micro-story-daiboddhota

দায়বদ্ধতা
ছন্দা বিশ্বাস


প্রতিদিনের মতো সেদিনও হুইল চেয়ারটা ঠেলতে ঠেলতে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালেন শিলাদিত্য।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবো হবো করছে। পাখিরা যে যার জায়গায় ফিরে এসেছে। নদীটা বয়ে চলেছে শব্দ কলস মুখে নিয়ে। বিয়ের পরে জিনিয়া প্রায়ই বলতেন আমাদের যদি নদীর ধারে একটা বাড়ি থাকতো।
খুব বেশীদিন লাগেনি জিনিয়ার এই স্বপ্ন পূরণ হতে।
শিলাদিত্যের এমন এক জায়গায় সেবার বদলি হল যে শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা নদী। নদীটার নাম সুধানীর। বেশ শান্ত ধীর গতিতে বয়ে চলেছে নদীটা। যেন কোনো তাড়া নেই, আবার অখন্ড অবসরও নেই। ছুটে চলার তাগিদ না থাকলেও তার একটা দায়বদ্ধতা আছে তাই সে এগিয়ে চলেছে।
সূর্য অস্ত গেছে বেশ কিছু সময়। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে চারপাশে।
শিলাদিত্য হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে ঘরের দিকে এলেন।
হাউজ কীপার রমলা বলল, রাখুন স্যার আমিই ম্যাডামকে উপরে নিয়ে যাচ্ছি।
আপনি যান, ফ্রেশ হোন।
শিলাদিত্য উপরে উঠে যান। মেয়ে এবারে তাকে নিয়ে চলে যাবে। মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার কথা বলছে বেশ কিছুদিন ধরে। সেই মতো দুর্গাপুরে একটি নামী বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে কথাও বলেছে। আজ রাতে ফাইনাল ওপিনিয়ন জানিয়ে দেবে।
শিলাদিত্য আর জিনিয়ার একমাত্র মেয়ে জিয়া মেক্সিকোতে থাকে। আগে সান ফ্রান্সিস্কোতে থাকাকালীন জিনিয়াকে নিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে এসেছেন। মেক্সিকোতে আছে তাও প্রায় ছয় সাত বছর হয়ে গেলো। কিন্তু একবারের জন্যেও যাওয়া হয়নি। জিনিয়ার বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতিতে এখন আর কিছুতেই সম্ভব নয়।
মাকে নিয়ে মেয়ের কোনো চিন্তা নেই। যত চিন্তা বাবাকে নিয়ে।
জিয়া আল্টিমেটাম দিয়েছে, এবারে এসে বাবাকে নিয়েই যাবে।
“এভাবে বৃদ্ধ বয়েসে তোমাকে কিছুতেই ফেলে রাখব না।”
মেয়ের গলায় অভিমানী সুর।
আজ রাতে ফোন করে জিয়ার সেই একই অভিযোগ,”তোমার খুব কষ্ট হয়ে যায় বাবা।”
“কীসের কষ্ট?”
“এই যে সারাটাদিন মায়ের দেখভাল কর?”
“কষ্ট মনে করলেই কষ্ট। আমার কিন্তু এক বারের জন্যেও সেটা মনে হয় না।”
“বাবা, এই যে তুমি মায়ের জন্যে এতো করছ মা কি তা বুঝতে পারছে?
মা একজন সেনাইল ডিমেনশিয়ার পেশেন্ট। মার কোনো স্মৃতিই নেই। কাউকেই মা এখন চিনতে পারে না। মা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। মা মা বলে কতো ডেকেছি বুকের ভিতরে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছি। মার দুই চোখে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই দেখিনি। বাবা, শুধু শুধু তুমি কষ্ট করে চলেছ। কী লাভ বাবা? যার জন্যে এতো কষ্ট করছ সেই যদি তার কিছুই না বোঝে তবে বৃথা এই কষ্ট করা।”
শিলাদিত্য গোপনে গভীর একটা শ্বাস ছাড়েন। এবারে কি তবে জিনিয়ার সঙ্গে তার সারা জীবনের মতো ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে? আর কি কখনো ফিরে আসতে পারবে?
শিলাদিত্য বেশ কিছু সময় নীরব রইলেন।
তারপরে আস্তে আস্তে বল্লেন, “জিয়া, তোর মার সঙ্গে আমার সম্পর্ক চল্লিশ বছরের। তোর মার স্মৃতি লোপ পেয়েছে বছর চার পাঁচ হল। প্যারালাইসিসের জন্যে আজকাল হাঁটাচলা করতেও পারেন না। এর আগের দিনগুলোতে কিন্তু আমরা সুখী দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে এসেছি। তুই তো জানিস আমাদের ভিতরে কোনোরকম দাম্পত্য কলহ ছিল না। আমি যেমন তোর মাকে ভালোবাসতাম বিশ্বাস করতাম , তোর মারও আমার উপরে ছিল অগাধ বিশ্বাস এবং গভীর শ্রদ্ধাবোধ।
তোর মার এখন স্মৃতি লোপ হয়েছে কিন্তু আমার তো স্মৃতি লোপ পায়নি।
এখনো তোর মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আমি দুদন্ড শান্তি খুঁজি।
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে শিলাদিত্যের ঠোঁট কেঁপে উঠল।
শিলাদিত্য কিছুটা সময় নিলেন। তারপরে বল্লেন, এতো সব কিছুর পরেও বলছি জিয়া, আসলে তোর মায়ের প্রতি আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে। বলতে পারিস স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ববোধ। আমাদের সম্পর্কের কাছে দায়বদ্ধ আমি।
এ আমার দায় বলে ভাবিস না কক্ষণো, তোর মাকে করুণা করছি সেটাও মনে আনিস না। ভাবিস এটা আমার দায়িত্ব, আমার কর্তব্য।
বাবার কথাগুলো তখন আকাশ ছুঁয়েছে। জিয়া কথা হারিয়ে ফেলেছে। জলের ধারায় চিবুক ভেসে যাচ্ছে ওর।
বলল, “বাবা, আমি কাঁদছি তোমার মতো এমন মহান মানুষের সন্তান হয়েও কীভাবে এতো নিষ্ঠুর হলাম!
ভেবেছিলাম তুমি বোধ হয় আমার প্রস্তাবে রাজী হবে।”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “micro-story-daiboddhota

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *