রাখী আঢ্য
নীলিমা পালের রিপোর্টটা আজ সকালের কাগজে দেখলাম ছোট করে ছেপেছে। “জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মহনন”। বিমল প্রামাণিক নামে সাংবাদিক ছেলেটা তো আমার কাছে সবকিছু জেনে হেডিং দিয়ে খবরটা ছাপাবে বললো, কিন্তু এত সংক্ষিপ্ত করে দিলো!! আমার কাছ থেকে তো পুরো ঘটনাটা জানলো, সবটা বললো না, আমার নামও উল্লেখ করল না!! খানিকটা হতাশ ও বিরক্ত হয়ে খবরের কাগজটা মুড়ে পাশে রেখে দিলাম। মৃত্যু টা এত নিঃশব্দে হয়ে যাক সেটাও যে আমি চাইনি।
-” এই শা…ও ঠকালো!” বিড়বিড় করে আরো চারটে কাঁচা খিস্তি দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েই বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেল, একেবারে জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে। চাকরকে ডেকে আর এক প্রস্থ চায়ের অর্ডার দিয়ে ব্যালকনিতে রাখা গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম।
নীলিমা যেদিন আমাদের অফিসে জয়েন করলো সেদিন দেখেই চমকে গেছিলাম। অবাক ঠিক ওকে দেখে হইনি, নীলিমা আসবে জানতাম কিন্তু দীপকের মৃত্যুর কুড়িদিনের মধ্যেই অফিস চলে আসবে ভাবতে পারিনি। কেন জানিনা একটা চোরা অস্বস্তি শরীরের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। কেন সেটা কদিন পরেই বুঝতে পারলাম।
সবে তিন মাস হল জয়েন করেছিলো। কিন্তু এর মধ্যেই ধীরে ধীরে অফিসে নিজের একটা জায়গা করে নিচ্ছিল। তার মধ্যেই শুনলাম ও প্রমোশন পেয়ে সেকশন হেড হয়ে যাবে। এই খবরটা তো কোনমতেই আমি নিতে পারলাম না। ও যে অনেকদূর যাবে সেটা বুঝেই আমার ঐদিন অস্বস্তি হচ্ছিল।
মনে পড়ে গেলো কিছুদিন আগের কথা। দীপকের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই ওদের বাড়িতে গিয়ে একটা ভালো চাকরির অফার করেছিলাম। বদলে আমার কি চাই সেটাও চোখ এবং হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিতে দ্বিধা করিনি। বদলে জুটেছিল বাঁ গালে সশব্দে একখানি চড়। মুহুর্তের জন্য অসহায়ভাবে ছটফটিয়ে গেছিলাম। মনে হলো এত দম্ভ, এত অহংকার কিসের যে আমাকে ইগনোর করে!! মেয়েছেলের এত অডাসিটি ভালো নয়, তবে সেদিনের পর চড়ের আঘাতটা নিজের মধ্যে নিয়ে ঘুরছিলাম, যাতে সুযোগমতো ফিরিয়ে দিতে পারি।
অফিস চত্বরে মুখোমুখি হতেই আমার দিকে যে অবহেলা আর ঘৃণা মিশ্রিত দৃষ্টি তে তাকাতো সেটা অফিসে কেউ কেউ দেখে ফেলেছিল আর সেটা নিয়ে ক্যান্টিন চত্বরে ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছিল। কিন্তু তাতে ওকে বিচলিত মনে হয়নি বরং সে ব্যাপারটা উপভোগ করতো। সেদিন তো ক্যান্টিনে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে কাকে একটা বলছিল, “অপরাধী ভাব আমার কেন থাকবে? যে আমাকে হেনস্থা করেছে মুখ নীচু সে করবে, শাস্তি আমি তাকে দেবো।” এই ঔদ্ধত্য আর নেওয়া যাচ্ছিল না। লহমার জন্য মনে উদয় হলো এর কথা সারা জীবনের জন্য বন্ধ করে দিই। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়েছিলাম। একদিন ক্যান্টিনে নীলিমাকে একা পেয়ে কিছু বলতে গেলে আমার দিকে ঘৃণাভরে তাকিয়ে বলল, “আমি যদি মুখ খুলি, তুমি মুখ দেখাতে পারবে এই অফিসে? তোমার চরিত্র আমার অনেকদিন আগেই জানা হয়ে গেছে। তাই আমি যেরকম আছি সেইভাবে আমাকে থাকতে দাও, ধারে কাছে আসতে চেয়ো না আমার। তুমি যে আমার পরিচিত সেটা কাউকে জানাবারও ভুলেও চেষ্টা করো না।” কথাগুলো চুপচাপ সহ্য করা কঠিন ছিল। তবে এই কথাগুলোর প্রতি বর্ণ সত্যি। এই ধারালো কথাজালের সামনে অসহায়ের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিলেও ততক্ষণে আমার ছক করা হয়ে গেছে পরবর্তী কাজ।
সেদিন সকালে হইচই পড়ে গেল নীলিমা সেনের মৃত্যুতে। কেউ বলতে লাগল আত্মহত্যা, কেউ বা বললো হত্যা। হ্যাঁ আমি তো ওর কথাই রেখেছি, আমি তো জানায়নি কাউকে যে, নীলিমা সেন আমার পরিচিত। তবে আমি সেদিনের অসমাপ্ত কাজটা সমাপ্ত করতে বেশি দেরি করিনি। নীলিমার সৌন্দর্যকে প্রাণভরে উপভোগ করে তারপর তার ঔদ্ধত্যসহ পুরো মানুষটাকে চিরজীবনের মতো শেষ করতে আমার এক মুহূর্ত সময় লাগেনি।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব সুন্দর প্লট
অসংখ্য ধন্যবাদ
দারুণ লাগলো
Thank you 😌💗
বাঃ! খুব সুন্দর। অণুগল্পটি শেষ হওয়ার পর শিরোনামটির অন্তঃস্থ আবেদন আরও মূর্ত হয়ে ওঠে। ভাললাগল।