travel-pori-painting-paris

পরী, পেন্টিং ও পিগেল ডিসট্রিক্টে
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

ঘুরতে ঘুরতে চলেছি। গ্লোবাস গেট ওয়ে সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে। পশ্চিম ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ দেখার পর সেবারের গ্রীষ্মে আমাদের ডেষ্টিনেশন পশ্চিম ইউরোপের বৃহত্তম রাষ্ট্র ফ্রান্স। রিপাবলিক অফ ফ্রান্স সমগ্র বিশ্বে খ্যাত তার রেভলিউশানের জন্য। মানবাধিকার সুরক্ষার মন্ত্র “লিবার্টি, ফ্রেটারনিটি, ইক্যুয়ালিটি ” সর্বপ্রথম লিপিবদ্ধ হয় এদেশে। আমাদের গন্তব্য নেপোলিয়ান বোনাপার্টে খ্যাত ফ্রান্সের রাজধানী শহর প্যারিস। পারিসি নামক কেল্টিক উপজাতিদের বাসস্থান ছিল তাই থেকে এই নাম।


পৃথিবীর অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র এই প্যারিস যুগ যুগ ধরে তার সংস্কৃতি, শিক্ষা, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, রাজনীতিতে উন্নত হয়ে উত্কর্ষতার শিখরে পৌঁছে গেছে। সিয়েন নদীর মৃদুমন্দ বাতাস ব‌ইছিল তখন। সময়টা সূর্যডোবার ঠিক আগের মূহুর্ত। বাস আমাদের নামিয়ে দিল সিয়েন নদীর ধারে। বলল আমরা পৌঁছে গেছি প্যারিসে, আপনারা সুদূর ইটালি থেকে এতটা পথ বাসে বসে রয়েছেন। অতএব নদীর ধারে হেঁটে নিন কিছুটা। সন্ধের ঝুলে নদীতীর থেকে দূরের প্যারিসের মোহময় রূপটা নিজের চোখে পরখ করে নিন।

প্যারিসের হোটেলে তিনরাত থাকব আমরা। নোভোটেল প্যারিসে গ্লোবাস প্রত্যেকের ঘরে ঘরে মালপত্র পৌঁছে দিয়েছে তার মধ্যে। নদীর হাওয়া গায়ে মেখে সন্ধের ঝুলেই আমাদের হোটেলে ফেরার পালা। পরদিন সকাল থেকে শুরু হবে ঘুরে দেখা। আইফেল টাওয়ার, নোতরদম গীর্জা, লুভর মিউজিয়াম, ভার্সাই প্যালেস সবকিছু আছে আমাদের আইটিনারিতে। তবে সেই বিকেলে সিয়েন নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল সত্যি সত্যি স্বর্গে পৌঁছে গেছি। পথের আশেপাশে ছড়ানো ছেটানো অবিন্যস্ত মার্বেল পাথরের ভাস্কর্য আর কি নান্দনিক সেই রূপ! পথের ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয় সেই স্কালপচারে চোখ রাখলে। মনে মনে বলে উঠি, সত্যি ইউরোপ! তোমরা গড়তে জানো, ভাঙতে নয়। তোমরা রাখতে জানো, ঢাকতে নয়। তোমাদের ভূগোল, ইতিহাস সব আছে। সেইসঙ্গে আছে তার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ।

কয়েক শতাব্দী ধরে এই শিল্পকলার অন্যতম পীঠস্থান প্যারিস স্থান দিয়েছে নামীদামী শিল্পীকে যাঁদের তুলিকলায় প্যারিস হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম, সিটি অফ আর্টস। ক্লড মোনে থেকে মানে, রেনো থেকে মাতিস, পল গঁগা থেকে ভিনসেন্ট ভ্যান গখ সকলেই এসেছেন প্যারিসে। নিজেদের শিল্পকলাকে প্রদর্শন করেছেন। ধন্য হয়েছেন তাঁরা আর সেই সঙ্গে ধন্য হয়েছে প্যারিস। ঠিক যেন আমাদের সেই সময়ের শান্তিনেকেতনের মত। এক আকাশের নীচে অগণিত নক্ষত্র সমাবেশ। কবি-সাহিত্যিক থেকে চিত্রকর, ভাস্কর সকলেই লাইমলাইটে এসেছিলেন। প্যারিস এখনও স্বমহিমায় বিরাজমান।


এই সেই স্বপ্নে দেখা প্যারিস শহর? যেখানে বিশ্বের অন্যতম ফরচুন ৫০০ কোম্পানির হেড কোয়ার্টার, এখানেই সেই নামকরা ক্যাথিড্রাল রয়েছে যাকে কেন্দ্র করে ছোটবেলায় পড়া হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম। আর এই সেই প্যারিস যেখানকার রাস্তায় ১৮৬০ তে প্রথম গ্যাসলাইট জ্বলে উঠেছিল সারেসারে? তাই একে বলে সিটি অফ লাইটস। প্যারিসের রাজপথে ফ্যাশনের কলরব। নামীদামী ফ্যাশন আইকন আর ব্র্যান্ডের দামামা সেখানে বেজেই চলে অবিরত। সেই কোন্‌ ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসা সব ফ্যাশন ব্র্যান্ডের কথা! সে সব ছিল স্বপ্ন। আজ তাদের সেই রাজপথ ধরে হেঁটে চলেছি আমরা। অভাবনীয় সেই মূহুর্তে। আগষ্টের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। অতি আরমদায়ক সেই পথ হাঁটা।

এই সেই ইউরোপীয় শহর যা অষ্টদশ শতাব্দীর নবজাগরণের আখড়া? তোলপাড় হতে চলল মন! আমরা গেছি ১৯৮৯ তে আর ১৭৮৯ তে হয়েছিল এই ফ্রেঞ্চ রেভলিউশান। ভাবতে ভাবতে এক জায়গায় দেখি মেলা চলছে। ঠিক আমাদের যেমন হয়। তবে আরো সুসংবদ্ধ ও শৃঙ্খলিত। নাগরদোলার টিকিট কেটে উঠতেই হবে। মনে মনে ভাবলাম। রাস্তায় কেউ কথা বুঝবেনা আমাদের। যতটুকু ইংরেজী পড়ে বুঝলাম। ফ্রেঞ্চ রেভলিউশানের বাই সেন্টিনিয়াল অর্থাত দুশোবছর উদযাপনের মেলা বসেছে। সেই উপলক্ষে মনের আনন্দে একটি ফ্রেঞ্চ রেভলিউশানের ছবি আঁকা টিশার্ট খরিদারি হল মেমেন্টো হিসেবে। আর সেই সঙ্গে মেরি-গো-রাউন্ড চড়ে ওপর থেকে ঝাঁ করে পাখীর চোখে প্যারিস শহরকে সন্ধ্যের ঝুলে ফুটফুটে আলোয় দেখে নেওয়া গেল।

আলো আঁধারিতে প্যারিসের সান্ধ্য রূপে দেখে মন ভরল না আমাদের। হোটেলে ফিরতেই হবে। ইউরোপীয়ান ডিনার টাইম একটু আগেই তার ওপর আমাদের সহযাত্রীদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া। আমার মন উচাটন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ টোষ্ট আর ফ্রেঞ্চ ওয়াইন টেষ্ট করার দিকে। ফ্রেঞ্চ ওপেন টেনিস আর ফ্রেঞ্চ টোষ্টে বঙ্গললনার নাড়ীকাটা। কিন্তু খাবারের লিষ্টে চোখ বুলিয়ে দেখলাম সেসব সেদিনের মত অধরা। অতএব অপেক্ষা। আরো দুটো ডিনার হবে এদেশে, সেই আশায় বুক বাঁধা।

পরদিন ঠিক সময়মত রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম গ্রুপের সঙ্গে। ট্যুর অপারেটর জেনিনের ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে বাসে চড়ে বসা। রোজ পালটে দিত বাসের জায়গা। বাই রোটেশন। কেউ সামনে, কেউ পেছনে আবার কেউ জানলার ধারে। সব দায়িত্ত্ব তার। কী সুন্দর পরিচালনা! কারোর মনখারাপের কোনো অবকাশ নেই সেখানে।


সকালের প্রথম দ্রষ্টব্য আইফেল টাওয়ার। ১৮৮৭ সালে বানানোর কাজ শুরু হয় আইফেল টাওয়ারের আর খুলে দেওয়া হয় ১৮৮৯ সালে, ফ্রেঞ্চ রেভলিউশানের বাতাবরণেই। এক বিশাল এবং রাজকীয় লৌহ স্তম্ভ এই আইফেল টাওয়ার সেই থেকে প্যারিসের কালচারাল মনুমেন্ট। যে এঞ্জিনিয়রের তত্ত্বাবধানে এই স্তম্ভ নির্মিত হয় তার নাম ছিল গুস্তাভে আইফেল। বিশাল সবুজ লনের ওপর প্রোথিত ঐ আয়রন ল্যাটিস স্তম্ভ। ওপরে উঠবার টিকিট কেটে নিয়ে ওপরে উঠতে থাকলাম। লিফটে করে উঠতে লাগলাম একের পর এক। তারপর সর্বোচ্চ তলায়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর দুবছর সময় লেগেছিল টাওয়ারের প্রধান স্ট্রাকচার খাড়া করতে।

এরপর প্যারিসের দ্বিতীয় মনুমেন্ট আর্ক ডি-ট্রায়ামফ পরিদর্শনে গেলাম। সিয়েন নদীর ধারে এই মনুমেন্টটি সত্যি অভিনব। ঠিক যেন আমাদের গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া বা ইন্ডিয়া গেটের মত। সেরিমোনিয়াল প্রবেশদ্বার। ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ানের কর্মজীবনের তুঙ্গে নির্মিত হয় এই গেটটি। প্যারিস স্বাধীন হবার পর ফরাসী সৈন্য মার্চ করেছিল এই প্রবেশ পথ দিয়ে। এরপর বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈন্যদের জন্য গড়া ইনভ্যালিড আর্মি হসপিটাল দেখা হল। ফরাসীভাষায় বলা হয় Institution Nationale des Invalides।

রাস্তার ধারে ধারে অজস্র সুন্দর স্তম্ভ। স্থাপত্যের নিদর্শন। যেন ফ্রান্স এমনি আছে আজীবন ধরে। সেগুলি কোনো প্লেস অফ ইন্টারেস্ট নয়। ক্যামেরার ক্লিকে বন্দী হতে থাকল সেই মনুমেন্টরা। এবার সিয়েন নদীর ওপর একটি সেতু। সিয়েন নদীর ওপর অনেকগুলি সেতুর একটিতে গিয়ে কিছুটা জিরেন ও ছবি তোলা। এবার ক্যাথিড্রাল অফ নোতরদম। সেই ভিক্টর হুগোর হাঞ্চব্যাকের স্মৃতি বিজড়িত চার্চ। ফরাসী গথিক স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এই চার্চটি।

হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদম তখন আমার ছোটবেলার স্মৃতি উসকে দিল। মোহিত হয়ে তাকিয়ে র‌ইলাম সেই ঐতিহাসিক গীর্জার দিকে যার নাম Notre Dame de Paris ফরাসীভাষায় যার অর্থ হল “Our Lady of Paris” কেউ কেউ বলেন নোতরদম ক্যাথিড্রাল। তার স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং সর্বোপরি স্টেইনড গ্লাস উইন্ডো আবারো নজর কাড়ে। তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই ক্যাথিড্রাল হল আর্কবিশপ অফ প্যারিসের সিংহাসন। আবারো সেই ঘুরে ঘুরে দেখা …রাজকীয় রোজ উইন্ডো, বড় বড় ঘন্টা, কুমারী মেরীর কোলে যীশুর অনবদ্য স্ট্যাচু আর বাইরে বেরিয়ে দেখা চার্চের দেওয়ালগাত্রে সেই হাঞ্চব্যাক….যার জন্য আকুলিবিকুলি প্রাণ। ভিক্টর হুগোর বর্ণণায় যে ছিল ঐ চার্চের ঘন্টাবাদক, বিকৃত শরীর ছিল, মস্ত কুঁজ ছিল পিঠে, নাম ছিল কোয়াসিমোদো।

আবারো সারাদিন গ্লোবাস গেটওয়ের একদল ক্লান্ত ভ্রমণপিপাসু মানুষ একত্রে ফিরে এলাম ফ্রান্সের সেই নোভোটেল হোটেলে। ফিরে এসেই কলকাতায় মায়ের কাছে চিঠি লেখা হাঞ্চব্যাককে নিয়ে। ডিনারের পর আবার পরদিনের তোড়জোড়। ভার্সাই প্যালেস ঘুরতে নাকি সারাদিন কেটে যায়। আর লুভর মিউজিয়াম দেখতে গেলে সময় থাকবেনা। রাতে ক্যাবারে নিয়ে যাবে ওরা। প্যারিসের নাইট লাইফ না দেখলে না কি জীবন বৃথা। কিন্তু এদ্দূর এসে আমি লুভর না দেখে যাব না। অতএব ভার্সাই প্যালেসের প্রধান প্রধান দ্রষ্টব্য দেখে নিয়ে আমরা দুজনে পালাব একা একা। শুনেছি প্যারিসের সাবওয়ে বা মেট্রো নেট ওয়ার্ক অত্যন্ত স্মার্ট ও ট্রাভেলার ফ্রেন্ডলি। তাই কলকাতার দুই ঝানু পর্যটক ঠিক নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হাজির হয়ে যাবে ট্যুর অপারেটরের সাথে। আর না ফিরতে পারলে আমরা সোজা সে রাতে পৌঁছে যাব ক্যাবারে আখড়ায়। খুব টেনশানে ছিলাম সারাদিন। বিফলে যাবেনাতো প্যারিস ট্যুরের শেষটুকু? সব ভালো যার শেষ ভালো। পাঁচ সাতভেবেও দেখলাম লুভর মিউজিয়ামের সাথে নো কম্প্রোমাইজ। আপাতত ভার্সাই প্যালেস পৌঁছালাম।


আমরা যাকে ভার্সাই প্যালেস বলে থাকি ফরাসী ভাষায় তার নাম “Chateau de Versailles”। এ যেন ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল। ভার্সাই ছিল প্যারিসের উপকন্ঠে একটি গ্রাম। অট্টালিকায় ভরে উঠল। ধনসম্পত্তির প্রাচুর্যে প্যারিসে অক্ষয় রয়ে গেল তার স্মৃতি। ফরাসী সম্রাট লুই দ্যা ফর্টিন্থয়ের রাজত্বে এই ভার্সাইয়ের গ্রাম থেকে রাজমর্যাদায় উত্তরণ হল। নির্মিত হল বড় বড় অট্টালিকা, এপার্টমেন্ট আর বাগিচা।

অশ্বারোহী লুই দ্যা সিক্সর্টিন্থয়ের স্ট্যাচুটিও দেখা গেল। অন্দরমহলে প্রবেশ করলে বোঝা গেল বিত্ত আর প্রতিপত্তি থাকলে কি না করা যায়! রাণীর মাষ্টার বেডরুম এখনো সজ্জিত সেই সুবিশাল আর্শিতে। পালঙ্কে এখনো লেগে রয়েছে কয়েক শতকের পুরণো প্রতিফলিত আলোকরশ্মির চুম্বন। সুউচ্চ সিলিং থেকে ঝুলন্ত স্ফটিকের ঝাড়লন্ঠন এখনো অমলিন। বাইশ ক্যারট সোনার সূতোয় এমব্রয়ডার্ড ট্যাপেষ্ট্রি ঝুলে আছে দেওয়ালে। অলিন্দে, অলিন্দে প্রতিধ্বনিত হল লুই দ্যা সিক্সর্টিন্থয়ের সাথে মেরী এন্টনিয়েটের বিবাহবাসরের গল্প। সেই হল, সেই শ্বেতপাথরের টেবিল, কনসোল এখনো স্বমহিমায়। আমরা তো ছবি নিতেই ব্যস্ত। কিন্তু কি বিপুল পরিমাণ অর্থ আর কি অনবদ্য অধ্যাবসায়ে নির্মিত হয়েছিল এই ভার্সাই প্যালেস তা ভাবলে আজো শিহরিত হ‌ই। আমরা গেছি আগষ্টের সোনাঝরা রোদ্দুরের সকালে। ঠিকরে পড়ছে সে আলো তখন মাষ্টারবেডরুমে আর বিচ্ছুরিত হচ্ছে স্ফটিকের ঝাড় থেকে আলোকরশ্মি। রাণী মেরী এন্টনিয়েটের এই শয্যাকক্ষের নাম ফরাসীভাষায় petit appartement de la reine।

আমাদের হৃদ্‌‌পিন্ডের নিলয়-অলিন্দে তখন নীলশোণিত প্রবাহ। কিছুক্ষণের রাজারাণী আমরা। শয্যাকক্ষ থেকে এবার বাগিচায় এসে দাঁড়ালাম। ঝাউবনের কেয়ারি আর মধ্যে মধ্যে অজস্র রং বেরংয়ের ফুল। রাজাবাগিচা বলে কথা। কি বিশাল ভার্সাই গার্ডেন। ফোয়ারা, হাঁটবার সরণী, আরো কত কি! লুই দ্যা সিক্সটিন্থের আমল হল ভার্সাই প্যালেসের স্বর্ণযুগ। বাগান থেকে প্রাসাদ সবকিছুর নান্দনিক উত্কর্ষ এই সম্রাটের জমানাতেই সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছিল।

আলোকময় রাজপ্রাসাদের রাজারাণীর রূপকথারা চুপকথায় বারেবারে ফিরে যেতে লাগল ট্যুর অপারেটর জেনিনের মুখে। অনেক দেখা হল ভার্সাই। এবার আমাদের ঘড়ির কাঁটা বলছে পালাতে হবে লুভর। কারণ লুভর একছুট্টে দেখে এসে আবার মিট করতে হবে ট্যুরমেটদের সঙ্গে। জেনিনকে অনেক পটিয়ে পাটিয়ে আমরা শেষমেশ পালালাম। রাস্তায় এসেই প্যারিসের পাতাল রেলের খোঁজে। পেয়েও গেলাম চটপট। ভার্সাইয়ের মধ্যেই ম্যাপ দেখেই জেনেছিলাম। ব্যাস্‌। টিকিট কেটেই মেট্রো চড়ে সোঁ করে লুভর। হাতে মোটে দুঘন্টা সময়। ঠিক করেই রেখেছিলাম। আমাদের হাতে সময় কম আর আমরা তখন গাইডবিহীন হয়ে লুভরে প্রবেশ করছি। অতএব অন্তত দুটি বিখ্যাত জিনিষ দেখেই চম্পট দেব লুভর থেকে। যাইহোক মিউজিয়ামের টিকিট কেটেই দেখে নিলাম একে একে…লুভর প্যালেসের সামনেই অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত গ্লাস পিরামিড, প্রাচীন গ্রীক ভাস্কর্য ভেনাস-ডি-মিলো আর লিওনার্দো দা ভিন্সির অরিজিনাল মোনালিসার তৈলচিত্রটি। দুটির বদলে তিনটি দ্রষ্টব্য দেখে মন যারপরনাই কানায় কানায়। প্রচুর ভীড় মিউজিয়ামে আর ঐ তিনটি দেখার জন্য ভীড় উপছে পড়ছে। কিন্তু ম্যাপ দেখে দেখে সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। অসুবিধে হলনা মোটেও।


দুপুরের মধ্যেই আবার সাবওয়ে দিয়ে পৌঁছে গেলাম জেনিনের বলে দেওয়া নির্ধারিত স্থানে। দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে হবে সেখানে। জাস্ট ইন টাইমে আমরাও হাজির একটি ফ্রেঞ্চ ক্যাফেটেরিয়ায়। ফ্রেঞ্চ বেকারী বিখ্যাত তার ফ্রেঞ্চ লোফের জন্য। চকোলেটের জন্য আর নানাবিধ স্যান্ডুইচের জন্য। থরে থরে কাঁচের মধ্যে সুসজ্জিত সব বেকারী প্রডাক্ট। টাটকা পাঁউরুটির গন্ধে ম ম করছে আশপাশ। কিন্তু কাঁচের আড়ালের ঐসব সুখাদ্যগুলির নাম অজানা। ফরাসীভাষা বুঝিনা আমরা আর দোকানীরাও ইংরাজী বোঝেনা। অতএব হাত-পা নেড়ে একটি সুখাদ্যের ইঙ্গিত করতেই তা প্লেটে করে আমার সম্মুখে হাজির হল। দেখতে আমাদের ফ্রেঞ্চটোষ্টের মত। ভাবলাম বাঁচা গেল। এদ্দিনে আসল ফ্রেঞ্চটোষ্টের স্বাদ পাব। দুটি পাঁউরুটির মধ্যে হ্যাম আর চিজের টুকরো। তারপর চিজ আর ডিমের কোটিংয়ে ভাজা হয়েছে সেই মোটা আর ফ্যাটি পাঁউরুটির স্যান্ডুইচকে। আর তখুনি বুঝলাম আমরা বাড়িতে যে ফ্রেঞ্চটোষ্ট বানাই তা হল এর অপভ্রংশ। চিজের গন্ধেই মাত। উদরপূর্তি হল আমার। খিদের মুখে অমৃত।

তারপর ফরাসী ডার্ক চকোলেট দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েত আমাদের লাঞ্চ।

হোটেলে ফিরে এসে দিবানিদ্রা দিতে হবে কারণ রাত জেগে দেখতে হবে প্যারিসের নাইটলাইফ। সারাদিনের ধকলও কম হয়নি। অদ্যৈ অন্তিম রাত @ প্যারিস। সে রাত না জানি কত মোহময়, মায়াময়! গ্লোবাসের ট্যুরেই অন্তর্ভুক্ত আছে পিগেল ডিষ্ট্রিক্ট এর নামকরা ক্যাবারে শো লা-ন্যুভেলি-ইভ এর টিকিট। সাথে কম্প্লিমেন্টারি ডিনার ও এক বোতল ফ্রেঞ্চ ওয়াইন। প্যারিসের আরো একটি কেতার ক্যাবারে হল মুলা রুজ। সেটি আরো দামী তাই আমাদের লা-ন্যুভেলি-ইভেই বুকিং।

ক্যাবারের কথা নভেলে পড়েছি, শুনেছি। কলকাতার পার্ক স্ট্রীটে ঊষা উত্থুপ ট্রিংকাসে গান গাইছেন, এ সব কাগজে পড়ে রীতিমত আমি তাঁর ফ্যান। মিস্‌ শেফালি নাকি শুরু করেছিলেন ক্যাবারে নাচ। অতি স্বল্প পোষাকে, লাস্যময়তায় তিনিই নায়িকা ও গায়িকা আবার কিছুটা অভিনয় নাচের মধ্যে দিয়ে। ক্যাবারে কুইন মিস শেফালির হাত ধরে মেনস্ট্রিম বাংলা থিয়েটারে আরো কত কত মিস ক্যাবারেরা ঢুকে পড়েছেন। একে একে মঞ্চস্থ হত তখন সম্রাট ও সুন্দরী, বারবধূ ইত্যাদির মত প্রাপ্তবয়স্ক নাটকগুলি। আমার শুধু কাগজে বিজ্ঞাপন আর রিভিউ পড়া ছাড়া সে বাসনা মেটানো হয়নি। তাই বলে হার্ডকোর ক্যাবারে তাও আবার প্যারিসে বসে? ভাবিনি কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হব।

ক্যাবারের মদ্দা কথা এন্টারটেইনমেন্ট। তাকে ঘিরে ছোট ছোট টেবিলে দর্শক-শ্রোতা-উপভোক্তা, সঙ্গে ইথাইলের ফোয়ারা। কলকাতার নাইট লাইফেও ঢুকে পড়েছে। তারপর পার্কহোটেলের তন্ত্র-মন্ত্র-ডিস্কোথেকের রোশনাই তো উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।


এই ক্যাবারে কনসেপ্টের উত্স স্থল ইউরোপের প্যারিস। ১৮৮১ সালে ক্যাবারে কালচার প্যারিসে প্রথম শুরু হয়। নিছক ইনফর্ম্যাল সান্ধ্য আড্ডার মেজাজে। যেখানে তদানীন্তন কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞেরা এসে একত্র জড়ো হয়ে নিজ নিজ শিল্পীসত্ত্বার প্রকাশ ঘটাতেন। ভাগ করে নিতেন একে অপরের সাথে। তারপর সেই সংস্কৃতির হাত ধরেই আড্ডার অঙ্গ স্বরূপ ঢুকে পড়ে কিছু পয়সার বিনিময়ে মদ্যপান। নতুন নতুন আইডিয়ায় সমৃদ্ধ হতে থাকে প্যারিসের ক্যাবারে। সংযোজিত হয় থিয়েটার। এভাবেই জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ছড়িয়ে পড়ে প্যারিসের আনাচেকানাচে এমন ক্যাবারে ঠেক। তারপর সমগ্র ইউরোপে এবং অবশেষে আমেরিকায়। কোথাও ক্যাবারেতে হয় নাটক, কোথাও মিউজিক্যাল ব্যান্ড পারফর্ম করে, কোথাও কনসার্ট কিম্বা ব্যালে, কোথাও অপেরা সঙ্গীত অথবা কবিতাপাঠ, আবার কোথাও হয় একাঙ্ক নাটিকা কিম্বা ইনডোর সার্কাস প্রদর্শন। তবে অনেকস্থানে এই ক্যাবারে কেবলমাত্র‌ই নাইটক্লাবের এন্টারটেইনমেন্ট। তাই ব‌ইপড়া অভিজ্ঞতায় আমি একটু অস্বস্তিতে ছিলাম। তবে একলা নই বলে কিছুটা হলেও অস্বস্তি লাঘব। সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা বাতাবরণ। বাধো বাধো ঠেকছিল। আমার বয়স তখন মোটে তেইশ। ওনাকে বললাম আমাদের না গেলেও তো হয়। উনি হেসে বললেন, প্যারিসে এসে ক্যাবারে না দেখে চলে গেলে লোকে তোমাকে আওয়াজ দেবে। তায় আবার মহার্ঘ্য গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে ক্যাবারের টিকিট কাটা রয়েছে আগে থেকেই। অতএব হোক আমারো ক্যাবারে দর্শণ এই বলে সারাদিনের পথশ্রমে ক্লান্ত আমি বিউটিস্লিপ দিয়ে নিলাম ঘন্টাখানেক। আমাকেও তো সেজে গুজে যেতে হবে সেখানে আর ভারতীয় নারীর সর্বোত্কৃষ্ট পোষাক শাড়ীতেই আমি সাজব, সে কথাও মাথায় রইল।


প্যারিসের পিগেল ডিষ্ট্রিক্টই হল ক্যাবারের পৃথিবীখ্যাত আখড়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই পিগেল ডিষ্ট্রিক্ট ছিল মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনীর ফূর্তিফার্তা, আমোদপ্রমোদের আখড়া, “Pig Alley” অর্থাৎ যাকে আমরা নিষিদ্ধপল্লী বলি আর সেই থেকেই ঐ নামকরণ। পাবলো পিকাসো, ভিনসেন্ট ভ্যান গখ বাস করতেন একসময় এই পিগেলে। অতএব জেনিনের মুখে শোনামাত্র‌ই টিকিটের কিছু পয়সা উশুল হল মনে হল। প্যারিসের অন্যতম ট্যুরিষ্ট স্পট এটি সেই রাতে থিক থিক করছে মানুষের ভীড়ে। আর কলকাতার পার্কস্ট্রীট বড়দিনে যেমন আলোয় সাজে তার চতুর্গুণ আলো জ্বলছে সেখানে। সব হোটেল, রেস্তোরাঁর মাথায় মাথায়। মানুষ পয়সা দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে প্যারিসের নাইটলাইফের দিকে। দেখতে পাওয়া গেল সেই নামীদামী মুলারুঁজ। আমরা এগিয়ে গেলাম না ন্যুভেলি ইভের দিকে। ঢুকতে গেলে ছেলেদের ড্রেসকোড আছে। ফর্ম্যাল স্যুট, টাই সহ পরতে হল তেনাকে আর আমি নতুন চান্দেরী বেনারসীতে। আর সঙ্গে ছোট্ট টিপ, হালকা লিপস্টিক, শখের গয়নাগাটি। খুব বেমানান ট্যুরের অগণিত জনতার সঙ্গে এহেন আমি। নিউজিল্যান্ডের দুই মা ও মেয়ে রয়েছেন, এতদিন একসঙ্গে ঘোরার পর অনেকের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে। ক্যাবারে হলে প্রবেশ করে দেখলাম চারজন করে এক টেবিলে বসে দেখতে হবে শো এবং সেই সঙ্গে ডিনার এন্ড ড্রিংক্স। ঐ মা ও মেয়ের সঙ্গ নিলাম আমরা। তার আগেই আমার নীলাভ সবুজ শাড়িটির দিকে তাকিয়ে সকলেই প্রশ্ন করেছেন ভারতের কোন্‌ প্রদেশের শাড়ি এটি। আমার দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পেরে আমি যারপরনাই গর্বিত তখন ঐ মধ্যপ্রদেশীয় চান্দেরীটিকে নিয়ে।

তারপর মঞ্চ আলোকিত হল। একে একে উঠলেন বিকিনি-বেশীনী নর্তকী, গায়ক, গায়িকারা। অনেকক্ষণ তামাশা, ব্যালে, নাটক, ফষ্টিনষ্টি, গান আর উদ্দাম নৃত্য চলল। তার ফাঁকে সুখাদ্য এল টেবিলে। আর সঙ্গে বহু প্রতীক্ষিত ফ্রেঞ্চ ওয়াইন।

আমার মতে ফ্রান্স ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর দেশ আর প্যারিস হল তার মধ্যে এক খণ্ড স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য অমরাবতী।


এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

3 thoughts on “travel-pori-painting-paris

  1. আমি এমনিতেই তোমার লেখার ভক্ত। ভালো লাগলো।

  2. খুব চমৎকার লাগল । আমিও ২০১৬ তে প্রথম প্যারিস দেখি । মিলিয়ে নিলাম আপনার অভিজ্ঞতা র সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাললাগার ।

Leave a Reply to Sathi Sengupta Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *