micro-story-bemanan

বেমানান
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

 

ফুল, থার্মোকল, জরি, চুমকির মালা — এইসব দিয়ে সাজানো মঞ্চটা ঝকঝক করছে। মাঝখানে কয়েকটা চেয়ার, একধারে একটা টেবিলের ওপর বেশ কিছু মেমেন্টো সাজানো।

গোটা মঞ্চ প্রায় ফাঁকা, শুধু মঞ্চের ডানদিকে একজন স্বেচ্ছাসেবক দাঁড়িয়ে মাইকে নানা ঘোষণা করে চলেছে। কখনও বিশিষ্ট অতিথিদের নাম বলছে, কখনও আজকের অনুষ্ঠানের বিষয়ে জানান দিচ্ছে।

ঠিক তখন মঞ্চের সামনে, যেখানে বিরাট মাঠটায় সারি সারি চেয়ার পাতা ছিল, তার প্রথম সারিতে শুধুমাত্র একজন লোক বসে ছিল। তার গায়ে শতচ্ছিন্ন একটা জামা, পরনে ছেঁড়া রংচটা একটা প্যান্ট, মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ।

লোকটা একটু সকাল সকালই এসে পড়েছে এখানে। কারণ তার মনে একটাই টেনশান কাজ করছিল, যদি দেরি হয়ে যায়? যদি সেই কারণে সুযোগটা ফস্কে যায়? কতদিন বাদে দুপুরে একটু পেটভরা খাবার জুটবে, এ সুযোগ কি ছাড়া যায়?

আসলে এখানে আজ একটা উৎসব হচ্ছে। রক্তদান উৎসব। স্থানীয় ক্লাব জনকল্যাণ সংঘের উদ্যোগে প্রতিবছরের মতো এ বছরেও এই রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে, আর লোকটা সেখানেই এসেছে রক্ত দিতে।

এ ছাড়া আর কী করবে সে? নির্দিষ্ট কাজকর্ম বলতে তো কিছু নেই তার। যেদিন যেভাবে পারে, একবেলা কি আধবেলা জুটিয়ে নেবার চেষ্টা করে। একটা তো পেট। ঘরেও তো কেউ নেই তার। আর ঘরই বা কী! একটা কারখানায় রাত্রে চট পেতে শোয়। অতএব আগুপিছু টানও কিছু নেই তার।

এইবার একটু একটু করে লোক জমতে শুরু করেছে। অতিথিরাও এক-দুজন করে হাজির হচ্ছেন। তাঁদের নাম ধরে ডেকে সাদরে মঞ্চে তুলে চেয়ারে বসানো হচ্ছে। সবাই এসে গেলে অতিথিবরণ, তারপর অতিথিদের বক্তব্য পেশ হয়ে গেলে তবেই রক্তদান অনুষ্ঠান শুরু হবে। পাশে ক্লাবঘরের ভেতরেই রক্তদানের আয়োজন করা হয়েছে। দুটো বেড আর রক্ত সংগ্রহ করার সব সরঞ্জাম রেডি। দুজন ডাক্তার আর একজন নার্সও ইতিমধ্যেই এসে গেছেন।

তবু অনুষ্ঠান শুরু হতে দেরি হচ্ছে। কারণ আজকের অনুষ্ঠানের মূল যে হোতা, সেই প্রধান অতিথিই এখনও এসে পৌঁছননি। সেই বিশিষ্ট মানুষটি হলেন এই এলাকার বিধায়ক — রাসবিহারী চৌধুরী। খবর পাওয়া গেছে, তিনি রাস্তায় আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বেন। আর তারপরেই অনুষ্ঠান শুরু।

এইবার ডাক এল। মঞ্চ থেকে ঘোষক বলে উঠলেন, “একটি ঘোষণা। আজকের রক্তদান শিবিরে যে সকল ব্যক্তি রক্ত দেবার জন্য উপস্থিত হয়েছেন, তাঁরা দয়া করে মঞ্চের পাশে চলে আসুন। এখানে খাতায় তাঁদের নাম রেজিস্ট্রি করে যান। তারপর রক্তদান শুরু হলে একে একে গিয়ে তাঁরা রক্ত দিতে পারবেন।”

ঘোষণা শুনে মাঠের মধ্যে এদিক ওদিক থেকে অনেকেই উঠে দাঁড়াল। লোকটাও ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। আর তখনই তার আশপাশের লোকেদের নজর পড়ল তার দিকে। এইসব সুসজ্জিত ভদ্রলোকদের মধ্যে লোকটা বড়ই বেমানান। তবে সেসব দিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ না করে সে এগিয়ে গেল মঞ্চের পাশে টেবিলটার দিকে, যেখানে রেজিস্ট্রেশান শুরু হয়েছে। গিয়ে লাইন দিয়ে সে দাঁড়াল ভদ্রলোকদের মাঝে, মূর্তিমান বেমানান হয়ে।

ঠিক সেই সময় বিধায়কের গাড়িটা এসে দাঁড়াল মঞ্চের একদম কাছে। কিছু পুলিশ আশেপাশেই ছিল, তারা চটপট এসে জায়গাটা ঘিরে ফেলল। তাদের মধ্য দিয়ে সঙ্গীসাথী সমেত বিধায়ক এগিয়ে এলেন মঞ্চে উঠবেন বলে। আর ঠিক তখনই তাঁর নজর পড়ল মঞ্চের পাশে লাইনটার দিকে। ক্লাবের যে কর্মকর্তা পাশেই ছিলেন, ভুরু কুঁচকে তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন বিধায়ক। সে উত্তর দিতেই বিধায়কের ভুরু আরও কুঁচকে গেল। লাইনের মধ্যে থেকে লোকটার চোখে পড়ল, বিধায়ক যেন একদৃষ্টে তাকেই লক্ষ্য করছেন। কে জানে, ঠিক না ভুল। তবে এর পরেই বিধায়ক গলা নামিয়ে কিছু একটা বললেন, তারপর দ্রুতপায়ে মঞ্চে উঠে গেলেন।

ঠিক তারপরেই সবাই দেখল, দুটো পুলিশ এসে লাইনের মধ্যে থেকে শুধু ওই লোকটাকে বার করে নিল। তারপর তাকে ঠেলতে ঠেলতে মাঠের বাইরে নিয়ে চলল। লোকটা অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ বাধা দেবার চেষ্টা করল, তারপর চুপ হয়ে গেল। পুলিশগুলো তাকে একেবারে এই অনুষ্ঠানের ত্রিসীমানা থেকেই বার করে দিয়ে এল।

 

 

এরপর কেটে গেছে প্রায় সাত-আটটা মাস। সমাজটা এখন বেশ অস্থির। চারিদিকে নানা ঝামেলা, অশান্তি। মানুষের মনে সুখ নেই, পকেটে পয়সাও নেই। তবে লোকটা এখনও বেঁচে আছে। একবেলা কিংবা আধবেলা খেয়েই বেঁচে আছে। এখনও সে সেই ছেঁড়া রংচটা পোশাক পরেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায় খাবারের খোঁজে।

সেদিন এরকমই ঘুরতে ঘুরতে সে হঠাৎ একটা ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেল। সামনে ভোট, তাই নানা ছোটবড় সভা সমিতি চলছে চারিদিকে। সেরকমই একটা মিটিংয়ে হঠাৎ বোমাবজি শুরু হয়ে গেল। লোকটা কোনরকমে সেখান থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালাচ্ছিল। এমন সময় তার চোখের সামনেই একটা ধুতি পাঞ্জাবী পরা মানুষ বোমার ঘায়ে ছিটকে পড়ল রাস্তায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই চারপাশটা শুনশান হয়ে গেল। যে যেখানে পারে পালিয়েছে, শুধু আহত মানুষটা পড়ে পড়ে কাতরাচ্ছে।

লোকটা এখন কী করবে? পালালেই সে বেঁচে যাবে, কিন্তু এ তো বাঁচবে না। কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর এদিক ওদিক তাকাতে চোখে পড়ল একটা ভ্যানগাড়ি। গাড়ির মালিক প্রাণভয়ে চম্পট দিয়েছে। লোকটা একার চেষ্টাতেই মানুষটাকে কোনরকম ভ্যানে তুলল, তারপর হাসপাতালের দিকে নিয়ে চলল। তবে ভ্যানে তোলার সময় সে মানুষটাকে চিনতে পেরেছে। সেই বিধায়ক, রাসবিহারী চৌধুরী।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “micro-story-bemanan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *