আত্মকথা
বিমল গুহ
পৃথিবী সৌরলোকের একটি ঘূর্ণায়মান বস্তুখন্ড, যার সঙ্গে প্রাণিজগতের আনন্দ-বেদনার সম্পর্ক। গ্রহ মানে আমার ধারাজল, হাওয়া আর আলোর উদ্ভাস। এর এক প্রান্তে আমাদের ঠাঁই, আমরা বলি বাড়ি। আমার মাতৃভূমি। মায়ের কোলের শান্তি যেন। তবুও শান্তি, আনন্দ চিরস্থায়ী কোনও জিনিস নয়, তার ব্যতিক্রম হয়। জীবন তো সমান্তরাল পথে চলে না। হঠাৎ কোনও বিপত্তি হতে আর কতক্ষণ! ২০০৭ সালের জুলাই মাসে আমরা বিলাত হবো, হঠাৎ মীনা বললো তার বাম চোখে এপাশ থেকে ওপাশে একটা তীর্যক আলোরেখা ছুটে যাচ্ছে মতো মনে হচ্ছে তার! বিষয়টা তেমন বুঝে উঠতে না-পারলেও গুরুত্ব দিয়েছিলাম। বললাম, চলো যাত্রার আগে ডাক্তার দেখিয়ে নিই। গেলাম ফার্মগেটে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে। জুন মাসের প্রথম দিকে। ডাক্তার সাহেব আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, কোনও অসুবিধা নেই। আমরা পরের মাসে নিশ্চিন্তে রওনা হলাম লন্ডনের পথে। সপরিবার যাচ্ছি লন্ডনপ্রবাসী বড়মেয়ের কাছে, মহা আনন্দর ব্যাপার বটে! আমরা মাসখানেক লন্ডন-প্যারিস ঘুরে বাসায় ফিরে এসে মহা আনন্দে জাবর কাটছিলাম। এর মধ্যে মীনা আবার তার চোখের সমস্যার কথা বললো। আমি যোগাযোগ করলাম বারডেম-এর কর্ণধার অধ্যাপক আজাদ খানের সঙ্গে। বারডেম-এর চক্ষু বিভাগে দেখানো হলো। প্রথমে চোখের ছানির কথা বলা হলো। ঠিক করলাম ছানি অপারেশন করিয়ে নেবো। চক্ষু বিভাগের আর.এস.-কে দেখিয়ে ছানি অপারেশনের তারিখ নিলাম ২০শে আগস্ট ২০০৭। যেদিন অপারেশন করতে গেলাম, চক্ষু বিভাগের সিনিয়র চিকিৎসক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম যত্নের সঙ্গে দেখলেন। তিনি বললেন, ছানির সমস্যা তো রয়েছেই তার চেয়ে বড় সমস্যা মনে হচ্ছে রেটিনাল ডিটাচমেন্ট। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর আর এক সহকর্মী ডা. জিয়ার সঙ্গে আলাপ করলেন। ডা. জিয়া এসে দেখলেন। দুজনে সিদ্ধান্তে এলেন রেটিনাল ডিটাচমেন্ট।
এটি গুরুতর সমস্যা। অতি দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে রোগীর অন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে! অকস্মাৎ ভড়কে গেলাম। বারডেম-এ তখন রেটিনা-চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিলো না। কিন্তু অতি দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। মাথায় যেন বাজ পড়লো। মিনিট নষ্ট করার সুযোগ নেই। তাদের পরামর্শ মতো ঠিক করা হলো কালকের মধ্যে মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) অবস্থিত শংকর নেত্রালয়ে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাবো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিতে হবে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ বেশ উত্তাল। খেলার মাঠে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বাবদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পড়েছে। তার প্রভাব অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পড়তে শুরু করেছে। ঘটনা রূপ নিচ্ছে দুর্ঘটনায়! এই অবস্থায় আমরা পড়ে গেলাম মহা ফ্যাসাদে। প্রশাসনের চিন্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষার, আর আমাদের চিন্তা তখন চোখ রক্ষার। এমন বিপদও মানুষের জীবনে আসে! বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। তারা সদয় হয়ে সেই অবস্থায় ছুটির কাজটি করে দিলেন। সেদিন ২৩ তারিখ বৃহষ্পতিবার। পরদিন শুক্রবার। অনুমতির চিঠি পেলাম শনিবার ২৫শে আগস্ট। ঢাকা-কলকাতা প্লেনের টিকেট পেলাম না। নিলাম বাসের টিকেট। কলকাতা থেকে প্লেনে। বিশেষ ব্যবস্থায় পরের দিন ২৬শে আগস্ট আমাদের ভিসা হলো। ২৮শে আগস্ট রওনা হলাম কলকাতা হয়ে চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে। প্রথমে বাসে। কলকাতা থেকে প্লেনে। আমাদের এক আত্মীয়কে দিয়ে কলকাতা-চেন্নাই ইন্ডিগো এয়ারলাইনের লোকাল টিকেট করানো হয়েছিলো। এক রাত কলকাতায় থেকে পরদিন ২৯শে আগস্ট সকাল ৯টায় প্লেন উড়লো আকাশে। চেন্নাই এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম সকাল ১১-৩০ মিনিটে। সেখান থেকে দ্রুত ছুটলাম হাসপাতাল ইমার্জেন্সিতে। আমরা পৌঁছার ১৫ মিনিটের মধ্যে ডাক পড়লো। শুরু হলো বিভিন্ন রকমের চেক-আপ। তারাও জানালো রেটিনাল ডিটাচমেন্ট জরুরি অপারেশন করতে হবে। ভর্তির ব্যবস্থা হলো কেবিনে। রোগীর পাশে অ্যাটেন্ডেন্টের থাকার ব্যবস্থা আছে। সেখানে থাকলাম আমি। আমার কোনও কাজ নেই। সব নার্সেরা করছে। রক্তের স্যাম্পেল নেয়া, ইসিজি করা যাবতীয় পরীক্ষা শেষ হলো ৩০ তারিখের মধ্যে। অপারেশনের দিন পড়লো ৩১শে আগস্ট দুপুর ১২টায়। অপারেশন করবেন ডা. প্রমোদ ভেঁদে। আমরা আছি তিনতলায়, অপারেশন থিয়েটার চারতলায়। মীনাকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করে থিয়েটারে নেয়া হলো বেলা ২-৩০ মিনিটে। ডাক্তার বের হয়ে আসলেন বিকেল ৫-১০ মিনিটে। ডাক্তার জানালেন অপারেশন সাকসেসফুল। মীনাকে যখন বেডে নেয়া হলো তখনও সে অচেতন, চোখে ব্যান্ডেজ। একদিন রাখার পর রিলিজ করে দেয়া হলো হাসপাতাল থেকে। আমরা গিয়ে উঠলাম চেটপেট এলাকায় ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস সেন্টার’-এ। চিকিৎসা নিয়মিত চোখে ড্রপ দেয়া ও উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা। আমার কাজ বসে বসে বই পড়া।
চেন্নাইতে তখন অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব পোয়েটস-এর ২৭তম সম্মেলন। প্রতিবছর কবিদের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় কোনও না কোনও দেশে। ২০০৭ সালের ১-৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ভারতে। অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে এম-আর-সি নগরের চেট্টিনাদ কালাইয়ারঙ্গম বিশাল অডিটরিয়ামে; আমাদের রেস্ট হাউজের অদূরে। মীনা বললো, তুমি সম্মেলন থেকে ঘুরে এসো। আমি তো শুয়েই থাকবো। সম্মেলনে ঘুরে আসবো ঠিক করলাম। সম্মেলনের সভাপতি বিচারপতি এস. মোহন, মহাসচিব ড. মওরাজ ইয়ং। তামিলনাড়–র গভর্ণর সুরজিত সিং বর্ণালা সমাপ্তি ভাষণ দেবার কথা। চেটপেট থেকে বাসে রওনা হলাম সকাল ১০টায় এম-আর-সি নগরের উদ্দেশ্যে। যেতে হয়েছে মেরিনা সী বীচের পাশ দিয়ে। চেন্নাইয়ের দীর্ঘ সী বীচ। এই সী-বীচের পাশেই সম্মেলন কেন্দ্র। ১১টার দিকে গিয়ে পৌঁছলাম রিসেপশন কাউন্টারে। পরিচয় দিলাম আমি বাংলাদেশের কবি, পারিবারিক প্রয়োজনে চেন্নাই এসেছি। বললেন, ওয়েলকাম… প্লিজ হ্যাভ ইউর সীট ইনসাইড দি অডিটরিয়াম। আনুষ্ঠানিকতা সেরে হলে প্রবেশ করে দেখি তখন গভর্ণরের বক্তৃতা চলছে। ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি তাঁর লেখা কবিতাও পড়লেন। সবাই মুগ্ধ হয়ে বক্তৃতা শুনছে। ঠিক ১২টায় বক্তৃতা শেষ হলো। সম্মেলনের সভাপতি বিচারপতি এস. মোহন ভাষণের পর দুপুর ১টায় সম্মেলন শেষ হলো। এবার খাবারের বিরতি। এই ফাঁকে আলাপ-পরিচয় হলো অনেকের সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে যোগ দিয়েছেন কবি আমিনুর রহমান। তার সুবাদে সম্মেলনে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। আনন্দে ভরে গেলো বুক। আমিনুর রহমানের সঙ্গেও কথা হলো। কথা হলো সম্মেলনের সভাপতি বিচারপতি এস. মোহন, ২৭তম সম্মেলনের সমন্বয়কারী কবি এম.এস. সুকুমার, জি. মণিক্রম, এরবারি এস. রাধাকৃষ্ণন, চাইনিজ কবিতা সংঘের সভাপতি ড. ইউ-শি, এবং মেক্সিকান কবি ও ২৮তম সম্মেলনের সমন্বয়কারী ইউজেনিয়া সোবেরাসি-এর সঙ্গে। মিস ইউজেনিয়া সোবেরানিস ২০০৮ সালের অক্টোবরে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠেয় ২৮তম সম্মেলনে যোগদানের জন্য আগাম আমন্ত্রণ জানালেন।
মীনা রেস্টহাউজে একা আমার অপেক্ষায় আছে। দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তাদের পরের পরিকল্পনা শহরের দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন। বাস প্রস্তুত। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আমার পথে বাসে চাপলাম। মেরিনা সী-বীচের তীর ঘেঁষে বাস চলছে। ইচ্ছা করলেও নামার সুযোগ নেই। বাস থেকে সমুদ্রের দৃশ্য যতটা দেখা যাচ্ছিলো তা উপভোগ করলাম। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। চেটপেটের কাছে একটা বাংলা হোটেল আছে, সেখান থেকে দুজনের জন্য ভাত-মাছ-ডাল-সবজি নিয়ে দ্রুত রুমে ফিরে এলাম। মীনাও খাবারের অপেক্ষায়। দুজন পেটপুরে খেয়ে দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম মীনার কাছে। এভাবে আরও এক সপ্তাহ থাকতে হবে। এরপর ডাক্তারের চেক-আপের শেষে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত হবে। চেক-আপের সময় ডাক্তার বলেছিলেন প্লেনে চড়া নিষেধ। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী ৯ই সেপ্টেম্বর চেন্নাই থেকে ট্রেনে ঢাকার পথে রওনা হলাম। বাসায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ-পড়ুয়া দুই মেয়ে একা ছিলো। এমন পরিস্থিতিও মানুষের জীবনে হয়ে যেতে পারে যে কোনও সময়।
মীনার চিকিৎসা-পরবর্তী চেক-আপের জন্য আবার চেন্নাই গিয়েছিলাম ২০১১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি। আমরা তিনজন মীনা, ছোটকন্যা মিথিলা ও আমি। আমরা সেবারও উঠি ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস সেন্টার’-এ। যথাসময়ে হাসপাতালে গিয়ে চেক-আপ করানো হয়েছিলো। চোখের অনেকটা উন্নতি হয়েছে। চেন্নাইয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ ভালো। এর আদিনাম চেন্নাপত্তম। ‘পত্তম’ মানে শহর, অর্থাৎ চেন্না শহর। এর গোড়াপত্তন হয়েছিলো ২০০০ বছর আগে তামিল-কবি তিরুভেল্লার সময়ে। প্রথম দিকে এটি কোভাম’ ও ‘আধায়ার’ নদীর তীরবর্তী কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠে। কলক্রমে আশেপাশের গ্রাম ট্রিপ্লিকেইন, এগমোর ও চেটপেট নিয়ে ‘চেন্নাপত্তম’ গড়ে ওঠে। তখন নাম দেয়া হয় ‘মাদ্রাজ’। ১৯৯৬ সালে মাদ্রাজ নামের স্থলে নামকরণ হয় ‘চেন্নাই’। রেস্টে কেটে গেল দুইদিন। এদিকে যোগাযোগ হলো চেন্নাইয়ের কয়েকজন কবির সঙ্গে। আমাদের যাত্রার দু’দিন আগে গেস্ট হাউজে দুপুর পর্যন্ত শুয়ে-বসে পত্রিকা পড়ে কাটালাম।
দুপুরে চেন্নাইয়ের কবি এম এস সুকুমারন ফোন করে জানালেন, তারা তরুণ কবিসহ কয়েকজন বিকেল ৫-টায় রেস্ট হাউজে আসবেন। তাঁরা সময় মতো এলেন ৫জন- এম এস সুকুমারন, ভি ডি কৃষ্ণমূর্তি, টি এন কৃপানন্দন, টেলিফোন মীরন ও এন ভি সুব্রহ্মনম। রেস্ট হাউজের নিচতলায় অবস্থিত নামকরা রেস্তঁরা ‘পলিমার’। সেখানে জমে উঠলো সাহিত্য-আড্ডা। আমার জন্য নিয়ে এলেন ‘ইয়ং পোয়েট’ নামের একটি পত্রিকা। এর সম্পাদক এন ভি সুব্রহ্মনম, প্রকাশক ইয়ং পোয়েটস ক্লাব অফ ইন্ডিয়া, চেন্নাই। পত্রিকাটিতে তারুণ্যের অদম্য ইচ্ছা ও সাহসের পরিচয় আছে। আমরা নিচে বসে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিলাম। আলোচনায় উঠে এলো চেন্নাইয়ের সাহিত্যের, বিশেষ করে কবিতার রূপ। কিছুক্ষণ পর এসে যোগ দিলেন কবি এরাভাডি রাধাকৃষ্ণন। এঁরা চেন্নাইয়ের উল্লেখযোগ্য কবি। এরাভাডি রাধাকৃষ্ণনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কবিতা বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কভিতাই উরাভু। আমাদের আড্ডায় বাংলাদেশের কবিতা ও চেন্নাইয়ের কবিতার মোটামুটি একটা রূপ উঠে এলো। চেন্নাইয়ের সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। এখানকার খুব জনপ্রিয় প্রবীণ কবি ভাইরা মুতু। অন্য যাঁদের কথা আলোচনায় উঠে এসেছে, চেন্নাইয়ের প্রথম সারির কবিরা হলেন ভালি, ভা মু সেতুরমন, মু মেতা, মারাই মালাইয়ান, পোন্নাদিয়ান, কালিমোগরি, তামিল আমুদান, ভেঝা ভেন্দন, কে রামামূর্তি, কান্নাডসান প্রমুখ। আড্ডা দিতে দিতে ‘ইডলি সাম্বার’ আর ‘দোসাই’ খাওয়া হলো। এসব এদের প্রিয় খাবার। এছাড়াও ছিল থালি, খিচড়ি, নানরুটি, হালুয়া, ভাত-মাছ ইত্যাদি। অবশ্য সর্বক্ষণ চা পাওয়া গেছে। আড্ডা চললো রাত ৮-টা অবধি।
চেন্নাই থেকে ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১১ আমরা দিল্লী হয়ে ঢাকার পথে রওনা দিয়েছি। ঠিক করা হয়েছে দিল্লীতে আমরা উঠবো আইআইটি ফ্যাকাল্টি গেস্ট হাউজে। সেখানে আমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন দিল্লীর-কবি প্রাণজি বসাক। প্রাণজি বসাক তখন কলকাতার পথে বলে জানালেন। বললেন, আপনারা আসবেন জানলে কলকাতা যেতাম না। আপনারা থাকুন, আমি ২দিন পর ফিরে আসবো। কোনো অসুবিধা নেই আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি দিল্লীতে থাকার। ৬ই ফেব্রুয়ারি ১০টায় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস সেন্টার থেকে বিদায় নিয়ে লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি। আমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছিয়ে দিতে চেন্নাইয়ের কবি টি এন কৃপানন্দন গাড়ি পাঠিয়েছেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। আমাদের জেট এয়ারওয়েজ ফ্লাইটে দিল্লীর পথে রওনা দেবো দুপুর ১-৩৫ মিনিটে। দিল্লী পৌঁছলাম বিকেল ৪-৩০ মিনিটে। দিল্লীর ‘ইন্দিরা গান্ধী ইন্টান্যাশনাল এয়ারপোর্ট’ বেশ বড়, সুন্দর। প্লেন থেকে নেমে এয়ারপোর্টের ভিতর প্রায় এক কিলোমিটারের মতো হেঁটে আমাদের ব্যাগ সংগ্রহ করলাম। বাইরে এসে প্রি-পেইড ট্যাক্সির টিকেট নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই ট্যাক্সি চলে এলো। এয়ারপোর্ট থেকে ৫-৪০ মিনিটে ছেড়ে ঠিক এক ঘণ্টায় চলে এলাম গেস্ট হাউজের গেইটে। ব্যবস্থামতো আমাদের জন্য নির্ধারিত ১১২নং কক্ষে জায়গা হলো। গোলাকার বৃত্তে সাজানো মনোরম গেস্টহাউজ। থাকার ব্যবস্থাও বেশ ভালো। গেস্টহাউজের কর্মকর্তা মি. রজনীশ খোঁজ রাখছেন সব ব্যাপারে।
মি. রজনীশের সহযোগিতায় পরদিন ৭ই ফেব্রুয়ারি দিল্লী সফরের জন্য ট্যাক্সি চলে এলো। টেক্সিচালক সুনীল ভালো মানুষ। সকাল ৯-টায় দিল্লী দেখতে বের হয়ে গেলাম। গাড়িতে যেতে যেতে শহর দেখাতেও আনন্দ যেন। প্রথমে গেলাম কুতুবমিনার দেখতে। এলাকাটি সংরক্ষিত। যে-জাতি ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে জানে না, তাদের চোখ কখনো নূতন আগামীর আলো দেখতে পাবে না। জনপ্রতি ১০ রুপী দিয়ে টিকেট কেটে ভেতরে যেতে হয়। আমরা ভেতরে ছিলাম ৪৫ মিনিট। অতীত ভারতের কী অপরূপ নিদর্শন! সেদিন লোটাস টেম্পল ও স্বামী নারায়ণ অক্ষরধাম মন্দির বন্ধ ছিলো। ১২টার দিকে এরপরে মহাত্মা গান্ধীর সমাধি দর্শন করলাম। একই ট্যাক্সিতে গেলাম পার্লামেন্ট হাউজের উত্তর-দক্ষিণ ব্লকে, সেখান থেকে গেলাম রাষ্ট্রপতি ভবনে। দেখলাম ইন্ডিয়া গেট; এটি আফগান যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। পরদিন আমরা আগ্রা যাওয়ার টিকেট নিয়েছি। ৮ তারিখ সকাল ৬.১৫ মিনিটে ভূপাল শতাব্দী এক্সপ্রেসে উঠলাম। মাঝে মথুরা স্টেশন ফেলে আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছলাম ৮-২৫ মিনিটে। স্টেশন থেকে প্রি-পেইড ট্যাক্সিতে ১৫০ রুপি ভাড়ায় চলে গেলাম আগ্রার পশ্চিম গেটে। ভেতরে প্রবেশের জন্য টিকেটের মূল্য ভারতীয় ২০ রুপী, বিদেশী ৩০০রুপী। পুরুষ-মহিলা আলাদা লাইনে সিকিউরিটি চেক-আপের পর ভেতরে ঢুকতে হয়। ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, পানির বোতল, টাকাপয়সা বাদে অন্য জিনিস থাকলে বাইরে লকারে রেখে যেতে হয়। লকারের ভাড়া ২০ রুপী। ভেতরে ঢুকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকালাম সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের নিদর্শন শ্বেতপাথরের এই অনন্য স্থাপনার দিকে। যমুনা নদীর পাড়ে শ্বেতপাথরের শোভা রোদের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠছে। যমুনায় ক্ষীণ জলধারা বয়ে যাচ্ছে, সর্বত্র বিস্তৃত চর ভেসে উঠেছে। মিথিলার আনন্দ অনেক বেশি।
তাজমহল থেকে বের হয়ে গেটের কাছে তাজ রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিলাম তিনজন। পরে গেলাম আগ্রা দুর্গ দেখতে। এই দুর্গে বসেই সম্রাট আকবর, শাহজাহান, বাবর, ইব্রাহিম লোদী রাজ্যশাসন করছেন। দিল্লী রাজধানী হলেও আগ্রাকে দ্বিতীয় রাজধানী রূপে গণ্য করা হতো। এই প্রাসাদ থেকে তাজমহলের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আগা ভ্রমণ শেষ করে সে রাতে ভূপাল শতাব্দী এক্সপ্রেসে ফিরে এলাম দিল্লীতে। এর মধ্যে কবি প্রাণজি বসাক কোলকাতা থেকে ফিরে এসেছেন। পরদিন ৯ই ফেব্রুয়ারি সকালে যোগাযোগ করা হলো Foundation of SAARC Writers and Literature (FOSWAL)-এর প্রেসিডেন্ট সাহিত্যিক অজিত কৌরের সঙ্গে। আমার দিল্লীর আসার খবরে খুশি হলেন, এবং দুপুরে আমাদের সবাইকে তাঁর বাসায় খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। আমরা দাওয়াত গ্রহণ করলাম। যথাসময়ে আমি, আমার স্ত্রী মীনা, কন্যা মিথিলা ও প্রাণজি বসাক চলে গেলাম FOSWAL দপ্তর সিরি ফোর্ট ইনস্টিটিউশনাল এরিয়ায় অজিত কৌরজীর কাছে। আমরা গিয়ে পৌঁছলাম দুপুর দেড়টার দিকে। অনেক সমাদর করলেন অজিতজী, দুপুরে আমরা একসঙ্গে খেলাম। খুব ভালো লাগলো সেখানে যতক্ষণ ছিলাম। আমার সঙ্গে রাখা কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার ও আমার ইংরেজি অনুবাদের দুটি কবিতার বই অজিতজীর হাতে দিলাম। অজিতজী আমাকে পরের মাসে অর্থাৎ মার্চ মাসে অনুষ্ঠেয় সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে যোগদানের অনুরোধসহ আমন্ত্রণ জানালেন।
২০১১ সালের ২৫-২৭শে মার্চ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয় ‘সার্ক ফেস্টিবল অব লিটারেচার’। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষে ১৯৮৫ সালে গঠিত সাত-জাতি রাষ্ট্র সংস্থা সার্ক। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আফগানিস্থান। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় রয়েছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও উন্নত সাহিত্য। সার্কভুক্ত দেশসমূহের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মানবিক সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করার লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় Foundation of SAARC Writers and Literature (FOSWAL)। এই সংগঠন নিয়মিতভাবে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের লেখকদের সম্মেলন আয়োজন করে আসছে। পাঞ্জাবী কথাসাহিত্যিক অজিত কাউর সম্মেলনের প্রধান কান্ডারী। এরারের উৎসবে আমি প্রথমবারের মতো আমন্ত্রিত অতিথি। নয়াদিল্লীর অগাস্ট ক্রান্তি মার্গ-এ স্থাপিত এনসিইউআই অডিটরিয়ামে করা হয়েছে সেই আয়োজন। উৎসবে সম্মানিত অতিথি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের সহধর্মিনী সরদারনি গুরশরণ কৌর। অভ্যাগত অতিথিসহ সবাই সেদিন সকাল ১০-টায় জলভর্তি পাত্রে গোলাপের পাপড়ি ভাসিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হলে FOSWAL-এর প্রেসিডেন্ট কথাসাহিত্যিক অজিত কৌর স্বাগত ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন শিল্পী কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীগণ তাঁদের লেখার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে পারেন একটি সমৃদ্ধ সমাজ, সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও লেখকদের মধ্যে সুভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলার জন্য সাহিত্যসভা, সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে ভাব-বিনিময়ের বিকল্প নেই। এর জন্য সার্ক অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীগণের জন্য যাতায়াত ব্যবস্থা ভিসামুক্ত হওয়া দরকার। আমন্ত্রিত অতিথির ভাষণে সরদারণি গুরুশরণ কৌর বলেন শিল্পী আর কবি-সাহিত্যিকগণ হচ্ছেন সমাজের আয়না, যাঁরা পরস্পরের চিন্তাচেতনা বিনিময় ও তাঁদের লেখনীর মধ্য দিয়ে আধুনিক সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেন।
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে মূলবক্তা হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন করেন জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজার উত্তরপুরুষ লোকসভার সদস্য ড. করণ সিং। সুবক্তা ড. সিং তাঁর জন্য নির্ধারিত ২০ মিনিটের স্থলে ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। বক্তব্যে তিনি সার্ক অঞ্চলের দেশসমূহের মধ্যে সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন বিষয়ে সংযোগ গড়ে তোলার উপর জোর দেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ বক্তা ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী মণিশংকর আয়ার। তাঁর পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যেও উঠে আসে ইতিহাস, সভ্যতা ও উপমহাদেশ। আরো বক্তৃতা দেন শ্রীলঙ্কার মান্যবর রাষ্ট্রদূত মি. প্রসাদ কারিয়াওয়াসাম, জাতিসংঘের তথ্যকেন্দ্রের প্রতিনিধি মিস কিরণ মেহরা-কারপেলমান। মিস মেহরা বলেন, সার্ক অঞ্চলের লেখকদের রচনা সার্ক অঞ্চলের স্কুল-কলেজে পাঠ্য হওয়া উচিত। অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত দেশের কয়েকজন লেখককে সম্মননা প্রদান করা হয়। এরা হলেন ভারতের জগিন্দর পাল, শ্রীলঙ্কার নিহাল রড্রিগো, আফগানিস্তানের পারটো নাদেরি, মালদ্বীপের ইব্রাহিম ওয়াহিদ, পাকিস্তানের সৈয়দ আকতার হোসেন আকবর ও বাংলাদেশের রুবানা হক। আমিসহ উৎসবের বিভিন্ন পর্বে কবিতা ও অন্যান্য সাহিত্যপাঠে অংশ নেন সার্কভুক্ত আমন্ত্রিত কবি-সাহিত্যিকবৃন্দ। সার্ক লিটারেচার ফেস্টিভাল প্রতিবছরই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতিবারই বাংলাদেশ থেকে অনেকে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। গত ১৮ অক্টোবর ২০১৯ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য সম্মেলনে আমরা সর্বশেষ যোগদান করেছিলাম।
বাংলাদেশের দলও বেশ বড় থাকে। কয়েক বছরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন উৎসবে আমি যাঁদের সঙ্গী হয়েছি তাঁরা হলেন- সেলিনা হোসেন, রামেন্দু মজুমদার, মুহম্মদ নূরুল হুদা, নিয়াজ জামান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ফকরুল আলম, আবুল মোমেন, শীলা মোমেন, মাহবুব সাদিক, হাবিবউল্লাহ সিরাজী, ফারুক মাহমুদ, শেখ রবিউল হোসাইন, মাসুদুজ্জামান, ফরিদ আহমদ দুলাল, জরিনা আখতার, বুলবুল মহলানবীশ, মাহমুদ কামাল, মীনা গুহ, ঝর্না রহমান, আবদুস সেলিম, হরষিত বালা, কামরুল ইসলাম, নাসরিন নঈম, গোলাম কিবরিয়া পিনু, রুবানা হক, আনিসুল হক, সন্তোষ ঢালী, মজিদ মাহমুদ, রোকেয়া সুলতানা, তাহমিনা কোরেশী, নাহার ফরিদ খান, নাহার আহমেদ, তপন বাগচী, কামরুল হাসান, কামরুল বাহার আরিফ, নূর কামরুন নাহার, ফরিদুর রহমান, মোবারক হোসেন, এ এম এম. আরিফুল হক, সৈয়দা আইরিন, পার্থ সঞ্জয়, আরিফুল হক, আশরাফ জুয়েল, তুষার কবির, নাহিদা আশরাফি, গিরিশ গৈরিক, ইশরাত তানিয়া, নাহিদ কায়সার, মার্জিয়া লিপি, সালমা বেগ, চানক্য বাড়ৈ, তুষার তালুকদার, জব্বার আল নাঈম, ইকবাল রাশেদীন, খালেদ উদ-দীন, হামিম কামাল, জাকির জাফরান, জুয়াইরিয়া মৌ, হানযালা হান, রাসেল রায়হান, সুলাইমান সুমন, শাফিনূর শাফিন প্রমুখ।
উৎসব শেষ হয় ২৭শে মার্চ। তার আগের দিন ২৬শে মার্চ শনিবার আমাদের অনেককে ‘দিল্লী হাটার্স’-এর পক্ষ থেকে তাদের সাহিত্য-আড্ডায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানায়। ‘দিল্লী হাটার্স’ হচ্ছে দিল্লীতে অবস্থানরত কিংবা বসবাসরত বাংলাভাষী কবিদের আড্ডার কেন্দ্র। এই সাহিত্য-আড্ডা প্রথম শুরু হয় ২০০১ সালে ঘরোয়াভাবে। পরে সাংগঠনিক রূপ দেয়া হয় ‘দিল্লী হাটার্স’ নামে। যেহেতু দিল্লীহাটেই বসছে আড্ডাটি তাই এই নামকরণ। সপ্তাহের প্রতি শনিবার দিল্লী হাটের ‘বিজলী গ্রীল’ নামের একটি রেঁস্তরার সামনে আড্ডাটি বসে। আড্ডা চলে বিকেল থেকে রাত অবধি। আমরা সেদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ থেকে অনেকে আড্ডায় যোগ দিয়েছিলাম যারা মুহম্মদ নূরুল হুদা, ফারুক মাহমুদ, শেখ রবিউল হক, ফরিদ আহমদ দুলাল, ঝর্না রহমান, মজিদ মাহমুদ, কামরুল হাসান, আশরাফ জুয়েল, তুষার কবির ও আমি। দিল্লী হাটার্সের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন প্রাণজি বসাক, রবীন্দ্র গুহ, দীপঙ্কর দত্ত, কৃষ্ণামিত্র ভট্টাচার্য, দিলীপ ফৌজদার, দেবব্রত শংকর, অপর্ণা আচার্য, প্রশান্ত বারিক, পীযূষ বিশ্বাস প্রমুখ। ভারতের বিভিন্ন অংশের কবিরা দিল্লী এলে অনেকেই শনিবারের সেই আড্ডায় যোগ দেন বলে জানা গেলো। দিলীপ ফৌজদারের সম্পাদনায় ‘দিল্লী হাটার্স’ নামে একটি পত্রিকাও তাঁরা বের করেন। ‘দিল্লী হাটার্স-২০১০’ শিরোনামে প্রাণজি বসাকের সম্পাদনায় একটি কবিতাসংকলনও প্রকাশ করা হয়েছে।
জীবনের গল্প তো শেষ হয় না। সারা জীবন বলতে বলতেই সময় কাটে। বন্ধুদের সঙ্গেই এসব গল্প হয় সাধারণত বেশি। মনে পড়ে গেলো ২০১২ সালের আমেরিকা ভ্রমণের কথা। তখন জানুয়ারির শেষভাগ। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। শরীর জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। বরফ পড়ছিল। হোটেল থেকে বরফ পড়ার দৃশ্য দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল সারা নিউইয়র্ক জুড়ে শিমুল তুলা ফেটে পড়েছে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো শহরে! উড়ে উড়ে পড়ছে মাটিতে। বৃষ্টি যেমন মাটিতে সরাসরি পড়ে, বরফ তেমনভাবে পড়ে না। বরফের কণাগুলি অনেক হালকা বলে বাতাসে ভেসে ভেসে নিচে পড়তে থাকে। অন্য রকম সুন্দর দৃশ্য বটে। তবে, বাইরে অসহনীয় ঠান্ডা! তখনও ভালো সময় কেটেছে আমাদের। দেশে ফেরার কদিন আগে বন্ধুবান্ধবদের সাক্ষাৎ প্রত্যাশী হলাম। উঠেছিলাম উডসাইড এভেন্যু এলাকায় ‘কোয়ালিটি ইন’ রেস্ট হাউসে। সন্ধ্যায় ‘কোয়ালিটি ইন’-এ দেখা করতে এলেন আমেরিকা-প্রবাসী কবি হাসান আল আবদুল্লাহ। তিনি আমাকে নিয়ে বের হলেন। কিছুক্ষণ আনন্দময় সময় কাটালাম তাঁর সঙ্গে। রেস্টুরেন্টে এক সঙ্গে খেলাম। আলাপ হলো সাহিত্যের হালচাল নিয়ে। নিউইয়র্ক থেকে ‘শব্দগুচ্ছ’ নামে একটা সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করেন তিনি। মানসম্পন্ন পত্রিকা। দেশের টানে প্রায় প্রতিবছরই বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। বইমেলার লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণে পত্রিকার স্টলও নেন। খুব বন্ধুবৎসল। আমাকে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেলেন। পরদিন সকালে এলেন প্রবাসী সংস্কৃতিকর্মী ও সাংবাদিক হাকিকুল ইসলাম খোকন ও কবি এবিএম সালেহ উদ্দিন। তাঁরা উভয়ে নিউইয়র্কের সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত। আলাপী, সজ্জন। তাঁদের সঙ্গেও কাটালাম কিছু সময়।
আমাদের আগমনের খবর দিলাম নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘ঠিকানা’ পত্রিকার সম্পাদক জনাব ফজলুর রহমানকে। তাঁর শরীর তখন ভালো যাচ্ছিলো না। তবুও আমাদেরকে বাসায় দাওয়াত করলেন। এই পরিবার আমাদের বন্ধু। তাঁদের মেয়ে মুমু আনসারী, আমার মেয়ে ঈষিকা ও উপমা একসঙ্গে লেখালেখি করতো। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের স্নেহধন্য ছিল এরা। খুব উজ্জ্বল মেয়ে মুমু। লেখায়, বক্তৃতায়, আবৃত্তিতে, গানে সবার আগে বেশ নাম করেছে তখন। মুমু আমার ঈষিকার দু’বছরের বড়। এক সময় বাবা-মার সঙ্গে চলে এসেছে আমেরিকায়। একেই আমরা বলি পরিবর্তন। আমার ঈষিকাও এখন যুক্তরাজ্য প্রবাসী, আর উপমা তো আমেরিকাতেই। কবি এবিএম সালেহ উদ্দিন এসে আমাদেরকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাসায়। আমি আর আমার ছোটমেয়ে মিথিলা। মিথিলার ডাকনামও মুমু। দুই মুমু বয়সের বড় ব্যবধান সত্ত্বেও একত্রে বসে অনেকক্ষণ গল্প করেছে। আমেরিকার মুমু, অর্থাৎ মুমু আনসারী এখন বড় হয়েছে। সংসার হয়েছে। চাকুরি করে। তার দুই ছেলে অরিত্র ও আদিত্য আমাদের আনন্দের অংশী ছিলো। অরিত্র কবিতা আবৃত্তি করে শোনালো, ছবি এঁকে দেখালো আমাদেরকে। মুমু তার দুই সন্তানকে নিজের মতো করেই গড়ে তুলছে দেখে ভালো লাগলো। তারা আমাদেরকে পেয়ে স্মৃতি রোমন্থন করলো অনেকক্ষণ। মুমু আনসারীর মা, মিসেস হোসনে আরা বেগম এক সময় ঢাকার নটরডেম কলেজে অধ্যাপনা করতেন। সম্ভ্রান্ত মহিলা। আমাদের জানালেন নিউইয়র্ক ও আমেরিকার সর্বত্র তাঁর ছাত্রছাত্রী, তা তাঁকে আনন্দ দেয়। এই তো শিক্ষকের পাওয়া!
এই পরিবারটি চার জেনারেশনের সদস্য মিলে এখানে একত্রে বাস করছে ফজলুর রহমান সাহেবের মা, তাঁরা দুজন, তাদের কন্যা মুমু ও তার সন্তান। এখন প্রায় ২২/২৩ বছর ধরে আছেন আমেরিকায়। এখন থিতু হয়েছে। বলেছিলেন বাড়ি যান সুযোগ পেলেই। ভাবীও এখন একটি ল ফার্মে কাজ করেন। ইমিগ্রেশন-সংক্রান্ত কাজ তাঁর। গল্পে-গল্পে জানা গিয়েছিলো বাংলাদেশের নাগরিকদের বিয়ে-বিচ্ছেদের বিষয়টি বেশি। আমেরিকায় ইমিগ্রেশন বেশ কড়াকড়ি। তবুও কারো চাইতে কারো বুদ্ধি কম নয়। তখন যে-গল্প শুনে এসেছি, তা সবসময় চলতে পারে! আমেরিকার ইমিগ্রান্ট হওয়ার একটা উপায় নাকি কোনও আমেরিকান সিটিজেনকে বিয়ে করা। এইসব মতলবি-বিয়ে ভেঙে যেতে আর কতক্ষণ! এ সংখ্যা বেশি না-হলেও বিয়ে-বিচ্ছেদের ঘটনা নাকি বেশ ঘটে। মতলবি-বিয়ের বিষয় কেউ প্রকাশ করে না, তবে তা তাদের কার্যকলাপে বোঝা যায়। এই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়ার নয় যে কেউ আমেরিকার ইমিগ্রান্ট হওয়ার জন্য বিয়ে-চুক্তি করলো, কাজ শেষ হওয়ার পর যার-যার মতো। সেই চুক্তির পরিসমাপ্তির জন্যও ল ফার্মে যেতে হয়ে! ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা এসব আঁচ করতে পেরে নাকি স্বামী-স্ত্রীর আলাদা-আলাদা ইন্টারভিউ নেন। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অনেক সময় হালকা-রসাত্মক প্রশ্নও করা হয় তাদেরকে। মানুষ জীবিকার জন্য, বাঁচার জন্য কী না করে!
এ রকম বিয়ে-চুক্তির গল্প ১৯৮৭ সালে আমি যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডে পড়াকালীন সময়েও একবার শুনেছি। গল্পের মতো শোনালেও তা ছিল সত্যি ঘটনা। আমি এক বাঙালির রেস্টুরেন্টে খেতে যেতাম মাঝে মাঝে। নাম ছিলো হিমালয় রেস্টুরেন্ট। সেখানে যারা কাজ করত তাদের একজন বাংলাদেশ থেকে এসে অবৈধভাবে থেকে গেছে বছর তিন/চারেক আগে। বাংলাদেশে তার নববিবাহিতা স্ত্রী আছে। শত চেষ্টায়ও স্ত্রীকে নিয়ে আসতে পারেনি। আর বৈধ কাগজ না-থাকাতে দেশেও যেতে পারছে না। একই রেস্টুরেন্টের আরেক কর্মচারী দেশে যাচ্ছে ছুটিতে। ঠিক করল তাকে দিয়েই সে তার স্ত্রীকে নিয়ে আসবে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ! বাংলাদেশ থেকে সব কাগুজে-আয়োজন সম্পন্ন করে সহকর্মীর স্ত্রীকে নিজের স্ত্রী বানিয়ে শেষ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড নিয়ে এলো। কিন্তু শেষে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে! বাংলাদেশে এসে নিজের স্ত্রী সাজাতে গিয়ে তারা ঘনিষ্ঠ হয়েছে, এখানে ওখানে যেতে হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করতে হয়েছে, একত্রে থেকেছে। স্কটল্যান্ডে আসার পর সেই স্ত্রী আর তার আসল স্বামীর কাছে যেতে চায় না। থাকতে চায় বানানো স্বামীর সঙ্গে। শেষপর্যন্ত কাগুজে-স্বামীই হয়ে গেলো আসল স্বামী। কাগুজে স্বামীরও এমন মহব্বত জমে যায় যে, সেও তাকে রাখতে রাজি। আসল স্বামীটা আক্ষেপ করে বলেছিলো ফাটা কপাইল্যা হইছি যখন, কী আর করবো! বন্ধুরে বিশ্বাস কইরা সবই হারাইলাম! আমেরিকায় এমন ঘটনার অভিজ্ঞতা না হলেও বিয়ে-বিচ্ছেদ ঘটে নাকি প্রায়শই।
বেশ আনন্দে কাটালাম পুরো সন্ধ্যা মুমু আনসারীদের সঙ্গে। রাতে ভোজের ব্যবস্থা হলো। ফিরে যাবার সময় উপহারও দিলেন আমাদেরকে। বাঙালি আতিথেয়তা বলে কথা! এই মহা আনন্দ-আয়োজন সমাপ্ত করে ফিরে গেলাম হোটেলে। কবি এবিএম সালেহ উদ্দিন আমাদের পৌঁছিয়ে দিলেন হোটেলে। দিনটি ছিলো ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ ২০১২ সাল। বরফ পড়েছে সেদিনও, তবে তুলনামূলকভাবে কম। বরফ পড়ার দৃশ্য খুব মজার হয়, উপভোগ্য হয়। মনে হয় কোনও যাদুকর তার অদৃশ্য থলি থেকে ফুঁ দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে রাশি-রাশি বরফের তুলো। তবু কোথাও কোনও কাজ থেমে থাকে না।
পরের দিনের পরিকল্পনা করলাম। বিকেলে প্রবাসী-কবি শামস আল মমীন আমাকে নিয়ে যাবেন বাংলা ভাষার খ্যাতিমান কবি শহীদ কাদরীর বাসায়। শহীদ কাদরীও ১৯৭৭ সাল থেকে প্রবাসে। তিনি বেশ অসুস্থ দীর্ঘদিন। জানলাম সপ্তাহে ৩ দিন ডায়ালাসিস করতে হয়। আমরা যখন বাসায় পৌঁছই তখন বিকেল। সূর্যের স্পষ্ট আলো বাইরে না থাকলেও ঘোলাটে আভা বিছিয়ে আছে নিউইয়র্ক জুড়ে। ভাবী অর্থাৎ মিসেস কাদরী আমাদের স্বাগত জানালেন। শহীদ ভাই শুয়ে ছিলেন সোফায়। উঠে আমাদের স্বাগত জানিয়ে বসলেন। গল্প হলো ঘণ্টাখানেক। দেশের গল্প, কবিতার গল্প। সাহিত্যের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মনখোলা আলাপ। আমার সঙ্গে সেই শেষ আলাপ। তিনি যখন ১৯৭৭ সালে বিদেশমুখী হলেন, তখন আমি সবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ঢাকা এসেছি। আমরা যখন তাঁর বাসা থেকে বের হয়ে আসি তখন ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজে।
নিউইয়র্কের ‘সাহিত্য একাডেমি’ আমাকে ঘিরে আড্ডার আয়োজন করেছে ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ সাল। সেখানে অপেক্ষা করছিলো প্রবাসী কবি-সাহিত্যিক বন্ধুরা। সফররত কবি হিসেবে আমাকে সম্মানিত করা হলো। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করলেন সাহিত্য একাডেমির উদ্যোক্তা জনাব মোশাররফ হোসেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে সেই সময়ে মৃত্যুবরণকারী সাহিত্যিক কবীর চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক রশীদ করিম, নিহত সাংবাদিক মেহেরুন রুনী ও সাগর সারোয়ারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হলো। সুন্দর অনুষ্ঠান হলো। আমার কবিতা, আমেরিকার বাংলা সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। বেশ জমজমাট আয়োজন। প্রবাসী কবিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শামস আল মমীন, তমিজ উদদীন লোদী, ফকির ইলিয়াস, এবিএম সালেহ উদ্দিন, মনজুর কাদের, আমিনুর রশিদ পিন্টু, জুলি রহমান, ফারুক আজম, গল্পকার মুহম্মদ মনসুর আলী, সাংবাদিক হাকিকুল ইসলাম খোকন, শিল্পী মনিজা রায় প্রমুখ। আমার সঙ্গে ছিল আমার ছোট মেয়ে মিথিলা। অনুষ্ঠান আমাকে ঘিরেই চলে। আমিও কবিতা প্রসঙ্গে কথা বললাম, কবিতা পড়লাম। স্মৃতি সতত আনন্দের। কোনও কোনও আনন্দ অন্তরে কুয়াশার ফুলকি ছড়াতে থাকে সব সময়। কোথা থেকে পেছনে টেনে নিয়ে এলো কোথায়!
২০১৬ সালের ১৪ই আগস্ট আমেরিকার নেভাদা রাজ্যের প্রমোদ-নগরী লাস ভেগাসের কথা মনে পড়লো। তখন সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্তে। তার বিকিরণ এসে পড়েছে ভবনগাত্রে ও আমাদের মুখমন্ডলে। মীনাকে বললাম কনে দেখা আলোয় তোমাকে অসাধারণ লাগছে। বয়সই কমিয়ে দিয়েছে সূর্যাস্তের রক্তিমরেখা। আবার শুরু করলাম পদব্রজে নগরভ্রমণ। একটু এগিয়ে গেলাম ‘দি ভেনেসিয়ান রিসর্ট’-এ। এটিও বিশাল স্থাপনা। অপরূপ স্থাপত্যশৈলী। বিশতলা হোটেলের নিচতলায় ক্যাসিনোর মহাযজ্ঞ বিলাসী মানুষের ফুর্তিকেন্দ্র। উপরে হোটেল অর্থাৎ থাকার ব্যবস্থা, আর নিচে সারা বেসমেন্ট-জুড়ে কৃত্রিম লেক। নৌ-ভ্রমণের সব ব্যবস্থা আছে। ভবনের স্থাপত্য-পিলার ঘুরে ঘুরে বেড়ানো। আমরাও উঠলাম একটা বোটে। চালাতে হচ্ছে বৈঠা দিয়ে। আমি তো গ্রামের পোলা, খালেবিলে বর্ষায় দাঁড় টেনে ঘুরে-বেড়ানো ছেলে। অন্যরা হিমসিম খাচ্ছে এদিক-ওদিক এলোমেলোভাবে যাচ্ছে। আর আমি কী দিব্যি দাঁড় বেয়ে ঘুরে এলাম সহজে। মীনা অবাক!
বলে তুমি এতো সুন্দরভাবে পারলে কী করে?
আমি বলি আমি তো গ্রামের ছেলে। বর্ষাকালে নৌকো নিয়ে দল বেঁধে কত ঘুরে বেড়িয়েছি! ডোবা থেকে শাপলা-শালুক তুলেছি। নৌকা-বাইচ খেলেছি!
তুমি তো বলতে, তোমরা গ্রামের জমিদার। নৌকো বাইতে গেলে কীভাবে? লোক পারাপার করতে না কি?
আরে! বিয়ের সময় রাজা, জমিদার এসব অনেক কথাই তো বলতে হয়। একটা বয়সে মানুষ কখনও রাজপুত্র হয়, কখনও উজির-নাজিরের সন্তান হয় এ রকম কত কী!
এ প্রসঙ্গে আরেকটা গল্প মনে পড়ে গেলো। ১৯৮১/৮২ সালের ঘটনা। আমরা দুইবন্ধু প্রায়শ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোশারফ হোসেনের বাসায় যেতাম। স্যারের (ফিনল্যান্ডের) বিদেশিনী স্ত্রী অধ্যাপক ইনারী হোসেন। এদেশে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। ভালো বাংলা বলতেন। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলোতে। আমার বন্ধুর জন্য পাত্রী ঠিক করার কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি এক পাত্রীর কথা বললেন। তাঁদের এক বন্ধুর মেয়ে। আমার বন্ধুটার ভাবখানাও আমার মতোই, যেন জমিদারনন্দন! বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলেন মেয়েটা দেখতে সুন্দর তো, আন্টি? আন্টি তখন বললেন, অবশ্যই সুন্দর। শোন। আমার মা বলতেন, বিয়ের বয়সে সব মেয়েই সুন্দরী হয়! বয়সেরও তো একটা মাধুর্য থাকে। তা তাকে সুন্দরী করে তোলে। তোমাকে ওসব চিন্তা করতে হবে না। সব ঠিক আছে। মেয়েটা দেখতে শ্যামলা, কিন্তু সব দিক থেকে অসাধারণ। তুমি সম্মত হলে আমি বিয়ের ব্যবস্থা করবো। ওই দিন আর কথা হলো না। বন্ধুটিও আর অগ্রসর হয়নি। কিন্তু, বিয়ের-বয়স প্রসঙ্গে আন্টি যে অভিজ্ঞ-উক্তিটি করেছিলেন, তা সর্বকালীন।
২০১৬ সালের ১৯শে আগস্ট গিয়েছিলাম অ্যারিজোনা স্টেট ভ্রমণে প্রকৃতির রহস্যভরা ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ দেখতে। আমরা গেলাম এর পশ্চিম পাশে, অর্থাৎ ওয়েস্ট রিম। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন হলো শত-শত মাইল বিস্তৃত আশ্চর্য গিরিখাত। এর বিস্তৃতি ৩০০ মাইলের মতো, পাশও কয়েক মাইল হবে। গভীরতা কম-বেশি এক মাইল। প্রকৃতির কী খেয়াল! এটিকে পৃথিবীর সপ্তম প্রাকৃতিক-আশ্চর্যের সেরা বলে গণ্য করা হয়। প্রাকৃতিক এই সপ্তম আশ্চর্যের একটি হলো এশিয়ায়। নেপালের হিমালয় পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট। বাকি ৫টি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। প্রকৃতির এই খেয়ালি-সৌন্দর্য দেখার জন্য বাসের টিকেট কেটেছি আগেই। আমাদের যাত্রা লাস ভেগাস থেকে। আমরা উঠেছিলাম হোটেল হিলটনে। আমি আর মীনা আগেভাগেই হোটেলের নিচে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। সকাল ৭টা বাজার ৫মিনিট আগে বাস এসে দাঁড়ালো। উঠে বসতে যা সময়। ঠিক সময়ে ছেড়ে দিলো বাস। আমি সবসময় সামনের সিটে বসার যাত্রী। দূরের পথে অনেকে হিসেব করেই সামনের সিটে বসে না, বসে মাঝের সিটে। এতে দুর্ঘটনা হলে নাকি বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আমি সামনে বসে সবকিছু মনভরে দেখেই মরতে প্রস্তুত।
লাস ভেগাস থেকে গ্রেট বেসিন হাইওয়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাস। মাত্র ২০/২৫ মিনিট যেতেই সামনে পড়লো বিখ্যাত ‘হুভার বাঁধ’ এলাকা। এটি একটি বড় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। কলোরাডো নদীর উপর স্থাপিত। এই নদী নেভাদা ও অ্যারিজোনা স্টেটকে ভাগ করেছে। লাস ভেগাস উপসাগরের পানি এই নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে। এই বাঁধ পরিদর্শনের জন্য সেখানে বিরতি দেয়া হলো ৩০ মিনিটের। আমরা সংরক্ষিত এলাকায় বাঁধ নির্মাণের বিবরণ দেখে এগিয়ে গেলাম সেতুর উপর দিয়ে। মূল সেতুর এক পাশে দর্শনার্থীদের হাঁটার সরু রাস্তা করা হয়েছে। আমরা রেলিং ধরে ব্রিজের সরু পথে দাঁড়িয়ে আছি। নিচে পানির লেভেল থেকে আমরা ৭২৬ ফুট উপরে দাঁড়িয়েছি। তবু মুগ্ধচোখে তাকানো যায়।
আবার যাত্রা শুরু হলো। পৌঁছে গেলাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এলাকায়। বাস থেকে নেমে কিছুক্ষণ মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ালাম আমি আর মীনা। ঈগল পয়েন্টে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির মহাভাস্কর্য মনভরে দেখলাম! ছবি তুললাম। গিরিখাতের কিনারে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই রূপের বিষয় ভাবছি, আর অবাক হচ্ছি। এসব কি ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হলো এতো বিশাল এলাকা, এতো বিশাল খাদ? আমাদের শিল্পীরা ছবি আঁকেন, ভাস্কর্য নির্মাণ করেন আর প্রকৃতিই বানিয়ে রেখেছে এই মহাভাস্কর্য! মানুষের বুদ্ধি বিকাশের, চেতনা বিকাশের আর রূপকল্প নির্মাণের প্রকৃতি-প্রদত্ত বিস্ময় তো চোখের সামনেই। প্রকৃতির রূপ একজীবনে দেখে শেষ করা যাবে না।
আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছি ঘরের ছেলে ঘরে। ‘চান্দ্রমাস’-এর বর্ষপূর্তি উৎসবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হলো আমাকে। সম্পাদক কবি গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণ ফেলতে পারিনি, একদিনের জন্য হলেও আমাকে যেতে হলো। ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। চান্দ্রমাস-এর ৪০বর্ষপূর্তি উৎসব। এটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাহিত্যপত্রিকা। অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো কলকাতা বাংলা আকাদেমির সভাঘরে। প্রধান অতিথি ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। অতিথি ছিলেন পবিত্র সরকার, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামলকান্তি দাশ, শংকর চক্রবর্তী, কমল চক্রবর্তী, তুষার রায় প্রমুখ। উৎসবের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন চান্দ্রমাস পত্রিকার সম্পাদক গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়। বক্তাগণ সাহিত্যপত্রিকার নানাদিক নিয়ে আলোচনা করলেন। বিশেষ করে ‘চান্দ্রমাস’ পত্রিকার শুরুর গল্প শোনান সম্পাদক নিজে, এবং শ্যামলকান্তি দাশ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে শঙ্খ ঘোষ সাহিত্যে লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা তুলে ধরে ধারাবাহিক ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করেন। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আমিও বক্তব্য রাখলাম। এর পরে বাংলা একাডেমি চত্বরে জমে ওঠে বন্ধুকবিদের আরেক আড্ডা। সে-আড্ডায় ছিলাম মৃণাল বসুচৌধুরী, শ্যামলকান্তি দাশ, কমল চক্রবর্তী, গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, শংকর চক্রবর্তী, আবদুস শুকুর খান, আমি ও আরও কয়েকজন। আড্ডা জমিয়ে রেখেছিলেন কমল চক্রবর্তী ও শ্যামলকান্তি দাশ। এসব আড্ডারও অনেক প্রয়োজনীয় দিক থাকে, চিন্তার বিকাশে যা সহায়ক।
এত সবের মধ্যে মানুষের পিছু পিছু থাকে নানা বিপদ-আপদ। এর থেকে উত্তরণের চেষ্টা চোখ বুঝে অসহায়ত্ব দেখানো নয়, চোখ খুলে নির্ভয়ে তাকে জয় করার জন্য উদ্যোগী হওয়া। এই তো সেদিন ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর চীনের হুবাই প্রদেশের উহান শহরে করোনা-নামক এক ভাইরাসের প্রথম হদিস হয়! এর প্রভাব যে কী-রূপ নিতে পারে, তা কল্পনারও বাইরে ছিল। আমরা যখন এই ভয়াবহ সংবাদ প্রথম শুনি, তখন আঁতকে উঠেছিলাম। তা যে একসময় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, এবং বাংলাদেশও তার ছোবল থেকে রক্ষা পাবে না, তা তখন বুঝে উঠতে পারিনি। ২০২০ সালের ১১ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নাম দেয় ‘কোভিড-১৯’। করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯-এর সংক্ষিপ্ত রূপ এটি। বিশ্ব সংস্থা একইদিন এটাকে অতিমারি (প্যন্ডেমিক) বলেও ঘোষণা করে। সেদিনই পৃথিবীর ইতিহাসে বর্তমান শতাব্দীর এই বড় বিপর্যয় বুঝতে পারে মানুষ। আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই করোনায় আক্রান্ত হই, এবং কোনওমতে তা থেকে প্রথম যাত্রায় উদ্ধার পাই। কিন্তু আমার সহোদর ছোটভাই নির্মল আর করোনাকে জয় করে উঠতে পারেনি। করোনা নিয়ে গেছে সমাজের অনেক গুণী মানুষকে। এর মধ্যে রয়েছেন দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ আনিসুজ্জামান, আশরাফ সিদ্দিকী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কামাল লোহানী, জামিলুর রেজা চৌধুরী, আজাদ রহমান, এমাজউদ্দীন আহমদ, মেজর জেনারেল সি আর দত্ত, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী, মুর্তজা বশীর, রাহাত খান, মনজুরে মওলা, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, আলী যাকের, রাবেয়া খাতুন, আহমদ কবির, রশীদ হায়দার, আবুল হাসনাত (মাহমুদ আল জামান), ভূঁইয়া ইকবাল, জাফর আলম, মাশুক চৌধুরী, নাসের মাহমুদ, আহমেদ খালেদ কায়সার, মকবুলা মন্জুর, ফকির আলমগীর, কাশীনাথ রায়, নুরুল করিম নাসিম, এন্ড্রু কিশোর, আলম তালুকদারসহ অনেকে। একই সঙ্গে মনে পড়ছে ভারতের খ্যাতিমান কয়েকজনের নাম- প্রণব মুখার্জি (প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট), শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, দেবেশ রায়, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্য, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অমলা শংকর প্রমুখ। এরকম আমরা পৃথিবীর বহু খ্যাতিমান ব্যক্তিকে হারিয়েছি। পৃথিবীর মানুষ একদিন করোনা-অতিমারীকে জয় করবে, সেদিন আগের পৃথিবী কি ফিরে পাবে মানুষ? হয়তো নতুন পৃথিবীতে, নতুন পরিবেশে বাস করবে তারা। তবু জয়ী হতে হবে আধুনিক বিজ্ঞানের অভিযাত্রী এই মানুষকে। মানুষকে বাঁচতে হবে প্রকৃত সংবেদনশীল মানুষ হয়ে। তাকে জানতে হবে পরিবেশ, সমাজ, মানুষ ও মানুষের জীবনকে। মানুষ হবে বিজ্ঞান-মনস্ক, একই সঙ্গে সংবেদী।
আমার জন্য ২০২২ সাল আনন্দ ও বেদনামিশ্রিত আর-একটি বছর। আনন্দ এজন্য যে, প্রতিষেধক-টিকা আবিস্কার হওয়ায় বিশ্বে করোনার প্রকোপ কমে এসেছে। করোনার কারণে দেরিতে হলেও আমাদের একুশের বইমেলা মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেলায় আমার তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর ‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব’ আমাকে ‘দ্বিতীয় বৃত্তে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘রাইটার্স ক্লাব সাহিত্য পুরস্কার ২০২০’ প্রদান করেছে। এটা আমার জন্য ভালো সংবাদ। আরও ভালো সংবাদ হলো এ বছরই আমি ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২১’ লাভ করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনলাইন উপস্থিতিতে ১৫ই ফেব্রুয়ারি তাঁর পক্ষে পুরস্কার তুলে দেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, এমপি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাসহ সমাজের মান্যব্যক্তিবর্গ।
একই সঙ্গে বেদনার হলো এই যে, বিশ্বরাজনীতি হঠাৎ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে টন-টন বোমা ফেলে বিপর্যস্ত করে তুলেছে ইউক্রেনের জনজীবন। দেশটি পরিণত হয়েছে ওয়েস্টল্যান্ডে। উভয় দেশের অন্তর্কলহ, ভূ-রাজনীতি, বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রণক্ষমতার দ্বন্দ্ব যুদ্ধের মূল কারণ বলে ধারণা করা যায়। ইউক্রেন ন্যাটোমুখী, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী এটা রাশিয়ার জন্য হুমকি মনে করেছে রাশিয়া। উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে কি বিরোধ মিটানো অসম্ভব? স্বার্থ যখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, নীতিবোধ তখন আর কাজ করে না! পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের প্রতি মানবিক আচরণ না করলে একদিন বিশ্বের জন্য তা বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে! বড় বিচিত্র মানুষের মন; বড় বিচিত্র জীবন মানুষের!