micro-story-agantuk

আগন্তুক
মানস দে



দ্বিতীয়বার আবার যখন কলিং বেলের আওয়াজ হল, দরজা খুলে দেখে এক সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে।
মুখ ভর্তি হাসি।
– আমি স্কট। বছর পঁচিশেক আগে এই বাড়িতে আমি থাকতাম।
– তাই নাকি? এটা আপনার বাড়ি ছিল? আমরা তো বছর পাঁচেক আগে এই বাড়িতে মুভ করেছি।

– এই বাড়ি বিক্রি করে আমরা ফ্লোরিডা চলে যাই। আটলান্টায় এক বন্ধুর বাড়িতে এসেছিলাম। ভাবলাম একবার ঘুরে যাই।
– ভালো করেছেন।
– আমি কি একবার বাড়িটা ঘুরে দেখতে পারি?
– নিশ্চয়।

স্টিভ ভেতরে আসার অনুমতি দেয় স্কটকে। ভেতরে এসে সব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখে। জিজ্ঞেস করে – “আমি কি একবার ওপরে যেতে পারি?” অগোছালো বাড়িতে এক আগন্তুককে ওপরে যেতে দেওয়ার
মন চায় না স্টিভের স্ত্রী জেসিকার। জেসিকা নিমরাজি ভাবে বলে – “ঠিক আছে।“

ওপরের ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে নিচে নেমে আসে স্কট। মুখে সর্বদাই একটা স্মিতহাসি লেগে, কোন
শান্ত শীতল সকালের প্রথম রোদের মত। কথা বলার সময় বেশ আস্তে আস্তে প্রতিটি কথা যত্ন সহকারে অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তির দিকে নিক্ষেপ করেন। শোনেন বেশি, তুলনায় বলা অনেকটাই কম। জেসিকার দিকে তাকিয়ে বলেন – “খুব সুন্দর করে রেখেছ বাড়িটাকে। বাড়ির রঙের সঙ্গে ফার্নিচারগুলো
খুব সুন্দর মানিয়েছে। তার থেকেও সুন্দর বাড়ির লোকজন। আমাকে এভাবে বাড়িতে প্রবেশের
অধিকার দেবার জন্যে ধন্যবাদ।”
স্টিভ বলে “আমাদের এখন ডিনার টাইম। তুমি যদি আমাদের সঙ্গে ডিনার কর তবে বেশ খুশিই হব।”স্কট প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়। ডিনারের ঠিক আগে ওদের সাতবছরের মেয়ে টিনা বাড়িতে ফেরে। ওর বন্ধুর বাড়িতে ছিল।

ডিনার টেবিলে স্কটকে দেখে টিনা প্রথমে একটু অবাক হয়ে যায়। আগে তো কখনো দেখেনি।
স্টিভ ওকে সব কথা খুলে বলে। স্কট টিনাকে বলে – “আমি খুব লজ্জিত যে তোমার জন্যে কিছু আনতে
পারিনি। বুঝতে পারিনি এই বাড়িতে তোমার মতো একটা সুন্দর মিষ্টি মেয়ে আছে।” ডিনারের
পর স্কট বলে – “তোমাদের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ।” তোমাদের কাছে আমার একটা শেষ অনুরোধ
আছে। তোমাদের যে সেই অনুরোধ রাখতেই হবে তা নয়। স্টিভ বলে – “ঠিক আছে, আপনি বলুন না
আগে।” স্কট বলে – “আজ রাতটা আমি এই বাড়িতে কাটাতে পারি? বিশেষ করে ওপরে সিঁড়ির পাশে
ছোট্ট ঘরটিতে। ওটা আমার মেয়ের রুম ছিল।”

এবার যেন মনে মনে একটু বিরুক্তই হয় স্টিভ। লোকটার মতলব কি? প্রথমে বাড়িতে আসতে চাইল, যাইহোক ভদ্রতা বশত ওঁকে ডিনারে বলা হল। এখন নিজে থেকে থাকতে চাইছে। স্কট বোধহয় স্টিভেরমুখ দেখে আঁচ করতে পেরেছিল যে ও খুব একটা খুশি হয়নি এই অনুরোধে। মানুষটাকে দেখে
জেসিকার যেন একটু দয়া হয়। অদ্ভুত এক সারল্য আছে মুখটায়। প্রতিটা কথা মনে হয় অন্তরের
অনুভূতিগুলো ভেতর থেকে ধীরে ধীরে উঠে এসে ভাষা পাচ্ছে। তেমন একজনকে মুখের ওপর না
বলতে ঠিক ভালো দেখায় না যেন। তাই স্কটের অস্বস্তি অগ্রাহ্য করেই জেসিকা বলে – “ঠিক আছে।
আপনি ওই রুমেই না হয় আজ রাত কাটাবেন।” বলে তো দিল তবুও মনের মধ্যে কেমন জন্ম নিল
একটা ছোট্ট আশঙ্কা। যতই হোক অচেনা আগন্তুক।

স্টিভকে দেখে মনে হল স্কটকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। কে জানে কার কি মতলব। ড্রয়ার থেকে পিস্তলটা
বের করে বালিশের নিচে রাখে। মোবাইলটা বালিশের পাশে। স্টিভের ঘুম আসে না। হটাৎ করে রাত
প্রায় দুটো দরজা খোলার শব্দে স্টিভ বিছানায় উঠে বসে হাতে পিস্তলটা নিয়ে। কিছুক্ষন পর বাথরুম
থেকে ফ্লাশের আওয়াজ হয়। তারপর আবার দরজা বন্ধ।

সকাল হতে না হতেই স্টিভ ও জেসিকা নিচে নেমে আসে। ওদেরকে দেখে আবার সেই একই রকম
স্মিত হাসি হেসে স্কট বলে – ” সুপ্রভাত। কিন্তু তোমাদের মনে হয় ভালো করে ঘুম হয়নি।
আমার জন্যেই বোধহয়।” স্টিভ কিছু বলতে গেলেই স্কট কফির কাপটা বাড়িয়ে দেয়। ওদের জন্যেই
আগে থেকেই কফি বানিয়ে রেখেছিল। কফির কাপটা হাতে নিয়ে স্কট ব্যাকইয়ার্ডে আসে, একটা
আপেল গাছের নিচে। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে। ফিরে এসে বলে – “আমার মেয়ের হাতে লাগানো
গাছ।”

জেসিকা জিজ্ঞেস করে “আপনার মেয়ে কোথায় থাকে এখন?” কিছুক্ষন ঘাড়টা নিচু করে রেখে আস্তে আস্তে ওপরে তোলে স্কট। বলে – ” আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে, ওর যখন কুড়ি বছর বয়েস,
হটাৎ করে এক দুর্ঘটনায় ওকে আমরা হারাই। ওই রুমটায় ও থাকত ছোট থেকে। কাল রাতে ওর সঙ্গে অনেক কথা বলেছি। আজ ওর জন্মদিন ছিল।” হটাৎ করে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় আছন্ন হয়ে যায় ওরা
সবাই। বাইরে তখন নিয়ম মেনে সকাল হচ্ছে। স্কট উঠে দাঁড়ায়। বলে – “এবার আসি।” জেসিকা,
স্টিভ বজ্রাহত। সময়টা যেন একটু হলেও থমকে যায়। সরি বলার ক্ষমতাটুকুও ওদের নেই। তবুও
জোর করে একটা সরি বলার চেষ্টা করে আবার নীরবতায় ডুবে যায় ওরা। এক ভাঙাচোরা শরীর ধীরে ধীরে পা রাখে দরজার বাইরে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *