাশে শরতের সাদা মেঘে মন কেমন করা ঘরে ফেরার তাগাদা। কে আর এড়াতে পারে। পিছনে পরে রইলো তাদের নিশান। বান্টু নারীর জঠরে বাড়তে থাকা ভিনদেশি বীজ। বদলে গেলো ক্রমে জানজিবারের মানুষ। আফ্রিকান আরব ভারতীয় মিশে হয়ে গেলো জানজিবারই। ভাস্কোদাগমার নৌকোয় চেপে একদিন এলো ইউরোপিয়ানরাও। ভাষা বদলে গেলো বান্টু আরবি ফারসি হিন্দি পর্তুগীজ ইংরেজি মিশে হয়ে গেলো সোয়াহিলি। ধর্ম বদলে গেলো। শুধু মানুষ আর ভাষার মত ধর্মরা মিশ খেলোনা। পৃথক হয়ে রইলো আল্লাহ্ ভগবান আর গড। জানজিবারের পাথর টুলির (stone town) পুরনো কফি হাউসের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে মাথা বাঁচিয়ে উঁচু ছাদে উঠলে দেখা যায় চারিদিকের টিন আর টালির ছাদের ভিতর থেকে মাথা তুলে আছে দুটো বড় গির্জা তিনটে মন্দির আর বেশ কিছু মসজিদের মিনার। আজানের শব্দ মন্দিরের কাঁসর আর কফির গন্ধ তবু মিলে মিশে একাকার।
মার্কো পোলো তার সফরনামায় বলছে অত্যন্ত বাজে দেখতে ঠোঁট মোটা নাক উল্টোনো অতিকায় চেহারার বেজায় কালো মানুষদের দেশ জানজিবার। ধরে নেওয়া হচ্ছে মার্কো পোলো না গিয়েই বানিয়ে বলছে, কারন জাঙ্গি বারায় অনেকদিন আগে থেকেই আফ্রিকান বান্টুদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আরব মুসলিম আর ভারতীয় হিন্দুদের বাস। মুঘল বা আফঘানদের হাবসি ক্রীতদাস অথবা খোজারা এখান থেকেই যেত। মানুষের চোখের জলের মতো এই দ্বীপ। টিয়ার ড্রপই বটে। করুণ এর ইতিহাস। আফ্রিকার ক্রীতদাস জোগানের দুটো পৃথক ধারা – পূব আর পশ্চিম। পশ্চিম থেকে ইউরোপ হয়ে বা লাতিন আমেরিকা হয়ে ব্রাজিল বা আমেরিকায় যেত আঙ্কেল টম রা। আর পূব থেকে মিশর আরব ওমান ভারত চীন মালয়ে ছড়িয়ে পড়ত মালিক অম্বর রা। এই পূব শোকগাঁথার প্রাণকেন্দ্র ছিল জানজিবার।
মাঝারি সাইজের পাল তোলা নৌকা যার সোয়াহিলি নাম ধউ, টালমাটাল ঢেউয়ে দোল খায় আর তার নিচের পাটাতনে একজনের ওপর আরেকজন হয়ে শুয়ে থাকে শয়ে শয়ে আদিম কালো মানব শরীরে বসন্তের গুটি আর মুখে সমুদ্র পীড়ার মুমূর্ষ গেঁজলা নিয়ে- তিন বছরের শিশু থেকে পঞ্চাশ বছরের নতুন বৃদ্ধ। জানজিবারের ক্রীতদাস বাজার থেকে আজকের তিন ডলারে কিনে দশ ডলারে বিক্রি হয় মুম্বাইয়ের ধারে কসাই দ্বীপে বা ওমানের মুস্কাটে। অবশ্য অর্ধেককেই মাঝ পথে গায় গুটি বসন্ত দেখলে ছুড়ে ফেলা হত ভারত মহাসাগরের নিরীহ জলে। হয়ত বা ডুবে গিয়ে বেঁচে যেত তারা। হয়তো বা বেঁচে গেলে জল দস্যু খাতায় নাম লেখাত।
কি করে শিকার হতো এই হতভাগারা মানুষের লালসার? সেও আরেক করুন গল্প তবে খুবই চেনা। কিছু নেতা গোছের কালো মানুষই তাদের আরব মনিবদের খুশি করতে ছড়িয়ে পড়ত জঙ্গলের ভিতর প্রত্যন্ত গ্রামে। শিকার করা হাতির দাঁত বইতে মুটে খুঁজতো তারা। গ্রামের কোনও মাতব্বর কে টাকা দিয়ে সেই গ্রামের মাতব্বরের অপছন্দের লোকগুলো কে মোট বইতে বহাল করা হতো। মাতব্বর তাদের পরিণতি জানলেও তারা নিজেরা জানত না। কাঁধে করে ভারী হাতির দাঁত বা গাছের গুঁড়ি বয়ে এনে যখন ক্লান্ত দেহগুলো জল আর পরিশ্রমিকের আশায় যুথবদ্ধ বসে আছে জানজিবারে তখন তাদের হাতে পায়ে শিকল আটকানো হতো পারিশ্রমিক হিসেবে। রাখা হত গুহায় আর তারপর বিক্রি করা হতো ভরা বাজারে গরু ভেড়া ছাগলের মতো। পরের কিছুদিন ঢেউ আর মারণ রোগের সাথে সংঘর্ষ চলত। বেঁচে থাকলে তারা ভুলে যেত কার বাবা কার মা কার ভাই কার বোন ছিল। আবলুশ কাঠের খোদাই করা শরীরগুলো তখন কেবলই ক্রীতদাস। মনিবের চাবুকের আজ্ঞাবহ দাস।
পনেরো থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি চলতে থাকে জানজিবার দখলের লড়াই, মূলতঃ পর্তুগীজ আর ওমানিদের ভিতর। মাঝে ওলোন্দাজ থেকে স্পেনীয় আরও বেশ কিছু পর ইংরেজরা লড়াই করে। অবাক হলেও ইংরেজদের একটাই অবদান ক্রীতদাস ব্যবসা বন্ধ করা। বোধহয় তারা অন্য ইউরোপিয়ান দের থেকে নিজেদের বেশি সভ্য প্রমান করতে চেয়েছিল। বোধহয় ক্রীতদাস না কিনেও তারা জেনে গেছিল বাণিজ্যর নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি করে কি করে মানুষকে বা দেশকে নিঃস করা যায় নীল চাষের দাদন দিয়ে। তবে জানজিবারে তাদের রাজত্ব অল্প কদিনের মাত্র। ফিরে আসে ক্ষমতায় ওমানের সুলতান ও তার সামন্ত সৈয়াদিরা। জানজিবারের কান্না থামেনা। একেক দিনে চল্লিশ হাজারেরও বেশি ক্রীতদাস পাচার হতে থাকে।
পাথর টুলির প্রাচীন গলিগুলো অনেকটা বেনারসের মত। গলির পাশের বাড়িগুলোর দরজাগুলো দেখার মত। কাঠের প্রাচুর্য আফ্রিকায় বরাবরই। কালো এবনি কাঠের দরজাগুলো প্রধানত তিন প্রকারের। বিশাল চেহারার আরব্য রজনী থেকে উঠে আসা কালো দৈত্যের মত দুপাল্লার ভারি দরজাদের গায়ে কারুকাজের অতো বালাই নেই – সেগুলো আরবি। দরজার গায়ে বড় বড় কালো বলয় কেটে বসানো। মনে হবে মুঘল কেল্লা বা চিতোর গড়ের রামপাল। আর আছে খুব সুন্দর কারুকাজ করা আমাদের কাশ্মীরি শাল বোনা যেনো কাঠের ওপর – ওগুলো ভারতীয় শিল্পকলা। যেগুলোর মাথাগুলো গোল গম্বুজের মত গম্ভীর – ওগুলো ভারতীয় ইসলামিক স্টাইল আর যেগুলোর মাথাগুলো মন্দিরের মত টিকোনা – ওগুলো ভারতীয় হিন্দু। বাড়িঘর পুরনো সাবেকি হলেও দরজারা আজও অটুট। যেসব বাড়িতে নতুন করে ইট চুন সুড়কির প্রলেপ লাগছে নতুন দরজা বসছে ঠিকই কিন্তু পুরনো ধাঁচের। আর আছে রাস্তার ধারে ধারে গলির মোড়ে মোড়ে শিল্পীদের ষ্টুডিও। আফ্রিকান পেইন্টিং এতো সুন্দর এবং এতো শিল্পীর ছড়াছড়ি না দেখলে বিশ্বাস হয়না। ক্যানভাস ভর্তি রঙের বিদ্রোহ অনেকটা সন্ধ্যাকালীন রক্তাক্ত ওপরের আকাশের মতই। আর আছে জলের ধারে একটা বড় ফোর্ট যেটা পর্তুগীজরা তৈরি করেছিলো। এখন সন্ধ্যায় যেখানে বাজার বসে। অনেকটাই আমাদের পুরনো কেল্লা র ভিতর লাল কেল্লার বাজার বসিয়ে দিলে যেমন হবে।
জানজিবারের কথা বলতে গেলে ইতিহাস ঢুকে যায় অকারণে। কিছুতেই এড়ানো যায় না। অথচ ইতিহাসের পাশ কাটিয়ে কষ্ট করে একটু যদি এগোনো যায় দেখা যাবে আমাদের আন্দামান বা পুরতোরিকোর মত নদীনালা আর ঠাস বুনোট গাছ গাছালি। গাছ, বিশেষ করে নারকেল দারুচিনি লবঙ্গ এলাচ জায়ফল জয়িত্রী আর গোল মরিচ। আম জাম কাঁঠাল ও আছে সাথে। রোদেলা দুপুরে এরকম একটা মসলার গাছের জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার জন্যেই শুধু জানজিবার যাওয়া যায়। আর এই জঙ্গলের হাতছানি পেরিয়ে যাওয়া যায় উত্তরে একেবারে মাথার ওপর ঘুমেজড়ানো জেলেদের গ্রাম নঙ্গুই। দ্বীপের ওই একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বা কোন ধউয়ে বসে দুলতে দুলতে ম্লান জলের ওপর পুবের সূর্য ওঠার থেকে পশ্চিমের সূর্যের ঢলে পড়া দেখা যায়। একটা দিন কেতে যাবে জিবনের অকারনে জীবনকে ভালবেসে। নঙ্গুই একা না, এরকম অসংখ্য জেলেপাড়া শুয়ে আছে পাথর টিলার ঘিঞ্জি ব্যস্ততার থেকে অনেকদূর শান্ত অস্তিত্ব নিয়ে। শুয়ে আছে বুকের কাছে চিকচিকে বালি আর রোদ্দুর নিয়ে। অসম্ভব সুন্দর জল যেখানে হিংসার কান্না ধুয়ে দিয়ে যায়। পাথর টিলার থেকে নঙ্গুই বা দ্বীপের উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিমের ঘুমন্ত গ্রামগুলো যাওয়ার রাস্তা ছোটো হলেও গাড়িতে লাগে দুই থেকে তিন ঘন্টা। বেশ ঝাঁ চকচকে পাকা রাস্তা আর অনেকটাই এবড়োখেবড়ো মাটির উঁচু নিচু ঢেলা।
জানজিবারের চারপাশের গা ঢালা অনন্ত নীলে যেসব নাম জানা আর নাম-না-জানা মাছ সারা-দিনমান সাঁতার কেটে বেড়ায় তাদের মধ্যে একটা মাছ খুব দেখা যায়। পুরনো সোয়াহিলি ভাষায় সে মাছের পোশাকি নাম চঙ্গু। তা এই চঙ্গুদের দেবতা একদিন ঠিক করল আকাশটা দেখতে হয় আর তাই যেমন ভাবা তেমন কাজ। উঠে এলো জলের ওপর, উঠে এলো সুন্দর পৃথিবী দেখবে বলে। জল ছেড়ে উঠতেই নিঃশ্বাস বুজে এলো তাঁর। স্থবির হয়ে গেল। ক্রমশ দেহ পাথর হল পড়ে পড়ে আর পাথরের হাড়ে ঘাস গজাল। ধীরে ধীরে লতা পাতা দারুচিনি গাছ আরও কত কি। এখন প্রকাণ্ড আকাশের নিচে বড় পাথরের শরীর নিয়ে শুয়ে থাকে ছাঙ্গু; মাছের মতই দেখতে একটা দ্বীপ। পোশাকই নাম যার প্রিসন আইল্যান্ড। জানজিবার থেকে পাল তোলা নৌকায় হাওয়ার পক্ষে গেলে দেড় ঘণ্টার পথ।
এ দ্বীপে মানুষ থাকতো না কোনও, থাকার কথাও নয়। মাছ জমে পাথর হল কিন্তু জল কই। নদী তো নেই। নুন জল খেয়ে কি মানুষ বাঁচে?
জানজিবারের প্রথম স্বতন্ত্র সুলতান সৈয়দের ছেলে সৈয়দ তাই ছাঙ্গু দিয়ে দিলো আরব দাস ব্যবসায়ীদের জিম্মায় যাতে ওরা নিজেদের অবাধ্য ক্রীতদাসদের ওখানে পাঠিয়ে দিয়ে শায়েস্তা করতে পারে। জল না খাইয়ে এক বড় গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারে হাতে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে। আর জল চাইলেই বেত মারতে পারে ততক্ষণ যতক্ষণ না তৃষ্ণা ভুলে যায়।
সৈয়দের ছেলে সৈয়দ। নাম অবশ্য একটা আছে তার মজিদ বিন সৈয়দ কিন্তু ছোটবেলার ইতিহাস বইয়ে রাজাদের নাম আমি কোনোদিন মনে রাখিনি। রাখতে চাইনি। রাজার ছেলে রাজা হওয়ার এই যে রীতি তার বিরুদ্ধে ছোটো বালকের নির্বাক প্রতিবাদ। ইতিহাসে সেই জন্যে ভালো হওয়া হয়নি কোনোদিন।
ফিরে আসি ছাঙ্গু দ্বীপের গল্পে। আরবরা তাদের কতজন অবাধ্য দাস কে এখানে জল খেতে দেয়নি তা কেউ জানেনা তবে সেই আরব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এ দ্বীপ কিনে নেন সোনালি চুলের ইংরেজ ফার্স্ট অফিসার লয়ড ম্যাথউস। তার ইচ্ছা ছিল এক জেলখানা তৈরি করার। কয়েদিরা কোনদিন পালাতে পারবেনা। নীল জলে আটকে যাবে তাদের পা। ততদিনে খনন কর্ম শুরু করেছে জানজিবার থেকে দৈনিক ক্রমে আসা কৃতদাসের দল। খনন করে পাওয়া যায়নি কিছুই তবে প্রকৃতি কি কোনও জায়গা ফাঁকা রাখে। উপড়ানো পাথরের জায়গায় বৃষ্টির জল জমল। লয়ড সাহেব জেল খানা গড়লেন কিন্তু রাখার মত আসামী পেলেন না। উল্টে সপ্তাহান্তে তিনি ঘুরতে আসেন এই দ্বীপে। বড়ো মায়া পড়ে গেছে তার জায়গাটার প্রতি। একা থাকেন আর মনে ভাবেন সঙ্গী চাই। তিনি চলে গেলে চঙ্গু দেবতা একা হয়ে যাবেন। সাথে করে নিয়ে এলেন একদিন তিনটে কচ্ছপ। তিন জনের গোল বাঁধল। একটা গেলো মরে কিন্তু অন্য দুটো বহাল তবিয়তে তাদের প্রেম জারি রাখল। মা কচ্ছপ বাবা কচ্ছপ থেকে দাদু কচ্ছপ আর ঠানদি কচ্ছপ থেকে বাবা-দাদু আর মা-ঠানদি হতে সময় লাগলো না।
কচ্ছপ তার পরিবার পরিজন নিয়ে ছাঙ্গু দ্বীপে কয়েদ হল। এদিকে লয়েড এর জেলখানার কয়েদি মিললনা তবে যেটা মিলল সেটা হল শয়ে শয়ে অসুস্থ মানুষ। ১৯২৩ সাল – আফ্রিকা তখন ইয়েলো ফিভারের খপ্পরে। জানজিবারের ইংরেজরা জানজিবার কে মুক্ত রাখতে প্রিসন আইল্যান্ড কে ব্যবহার করতে লাগলো কোয়ারেন্টাইন দ্বীপ হিসেবে। ক্রীতদাস থেকে দাগি আসামী থেকে মুমুর্ষ রোগী। প্রস্তুরিভুত ছঙ্গু দেবতা শেষমেশ জনস্বাস্থ্যর কাজে লাগলেন। খুশি হলেন বটে। এখানেই মানুষের ভাগ্য – অনেক খানা খন্দ পেরিয়ে একসময় ঠিক জন হিতকর কাজে নিযুক্ত হয় তার মনন। আর যত দিন এটা হচ্ছে বা হবে ততদিন মানুষ থেকে যাবে পৃথিবীতে।
এদিকে সইদ চলে গেলো, লয়ড চলে গেলো, ক্রীতদাস প্রথা চলে গেলো, টাঙানায়িকা আর জানজিবার মিলে তানজানিয়া হল, এমনকি তানজানিয়া থেকে ইয়েলো ফিভার চলে গেলো, লয়ড সাহেবের আনা সেই কচ্ছপ কিন্তু রয়ে গেলো। এখন তার বয়স ১৯০ বছর। দ্বীপের খুব নিরিবিলি দিকটায় একা একা থাকে। তার নাতি পুতিরা বছর বছর নতুন কচ্ছপের জন্ম দিতে ব্যস্ত, বুড়ো সর্দারের তেমন খোঁজ করেনা আর। দেখে এলাম তাঁকে। পিঠের খোল ভেঙে আবার জোড়া লেগে গেছে। করুন ভাবে জলে মুখ গুঁজে রোদ পোহায়, কাছে গেলে মুখ সরিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে শুধু ময়ূর এসে নাচ দেখায়। ওহ ভুলে গেছি ছাঙ্গু দ্বীপে ময়ূর আর ডিগ ডিগ ও আছে।
আর আছে কল্পনার দ্বীপ নাকুপেন্দা। পাথর টিলার থেকে নৌকো নিলে আধ ঘণ্টায় পৌঁছনো যায়, নীল জলের সাথে কাঁচের মিহি গুড়োর বালি সোহাগ যেখানে। বালির প্রগার প্রেম এতটাই মাঝে মাঝে তা জাহির করতে হয় আর তাই ভাঁটার টানে নীল সবুজের আলিঙ্গন ছেড়ে জেগে ওঠে পবিত্র সুন্দর সোনালি বালির দ্বিপ নাকুপেন্দা। সাবেকী বাংলায় যার অর্থ – আমি তোমার হাত খুঁজি। অরন্যদেব নিয়ে গেছিল ডায়নাকে কিলাউইলির সমুদ্রতটে। গা ভাসিয়েছিল ওরা সারা শরিরে সোনা মেখে তারপর ধুয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপন করেছিল। ওরকমই যাপন করতে আসে জাঞ্জিবারিরা ভাটার টানে আর জোয়ার এলে ওরা চলে যায়। নাকুপেন্দা ডুবে যায় তারপর আবার চারিদিকের দ্বীপগুলো যখন ঘুমায় চুপিসারে, সে জেগে ওঠে জ্যোৎস্না আলো গায়ে মেখে। স্বৈরিণী বালি হাতছানি দেয়, ডাকে, সবুজ নীল জামা পরে জল আসে ঢেউয়ের পিঠে। কেউ দেখে না তাদের শুধু রাত জাগা জেলেদের ফেলে যাওয়া নৌকোগুলো ছাড়া।
সারাদিনের ক্লান্তি শরীর জড়িয়ে ধরে অথচ মন জেগে থাকে। রাতের হাওয়ায় হাহাকার মিশে থাকে। কবে সেই ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের এমনই কোনও এক রাতে পর্তুগীজদের হারিয়ে জানজিবার দ্বীপ দখল নেয় ওমান এর সুলতান। ওমানের সুলতান সয়েদ গড়ে তোলে তাদের উপনিবেশ। যে উপনিবেশ থেকে মৃত সাদা হাতির দাঁত আর মৃত হলেও জীবিত কালো রঙের রক্তে মাংসের মানুষ দলে দলে নিয়ে বেচে দেওয়া যায় পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে। আর এই ব্যবসায় তাদের ডানহাত হয়ে দাঁড়ালো জানজিবারে জন্মানো টিপু টিপ-রা। ইংরেজরা এলো ঠিকই কিন্তু বন্ধ করতে পারলো না সেই ব্যবসা। তলে তলে চোরাগোপ্তা চলতে লাগলো। জলের ওপারেই ডার-এ-সালাম, জার্মান উপনিবেশ টাঙানায়িকার প্রধান শহর। এই জার্মানরাই ১৯৬৪ সালে টাঙানায়িকা কে স্বাধীন ঘোষণা করে চলে যায়। তার আগে ১৯৬৩ সালে ইংরেজরাও সয়েদের ছেলে সৈয়েদের কাছে জানজিবার ছেড়ে দেয়। গণতন্ত্রের আড়ালে চলতে থাকলো আরবদের কায়েমি স্বার্থ। বেশিদিন না। ১৯৬৪ র এক সকালে, সূর্যের কড়া রোদ তখনও মহাসাগরের লোনা জলে ইলিশের চকচকে শরীর পায়নি, সেইসময়ে আটশর কাছাকাছি জানজিবারি ঘিরে ধরলো ধন্যাঢ্য আরবি ও ভারতীয়দের। দিন পেরিয়ে রাত হল অথচ রক্তের স্রোত থামে কই। রাতভর ধরে চললো সেই বীভৎস রক্তখেলা। তার কিছুদিন বাদে টাঙানায়িকা আর জানজিবার মিলে একযোগে জন্ম নিলো আজকের টানজানিয়া। কুড়ি হাজারেরও কিছু বেশি লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেদিন ভারত মহাসাগরের শান্ত নীল জলে। এই জলেই একদিন তাদের পূর্বপুরুষেরা ক্রীতদাস ছুড়ে ফেলে দিতো। রক্তের রঙে সবুজ শেওলার মত হয়ে গেছে সে জল। ষাট বছরের ওপর বেশি ক্ষমতায় থাকা সমাজবাদী সরকার এখন সে জলে মাছ ধরে রপ্তানি করে।
জাঞ্জিবারের ভ্রমনের ব্যাপারে ইচ্ছুক পাথকেরা বিস্তারিত জানতে চাইলে ইমেইল এ যোগাযোগ করতে পারেন puskinray@gmail.com
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন