travel-sohorer-vetore-sohor

শহরের ভেতরে শহর – আমানা কলোনী
এলিজা বিনতে এলাহী (পরিব্রাজক)

মনে হচ্ছিল প্রতিটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি

আমাদের কিশোর সময়ে দেয়ালে ঝুলানো পঞ্জিকার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। তখন কিছু বিদেশী দৃশ্য দিয়ে ক্যালেন্ডার তৈরি করা হতো। সেই দৃশ্য গুলো দেখলে ঠিক সত্যি মনে হতো না। সবুজ গ্রাম, কাঠের বাড়ি, পিচে ঢালা পথ, যেখানে নেই আবর্জনার ছিটেফোঁটা।

আমানা কলোনী ঠিক এরকমই একটি গ্রাম। ভ্রমণ করতে গিয়ে এই গ্রাম গুলো দেখেছি ইউরোপে, জাপানে। একটি শহরের মধ্যে তৈরি হয়েছে একটি ভিন্ন শহর। এরকম শহরের কথা তো কতই জেনেছি। উদাহরণ দিতে বললে চট করে মনে পড়ে যায় ইতালির ভ্যাটিক্যান সিটির কথা। কিন্তু সাহিত্যের নগরেও যে রয়েছে এরকম একটি শহর সেটি আমার জানা ছিল না।

সাহিত্যের নগর?

কোথায় এই নগরী? মার্কিন মুলুকের আইওয়া রাজ্য। এই রাজ্যের রাজধানী শহর আইওয়া হলো দ্য সিটি অব লিটারেচার। সাহিত্যের নগর হবার তকমা পেয়েছে এই শহর বলা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকে। এই নগরের ভেতরের একটি ছোট্ট, ছিমছাম, গোছানো ছবির মত শহর আমানা কলোনী।

আমানা কলোনীর গল্প বলার আগে সাহিত্যের নগরের পরিচয় আর আমিই বা কেন গেলাম আইওয়া রাজ্যে সেটি একটু বলে নেই।

“আইভিএলপি ২০২২” এর প্রোগ্রাম শিডিউল যখন হাতে পেয়েছি, সত্যি কথা বলতে আইওয়া সিটি সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিল না। আমানা কলোনীর নাম তো কখনই শুনিনি। তারপর খোঁজখবর করে অল্প বিস্তর জেনেছি। সেই অল্প বিস্তর জানাতে দারুন এক আগ্রহ তৈরী হয়েছিল প্রেমের এই নগরীর প্রতি। যদিও এই শহরকে প্রেমের শহর বলা হয়না। সরল ভাষায় বলতে গেলে আইওয়া আমেরিকার দারুন গোছানো শান্ত একটি গ্রাম। ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়াকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই অঞ্চল।

১৮৫৫ সালের একটি মাংসের দোকান

দ্য সিটি অফ লিটারেচার উপাধির পেছনেও রয়েছে আইওয়া ইউনিভার্সিটি। ১৯৩৬ সাল থেকে বিশ্বের নানা দেশ থেকে লেখকরা জমায়েত হয় এই শহরে লেখকদের কর্মশালায়। বাদ যায়না বাঙালী লেখকরাও। বাঙালী লেখকদের পড়াশোনার ইতিহাসও রয়েছে।

কবিগুরু এখানে এসেছিলেন ১৯১১ সালে। তখন তিনি নোবেল বিজয়ী হননি। তাই এই শহরে সেরকম সাড়া পরেনি তার আগমনে। যতদূর জানি ৫ বার আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন কবি গুরু। কিন্তু প্রথমবারই ছিল আইওয়া শহরে। সম্বুগ হাউজ নামে একটি বাড়িতে উঠেছিলেন ইউনিভার্সিটি এলাকায়। এটি ছিল কবিগুরুর বন্ধুর বাড়ি। কবিতার উৎযাপনে তিনি পাপুয়া নিউগিনি, তিব্বত, ইকোয়াডর ছাড়া সব দেশেই গিয়েছেন। এরকমতো বলাই যেতে পারে, তিনি আইওয়াতে না জেনেই এসেছিলেন যে তিনিই পৃথিবীতে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রাম তৈরি করবেন, যেখানে ছোট্ট লণ্ঠন-জ্বলা গ্রামে দেশ-বিদেশ থেকে লেখক, গায়ক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীরা এসে থাকবেন।

প্রতিটি গ্রামেই এরকম একটি রান্না ঘর রয়েছে । যেখানে রান্না হতো গ্রামের সব মানুষের জন্য

আইওয়া শহর এখনই দারুন চুপচাপ। ঢাকা নগরী থেকে এখানে এসে পা রাখলে মনে হয়, এটি শহর হয় কি করে! সাপ্তাহিক ছুটির দিন গুলোতে জনমানবহীন মনে হয়। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আইওয়া নদীও শব্দহীন ভাবে বয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড়ের মিষ্টি হাওয়াও দারুন শান্ত। আমি পথে হাঁটি আর ভাবি ১৯১১ সালে এই শহরের অবয়ব কেমন ছিল! সুনীল মার্গারিটকে খুঁজে পেয়েছিলেন এই শহরে, আইওয়া ইউনিভার্সিটিতে। মার্গারিট আর সুনীলের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব (নাকি প্রেম জানি না), না হলে “ছবির দেশে, কবিতার দেশের জন্ম হতো কি না, কে জানে!!

শংখ ঘোষও এই শহরের পথে পথে হেঁটেছেন। লিখেছেন “আইওয়া এলবাম”। আমার হোটেলের পাশেই রয়েছে “রাইটার্স ইন এ ক্যাফে” নামে একটি কর্নার। সেখানেই ইতিহাস পেয়েছি এই শহরের “দ্য সিটি অফ লিটারেচার ” হয়ে উঠবার। ইউনেস্কো স্বীকৃত দিয়েছে এই শহরকে।

যেহেতু একটি ওয়ার্কশপ এর অংশ হিসেবেই দেখা হয়েছে আইওয়া রাজ্য। তারপরও আমাদের মিটিং মিছিলের ফাঁকে এই রাজ্যকে জানার সুযোগ পেয়েছি। সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন খোদ মার্কিন সরকার।

সেদিন সকালের কথা বলছি, মানে আমানা কলোনী ভ্রমণে যাবার দিন।

আগেই আমাদের বলা হয়েছিল সকাল ৮টার মাঝেই বেরিয়ে নাস্তা সেরে বেরিয়ে যাবো। যথারীতি হোটেলের বাইরে আমাদের জন্য গাড়ি রেডি ছিল। আমাদের সাথে ছিলেন দুই জন মার্কিন কর্মকর্তা কিন্তু তারা বাংলাদেশী। আমানা কলোনীতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে গাইড, পুরো শহরটি ঘুরে দেখাবার জন্য।

আইওয়া নদী

আইওয়া শহর থেকে আমানা কলোনী যেতে সময় লাগলো ঘন্টা দেড়েক। আমানা উপনিবেশগুলি হল প্রায় ২৬ হাজার একর জমি নিয়ে সাতটি গ্রাম। গ্রামের নাম গুলো হলো আমানা, পূর্ব আমানা, উচ্চ আমানা, মধ্য আমানা, দক্ষিণ আমানা, পশ্চিম আমানা এবং হোমস্টেড।

গাইড অভিবাদন জানিয়ে বললো, আমাদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা তৈরি এবং আজ আমাদের দ্বারা সংরক্ষিত একটি খাঁটি জার্মান পরিবেশের জগতে প্রবেশ করুন৷ অনন্য সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা নিন যার শিকড় জার্মানিতে রয়েছে এবং ৯০ বছরেরও অধিক সময় ধরে একটি সাম্প্রদায়িক যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিকাশ লাভ করেছে।

এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এখানকার মনোরম সাতটি গ্রামে পর্যটক আসছে। কেউ এখানে ভ্রমণে আসে ভিন্ন রকম খাবারের জন্য, কেউবা ওয়াইন বিয়ারে চুমুক দিতে, মানসম্পন্ন হস্তশিল্পের পণ্য, শিল্প এবং বিভিন্ন ধরণের বিচিত্র দোকানের জন্য যা রাস্তায় সারিবদ্ধ ভাবে রয়েছে।

পথে হাটতে হাটতে আমরা গাইডের কথা শুনছি আর চারদিক উপভোগ করছি। মার্কিন মুলুকে ছোট্ট এক জার্মান শহরে এসেছি, অল্প আলাপেই এতটুকু বুঝতে পারলাম। এই বসতি স্থাপনের ইতিহাস জানতে আগ্রহী হলাম।

আমানা গ্রামের একটি ওয়াইন ফ্যাক্টরী

আমানা উপনিবেশের ইতিহাস, একটি জাতীয় ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক এবং আমেরিকার সবচেয়ে দীর্ঘজীবী সমাজগুলির মধ্যে একটি।

আঠারো শতকের গোড়ার দিকে জার্মানীতে একটি অশান্তিপুর্ন ধর্মীয় আন্দোলন শুরু হয়। আমানা ধর্মের শিকড় রয়েছে পিয়েটিজম এবং রহস্যবাদের আন্দোলনের মধ্যে যা ১৭০০ এর দশকের গোড়ার দিকে জার্মানিতে বিকাশ লাভ করেছিল। ১৮৪২ সালে, আমানা ধর্মের একটি সম্প্রদায়ের সদস্যরা, জার্মানিতে নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। প্রথমে তারা নিউয়ইর্কের কাছে একটি স্থানে বসতি স্থাপন করে। এরপর একই সম্প্রদায়ের আরও অনেক অনুপ্রেরনাবাদী আমেরিকায় পাড়ি জমায়। ১৮৫৫ সালে, আমানার প্রথম গ্রামটি আইওয়া নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে। ১৮৬৩ সালের মধ্যে, আরও ছয়টি গ্রামে তাদের উপনিবেশ গড়ে তোলে।

আমানা হেরিটেজ মিউজিয়াম

গাইড বললো, এখন গন্তব্য আমানা কলোনী হেরিটেজ মিউজিয়াম।

আমানা কলোনীর ইতিহাস অন্বেষণ করার সেরা জায়গাগুলির মধ্যে একটি হল আমানা হেরিটেজ মিউজিয়াম। সেখানে, একটি দুর্দান্ত ভিডিও দেখলাম যা ইতিহাসকে দারুনভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি গ্রামেই একটি করে জাদুঘর রয়েছে। এই মিউজিয়াম থেকেই জানতে পারলাম, নারী পুরুষ মিলে এই সাতটি গ্রামকে কিভাবে তারা গড়ে তুলেছে।

প্রতিটি গ্রামই স্বয়ং সম্পুর্ন, নিজেদের খাবার উৎপাদন নিজেরাই করে থাকে। প্রতিটি গ্রামের নিজস্ব স্কুল, খামার, গীর্জা, কমিউনিটি রান্না ঘর, ওয়াইন উৎপাদন কারখানা, বেকারি, রেস্টুরেন্ট, পর্যটকদের থাকবার জন্য হোটেল রয়েছে। অর্থাৎ পুরো একটি আলাদা রাজ্য আমানা কলোনী, যেখানে আপনি পাবেন পুরোপুরি জার্মান সংস্কৃতির স্বাদ।

আমেরিকার ভেতরে ছোট্ট জার্মানী। আমানা কলোনি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থানীয় অর্থনীতি বজায় রেখে চল, শিল্পায়নকারী আমেরিকান অর্থনীতি থেকে তারা খুব কম আমদানি করে। আমানিয়ানরা ইউরোপ থেকে তাদের সাথে নিয়ে আসা বিশেষ কারুশিল্প এবং চাষ বাসের পেশাগুলি মেনে চলার মাধ্যমে এই স্বাধীনতা এবং জীবনধারা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

আজ, আমানার সাতটি গ্রাম তাদের রেস্তোরাঁ এবং কারুশিল্পের দোকানগুলির জন্য পরিচিত একটি পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র। ১৯৬৫ সালে আমানা কলোনী আমেরিকার একটি জাতীয় ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

কাঠের এই দ্বিতল বাড়ি গুলো প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে

গল্পের শুরুতে বলেছিলাম একটি ওয়ার্কশপে যোগ দেবার জন্যই আইওয়া শহর ও আমানা কলোনী ঘুরে দেখা। সেটি ছিল আইভিএলপি। মার্কিন মুলুক ভ্রমণের গল্পে অনেকবারই লিখেছি সেকথা। সঙ্গত কারণে এখানেও বলতে হচ্ছে। ছোট করে বলি মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণ কি করে এলো। আইভিএলপি হলো ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ প্রোগ্রাম, মার্কিন সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে ভিন্ন ভিন্ন পেশার স্কলারদের নির্বাচন করে নিজ দেশে একটি কর্মশালার আয়োজন করে, যার মাধ্যমে আমেরিকার শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তুলে ধরা হয় সেই সব দেশের নির্বাচিত মানুষদের সামনে। এই পরিক্রমায় বাংলাদেশের পাঁচ সদস্যের একটি দলকে আমন্ত্রন জানিয়েছিল মার্কিন সরকার। বাংলাদেশে মার্কিন সরকার এই কার্যক্রম পরিচালনা করছে ১৯৫২ সাল থেকে, সারা বিশ্বে পরিচালিত হচ্ছে ১৯৪০ সাল থেকে। যারা বাংলাদেশে হেরিটেজ কিংবা ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছে এরকম পাঁচ ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হয়। আমার জন্য একটি অভাবনীয় সুযোগ তৈরি হয় আমেরিকার ৪টি প্রদেশ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঘুরে দেখবার। আর একটি তথ্য বলার লোভ সামলাতে পারছি না, বাংলাদেশের প্রথম আইভিএলপি অংশগ্রহণকারী ছিলেন আমাদের জাতির পিতা।

আমার প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ, প্রথম সাহিত্যের নগর ভ্রমণ, ঐতিহাসিক আমানা কলোনী সম্পর্কে জানা, স্মৃতি মানসপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে সব সময়।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *