মৌসুমী ঘোষ
অফিস টাইম। কেউ হেঁটে, কেউ ছুটে প্ল্যাটফর্মের দিকে যাচ্ছে। এদের কয়েকজন আমার নিয়মিত কাস্টমার। কেউ চা, কেউ বিড়ি, কেউ লুকিয়ে গুটখা নেয়।
রেলগেটের পাশে পোঁটলা নিয়ে বসে হাবিও ওদের হাঁ করে দেখছে। ওরা মাঝে মাঝে হাবিকে বিস্কুট-কেক দেয়।
—কত দরে বিক্রি হল, জানো কিছু?
—উঁহু, রাতারাতি হয়ে গেল তো।
—মাস্টার আসেনি আজ?
—বদলি হয়ে গেছে শুনলাম।
—সাফাই কর্মী?
—কেজানে! আজ তো কাউকেই দেখছি না।
—তাহলে কথাটা জানলে কেমন করে?
—গেটম্যান বলল।
—হবে জানা কথা ছিল, অনেকদিন ধরে লসে রান করছিল স্টেশানটা।
খবর হল, আপ মেন-লাইন বর্ধমান লোকালের। মেয়েটির কণ্ঠস্বর একেবারে অপরিচিত। পেশাদারি স্পষ্ট স্বর। সামন্তদা সাইকেল গ্যারেজে গাড়ি রেখে ছুটলো। ভোরে স্টেশন পরিষ্কার হয়েছে মেশিন দিয়ে। চায়ের স্টলগুলো তুলে রেলের জমির বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
—কত করে পেলে তোমরা?
—কিচ্ছুনা। মডেল স্টেশান। শুধু মেয়েরা অপারেট করবে।
—কে বলেছে?
—ঠিকাদারের লোক এসেছিল ফার্স্ট লোকালে। নোটিশ বোর্ডে কাগজ সাঁটিয়ে ফিরতি লোকালে চলে গেছে।
খবর হল, ডাউন মেন-লাইন হাওড়া লোকালের। মেয়েটার কণ্ঠস্বর মাইকে ভেসে এল।
রতনবাবু স্কুটারের চাবিটা পকেটে ভরে এগিয়ে গেলেন। স্টেশনের মুখে একজন আরপিএফ লাঠি উঁচিয়ে খুব চেঁচাচ্ছিল। অফিস টাইমের ভিড় সরে আসছিল উর্দিধারীর কাছে। সাইকেল গ্যারেজের টোটন ছুটে গেল ভিড়ের দিকে। বিড়ি বার করে মুখে গুঁজতেই চোখ চলে গেল রেলগেটের দিকে। হাবি কোথায়? থুথু ফেলে এগোলাম।
টোটন ভিড় থেকে বেরিয়ে বলল, আরপিএফটার পা ছাড়ছে না হাবি। লোকটা লাঠি মেরে হাবির মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। হাবি তবু প্ল্যাটফর্মে উঠবেই বলে জেদ করে আছে। ইউনিয়নের বাপিদাদের ডাকতে গেল টোটন।
ভিড় সরিয়ে ঝুঁকতেই হাবির রক্তাক্ত উকুন ভরা জটাচুলো মাথাটা দেখলাম। সরে এসে থুথু ফেললাম। টিকিট কাউন্টারে নতুন মেয়ে। হোলটা দিয়ে ফর্সা হাত আর বুকদুটো দেখা যাচ্ছে। কয়েকজন অফিস প্যাসেঞ্জার দূর থেকে বোঝাচ্ছিল হাবিকে। হাবি নাছোড়।
আরপিএফটি তখন হাবির চুলের মুঠি ধরে পা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
—কী নিশংস রে বাবা! একটা পাগলীর সঙ্গে কেউ এমন করে?
—এই তো শুরু। বেসরকারীকরণের প্রথম আঁচ। বেচারা হাবি।
কথা বলতে বলতে মেয়ে দুটো লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে গেল। থুথু ফেলতে সরে এলাম। ভিড় থেকে একটা মেয়ের গলা শোনা গেল। প্যান্ট-শার্ট পরা একটা মেয়ে হাবিকে তুলে দাঁড় করালো। হাবি হঠাৎ শান্ত হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়াল।
—তুমি স্টেশনে গিয়ে কী করবে? ট্রেনে চড়বে? ট্রেনে চড়ে কোথায় যাবে?
কোনো উত্তর নেই। কী মিষ্টি কণ্ঠস্বর! হাবিকে বেঞ্চে বসিয়ে ওর মাথায় বোতল থেকে জল ঢালল।
—তোমার নাম কী? বাড়ি কোথায়?
ভিড়টা ধীরে ধীরে আপ-ডাউনে ভাগ হয়ে গেল।
চায়ের গুমটিটা সারিয়ে গ্যারেজের পাশে বসানো হয়েছে। স্টেশনে ঝকঝকে কয়েকটা স্টল বসেছে। তারই একটা স্টলে সিমলি ডাস্টবিন পরিষ্কার করে। ফাইফরমাস খাটে। সিমলির চুল পরিপাটি করে বাঁধা। ছেঁড়া সায়া-ব্লাউজ নয়, এখন কোম্পানির লোগো আঁটা চুড়িদার পরে থাকে সিমলি। জামা কোথায় পেলি জিজ্ঞেস করলে মুচকি হেসে বলে, দিদিমণির পুরোনো জামা। টেকে নিয়েছি।
পর পর দু’টো গাড়ির খবর হল। অ্যানাউসারের কণ্ঠস্বরটা এ ক’দিনেই পরিচিত হয়ে গেছে। শেষ ডাউনের গাড়িটায় স্টলে কর্মরত মেয়েগুলো ফিরে যায় দোকান বন্ধ করে। ওরা চলে গেলে, সিমলি যায় ম্যাডামের কোয়াটার্সে। ইউনিয়নের ছেলেরা ‘হাবি’ বলে আওয়াজ দিলে পিছন ফিরে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, আমাকে ‘সিমলি’ বলে ডাকবে। ম্যাডাম নাম দিয়েছে। চারদিক থেকে ছেলেগুলোর ‘হোহো’ হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। থ্রু ট্রেনের হুইসিলের আওয়াজটা দ্রুত কাছে আসতেই হাসির আওয়াজ চাপা পড়ে যায়। বাপিদা বিড়িতে আগুন ধরিয়ে কালী বাড়ির দিকে যায়। বাইকের ধোঁয়াটা গুমটির সামনে ঘুরপাক খায় কিছুক্ষণ। ধোঁয়া-ভরা থুথুটা ফেলে আসার জন্য স্টেশানের পে টয়লেটের দিকে এগোই।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
পড়েছি আগেই, চার্জ চলে গিয়েছিল বলে কমেন্ট দিতে পারিনি। তোমার অন্যান্য গল্পের মতই এতেও নতুনত্বের স্বাদ পেলাম।
পড়েছি আগেই, কমেন্টটা দেওয়া হয়নি। তোমার অন্যান্য গল্পের মতই এ গল্পেও নতুনত্বের স্বাদ পেলাম।
ভালো লাগল
নতুন বিষয়। ভালো লাগল।