travel-kallolini-kolan

কল্লোলিনী কোলন
ছন্দা বিশ্বাস


ভারতবর্ষের মাটি থেকে পা তুলে নিলাম।

আগস্টের শেষ। ঝকঝকে নীলাকাশ দিল্লীর। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক একটা বেজে ত্রিশ মিনিট। এয়ার ইন্ডিয়া মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে গেল।

আমাদের এ বারের ইউরোপ ভ্রমণের শুরুটা হয়েছিল জার্মানি থেকে। প্রথমে দিল্লী থেকে ফ্রাংকফূর্ট।

ফ্রাংকফূর্টে যখন পৌঁছলাম তখনো সূর্যদেব স্বমহিমায় আকাশে বিচরণ করছেন। ফ্রাংকফূর্টের টাইম দেখাচ্ছে বিকেল ছটা। ভারতীয় সময় রাত সাড়ে নটা। আগস্টের দীর্ঘ দিন। প্রায় সাড়ে আটটা- নটার দিকে সন্ধ্যা হয় এখানে। গোটা পথটাই তাই সূর্যোকরোজ্জ্বল আলোতে দেখতে দেখতে চলে আসি। প্লেনের জানালায় চোখ রেখে মাত্র কয়েক ঘন্টার ভিতরে এক মহাদেশ পেরিয়ে আরেক মহাদেশে ঢুকে গেছি ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চ লাগছে। কত পাহাড়- নদী- অরণ্য কত নগর- জনপদ-দেশ পেরিয়ে অবশেষে ইউরোপ মহাদেশে এসে উপস্থিত হলাম।

এই প্রথম ফ্রাংকফূর্ট এয়ারপোর্টে পা রাখলাম।

ফ্রাংকফূর্ট বিমান বন্দর থেকে বের হয়েই একটা ছোট ট্রেনে চেপে ফ্রাংকফূর্ট মেন স্টেশানে এসে কোলনগামী ট্রেন ধরলাম। সময় লাগল এক ঘন্টা।

পরেরদিন এই কোলন থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

কোলন পশ্চিম জার্মানির একটি বিখ্যাত শহর।

বহু বাঙ্গালি তথা ভারতীয়দের বাস এখানে। পরে এ বিষয়ে আলোকপাত করব।

কোলন স্টেশান থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেল বিশাল উঁচু টুইন টাওয়ারে। কালো পাথরে তৈরী প্রাচীন রোমান গথিক স্থাপত্য নজর কেড়ে নিল। উচ্চতার নিরিখে এটি হল বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম ক্যাথিড্রাল। রাইন নদীর বাম তীরে অবস্থিত এই কোলন শহর হল জার্মানির চতুর্থ জনবহুল শহর। বার্লিন, হামবুর্গ, মিউনিখের পরেই এর অবস্থান।

পশ্চিম জার্মানির নর্থ রাইন ওয়েস্ট ফালিয়া রাজ্যে অবস্থিত কোলনের ইতিহাস অতি প্রাচীন। যীশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় চল্লিশ বছর আগে আনুমানিক ৩৯ খৃস্টাব্দে এখানে বাস করত জার্মানির এক জনজাতি, উবি। রোমান জেনারেল মার্কাস ভিপসানিয়াস আগ্রিপার বাহিনীর সঙ্গে এই উপজাতির যুদ্ধে পরাজয় ঘটলে তারা একটা চুক্তিবদ্ধ হলেন। এই চুক্তি অনুসারে রোমানরা রাইনের বাম তীরে তাদের বসতি স্থাপন করবেন ঠিক হল। তাদের সদর দপ্তর হল, Oppidum Ubiorum’। একই সঙ্গে এটি হল রোমানদের সামরিক বাহিনীর সদর ঘাঁটি। এরপরে ৫০ সালে সম্রাট কলোডিয়াস সিং হাসনে বসলেন। সেই সময়ে কোলনের সেরা সুন্দরীদের একজন ছিলেন এগ্রিপিনা দ্য ইয়ংগার। কলোডিয়াস এগ্রিপিনাকে বিয়ে করলেন। স্ত্রী কোলনে জন্মগ্রহণ করায় সম্রাট তার জন্মভূমি এই গ্রামটিকে একটি উপনিবেশ তৈরীতে মন দিলেন। তখন থেকে এটি হল রোমানদের তৈরী উন্নত এক নগরী। এই সময়ে এই অঞ্চল রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হল। রোমান আইন অনুসারে এর নামকরণ করা হল,‘কলোনিয়া ক্লডিয়া আরা অ্যাগ্রাপিনেন সিয়াম’।

স্ত্রীর নাম নিয়ে গড়ে তুললেন সুন্দর এক নগরী। এগ্রিপিনার এক জন্মদিনে কোলন নগরী উপহার দিলেন।

সেই সময়ে কোলন ছিল জার্মানির একটি প্রধান ভিলা। তাকেই নগরীর রূপ দেওয়া হল।

সেই সময় ফ্রাংকিশ শাসন চলছিল। রাইন নদীর তীরে হওয়ায় ভৌগলিক কারণের জন্যে এটি হয়ে উঠল ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। গড়ে উঠল বিশাল এক নদী বন্দর। উত্তর ইতালি থেকে লন্ডন পর্যন্ত পণ্য পরিবহণ চলত এই নদী বন্দর দিয়ে।

এরপরে এখানে নির্মাণ করা হল বিশাল এক জলাশয়। আইফেল জলাশয়। এটি ছিল সেইযুগে রোমান সাম্রাজ্যের দীর্ঘতম জলাশয়। এই জলাশয় থেকে প্রতিদিন ২০,০০০ ঘনমিটার জল নগরবাসীর নিকট

পৌঁছে যেত। এমন উন্নত পরিষেবার কথা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। এরপরে এলেন সম্রাট পোস্টুমাস। তিনি কোলনকে গ্যালিক সাম্রাজ্যের রাজধানী করলেন। পরে সম্রাট কন্সট্যান্টাইন ক্ষমতায় এলেন। তিনি চিন্তা করলেন নদী পারাপারের জন্যে সেতু নির্মাণ করা হলে যাতায়াতের সুবিধা হবে। এ পারের সঙ্গে ও পারের যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ হবে। সেই কথা চিন্তা করে তিনি প্রথম রাইন নদীর উপরে সেতু নির্মাণ করলেন। সেটি ছিল ৩১০ সালে। এরপরে চতুর্থ শতকে ফ্রাংকদের দ্বারা কলোনিয়া লুঠ হল বেশ কয়েকবার। এরপরে ক্ষমতায় আসেন সম্রাট শার্লেমন।

কোলনের এই চার্চটি নির্মিত হয়েছিল ১২৪৮ সালে। তখন এটি ছিল কনরাড ভন হোচস্টাডেনের অধীনে।

কোলন ক্যাথিড্রাল

এই মুহূর্তে কোলন হল পশ্চিম জার্মানির একটি প্রধান বিপণন কেন্দ্র। রোমান যুগে গড়ে তোলা হয়েছিল সুন্দর এক মিউজিয়াম। সেটা ছিল আনুমানিক তৃতীয় শতাব্দী। দীর্ঘকাল ধরে রোমানরা এই সব অঞ্চল শাসন করতেন। তখন থেকেই গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ক্যাসেল। এরপরে রাইনের উপর দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেছে। কত ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী এই নদী। কত সাম্রাজ্যের উত্থান পতন, কত রক্তাক্ষয়ী সংগ্রামের কাহিনী লেখা আছে তার বুকে।

এর অনেক অনেক পরে ১৮০১ সালে ‘লুনিভিল চুক্তি’ অনুসারে রাইন নদীর বাম তীরের অঞ্চল সমূহ রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সমগ্র অঞ্চল ফরাসী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হল। পরবর্তীকালে এটি সম্রাট নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে গেল।

ফরাসী দখলের পরে ১৮১৫ সালে একে প্রুশিয়া সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হল। এর পর থেকে কোলনের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি বিকশিত হতে থাকে। ১৮৮০ সালে এই ক্যাথিড্রালটি হল জার্মান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক। এটি হল কোলনের সেরা ল্যান্ড মার্ক।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে এই ক্যাথিড্রালটিও যুদ্ধের আগুন থেকে রেহাই পায়নি। ক্যাথিড্রালের পিছনের দিকে কিছুটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এটি। কয়েক দশকের চেষ্টায় তাকে আবার পুনর্গঠন করে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়েছে।

কোলন জার্মানির ইতিহাসে এক অতি প্রাচিন নগরী। বহুকাল আগে থেকে কোলন বিখ্যাত নদী বন্দর রূপে পরিচিত। ইউরোপের বিভিন্ন বণিক সম্প্রদায়ের মুখে মুখে ঘুরত এই নদী বন্দরের কথা। কোলনের ভৌগলিক অবস্থান অতি গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র পঁচিশ মাইল দূরে আছে বিখ্যাত শহর বন এবং চল্লিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অন্য এক বিখ্যাত শহর, ডাসেলডর্ফ। এ ছাড়া কোলন হল একটি গুরুত্বপূর্ণ জংশন। এখান থেকে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে যাতায়াত করা যায়। যাওয়া যায় ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং ইতালির বিভিন্ন স্থানে। এই বিশেষ পরিচিতির কারণে এখানে সারাটা বছর বিভিন্ন দেশের মানুষের আগমন ঘটে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ আসেন এই শহরে। শুধু ইতিহাসের টানে নয় এর চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষদেরকে মুগ্ধ করেছে। জলপথে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার জন্যে সুন্দর পরিবহন ব্যবস্থা আছে। দীর্ঘকাল ধরে অর্থনীতি বিকাশিত হওয়ার ফলে এই নদী বন্দর শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা লাভ করেছে।

কোলন মেন স্টেশান

শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠায় এটি বণিক সভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। বর্তমানেও তার সেই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ আছে।

কোলন তাই পর্যটকদের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। বহু বিখ্যাত হোটেল এবং রেস্ট্যুরেন্ট গড়ে উঠেছে। বহু যুগ আগে থেকেই কোলনে ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলত। ছিল ঘোড়ায় টানা যান। সেটাই পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে ইলেকট্রিক ট্রামের রূপ পেয়েছে।

ক্যাথিড্রালটির কথা বাদ দিলে কোলন শহর প্রথম যে কারণে আমাকে আকর্ষণ করেছিল সেটা হল রাইন নদী। ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি রাইন নদীর কথা। এমন সুন্দর নদী এবং নদী বন্দর স্বচক্ষে দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। ম্যাপল গাছের স্নিগ্ধ শীতল ছায়াঘেরা পথ চলে গেছে রাইন নদীর তীর ধরে। আছে সুন্দর ম্যাপল উদ্যান। নদীর তীরের সৌন্দর্য উপভোগ করা এবং ভ্রমণকারীদের জন্যে আছে সুন্দর বসার জায়গা। গড়ে উঠেছে ওপেন এয়ার রেস্ট্যুরেন্ট। হাজার হাজার মানুষ খেতে খেতে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করছে।

নদী পথে ভেসে চলেছে বিশাল বড়ো বড়ো ক্রুজ। চলছে পালতোলা অপূর্ব সব নৌকা। দৃষ্টিনন্দন এই সব ক্রুজশীপগুলো বহুদূর চলে যাচ্ছে যাত্রী নিয়ে।

সুপ্রাচীন কাল থেকে রাইন নদী তার দায়িত্ব পালন করে আসছে। দৃষ্টিনন্দন ক্রুজ আর নৌকাগুলো ভাসতে দেখে মনে হচ্ছে মাতৃসমা নদীটি বুকে নিয়ে চলেছে তার ছানাপোনাদের। সারাটাদিন নদী দেখেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। এমন সুন্দর রাইন নদী- বন্দর।

স্টেশান থেকে বেরিয়ে ক্যাথিড্রাল দেখে চলে এলাম রাইনের পাশে।

অসংখ্য পর্যটকের ভিড়ে গিজ গিজ করছে নদী তীরস্থ রাস্তাটা। মেপল গাছের ছায়াঘেরা পথ। হাত বাড়ালেই বিশাল বিশাল সব বহুতল জাহাজ। লম্বা জেটি। জাহাজের বাঁশির শব্দ, কুলি-খালাসিদের তোড়জোর, যাত্রীদের হৈচৈ করে ক্রুজে চেপে জলবিহার দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেল।

কোলনের আর এক আকর্ষণীয় বিষয় হল এর পরিবহন ব্যবস্থা। শহরকে যানজট মুক্ত রাখতে বানানো হয়েছে অসংখ্য টানেল।

একটা জিনিস দেখে খুবই আশ্চর্য হলাম। একই ট্রাম স্থলপথে চলতে চলতে মূল শহরের কেন্দ্রস্থলে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে ঢুকে যাচ্ছে টানেলে। সেটাই ‘ইউ বান’ (আন্ডারগ্রাউন্ড রেল) অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ মেট্রো হয়ে এগিয়ে চলেছে। ভূগর্ভের এই স্টেশানের প্ল্যাটফর্মগুলো কম উচ্চতার। একই স্টেশানের বিভিন্ন তলে বিভিন্ন ধরণের ট্রেন চলছে। বিভিন্ন গতিসম্পন্ন ট্রেন। উপর দিয়ে ছুটে চলেছে হাই স্পীড দোতলা ট্রেন। কোনটা ঘন্টায় দুইশ কোনটা আবার ঘন্টায় তিনশ কিলোমিটার বেগে ছুটছে। এ ছাড়া মেট্রো পরিষেবা তো আছেই। দেখলে বিস্মিত হতে হয়। জার্মান প্রযুক্তি কোথায় পৌঁছে গেছে। কম দূরবর্তী, নগর পরিক্রমাকারী, বহু দূরবর্তী বিভিন্ন ধরণের ট্রেন চলছে কোলনে।

নদীর উপরে মোহেনজোলার্ণ ব্রীজ

উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা কোলনকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।

রাইন নদী তীরে বেশ কিছু সময় কেটে গেল। দূরে রাইন নদীর উপরে ‘মোহেনজোলার্ণ ব্রীজ’। ব্যস্ততম রেল ব্রীজ। নদীর উপরে অন্য একটা ব্রীজ আছে। মানুষ এবং বাস- ট্রাম চলাচলের জন্যে এটা ব্যবহৃত হয়। মোহময় এই সেতুর উপরে দাঁড়ালে নদীটাকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। দেখা যায় নদীর দুই ধারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। নানা রোমান স্থাপত্য, শহরের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরী বিল্ডিং, নানা স্থাপত্য দেখে নয়ন মন সার্থক হল। উপর থেকে খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায় কোলন ক্যাথিড্রালটিকে। ঐতিহ্যময় এই সেতুটি দেখার স্বপ্ন ছিল বহুকাল ধরে।

দেখলাম এই সেতুর উপর দিয়ে একই সঙ্গে চলছে মানুষ, ট্রাম এবং বাস। প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা পথ। ২০০৮ সালে পথচারীদের জন্যে রেলিং দিয়ে ফুটপথের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এরপরে চলে আসি রোমান-জার্মান মিউজিয়াম দেখতে।

কোলন ক্যাথিড্রালের ঠিক দক্ষিণে আছে ঐতিহ্যবাহী এই মিউজিয়ামটি। এটি ১৯০৭ সালে নির্মিত হয়েছিল। মধ্য ও প্রাক মধ্যযুগের ইতিহাসের নানা নিদর্শন আছে এখানে। সুপ্রাচীন রোমান যুগের নানা নিদর্শন আছে। রাইন ল্যান্ডের প্রাক ইতিহাসের নানা নিদর্শন এটিকে সমৃদ্ধ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমার আঘাত থেকে এটি ভাগ্যক্রমে বেঁচে আছে।

পরের দ্রষ্টব্যস্থান হল ‘লুডুইগ মিউজিয়াম’।

মডার্ণ আর্ট দ্বারা সমৃদ্ধ এই মিউজিয়ামটি। পৃথিবী বিখ্যাত বহু শিল্পীর আঁকা ছবি আছে এই মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামের দেওয়ালে আছে মহান শিল্পী পিকাসোর আঁকা বহু দুর্মূল্য চিত্র। পোপ আর্ট, অ্যাবস্ট্রাক্ট এবং সুররিয়ালিজমের নানাবিধ সংগ্রহ। ১৯৭৬ সালে এটি নির্মিত হয়। কোলন ক্যাথিড্রালের খুব কাছেই এটি অবস্থিত।

এই মিউজিয়ামের আর একটি বিখ্যাত দেখার বিষয় হল, কোলন ফিল হারমোনি।

আদতে এটি হল সিম্ফোনিক কন্সার্ট হল। এটি মিউজিয়াম লুডুইগ এর একটি অংশ। কোলন মেন স্টেশান এবং কোলন ক্যাথিড্রালের কাছেই অবস্থিত এই মিউজিক হল। এই কনসার্ট হলটি হল আদতে একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার। এই হলে কোনো কলাম নেই। এক সঙ্গে ২০০০ দর্শক বসতে পারেন।

সুপ্রাচীন কাল থেকে কোলন ইউরোপের একটি উল্লেখযোখ্য নদী বন্দর হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিল। রাইন নদীটি যেহেতু পাঁচটি দেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তাই এক সময়ে জলপথে পরিবহন এবং যাতায়াতের উল্লেখযোগ্য মাধ্যম ছিল এই নদী বন্দর। বিশাল বড়ো বড়ো জাহাজ, নৌকা, ক্রুজ চলত এই বন্দর থেকে। বিভিন্ন শহর, বন্দরে পৌঁছে দিত বাণিজ্য সম্ভার। রাইনের তীরে গড়ে ওটা কোলন শহরটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পিছনে রাইনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

নদীর তীরে গড়ে উঠেছে নানা মানের রেস্টুরেন্ট, হোটেল, বিভিন্ন দোকান বাজার। কোলন শহরের কেন্দ্রস্থলে আছে রাইন নদীর উপরে সেতু। ব্রীজ থেকে পুরো কোলন শহরটা সুন্দরভাবে দেখা যায়। ব্রীজের পরে চলছে ট্রাম। সেই ট্রামটাই ভূগর্ভে ইউ বান অর্থাৎ আন্ডার গ্রাউন্ড মেট্রো ট্রেন হয়ে যাত্রী নিয়ে পরের স্টেশানে যাচ্ছে। কোলন সেন্ট্রাল বা সিটি সেন্টারে প্রচুর জন সমাগমের কারণে যানজট এড়াতে এমন উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা দেখলে তাক লেগে যায়।

কোলন ক্যাথিড্রাল থেকে কয়েক মিটার এগোলেই ‘হিউ মার্কেট’। রোমান যুগে এই জায়গায় ঘোড়াকে খড়- বিচুলি খাওয়ানো হতো। প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী সেই জায়গাটিকে মর্যাদার সঙ্গে সাজিয়ে রাখা হয়ে হয়েছে। কয়েক পা এগোলেই চোখে পড়বে রাস্তার উপরে কালো কালো পাথরের বিন্যাস। কয়েক জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। গাইডের মুখ থেকে জানতে পারলাম ক্যাথিড্রাল বানানোর সময়ে ইতালি থেকে আনা হয়েছিল এই পাথরগুলো। পরে রোমানরা যখন এই জায়গা ছেড়ে চলে যায় তখন বেশ কিছু পাথর চুরি হয়ে যায়। বাকী পাথরগুলো যাতে কেউ না নিতে পারে তার জন্যে পথের উপরে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোলনবাসীদের কাছে এগুলো খুবই পবিত্র পাথর।

ঘুরতে ঘুরতে রাইন নদীর তীর বরাবর গড়ে উঠেছে বিখ্যাত সব রেস্ট্যুরেন্ট, নদী তীরে সারি সারি চেয়ার টেবিল পাতা আছে প্রত্যেক রেস্ট্যুরেন্টের সামনে তার একটাতে গিয়ে নদীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কফি আর স্ন্যাক্স খেলাম।

আবার পথ চলা শুরু।

ছায়াঘন মেপল উদ্যান। তার নিচেয় লাইন দিয়ে তৈরী করা হয়েছে লোহার বেঞ্চ। প্রচুর পর্যটক সেই বেঞ্চে বসেই চা কফি কিনে খাচ্ছেন।

নদীর ওপারে কোলেট

আমরা সেই জায়গা ছেড়ে স্টেশানের উল্টো দিকে চলে আসি। এখন লাঞ্চের সময়। তাই কোলনের বিখ্যাত রেস্ট্যুরেন্ট ‘লস্টারিয়া’তে গেলাম লাঞ্চের জন্যে। এটা কোলন হাফ বান হাফ বা সেন্ট্রাল স্টেশান থেকে একটা ছোট ‘এস বান’ ট্রেন ধরে গেলাম Cologne Messe/ Deutz এ । দুই স্টেশানের দূরত্ব মাত্র আড়াই কিলোমিটার। সময় লাগল পাঁচ মিনিট। রাইন নদীর উপরে বিখ্যাত মোহেনজোলার্ণ ব্রীজ পার হলেই ওপারে ‘কোলন মেসে’ স্টেশান।

স্টেশান থেকেই দেখা যাচ্ছে সামনে কয়েক মিটার দূরে ‘লস্টারিয়া’ (L’OSTERIYA)রেস্ট্যুরেন্টটি। স্টেশান চত্বর ছাড়ালেই চোখে পড়বে কোলনের বিখ্যাত এই রেস্ট্যুরেন্টটি। সামনে প্রশস্ত চাতালে পাতা আছে বেশ কিছু টেবিল চেয়ার। আছে ফুলের বাগান। এখানে সকলেই উন্মুক্ত পরিবেশে খেতে বেশী পছন্দ করে। ফুরফুরে মিষ্টি বাতাস তখন হাল্কা শীতের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। মিঠেল রোদে বসে খেতে কার না ভাল লাগে। চারিদিক পাথর দিয়ে মোড়া। তাই ধূলোর অস্তিত্ব অনুপস্থিত।

রেস্ট্যুরেন্টে পৌঁছে দেখলাম আমাদের মতো বহু উৎসুক ভোজন রসিক উপস্থিত হয়েছেন। পর্যটক ছাড়াও লোকাল মানুষজন ফ্যামিলিসহ এসেছে এখানে। বেলা যত বাড়ছে তত লোক সমাগম হচ্ছে। ভিতরে এবং বাইরের সব কটা টেবিল বুকড হয়ে গেছে।

আমরা শুরুতে তিনজন তিনটে ড্রিংক নিলাম। সঙ্গে একটা লাসানে এবং পিৎজা ক্যানারিনো অর্ডার করলাম। সঙ্গে ফ্রুট স্প্রিৎজার। এখানে বিভিন্ন ধরণের ওয়াইন পাওয়া যাচ্ছে দেখে আমার সঙ্গী হোয়াইট ওয়াইন নিল। জার্মানিতে ওয়াইন তুলনামূলক ভাবে বেশ সস্তা। ছেলের মুখে শুনলাম থিন ক্রাস্ট পিৎজা বিখ্যাত এখানে। ও বন্ধুদের নিয়ে মাঝে মধ্যে এখানে চলে আসে খেতে। একটাই বিশাল সাইজের পিৎজা তিজনে শেয়ার করছি। তাই পরে ‘হাফ রোকালা’, ‘হাফ রাস্টিকা’ অর্ডার করলাম।

তবে রাস্টিকাটা বেটার লাগল খেতে। এখানকার পিৎজা আকারে এত বড় যে চোখ জুড়িয়ে যায়। এতো বড় যে প্লেটে দিতে পারে না। টেবিলের উপরে পেপার পেতে তার উপরেই সার্ভ করতে হল। সস আর টপিংস এতো বেশী পরিমাণে দেওয়া হয় যাতে অন্য কিছু চাওয়ার দরকারই পড়ে না।

লাঞ্চের পরে চলে এলাম বাজারটা ঘুরে দেখার জন্যে। কোলনের মার্কেট দেখার মতো। যেহেতু এটা একটা উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থান তাই এখানে বিভিন্ন স্যুভেনির শপ এবং অন্যান্য দোকানগুলো নানান জিনিসে ভর্তি।

দশ বারো ইউরোতে বিভিন্ন মেমেন্টো দেদার বিক্রী হচ্ছে। ত্রিশ চল্লিশ ইউরো দিলে পাথরের তৈরী ছোট ছোট ক্যাথিড্রাল, মিউজিয়াম, রাইন নদীর উপরে ব্রীজ, শহরের বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানের কোলাজ দিয়ে বানানো রেপ্লিকা পাওয়া যাচ্ছে। পাথরের তৈরী জিনিসগুলো দেখতে যেমন অপূর্ব তেমনি দামেও বেশ কড়া। তবু পর্যটকদের দেখায় এবং কেনায় খামতি নেই।

এটা সেটা দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে গেলে ফের রাইন নদীর পাড়ে গিয়ে কফি শপে গিয়ে বসলাম।

আর এক প্রস্থ ক্যাপুচিনোতে মনোনিবেশ করলাম।

লক্ষ্য করলাম সকালের তুলনায় এখন পর্যটকের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশী। পথের ধারে রেস্ট্যুরেন্ট, দোকান ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে লোকে গিজ গিজ করছে। উৎসব মুখর পরিবেশ নজরে পড়ল সর্বত্র। উচ্ছ্বাস আছে তবে বল্গাহীন নয়। সংযত, সং হত ইউরোপীয়ানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

কোলনে বহু ভারতীয়দের বাসস্থান। জীবন জীবিকা, শিক্ষার জন্যে বহু মানুষ এখানে আসেন। রীতিমতো বেশ কয়েকটা বাঙ্গালি পাড়া গড়ে উঠেছে। সেখানে প্রতি বছর ঘটা করে দুর্গাপুজো হয়। জার্মানির বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু মানুষ আসেন এই দুর্গাপুজো দেখতে। অনেক আগে থেকে হোটেল বুকিং করা হয়। চার দিনে খাওয়া দাওয়া সমস্ত কিছু আগেই বুক করা হয়ে থাকে। একেবারে পঞ্জিকা মেনে পূজা করা হয়। কোনো থিম নয়, মন দিয়ে ভক্তিভরে পুজো করেন সকলে। পূজোর সেই কটা দিন বিভিন্ন ধরণের কালচারাল প্রোগ্রাম থাকে। বিভিন্ন ধরনের নাচ, গান ছাড়াও রবীন্দ্র গীতি নাট্য এবং নাটক মঞ্চস্থ হয়।

দুর্গাপুজো ছাড়াও দোল এবং পয়ালা বৈশাখেও সকলে সমবেত হয়, আনন্দ করে। বিদেশের মাটিতে বসে দেশের স্বাদ গ্রহণ, অনেকেই নস্টালজিক হয়ে পড়েন। স্বাভাবিক, জন্মভূমিকে কে কবে অগ্রাহ্য করতে পেরেছে। শিকড়ের টান বলে কথা!

লস্টেরিয়া রেস্ট্যুরেন্ট

সারাটাদিন ঘুরে ঘুরে কোলন শহরটাকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলাম। জন বসতিপূর্ণ এই শহরের মানুষ গুলো সত্যি খুব সুখী। বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের আশ্চর্য সহাবস্থান। প্রত্যেকের ভিতরে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব। জার্মানিরা এমনিতে খুবই ধীর,সংযত এবং কঠোর শৃংখলাপরায়ণ। পথঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কারো ব্যাপারে এরা অতিরিক্ত কৌতূহলী নয়। এত মানুষ অথচ কোলাহলহীন। কথাবার্তা বলেন খুব আস্তে আস্তে। কোনোরকম হুড়োতাড়া নেই। পথ চলতে এবং বাসে- ট্রামে- ট্রেনে উঠছে লাইন দিয়ে। ধীরে পাশ কাটিয়ে। কাউকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নয়।

এখানকার জার্মান জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলো দেখবার মতো। প্রতিটা বাড়ির সামনে সারি সারি বড় বড় ফুলের টব বসান। রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন ফুলের সমারোহ। বাড়িগুলো একেবারে রাস্তার পাশে সার বেঁধে সোজা উঠে গেছে। রাস্তার দিকে কোনো ব্যালকনি নেই। বাড়ির ভিতরের দিকে আছে ব্যালকনি এবং বাগান। যেটা রাস্তা থেকে দেখা সম্ভব নয়।

এরা খুবই রুচিসম্পন্ন এবং পরিবেশ সচেতন। প্রায় মাস খানেক জার্মানির বিভিন্ন শহর ঘুরে রাস্তাঘাটে কোথাও ময়লা আবর্জনা নজরে পড়েনি। যেমন নজরে পড়েনি কোনো হৈ হট্টগোল। কোলনেও সেই ধারা বিদ্যমান।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কোলন শহরকে এমন উচ্চতর মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। গোটা একটা দিন কোলনে কাটিয়ে চোখ আর মনের পরিতোষণ ঘটিয়ে ফিরে গেলাম গন্তব্যস্থলে। এরপরে আরো কয়েকবার কোলন

স্টেশানে যেতে হয়েছে বিভিন্ন দিকের ট্রেন ধরার জন্যে।

হাতে সময় থাকলে এসে দাঁড়িয়েছি নদীর ধারে। যত বার আসি ততবার মুগ্ধ হই।

বুঝতে পারি এ দেখার কোনো শেষ নেই।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *