অপর্ণা গাঙ্গুলী
আমাদের ছোটোপিসি, মানে আমার পিস্শাশুড়ি বড়ো সুস্বাদু, পুষ্টিকর রান্নাবান্না করেন । এই সব রান্নাবান্নাকে স্বাত্বিক রান্নাও বলা চলে । ছোটোপিসির এইসব রান্নাবান্না তাঁর দীক্ষাগুরু শ্রী শ্রী আনন্দময়ী মায়ের হেঁসেল থেকে নেওয়া। মা স্বয়ং যখন তাঁর দীক্ষিত সন্তানদের রান্নাবান্না করে খাওয়াতেন, সে’সব খাবারের তারই ছিল আলাদা রকমের । তা সেই সব রান্না যখন আনন্দময়ী মায়ের রান্নাঘর উদ্ভূত, তার নাম “ব্রহ্ম খিচুড়ি” হবে নাই বা কেন । এ রান্নার সঙ্গে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের সাযুজ্য ছিল কিনা বলতে পারিনা, তবে এ খাবার খেয়ে যে তুরীয় আনন্দলাভ করা যায়, তা বলাই বাহুল্য ।
তাহলে, কী এই ব্রহ্ম খিচুড়ি । এ খিচুড়ি কিন্তু শুধু আলু ফুলকপির মেলবন্ধনে তৈরী স্রেফ বাঙালি খিচুড়ি নয় । এতে সবরকম সব্জী দেওয়াই যায় । মানে, বাড়িতে কুমড়ো শুকিয়ে যাচ্ছে, কিংবা আলু, মুলো, গাজর একটু একটু করে সব পড়ে রয়েছে, দাও ঢেলে ওই খিচুড়িতে, স্বাদ বাড়বে বই কমবে না । ছোটোপিসি তাই সপ্তাহ শেষে একদিন ওই ব্রহ্ম খিচুড়ি বানান । ব্রহ্ম খিচুড়ি তয়ের করার জন্য সব্জী যা যা লাগতে পারে, তা হলো: আলু, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি, গাজর, মুলো, বিনস, পেঁপে, এটা সেটা, যে যে সব্জী হাতের কাছে পাওয়া যায় । তা এই সব সব্জীপাতি, ডুমো ডুমো করে কেটে ধুয়ে রাখতে হবে । এরপর যতটা পরিমান মুগ ডাল, ঠিক ততটা পরিমান চাল নিতে হবে । সে চাল বাসমতি কিংবা গোবিন্দভোগ হলে খুব ভালো হয় । মুগের ডাল ভাজা কিংবা না-ভাজা হলে চলবে ।
এর পরে কয়েকটি কাঁচা লঙ্কা কেটে নিতে হবে দু ফালা করে । অনেক অনেক ধনে পাতা কুচিয়ে রাখতে হবে । আর লাগবে, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, গোটা জিরা, গরম মশলা ফোড়নের জন্যে । আর প্রয়োজনমতো হলুদ গুঁড়ো, জিরা গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো আর ঝিরি ঝিরি করে কাটা আদা । অল্প আদাবাটাও নিতে পারেন । তবে ওই ঝিরঝিরে আদা মুখ পড়লে বেশ একটা অন্যরকম মৌতাত গড়ে ওঠে কিনা । এই সব পরমানন্দ লাভ মনুষ্যজীবনের এক পরম প্রাপ্তি । সুতরাং এইসব মশলাপাতির হেরফের হলে চলবে না ।
সব্জীপাতি মশলা যখন সব জোগাড় হলো তখন পিসি রান্নাঘরে ঢোকেন স্নান সেরে, ব্রহ্ম খিচুড়ি রাঁধতে । আমি নীরব দর্শক, মাথার মধ্যে ঘন ঘন নোটস নিয়ে আপডেট রাখতে থাকি পরে কোনোসময়ে রান্নাবান্নার খেরোখাতায় লিখে রাখবো বলেই । ছোটোপিসি আঁচলের প্রান্ত দিয়ে মুখ নাক বেশ করে বেঁধে নিলেন । ভোগের খিচুড়ি বলে কথা, উচ্ছিষ্ট না হয়ে যায় । এ’সময়ে কোনো কথা বলা চলবে না, শুধু দূরে দাঁড়ানো নীরব দর্শক হয়ে থাকতে হয় । তাই সই ।
পিসিমা ততক্ষণে মাজা পেতলের কড়াই উনোনে বসিয়ে বেশ খানিকটা সর্ষের তেল ও বিশুদ্ধ গাওয়া ঘি দিয়েছেন গরম করতে। সর্ষের তেলের বদলে সোয়াবিন তেলও ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘি পড়তেই গন্ধ বেরিয়েছে স্বর্গীয় আর তাতে তেজপাতা শুকনো লঙ্কা, গরম মশলা আর জিরে ফোড়ন দেওয়া হলে পর ম ম করে ওঠে রান্নাঘরের চৌহদ্দি। এর পর শক্ত আনাজ, যেগুলো সেদ্ধ হতে সময় লাগে যেমন আলু, গাজর, বিনস, মুলো এগুলো দিয়ে দেওয়া হয় তেলের ওপর এক এক করে। কিছুটা নাড়াচাড়া করার পর কড়াইশুঁটি, কুমড়ো, ফুলকপি এক এক করে তেলে ছাড়া হয়। পাকা রাঁধুনি মাত্রেই জানেন, ঠিক কতটা ভাজা হলে সব্জী স্বাদে গন্ধে রান্নার স্বাদ বাড়াবে নিজগুণেই। শিক্ষানবিশ আমি, শিখে নিই এ’সব একটু একটু করে, যদিও হাতে কলমে এইসব করেই হাত পাকাতে হয় ধীরে ধীরে।
খিচুড়িতে দেওয়া সব্জী “চেয়ে চেয়ে থাকলে” চলবে না। এখন এই চেয়ে থাকার মানে হলো, সুসেদ্ধ হওয়া কিন্তু একেবারে মজে না যাওয়া। সে ভারী অদ্ভুত ব্যাপার। সব্জী গলে না গিয়ে বেশ আলো আলো রূপ ধারণ করবে কষতে কষতে, তবেই না রান্না। বাকিটুকু ঠিক সেদ্ধ হয়ে যাবে, চাল ডালের সঙ্গে আঁতাতে। এরপর দিতে হবে, হলুদ গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, ইচ্ছে মতন আদা বাটা, প্রয়োজনমতো লঙ্কা গুঁড়ো (যে যেমন ঝাল খান, তার ওপর নির্ভর করে) প্রয়োজন মতো লবণ এবং অল্প মিষ্টি। ও হরি, সেই ঝিরি ঝিরি আদা আর চিরে রাখা কাঁচালঙ্কা যেন ভুলে না যাই। এরপর, বেশ করে নেড়ে তারপর সেই ঘিয়ে ভেজে রাখা চাল ও ডাল দিতে হবে সব্জী ও মশলার সঙ্গে। ভালো করে কষিয়ে গরম জল দেবার পালা এখনই। ব্রহ্ম খিচুড়ি মা আনন্দময়ী যেমন রাঁধতেন, বেশ ঝোল ঝোল, সাপ্টেসুপ্টে মেখেমুখে খাবার মতো করে। বেশি আঁট আঁট নয়। তাই ফুটতে ফুটতে যখন প্রথম বসন্ত দিনের সূর্যের আভা খেলে যাবে সে রান্নায়, আর ঘরময় এক অপূর্ব সুরভী প্রাণমন মাতিয়ে দিয়ে ঈশ্বরলাভের আনন্দে ভরে উঠবে, ঠিক তখনই বোঝা যাবে, রান্না হয়ে গেছে ব্রহ্ম খিচুড়ি। ওপরে সেই কুচোনো ধনে পাতা ছড়িয়ে পরিবেশন করলেই হলো।
এরপর? এরপর আর কী? অনেক সব্জী থাকার জন্য অল্প ঘি মাখন ছড়িয়ে দিব্য খাওয়া হয়ে যায় এই ঈশ্বর নিবেদিত অপরূপ ভোগ। ভাজাভুজি লাগেও না। খুব চটজলদি কিছু খাবার রান্না করে নিয়ে সবাইকে পরিবেশন করতেও এই রান্নার জুড়ি নেই। সব্জী, চাল ডাল সবই তো খাওয়া হলো একসঙ্গে।
আর এই ভোজনের প্রতিটি কণার মধ্যে দিয়ে আনন্দ তো ছড়িয়েই আছে অন্নময় থেকে প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় এবং সর্বোপরি আনন্দময় কোষে কোষে।
ওঁম পূর্ণমদ: পূর্ণমিদম পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ll
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন