micro-story-chot-jaal

চট জাল
হামিরউদ্দিন মিদ্যা


খালপাড়ের ধারে করম আলীর ভিটেমাটি আগলে আশি ছুঁই ছুঁই মেহেরনুন্নেশার ঘরসংসার। এক ছেলে, সে-ও বুড়োতে গেল। নাতি-নাতবউ নিয়ে চারজন।

নাতিটাকে নিয়েই বুড়ির যত ভয়। পাগল হয়ে গেল নাকি! কোথা থেকে কী শুনেছে কে জানে! সব কাজ মাথায় তুলে,কাগজপত্তর নিয়ে মেতেছে। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই—শুধু এখানে সেখানে ছোটাছুটি।

মাথায় কী যে ভূত চেপেছে! একদিন পুরনো সিন্ধুক, বাক্সপেটরা সব ধা করে ফেলে, জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে তছনছ করল। হাতড়ে-হুতড়ে বাক্সের তলায় শুধু পেল, তার মায়ের বিয়ের লগনে দেওয়া একটা পেতলের কাজললতা, দুটো শুকনো হরিতকী, আর একটা সুপুরি কাটার জাঁতি।

নাতবউ খালাস হতে গেছে বাপের বাড়ি। সেই মেয়ে এখন ঘরে থাকলে, নাতির খ্যাপাগিরি ঘুঁচিয়ে দিত। মেহেরনুন্নেশার সেই সাহস নেই।

নাতির পেছনে দাঁড়িয়ে কান্ডকারখানা দেখে ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করল, এমুন করে কী খুঁজিস বাপ? পাগল হয়ি গেলি নাকি!

নাতি তখন বিরক্তিতে মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল—হ হ, পাগল হয়ি গেছি। শালার বুড়োটা কাগজপাতি কিছুই রেখে গেছে! মোষের মতো খেটেচে, আর খেইচে। এবার মজা দেখবি।

মেহেরনুন্নেশা তো তো করে—কী হয়িচে একটুকুন খুলে বল বাপ। কে মজা দেখাবেক!

—এই যে ভিটেমাটি, যার উপর আমরা দাঁড়িই আছি— এগুলো কার? কতদিন বাস করছিস এখানে?

—কার আবার! আমাদের। সেই কুন কালে মল্লিকবাবুরা পুকুরটা দেখভালের জন্যি রাখা রাখলেক। তুর দাদোর বাপ ছেল রাখা। তুর দাদোও রাখাগিরি করতুক। সে কী আজকালকার কথা রে!

—তার প্রমাণ কী? কাগজপত্তর কিছু আছে? দ্যাশে নতুন আইন হচ্ছে। সবাইকে প্রমাণ দেখাতে হবেক।

বুড়ি নাতির কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল, বলল—আমার ভিটে, আমার মাটি, আবার আমাকেই পমাণ দেখাতে হবেক! কে পমাণ লিবেক? আসুক দিনি আঁটকুড়োর ব্যাটারা! ঝেঁটিয়ে মুইয়ের বিষ ভুঁইয়ে নামিই দিব।

দাদির কথা শুনে নাতির মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। বলল, তুর ওসব ছেঁদো কথায় কিছু কাজ হবেকনি দাদি। তুর ভিটে, তুর মাটি সেটা গিরামের লোকে জানে। সরকার জানবেক কী করে? অন্য দ্যাশ থিকেও তো লুকিয়ে ঢুকে পড়তি পারিস। কাগজই সব কথা বলবেক।

—রাখ তুর কাগজ! কাগজের নিকুচি করেছে! খালপাড়ের দখিনে খেঁজুর গাছটার তলায় শুইয়ে আছে তুর দাদো করম আলী। মাটি খুঁড়ে হাড়পাঁজরা গুলো দেখিই দিব।

নাতির মন মানে না। দিনকে দিন কাগজ কাগজ করে পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছে। বুড়ি হা-হুতাশ করে উঠে, ও নওশনের বাপ। আমাদের কুথায় থুইয়ে গেলে গ!

মেহেরুন্নেশা প্রথমে ভেবেছিল নাতির মাথায় কোনো ব্যামো-ট্যামো হয়েছে। তাই আলফাল বকছে। সেই ভুল ভাঙতে বেশি দেরি হল না। যেদিকেই যায় এখন, সবখানেই একই কথা। নাতির মাথার ব্যামোটা তাইলে গোটা গাঁয়ের মানুষগুলোর মাথায় ঢুকে পড়ল নাকি! হায় আল্লাহ! এ কী দিনকাল পড়ল গো! সারা দেশ জুড়েই যে আগুন জ্বলার খবর।

পুকুরে চট জাল নামিয়ে আগাছা মাছগুলো যেমন তুলে ফেলা হয়, তেমনি সারা দ্যাশ জুড়েই নাকি জাল ফেলা হবে! সবার তাই ছোটাছুটি। নিজেকে জাত মাছ হিসাবে প্রমাণ দেওয়ার জন্যে মরিয়া।

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মেহেরনুন্নেশা একবার ঘরে ঢুকে, তো একবার ঘরের পিঁদাড়ে এসে খালপাড়ের দখিন পানে চেয়ে দাঁড়ায়। কার জন্যে অধীর প্রতিক্ষা করে থাকে বুড়ি। যেন ঝোপঝাড়ের তলায় চাপা পড়া কবর ফুঁড়ে কয়েকশো বছরের পুরনো দলিল হাতে উঠে আসবে বুড়ো করম আলী।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *