short-story-roudra-chayar-dinguli

রৌদ্রছায়ার দিনগুলি
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য


লনে কয়েকটা বেতের চেয়ার ছড়ানো ছেটানো। টানাটানি করে চারটে চেয়ারকে এক জায়গায় জড়ো করল সাম্য। তার একটায় বিবস্বান মৈত্র আরাম করে বসে একটা কিংসাইজ সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘আকাশের গায়ে বিঁধে থাকা পাহাড়, নিশ্চল ঢেউয়ের মতো চা-বাগান আর ধুপিগাছের জঙ্গল আর তার সঙ্গে এমন জ্যোৎস্না … আঃ বিউটিফুল! আমার মতো যে কোনও অ-কবিকেও হাতে কাগজ কলম ধরিয়ে দিলে সে একটা কবিতা লিখে ফেলবে অনায়াসে!’

গোলগাল আদুরে চেহারার অনুভাদি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন আর একটা চেয়ারে। তিনি যে সুখী এবং তৃপ্ত, তা স্নিগ্ধ লাবণ্যর মতো তাঁর চেহারায় বিজ্ঞাপিত। অনুভাদি স্বামীর দিকে ভুরু তুলে বললেন, ‘তুমি আবার সিগারেট ধরালে?’

বিবস্বানদা মুখে একটা কাঁচুমাচু ভাব ফুটিয়ে বললেন, ‘এই একটাই, ব্যস আজকের মতো ইতি।’

‘যা খুশি করো, আই অ্যাম লিস্ট বদার্ড। তবে ভুলে যেও না তুমি একজন ক্যানসার সারভাইভার।’ অনুভাদি খানিক গজগজ করে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে গলার স্বর বদলে হাসিমুখে বললেন, ‘অ্যাই ধূপছায়া, এই জায়গাটা কি এখনও ভার্জিন?’

আমি স্মিতমুখে বললাম, ‘কাইন্ড অফ। রিকিসাম এখনও বেশ ফাঁকা-ফাঁকাই। বাড়িঘরও নেই তেমন। আসার সময় দু-একটা কটেজই শুধু চোখে পড়েছিল। হোটেল লজ বা রিসর্ট তো তেমন নজরে আসেনি।’

বিবস্বানদা তেতো গলায় বললেন, ‘কতদিন আর ফাঁকাফাঁকা থাকবে! তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও এদিকেও মরশুমি পাখির মতো টুরিস্টের ঢল নামবে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে যাবে লজ হোটেল। ওই যে পিরামিডের মতো টিলাটা দেখছ, ওর ওপরও রিসর্ট তৈরি হবে। তখন এই সেরেনিটি আর থাকবে না, পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যাবে।’

বিবস্বানদার পারিবারিক ব্যবসা আছে নানারকম। ধী নামে একটি প্রকাশনা সংস্থাও আছে ওঁদের। বিবস্বানদাই সেটা দেখেন। অনুভাদিও অবশ্য সাহায্য করেন নেপথ্যে থেকে। প্রথিতযশাদের পাশাপাশি নবীনদের বইও ছাপে ধী। সাম্যর মুখে শুনেছি প্রতিভাবান নতুন লেখকদের পান্ডুলিপি বিবস্বানদা নাকি অনুভাদিকেই দেন পড়তে প্রথমে। সাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠক অনুভাদি সেই ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়েন মন দিয়ে। তিনি গ্রিন সিগনাল দিলে বিবস্বানদা আর দ্বিধা করেন না। সেই লেখকের ওপর বাজি ধরেন সাহস করে। আজকের বহু নাম করা কবি সাহিত্যিক উঠে এসেছেন এই প্রতিষ্ঠান থেকে। পেয়েছেন ছোট বড় পুরস্কার। মৈত্র দম্পতির একমাত্র সন্তান ধী লন্ডনে ম্যানেজমেন্ট পড়ে। তার নামে পাবলিশিং হাউজের নাম। আমি আর সাম্য অবশ্য ধী-কে ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামের ছবিতেই শুধু দেখেছি। সাক্ষাৎ হয়নি এখনও।

সাম্য পর্যটন দপ্তরের ছোটখাট অফিসার। জলপাইগুড়িতে পোস্টেড। নেশায় লেখক। লেখালিখির সূত্রেই বিবস্বানদার সঙ্গে তার পরিচয়। সাম্য তার প্রথম উপন্যাস ধী-তে পাঠিয়ে অপেক্ষা করছিল। আশায় ছিল বই হবে ধী থেকে। তখনই ঘটে যায় বিপত্তি। ভদ্রলোকের পিঠের কাছে একটা পুরনো টিউমার বড় হতে শুরু করে। জেনারেল ফিজিশিয়ন প্রমাদ গুনে সঙ্গে সঙ্গে রেফার করেন অংকোলজিস্টকে। প্রথম অবস্থায় ধরা পড়ায় বিবস্বানদা প্রাণে বেঁচে যান। মুম্বইয়ের যশলোক হাসপাতালে চিকিৎসা চলে দীর্ঘদিন। অবশেষে বিপদমুক্ত হয়ে বিবস্বানদা ফের মন দিয়েছেন প্রকাশনায়। কয়েকটা বই বের করেছেন এবার পয়লা বৈশাখে। সাম্যর উপন্যাসটাও এই অনুষ্ঠানে এবার বই হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। বই ছাপার খরচ থেকে বুক-লঞ্চিং – সাম্যর থেকে একটি পয়সাও ভদ্রলোক নেননি।

বিবস্বানদা আর অনুভাদির পায়ের তলায় সর্ষে। ফাঁক পেলেই দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ান আর ছবি পোস্ট করেন ফেসবুক ইনস্টা-তে। ইনফ্লুয়েনশিয়াল মানুষ, ফলে লাইক কমেন্টসের প্লাবন বয়ে যায়। পয়লা বৈশাখ কলকাতার এক অভিজাত ক্লাবে বুক-লঞ্চিং ছিল। অনুষ্ঠান শেষে সাম্যকে বিবস্বানদা বলছিলেন, ‘কলকাতার ক্যাকোফোনি আমার আর সহ্য হচ্ছে না। তুমি তো ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টে আছ। কোনও রিমোট জায়গায় দু’রাত্তির থাকার ব্যবস্থা করতে পারবে?’

সাম্য একটু ভেবে বলেছিল, ‘আমরা হানিমুনে রিকিসাম গিয়েছিলাম। পাহাড়, চা-বাগান, জঙ্গল মিলিয়ে বেশ জায়গাটা। টি এস্টেটের ম্যানেজারের কাঠের বাংলোতে হাত পা ছড়িয়ে থাকার ব্যবস্থা। যাবেন?’ বিবস্বানদা দু-চার সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলেছিলেন, ‘যাওয়াই যায়। তবে একটা শর্ত আছে। তুমি আর ধূপছায়া কিন্তু কোম্পানি দেবে আমাদের।’

সাম্য বাংলো বুক করে ফেলেছিল পরদিনই। আজ বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে ভাড়া গাড়িতে রিকিসাম এসেছেন ওঁরা। আমি আর সাম্য এসে পৌঁছেছি বিকেলের দিকে। দেখলাম লাটাইতে সুতো গোটানোর মতো কেউ দ্রুত গুটিয়ে নিল বিকেলটাকে। নেমে এল সন্ধে। চা খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল কেয়ারি করা লনে বসে উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে। অনুভাদি সামনের টিলাটা দেখতে দেখতে বলছিলেন, ‘এত বছর ধরে সংসারের জোয়াল টানতে টানতে ভেতরের রোমান্স টোমান্স সব মরে গেছে। বয়স যদি আর বছর বিশেক কম হত তাহলে ওই টিলাটার মাথায় হেঁটে উঠতাম, ফর শিওর।’

আমি টিলার ওপর ভেসে থাকা গোল চাঁদটার দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। সাম্য আমাকে বলে চন্দ্রাহত। হবে হয়তো। আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিতে পারি। গোল চাঁদ হলে তো কথাই নেই। সময়ের কথা খেয়ালই থাকে না। আমি অন্যমনস্ক গলায় বলে উঠলাম, ‘হানিমুনে এসে সেবার আমরা কিন্তু পায়ে হেঁটে উঠেছিলাম ওই টিলাটার মাথায়…।’

বিবস্বানদা একবার টিলাটা দেখলেন, তারপর আমাদের। হাসিমুখে প্রণামের ভঙ্গি করে বললেন, ‘বলো কী হে, এ তো রীতিমতো ট্রেকিং! এই হানিমুন কাপলের খুরে খুরে দণ্ডবৎ! তোমরা আমার পেন্নাম নিও।’

অনুভাদির মুখে হাসির আভা মোড়ানো। গলায় বিস্ময় মাখিয়ে বললেন, ‘হানিমুনে এসে ট্রেক করে ফেললে! তাও আবার অতটা পথ! গপ্পোটা ডিটেলে বলো তো ধূপছায়া, শুনি।’

সেদিন আমাদের ডিনার হয়ে গিয়েছিল আটটার মধ্যেই। শুতে শুতে আরও ঘন্টা তিনেক। সেদিনও ছিল পূর্ণিমা। লনে বসে ছিলাম দুজনে। আমি টিলাটার ওপর ভেসে থাকা চাঁদটাকে দেখছিলাম। আমার আঙুল নিয়ে খেলছিল সাম্য। ও তখন জীবনের প্রথম উপন্যাসের বিষয় খুঁজছে। সেই নিয়েই অনর্গল কথা বলছিল। আমি আদুরে গলায় বলেছিলাম, ‘ওই টিলাটা কত উঁচু? চলো না ওটার মাথা অবধি হেঁটে আসি।’

আমার গা থেকে বিয়ের গন্ধ তখনও যায়নি। আমার ইচ্ছের আঠায় আমি তখন আটকে রাখতে পারতাম সাম্যকে। দুজনে বেরিয়ে পড়েছিলাম। জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল কুয়াশা। খাড়া পথ ধরে হাঁটছিলাম দুজন। চড়াই ভাঙতে গিয়ে আমার দম ফুরিয়ে আসছিল। সেই সঙ্গে কেমন গা গোলানো ভাব। শরীরের সবটুকু শক্তি পায়ে জড়ো করে হাঁটছিলাম। বিছুটির ঝোপ পড়ল পথে। বিছুটি লেগে হাত চুলকোতে লাগল। সেসব অগ্রাহ্য করে ধুপির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে টিলাটার মাথায় পৌঁছলাম। পৌঁছেই হড়হড় করে বমি করে ফেললাম আমি। সাম্য ঘাবড়ে গেল। গলায় উৎকণ্ঠা মিশিয়ে বলল, ‘কী হল সোনা?’ আমি তখন ধুঁকছি। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সাম্য বলল, ‘কষ্ট একটু কমল?’

আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। জিভের ডগা থেকে আলটাগরা অবধি কর্কশ বালির মতো খরখরে। খাবি খাওয়া মাছের মতো অক্সিজেন নিতে নিতে বললাম, ‘ক’দিন হল একটুতেই টায়ার্ড ফিল করছি। পিরিয়ড নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। বুকে একটা লাম্প মতো হয়েছে। সেটার জন্যই এমন হচ্ছে কিনা জানি না।’ সাম্য উদ্বিগ্ন মুখে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কী বাধালে কে জানে, দেরি করা যাবে না, জলপাইগুড়ি ফিরেই ডাক্তার দেখাতে হবে।’

গা ম্যাজম্যাজানি ছিল, হালকা জ্বর এল ভোরের দিক। ঘুম হল না তেমন, রাতটা মোটামুটি এপাশ ওপাশ করে কাটল। জলপাইগুড়ি ফিরেই যাওয়া হল ডাক্তারের কাছে। তিনি আমাকে আগাপাশতলা জরিপ করলেন। তার পর পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দিলেন কয়েকরকম। পরদিন রিপোর্টস দেখেশুনে বললেন, ‘অংকোলজিস্ট কনসাল্ট করুন, ইমিডিয়েটলি।’
পরদিন রাতের ট্রেন ধরে চলে এলাম কলকাতা। হাসপাতালে করিডোরে দেখি এক বৃদ্ধকে মাঝখানে রেখে এক যুবক আর এক তরুণী ধীর পায়ে হাঁটছে। এরা স্বামী স্ত্রী না কি ভাই বোন বলতে পারব না, হঠাৎ ঘাড়ভাঙা পাখির মতো বৃদ্ধের মাথাটা নুয়ে পড়ল নিচে। যুবকটি ডুকরে উঠল ‘বাবা … বাবা’ বলে। তরুণীটিও ভেঙে পড়ল কান্নায়। আমার গলার কাছে উঠে এল হৃদপিণ্ড। হে ঈশ্বর আমার জন্যও কি তবে অপেক্ষা করে আছে এমনই ভবিতব্য ? এখানেও নতুন করে টেস্ট করানো হল নানারকম। পরদিন রিপোর্টস খুঁটিয়ে দেখে ডাক্তার গম্ভীর গলায় বললেন, ব্রেস্ট ক্যানসারের ফার্স্ট স্টেজ। কাল থেকেই কেমো শুরু করতে হবে।

সে এক কালান্তক সময়। বাবা-মা চলে এল কলকাতায়। ওরা আর সাম্য বোঝাত বারবার, আমি যেন ভয় না পাই। আমি বীরত্ব দেখিয়ে বলতাম, ‘আমি কি অতই ভিতু নাকি!’ কিন্তু মনের ভেতর আর একটা মন কুঁকড়ে যেত। শিরশিরে ভয়ের অবশ অনুভূতি ছড়িয়ে যেত শরীরে। পরদিন শুরু হল কেমো। সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পর শরীরে শুরু হল প্রলয় নাচন। একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়ি। ভাত চিবোবার ক্ষমতা থাকে না। সাম্য বলে, ‘এটুকু খেতেই হবে সোনা।’ এক চামচ ভাত মুখে দিয়ে আমি বিছানায় ফের লুটিয়ে পড়ি। সাম্য বলে, ‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’ আমি শ্বাস ফেলে বলি, ‘জানি না।’

একুশ দিন বাদে বাদে কেমো চলে। হার্টের পাশে বসানো কেমোর পোর্ট। প্রথম কেমোর দু’সপ্তাহ পর চুল ঝরে পড়তে শুরু করে। সাম্য অনলাইনে উইগ কিনে আনে। মজা করে বলে, ‘বেশি দামের কিনলাম না। ক’দিনই বা ব্যবহার করবে, সেরে গেলেই তো নতুন চুল গজাবে।’
সাম্যকে দেখে আমার বুক মুচড়ে ওঠে। কেউ যেন বেচারির বেঁচে থাকার সমস্ত আনন্দ আর ইচ্ছে শুষে নিয়ে একটা খোলস ফেলে রেখে গেছে।
আমি কথা ঘোরাবার জন্য বলি, ‘তোমার উপন্যাসটা কতদূর?’ সাম্য নিস্প্রভ মুখে হাসে।
বলে, ‘লিখছি তো। মনগড়া নয়, সত্যি কাহিনি।’
আমার চোয়ালে অসহ্য ব্যথা। কথা বলতেও কষ্ট। তবুও বলি, ‘কী নিয়ে গল্প?’

সাম্য বলে, ‘একটা সুস্থসবল মিষ্টি মেয়ের ওপর ছায়া পড়েছিল কর্কটক্রান্তির। সেই মেয়েটি ভিতু নয়, ভীষণ সাহসী মেয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে সে লড়ে গিয়েছিল অসুখের সঙ্গে। সেই নিয়েই গল্প।’
আমি আকুল গলায় বলি, ‘মেয়েটা কি হেরে গেল?’
সাম্য চোয়াল শক্ত করে বলে, ‘হারবে কেন? জিততেই হবে তাকে। আমি তো লেখক, আমিই জিতিয়ে দেব মেয়েটাকে।’
আমি বলি, ‘কী নাম দিলে উপন্যাসটার?’
চোখের তলায় পুরু কালি, সাম্য হাসার চেষ্টা করে বলে, ‘ধূপছায়ার দিনগুলি।’
লজ্জা পেয়ে বলি, ‘যাহ্‌ আমার নামে নাম দিও না, অন্য কোনও নাম ভাবো।’
সাম্য হাসে, ‘সরি ম্যাম আমি এক কথার মানুষ। যা বলেছি তা বলেছি। ওই নাম আর নড়চড় হবে না। শুধু তাই নয়, বইটা আমি উৎসর্গ করব সেই লড়াকু মেয়েটিকেই।’
আমি অবিশ্বাসী চোখে সাম্যকে দেখি। এত সুখ কি আমার সইবে! আমার চোখ জ্বালা করে। মনে মনে ভয় হয়, বই বেরোনো পর্যন্ত বেঁচে থাকব তো আমি?

দিনের পিঠে চেপে বসে অনেকগুলো দিন। হারক্লোন নামে কুড়িটা দামি দামি ইঞ্জেকশন নিতে হয় আমাকে। হেলথ ইনসুরেন্স করা ছিল। তার বাইরেও খরচ হয় কিছু। কিন্তু খাদের ধার থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে আসি আমি। ভাল হয়ে যাই পুরোপুরি। এখন আর তেমন কোনও বিধিনিষেধ নেই। এমনকী, ইচ্ছে করলে আমি সন্তানধারণও করতে পারি। কিন্তু সাম্য অনেক বেশি বিচক্ষণ। কনসিডারেট। ও বলছে অত বড় ধকল নেবার আগে আর একটু অপেক্ষা করা ভাল। বুঝতে পারি, সাম্য আমার নাম-কা-ওয়াস্তে স্বামী নয়, দোসর। আদর্শ জীবনসঙ্গী।

বুক-লঞ্চের দিন সেলিব্রিটির ছড়াছড়ি। ধূপছায়ার দিনগুলি নামটার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আসাম সিল্ক পরেছিলাম। সোনালি-ধূসর ব্লক প্রিন্ট। গলায় ডোকরার গয়না। চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে সময়ের আগেই। তাই অনুষ্ঠানের আগের দিন পার্লার থেকে চুল ডাই করিয়ে এসেছিলাম। সাম্যর বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন টালিগঞ্জের এক অভিনেত্রী। ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলসানির মধ্যে সাম্য হাসিমুখে বই হাতে দাঁড়াল। সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বাইট দিল। এক ফাঁকে দর্শকাসনে বসে থাকা আমাকে দিয়ে গেল একটা কপি।

হাতে নিয়ে দেখি ধূপছায়ার দিনগুলি নয়, বইটার নাম রৌদ্রছায়ার দিনগুলি। আমার চারদিক ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বুকের খাঁচার মধ্যে শাবল চালাতে থাকে কেউ। বইটার নাম বদলে দিল, অথচ সাম্য সেটা আমাকে বলেনি ঘুণাক্ষরেও। প্রবল এক বঞ্চনার বোধ আমাকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিতে থাকে। বঞ্চনা, নাকি প্রবঞ্চনা? বুকের ভেতরটা গুঁড়িয়ে দিয়ে হু হু কান্না উঠে আসতে চায়। আমি ভাবলেশহীন ভাব ফোটাই মুখে। নিষ্কম্প থাকার চেষ্টা করি।

পাতা উল্টোই। উৎসর্গপত্রে দেখি সাম্য লিখেছে – ‘বিবস্বান মৈত্রকে, মারণরোগ জয় করে জীবনের রৌদ্রভরা রাজপথে ফিরে এসেছেন যিনি’। আমি বইটা বন্ধ করে ফেলি। আমার শিরা-ধমনীর মধ্যে তাণ্ডব নাচে অগণন ভূতপ্রেতের দল। বাড়ি ফিরে আসি চুপচাপ। সাম্য সারা রাস্তা বকবক করতে করতে আসে। আমি হাঁ হু করে উত্তর দিই।

রাতের শয্যায় সাম্য আমাকে ঘাঁটে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকি। বিবস্বান যে সূর্যের আর এক নাম তা আচমকা মনে পড়ে যায়। সূর্যের অনুষঙ্গ থেকেই কি রৌদ্র? জানি না। কিন্তু এই যোগসূত্রগুলো পোকার মতো কিলবিল করে বেড়ায় আমার চিন্তার দেওয়াল বেয়ে। নামী দোকান থেকে চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ান প্যাক করে নিয়ে এসেছিল সাম্য। সেই খাবার ডিনার টেবিলে সাম্যর সঙ্গে খুঁটে খুঁটে খাই। বমি করে উগরে দিই মাঝরাতে। সাম্য জানতে পারে না।

চারদিকে পাহাড়ের ছড়াছড়ি। চা-বাগান। ধুপির জঙ্গল। রুপোর থালার মতো চাঁদ ঝুলে আছে টিলাটার ওপর। রুপোর গুঁড়োর মতো জ্যোৎস্নার সঙ্গে কুয়াশা মিশে চারদিক রহস্যময় করে রেখেছে। আমার দিকে তাকানো ওরা তিনজন। আমি ঘোরের মধ্যে বলে চলি আমার অসুখের দিনগুলোর কথা। সেই কালান্তক সময়টায় সাম্যর সাহচর্যের কথা আর সেবা-শুশ্রূষার কথা বলতে ভুলি না। অনুভাদি বিস্মিত হয়ে আমাকে দেখেন। বিবস্বানদা অবাক গলায় বলেন, ‘সে কী ধূপছায়া, তোমারও কার্সিনোমা হয়েছিল? সাম্য কখনও বলেনি তো!’

আমি নাগাড়ে কথা বলে যেতে যেতে থামি একসময়। আমার চটকা ভাঙে। আমি আড়চোখে সাম্যকে দেখি। পাহাড়তলি এলাকায় বিকেলের রং যেমন খুব তাড়াতাড়ি বাসি হলুদের মতো হয়ে যায় সাম্যর মু্খের রংও তেমন করে পাণ্ডুর হতে থাকে। পাহাড়ি বিকেল যেভাবে চট করে ফুরিয়ে যায় তেমন করে উবে যেতে থাকে সাম্যর স্মার্টনেসটুকু। তার সপ্রতিভ উষ্ণতা শেষবেলার রোদের তাপের মতো জুড়িয়ে যেতে থাকে। আমি অপ্রস্তুত গলায় বলি, ‘না না, ওর দোষ নেই কোনও। আমিই কাউকে বলতে চাই না আমার অসুখের কথা। শুধুমুধু কী হবে বলে…।’

সাম্যর চোখে দৃষ্টিহীন ঘোলাটে দৃষ্টি। রুপো নয়, সিসের গুঁড়োর মতো জ্যোৎস্না ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর মুখে। বাজে-পোড়া গাছের মতো লাগে দেখতে সাম্যকে। বিবস্বানদা আর অনুভাদি একবার আমাকে দেখেন, একবার সাম্যকে। আমি চোখ সরাই। পিরামিডের মতো টিলাটার মাথায় ভেসে থাকা অস্পষ্ট গোল চাঁদটাকে দেখি। দেখতেই থাকি। সেই সঙ্গে আমার দুই ঠোঁটের ফাঁকে ফুটে থাকা দুর্বোধ্য হাসিটাকে খুন করি টিপে টিপে। নিস্পৃহ মুখ ফেরাই ওদের দিকে। আলগা গলায় বলি, ‘ক্যানসার সারভাইভার শুনলে সকলেই বাড়তি অ্যাটেনশন দেয়, ধুস আমার ওসব একদম ভাল লাগে না!’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

11 thoughts on “short-story-roudra-chayar-dinguli

  1. গল্পটি ভীষণ সুন্দর। ধুপছায়ার জীবনের মধ্যে সব পাওয়ার পরও না পাওয়ার বেদনা বড় বেশি করে বেজে ওঠে যেন। বড্ড মরমী লেখা। এমন একটি গল্প আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য লেখককে অভিনন্দন।

    1. অজস্র ধন্যবাদ অনুভা।

  2. একটা অসাধারণ গল্প । শেষটা পড়তে পড়তে মনখারাপ, শূন্যতা বোধ কত কি যে গ্রাস করল ।

    1. এই গল্পে মানুষের জটিল মনস্তত্ত্বের কথা বলতে চেয়েছি। সাম্য আর ধূপছায়ার মনোজগতে চেয়েছি আলো ফেলতে। কতটা কী হয়েছে জানি না।

      ভালবাসা নিও সাথীদি।

  3. খুব সুন্দর গল্প।মানুষের রহস্য ভরা মনোজগতের গল্প আপনার লেখায় বারবার ফুটে ওঠে।ভালো লাগে পড়তে।গল্পের শেষে মনটা মুচড়ে উঠল।ধূপছায়ার জন্য তো কষ্ট হচ্ছে।সে বঞ্চিত হয়েছে।ভালোবাসার উপর সে আর বিশ্বাস করতে পারবে কী?আর সাম‍্য,সে প্রবঞ্চনা করেছে তাঁর ভালোবাসার সাথে।সারাজীবন তাঁকে এই দায়ভার বয়ে যেতে হবে।এমন কত কষ্ট থাকে আমাদের জীবনে,যা কাউকে বলা যায় না।

    1. সাম্য তার স্ত্রীর চরম দুঃসময়ের দিনগুলিতে পাশে থেকেছিল প্রকৃত জীবনসঙ্গীর মতো। ধূপছায়াকে যে সে ভালবাসে না তা নয়। কিন্তু লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া তার কাছে আরও বড় প্রায়োরিটি। সে কারণে স্ত্রীর সঙ্গে এই ‘তুচ্ছ’ প্রবঞ্চনা করতেও তার বাধে না। সাম্য কিন্তু কোনও বিচ্ছিন্ন চরিত্র নয় এমন যশোলোভী লেখক আমাদের আশেপাশেই আছে।

      ধূপছায়া চরিত্রটিও পড়ে পড়ে মার খাওয়ার নয়। তার মধ্যেও জটিলতা আছে। ঔদাসীন্যের আড়ালে সে-ও লুকিয়ে রেখেছে তার বাঘনখ।

      গল্পটি আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম খুব। অজস্র ধন্যবাদ।

  4. খুব ভালো লাগলো দাদা গল্পটি। শুভকামনা💐

  5. চমত্কার । তোমার লেখা আমাকে সবসময়ই আকৃষ্ট করে । মোহিত হই। এবারও মোহিত হয়ে ভাবতে বসলাম। তোমার এ গল্পেও চমতকার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লষণ । আরও লেখো। অফুরান শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *