নীলা নাথ দাস
সারাদিন দিন মজুরের কাজ করে ক্লান্ত দেহ, মন নিয়ে সন্ধ্যে বেলায় ওর ঝোপড়িতে ফেরে বিলাস৷ মেয়ের জন্য খাবার বানিয়ে, ওকে খাইয়ে তারপর সত্যের সঙ্গে একটু গপসপ করে ঘরে ফেরে৷ ততক্ষণ, ওর পড়শী লছমী মাসী মেয়েকে দেখে রাখে৷ ও আর সত্য সুখ-দুঃখের কথা আদান-প্রদান করে মন শান্ত করে৷ কখনো সখনো সত্যের বউ এসে গল্প করতে জুটে যায়৷ রাত গাঢ় হতে শুরু করলেই বিলাস ওঠার জন্য ছটফট করে৷ মা হারা মেয়ে ঝুমরীর জন্য মনটা উথাল-পাথাল করে৷ এতক্ষণে মেয়েটা বুঝি ঘুমিয়ে পড়ল৷ সেই ভোরবেলা বেরিয়ে যায়, সারাদিন সাক্ষাৎ হয়না৷ রাত্রে একটু আদর পায় মেয়েটা৷ ও ওঠার জন্য তাড়াহুড়ো করে৷ সত্য বলে, “বিয়ে কর বিলাস৷ কত বড় জীবন এখনো পড়ে আছে৷ মেয়েটাও তো কত ছোট, পাঁচ বছরের৷ মা ছাড়া কি করে মানুষ করবি ঝুমরীকে! বিলাস বলে, “পাগল, সৎ মা কি কখনো নিজের মায়ের মতো হয়? বিয়ে আমি করব না৷ মেয়েকে একাই বড় করব, লেখাপড়া শেখাব৷ তাছাড়া, তোরা সবতো আছিস৷” বলতে বলতে উজ্জ্বল হয় ওর মুখ৷
তারপর, ঘরের পথ ধরে বিলাস থুড়ি সুখমনি৷ বিলাস তো ওর স্বামীর নাম৷ রাজমিস্ত্রীর কাজ করত বিলাস৷ একদিন, কাজ চলাকালীন উঁচু ভারার থেকে পড়ে যায় বিলাস৷ মাথায় আঘাত লেগেছিল৷ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যায় ও৷ তারপর স্বজনহীন এই দুনিয়ায় কোলের মেয়েকে নিয়ে অথৈ জলে পড়ল সুখমনি৷ কিন্তু পেট তো খিদে মানে না৷ বিলাসের শ্রাদ্ধ শান্তি মিটতেই মেয়েকে পিঠে বেঁধে কনস্ট্রাকশন সাইটে যোগালির কাজ নেয় ও৷ কিন্তু, সেখানেও বিপদ যেন ওত পেতে ছিল৷ প্রতিদিনই কেউ না কেউ কু প্রস্তাব দিতে শুরু করল সদ্য বিধবা যুবতী সুখমনিকে৷ একরাতে মেয়েকে নিয়ে পালাল ও৷ ট্রেনে চেপে একদম ভিন রাজ্যে৷ তারপরের জীবন রূপান্তরের৷ পুরুষের মত করে চুল ছেঁটে, লুঙী শার্টে রাতারাতি পুরুষের ভেক ধরল ও৷ নাম নিল স্বামীরই৷ বিলাস৷ বিলাস ওঁরাও৷ নিজের রূপান্তরের কথা কাউকে কখনো বলেনি সুখমনি৷ এখন, মেয়ে আর ও নিজে দুজনেই নিরাপদ৷ তবু, মাঝে মাঝে, একা ঘরে আয়নায় নিজের মুখ দেখে সুখমনি৷ অকাল বার্ধক্যের চিহ্নস্বরূপ বলিরেখাযুক্ত রুক্ষ ত্বক, কাঁচা পাকা ছোট করে ছাঁটা চুলে নিজেই নিজেকে দেখে চিনতে পারা কঠিন৷ কিন্তু বুকের ভেতর ফল্গুধারাকে তো আটকানো যায়না৷ তার কুলকুল শব্দ শুধু ও শুনতে পায়৷ আর কেউ না৷ সকলের অজ্ঞাতে কত কাল ধরে, ওর সুধারসে সঞ্জীবিত করে রেখেছে ও ঝুমরীকে৷ ও যে ঝুমরীর মা! বিলাস তো ওর ঢাল মাত্র!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন