জয়তী রায়
ছেলেটা তার্কিক। জেদী। স্বপ্ন দেখে। প্রবীণরা নাক কুঁচকে বলে–
গৌড়েশ্বর বললেই তোমায় রামায়ণ লিখতে হবে? এ কি ছেলের হাতের মোয়া?
কথা সত্যি। বাল্মীকি রামায়ণ। কাব্য ছন্দ ভাষা অলঙ্কারের মহাসাগর। তাকে নতুন করে লেখা? তাও কি না, বাংলা ভাষায়? কেউ শুনেছে কখনো!
কেউ যা শোনে নি, জিদ্দি লোক তাই ই করবে। দেবভাষা থেকে বাংলা ভাষার মত অ – কুলীন, অ – ব্রাহ্মণ, ভাষায় রামায়ণ?
নানারকম টেরা বেঁকা মন্তব্য ধেয়ে আসতে লাগল চারিদিক থেকে। কান দিল না ফুলিয়া গ্রামের ছেলে, পণ্ডিত কৃত্তিবাস ওঝা।
মূল রামায়ণ কঠিন অনুষ্টুপ ছন্দে লেখা। কৃত্তিবাস নিয়ে এলেন পয়ার ছন্দ। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ছন্দের তিনটি প্রধান ধারা। ধামালি লাচাড়ি ও পয়ার। ১৪ মাত্রা বিশিষ্ট ছন্দ বদ্ধ বলে, পয়ার ছন্দ বেশ জনপ্রিয় ছিল। মুখে মুখে পাঠের জন্য এটি ছিল সহজ। সেই সঙ্গে চরিত্রগুলি একেবারে আমাদের পরিবার থেকে উঠে এসেছে।
বাল্মীকি রামায়ণ থেকে অনেকটা সরে এলো বাংলার জেদী কবি। নতুন নতুন আখ্যান জুড়ে লিখে ফেললেন রামায়ণ পাঁচালী।
স্বপ্ন দেখতে হয়। প্রথমে যা অলীক মনে হয়, যোগ্যতা আর পরিশ্রম থাকলে …তাই ই একদিন সত্য হয়ে ওঠে।
********
দুঃসাহসী কবি, কৃত্তিবাস ওঝা (জন্ম আনুমানিক ১৩৮১ খ্রিষ্টাব্দ —মৃত্যু আনুমানিক ১৪৬১ খ্রিষ্টাব্দ)। দুঃসাহসী কবি কেন? কারণ, বাল্মীকি রামায়ণ ভাবানুবাদ করে, বাঙ্গালীর ঘরের আঙিনায় পৌঁছে দেওয়া, সেই সময়ের নিরিখে দুঃসাহসী কাজ ছিল।
কেমন করে হল এমন অসম্ভব কাজ?
কৃত্তিবাস মুখোপাধ্যায়। ফুলিয়া গাঁয়ের ছেলে হলেও, তিনি বরাবর অন্যরকম। ডাকাবুকো। গতানুগতিক কিছু তাঁকে মোটেই আকর্ষণ করে না। সেজন্য, বারোবছর বয়সে বাড়ি ছাড়েন। গঙ্গানদীর অপর পাড়ে এক পন্ডিতের কাছে সোজা চলে যান বিদ্যে শিক্ষে করবেন এমত অভিপ্রায়ে। পিতা বনমালী আর মাতা মালিনীর ছয়পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তান কৃত্তিবাস। পরিবারের সবার থেকে আলাদা। সবসময় চ্যালেঞ্জ –নতুন কিছু করব। নতুন ধারণার জন্ম দেব।
গ্রামের লোক তাচ্ছিল্য করে বলে — কি করবি রে বাপু! দীন দরিদ্রের ছেলে তুই। কবিতা লেখার শখ চাপে কেন?
আত্মীয় স্বজন শঙ্কিত। কষ্মিনকালে কেউ শুনেছে? গঙ্গানদী পার করে চলে যায় বিদ্যে শিখতে?
********
তারপর? শেখা শেষ হল তো, চলল গৌড়েশ্বর রাজাকে শ্লোক শোনাতে! বলে কি না রাজসভায় সভা কবি হব! কবিতা লিখে ধনী হবে। এক ডাকে লোক চিনবে। এমন কথা কেউ শুনেছ কখনো?
কবিতা লিখে ধনী হব! সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জ। সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মবিশ্বাসী যুবক কবিতা লিখে ধনী হবার স্বপ্নে মশগুল।
সেটাই হল বটে। গৌড়ের দরবারে অপেক্ষা করতে করতে দিন গড়িয়ে গেলেও হতাশ হল না। শেষপর্যন্ত তাঁর রচিত সাতটি কবিতা শুনে রাজা বললেন —- শোনো হে কৃত্তিবাস। সংস্কৃতে লেখা রামায়ণ। মহাকবি বাল্মীকি যার রচয়িতা। তুমি এর বাংলা অনুবাদ করো।
রাজ আদেশ শুনে ভিতরে ভিতরে একটু অস্থির। জীবনের প্রথম কাজটিই দূরূহ। আপামর ভারতবাসীর প্রিয়গ্রন্থ। পণ্ডিতের গবেষণার গ্রন্থ…সেই রামায়ণ অনুবাদ করা? সে ও কি না বাংলা ভাষায়?
কিন্তু হেরে যাবার পাত্র তিনি নন। নিজে খুব ভালো জানেন সংস্কৃত ভাষা। আর সেজন্যেই জানেন, দেবভাষা থেকে সাধারণ চলিত ভাষায় অনুবাদ করার বিপদ অনেক।
তার উপরে রামায়ণের মত বহুল প্রচারিত, জনপ্রিয় কাহিনীকে রূপান্তরিত করা আরো কঠিন।
বঙ্গের অলঙ্কার
চুপ করে বসে আছেন কৃত্তিবাস। সামনে যত্ন করে রাখা বাল্মীকি রামায়ণ। পাশে দোয়াত কলম। কুলীনভাষা আর্যভাষা। প্রাকৃত বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা খুব শক্ত কাজ। রামায়ণ মহাভারত এগুলো শুধু সংস্কৃত বা দেব ভাষার সম্পদ। বাংলা ভাষার মত অকুলীন অব্রাহ্মণ অনার্য ভাষায় এগুলোর চর্চা করা …! কপাল কুঁচকে রইল রাতভর।
পূব আকাশে উদয় হল সূর্যদেব। কৃত্তিবাস তখনো বসে আছেন। সটান। রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি অনুভব করছেন না আর। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বাংলাদেশ। তাঁর জন্মভূমি ফুলিয়া। গ্রামের পথে সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ। ভেসে উঠছে বাঙ্গালী যৌথ পরিবার। বাঙালি জীবনের পাঁচালী। জীবনের অন্ধকার দিকে দিশা দিচ্ছেন এক যুগপুরুষ। শ্যামল মুখে মিষ্টি হাসি। হাতে ধনুকবান। চোখে প্রেম।। কৃত্তিবাস তুলে নিলেন কলম।
লিখলেন: শ্রীরামপাঁচালী।
বিদ্বান সমাজকে ফুৎকারে ভাসিয়ে দিয়ে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করল কৃত্তিবাসী রামায়ণ। ১৪ শ –১৫ শ শতাব্দী কাল সময়ে রচিত এই কাব্য, বাংলার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ল। মহাকবি বাল্মীকি রচিত রামায়ণ, শুধু যে সংস্কৃত ভাষাগত কারণেই মানুষের কাছে দুর্বোধ্য তা নয়, তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল এর ছন্দ। অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত মহাকাব্য। ওজস্বী রূপ এই কাব্যের সম্পদ। কৃত্তিবাস প্রথমেই দুটি জিনিস ভাবলেন। এক.ছন্দ হবে সুললিত। ভাষা হবে সরল। সহজ। আর তিনি কখনোই আক্ষরিক অনুবাদক হবেন না। দায়িত্ব পেয়েছিলেন অনুবাদকের। হয়ে উঠলেন মৌলিক রচনাকার।
সূচনাতেই বিপ্লব ঘটালেন। কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালী শুরু হল এক অদ্ভুত ঘটনার মধ্যে দিয়ে। যে ঘটনা মহাকবি বাল্মীকির জীবনে কখনো ঘটেইনি!
মহর্ষি বাল্মীকির নবরূপ দেখলাম আমরা। দস্যুরত্নাকর। মরা মরা শব্দ থেকে রাম রাম! আপামর জনতা স্তব্ধ। কিন্তু দস্যু রত্নাকর আর পাপমুক্তির জন্য তাঁর হাহাকার … চোখ ভিজে ওঠে পাঠকের।
: মানুষ মারিয়া আনি যত ধন আমি/
আমার পাপের ভাগী বট কি না তুমি।।
একবার ভাবা যাক পংক্তিদুটির ভিতরের অর্থ। অর্থাৎ, অন্যায় করে প্রধান অজুহাত হয়… যা করেছি পরিবারের জন্য। রত্নাকরের পরিবার অস্বীকার করল মানুষ খুনের দায়ভাগ নিতে। অন্তর চক্ষু উন্মোচন হল। তাহলে? আপন কেউ হয় না? একমাত্র সেই পরমব্রহ্ম ছাড়া?
একমুহূর্তে ত্যাগ করলেন নিজের পরিবার। সম্পদ। চলে এলেন অরণ্যে। শুরু হল নিজেকে খোঁজার সাধনা। জন্ম নিলেন মহর্ষি বাল্মীকি।
দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি রূপান্তরিত হলেন রাম নাম করে। দুঃসাহসী পদক্ষেপ নয়? কৃত্তিবাস আর অনুবাদক রইলেন না। তাঁর কলম এগিয়ে চলল নতুন সৃষ্টির দিকে।
******
বদল ঘটালেন নায়ক চরিত্রে। রামচন্দ্র। যিনি একজন আদর্শ পুত্র। পিতা মাতা যাঁর কাছে জীবন্ত দেবতা। এমন আবেগ বাল্মীকি রামায়ণে কোথাও নেই। তাতে কি! পন্ডিত সমাজ রে রে করে উঠল। বয়েই গেল! কৃত্তিবাস অটল। তার সৃষ্ট রাম — আর্যসমাজের প্রতিভূ রাজপুত্র যোদ্ধা রাম নন। সকল দুঃখহারী, পরিবারের বড় ছেলে। কর্তব্যপরায়ণ, প্রজাপালক শ্রীরামচন্দ্র।
******
বাল্মীকি থেকে কিছু আখ্যান নিলেও, কৃত্তিবাস প্রভাবিত হলেন না মোটেই। অনেক আখ্যান উপাখ্যান নিজে নিজে যুক্ত করলেন। সম্পূর্ণ নিজের কল্পনায়। যেমন, শরৎকালে দুর্গাপূজা। পদ্মের অভাবে, রামের চক্ষুদান। সীতা কতৃক রাবণের চিত্র অঙ্কন। রামের রাবণের কাছে নীতিশিক্ষা লাভ করা — মূল রামায়ণে নেই। কৃত্তিবাস নিজের কল্পনায় সৃষ্ট করেছেন নতুন আখ্যান। এইভাবে নিজের ভাবনাকে ঢুকিয়ে দেওয়া কম সাহসের পরিচয় নয়। কালক্রমে এই আখ্যানগুলি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
******
শুধু নতুন নতুন গল্প সংযোজন করে ক্ষান্ত হলেন না, বাংলার তরুণ তুর্কি। দুঃসাহসী কৃত্তিবাস, পরিবর্তন আনলেন ছন্দে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ছন্দের তিনটি প্রধান ধারা ছিল। ধামালি লাচাড়ি ও পয়ার। পয়ার ব্যবহার করা হত কাব্য বা পুঁথি রচনার ক্ষেত্রে। পা বা পদের অর্ধ তৎসম শব্দ হল পয়া। ১৪ মাত্রা বিশিষ্ট ছন্দ বদ্ধ বলে পয়ার ছন্দ বেশ জনপ্রিয় ছিল। মুখে মুখে পাঠের জন্য ছিল এটি খুব সহজ। যেমন :
//না জানি পিতার নাম মাতৃনাম সীতা।
বাল্মীকির শিষ্য মোরা নাহি চিনি পিতা।।
//এই পরিচয় পেয়ে শ্রী রঘুনন্দন / দুই পুত্রে কোলে করি করেন ক্রন্দন।।
সুর করে করে, দুলে দুলে আরাম করে পড়ার কাব্য, মহাকাব্যিক ভাব থেকে বেরিয়ে পারিবারিক পাঁচালী হয়ে উঠল রামায়ণ।
১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালী তথা রামায়ণ শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয়, পাদ্রীদের তৎপরতায়। তার ফলে সারা বঙ্গদেশে এটি ছড়িয়ে পড়ে।
******
যুগ যুগ ধরে জনপ্রিয়তম কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ, সুর করে পড়া হতে থাকল পল্লী বাংলার ঘরে ঘরে। সন্ধ্যা বেলার পিদিমের আলোয় রামায়ণ পড়ছে এমন দৃশ্য সকলের কাছে খুব পরিচিত। তেমনি ধনীর ঘরেও শোভা পেত রামায়ণ। রোগের মুক্তিতে, বাড়ির শুভ কাজে, মৃত আত্মার শান্তির জন্য__রামায়ণ পাঠ হয়।
আজকের আধুনিক যুগ বহু কিছু ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। নিজেদের লাবন্য সরিয়ে, উপরের জৌলুস বাড়িয়ে চলেছে ধার করা বিদ্যা দিয়ে। কৃত্তিবাস ওঝা —নামটি কিন্তু হারাবে না। সম্ভব না। তিনি মিশে থাকবেন, বাংলার সংস্কার ও সংস্কৃতির সঙ্গে।।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন