দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
গাড়ি থেকে নেমেই মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল শায়রীর। মেঘের দেশে সবুজ পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট লগ হাট। ফুলের কেয়ারি করা পথ দিয়ে ওরা যে হাটটায় এসে পৌঁছাল নাম মাধুরী, সত্যিই যেন শিল্পী নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে লগ-হাটটা সাজিয়েছে। এক টুকরো সবুজ লনে গাছের গুড়ি কেটে বসার জায়গা, দুটো পাইন গাছের মাঝে একটা হ্যামক ঝুলছে। সামনেই অতলস্পর্শী খাদের ও পারে তুষার ধবল গিরিরাজ হাসছে। যেন প্যারাগ্লাইডারে উঠে ছুঁয়ে আশা যাবে ঐ সফেদ পাহাড়।
হঠাৎ একটুকরো জলে ভরা মেঘ এসে ঢেকে দিল দৃশ্যপট, কে যেন ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলল নিজের আঁকার খাতা।
****
অপেক্ষা আর শায়রী, বিয়ের বয়স তিনদিন, প্রেমের বয়স তিনমাস। ঠিক দুজনের দুজনকে চিনতে জানতে যে সময়টুকু লেগিয়েছিল। তারপরেই ওরা উড়ে এসেছে পাহাড়ে, কারণ ওদের দুজনের প্রথম পছন্দই পাহাড়। শায়রী অবশ্য বহুবছর দেশের বাইরে থেকে হঠাৎ দেশে ফিরেছে। ওদের দুজনের পরিচয়টাও হঠাৎ করেই। অপেক্ষার ঠিক পাশের ফ্ল্যাটটায় ভাড়া এসেছিল শায়রী। দ্বিতীয়দিন রাতে খাওয়ার জল শেষ হয়ে যাওয়ায় ও অপেক্ষার ঘরের বেল বাজিয়েছিল। এরপর টুকটাক আলাপ, গল্প, পরিচয় থেকে পরিণয়ের গণ্ডি পার করতে সময় লাগেনি। দুজনের কারোর বাবা মা বা অভিভাবক নেই। তাই কোর্ট ম্যারেজ করেই উড়ে এসেছিল পাহাড়ের কোলে, পেলিংএ।
****
”আপনারা অপেক্ষাকে দেখেছেন, আমার হাজবেন্ট। কাল সকালে আমরা চেকইন করেছিলাম… সকালে ছবি তুলতে বেরিয়েছিল, এখন দুপুর বারোটা। ফোনটাও নট রিচেবল।”
রিশিপসনে এসে প্রশ্ন করে শায়রী।
”সকাল থেকে পাচ্ছেন না! কত দূরে আর যাবে, হয়তো পথ হারিয়ে ফেলেছেন।”
“পেলিং এ ও আগেও এসেছে বলেছিল। কিন্তু ও বলেছিল দশটায় আমরা রাবডানসে ঘুরতে যাব। অথচ… আমি সেই থেকে রেডি হয়ে…ফোনটাও তো লাগছে না।”
ঘড়ির কাটা এগিয়ে চলে, অপেক্ষা আর ফেরে না। পরদিন পুলিশ চারদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখে। তৃতীয় দিন অতল খাদের ভেতর থেকে অপেক্ষার পচা গলা লাসটা তুলে আনে রেসকিউটিম। ছবি তুলতে গিয়ে পাইন বনের শেষে খাদের ভেতর পড়ে গিয়েছিল অপেক্ষা।
শোকে পাথর শায়রী জ্ঞান হারিয়েছিল। পুলিশ হাল্কা জেরা করেছিল। কিন্তু কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না মেয়েটা। ঘটনাটা যেন বিশ্বাস করতেই পারছিল না ও। পাঁচদিন পর একাই ফিরে এসেছিল ব্যাঙ্গালোর। অপেক্ষার ফ্ল্যাটের তালাটা খুলে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। এই ঘরের সর্বত্র কত স্মৃতি… কত টুকরো টুকরো কথা মনে পড়ছিল।
কিছুক্ষণ পর মনকে শক্ত করে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে ও। রাস্তার ওপার থেকে রজনীগন্ধার মালা আর চন্দন গন্ধের ধূপকাঠি কেনে, অপেক্ষার শোওয়ার ঘরের আলমারির ড্রয়ার থেকে বের করে আনে বড় করে বাঁধানো ছবিটা। ড্রইংরুমের টেবিলে রেখে ফুলের মালাটা পরিয়ে ধূপ জ্বেলে দেয় ও।
তারপর বলে, ”আমি পেরেছি রিয়া, তোর অপেক্ষাকে তোর কাছেই পাঠিয়ে দিয়েছি। ঠিক যে ভাবে এই সম্পত্তির লোভে তোকে বিয়ে করে ও তোকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলেছিল… সেভাবেই। তোর বিয়েতে আসতে পারিনি বলে আপসোস ছিল। ভাগ্যিস আসিনি। তাই তো ও আমায় চিনতেই পারেনি। সেদিন যখন আমি তোর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছিলাম আমি তোর আগেই ওকে দেখতে পেয়েছিলাম, তোকে সাবধান করার আগেই ও ধাক্কাটা মেরে দিয়েছিল, বিদেশে বসে আমি কিছুই প্রমাণ করতে পারতাম না। তাই ফিরে এসেছিলাম। নিজে হাতে অপেক্ষাকে তোর কাছে পৌঁছে দিলাম। বাকি হিসাবটা তুই বুঝে নিস।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
দারুন লাগলো 👏