মাহাবুবা লাকি
রাত তখন দুইটা বাজে। ওরা গোয়েন্দা মারফত খবর নিয়ে এম্বুসে আমাদের ঘিরে ফেলে। রাজাকার ও পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়। পাশের থানা হলেও এটা আমাদের অপরিচিত এলাকা ছিল। তাছাড়া আমার সব সাথীদের অধিকাংশই স্কুল, কলেজের ছাত্র ছিল। দুই ঘন্টা কাল তুমুল যুদ্ধ হয়। শত্রুরা বৃষ্টির মত গুলিবর্ষন করে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কে কোথায় পড়ল বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার দুজন সাথী আবুল কালাম আজাদ ও সবুর গুলিবিদ্ধ হয় ও আমি মারাত্মক আহত হই। দেখি ওরা সেই অবস্থায় আমাকে নিয়ে টানা হেচড়া করছে। ওদের রক্তের স্রোত দেখে নিজেকে শক্ত করলাম এবং গামছা দিয়ে ওদের ক্ষতস্থান বাঁধতে বল্লাম। এই সময় সামচু ভাই সহ আরো তিনজনকে পেলাম। মোট ২৬ জন সাথীকে পেলাম। নির্দেশ করলাম অস্ত্র ছাড়া আর কিছু বহন কর না। সাথে থাকা থালা প্লেট গ্লাস ও কাপড় সব ফেলে দিতে বললাম। শত্রুরা আমাদের চারিদিক থেকে অবরোধ করেছে তবে রাতে বাগানে ঢুকবে না। আরো ১৫ মিনিট অন্য সাথীদের জন্য অপেক্ষা করলাম এবং বাকিদের বললাম যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দক্ষিণদিকে সরে যেতে হবে। যেতে যেতে অন্য সাথীদের আওয়াজ পাবার চেষ্টা করছিলাম। না পেয়ে মন খারাপ ছিল। ৪ মাইল অতিক্রম করার পর আজানের শব্দ শুনলাম। তাড়াতাড়ি এক পুরানো ভিটার আনারস বাগানে আশ্রয় নিলাম। সাথীদের বললাম আমরা আক্রান্ত, কেউ আর বাঁচব না।
তবে সবাই মন খুলে শোন মৃত্যুর আগ মুহুর্ত অব্দি সবাই প্রাণপন লড়ে যাব। তবে গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম কেউ ভঙ্গ করব না। সেদিন বাকি ৩৩জনকে রাজাকাররা ঘিরে ফেলে। সারারাত গুলি বিনিময় হয়। রাজাকারদের পরিচিত এলাকা হওয়ায় ওরা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে গুলি করে। গুলিতে ৭ জন ওখানে নিহত হয়। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মুক্তি যোদ্ধারা অসহায় হয়ে পড়ে। অসংখ্য রাজাকাররা বাগানটি ঘিরে ফেলে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাগানের দিকে আগায়। সেই মুহুর্তে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা পালাতে পারলেও বাকি ৯ জন রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। অমানুষিক নির্যাতন করে তাদের খুলনা ক্যাম্পে সোপর্দ করে। এখান থেকে দুজনকে জেলে পাঠায় ও বাকিদের বদ্ধভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। ফকিরহাটের পিলজঙে এভাবে ১৪ জন মুক্তি যোদ্ধা শহীদ হন।
৫ই অক্টোবর রাত ৮টার সময় ফকির হাটের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মোল্লাহাট থানাধীন চাঁন্দেরহাটে পৌঁছলাম। আবুল কালাম আজাদের গুলিবিদ্ধ স্থান হতে পচা গন্ধ বের হচ্ছিল। সে কান্নায় ভেঙে পড়ল, বলে তালেব ভাই আমি বাঁচব না। সাহস দিয়ে বললাম নিজের এলাকায় এসেছি তোর কিছু হবে না। তাছাড়া নিহত সাথীদের বদলা না নিয়ে আমরা কেউ মরব না। সাথীরা মনোবল ফিরে পেল। সেদিন ৬ই অক্টোবর চাঁন্দেরহাট বাসিরা আমাদের প্রচুর খাবার এনে দিল। কেউ খেতে পারলাম না। একাধারে ৪দিন অনাহার ও সাথীদের করুণ পরিণতি আমাদের মর্মাহত করে।
পরের দিন বড় গাওলায় পৌঁছে গেলাম। ওখানে কেশববাবুর সাথে দেখা হল। দেখা হল দেশপ্রেমিক জয়নাল আবেদীন এর সাথে, তিনি আমার এক সাথীর বাবা। জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেন, আবুতালেব তোমাদের জন্য মোল্লাহাটবাসী পাগল হয়ে আছেন। তোমরা ফিরে আসবা ভাবতে পারি নাই। সেদিন ফেলে আসা সাথীদের কথা তাকে জানাতে পারলাম না। নগরকান্দি, ঘোষগাতি সহ পশ্চিম মোল্লাহাটের শত শত মানুষ দেখতে এসেছিল আমাদের।
সংবাদ হয়েছিল আমি বেঁচে নেই – এটা শুনে তোদের বাবা শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল। লোকমুখে সংবাদ পেয়ে সে ও ছুটে এসেছে। দেখা মাত্র বুকে জড়িয়ে কপালে চুম্বন দিতে লাগল। ফেলে আসা সাথীদের কথা মনে করে চোখ দিয়ে পানি এসে গেল। ভাবলাম আজ ওরা ফিরলে আপন জনেরা এভাবে আদর করতো। রাতে বসে ঠিক করলাম কিভাবে আগাবো কি করবো এবং সাথীদের নিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম এই প্রতিশোধ আমরা নিবোই এবং মা মাটি দেশকে স্বাধীন করবোই।
সেদিন ভোর রাতে ৭ই অক্টোবর মোল্লা আশরাফ ও শেখ আবুল মিয়া আমার সাথে দেখা করে এবং তারা জানায় আজ পাকসেনা ও রাজাকাররা চরকুলিয়া আক্রমণ করবে। তারা এও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে সব জ্বালিয়ে দেবে। এই সংবাদটি পাওয়া মাত্র ডাঃ লতিফ ফরাজি ও বিজয় বাবুর তত্বাবধানে গুলিবিদ্ধ সাথী আবুল কালামের চিকিৎসার জন্য অনুরোধ করলাম এবং ডাঃ মমতাজ উদ্দিনের নিকট যিনি শহীদ মহিদুল হাবিবের পিতা তার নিকট গুলিবিদ্ধ সবুরকে প্রদান করলাম।
খুব ভোরে কেশব বাবুর বাড়িতে সামান্য খাবার খেয়ে সাথীদের নিয়ে চরকুলিয়া যাত্রা করলাম। ওখানে পৌঁছলে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও কয়েকজন পুলিশ আমার সাথে দেখা করে, ও আমার হারানো সাথীদের নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে। পুলিশ হানিফ ভাই জানাল ভাইডি কোন বিপদ নেই। তোমার সাথীদের নিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে পার। কিন্তু ঠিক ১৫মিনিটের মাথায় গুলির শব্দ শুনতে পাই। জানতে পারলাম পাকসেনা ও রাজাকার দ্বারা আমরা আক্রান্ত। সমানতালে গুলি চলছে। সাথীদের নিয়ে মরহুম ফজলে মোক্তার সাহেবের উপর তালা হতে তড়িৎ গতিতে চরকুলিয়া পুল পার হয়ে উত্তর পাশে পজিশন নিয়ে আপাতত শত্রুর গুলির প্রতিউত্তর দিতে লাগলাম। এরই মধ্যে চরকুলিয়া স্কুল রাজাকারদের দখলে চলে যায়। আমি সাথীদের নিয়ে কাভারিং ডামার করতে লাগলাম। রাজাকার ও পাকসেনারা চরকুলিয়া পুল পার হয়ে আমাদের গোটা ক্যাম্প দখল করার চেষ্টা করছিল। সেই মুহুর্তে চরকুলিয়া স্কুলে গ্রেনেড চার্জ করার জন্য সাথীদের নিয়ে ক্রলিং করে বাজারের দিকে আগাচ্ছিলাম। হঠাৎ মোশাররফ নাম করে আমার এক সাথী গ্রেনেডটি ছিনিয়ে নিয়ে বলে তালেব ভাই আমরা বেঁচে থাকতে আপনার এ কাজ করতে হবে না।
সে শুধু আমায় কাভারিং ফায়ার করতে বলে বট গাছের সাথে পিঠ মিশিয়ে স্কুলের দিকে গ্রেনেড চার্জ করলো। এই মুহুর্তে কভারিং ফায়ারে আমায় সাহায্য করছিল প্রাক্তন আর্মি মোল্লা গোল্লাম মওলা, উত্তর খুলনার জামাল কমান্ডার ও মরহুম ফহম উদ্দিন সাব। গ্রেনেডের বিকট শব্দে পাকসেনা ও রাজাকাররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যে সেদিনকার মত যুদ্ধ বিরতি ঘটে।
গল্প বলার মাঝে হঠাৎ দেখি আমার চাচা চোখ মুছছেন। জানতে চাইলে বলেন সেদিন অনেক দুঃখ ও ভয় পেয়েছিলাম জানিস! অত্যন্ত দুঃখের সাথে তিনি বলেন, প্রাক্তন আর্মি হাবিব সাব ও তার সাথে থাকা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও পুলিশ বিপদের আশঙ্কা করে সেদিন রণক্ষেত্র ত্যাগ করেছিল যুদ্ধ না করে। ক্যাম্পে ফিরে তাদের তিরস্কার করায় হাবিব সাব তার কয়েকজন সাথীকে নিয়ে দত্তডাঙার নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করেন। মোল্লাহাটে বেশি রাজাকার জন্ম নিতে পারে নাই কারন মোল্লাহাটবাসী একপ্রকার স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ ছিল।
৮ই অক্টোবর চিন্তায় পড়ে গেলাম এই বিশাল বাহিনীর খাবার, পোশাক, ওষুধ, চিকিৎসা কিভাবে যোগাড় হবে। গেরিলা যুদ্ধে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা অনেক আন্তরিক ছিল। ভাবলাম তোদের বাবার সাথে ও এলাকার স্থানীয় কয়েকজনের সাথে আলাপ করি এই বিষয়ে কী করা যায়। তাই ক্যাম্পের দায়িত্ব সামচু ভাইকে দিয়ে দুজন সাথী সহ নগরকান্দি আসি। আমাকে দেখে হাজার মানুষ জড়ো হয়ে যায় এবং পিলজঙ্গের দুর্ঘটনার কথা জানতে চায়। উত্তরে সেদিন বলেছিলাম আপনারা ধৈর্য ধরুন রক্তের প্রতিশোধ না নিয়ে কোন কাহিনী বলবার সময় এখন না। এই মুহুর্তে খেয়াল করলাম তোদের বাবা শরীফ মোসলেম আহমেদ ও শহীদ মুক্তি যোদ্ধা জাহিদের পিতা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তোর বাবা আমায় ইশারা করল ডাক্তার মাকে সান্ত্বনা দিতে। আমি পাথর হয়ে গেলাম! কি বলব। দেখি মামাই বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমরা ফিরে এসেছ তাই আমি ভেঙে পড়ি নাই। মনে করছি আমার জাহিদরা ফিরে এসেছে। মন প্রান দিয়ে লড়ে যাও। জয় আমাদের নিশ্চিত।
উনারা সবাই একটি অফিস রুমে নিয়ে বসালেন। আমি মুক্তি যোদ্ধাদের আগামী সব সমস্যা তুলে ধরলাম। তখন শেখ হাবিবুর রহমান ও তোর বাবা বলেন, তোমাদের কথা ভেবে আমরা ১১ সদস্য বিশিষ্ট উপদল গঠন করেছি। আমি তোমার ভাই মোসলেম আহমেদ, ডাঃ মমতাজ, সেখ মান্নান, সেখ আতিয়ার আরো অনেকে আছেন। উপস্থিতি সবাই বললেন, মুক্তি যোদ্ধাদের খাবার, রসদ, ওষুধ ও চিকিৎসার ভার আমরা নিয়েছি। তুমি শত্রু সৈন্যের মহড়ায় ব্যাস্ত থাক। ফিরে এসে সামচু ভাইকে জানালাম অস্ত্র গুলি আর শত্রু ধ্বংস ছাড়া আমাদের আর কোন চিন্তা নাই। সেই সব যুদ্ধভরা দিনে আমার বাবার কাছে জমানো যত টাকা ছিল সব মুক্তি যোদ্ধাদের খাবার, ওষুধ, কাপড়ে ব্যয় করে যখন নিঃস্ব, তখন মায়ের সামনে কড়জোড়ে ভিক্ষা চাইলেন তার গহনা। মা বরাবরই স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। দেশ ও দেশের সম্মান তার কাছে বড় ছিল। তাই বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবর ও স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশের সম্মানের জন্য একে একে সব গহনা বিক্রি করে টাকা বাবার হাতে তুলে দেন। যখন আর কোন পথ ছিল না শেষ কানের পাশাটি ও খুলে স্বামীর হাতে তুলে দেন মুক্তি যোদ্ধাদের খাবারের জন্য। তিনি মুক্তি যোদ্ধাদের খাবার রান্না করে বাবাকে দিয়ে ক্যাম্পে পাঠাতেন। অনেক মুক্তি যোদ্ধারা তার হাতের খাবার খেয়েছে।
মোল্লাহাট প্রপারে পাকসেনাদের মেইন ঘাঁটি ছিল। ওখানে বসেই তারা যুদ্ধ পরিচালনা করতো। ২১শে মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পত পত করে নগরকান্দি বাজারে লাল সবুজ পতাকা উড়তো। যুদ্ধের সময় হাজার হাজার মানুষ পশ্চিম মোল্লাহাট অর্থাৎ নগরকান্দিতে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকসেনা ও রাজাকাররা তাই বার বার পশ্চিম মোল্লাহাটে ঢুকবার চেষ্টা করতো।
১০ই অক্টোবর পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন সেলিম শত শত পাকসেনা ও রাজাকার নিয়ে চরকুলিয়া আবার আক্রমণ করে। উদ্দেশ্য একটাই চরকুলিয়া ধূলায় মিশিয়ে সব মুক্তি যোদ্ধাদের হয় হত্যা না হয় ধরে নিয়ে যাবে। সেদিন ছিল শুক্রবার। বেলা তিন ঘটিকা মর্টার ও গুলি বৃষ্টির মত আমাদের ক্যাম্পের দিকে আসতেছিল। আমি আগে থেকেই সাথীদের নিয়ে চরকুলিয়া বাজারের উত্তর দিকে হাড়িদাহ নামক স্থানে এম্বুস করে অবস্থান করছিলাম। সামচুকে বললাম আমাদের সাথীরা নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কেউ গুলি ছুঁড়বেন না। পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন সেলিম সহ রাজাকার বেষ্টিত বিশাল বাহিনী আমাদের নিকটবর্তী নজরের মধ্যে এসে পড়ল। সাথীদের নির্দেশ সংকেত প্রদান করলাম। প্রচন্ড গোলাগুলি প্রায় ২৫ মিনিট তুমুল যুদ্ধ। ক্যাপ্টেন সেলিম নিহত হলেন। রাজাকাররা ও পাকসেনারা দিশেহারা যুদ্ধ চলছে। সেদিন তারা সমূলে সব ধ্বংস হয়েছিল।
হাড়িদাহের বাগান রাস্তা ঘাট শত্রুর রক্তে রঞ্জিত হল। আমার সাথীদের মনোবল বেড়ে গেল। তাদের উম্মদনা দেখে মনে হচ্ছিল তারা এক এক জন একশ শত্রুর সাথে লড়তে পারবে। আমাদের অবস্থা দিন দিন অনুকূলে আসতে লাগল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিমাণ ও বেড়ে বিশাল হতে লাগল। যারা মুক্তি যোদ্ধা হতে পারে নাই তারা শত্রুদের গতিবিধি আমায় জানাতে লাগলো।
১০ই অক্টোবরের যুদ্ধে রাজাকার ও পাকসেনারা চরকুলিয়ায় যে প্রচন্ড মার খেল তা মুজিব নগর কেন্দ্র থেকে দুই দুইবার প্রচারিত হয়েছিল। মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে ক্যাপ্টেন সেলিম সহ ৫৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও স্থানীয় রাজাকার সহ শতাধিক নিহত হয়েছে। সেদিন সারারাত তারা গরুর গাড়িতে করে সব লাশ মোল্লাহাট নিয়ে গিয়েছিল রাতে অনেকেই তা দেখেছে।
অতঃপর সামচু ভাই আমার সাথে পরামর্শ করে দত্তডাঙ্গায় ও একটি মুক্তি যোদ্ধা ক্যাম্প গঠন করেন। রাজাকার ও পাকসেনাদের সাথে সেখানেও আমাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধেও তারা চরম ভাবে মার খেয়েছিল আমাদের হাতে।
যুদ্ধকালীন সময়ে গঠিত উপদলের সাথে আমার বাবা শরীফ মোসলেম আহমেদ অন্যান্যদের সাথে তার সর্বোচ্চ দিয়ে মুক্তি যোদ্ধাদের সেবা করেছিল। সে সময় আমাদের বাড়ির অন্যান্যরা ও তাদের শ্রম দিয়ে খাবার দিয়ে সেদিন সক্রিয় ছিল বাবার পাশে মুক্তি যোদ্ধাদের সেবায়। যেদিন পশুর নদী অতিক্রম করে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সাথীদের নিয়ে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি খাদে পড়ে যাই এবং সাথে থাকা এল এম জির বাড়ি লাগে মাথায়। পরবর্তীতে গুলি না লাগলে ও পিলজঙ্গে মারাত্বকভাবে আহত হয়েছিলাম। যে কারণে উত্তর খুলনার জোনাল কমান্ডার মরহুম ফহমউদ্দিন সাহেব আমার চিকিৎসার প্রতি কঠিন নির্দেশ দিলেন এবং বলেন, আবুতালেব যুদ্ধ ক্ষেত্রে না থাকলে আমাদের সকল উদ্দেশ্য ব্যার্থ হবে।
ইতিমধ্যে আবার ও যুদ্ধের ডংকা বেজে ওঠে। নিহত পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন সেলিমের ভাগ্নে মামার হত্যার প্রতিশোধ নিতে গানবোটে নদী পথে পাকবাহিনীর একটি কোম্পানি ও শত শত রাজাকার আল-বদরদের নিয়ে মোল্লাহাট জড়ো করে। আমি সামচু ভাইকে গভীর রাতে জানালাম সাবধানে এগোতে হবে ওরা শেষ কামড় দিতে আসছে। গেরিলা তৎপরতার নিয়মাবলি দুজন পরামর্শ করলাম এবং বললাম আজই মূল ক্যাম চরকুলিয়া থেকে সরাতে হবে। সেই মোতাবেক নতুন ঘোষগাতির বড় ঘাটে অস্থায়ী ক্যাম্প করলাম।
এটা ছিল নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। আলিমুদ্দি খালের অর্ধেক ভেঙে দেওয়া হল। আমার সাথীদের নিয়ে এপারেই এম্বুস পজিশনে প্রস্তুত থাকলাম। শত্রুপক্ষ আক্রমণ করল চরকুলিয়া এবং আমার মূল ক্যাম্পে ঘাঁটি গেড়ে। তারা বর্ষার মত গুলি, মর্টার সেল ছুঁড়তে লাগলো। সেদিন মোল্লাহাট থরে থরে কাঁপছিলো এবং সবাই ভেবে নিয়েছিল এবার সব শেষ হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় মুক্তি যোদ্ধারা থমকে যায়। কারন দু’দিন যুদ্ধে গোলাবারুদ ও অস্ত্র সীমিত হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া এটা গেরিলা যুদ্ধ ছিল না। ছিল সম্মুখ যুদ্ধ। একক ভাবে এই যুদ্ধ দু’দিন ধরে চলতে থাকে শেষ রাতে অনেকেই যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করে এই ভেবে আর বাঁচার কোন পথ নেই। সব শেষ।
সকাল হবার আগেই আশা ও আলি জানায় তালেব ভাই রণক্ষেত্র শূন্য। আমাদের ছেলেরা টিকতে পারছে না। আশা ও আলিকে বললাম ওদের ডাক। সাথীদের বললাম চোরের মত আঠার বেকি নদী পার হয়ে চলে যেতে হবে এবং শুনতে হবে পশ্চিম মোল্লাহাট ওরা দখল করে মা বোনদের ইজ্জৎ লুটে নিচ্ছে। ইতিহাসে এ কথা লেখা হয়ে যাবার আগে কে কে আমার সাথে মরতে চাও। আমার সাথীরা সবাই বলে উঠল মরেছি এবং মরবো।
প্রভাত মুহুর্তে সাথীদের নিয়ে আলিমুদ্দি খালের পাশে মাচা বসিয়ে দিলাম। ঠিক ওই সময় রাজাকার ও পাকবাহিনী খাল অতিক্রম করে পশ্চিম মোল্লাহাটে ঢুকবার চেষ্টা করতেছিল। সাথীদের আদেশ দিলাম গুলি ছুঁড়তে। প্রচন্ড গুলিবিনিময়। সাথীদের আদেশ দিয়েছিলাম ওরা হাজার হাজার গুলি ছুঁড়ুক তোমরা দুই তিনটি ছুঁড়বে। শুধু ওদের জানান দেবার জন্য যে আমরা ময়দানে আছি। পরের দিন ঘোর অমাবস্যার রাত। ১২ ঘন্টা আগেই সাথীদের গুলি বন্ধ করে দিলাম। শত্রুরা ভাবল মুক্তিযোদ্ধারা রণক্ষেত্র ত্যাগ করেছে। তারা আনন্দে গুলি ও মর্টার নিক্ষেপ করে মোল্লাহাট কাঁপিয়ে তুলছে। বর্ষার মত গুলি আমাদের দিকে আসছে। রাত তখন আনুমানিক দুইটা। ওরা খালের পাশে রাইচ মিলের নিকট একত্রিত হল এবং ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে উল্ল্যাস করতে লাগল।
ওই মুহুর্তে আমার দল ও গ্রুপের অন্য দলগুলি যেখানে যেখানে বসিয়েছিলাম সংকেত দেওয়া মাত্র ওদের উপর গুলি ছুঁড়া শুরু করল। সেদিন অগনিত পাকসেনা ও রাজাকার ধ্বংস হল আহত হল অনেক ওরা পালাতে শুরু করল। প্রভাত হলে সাথীদের নিয়ে চরকুলিয়ার দিকে চল্লাম। দেখি চরকুলিয়ার রাস্তা ঘাট দালান কোঠায় শত্রুর রক্তে লাল হয়ে আছে। বিজয়ের উল্লাসে আমার সাথীরা জয় বাংলা শ্লোগান দিতে লাগলো।
চরকুলিয়ার বুকে পাকসেনা ও রাজাকারদের এটাই ছিল শেষ যুদ্ধ। সমগ্র বাগেরহাট জেলায় নিহত পাকসেনাদের সংখ্যার মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় সংখ্যা। এসব গল্প বাস্তবে ঘটে যাওয়া যুদ্ধ দিনের গল্প। বিকেল হলে কাঁচারী ঘরের সিঁড়িতে, রাতে পড়ানোর সময় কাকু যখন এসব কথা থেমে থেমে বলতো তখন মনে হত রূপকথার যুদ্ধ কাহিনী। কিন্তু বড় হতে হতে যখন জানলাম সেই রূপকথার নায়ক আমার কাকু বীর মুক্তিযোদ্ধা শরীফ আবুতালেব এবং মাঠে থেকে যোদ্ধাহত মুক্তি যোদ্ধাদের আহার, ওষুধ, সেবা দিয়ে পাশে ছিলেন আমার বাবা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শরীফ মোসলেম আহমেদ, তখন গর্বে মাথা উঁচু হয়ে যায়।
আর আমার মা যিনি তার সমস্ত জমানো টাকা ও গহনা বিক্রি করে মুক্তি যোদ্ধাদের খাবার দিয়েছেন সে ও তো দেশকে ভালবেসেই এটা করেছিল। যুদ্ধ পরবর্তী সময় সব মুক্তি যোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে আড্ডা দিত কাকুর সাথে মা তখনও তাদের ভাত রেঁধে খাওয়াতেন এবং সেটা নাকি অনেক বছর ধরে এমন রেওয়াজই হয়ে গিয়েছিল।
দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমরা সেই স্বাধীন দেশে গর্বে পা ফেলে হাঁটি। কিন্তু এখনো কাঁদি, কেঁদে দু’চোখের কণা ভিজে ওঠে যখন মনে পড়ে তারা সেই স্বাধীন দেশে বেশিদিন নিশ্বাস নিতে পারে নাই। যুদ্ধক্ষেত্রের ইঞ্জুরির কারণে সেটা ইনফেকশন হয়ে কাকুর ব্রেনে টিউমার হয় তখনকার দিনে চিকিৎসা ব্যাবস্থা উন্নত না হওয়ায় কাকু সরকারে তত্বাবধানেই পিজিতে মারা যান। তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সেই বিয়ে ও তিনি করে যেতে পারেন নি। সম্ভবত ৭৮ সালে তিন মারা যান। সন্তান সমুতুল্য ভাই যাকে নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালবাসতেন তার মৃত্যুর খবরে আমার বাবা স্ট্রোক করেন এবং প্যারালাইজড হয়ে মুখের কথা অব্দি বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর এমন অবস্থায় থেকে তিনিও চলে যান আমাদের ছেড়ে।
আমার মা একটি যুদ্ধ শেষ করতে না করতে আর একটি যুদ্ধের খাদে পড়ে গেলেন আটটি সন্তান নিয়ে। এক যুদ্ধে তিনি তার সব অর্থকড়ি শেষ করেছেন। আর এক যুদ্ধে স্বামী ও দেবরকে হারিয়ে প্রকারান্তে এই নারী সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন। বহু কষ্টে তিনি তার সন্তানদের বড় করে তুলেছেন। এখনো কাঁদেন, এখনো যুদ্ধ দিনের কথা বললে ফুঁসলে ওঠেন। অঝোর ধারায় পানি ফেলেন দেশের কথা বলে। আর আফসোস করে বলেন, এই দেশের জন্য তোমার বাবা কাকা সব দিয়ে গেলেন। কিন্তু দেশ আমাকে স্বামীর মুক্তিযুদ্ধ ভাতা ছাড়া আর কিছু দেননি। আমার মা পাঁচ বছর ধরে প্যারালাইজড ও শয্যাশায়ী। দোয়া করবেন আমার মায়ের জন্য।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন