short-story-boro-andhokar

বড় অন্ধকার
বাসুদেব মালাকর


“এই যে ভাই, ভাড়া যাবেন তো?”
“কোথায় যাইবেন?”
“গাজনডাঙা, সিংহবাড়ি।”
“যাব, দশ টাকা বেশি লাগব।”
“হঠাৎ বেশি কেন?”
“রাত ন’টা বেজে গেছে—ন’টার পরে রেট নাই!”
সীটের উপরে বসে ড্রাইভিং সীটের উপরে পা রেখে, লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে তুলে রিকশাচালক বেশ তেরিয়া ভঙ্গিতে অতনুর সঙ্গে কথা বলছিল। রাত খুব বেশি হয়নি—ন’টা বেজে বারো মিনিট। ঘন্টাখানেক আগে একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। বহুদিন পিচ না-পড়া রাস্তার খানা-খোদলে নোংরা জল জমে আছে। এখন বৃষ্টি নেই, কিন্তু আকাশে মেঘ আছে। পশ্চিমদিক থেকে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। আপ ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর স্টেশন এলাকাটা একেবারে শুনশান। স্ট্যাণ্ডে খানতিনেকের বেশি রিকশাও নেই।
অতনুর বাঁ-কাঁধে একটা মোটামুটি ভারী ব্যাগ, ডান হাতে অ্যাটাচি। তার পিছনে মাধবী। ট্রেনের ভিতরেও বৃষ্টির ছাঁট এসে তার শাড়ির নিচের দিকটা ভিজিয়ে দিয়েছে, ঠাণ্ডা হাওয়ায় বোধহয় শীতও করছে—মাধবী আঁচলটা গলায় জড়িয়ে নিয়েছে।
স্টেশন থেকে গাজনডাঙায় তাদের বাড়ি খুব বেশি দূর নয়। স্বাভাবিক গতিতে হাঁটলে মিনিট দশেক লাগবার কথা। এমনিতে রিকশাভাড়া কুড়ি টাকা। আজ তার উপরে দশ টাকা বেশি দিতে হবে। অতনু রিকশাওয়ালাকে বলল, “আপনি নেমে দাঁড়ান, উঠব।” প্রথমে মাধবী, তারপরে অতনু উঠতে রিকশা চলতে শুরু করল।
রাস্তার দু’পাশের জলায় ব্যাঙ ডাকছে নতুন বৃষ্টির জল পেয়ে। জলার ওপাশের বাড়িগুলো থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। ডান দিকে, অনেকটা দূরে হলেও, তাদের বাড়ির পিছনে একটা মোবাইল টাওয়ার বসেছে—তার মাথার লাল আলোটা চোখে পড়ছে।
অতনু রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল, “বিশেষ বিশেষ সময়ে এই যে আপনাদের ভাড়ার হেরফের হয়, এগুলো কারা ঠিক করে দেয়?”
রিকশাওয়ালা বলল, “কে আবার ঠিক করবে! আমরা নিজেরাই করি!”
“ইউনিয়ন নেই? তারা কিছু বলে না?”
“কী আবার বলবে! আমাদের কথার উপরে কে কথা বলবে?”
“আপনাদের ইউনিয়নের লীডার কে এখন?”
রিকশাওয়ালা লোকটা সত্যিই উদ্ধত প্রকৃতির, বোঝা গেল। অভব্য তো বটেই—যে ভাবে মাধবীর সামনে উরুর উপরে লুঙ্গি তুলে বসে ছিল…।
বেশ কর্কশস্বরেই জিজ্ঞাসা করল, “লীডারের নামে কী দরকার? নালিশ করবেন নাকি? কিচ্ছু করতে পারবেন না! আমরা পার্টিকে রেগুলার চাঁদা দিই, ভোট দিই, সব পোগ্গামে থাকি।”
অতনু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, মাধবী তার উরুতে চিমটি কেটে ঠোঁটে তর্জনি ছুঁইয়ে চুপ করে থাকার ইশারা করল।
লোকটা আগের কথা খেই ধরেই বলল, “তপনদা, তপন সাহা আমাদের লীডার। চিনেন তারে? আমার নাম অজিত বণিক। তপনদারে রোজ সন্ধ্যায় পার্টি অফিসে পাইবেন। তারে কইবেন, অজিত দশ টাকা বেশি নিছে।”
অতনু খুব নরম স্বরে বলল, “আপনি কতদিন আছেন এখানে?”
রিকশাওয়ালা উত্তর দিল, “ছয়চল্লিশ বচ্ছর!”
অতনু বুঝতে পারল, লোকটা মিথ্যে কথা বলল! এরা আগে এখানে ছিল না, হালে এসেছে।

অতনু এখানকার ভূমিপুত্র। এখানেই তাদের চোদ্দ পুরুষের বসবাস। সে এখন পাকাপাকিভাবে গ্রামে থাকে না, ঠিকই, কিন্তু তার মা-বাবা-কাকা-কাকি এখনও এখানে আছেন। কাকার নাতির অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে সে মাধবীকে নিয়ে আজ গ্রামে এসেছে।
অতনুর একটা ধারণা ছিল, এখানকার বিভিন্ন ক্লাব-কমিটি-সমিতি-ইউনিয়নের মাথায় যারা আছে, তাদের বেশিরভাগই তার পরিচিত হবে। হয় বন্ধু, না হয় স্কুলের ক্লাসমেট কিংবা বয়স্ক চেনাজানা কেউ। সে জন্যই এদের লীডারের নামটা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু অবাক হয়ে গেল এই ভেবে যে, কে এক বহিরাগত তপন সাহা, তার দলের অজিত বণিক কেমন রং দেখিয়ে জানিয়ে দিল, কোনও বিষয়ে নালিশ জানিয়ে ফল হবে না! এবং সেটা আগাম ঘোষণা করবার মতো একটা পরিস্থিতিও তৈরি হয়ে গেছে! অতনু মাধবীর দিকে তাকাল। মাধবী তার হাতে একটু চাপ দিয়ে বলল, “ইউ কান্ট্ রিফর্ম এ রোগ্! সো, ইট ইজ ইউজলেস টু ডীল উইথ দ্য ভাইল! ডোন্ট বি আপসেট!”

দশ টাকা বেশি দেওয়াটা অতনুর কাছে কোনও বড় সমস্যা নয়। এই লোকটা জানে না, এদের মতো অনেক গরিব মানুষদের সামনে তাকে প্রায়ই ঈশ্বরের ভূমিকায় নামতে হয়! তার সম্পর্কে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি সেই মানুষগুলোই ব্যবহার করে! অতনু হাসিমুখেই সেই ঈশ্বরের ভূমিকা পালন করে এবং সে জন্য তার মনে কোনও অহঙ্কার বা ঔদ্ধত্য নেই।

বাড়ির সামনে এসে মাধবী তার ব্যাগ খুলে তিনটে দশটাকার নোট অজিতের দিকে বাড়িয়ে ধরল। অতনু কী এক গভীর বিষাদ নিয়ে অজিতকে দেখছিল। দশ টাকা কী এমন বেশি! এক বাণ্ডিল বিড়ির দাম হয়তো। অজিতের দাবি ছিল অতিরিক্ত দশটি টাকা এবং সেই টাকাটা পাওয়ার নিশ্চয়তা সে আগেই কনফার্ম করে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার অন্য আরেকটা পদ্ধতিও ছিল! সে সিংহবাড়ির দরজায় ওদের নামিয়ে দিয়ে বলতে পারত, “দাদা, বৃষ্টিবাদলার রাত—ভাড়াটা একটু বিবেচনা করে দেবেন।” তাতে ওরই লাভ হত। মাধবী পঞ্চাশ টাকাও দিয়ে দিত হয়তো! তার বদলে…

অজিত তার কপিশ চোখের মণিতে ঔদ্ধত্য ফুটিয়ে বলল, “কী দেখতেছেন অত! ফটো তুইলা নিবেন নাকি! চেষ্টা কইরা দ্যাখেন—কিচ্ছু করতে পারবেন না!” মাধবী অতনুর বাহু ধরে তাকে ভিতরে নিয়ে গেল।

অতনুর ঠাকুরদা প্রমথ সিংহ অঞ্চলের গণ্যমান্য লোক ছিলেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে এখানে ছেলেমেয়েদের দুটো পৃথক হাইস্কুল, পোস্ট অফিস, বারোয়ারি পুজোমণ্ডপ, পুলিশ আউটপোস্ট তৈরি হয়েছিল। এখন যেখানে অজিতদের রিকশাস্ট্যাণ্ড, ওটাও অতনুদের জমি। প্রমথ সিংহ খুব রাশভারি লোক ছিলেন। এখন বেঁচে থাকলে হয়তো অক্ষম রাগে পাগল হয়ে যেতেন!

অতনু ডাক্তারি পাশ করে প্রথমে প্র্যাকটিসের দিকে না গিয়ে সরকারি হাসপাতালে চাকরি নিয়েছিল। তার ধারণা, হাসপাতালে একসঙ্গে বেশি মানুষকে পরিষেবা দেওয়া যায়। ইচ্ছে করলেই সে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারে। তার যা ডিগ্রি এবং হাতযশ— রোজ কোনও ওযুধের দোকানে বসলে বা নার্সিং হোমে জয়েন করলে সহজেই মাসে অঢেল টাকা আয় করতে পারে। কিন্তু তাকে ওসব করতে হয়নি। একগাদা টাকা আয় করবার কোনও তাগিদের সম্মুখীন হয়নি সে। এ ব্যাপারে তার একটি জোরালো রক্ষাকবচ আছে!

মাধবী নাম্নী যে ইঞ্জিনটাকে মা-বাবা তার সামনে একদা জুড়ে দিয়েছিলেন, সেটি একেবারে মার্টিন রেলের ইঞ্জিন! দুরন্ত গতি, সদর্পে লোহার লাইন গিলতে গিলতে এগিয়ে চলা, মাটি-কাঁপানো গর্জন—কিছু নেই তার! টাকাকড়ি গয়নাপত্তরের প্রতি তার কোনও আকর্ষণ নেই! তার একমাত্র চাহিদা হল রাজ্যের বই! সংসারের কাজকর্ম সেরে সে বইয়ের জগতে ডুবে যায়। একটা নতুন শাড়ির বদলে একটা কবিতার বই পেলেই সে খুশিতে ডগমগ করে! সারাদিন বই পড়ে পড়ে এই বিয়াল্লিশ বছর বয়সেই তার চোখে মোটা কাচের চশমা উঠেছে! অতনু তাহলে কার জন্য টাকাপয়সার পিছনে হন্যে হয়ে ছুটবে!

অনেকগুলো গ্রামীণ, মহকুমা, জেলা হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে সে এখন কলকাতার এক বড় হাসপাতালে থিতু হয়েছে এবং আনন্দে আছে। তাদের একটা মেয়ে—এবার হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা দেবে। তার স্বভাবও মায়ের মতো। দেড়-দু’মাস অন্তর মা-বাবা-কাকা-কাকিকে দেখতে অতনুকে বাড়ি আসতেই হয়। তাঁদের জন্য বাড়িতে কিছু জরুরি ডাক্তারি সরঞ্জাম, ওষুধপত্তর রাখা আছে। স্থানীয় হাসপাতাল, ডাক্তারখানায়ও বলা আছে, মা-বাবা খবর দিলেই কেউ যেন অ্যাটেণ্ড করে। অতনুর ক্লাসমেট, ব্যাচমেট, সিনিয়র, জুনিয়র তো সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। অসুবিধা হয় না তেমন।

গতকাল মাধবী বাড়িতে এসেই বলেছে, “দেখো তো, বাজারে ভালো কড়াইশুটি পাও কিনা। বাবাকে গ্রিন মোমো বানিয়ে খাওয়াব।” সকালে সেই কড়াইশুটির খোঁজে অতনু বাজারের দিকে যাচ্ছিল। একটা খালি রিকশা খ্যাড়খ্যাড় শব্দ করে প্রায় তার গা ঘেঁষে চলে গেল! পাশে যথেষ্ঠ জায়গা ছিল, তবুও মনে হল, রিকশাটা ইচ্ছে করেই এমন করল! ঘাড় বাঁকিয়ে একটু পাশে সরে গিয়ে দেখল, রিকশার চালকের আসনে কালকের সেই অজিত বণিক! লোকটা মনে হয় তাকে বিব্রত করে দাপট দেখাতে চাইছে! অপমানেরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পদ্ধতি আছে। নিচতলা সুযোগ পেলেই উপরতলার দিকে সেটা প্রয়োগ করে।
একটু এগিয়ে মিত্রবাড়ির সনতের সঙ্গে দেখা হল। সনৎ আজকাল রাজনীতি করছে। ভালো ছেলে, লেখাপড়া জানে, সৎ হিসেবে জানে সবাই। ওর জ্যাঠামশাই হরেন্দ্রনাথ মিত্র আন্দামান-ফেরৎ স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।
দেখা হতেই সনৎ হেসে বলল, “কবে এলে, অন্তুদা?”
অতনু বলল, “কাল রাতে বৃষ্টির ভিতরে। তোরা সবাই ভালো আছিস তো?”
সনৎ বলল, “হ্যাঁ, তোমরা? বৌদিও এসেছে নাকি?”
অতনু ইতিবাচক ভঙ্গি করে বলল, “আচ্ছা সনৎ, এখানকার রিকশা-টিকশাগুলো কারা কন্ট্রোল করছে রে আজকাল?”
সনৎ কী একটা আঁচ করে বলল, “ওটা আমাদের পার্টির হাতে নেই। ওখানে এখনও ঢুকতে পারিনি। তবে এবার ঢুকব। কেন, কিছু হয়েছে নাকি?”
অতনু বলল, “না, এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।” অতনু শুনেছে, সামনের পুরভোটে সনৎ প্রার্থী হবে। শোনা যাচ্ছে, জিতেও যাবে। সনৎ ভালো ছেলে, জিতলে ভালোই হবে।

বাড়ি ফেরার সময় গোপালদাকে দেখতে পেলো অতনু। মনে পড়ল, এই গোপালদা অতনুদের ছোটবেলায়ও রিকশা চালাত। এখন বেশ বুড়ো হয়ে গেছে, তবু রিকশা চালানো ছাড়েনি! কতদিন গোপালদা স্কুল থেকে ফেরার পথে অতনুকে রিকশায় তুলে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। মা টাকা দিতে গেলে বলত, “ছিঃ মা! বসেই তো ছিলাম—সেই ফাঁকে ভাইকে একটু চড়িয়েছি বলে পয়সা নেবো!” বাড়ির পুজোপার্বণে ওরা সপরিবারে পেট ভরে খেয়ে যেত। তখনও এ ধরণীতে অজিত বণিকেরা আবির্ভূত হয়নি। হলেও, নব্য দীক্ষায় দীক্ষিত হয়নি। মানুষের মনের গভীরে কোথাও একটা পারমানেন্ট ব্লকেজ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে—খুব ডিফিকাল্ট জোন—অপারেশন করাও সম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতে অতনু বাড়ি ঢুকে পড়ল।

কাকার নাতির অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান কাল মিটে গিয়েছে। অতনু ভেবেছিল, বিকেলেই মাধবীকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে যাবে। টানা চারদিন সে হাসপাতালের বাইরে, ডাক্তার বোসের উপরে খুব চাপ পড়ে যাচ্ছে। মেয়ে মালিনীও কাজের মেয়েটিকে নিয়ে ফ্ল্যাটে একা রয়েছে।

কিন্তু সেদিন আর ফেরা হল না। অনুষ্ঠানবাড়ির ধকলে হঠাৎ মায়ের শরীরটা খারাপ হয়ে পড়ল। প্রেশার বেশ উপরের দিকে, সঙ্গে ফ্লুয়ের মতন সিম্পটম। মা বললেন, “কতদিন কামাই করবি! আমার কিছু হয়নি। ও দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে। তুই মাধবীকে নিয়ে চলে যা। বাড়িতে দিদিভাই একা।” অতনু রাজি হয়নি। অন্তত আরও একটা দিন দেখে যাবে বলে মনস্থ করল। আকাশের অবস্থাও ভালো না। যে কোনও সময় অঝোরে নামতে পারে। অতনু আগামিকাল সকালেই বেরিয়ে পড়বে ঠিক করল।

রাত তখন প্রায় এগারোটা। অতনু ডিনার সেরে মায়ের কাছে বসে টিভি দেখছিল। সেইসময় উঠোনে একটা বাইক থামার শব্দ হল! কে যেন দু’বার ডাকল, “অন্তুদা, অন্তুদা, একবার বাইরে এসো, প্লিজ!” অতনু বেশ বিস্মিত হয়ে বারান্দায় এসে দেখল, সনৎ এসেছে! সঙ্গে আর একজন লোক। বাইরের আলোটা জ্বালতে সনৎ বলল, “অন্তুদা, একটা পেশেন্ট দেখতে যেতেই হবে, এখুনি! এত রাতে আর কাউকে পেলাম না।”

আগামি পুর নির্বাচনে সনৎ বোধহয় জয়ের গন্ধ পেয়ে গিয়ে থাকবে। এখন সেই গন্ধের টানে তাকে এমন জনসেবা চালিয়ে যেতেই হবে। সনৎ আগের কথার খেই ধরে বলল, “পেশেন্টের ভীষণ জ্বর, সঙ্গে মারাত্মক খিঁচুনি! হাত-মুখ বেঁকে যাচ্ছে! তুমি রাতটার মতো সামলে দাও, প্লিজ। এই যে, এর ছেলে, বছর বারো বয়স।”

অতনু জিজ্ঞাসা করল, “কয়েকদিনের ভিতরে ইদুর বাঁদর বিড়াল কুকুরে কামড়েছিল?” সনৎ পিছনের লোকটিকে বলল, “ডাক্তারবাবু যা জিজ্ঞেস করছে, উত্তর দে!” লোকটি এগিয়ে আলোর সামনে আসতেই অতনু অবাক হয়ে গেল! জিজ্ঞাসা করল, “আপনার নাম তো অজিত বণিক, তাই না?” সনৎ অবাক হয়ে বলল, “তুমি ওকে চেনো?” অজিতের দু’চোখে তখন এক আর্ত বিপন্নতা।

অতনু শুনেছে, খবরের কাগজেও পড়েছে, কখনও কখনও এভাবে ডাক্তারদের ভুয়ো কল দিয়ে ফাঁদে ফেলে নানারকম বেআইনি কাজ করতে বাধ্য করা হয়। তারপরে কাজ হাসিল হয়ে গেলে, প্রমাণলোপের জন্য—অতনুর গা-টা শিরশির করে উঠল! সনতের দিকে তাকিয়ে বলল, “যাব অবশ্যই। কিন্তু তোকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে।” সনৎ রাজি হল। অতনু বলল, “দাঁড়া, জামা-প্যান্ট বদলে ব্যাগটা নিয়ে আসছি।” কোনও অজুহাতেই বিপন্ন আর্ত মানুষকে ফেরানোর কথা সে ভাবতেই পারে না। অতনু দ্রুত ভিতরে চলে গেল।

অতনু অনেককেই জানে, রাতের কল এলে যাঁরা ডবল ট্রিপল ভিজিট নেন। সেই হিসেবে অতনুও তেমন চাইতে পারে। বিশেষ করে বৃষ্টির রাত, একটু আগেই একপশলা ধুম বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অতনুর পক্ষে সে কথা বলা জীবনেও সম্ভব হবে না। বললে, মাধবী তাকে রেহাই দেবে না! আজকের এই কল-এ তো ভিজিটের প্রশ্নই নেই!
নিঝুম রাত। বৃষ্টির রাতে জনপদ আরও আগে আগেই নিষুতি হয়ে গেছে। আকাশে মেঘ থই থই করছে। আবারও একপশলা ঢালবে মনে হয়। অন্ধকারের বুক চিরে সনতের বাইক যেন সগর্জনে একচক্ষু বাইসনের মতো দিকবিদিক হারিয়ে ছুটে চলেছে!

সনতের বাইকের পিলিয়নে বসে অতনু ভাবছিল, অজিতের ছেলেটা হয়তো সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু বাকিদের মস্তিস্কের চারপাশের ডিফিকাল্ট জোন-এ যে অমানবিকতা, অসৌজন্য, ঔদ্ধত্যের অন্ধকার জমেছে, তা রিমুভ করবার মতো শল্যচিকিৎসা শেখা হয়নি তার। সে সনৎকে জিজ্ঞাসা করল, “আর কত দূর রে?” সনৎ উত্তর দিল না। আরও কত পথ এমন অন্ধকার চিরে পাড়ি দিতে হবে, সনৎ বোধহয় নিজেও তা জানে না।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “short-story-boro-andhokar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *