আশান উজ জামান
“সেই যে সকালে মানুষ বানাতে বসেছে অনু, ধুকে ধুকে তারপর সূর্য গেল ডুবে, চাঁদ উঠে মিলিয়ে গেল মেঘে, তবু তার না আছে উঠবার নাম, না আছে খাওয়া-ঘুমের।
এই এক রোগ ছেলেটার- যা একবার পেয়ে বসে ওকে, তা থেকে উঠতে পারে না ও আর। নইলে অকারণ এমন মানুষ বানিয়ে কী লাভ, যা প্রাণ পায় না! তার চেয়ে বরং এটা ওটা পশু পাখি বানিয়ে রাখুক না, প্রতিদিনের কাজের চাপ কিছুটা এগিয়ে থাকবে। ভাবেন মা, তবে মুখ খুললেই অন্য আওয়াজ আসে।
‘অনেক হলো বাপ। এবার রাখ।’
‘বাবা রে, সারাজীবনের কাজ কি একদিনেই করবি?’
‘ওঠ বাবা, খেয়ে নে।’
রাতের পোকারাও ডেকে ডেকে হয়রান।
শুনছে অনু আর কাজ থেকে মুখ না তুলেই ‘আসছি, মা’ ‘এই তো, আর একটু।’ ‘হয়ে গেছে, মা।’ বলছে। কিন্তু হয়ে আর উঠছে না।
তারপর এই যে কিছুক্ষণ আগে, জোড়া প্যাঁচা ডেকে উঠল যখন, বানাতে থাকা মানুষটার মুখ এত সুন্দর হয়েছে যে, একবার তাকে নারী বানাচ্ছে তো পরক্ষণেই যোগ বিয়োগ করে গড়ে নিচ্ছে পুরুষ, এর মধ্যে ছুটে এলো মীরামাসি।
‘বাছাটার খুব অসুখ। কিছুই মুখে তুলছে না। মাছ পছন্দ করে। একটু যে ঝোল করে দেবো, তা…’
তড়িঘড়ি অনু বানিয়ে দিলো ছোট একটা মাছ। দিয়েই আবার ডুবে গেল কাজে। পুতুলের হাত পায়ের আঙুল আরো কানিকটা কার্যকর করা যায় ভাবতে ভাবতে খেয়াল করল, মাছটা হাতে নিয়েছে ঠিক, কিন্তু যায়নি মীরামাসি। চোখভরা প্রশ্ন নিয়ে তাকালো সে মাসির দিকে। মাসির মুখে খানিক অপ্রস্তুত ভাব, খানিকটা সংশয়। তবু, অনুর প্রশ্নের সামনে তা এড়াতে হলো।
‘আসলে হইছে কি… রুই মাছ তো খায় না…’
‘ওহ, আচ্ছা, আচ্ছা, আমি তো… ও হ্যাঁ…’ বলতে বলতে মাছটা হাতে নিলো সে আবার। তারপর আরো খানিকটা কাদা যোগ করে দিলো। মাছটার গায়ে এখন আগের চেয়ে বেশি মাংস, মাথাটা খানিক মোটা। দেখেই খুশিজ্বলা চোখে সেটা নিয়ে বেরিয়ে গেল মীরামাসি।
আকাশে চাঁদ। জোছনায় ঢেউ তুলে ভেসে যাচ্ছে হাওয়া। তাতে চিকন চিকন ঢেউ উঠছে নদীতে। পায়ে পায়ে পানিতে নামবে মীরামাসি এখন। হাঁটু পর্যন্ত নেমে চাঁদের দিকে মুখ করে দাঁড়াবে। তারপর দু’হাতের তালুতে নিয়ে ইলিশটাকে ধরবে ডুবিয়ে। চাঁদের আলোমেশা ঢেউয়ের তোড়ে আস্তে আস্তে ধুয়ে যেতে থাকবে মাছটার গা। তারপর এই তো, কিছুক্ষণ পর, মীরামাসির ধড়ফড় করতে থাকবে বুক। মনে হতে থাকবে হাতের ওপর কাদামাটির পুতুলটা আর নেই। আঁজলাভরা শুধুই ওই কাদাধোয়া পানি, আর তার সঙ্গে মিলমিশ জোছনা। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মীরামাসির ঘুমঘুম পাবে হয়তো, হয়তো তার ধরে আসবে কোমর। কতক্ষণ আর এমন নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায়! কিন্তু মাসি নড়বে না, কারণ সে জানে যে কোনও সময় ঘটে যাবে চমৎকারি। তার ধৈর্য্য দেখেই একসময় নড়ে উঠবে পানি, আর খলবল আওয়াজ করে লাফিয়ে উঠবে হাতখানেক লম্বা এক সত্যিকারের কাতল।”
এটুকু শুনেই “নাহ, এ হতে পারে না!” বলে উঠলাম।
“কী হতে পারে না?” পাল্টা প্রশ্ন করলেন শরনভাই, “নদীতে মাছ, নাকি আকাশে চাঁদ?”
“উঁহু, কাদামাটির পুতুল, যা ধুয়ে গেল পানিতে, তা থেকে জ্যান্ত একটা আস্ত মাছ হতে পারে না।”
“আচ্ছা!” খুব মজা পাচ্ছেন, এমনভাবে বললেন, “তাহলে মরা একটা টুকরো মাছ হতে পারে নিশ্চয়ই!” বলেই উঠলেন হো হো করে।
যত বিরক্তই হই, এই হাসির তোড়ে ভেসে না গিয়ে পারি না, পারি না তার কথা প্যাঁচানোর ক্ষমতায় মুগ্ধ না হয়েও। সহসা তাই বললাম না কিছু।
কাপের গলা পর্যন্ত ঠান্ডা চা। না, উনি গরমই দিয়েছিলেন; আমি তারিয়ে তারিয়ে ঠান্ডা করে নিলাম। গরম চা খাবে ঠান্ডার দেশের লোক, যেখানে বাতাস জমে হিম রক্ত জমে বরফ। আমাদের দেশে তো অমন শীত পড়ে না। তাও না হয় শীতকালে গরম চায়ের কাপ আরাম দেবে, কিন্তু এই হাড় গলানো গরমেও মানুষ গরম চা খায় কেন!
ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবছি কী বলব, এমন সময় শরনভাই বললেন, “বানানো গল্প না। অনুর ওই মীরামাসি যে বাছাটার জন্য মাছ নিতে এলো…”
“প্লিজ, আবার বলবেন না ওই বাছাটাই আপনি আর সেই মাছ খেয়েই আপনি এত বড় লেখক!”
“নাহ, কী যে বলো না, কই আর বড় লেখক!” বাদামি মুখ শরনভাইয়ের, লজ্জার খানিকটা লাল আর প্রশ্রয়ের রুপোলি মিলে চকচক করে উঠল। অপ্রস্তুত ভাবটুকুর সামনে ‘আর বড় লেখক…’ ভাবের আড়াল তুললেন। মুখের ওপর লেগে থাকা আবছা আঁধারটা সরে যেতে সময় দিলেন। তারপর ফিরে গেলেন গল্পে আবার।
“মীরামাসির ওই বাছার কাছেই শুনেছি ঘটনাটা। ওই মাছ খেয়ে সে লেখক হয়নি বড়, তবে আমাকে সেটা বলে যাবার জন্য অন্তত শ খানেক বছর বেঁচে ছিল।”
মাথার ওপর ফ্যান। বাতাসে তার টাকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কাঁচা পাকা চুল ক’টা দুলছে। হাত দিয়ে সেগুলো ডান থেকে বাঁয়ে নিয়ে এলেন, বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর মতো করে বুলিয়ে দিলেন হাত। তারপর বললেন, “এখন কি বিনা প্রশ্নে শুনবে, নাকি গল্প বাদ দিয়ে হাঁটতে বেরোব?”
“না, হাঁটতে বেরোব না। তবে বিনা প্রশ্নে শুনে যাব এমনও মনে হচ্ছে না।” ভেবে বললাম, “আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, ওই পুতুলের কাদায় এমনকিছু মেশানো ছিল যার টানে চলে এসেছে মাছটা। মানুষ তো যা দেখে তার কার্যকরণ না বুঝলে নিজের মতোই বানিয়ে নেয় কথা।”
“ভালো চিন্তা। কিন্তু স্যরি, তোমাকে হতাশ করতে হচ্ছে। শুধু মাছ না, কাদা ছেনে অনু যাই বানাত তাই পেয়ে যেত প্রাণ।”
“মীরামাসিকে যেদিন মাছ বানিয়ে দিলো, তার আগের দিনই তার কাছে এসেছিল কাদেরচাচা। ‘হালের গরুডা মারা যাওয়ার পর এঁড়ে বাছুর দিয়ে জমি চষাচ্ছিলাম। তা সেইটেও গেল বন্যেয় ভেসে। এ্যাকন কী যে করি… এ্যাটটা দামড়া গরু যদি পাতাম…’
তারপর এসেছিল নরেনকাকা। ‘বাপটা ওরম অপঘাতে মরল… শ্রাদ্ধও কি ভালোভাবে করতে পারব না… একটা পাঁঠা বানাতি পারো যদি…’
গ্রামময় খেটে খাওয়া মানুষ। হুটহাট প্রয়োজনে ছুটে আসে অনুর কাছে। শুনতে শুনতে অনু হাত লাগায় এঁটেল মাটির কাদায়। আর ছেনে-ছুনে বানিয়ে দেয় খাসি কিংবা পাঁঠা বা যার যা দরকার। খুশি মনে সেই পুতুল নিয়ে বাড়ি ফেরে সবাই। তারপর চাঁদ ওঠে যখন, আলোয় ভিজে নরম হয়ে ওঠে সোনাদিয়ার পানি, তাতে ডুবিয়ে ধরলেই একসময় নড়ে ওঠে পুতুলগুলো। তারপর উঠে আসে সত্যিকারের ছাগল পাঁঠা গরু ভেড়া।”
জানলা খোলা, রোদ এসে পড়ছে মুখে। উঠে গিয়ে পর্দা টেনে দিয়ে এলেন শরনভাই। তারপর বললেন, “তো কী মনে হচ্ছে? মাছ না হয় পানিতে থাকে, অনুর বানানো পুতুলের ঘ্রাণে ছুটে আসতে পারে, কিন্তু ছাগল ভেড়া?”
সত্যিই তো, এমন তো হবে না। ভেবেচিন্তে তাই ভাবার চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম। যা হয় হোক, গল্পটা আগে শুনি।
“দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে। তাদের কাছে অনু এক জাদুকর। বাচ্চাদের পাঠিয়ে দেয় তার কাছে, যেন তারাও শিখে নিতে পারে করনকৌশল। চোখ বড় বড় করে সবাই তাকিয়ে থাকে অনুর হাতের দিকে। সাধারণ মামুলি হাতের মতোই হাত তার। পাঁচটা আঙুল, আঙুলের বুকে একটা জোড়া আর একটা একা-পড়ে-থাকা দাগ। মুঠি করলে ওই দাগ বরাবরই গুঁটিয়ে যায় আঙুলগুলো। চেহারাও বিশেষ আলাদা কিছু না, গ্রামজুড়ে কাছাকাছি চেহারার মানুষ চাইলেই পাওয়া যাবে। পার্থক্য বলতে একটাই, পরোপকারের ঝোঁক। ঘরের চাল ডাল নিজের গাছের ফলমূল পুকুরের মাছ দিয়ে অন্যদের প্রয়োজন মেটাত সে।”
“এ কেমন কথা, ঘরেরটা নেওয়া লাগবে কেন, বলছেন তো সে চাইলেই বানাতে পারত।”
“এই দেখো, তুমি না বললে আর প্রশ্ন করবে না?”
“করব না, কিন্তু বানোয়াট মনে হলে তো…”
“বানোয়াট না। এটা তার ছোটবেলার কথা, যখন সে এই ক্ষমতা পায়নি।”
“শুরুতে এমন ছিল না অনু। ছিল আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই। পড়া ফাঁকি দিয়ে খেলত। খেলে খেলে ক্লান্ত, সন্ধ্যা জমতে না জমতেই ঢুলে পড়ত ঘুমে। আর পাঠশালায় খেত কানমলা কি এক-পা তুলে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি। দেখে হাসত সহপাঠীরা, টিটকিরি কাটত। অন্যরা পড়া না পারলে কিংবা পিছলপথে পড়ে গেলে হাসত অনুও।
তারপর হঠাৎ একদিন বদলে গেল সব। রাতটা সেদিন একটু বেশিই গাঢ়।
বন্ধু মতির দুঃখের কথা শুনেছে সকালে, ঘরে চাল নেই, খেতে পারছে না। মাকে বলেছে এই কথা। এক খুচি চাল দিয়েছে মা, কিন্তু তা দিয়ে বড়জোর এক সাঝ খাওয়া হবে। এরপর? এরপর কী হবে মা জানে না। ঘরে যে খুব চাল আছে তাও তো না, কোনোমতে চলে যাবে মৌসুমটা। তাহলে ধান দিক, ধান তো আছে। হ্যাঁ, বস্তাখানেক, কিন্তু খাওয়ার না, ওগুলো সব বীজ। ওগুলোও খেলে আগামী চাষের আর খবর থাকবে না।
হাহ! কী করবে অনু তাহলে? চুপসানো মন নিয়ে পড়তে গেছে। পড়া পারেনি বলে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন পণ্ডিতমশাই। অন্যরা চলে গেছে আগে, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনু দেখেছে পড়ে আসছে বেলা। তারপর যখন ছাড়া পেয়েছে, বৃষ্টি আর সন্ধ্যা মিলে তখন গভীর রাত। মেঘ ডাকে বৃষ্টি বাড়ে শন শন ঠান্ডা হাওয়া। কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরল অনু। এসে দেখে মা বাড়ি নেই, ঘর অন্ধকার; অমনি তার খুলে গেল চোখ!
ধানের বস্তাটা উঁচু করতে গিয়ে দেখে পারবে না। তড়িঘড়ি তাই আরেকটা বস্তায় অর্ধেক মতো ধান নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল পথে। বৃষ্টিভেজা পথ, যেখানে কাদা সেখানে হাঁটু পর্যন্ত ডোবে, যেখানে একটু শক্ত সেখানে পিছলে যায় পা। সঙ্গে আছে ভূতপ্রেতের ভয়। তারচেয়েও ভয়, সামনে দিয়েই যদি আসতে থাকে মা, ধরা পড়ে গেলে তো, ধরা না পড়লেও পড়ল অনু ঠিকই। দ্রুত পা ফেলছিল, পিছল পথে পা রাখা দায়, তার ওপর নড়বড় মাথায় বড়সড় বোঝা। পড়েছে মুখ থুবড়ে, কাদার ভেতর পুরো মুখ, গেঁথে গেছে শরীরেরও অর্ধেক।
পড়তেই ‘উঠতে হবে, ছুটতে হবে’ ভাবতে ভাবতে হাত পা ছুঁড়তে লাগল সে। কিন্তু উঠবে কী করে, ধানের বস্তাটা যে চেপে বসেছে তার ওপর! যত সে নিচের দিকে চাপ দিচ্ছে উপরে উঠবে বলে, তত যেন তলিয়ে যাচ্ছে। দম আটকে আসছে, চোখে কাদাপানি, জ্বলছে। মা মা করে ডাকতে গেছে ক’বার, শব্দ বেরোয়নি, উল্টো খানিক ঢুকে গেছে কাদা। হাত-পা অসার; বল নেই একটুও, মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়বে।
তারপর যখন হুঁশ নেই আর, মনে হচ্ছে মরেই গেছে ও, হঠাৎ মনে হলো বস্তাটা সরে গেল নিজে নিজে। না, নিজে নিজে না, কেউ একজন এসেছে। সে ওকে তুলেও নিল কাদা থেকে। কাদাভরা চোখে অনু দেখার চেষ্টা করল লোকটাকে কিন্তু পারল না ঠিকমতো। শুধু এটুকু বুঝল, গা দিয়ে চোখ দিয়ে তার ঠিকরে পড়ছে আলো। আলো আলো হাতে লোকটা তাকে জড়িয়ে রেখেছে বুকের ভেতর। আর লোকটা তাকে নিয়ে যাচ্ছে সোনাদিয়ার দিকে।
এখনও যেন তার উষ্ণতা অনুভব করতে পারে অনু। মনে হয় মানুষটা তার সঙ্গেই আছে। বিপদে পড়লে মনে হয় সে কথাও বলছে মাথার ভেতর।
সেই ঘটনার পরেই মূলত এই ক্ষমতা প্রকাশ পায় অনুর।
প্রথম দিনটা ছিল একটা টিয়েপাখির।
টিয়ে পোষার খুব শখ ওর। কিন্তু পায় না তেমন। অথচ মতির ঘরে কত পাখি! তক্কে তক্কে ছিল, ফাঁক পেয়ে তার টিয়েটাই নিয়ে আসছিল, কেউ যেন না দেখে, রেখেছিল পকেটে। তা ঘরে ফিরে দেখে পাখিটা নিজেই আর দেখবে না তাকে। তারপর থেকে পাগলা হয়ে গেছে মতি। নাওয়া নেই খাওয়া নেই, ওই টিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সবচেয়ে প্রিয় পাখিটা মেরে ফেলল, আবার সে কারণে সেই বন্ধুই যদি মরে! কী করবে বুঝতে পারছে না। অপরাধবোধ আর ক্ষোভে অনু কাঁদছে, এমন সময় হঠাৎ আওয়াজ উঠল মাথায়: ‘কাদা দলে নাও। পুতুল বানাও। চোখ ফোটাও।’ গমগমে আওয়াজ তার, আন্তরিক স্বর। যা বলে, ঠিকঠাক তা করলেই হলো সমাধান। কাউকে বলেনি কখনো, তবু, অনু জানে তার সকল শক্তির উৎস ওই সূর্যমুখীই।
আর চলে মানুষের প্রয়োজন মেটানো; ফুল পাখি পশু প্রাণী বানিয়ে চলা। কিছুদিনের মধ্যেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সোনাদিয়া নদীর স্রোতে ভেসে। গ্রামগুলো তো সব একই রকম, মানুষের প্রয়োজনও তো এ-গাঁ ও-গাঁয়ের সীমা মানে না। ফলে চিনগাঁ ভিনগাঁ মিলে অনুর বেড়ে গেল ব্যস্ততা।
এর মধ্যেই একদিন ছুটে এলো দু’জন সাজগোজ করা লোক, গায়ে-পায়ে একরকম জামা-জুতো, হাতে একই বল্লম। অনুর ক্ষমতার খবর জমিদার মশাইও পেয়েছেন। তাঁর জন্য একটা ঘোড়া বানাতে হবে, আর হাতি একটা মস্ত। জমিদারবাবু সাহায্য চেয়েছেন অনুর কাছে! আনন্দে অনু কেঁদেই ফেলে প্রায়। কিন্তু সেই কান্না যে আরও বড় কান্নার কারণ হবে, তা কি আর জানত সে তখন?
সেদিন সেই ঘোড়া আর হাতি নিয়ে চলে গেল জমিদারের পেয়াদা দু’জন। কিন্তু পরেরদিনই ফিরল আবার। জমিদার আগে বিশ্বাস করেনি অনুর ক্ষমতা। কিন্তু হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছেন; এখন তার সৈন্য লাগবে, হাতি ঘোড়া তো লাগবেই। না, ভয় পাওয়ার কারণ নেই, একদিনেই সব করতে হবে না। সময় নিক অনু, মাসখানেকের মধ্যে দিলেই হবে। ততদিনে শুকো মওসুম, জমিদারির বহর বাড়াবেন জমিদার, তার জন্য যুদ্ধ করতে হলে অনুর হাতের কাদার দলার দরকার হবে তার।
গোলটা বাধল সেখানেই। মানুষকে বাঁচানো যার কাজ, সে কেন মারার ব্যবস্থা করবে? অনু বলে দিলো যুদ্ধের ঘোড়া সে বানাবে না। আর সৈন্য বানানোর সাধ্য তো নেইই।
বুঝিয়ে, ভয় দেখিয়ে, শাসন করে- কোনো চেষ্টাতেই কাজটা করিয়ে নিতে পারল না পেয়াদারা। এমনকি পরে যে মন বদলাবে, তারও কোনো উপায় না দেখে চলে গেল শেষে। এদিকে গ্রামময় তটস্থ সবাই। জমিদারের কথা না-শোনার ফল ভালো হওয়ার কথা না।
পরের কদিন টানা বৃষ্টি। সঙ্গে সোনাদিয়ার ঢল, ভেসে গেল জিনিসপত্র। ভেসে গেল গরু ছাগল হাঁসমুরগি বাড়িঘর। ওপাড়ার ময়জদ্দির নাতনি পর্যন্ত রেহাই পেল না, ডুবে ডুবে ভেসে গেল টুকরো কাঠের মতো। উঠোনে-জঙ্গলে বানানো টঙের ওপর কোনোমতে টিকে থাকল অনুরা। আর টিকে থাকল আহাজারি তাদের। কদিন পর পানি শুকিয়ে এলেও শুকালো না চোখ। কী খাবে মানুষ, কী মাখবে, বাঁচবে কী করে! অনুর ব্যস্ততার শেষ নেই। এমন কোনও বেলা নেই, চারপাশের দু’দশ গ্রামের মানুষ এসে পড়ে থাকে না উঠোনে তার। বন্যার জলে পানসি বেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল জমিদার। এখন আবার ফিরে এসে অত্যাচার শুরু করেছে। খেয়ে পরে বাঁচার উপায় নেই, জমিদার চায় কর। না দিতে পারলে মরণ। বলতে গেলে প্রতিদিনই কেউ না কেউ মরছে। শোনে আর রাগে ফোঁসে অনু, ব্যাটাকে যদি শায়েস্তা করতে পারত একবার!
অবশ্য ভেবেই বা আর কী করবে সে? নাওয়াখাওয়া ভুলে তাই কাজই করছে। কিন্তু অন্য সবকিছুর সঙ্গে মানুষের ধৈর্য্যও যেন বন্যায় ভেসে গেছে। হুড়োহুড়ি মারামারি লেগে যায়, সবাই চায় আগে তারটা বানাতে। খাওয়া নেই ঘুম নেই বিশ্রাম নেই অনুর। কাজ করতে করতে দম যায় যায়। ক্লান্তির বশে নাকি অবচেতনে, ইচ্ছেমতো এটা সেটা বানাচ্ছে সে। গরুর ঘাড়ে ছাগলের মাথা, পাখির গলায় সাপের মুখ। ওলোট পালোট এমন তেমন ঘটতেই লাগল একের পর এক।
এই নিয়ে আবার নতুন হইচই। অনুর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে, নইলে এসব কী করছে সে?
এসবের মধ্যেই মাথা ঘুরে পড়ল একদিন। চোখের পাতা রক্তশুন্য, চোখের নিচে কালি। বদ্যি বললেন, বিশ্রাম নিক। ঠিকও হতে পারে। তারপর সত্যিই হুঁশ হলো যেদিন, আচ্ছা মতো তাকে শাসিয়ে দিলো মা। এখন থেকে আর পাগলের মতো কাজ করা যাবে না।
‘পাগলের মতো আর কী, তোমার ছেলে তো পাগলই!’ হাসতে হাসতে মায়ের চোখ মুছে দিলো অনু।
তারপর থেকে নতুন উপায় খুঁজছে। এত এত গ্রাম, এত এত দুঃখী অসহায় মানুষ, সবার কাজ অনু একা করবে কী করে? তার মতো আর কজন যদি থাকে, বেশ হয় ব্যাপারটা। এক ভোরে শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিল অনু। জমিদারের সেই পেয়াদার কথাও মনে পড়ল, জমিদার বলেছে তাকে সৈন্য বানিয়ে দিতে। তা সত্যিই কি সৈন্য বানানো সম্ভব? সম্ভব কি পুতুল বানিয়ে তাকে মানুষ করে তোলা? সেই চিন্তা থেকেই শুরু হলো অনুর এই নতুন পাগলামি। সারাদিন যে যা চায়, বানিয়ে দেয়। ফাঁকে ফাঁকে চলে তার মানুষ বানানোর খেলা।
কিন্তু অন্য প্রাণী বানানোর সময় যেটা ঘটে না, মানুষের বেলায় ঘটে ঠিক সেটাই- বারবার অনুর মনে হয় কোনও ভুল হয়ে যাচ্ছে। জীবন পেয়ে লোকটা যদি মন্দ হয়ে ওঠে! ভয়ে তাই ভেঙে ফেলে তা।
কদিনের চেষ্টার পর একটা যখন মনের মতো হলো, নিজেই তা নিয়ে গেল নদীতে সে। চাঁদনী রাত, হাঁটু পানি, হাতের পুতুল ডুবিয়ে ধরা- একই প্রক্রিয়া। তা কাদামাটি ধুয়ে ছাফ হয়ে গেল, কোমর ব্যথা হয়ে গেল বাঁকা হয়ে থাকতে থাকতে কিন্তু মানুষ এলো না কোনও। তাহলে কি অন্যদের দিয়ে করালে হবে কাজটা? সে চেষ্টাও বিফল। কী ভুল হচ্ছে, কী সমস্যা- শেষ না দেখে ছাড়বে না অনু। ছাড়তেই হলো অবশ্য। কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ বানানো বাদ রেখে শুরু করল জমিদার বানানো। ধরে ধরে প্রতিজনের সুখ দুঃখ ঠিক করার চেয়ে ভালো একজন জমিদার বানাতে পারলেই তো চুকেবুকে যায় ঝামেলা সব। সাধারণ মানুষের আর চিন্তা থাকে না কোনও। তারপর থেকেই তার বানানো নানা বর্ণের নানা রকমের মানুষের পুতুলকে জমিদারি সাজানো শুরু।
বেড়া দেয়া কাজের ঘরটায় কত যে মানুষ এখন- কেউ নারী কেউ পুরুষ কেউ জমিদার। সাজানো গোছানো পড়ে আছে চিৎ উপুড়, উল্টো সোজা।
নিষ্প্রাণের মতো অনুও সে-রাতে পড়ে ছিল তাদের পাশেই।
হাতে তার না পুরুষ না নারী সেই পুতুল, যাকে কী হিসেবে গড়বে তা ঠিক করতে পারছিল না। ঘুমের ভেতরও ব্যাপারটা তাকে জ্বালিয়েছে। হঠাৎ মনে হলো, মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য যে জমিদার সে বানাবে সে যদি নিজেই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়? না না, তা করা যাবে না। সাধারণ মানুষের অত্যাচার সহ্য করা যায়, কিন্তু জমিদারের অত্যাচার দূরারোগ্য।
তাহলে?
কী বানাবে অনু?
আচ্ছা, সবচেয়ে ভালো রাখতে পারবে কে? সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা কার?
বুঝতে পেরেই অনু উল্লাস করে উঠল।
তারপরই আবার মিইয়ে গেল আনন্দটুকু। বানিয়েও বা কী লাভ, অন্য কিছুর মতো প্রাণ তো পাবে না। শুধু শুধু… দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাসে পুতুলটাকে ধুয়ে নিলো সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই তার বুকে বিঁধল বল্লম একটা।
বল্লমের পিছে পিছে এলো জমিদারের পেয়াদা। বেয়াড়া অনু, জমিদারের কথা মানে না; যা খুশি তা বানায়, আবার বন্যা আনে! এত বড় সাহস- বলতে বলতে বল্লমটা তুলে নিয়ে গেঁথে দিলো আবার। রক্ত বেরুলো ফিনকি দিয়ে। কিছু বলারও সুযোগ পেল না অনু, টলে পড়ল তারই বানানো মানুষ-পুতুলের ওপর। কাঁচা মাটির পুতুলগুলোর কারণে তার পড়ে যাওয়ার শব্দ খানিকটা কম হলো বটে, তবে পেয়াদাগুলোর রোষ আর রোখের শেষ নেই। অনুকে মেরেই তারা ক্ষান্ত হলো না, ঘরময় ছড়িয়ে থাকা পুতুলগুলো দলাই মলাই করে, জমানো কাদা এদিক ওদিক ছুড়ে ফেলে তবেই গেল।
যেতেই সেখানে ঢুকে পড়ল সূর্যের আলো। ঝকঝকে ঝলমলে চাদরের মতো সে আলো ঢেকে রাখল অনুর দেহ, ঢেকে রাখল তার হাতে ধরা সেই নারী-পুরুষ নির্ধারিত না হওয়া পুতুলটাকেও। ওই রোদে পুতুলটা শুকিয়ে যেতে পারত, কিন্তু অনুর রক্তের প্রতিটা ফোঁটা তাকে নরম করে দিয়েছে, শিথিল হয়ে গেছে মাটির বুনন, খুলে খুলে পড়তে লাগল তা।
ওদিকে মীরামাসি ছুটে এসেছে, অনুকে নিয়ে কী বাজে স্বপ্ন নাকি দেখেছে, সাবধান করতে হবে অনুকে। তার আগে ডাকল অনুর মাকে, ছেলের মাকেও জানানো দরকার।
খাওয়ার জন্য ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল অনুর মা। মীরামাসির ডাকে জেগে উঠল যখন, তখন সে ঘোরের ভেতর। ঘোর কাটতে সময় লাগল, তারপর মাসির মুখে অনুর কথা শুনতেই ধক করে উঠল বুকের ভেতর। লজ্জায় আর কষ্টে কুকড়ে যাচ্ছে, ছেলেটা না খেয়েই কাটালো রাত! দৌড়ে গেল সে অনুর কাজের ঘরের দিকে। কেন এমন দৌড়, বুঝতে না পেরেও তার সঙ্গে দৌড়াতে লাগল মীরামাসি। যত এগোলো তারা তত তার ধক ধক করল বুক। কীসের যেন ঝড় বয়ে গেছে, কেমন যেন উথাল পাতাল সব। রক্তের দাগও দেখা যাচ্ছে নাকি? পাত্তা না দিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে। ঢুকেই গেল থমকে। নিঃসাড় অনু পড়ে আছে ভাঙাচোরা তার পুতুলগুলোর কাছে। আর বুকের কাছে জাপটে ধরে রাখা পুতুলটা থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে আলো।
মুহূর্তেই সেই আলো জড়ো হয়ে উঠল, উঠে দাঁড়ালো যেন কোনও কিছুর আকার নিচ্ছে পানি।
শেষ শ্বাস নিতে নিতে অনু দেখে নিল সবকিছু। তার বুকের রক্তের অপেক্ষাতেই হয়তো ছিল পুতুলটা। তারপর সূর্যের আলোয় পুড়েই প্রাণ পেল তার সূর্যমুখী। আহা, কী নিখুঁত! পানির মতো সরল হাত, আলোর মতো স্বচ্ছ দেহ; কাদার মতো নরম, আর রক্তের মতো গরম। যাক এবার আর কষ্ট থাকবে না কারোর। গর্বের চোখ বুজে আসবে অনুর, এমন সময় দেখল মা এসে পড়েছে। ছেলের অবস্থা বুঝে, আর তার হাতে ধরা পুতুল থেকে বের হতে থাকা অত বড় আলোর অবয়ব দেখে, মা পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে। তাল আর আতঙ্ক সামলাতে পারল না পেছন পেছন আসা মীরামাসিও।
নিঃসাড় দেহের ভেতরেও অনুর কেঁপে গেল বুক, আহারে কত জায়গায়ই না থেতলে গেল শরীর! ও মা গো, নিষ্কম্প বুকে অনুর ডেকে গেল কাকে। বেচারা মা, দুম করে পড়েছে, হাঁসফাঁস করছে, মুখের কাছে ফেনা; দম নিতে পারছে না মীরামাসিও।
আহারে… ভাবতেই হঠাৎ খটকা, সূর্যমুখীর তো ক্ষমতা অনেক; কিন্তু তার বানানো সূর্যমুখী অমন নড়ছে কেন আলাভোলা? একবার মায়ের দিকে যাচ্ছে, একবার মাসির দিকে। কাকে ধরবে, নাকি কাউকে ধরবে না, ঠিক করতে পারছে না বোধহয়। মুখে তার বিভেদের আঁধার। কেন? বুড়িদুটো পড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তেই কি তাদের ধরে ফেলতে পারত না? ব্যথিত মুখদুটোয় একটু কি বুলিয়ে দিতে পারত না মায়াময় ওই হাত?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন