micro-story-anuranan

অনুরণন
বিতস্তা ঘোষাল


বাঁ হাতটা ডান হাতের কনুইতে রেখে ডান হাতের আঙুলে সিগারেট ধরিয়ে রাস্তার ধারে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে গভীর কোনও ভাবনায় ডুবে শ্রেয়ান। পরনে নীল সিল্কের শার্ট, সাদা প্যান্ট। কাঁধে ঝুলছে কালো লেদারের ব্যাগ। সিগারেট নিয়ে এমন ভাবেই তাকিয়ে, দেখে মনে হচ্ছে সে দৃষ্টি এই পার্থিব জগতের কোনো কিছুর মধ্যেই নিবদ্ধ নয়। যেন অচেনা কোনো জগতের সঙ্গে এই মুহূর্তে তার যোগ তৈরি হয়েছে, সেখানে এই পৃথিবী, আশেপাশের কোনও কিছুই তাকে প্রভাবিত করছে না।
সীমন্তিনী গাড়ি থেকে নামার আগেই লক্ষ করেছিল শ্রেয়ানকে। তার ইচ্ছে করছিল ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার কাছে গিয়ে তাকে ছুঁতে, গায়ের গন্ধ নিতে। শ্রেয়ানের গা দিয়ে একটা পারফিউমের গন্ধ নাকে আসে। এই গন্ধটা তার জীবনের প্রথম পুরুষের গা দিয়েও আসত। শুধু এই ঘ্রাণ পাওয়ার জন্য কতবার সে যেন পা হড়কে গেছে, এমনভাবে তার গায়ের দিকে কাত হয়েছে। আর পুরুষটি তাকে ধরে নেবার ভঙ্গিতে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছে। ঘ্রাণের পাশাপাশি সে নিজের ও তার ধুকপুকানির শব্দ শুনেছে, শিহরিত হয়েছে। কয়েক মুহুর্ত ওভাবেই থাকার পর লাজুক মুখে সরে দাঁড়িয়েছে মাথা নীচু করে। সেই আকাঙ্খিত পুরুষ অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে সিগারেট বের করে সামান্য উদ্বিগ্ন স্বরে বলেছে- পাগলি একটা। ঠিক করে দেখে পথ চলতে পারিস না? এখনি দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল।
সীমন্তিনী মনে মনে বলত, এভাবেই থাকতে চাই আজীবন।
সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে সেই পুরুষ আর তার রাস্তা কখন বদলে গেছে, আর একমুখো হয়নি। দুজনেই এখন বিবাহিত। দুটি আলাদা দেশের বাসিন্দা। সীমন্তিনী মাঝে মাঝে তার ফেসবুক প্রোফাইল লুকিয়ে দেখে, সেই উজ্জ্ব্ল আলোমাখা চোখ, উচ্ছ্ব্ল হাসি, স্লিম, কোঁচকানো চুলের পুরুষটিকে আর খুঁজে পায় না। একজন মাঝ বয়স্ক, প্রায় টাক মাথা, এক ক্লান্ত মুখ চোখে পড়ে। এ মুখের সঙ্গে তার কখনো পরিচয় ছিল কিনা এটাই সে ভেবে পায় না।
গাড়ি থেকে নেমে সীমন্তিনীর ইচ্ছে হল শ্রেয়ানের সামনে গিয়ে কথা বলতে। সেই অল্প বয়সের কিশোরীর মতো পা স্লিপ করে তার গায়ে ঢলে পড়তে। নিজেকে সংযত করে নিল। আফটার অল শ্রেয়ান তার অফিস কলিগ। আড়চোখে শ্রেয়ানের দিকে তাকিয়ে যেন দেখতেই পায়নি এমন ভাবে হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
বেশ খানিকক্ষণ বাদে শ্রেয়ান এলো। আজ তার সঙ্গে জরুরী মিটিং আছে নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে। সীমন্তিনী সিসিটিভি দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল শ্রেয়ান সিঁড়ি দিয়ে উঠল, তার করিডরে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা মুখ থেকে সরিয়ে কোনায় ফেলল। এবার তার ঘরের দিকে আসছে।
আসব?
সে দরজার দিকে না তাকিয়েই কম্পিউটার মনিটরে চোখ রেখে উত্তর দিল, এসো।
সামনের চেয়ারে এসে বসা মাত্র সেই পুরোনো গন্ধটা নাকে এল। সীমন্তিনীর শরীর জুড়ে অজানা জলতরঙ্গ বেজে উঠল।
তুমি তো আমার সামনে দিয়েই এলে, দেখতে পেলে না আমাকে?
তুমি কোথায় ছিলে?
আমি অবাক হয়ে গেলাম তুমি গাড়ি থেকে নেমে এমনভাবে চলে এলে। আমার দিকে তাকালেও না।
এমা! ছি ছি! আমি আসলে অফিসে ঢোকার সময় কোনো দিকে তাকাই না। কিছু মনে কোরো না।
শ্রেয়ান হাসল। সীমন্তিনীর মনে হল তার দুজনেই এতদিন ধরে যে লুকোচুরি খেলাটা খেলছিল, সেটা শেষ হয়ে আসছে। সে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল উল্টোদিকে। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। কানের সামনে মুখ নিয়ে গিয়ে কোনোরকম প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই শ্রেয়ানের ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটের মধ্যে নিয়ে খামচে ধরল তার শার্ট।
শ্রেয়ানের শরীর সাড়া দিচ্ছে ক্রমশ। সেও আকঁড়ে ধরছে সীমন্তিনীকে। তার হাত সীমন্তিনীর বুকে। সে চেষ্টা করছে ভেতরে ঢোকার।
ঠিক সেই মুহূর্তেই সীমন্তিনীর সব কামনা, উত্তেজনা স্থিমিত হয়ে গেল। মনের মধ্যে যে শব্দটা কুলকুল করে একটু আগেও বইছিল হঠাৎ যেন শান্ত মাঝ নদীতে হারিয়ে গেল। তার মনে হল সে ডুবে যাচ্ছে চোরাস্রোতে। সেখান থেকে আর ফেরা হবে না তার।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “micro-story-anuranan

Leave a Reply to Aditi Chakraborty Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *