স্মৃতিচারণ
প্রিয়ব্রত দত্ত
পুজো এলে কেন জানি না বাপিদার কথা খুব মনে পড়ে। বাপ্পি লাহিড়ি। উল্কার মতো উত্থান। রাজার দাপটে জীবন যাপন। ধূমকেতুর মতো বিদায়।
সোনায় মোড়া শরীর ও জীবন। মানুষকে নাচিয়ে-কুঁদিয়ে, কাঁদিয়েও নিজে কেমন নিঃশব্দে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
ডিস্কো কিং বাপিদার সঙ্গে আমার মোলাকাত পেশা সূত্রে। তবে এক ভিন্ন পটভূমিতে। নিউ দিঘার সমুদ্রে সৈকতে। অগুন্তি ঢেউ আর অফুরান বালির মেহেফিলে।
এটিএন বাংলা চ্যানেলটি তখন পুরোপুরি ওপার বাংলার হয়ে যায়নি। বঙ্গ সংস্কৃতির অন্যতম বাহক, প্রচারক ও পৃষ্ঠপোষক ছিল চ্যানেলটি। সালটা সম্ভবত ১৯৯৮ অথবা ‘৯৯। চ্যানেলের কর্ণধার তপন রায় ঠিক করলেন মুম্বই, কলকাতা ও বাংলাদেশের বাঙালি শিল্পীদের নিয়ে তাঁদেরই গাওয়া গান দিয়ে ভিডিও অ্যালবাম করবেন। এই ‘ভিডিও অ্যালবাম’ বস্তুটি বাংলা বাজারে তপন রায়ই জনপ্রিয় করেন। তার জন্য চাই সুন্দর লোকেশন। তপনদা ঠিক করলেন কিছু গানের শ্যুটিং করবেন দিঘার সুমদ্র সৈকতে। অকূল পাথারকে পিছনে রেখে।
কমলদার (কমলকুমার ঘোষ) সঙ্গে তপনদার বেশ ভাব ছিল। কমলদাও ওই চ্যানেলে তখন ‘প্রিয়া প্রিয় শিল্পী’ নামে একটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুষ্ঠান করতেন। এ বঙ্গের বিভিন্ন পেশা ও মাধ্যমের বহু কেষ্টবিষ্টু কমলদার ক্যামেরার সামনে তাঁদের জীবনের জল ও স্থলের কথা শুনিয়েছেন।
সুতরাং সান্ধ্য আজকাল তথা কমলদা শ্যুটিং দেখতে আমন্ত্রিত হবেন, সে নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কমলদার নেমতন্ন মানে আমার ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। অফিস, ডেস্ক, পেজ মেকআপ ফেলে কমলদা তো আর দিন দুয়েকের আউটডোর কভারেজে যাবেন না, যাব আমি।
গেলামও। সঙ্গে ফটোগ্রাফার জয়দীপ। এক্সক্লুসিভ কভারেজ। শুধু আজকাল।
যাওয়ার সময় তপনদা বলেছিলেন তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
দিঘায় গিয়ে পৌঁছলাম রাত আটটা কী ন’টা। সেদিনের মতো শ্যুটিং প্যাকআপ হয়ে গেছে। আমরাও হোটেলের ঘরে সেঁধিয়ে গেলাম। পরদিন কলটাইম ভোর ভোর। সূর্যোদয়কে ব্যাকগ্রাউণ্ডে রেখে শ্যুটিং হবে। কার গান? তপনদা বললেন, গিয়ে দেখতে পাবি।
টাটা সুমোটা বিচের উপর বাঁক খেয়ে যখন থামল, সূর্য উঠি উঠি করছে। জল আর আকাশ গেরুয়ায় গা মেখে প্রস্তুত। দূর থেকে দেখছি সিলিউটে এক মোটাসোটা চেহারার লোক সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন হাত জোড় করে। ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা মাথার চুল সামুদ্রিক হাওয়ায় এলোমেলো।
রোল… ক্যামেরা… মিউজিক… অ্যাকশন…
আরে এ তো বাপি লাহিড়ির গলা! তপনদার দিকে তাকালাম। তপনদা চোখ টিপলেন। লং শটে ক্যামেরা বাপি লাহিড়িকে দু-তিনবার টেক করে অ্যাঙ্গেল বদল করল। ততক্ষণে দিনমণি ড্রপ খাওয়া বলের মতো লাফ মেরে নিজের পজিশনে।
আলো বাড়ছে। লোক বাড়ছে। বাড়ছে কৌতূহল। হাতের সামনে জলজ্যান্ত ‘বাপ্পি লাহিড়ি’কে পেয়ে কে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সেই ফাঁকে সোনায় মোড়া শরীরটা একটা ভ্যানের ভেতর পুরে দিলেন বাপি লাহিড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যে স্থানীয় পুলিশ গোটা এলাকাটা ঘিরে ফেলল। আমরা গোল হয়ে বসলাম ব্রেকফাস্ট করতে।
বেলা তখন দশটা। সমুদ্র সৈকতেই সাজানো হল কি বোর্ড, ড্রাম, কঙ্গো… ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে কি বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন সুর সম্রাট। বাপ্পা গিয়ে বসল ড্রাম সেটের সামনে। অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্টের সামনে কলকাতার মিউজিশিয়ানরা। শট শুরু হল। নিজের সুর করা আর গাওয়া গানেই লিপ দিচ্ছেন বাপি লাহিড়ি। (গানটা এখন আর মনে নেই)
আর এক প্রস্থ শট শেষ।
ডাব হাতে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে সমুদ্রের দিকে সুমোর দরজাটা খুলে স্ট্রয়ে টান দিলেন। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। অর্ধেক পৃথিবী তখন কোমর দোলাচ্ছে ‘বাপ্পি লাহিড়ি’র সুরে। গলাটা শুকিয়ে আসছে। তপনদার উপর রাগ হচ্ছে। আগে বলেনি। হোমওয়ার্ক করিনি। কী দিয়ে শুরু করব বুঝতে পারছি না। একটা ব্যপারে নিশ্চিন্ত ইংরেজি বা হিন্দি বলতে হবে না।
আমাকে কিছু বলতে হল না। একগাল হেসে বললেন, ‘তুমি ডাব খাচ্ছ না। ডাব খাও… ডাব খাও… খুব ভালো জিনিস… আমি জুহুতে হাঁটতে বেরোলেই গোটা পাঁচেক ডাব খাই।’
গ্ল্যামার গলে পড়ছে। গায়ের রঙটা গোলাপি। রোদের তাতে চামড়ার তলার রক্তটা যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিশ্বাস করুন ঘেঁটে গেলাম। ওই মাপের একজন সেলিব্রিটি, অথচ কোনও ঘ্যাম নেই! একেবারে তুমি! এমনভাবে কথা বলছেন যেন, গতকাল রাতে শুতে যাওয়ার সময় আমার কাছে পান চেয়ে খেয়েছেন। সকালে পিকটা ফেলে কথা শুরু করলেন।
এই গল্পের একটা সাব প্লট আছে। আমাদের বাড়িতে দুটি ভাড়াটে পরিবার বসবাস করতেন। জন্ম থেকে দেখে আসছি তাঁদের। আমরা বাবা-কাকা-জেঠারা একসঙ্গে থাকলেও হাঁড়ি আলাদা। সেই ঊনত্রিশ ভূতের বাড়িতে ওই দুই ভাড়াটে পরিবারও সমান সৌজন্যে মেলামেশা করত। বাড়ির পেছন দিকের দোতলায় থাকত সান্যাল পরিবার। একতলায় আচার্য পরিবার। (এই আচার্য পরিবারেরই মেজ ছেলে নির্মাল্য আচার্য। সত্যজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কলেজের বন্ধু। ওঁদের সহপাঠি আমার সেজজেঠু।) দোতলায় সান্যাল পরিবারের কর্তা সত্য সান্যাল ছিলেন তৎকালে সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক জগতের প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ব। নজরুল ঘনিষ্ঠ। স্ত্রী রবীন্দ্র সান্নিধ্য ধন্য আশ্রম কন্যা। মেয়েরা বিদুষী তো বটেই, গানে, নাচে, বাজনায় অনন্যা। মেজ মেয়ে মেঘমালা সুবিনয় রায়ের ছাত্রী। সেজ মেয়ে সাগর সেনের। সংস্কৃতিমনস্ক সতুবাবুর আহ্বানে তখনকার বহু প্রখ্যাত শিল্পী ওঁদের ফ্ল্যাটে আড্ডা মারতে চলে আসতেন। হারমোনিয়াম-তবলা টেনে নিয়ে বসে যেত গানের আসর। তাতে যোগ দিতেন আমার মেজ জেঠু শৈলেন্দ্রনাথ দত্তও। তিনি আবার শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ছাত্র ছিলেন। মাঝে মাঝে আসরের রঙ বাড়িয়ে দিতেন আমার ন’পিসেমশাই নিশীথ সাধু। বাবা-জেঠুদের মুখে শুনেছি বার দুয়েক নজরুল ইসলামও এসেছিলেন সতুবাবুর ঘরে। সেই রকম প্রায়ই আড্ডা মারতেন আসতেন অপরেশ লাহিড়ি ও বাঁশরী লাহিড়ি। তাঁদের পাঁচ বছরের শিশুপুত্র বাপিকে নিয়ে। অপরেশ-বাঁশরী গান গাইতেন। আর ছোট্ট বাপি তবলা বাজাত। বাবা বলত, বাপির ছোট শরীর তবলার পেছনে ঢাকা পড়ে যেত। হাত দুটো শুধু বাঁয়া আর ডাঁয়া চাপড়াচ্ছে দেখা যেত।
কথার মাঝখানে বাপিদা হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কেথায় থাক বলতো? তোমার কথায় উত্তর কলকাত্তাইয়া একটা টান আছে।’
আমি বললাম, ‘কলেজস্ট্রিট।’
আমি ততক্ষণে ড্রাইভারের সিটে। পেছনের সিটে বাপ্পা। আমার সঙ্গে ছেলের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমাদের তিনজনের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। তার মধ্যে দু’বার শট দেওয়া হয়ে গেছে। নড়েচড়ে বসে বাপিদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কলেজস্ট্রিট… কোথায় বল তো?’
আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। পারিবারিক ব্যাকগ্রাউণ্ডটা গড়গড়িয়ে উগরে দিলাম।
শিশুর মতো হাততালি দিয়ে উঠলেন বাপ্পিদা। এত বড় শরীরটা দুলে উঠল। সোনার চেনগুলো ঝমঝম করে বেজে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে বাপ্পাকে বললেন, ‘শোন শোন… কত ছোট বয়সে তবলা বাজাতে যেতাম… তোদের মনে আছে সতুবাবুর কথা বলেছিলাম… খুব রাশভারি মানুষ ছিলেন। তেমনই দিলদরিয়া… আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অন্টু (মেঘমালার ডাক নাম), নুটু (বনছায়ার ডাক নাম)… ওরা সব কী করছে… গান-টান গায়… ইস্… কত ছোটবেলার সম্পর্ক… ওরা আমার কথা বলে?’
আমি আবার ঘেঁটে গেলাম। চমকে তাকিয়ে দেখলাম ঐশ্বর্যহীন, বৈভবহীন, খ্যাতিহীন সাধারণ পাশের বাড়ির একটা দাদাকে। যে কিনা দুহাত কচলিয়ে নিজের শৈশবের দুই বান্ধবীর খবর নিচ্ছে। বললাম, ‘আপনার কথা বলে মানে! আপনি তো সারাক্ষণ ছেয়ে আছেন ওখানে। ওঁরা আপনার বাবা মায়ের গানগুলো এখনও গায়। আমি আকাই-বুস-এর ডেকে আপনার গান বাজালে অন্টুদি দোতলা থেকে চিৎকার করে বলে, বাপি ভলিউমটা বাড়িয়ে দে…’
‘আরে তোরও নাম বাপি…’ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। প্রোডাকশন…’ চিৎকার করে ডাকলেন বাপিদা। একজন ছুটে এলেন। ‘কই, আমার মাছ ভাজা কোথায়?’
‘এই তো আনছি স্যার…’ বলে সেই ভদ্রলোক দৌড় লাগালেন।
আমি ততক্ষণে ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’। বললাম, ‘ওটা আমার ডাকনাম।’
‘আরে আমারও তো! বাপ মায়ে নাম দিয়েছিল অলকেশ, বাড়িতে ডাকতো বাপি বলে। বাপিটা কখন যে বাপ্পি হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। বলে হা হা করে হাসতে লাগলেন। সমুদ্রের উচ্ছ্বাস ওঁর হাসিতে।
‘কত পুরনো কথা মনে করালি তুই, উফ ভাবা যায় না। বম্বে চলে যাওয়ার পর ওদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। আমার ফোন নম্বরটা দিস। ফোন করতে বলিস।’
কথার মাঝে দেখলাম প্রায় এক ধামা পার্সে, পোনা, ইলিশ আর পমফ্রেট ভাজা এলো। আমার চোখ ছানাবড়া। নে নে খা খা… পেছন থেকে বাপ্পা বলল, ‘মাছ পেলে বাবার আর কিছু দরকার নেই!’ একটা পার্সে মাছ আমার মুখে পুরে দিলেন বাপিদা।
‘তুই বম্বে এলেই কোনও দিকে তাকাবি না। সোজা আমার বাড়ি চলে আসবি।’
তখন ইন্টারভিউ নিতে গেলে যারা ‘বড়লোক’ সাংবাদিক সনি বা প্যানাসনিকের পকেট টেপ রেকর্ডার সঙ্গে নিতেন। আমার সাংবাদিকতার বয়স তখন সবেমাত্র তিন-চার বছর। এখন ভাবি যদি সেদিনের সেই সাক্ষাৎকার, আড্ডাটা টেপ করে রাখা থাকত!
সেদিনের মতো শ্যুটিং প্যাকআপ। বাপিদারও। পরদিন ওঁরা রওনা দেবেন। সন্ধে হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর খানা এবং পিনা শুরু হবে। তোড়জোড় চলছে। এমন সময় হোটেলের রুমের ইন্টারকমটা বেজে উঠল। রিসেপশন থেকে বলল ‘বাপ্পি লাহিড়ি’র লোক আপনাকে নিচে ডাকছে। জয়দীপ স্নানে গেছে। আমি নিচে নেমে গেলাম।
দেখি বাপিদার গাড়ির ড্রাইভার। ‘দাদা আপনাকে ডাকছেন। গাড়িতে।’ এই সেরেছে! একটু পরেই তো পার্টি শুরু হবে। ‘চলুন’, বলে ভদ্রলোকের সঙ্গে এগিয়ে গেলাম।
দেখলাম আগে পরে পুলিশের গাড়ি। মাঝে কালো কাচে মোড়া গাড়ি। ড্রাইভার ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন। ‘উঠে আয়, চ একটু সমুদ্রে হাওয়া খেয়ে আসি। আমি পেছনের সিটে বাপ্পার পাশে উঠে পড়লাম। মদ খাবি তো? ও আমি তোকে পরে খাওয়াব। বম্বে যাস চান করিয়ে দেব। (বাপিদা নিজে কিন্তু জীবনে মদ স্পর্শ করেননি।)
আমি লজ্জায় লাল হয়ে বললাম, ‘না না… ওটা এসেন্সিয়াল নয়। হঠাৎ এখন কোথায় চললেন?’
‘হাওয়া খেতে।’
বাপ্পা বলল, ‘বাবার ওই একটা নেশা। সময় পেলেই সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াবে।’
‘আরে ওটা আবরসাগর আর এটা বঙ্গোপসাগর। এর হাওয়াই আলাদা। ঢেউয়ের রিদমই আলাদা। দিঘায় আমি এই প্রথম এলাম জানিস…’
গাড়ি এসে দাঁড়াল সি বিচের ধার ঘেঁসে। পুলিশ বলল আরও এগিয়ে যেতে। না হলে মবড হয়ে যাবেন। সন্ধেতে সবাই সমুদ্রে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। পুলিশই নিয়ে গেল তুলনায় নিরিবিলি একটা জায়গায়।
আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। ‘আয় সমুদ্রের ধারে একটু বসি।’ বলে ধপ করে বালিতে বসে পড়লেন। গুনগুন করছেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী গান গাইছেন।’
‘বাবার একটা গান। ওই দোল দোল দোলে… এ দোলে ফুল দোলে… এ ঝিরি ঝিরি মিষ্টি হাওয়া…’
এতক্ষণ গুণগুণ করছিলেন। এবার গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করে দিলেন। দারুন রিদমিক গান… বাপ্পা আর আমি দু’আঙুলে টুসকি দিচ্ছি।
‘পুজোটাকে ভীষণ মিস করি বুঝলি…’ গান থামিয়ে বললেন বাপিদা।
‘মানে! আপনি তো চতুর্থী থেকে ফিতে কাটতে শুরু করেন… গোটা পুজোটা তো এখানেই থাকেন।’
‘ধুস্… ওটাকে পুজো কাটনো বলে নাকি। তোদের বাড়িতে যেরকম গানের আসর বসত… বাবা মাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে রে…’
‘বাবা আজ দুপুরে লাঞ্চ করেনি জানো প্রিয় আঙ্কেল,’ বলল বাপ্পা।
‘ইচ্ছে করল না।’
‘অত মাছ ভাজা খেলে খিদে তো মরে যাবেই’ আমি বললাম।
‘না তা ঠিক নয়, আজ বড় পুরনো কথা মনে পড়ছিল। ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা…’
‘সত্যি কথা বলুন তো বাপিদা, নুটুদি না অন্টুদি কার প্রেমে পড়েছিলেন?’
‘আবার সেই সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন ছাপিয়ে হাসি। ‘প্রেম আমি একজনের সঙ্গেই করেছি, চিত্রানী। আই লাভ হার!’
‘বউদিকে নিয়ে এলেন না কেন?’
‘ও আসতে চাইলো না। তোদের বাড়িতে একটা বড় ছাদ ছিল। আমরা খুব ছুটোছুটি করে খেলতাম। ছোটবেলাটা কেন যে হারিয়ে যায় রে? তোদের পাড়ার পুজোটা এখনও হয়? সন্ধিপুজোর সময় বাজি পোড়ায় এখনও? কী মজাই না হতো! ধুনোর ধোঁয়ায় মাকে পুরো ঢেকে ফেলেছে, মাঝে মাঝে মায়ের মুখ বেরিয়ে আসছে, যেন মেঘের আড়ালে মা দুগ্গা যুদ্ধ করছে! কী অসাধারণ মন্ত্র উচ্চারণ করতেন ঠাকুরমশাই… আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসত। বম্বেতে কোথাও আমি এমন পরিবেশ পাইনি। মঙ্গলদীপ জ্বেলে গানটা যখন আমি সুর করি তখন তোদের পাড়ার সন্ধি পুজোর ছবিটা চোখে ভেসে উঠছিল। বিশ্বাস কর একটা নিরিবিলি পুজো পাই না, যেখানে গিয়ে দু’দণ্ড শান্তিতে বসবো, মাকে একটা গান শোনাবো।’
‘আপনি নিজে তো বাড়িতে পুজো করতে পারেন?’
‘পাগল!’
‘বাবাকে কতবার বলেছি, রাজি হয় না’, বাপ্পা পাশ থেকে বলল।
‘না না, ওসব পুজো-ফুজোর অনেক ঝামেলা, আমার ইচ্ছে আছে একটা মন্দির বানানোর। মা দুগ্গাকে প্রতিষ্ঠা করব। সন্ধিপুজোর মতো রোজ ধুনোয় অন্ধকার করে মায়ের পুজো হবে। মায়ের ওই গানটা গাইব, ‘হিসাব যদি চাইবি মাগো’’ গাইতে শুরু করলেন বাপিদা।
কিন্ত শান্তি চাইলেই কি আর শান্তি জোটে! বিশেষ করে ‘বাপ্পি লাহিড়ি’র মতো আন্তর্জাতিক স্তরের সেলিব্রিটির! ভিড় বাড়ছে। ছ’সাতজন পুলিশের পক্ষে উৎসাহিদের আটকানো মুশকিল। তার উপর শরীর ভর্তি সোনা!
অফিসার কাঁচুমাচু মুখে বাপিদার দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘স্যার মবড হয়ে যাবেন। প্লিজ…’
‘কোথাও দু’দণ্ড নিজের মতো করে বসার জো নেই রে… নে হাতটা ধর তো বাপিবাবু!’ বলে বাপ্পা আর আমার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে পড়লেন বাপিদা।
‘আমাকে বাপ্পিদা বাপ্পিদা করবি না তো, স্রেফ বাপিদা। ওকে?’
‘ওকে স্যার!’ স্যালুট ঠুকলাম।
অটোগ্রাফ শিকারিরা নাছাড়োবান্দা। বাপিদাই বললেন লাইন দিয়ে দাঁড়ান। বলে অপরেশ লাহিড়ির ‘লাইন লাগাও’ গানটা গাইতে শুরু করলেন। সেদিন প্রথম ও শেষবার দেখলাম কোনও সেলিব্রিটি লাইনে দাঁড়ানো মানুষের কাছে গিয়ে নিজে সই বিলোচ্ছেন। গাড়ি পর্যন্ত গিয়ে দরজা খুলে টুক করে উঠে পড়লেন। বললেন, ‘চলে আয়।’
তারপর থেকে টানা পঁচিশ বছর বাপিদার সঙ্গে যেখানে যখন দেখা হয়েছে আমাকে ‘এই যে কলেজস্ট্রিটের বাপিবাবু’ বলে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছেন। আর আমিও কখনও বাপিদাকে বাপ্পিদা বলে ডাকিনি।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অসাধারন । অনেক অজানা তথ্য জানতে পেলাম ।
Ki je bhalo laglo pore…opurbo!