চতুর্থ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা | জুলাই সংখ্যা, ২০২২
আগামী সংখ্যা : অক্টোবর, ২০২২
মরণ খেল
মূল রচনা – ই সন্তোষ কুমার (মলয়ালম গল্প)
অনুবাদ- তৃষ্ণা বসাক
লেখক পরিচিতি – ই সন্তোষ কুমার মলয়ালম ভাষার এই প্রজন্মের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য লেখক। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা পনেরোর বেশি। সেরা গল্প সংগ্রহের জন্যে এবং উপন্যাস অন্ধাকরানঝি –র জন্যে দুবার পেয়েছেন কেরালা সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার যথাক্রমে ২০০৬ আর ২০১২ সালে। এই উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ- আইল্যান্ড অফ লস্ট শ্যাডোজ ২০১৫ সালের ক্রসওয়ার্ড পুরস্কারের জন্য বাছাই করা হয়েছিল। তাঁর দুটি গল্প থেকে মালয়ালম সিনেমা হয়েছে। তাঁর লেখা অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি, তামিল, হিন্দি এবং জার্মান ভাষায়। বাংলায় অনুবাদ এই প্রথম।
কন্ঠা শাজিকে মারার জন্যে যে তারিখটা ঠিক করেছিলাম, সেটা এগিয়ে আনতে হল। খবর পেলাম যে সে দু সপ্তাহর প্রার্থনার জন্যে ধ্যান কেন্দ্রে যাচ্ছে, এমনি এমনি তো আর তাকে কন্ঠা মানে রুদ্রাক্ষ বলা হয় না। হয়তো সে মোক্ষ লাভ করে ফিরতে ফিরতে এক মাস কেটে যাবে। তারপর ওর প্যারোল শেষ হয়ে যাবে, ওকে ফিরে যেতে হবে। এই মজার জন্যে তাকে চাইই। যদি সে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় তবে আরো জোশ আসবে।
একসঙ্গে মিলে আমরা পুনোজ থাম্পিকে শেষ করে দিয়েছি, প্রায় ৬ বছর আগে। কন্ঠা শাজিই আমাদের তার ব্যাপারে সব খবর দিয়েছিল। তখনো কন্ঠার এই অসহ্য দৈবী আদেশের ব্যাপারটা ছিল। এই সময় সে ছুরি, তলোয়ার, বোমা কিচ্ছু ছোঁবে না। কিন্তু সে একটা জাত সাপ, ভয়ানক বিষাক্তও। ওর রক্তে বেইমানি। ও পুনোজ থাম্পির ওপর টিকটিকিগিরি করল, যদিও পুনোজ ছিল তার গুরু। মরার সময়েও পুনোজ থাম্পি জানতে পারে নি যে কণ্ঠাই গদ্দারি করেছে। এমনি টপ ক্লাস অপারেটর কণ্ঠা।
কেসটাকে যতদূর সম্ভব নিরীহ করে ফেলে কন্ঠা তিন আর আমি পাঁচ বছরের জেল খাটলাম। কন্ঠা অ্যাপ্রুভার হয়ে গেল। সে জেলে দুবার এল আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। সে শুধু আমাদের সঙ্গে কথা বলত যিশুর বাণী, ক্রসের পথ আর শেষ বিচার নিয়ে। আমরা ওর চালাকি বুঝি। পরেরবার ও আসুক, আমরা ঠিক করে ফেলেছি… কিন্তু সেই থেকে ওর দেখাই মেলেনি।
পুথালিঙ্গন চেট্টি, যার আর্থিক সংস্থা দেউলিয়া হয়ে গেছিল, থাম্পিকে শুধু একটু রগড়ে দিতে বলেছিল। কিন্তু বহুত রগড়ানোর পরেও ও মচকাল না। একটা ভাঙ্গা পা নিয়েও সে আমাদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছিল। তারপর থাম্পি গুরুকে খিস্তি করতে শুরু করল। কীভাবে তাঁকে দোষ দেয় সে? তিনি কি ইতিমধ্যেই ধুলোয় মিশে যাননি? থাম্পিও তো কিছুদিন আগেও গুরুর ছুঁড়ে দেওয়া রুটির টুকরো চেটেছে। যে আমাকে রুটি রুজি জুগিয়েছে, সেই গুরুকে যদি কেউ, এমনকি আমার বাবাও অপমান করে আমি তাকে ছেড়ে দেব না। কোচা জাস্ট একটা লাথি কসাল। ওর আর্তনাদ দিগন্ত কাঁপিয়ে দিল। থাম্পি ভাঙ্গা সিমেন্টের মেঝেতে পড়ে কেঁচোর মতো কাঁপছিল। চক্কান্থারা কলোনির ওর সমস্ত কুত্তারা তাদের বিছানায় লাথি মেরে ছুটে আসতে লাগল। প্রায় একশর মতো লোক, হিজড়ের মতো হাব ভাব। একটু নড়লেই আমাদের টুকরো টুকরো করে দেবে।
‘ছুরি বার কর’ আমি কোচাকে চেঁচিয়ে বললাম। আমি সামনে এলাম, আমার ছুরি ঝিকিয়ে উঠল, অন্ধকারে ওর মুখ ঝলসে উঠল, যেন কিছুই ঘটেনি। কোচা আক্ষরিক অর্থেই একটা গাধা। সে খুব সিনেমা দেখে। আমার পেছন পেছন আসতে আসতে ও খুব ফিল্মি ডায়লগ ঝাড়ছিল। আমরা ওইভাবে চকান্থারা কলোনির মধ্যেকার দুর্গন্ধ গলি দিয়ে বেরোলাম। আমাদের মধ্যে নিয়ম হচ্ছে আমরা ভয় পাব না বা তাড়াহুড়ো করব না, যদি আমরা নিজের কাজ গুবলেট করে ফেলি তাহলেও। আমাদের গুরুর সঙ্গে বিভিন্ন অ্যাকশনে বেরিয়ে এটাই আমরা শিখেছি। কোচা ছুরি ভাঁজ করে ইয়েজদিতে স্টার্ট দিল, যেটা পাশে পার্ক করা ছিল। অনেকবার লাথি মারার পর স্টার্ট নিল বাইকটা। যতক্ষণ না স্টার্ট হল, আমি জনগণকে ছোরা দেখিয়ে ঠেকিয়ে রাখলাম। আমরা যখন চলে যাচ্ছিলাম, কলোনির মহিলারা আমাদের উদ্দেশ্যে বাছা বাছা গালাগালি দিতে লাগল যেন আমরা নরক গুলজার করে ফেলেছি। ‘যা খানকিরা, কুত্তার বাচ্চাদের কাছে, ওই যে আধমরা হয়ে পড়ে আছে’ আমরা বাইক স্লো করে ওদের চেঁচিয়ে বললাম। ‘এই চোদনগুলো না বলে কাঁদতে শুরু কর’ ওই কলোনির মহিলাদের কান্নার অভিজ্ঞতা খুব কম আছে। মৃত্যু, জন্ম বা জীবন সবেতেই একটাই ভাষা- ঝাড়পিট। ইস্টার হোক বা গুড ফ্রাইডে- সেই এক নোংরা গান। হঠাৎ কন্ঠা, খোচড়টাকে দেখা গেল। সে গলির তিন নম্বর বাঁকে হামাগুড়ি দিচ্ছিল। গদ্দারের ছায়া ওকে ছেড়ে যাবে না।
‘এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না শাজি, কেস ঘেঁটে গেছে’, কোচা বুঝিয়ে বলল থাম্পির সঙ্গে কী হয়েছে। কন্ঠা হিস্টিরিয়া রুগীর মতো ওপর নিচে দুলতে শুরু করল, তার গলায় কালো কারে আটকানো ক্রস আঁকড়ে চুমু খেতে খেতে। মনে হল টেনে একটা থাপ্পড় কষাই। ও প্রচণ্ড ঘামছিল। ইতিমধ্যে কোচা নিজের বাতেলা ঝাড়তে শুরু করে দিয়েছে। দুজনের ওপরই প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আমি আস্তে আস্তে একটা জায়গায় গেলাম, যেখানে অনেক রাতেও মদ পাওয়া যায়।
সেখান থেকেই পুলিশ আমাকে ধরল। আমি শুনতে পেলাম পুনোজ থাম্পি হসপিটাল পৌঁছনোর আগেই মারা গেছিল। পুলিশ কোচাকেও কচলাল। কিন্তু আমাকে ছুঁলো না যেহেতু আমাকে অনেকদিন চেনে। জেলেও আমি বিশেষ ছাড় পেলাম। আমি ওদের সঙ্গে ঝগড়া করিনি। ওরা তো শুধু ওদের কাজ করেছে। ওদের আমার ওপর বিশ্বাস আছে। ‘তুমি চলে যাচ্ছ, এখন রান্নাঘরের দায়িত্ব কাকে দেব?’ সুপারিন্টেনডেন্ট আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল। তেল মারা অবশ্যই, কিন্তু এর মধ্যে একটু সত্যিও ছিল।
ওকে, এইটাই ব্যাপার। তিন বছর কেটে গেছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেই আমি জানতে পারলাম কন্ঠার সাম্প্রতিক কীর্তি। প্রথমে ঠিক হজম করতে পারলাম না। শুনলাম যে কন্ঠা শাজি সব কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছে। শুনলাম যে সে এখন বাণী বিতরণে ব্যস্ত। বিয়ে করেছে, একটা বাচ্চা আছে, ভালো একটা বাড়িও করেছে। আর কাকে বিয়ে করেছে? আর কেউ নয়, পুনোজ থাম্পির বোনকে! মালটা একটা শয়তান না মেসিয়া? কিন্তু আমি ওর খেলাটা ধরে ফেললাম। থাম্পি এই শহরের তামিল সুদখোরদের কাছ থেকে অনেক টাকা নিংড়ে নিয়েছে। সব টাকা এখন শাজি হাতলেত্তি করেছে আর এই সাধুর ভেক আসলে একটা নাটক। আমি সত্যিই চাইছিলাম ওর সঙ্গে দেখা করতে। আমি তাড়াহুড়ো করে কিছু করি না। আমার মতো একটা গরিব মানুষ অমন একজন পবিত্র আত্মার কাছে যাবে, এতে দোষ কোথায়?
আমি যখন ফোন করলাম, আমাকে বলা হল সে গেছে পোট্টায়, ডিভাইন সেন্টারে। থাম্পির বোনই ফোন তুলেছিল। ওকে আর নিজের নাম বলার প্রয়োজন মনে করিনি, শুধু সেল নাম্বারটা দিয়েছি। আমি আশা করিনি সেই হোলি ম্যান আমাকে রিং ব্যাক করবে। কিন্তু মাঝরাতের দিকে কন্ঠার ফোন এল। ফোনটা যখন এল, তখন আমি একটা নিবু নিবু আলো জ্বলা বারে লক্ষ্যহীন ভাবে বসে ছিলাম, যেখানে প্রত্যেকেই হয় বেশি মদ খেয়ে ফেলেছে, নয়তো বমি করছে।
আমি ওকে বললাম আমি কে। খুব ক্যাজুয়াল গলায়, হালকা ভাবে।
কিন্তু ওর গলা কাঁপছে মনে হল।
‘আমাদের দেখা হওয়া দরকার’ আমি ওকে বললাম
ও তখন তোতলাতে শুরু করল ‘ওহ, কেন নয়, যেকোন সময়…’
‘আমি কাল তোমার বাড়ি আসব’ আমি বললাম
‘কিন্তু আমি তো কাল পোট্টা বা মুরিংগুরে থাকব। অন্য দিন দেখা করা যাক’ ও আমাকে এড়াবার চেষ্টা করল।
‘কাল সকালে’ বলে আমি ফোন বন্ধ করে দিলাম।
প্রতিটি শব্দের আলাদা মূল্য আছে। হ্যাজানো, কেমন আছ জিজ্ঞেস করা –এসব আমার পোষায় না। হয়তো লোকজনকে আলো দেওয়া আর তাদের বাণী শোনানো-র বিষয়ে কন্ঠার অনেক আইডিয়া থাকতে পারে। কিন্তু আমার এমন কোন পরিকল্পনা নেই। আর সেখানেই আমাদের তফাত।
কিন্তু পরেরদিন ছক বদলালাম। খেলার কৌশল একটু পাল্টালে কেমন হয়। এইরকম লুকোচুরি খেলা যদিও আমার ধরন নয়। যাই হোক কন্ঠার মতো লোকের সঙ্গে ডিল করার জন্য একটু বেশিই সতর্ক হতে হয়। আমি যখন ওর বাড়ি গেলাম, কন্ঠা বাড়িতেই ছিল। সে বাণী ছড়াতে বেরোয়নি। আমি কি নিশ্চিত ছিলাম না যে সে পোট্টা বা মুরিঙ্গুরে যাবে না? ওর গলায় অদৃশ্য ফাঁসির একটা প্রান্ত এখন আমার হাতে।
শহরের সুদখোরদের থেকে লোটা টাকা ভোগ করার সৌভাগ্য থাম্পির হয়নি। কিন্তু তার বোন আর ভগ্নীপতি এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে। ওর ড্রয়িং রুমের মাঝখানে কুমারী মেরির মূর্তি। তার সামনের বাতি কখনো নেভে না। শুধু ড্রয়িং রুমেই অন্তত চারখানা ক্রস। আমার ঝাঁট জ্বলে যাচ্ছিল এসব দেখানেপনায়। কিন্তু আমি কিচ্ছু বলিনি।
আমাকে দেখা মাত্রই থাম্পির বোন কাঁদতে শুরু করল। কী টিঙটিঙে রোগাই না ছিল মেয়েটা। কিন্তু এখন পুথালিঙ্গন চেট্টির টাকা হাতানোর পর দিব্যি মুটিয়েছে। সেটা তার শরীরে ভালো ফুটে উঠেছে। সে যে কাঁদবে সেটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু হতভাগা কন্ঠাও ফোঁপাতে শুরু করল। কী দুর্দান্ত অভিনয়! আমি বহু কষ্টে হাসি চাপলাম।
থাম্পির বোন চা বানাতে গেল আর কন্ঠা এই ফাঁকে আমাকে কনভার্ট করার চেষ্টা করল। তার সেই সব শব্দ- পাপ-পুণ্য আর ট্রাম্পেটের ছন্দময় উচ্চারণ আবার শোনা গেল। আমি ওকে বলে যেতে দিলাম, আমার কৌতূহল ছিল কতদূর যায় বেটা দেখি। তারপর সে আমাকে হাত ধরে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে যা ছিল, তা পাগল হয়ে যাবার পক্ষে যথেষ্ট। সে কিনা থাম্পির একটা লাইফ সাইজ পোট্রেট পুজো করছে!
আমি ন্যাকা সেজে বললাম ‘ইনি কে শাজি? তোমার বাবা নাকি?’
তার চোখ আরো ঢুলুঢুলু হয়ে গেল, নাক দিয়ে শব্দ বেরিয়ে এল। ‘সেদিন যা ঘটেছে, একটা বিরাট ভুল। থাম্পিচায়ানের সঙ্গে অমন করা আমাদের ঠিক হয়নি’
‘সত্যি? তাই যদি হয়, তবে যে ওর লোক আমাদের হুমকি দিচ্ছিল, তার কী?’
‘ওটা স্রেফ ভুল বোঝাবুঝি’
‘থাম্পি এমনকি তোমার বাবাকেও পিটিয়েছে। তোমার বাবার ছবি নেই কেন?’
কিছুক্ষণের জন্যে ও চুপ হয়ে গেল। ‘আমাকে তোমার ক্ষমা করা উচিত। আমি সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়েছি’
সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়েছে, ইল্লি! তাহলে এই যে মহান গুরু পুনোজ থাম্পির ছবি পুজো করা হচ্ছে, তার মানে? আনসান কথা বলছে ঠিক আছে, কিন্তু এইভাবে অভিনয় করার ও কে? আগের জীবনে ও কে-ই বা ছিল? দালাল? খোচড়?
আমি ওর প্রতি একটু নরমই হতাম, যদি না যখন আমি উঠতে যাব তখন ও ওই বোকা বোকা নাটকটা করত! সেই ঠগ থাম্পির বোনটা একটা বাচ্চাকে নিয়ে ঢুকল। আমি এক ঝলক দেখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলাম।
‘তুমি আশীর্বাদ করো ওকে’ সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল কন্ঠা। আমি টের পেলাম আমার ভেতরে ধৈর্যের শেষ সুতোটাও ছিঁড়ে গেল, ও আমাকে পুরুত বানাবার আগেই আমাকে পালাতে হবে। আমি যাইহোক নিজেকে সামলে নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। যেকোন বাচ্চাকে কাঁদাতে আমার এক মিনিট লাগে। একটু তাকালেই যথেষ্ট। কন্ঠা কিনা জাদুকরকে জাদুটোনা করতে চাইছে!
আমি শুনতে পেলাম বাচ্চাটা কাঁদছে। আমি ঘুরে তাকালাম না।
আমার মনে হল ওর কথা ভাবলে আমি পাগল হয়ে যাব। কীভাবে কেউ নিজেকে এত নিচে নামাতে পারে? এক পাত্তর খাওয়ার পরেও সেটা আমি ভুলতে পারলাম না। সময় এমন এসেছে যে একজনকে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে হয় এইসব চোদনাদের পেছনে না ঘুরতে, আর এরা তো আমাদের নেমন্তন্ন করছে ওদের পেছনে লাথি মারার জন্য!
এই সময় কোচার প্যারোলের খবর এল। যদিও টোটাল বোর, ওকে বিশ্বাস করা যায়। ফালতু সব সিনেমা দেখে নিজেকে নষ্ট করার আগে ওকে কাজে লাগানো দরকার।
কন্ঠা ফোন করছে। ফোনে পর্যন্ত আমাকে সে জ্ঞান দিচ্ছে, পবিত্র বাণী ঝাড়ছে যারা শুদ্ধ হয়েছে তাদের নিয়ে।
‘আমিও তোমার মতোই ভাবছিলাম’ আমি নরম স্বরে বললাম ওকে।
‘জয় যিশু’ কন্ঠা আবেগ নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
‘আমাদের দেখা হওয়া দরকার’ আমি বললাম
‘ভাই’ ও বেশ্যাদের মতো ন্যাকামি করে বলল
আমি হিসেবনিকেশ করে একটা ডেট বললাম, ‘আমি একা যাব না শাজি, কোচাও সঙ্গে থাকবে’ ওর পক্ষে সুবর্ণসুযোগ, একজন নয়, দু দুজন হতভাগাকে কনভার্ট করার।
কোচা আর আমি সকালে একটা নিরিবিলি জায়গার খোঁজে ঘোরাঘুরি করলাম। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কোচা একটা মোটর বাইক হাতলেত্তি করেছে। হেব্বি কাজের কাজ করেছে। স্বাধীনভাবে ঘোরার জন্যে একটা বাইক দরকার।
চুরির টাকায় থাম্পি এই ছ তলা বাড়িটা করেছে। আমরা আবিষ্কার করলাম অন্ধকারের পর টেরেসে কেউ থাকে না। আর তারপর কণ্ঠা আমাদের জানাল যে সে একটা জমকালো প্রার্থনা সভায় যাচ্ছে। ও চায় আমরা যেন সঙ্গে যাই। গ্রেট! আমি জানালাম আমরা আজ দেখা করে ব্যাপারটা ফাইনাল করে ফেলব। প্রথমে ভাবলাম কোচাকে পাঠাব ওকে আনতে। কিন্তু না। হতভাগাটা ফিল্মের ডায়লগ আউড়ে সব বানচাল করে দিতে পারে। তাই আমি ওকে বিল্ডিঙের কাছে দাঁড় করিয়ে কন্ঠাকে আনতে গেলাম। এবার তারা আরো বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করল। আবার বৌ আর ছেলেকে প্রধান চরিত্র করে নাটক করল। আমার বলতে ইচ্ছে করল ‘ওদের ভালো করে দেখে নাও। চাইলে শুভকামনা জানাও’
এমনকি আমি যেই বাইক স্টার্ট দিলাম, অমনি পিলিয়নে বসে কন্ঠা পবিত্র বাণী বিতরণ শুরু করল। আমি ভাবলাম এখনি ওকে একটা ছুটন্ত গাড়ির সামনে ফেলে দিই না কেন? কিন্তু তাতে লাভ নেই। কেন শাস্তি পেল সেটা জেনে যাওয়া ভাল।
শ্যাওলা ভরতি ছাদে কিছু ভাঙ্গাচোরা আসবাব ছিল। একটা ভাঙ্গা চেয়ার ঘিরে একটা কাঠের ফালির ওপর আমরা বসলাম। কন্ঠা ইতিমধ্যেই বাণী বিতরণ শুরু করেছে।
‘শাজি, এক পাত্তর গলায় ঢেলে শুরু করা যাক’
অবিশ্বাসের চোখে কন্ঠা আমাদের দেখছিল। আমি লক্ষ্য করলাম ওর চোখে ভয়ের ছায়া।
ও তুতলিয়ে বলল ‘আমি আর মদ খাই না’
‘আমরাও মদ ছেড়ে দেব’ আমি বললাম ‘এটাই শেষ বার’।
‘তাহলে তোমরা খাও, আমি খাব না’ ও মিহি সুরে বলল
ও ভাবেটা কী? শুধু ও নয়, এমনকি ওর মরা বাপ মাও আমাকে এভাবে বোকা বানাতে পারবে না। ওর চালাকি আমার সঙ্গে খাটবে না।
আমরা ওকে চেপে ধরে বোতল থেকে ওর মুখে মদ ঢেলে দিলাম। আগুন জ্বলা রাম, খেলে আলসে ঘোড়াও ছুটবে। সে ছাড়াবার জন্যে হাঁসফাঁস করল, বের করে দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ ইতিমধ্যেই পেটে চলে গেছিল। কোচা আর আমি বাকি বোতলটা শেষ করে কাঠের আসবাবের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
‘তোমার এত টেনশন করার কোন দরকার নেই’ আমি ওকে জ্ঞান দিলাম।
কণ্ঠা আমাদের দিকে ভর্তসনার চোখে তাকাল। ‘যখন তুমি তোমার বৌ বাচ্চার সঙ্গে রাজার মতো বাঁচছিলে, তখন এই দুজন জেলের গরাদের ওপারে দিন গুনছিল।’ কোচা অভিনেতার ঢঙ্গে ব্যারিটন গলায় বলল। এটাই ওর দোষ। ফিল্মের ডায়লগ থেকে বেরোতেই পারে না। যেন জেলে ওর কঠিন দিন গেছে। একবার তাকিয়ে দেখো। মোটা শুয়োর একটা।
‘আমি অনুতাপে জ্বলছি’ জড়ানো গলায় বলল কণ্ঠা। যদি এটা সিনেমা হত তবে অনুতাপ শব্দটাকে ফোটাতে একটা গোটা রিল খরচ হয়ে যেত। ‘থাম্পিচায়া নের জীবনকে একটা অন্য খাতে বয়ানো যেত। তোমার আর থাম্পির মধ্যের সমস্যা মিটে যেত’ সে বলেই চলে।
‘কিন্তু আমরা তো ওকে মিটিয়েই দিলাম তাই না?’ কোচা একটা টোপ ছুঁড়ে দিল।
‘মিয়ে কাল্পা, মিয়ে কাল্পা, মিয়ে ম্যাক্সিমা কাল্পা’ কন্ঠা মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে। সে ইতিমধ্যেই মাতাল হয়ে গেছে।
বোধহয় আর বেশি টানা উচিত না। ও তো ইতিমধ্যেই বান মাছের মতো খাবি খাচ্ছে। আমি একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে ওর হাতে দিই।
‘ও কি লিখতে পারে?’ কোচা জিজ্ঞেস করে।
আমি একটা পেন বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দি। ‘লেখো’ ওকে বলি ‘আমি যেমন বলি লেখো’
কন্ঠা আমাদের দিকে মরা চোখে তাকাল।
‘লেখো’ কন্ঠা তার সাহিত্যের ভাষা ঢেলে দিল ‘ ‘আমি অনুতপ্ত, আমি চলে যাচ্ছি। এ সমস্তই আমার পাপ’
‘আমার দোষ’ আমি এটা কণ্ঠার ভাষায় একটু বদলে দিলাম ‘শুধু আমার দোষ’
কাঁপা কাঁপা হাতের লেখায় সিগারেটের প্যাকেট ভরে গেল। ওকে সই করার জন্যে আমাদের সাহায্য করতে হল। তারপর এটা ভাঁজ করে ওর শার্টের পকেটে রেখে দিলাম।
‘আমাকে মেরো না’ সে মিনতি করল
‘তুমি আত্মহত্যা করবে’ সিনেমার হিরোর মতো ঘোষণা করল কোচা, কণ্ঠার গালে হালকা চড় মেরে।
‘আমার পরিবার…’ কণ্ঠা গুঙিয়ে উঠল। ও আবার একটা নৌটংকিপনা শুরু করতে যাচ্ছে, যেটা আর আমি নিতে পারছি না।
‘কোচা, তুই এই বোকাচোদার জাঙ্গিয়া আর সব জিনিস ওর মুখে গুঁজে দে’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘আমরা এখানে জলসা শুনতে আসিনি’
কণ্ঠা ওর মুখ চেপে ধরল কান্না থামাবার চেষ্টায়।
‘যদি না প্রভু নগর রক্ষা করে…’ সে আমাদের দিকে ক্ষমার আশায় তাকাল। আমরা ওকে ভাঙ্গা চেয়ারে তুললাম। যথেষ্ট ভারি মালটা। ‘ পুথালিংগন চেট্টির পাপের টাকায় ঘাড়ে গর্দানে হয়েছে’ আমি থাম্পিকে অভিশাপ দিলাম। চেয়ারটাকে ছাদের একদম ধারে নিয়ে গেলাম। চোখ বুজে কন্ঠা গসপেল আওড়াচ্ছিল। শক্ত করে ধরে চেয়ারটাকে কাত করলাম। ছোট্ট একটা ঠেলা, ব্যস চেয়ার খালি। চেয়ার থেকে কন্ঠা উড়ে যাবার পর, এটাকে আবর্জনায় স্তূপে ছুঁড়ে দিলাম।
একটা দমাস করে পড়ার শব্দ শোনা গেল নিচ থেকে। আমি তাকাবার চেষ্টাই করলাম না। বড় কোন ঘটনাই না। স্রেফ একটা কাজ, ওই আর কি, এটুকুই।
লোহার সিঁড়ি বেয়ে আমরা নেমে এলাম। আমার ঠিক পেছন পেছন কোচা এল। মনে হল দূর থেকে শিশুর কান্নার শব্দ পাচ্ছি। ওহ, ফেড আপ। মনে হল কোথাও একা বসে আছি। পুরো মুক্ত। কোচা পেছন থেকে কিছু বলতে শুরু করল। প্যারোলে বেরিয়ে আসার পর থেকে নির্ঘাত একশ-র ওপর সিনেমা দেখেছে। আমার প্রচণ্ড ঘেন্না হল।
রুপোলী ছুরি হাতে ধরে পেছন না ফিরে বললাম ‘ তোর এই বালের ডায়লগ আমাকে ঝাড়ার চেষ্টা করবি না। যদি নিজের কিছু থাকে, সেই ভাষায় কথা বল। যে নিজের ভাষায় কথা বলতে পারে না, তার আর কথা বলাই উচিত না’
অনুবাদক পরিচিতি – তৃষ্ণা বসাক এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ কবি ও কথাকার। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কল্পবিজ্ঞান, মৈথিলী, হিন্দি ও মালয়ালম অনুবাদকর্মে তিনি প্রতিমুহুর্তে পাঠকের সামনে খুলে দিচ্ছেন অনাস্বাদিত জগৎ। জন্ম কলকাতায়। শৈশবে নাটক দিয়ে লেখালেখির শুরু, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘সামগন্ধ রক্তের ভিতরে’, দেশ, ১৯৯২। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘আবার অমল’ রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯৯৫।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.ই. ও এম.টেক তৃষ্ণা পূর্ণসময়ের সাহিত্যকর্মের টানে ছেড়েছেন লোভনীয় অর্থকরী বহু পেশা। সরকারি মুদ্রণ সংস্থায় প্রশাসনিক পদ, উপদেষ্টা বৃত্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শী অধ্যাপনা, সাহিত্য অকাদেমিতে আঞ্চলিক ভাষায় অভিধান প্রকল্পের দায়িত্বভার- প্রভৃতি বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর লেখনীকে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- পূর্ণেন্দু ভৌমিক স্মৃতি পুরস্কার ২০১২, সম্বিত সাহিত্য পুরস্কার ২০১৩, কবি অমিতেশ মাইতি স্মৃতি সাহিত্য সম্মান ২০১৩, ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ) ২০১৩, ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার ২০১৫, সোমেন চন্দ স্মারক সম্মান (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি) ২০১৮, সাহিত্য কৃতি সম্মান (কারিগর) ২০১৯, কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন স্মৃতি সম্মান ২০২০, নমিতা চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য সম্মান ২০২০ ও অন্যান্য আরো পুরস্কার। বর্তমানে কলকাতা ট্রান্সলেটরর্স ফোরামের সচিব।