micro-story-gantobyohin

গন্তব্যহীন গন্তব্যে
শফিক হাসান


মম’র আম্মু দরজায় তালা দিয়েছেন, লক শেষে তালাটা কাঠের দরজায় বাড়ি খেয়ে কিঞ্চিৎ শব্দ করল; সেই প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সামনে দেখলেন রহমানকে। সিঁড়িতে নিশ্চল দাঁড়িয়ে। বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে বললেন, স্যার, আজ তো শুক্রবার। মম’র বন্ধের দিন। আপনি ভুল করে চলে এসেছেন নাকি!
বিব্রত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রহমান। নিচু করা মাথাতেই দেখতে পেল, মম’র বাবা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। শুষ্ক কণ্ঠে বলল, সামনে তো মম’র পরীক্ষা। ভাবলাম, একটু বেশি করে পড়ালে যদি…।
রহমানের কথা কেড়ে দিয়ে মম বলল, কী বলছেন, স্যার! গত মাসে না আমার পরীক্ষা শেষ হল! এখন জানুয়ারি মাস।
মম’র বাবা বিরক্তি চেপে বললেন, আমরা চিড়িয়াখানায় যাচ্ছি। সময় থাকলে আপনিও চলুন না!
রহমান বলল, আপনারাই যান। আমি অন্যদিন যাব।

তবুও সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বিষয়টা লক্ষ করে মম’র মা বললেন, আর কিছু বলবেন?
না, মানে… একগ্লাস পানি খেতাম। অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছি তো।
মনে বিরক্তি নিয়ে ভদ্রমহিলা ফের তালা খুললেন। ভেতরে ঢোকার সময় চাইনিজ তালাটা অহেতুক ঠোকর খেল দরজার ধাতব হাতলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি একগ্লাস পানি এনে দিলেন রহমানের হাতে। রহমান ঢকঢক করে খেয়ে বলল, আরেক গ্লাস খাব!
আরেক গ্লাসের বদলে পানি এল মগসহ। আরও দুই গ্লাস শেষ হল। কিন্তু পানি খেয়ে কি আর ক্ষুধা মেটে! মেসে অনেক টাকা বাকি পড়েছে। গত তিন মাসে তিন টাকাও দিতে পারেনি সে। ছয় সদস্যের বাসার বাকি পাঁচ রুমমেট বাধ্য হয়ে রহমানের খাবার বন্ধ ঘোষণা করেছে। সমুদয় বকেয়া পরিশোধ করলে সচল হবে আবার। ওর বাকির বোঝা বইবে কে। সবাইকে পাই পাই করে টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়। গতকাল রাতে খাবার জোটেনি। জুটেছে গালমন্দ, ফকিরনির বাচ্চা গালি। সকালে ক্ষুধার্ত পেটে যখন রান্নাঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করছিল, মেস ম্যানেজার মঞ্জুর ভাই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, তোর লজ্জা করে না, রহমান! টাকা না দিয়ে আরও গিলতে চাস?
শার্টটা গায়ে গলিয়ে রহমান হাঁটা দিয়েছে মমদের বাসার উদ্দেশে। মম’র মা ভালোই নাস্তা দেন। এক নাস্তাতেই পেট ভরে যায়। মিটে যায় ভাতের ক্ষুধা। চলতি মাস থেকে মমকে পড়ানোর দায়িত্ব পেয়েছে সে। তিন সপ্তাহ পার হয়েছে। আরও দিন দশেক গেলে হাতে আসবে তিন হাজার টাকা। তখন মেসের টাকা কিছুটা শোধ করতে পারবে। কিন্তু ভাড়া ও খাওয়ার বিল মিলে যে টাকা জমেছে, সেখানে তিন হাজার টাকা কিছুই না। অন্য কোনো জায়গা থেকে টাকা পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। ভাগ্যিস, টিউশনিটা ঠিক করে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই। নইলে এই ক্ষুদ্র স্বপ্নটাও থাকত না চোখের সামনে। আরেকটা টিউশনি জোগাড় করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাস্তায় নেমে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখল আবদুর রহমান। অপারেশন করে পেটে যদি কিছু পাথর ঢুকিয়ে দেওয়া যেত। সেই পাথর শুষে নিত সব ধরনের ক্ষুধা-তৃষ্ণা। বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে সত্য; কিন্তু ক্ষুধা নিবারক কিছু দিতে পারেনি এখনো। ক্ষুধার জ্বালা না থাকলে কুকুর-বেড়ালের পাশে শুয়েও রাত-দিন কাটিয়ে দেওয়া যেত দিন।
দুপুর গড়িয়েছে ততক্ষণে। দুশ্চিন্তা বুকে নিয়ে রহমান হাঁটা শুরু করল নিজেদের গ্রামে আক্কাস ভাইয়ের বাসার দিকে। ভাই হয়ত এখন অফিসে আছেন। দুইদিন কিছুই খায়নি সে, এটা বললে ভাবি নিশ্চয়ই মেস মেম্বারদের এতটা পাথর হয়ে থাকতে পারবে না। নারী মানুষ মায়ের জাত। এদের মনে দয়া-মায়া থাকে। কিন্তু বাসার সামনে গিয়ে আর স্থির থাকতে পারল না। মাথা ঘুরে পড়ে গেল। দশাসই একটা তালা ঝুলছে দরজায়।


দুই


আজ মম’কে পড়ানো শেষে ফেরার সময় ভাবি হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা খাম। বললেন, আপনার গত মাসের বেতন।
কম্পিত হাতে খামটা নিল রহমান। জীবনের প্রথম উপার্জন। বাবা-মা কাছে থাকলে তাদের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যেতে পারত। রাস্তায় নেমে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না সে। আঙুল সেঁধিয়ে দিল খামের ভেতরে। এ কী, দুই হাজার একশ’ টাকা কেন? তাকে তো তিন হাজার টাকা দেওয়ার কথা!
আবার ফিরে এল রহমান। মমকে কোথাও দেখা গেল না। ওর মা বললেন, আবার পড়াতে এসেছেন নাকি! পরীক্ষার কিন্তু দেরি আছে।
ইয়ে… ভাবি, আপনি আমাকে কত টাকা দিয়েছেন?
একুশ শ’ টাকা। তিন হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল না?
সেটাই বহাল আছে। নয় শ’ টাকা নাস্তা বাবদ কেটে রাখা হয়েছে।
মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল রহমানের, নাস্তার বিল! আপনারা হোটেল খুলেছেন কবে?
হোটেলের হিসাব করলে এই নাস্তার দাম হত ষাট টাকা। আপনার কী মনে হয়, ত্রিশ টাকা বেশি কাটা হয়েছে?
কিন্তু এভাবে নাস্তার বিল কেটে রাখা হয়, এমনটা কখনো শুনিনি।
ছাত্র মানুষ। আরও অনেক কিছুই আপনার শোনার-জানার বাকি আছে এখনো।
আপনাদের টাকা লাগবে না, ভাবি। রেখে দিন। মনে করেন, এতদিন আমি ফ্রিতেই পড়িয়েছি।
ভাবিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না রহমান। খামটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাইরে চলে এল। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর শার্টের ফাঁকা পকেট। আজ কী বলবে মেসে! খাবার বন্ধ আছে এখনো, কিন্তু বাসা ভাড়ার টাকা তো দিতে হবে।
মেসে ফিরে রহমানকে কিছুই বলতে হল না। মঞ্জুর ভাই বললেন, আমরা টু লেট সাঁটিয়েছি বিভিন্ন রাস্তায়। তুই এখনই চলে যা। অন্য কোথাও উঠে তাদের গলা কাট। সব টাকা মাফ করে দিলাম।
স্তম্ভিত হয়ে রহমান বলল, এসব কী বলছেন ভাই?
আমি বলছি না, সবাই মিলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাতেন বলেছিল, তোর জামা-কাপড়, বইপত্র রেখে দিতে। আমি হিসাব করে দেখলাম, ওই সব বিক্রি করে এক হাজার টাকাও উঠবে না। দরকার নেই কিছুরই। তুই তাড়াতাড়ি বিদায় হ। অন্যরা এসে দেখলে রাগ করবে।
ছোট্ট একটা ব্যাগেই এঁটে গেছে রহমানের সমুদয় জিনিসপত্র। জীবন সংসার। মাগরিবের আজান পড়েছে আরও আগে। দোকানপাটে জ্বলছে উজ্জ্বল আলো। এর ভেতরেই অন্ধকার পায়ে হেঁটে চলেছে রহমান। ঝাপসা দু’চোখে খেলা করছে নিষ্ঠুর পৃথিবীর কত কিছু। জানে না কোথায় যাবে সে; কেনইবা যাবে!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *