রূপা মজুমদার
করোনা পরবর্তীকাল কেমন হতে চলেছে? এই সম্বন্ধে আমাদের আগ্রহের সীমা নেই। আসলে অজানাকে জানার উৎসাহ আমাদের সেই সভ্যতার আদি যুগ থেকেই। সেই কারণেই তো মানব সভ্যতার এত অগ্রগতি। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এই কৌতূহল থেকেই এখন আয়োজিত হচ্ছে একের পর এক সেমিনার বা ওয়েবিনার, যার বিষয়বস্তু করোনা পরবর্তী পৃথিবী, বা করোনার সঙ্গে লড়াইকালীন আমাদের জীবন। বই ব্যবসা বা সাহিত্যে করোনার প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করতে আমি বেশ কিছু ওয়েবিনারে (Webinar) বা মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি। আমার বক্তব্য এটাই যে, বই পড়া এবং সাহিত্য চিরজীবী, ঠিক যেমন একটি প্রবহমান নদী। নদী যেমন কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর, গতি পরিবর্তন করে কখনো-সখনো, যেমন চলার পথে একদিক ভাঙে, একদিক গড়ে, যেমন দু’কূলের সব আবর্জনা নিজের মধ্যে নিয়ে সর্বংসহা হয়েও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, সাহিত্য এবং বই পড়াও ঠিক সেইরকম। কোনো বিপর্যয়ে বই পড়া বা সাহিত্য সৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দিক পরিবর্তন করতে পারে বটে, কিন্তু তার গতিরোধ হয় না কখনো। আমাদের মনের সব ময়লা গ্লানি বইয়ের মধ্যে বিসর্জন দিয়ে আমরা শুদ্ধ এবং পরিমার্জিত হয়ে উঠি।
লকডাউন কালে মানুষ উপলব্ধি করেছে অনেক কিছু, চিহ্নিত করতে পেরেছে অন্তরের অন্ধকার দূরীকরণের মাধ্যমগুলিকে। ফলস্বরূপ – বলা বাহুল্য, বই এবং সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ মানুষের আরো বেড়েছে। নিজের বাড়ির লাইব্রেরির অপঠিত বইয়ের দিকে মানুষ হাত বাড়িয়েছে কিংবা হাতড়েছে কিছু পুরোনো পত্র-পত্রিকা। প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ মনোনিবেশ করেছে ই-বুকে। আবার কেউ সাবস্ক্রাইব করেছে বিভিন্ন অডিও-বুক অ্যাপগুলো। অর্থাৎ বই এবং সাহিত্যে নতুন মাধ্যমগুলো কি মান্যতা দেওয়া শুরুর ধাপ বলে চিহ্নিত করতে পারি আমরা করোনা-কালকে? আমাদের জীবন যেভাবে ধীরে ধীরে প্রযুক্তি-নির্ভর হয়ে পড়ছে, বই এবং সাহিত্যেরও সেইরূপে প্রযুক্তি নির্ভর হওয়া শুরু হয়েছে। স্কুলে পড়তাম যখন, তখন ক্লাস সিক্সে বা সেভেনে খুব কমন একটা রচনা ছিল ‘বিজ্ঞান-অভিশাপ না আশীর্বাদ?’ কিন্তু এখন এই বিষয়ে রচনার কথা আমরা ভাবতেই পারি না, কারণ বিজ্ঞানের আশীর্বাদ এতটাই প্রসারিত যে অভিশাপ বাবাজি কোথায় গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে বোঝা ভার! খেয়াল করবেন যে আমি আগের বাক্যে তিনটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছি – ‘স্কুল’, ‘ক্লাস’ এবং ‘কমন’। আচ্ছা আমি যদি ‘বিদ্যালয়’, ‘শ্রেণি’ এবং ‘সর্বজনীন’ এই শব্দগুলি ব্যবহার করতাম, তাহলে কি বেশি গ্রহণযোগ্য হত? না, বোধহয়। কারণ আমরা পরিবর্তনশীল। আমাদের ভাষা, চিন্তা, আবেগ সবই পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের নামই জীবন। পুরাতনকে ভুলে আমরা সর্বদাই নূতনের জয়গান গাই। সেই কারণেই বিজ্ঞানের আশীর্বাদ এখন এতটাই গ্রহণ করেছি, যে তার অভিশাপগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করার কথা ভাবিই না, অতএব একদা-প্রিয় রচনার বিষয়টিও এখন অবলুপ্ত! একইভাবে বর্তমানে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা প্রযুক্তি-নির্ভর হয়ে পড়েছি ধীরে ধীরে। লকডাউনের সময় অনুভব করতে পেরেছি যোগাযোগ বজায় রাখবার একমাত্র মাধ্যম আন্তর্জাল বা ইন্টারনেট (অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য এবং সময়োপযোগী শব্দ)। কিছুকাল আগেও সভা সমিতিতে আলোচ্য বিষয় ছিল একটিই – ‘মুঠোফোনের অভিশাপ!’ বা ‘মুঠোফোনের আগ্রাসনে বই-পড়া অবলুপ্তির পথে!’ আমি কোনোদিন এর সপক্ষে বলতে পারিনি, ফলস্বরূপ আয়োজকরা অখুশি হতেন। কারণ আমি সময়ের সঙ্গে চলতে স্বচ্ছন্দবোধ করি এবং নতুনকে আহ্বান জানাতে ভালোবাসি – মুঠোফোন, থুড়ি মোবাইল ফোন (বেশি গ্রহণযোগ্য শব্দ) এবং আন্তর্জাল, থুড়ি ইন্টারনেট কখনোই বই পড়া বা সাহিত্যের গতিরোধ করতে পারে না। হ্যাঁ, সাময়িক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু গতিরোধ? অসম্ভব। গতি পরিবর্তন হতে পারে। প্রথমে নদীর তুলনা দিয়েছিলাম এই কারণেই।
করোনার প্রভাব বই পড়াতে অবশ্যই পড়েছে। বই পড়া অনেক বেশি প্রযুক্তি-নির্ভর হতে চলেছে। লকডাউনের সময় মানুষ যখন বই-সচেতন হয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছে সাহিত্যে মনোনিবেশ করবে বলে, তখন উদ্ধারকর্তা হিসেবে এগিয়ে এসেছিল ই-বুক এবং অডিও বুক। গুগল প্লে, অ্যামাজন কিন্ডেল বা সুইফ্টবুকস-এর মতো অ্যাপগুলোর রমরমা দেখে মনে মনে হেসেছিলাম এই ভেবে যে করোনা পরবর্তী সভাগুলিতে আলোচনার নতুন বিষয় আসতে চলেছে! অডিও বুকের সাবস্ক্রাইবার দিন কে দিন বেড়েই চলেছে। আমি এই চলটাকে স্বাগত জানাচ্ছি। কারণ বই পড়া এবং সহজপ্রাপ্তির অভাবে বাঙালির সন্তানেরা বাংলা সাহিত্যের মহাসমুদ্রে যে অসংখ্য মণি-মুক্তো-রত্নসম্ভার লুকিয়ে আছে, তার রস আস্বাদন থেকে অনেকটাই বঞ্চিত ছিল, কিন্তু এখন অডিও বুকের মাধ্যমে তারা সহজেই পরিচিত হতে পারবে আমাদের সাহিত্যের বিপুল রত্নভাণ্ডারের সঙ্গে।
লকডাউন পরবর্তীকালে শুরু হল আনলক পর্ব, যাত্রা আরম্ভ করল নিউ নর্মাল লাইফ। ধীরে ধীরে কলেজ স্ট্রিট খুলল, প্রকাশনা সংস্থাগুলো খুলল। অবশ্য তার আগে বয়ে গেছে আমাদের ওপর দিয়ে ‘আমফান’ নামের তাণ্ডব। কলেজ স্ট্রিট – এশিয়ার বৃহত্তম বইবাজার তখন কোমাচ্ছন্ন। নিউ নর্মালে জেগে উঠল বটে, কিন্তু তার ভাইটাল অর্গানস্ তখনও কাজ করছে না। ফুটপাতে হকার বন্ধুরা নেই, প্রেসিডেন্সি বা ইউনিভার্সিটির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো স্টলগুলি বন্ধ, কারোর কাঠামোসুদ্ধু সবকিছুই বেমালুম বেপাত্তা (আমফানের দৌরাত্ম্যে), আর ক্রেতা খদ্দের? তারা তো আকাশের চাঁদ! আকাশের চাঁদকে যেমন নাগালে পাওয়া যায় না, কলেজ স্ট্রিটে ক্রেতাও তেমন নাগালের বাইরে। লোকাল ট্রেন বন্ধ, যানবাহন চলছে না, মানুষ বই কিনতে আসবে কী করে? আরে মানুষ প্রাণে বাঁচবে আগে না বই পড়বে? তাহলে আর দোকান খুলে প্রকাশক বা বই বিক্রেতারা কী করবে? শুরু হল ফোনাফোনি।
“অ্যাই ইন্দ্রাণী কী করবে?”
“ত্রিদিবদা কিছু ভেবেছো?”
“সুধাংশুদা কী করবে বল তো?”
দেবজ্যোতিবাবুর ফোন এল, “হ্যাঁরে, কবে খুলছিস?”
“আরে খুলেই বা কি হবে! মানুষের পকেটে টাকা নেই, খেতে পাচ্ছে না, তারা কি বই কিনবে?”
বইপাড়া খুলল, জেগেও উঠল, অবশ্য তার মধ্যে মিডিয়াতে কয়েক দফা সাক্ষাৎকার থুড়ি ইন্টারভিউ দেওয়া হল যে ‘বইপাড়া বিধ্বস্ত’, ‘বইপাড়া জাগতে চলেছে’, ‘বইপাড়া জাগ্রত’। সবই হল, কিন্তু লোক কই? এ তো মহা মুশকিল! লাইট জ্বলছে, পাখা চলছে, গাড়ি করে কর্মচারীদের আনা হচ্ছে কিন্তু বিক্রি কই?
ইতিমধ্যে অফিসে ফোন “দাদা ওই বইটা আছে? পাঠানো যাবে কোনোভাবে?”
মেসেঞ্জারে মেসেজ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে “ম্যাডাম অমুক বইটা যদি একটু পাঠাতে পারেন।”
ক্যুরিয়ার ঝাঁপ ফেলে বসে আছে, পোস্টাল সিস্টেম দাঁত দেখাচ্ছে, অনলাইন বুক ডেলিভারি কোম্পানিগুলো লজ্জিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছে “স্যরি দিদি, মানে কীভাবে আর…”, অগত্যা দুগ্গা দুগ্গা বলে নিজেরাই শুরু করলাম। কয়েকদিন আগে-পরে সকলেই করল। আবার মিডিয়াতে খবর হল- ‘কলেজ স্ট্রিট থেকে হোম ডেলিভারি।’ আবার কয়েক দফা সাক্ষাৎকার, থুড়ি ইন্টারভিউ।
ততদিনে কেল্লা ফতে। দাঁড়িয়ে গেছে হোম ডেলিভারি স্কিম। বাঙালিরা পারেও বটে। পেটের খিদে মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে মগজের খিদে মেটাবার প্রক্রিয়াটি চালু রাখল। অতএব বইপাড়াও বেঁচে গেল। তারপর ঘুম ভেঙে আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠল অনলাইন বুক হোম ডেলিভারি সংস্থাগুলো। পুরোদস্তুর ব্যবসা চালু হয়ে গেল। করোনা, আমফান কিছুই কাবু করতে পারল না বইপাড়াকে। কারণ বাঙালিরা বইপাড়াকে কাবু হতে দেবে না। অনেকগুলো এনজিও সংস্থা ইতিমধ্যে এগিয়ে এসে দিন-আনি-দিন-খাই মানুষগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। অর্থাৎ বইপাড়া, বই পড়া এবং সাহিত্যস্রোত বহমান, দিক পরিবর্তন করেছে কিঞ্চিৎ, মান্ধাতা আমলের কূল ভেঙে, প্রযুক্তি-নির্ভর কূল গড়ে তুলেছে।
এরই মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করা শুরু করলাম ওয়েব সিরিজের নির্দেশকদের সঙ্গে। তাদের কন্টেন্ট চাই। কতদিন আর খুন-জখম-মারদাঙ্গা বেচে দর্শক টেনে রাখবে। আমাদেরও উদ্দেশ্য মানুষের কাছে বাংলা সাহিত্যকে আরো বেশি করে পৌঁছে দেওয়া। কন্টেন্ট-নির্ভর বা সাহিত্য-নির্ভর ওয়েব সিরিজে মানুষের মন ভরবে, মানও বজায় থাকবে, মগজও পুষ্টি পাবে। সুতরাং স্বাগত জানালাম এই প্ল্যাটফর্মকেও। আর এই সব কিছুর সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে চলছে বিভিন্ন ওয়েবিনার এমনকি আমাদের ফেসবুক পেজ থেকে গল্প পাঠের আসর, যার এক-একটির ভিউ হয় প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার, কখনো তারও অধিক। সুতরাং শুধুই গালমন্দ নয়, করোনা বাবাজির ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ কিন্তু প্রাপ্য, বাংলা প্রকাশনা জগৎকে অন্যখাতে প্রবাহিত করতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে।
ইংরেজিতে যখন বক্তব্য রাখি, তখন উপসংহারে একটি কথা প্রায়শই ব্যবহার করি “টু সাম আপ”। এখানেও “সাম আপ” করলে দাঁড়ায় যে – বাংলা সাহিত্য করোনা পরবর্তীকালে পাওয়া যাবে আদি অকৃত্রিম দুই মলাটের মধ্যে বই হিসেবে, অডিও বুকে, ই-বুকে, কন্টেন্ট-নির্ভর ওয়েব সিরিজে।
লকডাউন কালে মানুষ উপলব্ধি করেছে অনেক কিছু, চিহ্নিত করতে পেরেছে অন্তরের অন্ধকার দূরীকরণের মাধ্যমগুলিকে। ফলস্বরূপ – বলা বাহুল্য, বই এবং সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ মানুষের আরো বেড়েছে। নিজের বাড়ির লাইব্রেরির অপঠিত বইয়ের দিকে মানুষ হাত বাড়িয়েছে কিংবা হাতড়েছে কিছু পুরোনো পত্র-পত্রিকা। প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ মনোনিবেশ করেছে ই-বুকে। আবার কেউ সাবস্ক্রাইব করেছে বিভিন্ন অডিও-বুক অ্যাপগুলো। অর্থাৎ বই এবং সাহিত্যে নতুন মাধ্যমগুলো কি মান্যতা দেওয়া শুরুর ধাপ বলে চিহ্নিত করতে পারি আমরা করোনা-কালকে? আমাদের জীবন যেভাবে ধীরে ধীরে প্রযুক্তি-নির্ভর হয়ে পড়ছে, বই এবং সাহিত্যেরও সেইরূপে প্রযুক্তি নির্ভর হওয়া শুরু হয়েছে। স্কুলে পড়তাম যখন, তখন ক্লাস সিক্সে বা সেভেনে খুব কমন একটা রচনা ছিল ‘বিজ্ঞান-অভিশাপ না আশীর্বাদ?’ কিন্তু এখন এই বিষয়ে রচনার কথা আমরা ভাবতেই পারি না, কারণ বিজ্ঞানের আশীর্বাদ এতটাই প্রসারিত যে অভিশাপ বাবাজি কোথায় গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে বোঝা ভার! খেয়াল করবেন যে আমি আগের বাক্যে তিনটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছি – ‘স্কুল’, ‘ক্লাস’ এবং ‘কমন’। আচ্ছা আমি যদি ‘বিদ্যালয়’, ‘শ্রেণি’ এবং ‘সর্বজনীন’ এই শব্দগুলি ব্যবহার করতাম, তাহলে কি বেশি গ্রহণযোগ্য হত? না, বোধহয়। কারণ আমরা পরিবর্তনশীল। আমাদের ভাষা, চিন্তা, আবেগ সবই পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের নামই জীবন। পুরাতনকে ভুলে আমরা সর্বদাই নূতনের জয়গান গাই। সেই কারণেই বিজ্ঞানের আশীর্বাদ এখন এতটাই গ্রহণ করেছি, যে তার অভিশাপগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করার কথা ভাবিই না, অতএব একদা-প্রিয় রচনার বিষয়টিও এখন অবলুপ্ত! একইভাবে বর্তমানে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা প্রযুক্তি-নির্ভর হয়ে পড়েছি ধীরে ধীরে। লকডাউনের সময় অনুভব করতে পেরেছি যোগাযোগ বজায় রাখবার একমাত্র মাধ্যম আন্তর্জাল বা ইন্টারনেট (অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য এবং সময়োপযোগী শব্দ)। কিছুকাল আগেও সভা সমিতিতে আলোচ্য বিষয় ছিল একটিই – ‘মুঠোফোনের অভিশাপ!’ বা ‘মুঠোফোনের আগ্রাসনে বই-পড়া অবলুপ্তির পথে!’ আমি কোনোদিন এর সপক্ষে বলতে পারিনি, ফলস্বরূপ আয়োজকরা অখুশি হতেন। কারণ আমি সময়ের সঙ্গে চলতে স্বচ্ছন্দবোধ করি এবং নতুনকে আহ্বান জানাতে ভালোবাসি – মুঠোফোন, থুড়ি মোবাইল ফোন (বেশি গ্রহণযোগ্য শব্দ) এবং আন্তর্জাল, থুড়ি ইন্টারনেট কখনোই বই পড়া বা সাহিত্যের গতিরোধ করতে পারে না। হ্যাঁ, সাময়িক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু গতিরোধ? অসম্ভব। গতি পরিবর্তন হতে পারে। প্রথমে নদীর তুলনা দিয়েছিলাম এই কারণেই।
করোনার প্রভাব বই পড়াতে অবশ্যই পড়েছে। বই পড়া অনেক বেশি প্রযুক্তি-নির্ভর হতে চলেছে। লকডাউনের সময় মানুষ যখন বই-সচেতন হয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছে সাহিত্যে মনোনিবেশ করবে বলে, তখন উদ্ধারকর্তা হিসেবে এগিয়ে এসেছিল ই-বুক এবং অডিও বুক। গুগল প্লে, অ্যামাজন কিন্ডেল বা সুইফ্টবুকস-এর মতো অ্যাপগুলোর রমরমা দেখে মনে মনে হেসেছিলাম এই ভেবে যে করোনা পরবর্তী সভাগুলিতে আলোচনার নতুন বিষয় আসতে চলেছে! অডিও বুকের সাবস্ক্রাইবার দিন কে দিন বেড়েই চলেছে। আমি এই চলটাকে স্বাগত জানাচ্ছি। কারণ বই পড়া এবং সহজপ্রাপ্তির অভাবে বাঙালির সন্তানেরা বাংলা সাহিত্যের মহাসমুদ্রে যে অসংখ্য মণি-মুক্তো-রত্নসম্ভার লুকিয়ে আছে, তার রস আস্বাদন থেকে অনেকটাই বঞ্চিত ছিল, কিন্তু এখন অডিও বুকের মাধ্যমে তারা সহজেই পরিচিত হতে পারবে আমাদের সাহিত্যের বিপুল রত্নভাণ্ডারের সঙ্গে।
লকডাউন পরবর্তীকালে শুরু হল আনলক পর্ব, যাত্রা আরম্ভ করল নিউ নর্মাল লাইফ। ধীরে ধীরে কলেজ স্ট্রিট খুলল, প্রকাশনা সংস্থাগুলো খুলল। অবশ্য তার আগে বয়ে গেছে আমাদের ওপর দিয়ে ‘আমফান’ নামের তাণ্ডব। কলেজ স্ট্রিট – এশিয়ার বৃহত্তম বইবাজার তখন কোমাচ্ছন্ন। নিউ নর্মালে জেগে উঠল বটে, কিন্তু তার ভাইটাল অর্গানস্ তখনও কাজ করছে না। ফুটপাতে হকার বন্ধুরা নেই, প্রেসিডেন্সি বা ইউনিভার্সিটির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো স্টলগুলি বন্ধ, কারোর কাঠামোসুদ্ধু সবকিছুই বেমালুম বেপাত্তা (আমফানের দৌরাত্ম্যে), আর ক্রেতা খদ্দের? তারা তো আকাশের চাঁদ! আকাশের চাঁদকে যেমন নাগালে পাওয়া যায় না, কলেজ স্ট্রিটে ক্রেতাও তেমন নাগালের বাইরে। লোকাল ট্রেন বন্ধ, যানবাহন চলছে না, মানুষ বই কিনতে আসবে কী করে? আরে মানুষ প্রাণে বাঁচবে আগে না বই পড়বে? তাহলে আর দোকান খুলে প্রকাশক বা বই বিক্রেতারা কী করবে? শুরু হল ফোনাফোনি।
“অ্যাই ইন্দ্রাণী কী করবে?”
“ত্রিদিবদা কিছু ভেবেছো?”
“সুধাংশুদা কী করবে বল তো?”
দেবজ্যোতিবাবুর ফোন এল, “হ্যাঁরে, কবে খুলছিস?”
“আরে খুলেই বা কি হবে! মানুষের পকেটে টাকা নেই, খেতে পাচ্ছে না, তারা কি বই কিনবে?”
বইপাড়া খুলল, জেগেও উঠল, অবশ্য তার মধ্যে মিডিয়াতে কয়েক দফা সাক্ষাৎকার থুড়ি ইন্টারভিউ দেওয়া হল যে ‘বইপাড়া বিধ্বস্ত’, ‘বইপাড়া জাগতে চলেছে’, ‘বইপাড়া জাগ্রত’। সবই হল, কিন্তু লোক কই? এ তো মহা মুশকিল! লাইট জ্বলছে, পাখা চলছে, গাড়ি করে কর্মচারীদের আনা হচ্ছে কিন্তু বিক্রি কই?
ইতিমধ্যে অফিসে ফোন “দাদা ওই বইটা আছে? পাঠানো যাবে কোনোভাবে?”
মেসেঞ্জারে মেসেজ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে “ম্যাডাম অমুক বইটা যদি একটু পাঠাতে পারেন।”
ক্যুরিয়ার ঝাঁপ ফেলে বসে আছে, পোস্টাল সিস্টেম দাঁত দেখাচ্ছে, অনলাইন বুক ডেলিভারি কোম্পানিগুলো লজ্জিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছে “স্যরি দিদি, মানে কীভাবে আর…”, অগত্যা দুগ্গা দুগ্গা বলে নিজেরাই শুরু করলাম। কয়েকদিন আগে-পরে সকলেই করল। আবার মিডিয়াতে খবর হল- ‘কলেজ স্ট্রিট থেকে হোম ডেলিভারি।’ আবার কয়েক দফা সাক্ষাৎকার, থুড়ি ইন্টারভিউ।
ততদিনে কেল্লা ফতে। দাঁড়িয়ে গেছে হোম ডেলিভারি স্কিম। বাঙালিরা পারেও বটে। পেটের খিদে মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে মগজের খিদে মেটাবার প্রক্রিয়াটি চালু রাখল। অতএব বইপাড়াও বেঁচে গেল। তারপর ঘুম ভেঙে আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠল অনলাইন বুক হোম ডেলিভারি সংস্থাগুলো। পুরোদস্তুর ব্যবসা চালু হয়ে গেল। করোনা, আমফান কিছুই কাবু করতে পারল না বইপাড়াকে। কারণ বাঙালিরা বইপাড়াকে কাবু হতে দেবে না। অনেকগুলো এনজিও সংস্থা ইতিমধ্যে এগিয়ে এসে দিন-আনি-দিন-খাই মানুষগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। অর্থাৎ বইপাড়া, বই পড়া এবং সাহিত্যস্রোত বহমান, দিক পরিবর্তন করেছে কিঞ্চিৎ, মান্ধাতা আমলের কূল ভেঙে, প্রযুক্তি-নির্ভর কূল গড়ে তুলেছে।
এরই মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করা শুরু করলাম ওয়েব সিরিজের নির্দেশকদের সঙ্গে। তাদের কন্টেন্ট চাই। কতদিন আর খুন-জখম-মারদাঙ্গা বেচে দর্শক টেনে রাখবে। আমাদেরও উদ্দেশ্য মানুষের কাছে বাংলা সাহিত্যকে আরো বেশি করে পৌঁছে দেওয়া। কন্টেন্ট-নির্ভর বা সাহিত্য-নির্ভর ওয়েব সিরিজে মানুষের মন ভরবে, মানও বজায় থাকবে, মগজও পুষ্টি পাবে। সুতরাং স্বাগত জানালাম এই প্ল্যাটফর্মকেও। আর এই সব কিছুর সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে চলছে বিভিন্ন ওয়েবিনার এমনকি আমাদের ফেসবুক পেজ থেকে গল্প পাঠের আসর, যার এক-একটির ভিউ হয় প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার, কখনো তারও অধিক। সুতরাং শুধুই গালমন্দ নয়, করোনা বাবাজির ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ কিন্তু প্রাপ্য, বাংলা প্রকাশনা জগৎকে অন্যখাতে প্রবাহিত করতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে।
ইংরেজিতে যখন বক্তব্য রাখি, তখন উপসংহারে একটি কথা প্রায়শই ব্যবহার করি “টু সাম আপ”। এখানেও “সাম আপ” করলে দাঁড়ায় যে – বাংলা সাহিত্য করোনা পরবর্তীকালে পাওয়া যাবে আদি অকৃত্রিম দুই মলাটের মধ্যে বই হিসেবে, অডিও বুকে, ই-বুকে, কন্টেন্ট-নির্ভর ওয়েব সিরিজে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
বাস্তবের প্রতিচ্ছবি লেখায় ফুটে উঠেছে। খুব ভালো লাগলো।