novel-bristir-dinratri

বৃষ্টির দিনরাত্রি
নন্দিনী নাগ


“তোমাকে দিয়েছি আমার প্রাণের বর্ষা ঋতু
এখন বর্ষায় আমার আর নেই অধিকার
তবুও হৃদয় জলদমন্ত্রে কাঁপে যেহেতু
চোখ বুজে তাই মনে মনে করি ক্ষণিক বিচার।”

‘প্রায়ই তোকে স্বপ্নে দেখি জানিস! ক্লাসরুমে বসে আছিস সবার সঙ্গে, আমরা সব বন্ধুরা কথা বলছি, গল্প করছি কিন্তু তুই আমার সাথে একটাও কথা বলছিস না। কিন্তু আমার তোকে অনেক কথা বলার আছে, তাই বাধ্য হয়ে নিজে যেচে তোর কাছে গেলাম, তুই তাও আমার সাথে কথা বললি না। ফোন নাম্বার চাইলাম, তুই সেটাও দিলি না। এখনও এত রাগ পুষে রেখেছিস আমার ওপর?’

নিষাদ একবার তাকাল বৃষ্টির দিকে, কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়ে যেমন হাঁটছিল হাঁটতে লাগল। বৃষ্টি ওর পিছু নিল।

‘কত খুঁজেছি তোকে এই কয়েকবছর ধরে জানিস! ল্যান্ডফোনের নাম্বার ছিল আমার কাছে, স্বাভাবিকভাবেই তাতে পাইনি। যে ঠিকানায় তোকে আগে চিঠি লিখতাম, স্মৃতি হাতড়ে সেই ঠিকানা মনে করলাম, তারপর খুঁজে খুঁজে তোদের বাড়িতেও গেছিলাম। শুনলাম তোরা আর থাকিস না ওখানে। আশেপাশের কেউ নতুন ঠিকানাও দিতে পারল না। বাধ্য হয়ে খোঁজা ছেড়ে দিলাম। এতবছর পরে তোকে খুঁজে পেয়েছি, প্লিজ একটু দাঁড়া। আমি শুধু তোকে কয়েকটা কথা বলতে চাই, এখন না, পরে ফোনে বলব। প্লিজ ফোন নাম্বারটা দে।’

বোধহয় একটু মায়া হল নিষাদের, পকেট থেকে পেন বার করল। কিন্তু নাম্বারটা আর নেওয়া হল না বৃষ্টির, ঘুম ভেঙে গেল।

মনটাও ভেঙে গেল। বার বার স্বপ্নে আসছে নিষাদ, কিন্তু কিছুতেই ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না বৃষ্টি। দেখা হওয়া তো দূরের কথা, নিদেন পক্ষে যদি ফোন নাম্বারটাও পেত, তাহলেও চলত। অন্তত মনের মধ্যে জমে থাকা কথাগুলো বলে তো হালকা হতে পারত।

এক ক্লাসে যারা পড়ত, সেই সব বন্ধুদের কারো সাথেই নাকি যোগাযোগ নেই নিষাদের, কেউই ওর ঠিকানা, ফোন নাম্বার জানে না। একমাত্র শীর্ষ খবর দিয়েছিল, ও নাকি স্টেটব্যাঙ্কে আছে, কামারহাটি ব্রাঞ্চে। মরিয়া হয়ে সেখানেও একদিন গেছিল বৃষ্টি, কিন্তু পায়নি। ওখানে নাকি কাজ করে না নিষাদ।

সত্যিই কি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যাবে নিষাদ, ডাকলে সাড়া না দিয়ে? ঠিক যেমনটা ও করে থাকে প্রত্যেক স্বপ্নে? অপরিচিতের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও কি ফিরিয়ে দিতে পারবে বৃষ্টির চোখের কাতর আবেদনটুকু?

সত্যিই যদি চোখে চোখ পড়ে যায় কোনোদিন, ও কি থমকে যাবে না একমুহূর্তের জন্যেও? নিষাদ কি ভুলিয়ে দিতে পেরেছে সেই বিশেষ সন্ধ্যার কথা, যা বৃষ্টির চোখে এতবছর পরেও উজ্জ্বল? বৃষ্টির জানতে ইচ্ছে করে ভীষণ।

‘আরে তুই ঋষি না?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি তো আপনাকে ঠিক…’

‘চিনতে পারিসনি? আরে আমি নিষাদের বন্ধু, বৃষ্টি। সেই যে বইমেলায় গিয়ে পরিচয় হল? আমরা তখন কলেজে, সেকেন্ড ইয়ারে পড়তাম। তারপর একদিন তো তুই আমাদের কলেজেও এসেছিলি ফেস্ট এ, মনে নেই?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ! মনে পড়েছে। আসলে এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে তো, হঠাৎ করে খেয়াল করতে পারিনি, সরি রে।’

‘সরি-টরি ছাড়, হতেই পারে। আমার সাথে ফর্মালিটি করতে হবে না। হ্যাঁরে, নিষাদের খবর কি?’

পুজোর ছুটিতে সপরিবারে কেরল বেড়াতে এসেছে বৃষ্টি। কোচি বিমানবন্দরে আকস্মিকভাবে ঋষিকে দেখতে পেয়ে ওর হাতে চাঁদ পাওয়ার মত অবস্থা হল। ঋষি, নিষাদের প্রাইমারী স্কুলবেলাকার বন্ধু, বড় হয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্র আলাদা হয়ে যাবার পরেও বন্ধুত্ব একইরকম থেকে গেছে, একথা নিষাদের কাছ থেকেই শোনা। সেই ঋষিকে যখন পাওয়া গেছে, তখন নিষাদকেও পাওয়া যাবে, ভেবেই খুব আনন্দ হচ্ছিল বৃষ্টির।

‘ওর ও তো ফ্যামিলি নিয়ে আমাদের সঙ্গেই আসার কথা ছিল এই ট্রিপে। কিন্তু শেষবেলায় কাকিমা অসুস্থ হয়ে গেলেন, তাই ওকে ক্যানসেল করতে হল।’

ঋষির কথা শুনে খুব আক্ষেপ হল বৃষ্টির। ইশশ! কাকিমা অসুস্থ না হলে, এবারেই দেখা হয়ে যেত নিষাদের সঙ্গে, এতবছরের খোঁজাখুঁজি শেষ হত।

‘তুমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছ? আমাদের সিকিউরিটি চেক দিয়ে দিয়েছে, আমি তখন থেকে খুঁজছি-’ বলতে বলতে যে মহিলা এগিয়ে এল ঋষির দিকে, এই কয়েকবছরে বেশ গায়েগতরে লাগলেও তাকে দেখেই চিনতে পারল বৃষ্টি। তাহলে ঋষি আর ধৃতির বিয়ে হয়েছে। এই মেয়েটি, ধৃতি, সেও ওদের সঙ্গে বইমেলায় গেছিল সেবছর, দীর্ঘসময় ওদের সঙ্গে কাটিয়েছিল। নিষাদের পাড়ার বন্ধুরা, যারা ওদের কলেজে পড়ত না, তাদেরও তখন চিনত বৃষ্টি।

বৃষ্টির সাথে ঋষিকে কথা বলতে দেখে নিজের কথা থামিয়ে দিয়েছিল ধৃতি। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল চিনতে পারেনি বৃষ্টিকে।

‘আমি বৃষ্টি, নিষাদের বন্ধু, মনে পড়েছে?’

‘হাই! ভালো আছ তো?’

শুকনো হেসে বলল ধৃতি। ওর স্বরে সেই আন্তরিকতা ছিল না, যেটা ঋষির মধ্যে ছিল।

বৃষ্টি বুঝল ঋষিকে আর আটকে রাখাটা ঠিক হবে না। তাই বলল, ‘নিষাদের নম্বরটা দিবি? আমি অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি, কিছুতেই ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।’

‘সিওর। এই যে আমার কার্ড, আমাকে পরে কন্টাক্ট করিস, দিয়ে দেব।’

বউয়ের সঙ্গে চোখের আড়ালে চলে গেল ঋষি। বৃষ্টি ভাবছিল, আর দুমিনিট দাঁড়িয়ে একেবারে নিষাদের নম্বরটা দিয়ে গেলে কী এমন দেরি হয়ে যেত ওদের!

কেরল ট্রিপটা ভালো কাটল না বৃষ্টির, মনের মধ্যে সর্বক্ষণ একটা অস্থিরতা, দোলাচল। মাঝেমাঝেই মনে হচ্ছিল, ঋষিকে একবার মেসেজ করে নিষাদের নম্বরটা চেয়ে নেবে, আবার নিজের ইচ্ছেটাকে দমন করতে হচ্ছিল, এত উৎসাহ দেখানো ঠিক হবে না ভেবে।

শেষ পর্যন্ত বাড়িতে ফিরে গিয়েই মেসেজ করল ও, ওদিক থেকে জবাব এল, ‘দিচ্ছি’। কিন্তু ফোন নম্বরটা আর এল না।




‘ছোড়দি! খুব ভালো একটা ছেলে আছে, মুন্নিকে ওদের খুব পছন্দ, কথা বলবি?’

‘তোর কি মাথা খারাপ! মুন্নি এখনও ছোট, পড়াশোনা করছে, এখন ওর সম্বন্ধ এনেছিস?’

‘তোকে এখনই বিয়ে দিতে কে বলেছে? ওরাও দেবে না। ছেলে ডাক্তারি পড়ছে। কথাবার্তা বলে রাখতে পারিস, মুন্নি আর বুবলাও কথাবার্তা বলুক, মেলামেশা করুক, তারপর ছেলে প্রতিষ্ঠিত হলে বিয়ে দিবি।’

‘বুবলা? মানে তোর যে ভাসুর আমেরিকায় থাকত, তার ছেলে?’

‘হ্যাঁ। সেইজন্যই তো বলছি। বুবলার মুন্নিকে ভালো লেগেছে, এই সুযোগ হাতছাড়া করিস না। মেয়ে বড় হয়েছে, দশটা ছেলের সঙ্গে মিশছে, কোথা থেকে কাকে পছন্দ করে বসবে তখন ঝামেলা বাঁধবে। তার চাইতে বরং বুবলার সাথেই মেলামেশা করুক।’

বোনের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলেন না মুন্নির মা। ছেলে ডাক্তার, ভালো পরিবার, আবার পায়ে হেঁটে আসা সম্বন্ধ। এমন পাত্র হাতছাড়া করা যায় নাকি! মুন্নির বাবার কানেও কথাটা তুললেন তিনি, তাঁরও অমত হল না।

বুবলাকে পছন্দ না করার কোনও কারণ ছিল না মুন্নির। দেখতে শুনতে ভালো, পড়াশোনায় ভালো, আপাদমস্তক ভদ্র একটি ছেলে। দুই পরিবারে যেহেতু সম্মতি ছিল, লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করার কোনো দরকারই ছিল না ওদের। বুবলা হোস্টেলে থাকত, সপ্তাহে একদিন বাড়ি ফিরত আর ফিরেই দেখা করতে আসত মুন্নির সঙ্গে।

মুন্নি তখন ক্লাস টুয়েলভে, সায়েন্স নিয়ে পড়ে। কাজেই প্রেমিক মাঝে মাঝে ‘মাস্টারমশাই’ও হয়ে যেত ওর মায়ের আবদারে।

‘কেমিস্ট্রিতে মুন্নি খুব কম নম্বর পেয়েছে। কী যে করবে ও! আর কদিন পরেই তো ফাইনাল পরীক্ষা। তুমি একটু দেখে দিও তো।’

কোনওদিন আবার বলতেন, ‘বায়োলজিটা একটু বুঝে নিতে পারছিস না ওর কাছে! এরকম পড়াশোনার ছিরি হলে জয়েন্টে চান্স পাবি?’

মুন্নির ভালো লাগত না। মায়ের এই সবসময় পড়া নিয়ে পেছনে লেগে থাকা, জয়েন্ট জয়েন্ট করে মাথা খারাপ করে ফেলা, সপ্তাহে একদিন বুবলা এলে তার কাছেও ধরে বেঁধে পড়তে বসিয়ে দেওয়া, এসব একদম ভালো লাগত না ওর। বুবলা আড়ালে বলত বটে, ‘তোমার মায়ের জন্য একটু শান্তিতে প্রেম করারও উপায় নেই’, কিন্তু মায়ের আদেশ পালন করতে কসুর করত না। মুন্নিকে বইপত্র নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও বসাতো।

মুন্নি বসত বটে, কিন্তু ওর মন পড়ায় বসত না। কারণ ও ডাক্তার হতে চায় না। ইঞ্জিনিয়ারও না। ও জানত, জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করা সম্ভব নয় ওর পক্ষে, কারণ ওর ভালো লাগে না।

‘আমি যদি জয়েন্ট এন্ট্রান্স ক্লিয়ার না করতে পারি, তুমি কি খুব দুঃখ পাবে?’

বুবলাকে জিজ্ঞেস করেছিল মুন্নি।

‘আমার দুঃখ পাওয়ার কী আছে? তুমি যদি ক্র্যাক করতে পার, তবে তোমারই তো ভালো।’

‘আমি জানি আমি পারব না। তোমার মত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট তো নই আমি, তাছাড়া আমার ভালোও লাগে না এসব পড়তে। আসলে তুমি এত লেবার দিচ্ছ আমার পেছনে, সব বৃথা হয়ে যাবে, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।’ ফিচেল হাসি হেসে বলল মুন্নি।

নিজেকে চিনতে এতটুকুও ভুল হয়নি মুন্নির। জয়েন্ট তো দূরের কথা, হায়ার সেকেন্ডারীর রেজাল্ট যা হল তাতে ভালো কোনও কলেজে সায়েন্সের কোনো বিষয়ে অনার্সও পেল না। বাংলা, ইংরেজিতে ভালো নম্বর ছিল, শেষ পর্যন্ত বাবার ইচ্ছেতে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হতে হল ওকে। বাবার ধারণা, ইংরেজি নিয়ে পড়লে তবু লোকসমাজে মুখ দেখানো যাবে।

জুন মাসের শেষের দিক, দুপুরের দিকে হঠাৎ করেই আকাশ কালো হয়ে এল। এতটাই অন্ধকার যে আলো না জ্বালালে ঘরের ভেতর স্পষ্ট নজর চলে না। ছেলেমেয়েরা সমস্বরে চিৎকার করতে শুরু করল, ‘স্যর ছেড়ে দিন! আজ আর পড়াবেন না!’

ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত অধ্যাপকমশাইও রোমান্টিক মানুষ, মেঘ তাঁর মনও কেড়ে নিয়েছে। টেবিলের ওপরে রাখা বইটা বন্ধ করে তিনি বললেন, ‘বেশ। তবে গান হোক। বৃষ্টি দিনের গান।’

স্যরের কথা শুনে আবার অনেকে মিলে হৈ হৈ করে বলে উঠল, ‘অ্যাই বৃষ্টি! শুরু কর না!’

বৃষ্টি অন্যমনস্ক ছিল, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখছিল। ক্লাসের ঘটমানতা থেকে অনেকক্ষণ আগেই সরে গেছিল ওর মন। হঠাৎ নিজের নামটা শুনে থতমত খেয়ে বাস্তবে ফিরল।

‘আমি?’

‘হ্যাঁ তুই। বৃষ্টির গান বলেছেন স্যর, মানে তোর গান। তুই গাইবি না তো কি ক্যান্টিনের বিশুদা গাইবে!’

ফিচলেমি করে একজন ফুট কাটল।

‘আমি তো কেবল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারি।’

গলার স্বরে অসহায়তা বৃষ্টির। পুরো ক্লাসকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়ে কাঁচুমাচু মুখে বলল অধ্যাপককে।

‘আমি সেটাই শুনতে চাইছি। এই পরিবেশে রবি ঠাকুরের বর্ষার গানই সবচেয়ে উপযুক্ত।’

স্যরের কথার ওপরে আর কথা চলে না। সুতরাং ক্লাসের যেসব ফিচেল এবং মহাফিচেলরা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এতদিন গানের পর্যায়েই ফ্যালেনি, শোনার অযোগ্য বলে ব্রাত্য করে রেখেছে, তারাও বাধ্য হয়ে চুপ করে বসল শুনতে। আর বৃষ্টি, যে কি না শুনে শুনে নিজে শেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত স্কুলে দিদিমনিদের অনুরোধে ক্লাসরুমে ছাড়া কখনো বাইরে কোথাও গায়নি, সেও বলতে পারল না, ‘আমি তো গান শিখি না।’

‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়’ বৃষ্টি জানালার বাইরে তাকিয়ে শুরু করল ওর গান।

সুর, তাল, লয় হয়তো একজন প্রথাগতভাবে শিখে আসা শিল্পীর মত নিখুঁত হল না, কিন্তু ওর গানের মধ্যে এমন প্রাণ ছিল, এতটাই আবেগ ছিল যে পুরো ক্লাসের মনোযোগ ঘুরে গেল ওর দিকে।

বাইরে তখন অঝোর বৃষ্টি, আর ঘরে বৃষ্টির গানের জাদু।




“বৃষ্টি নামল যখন আমি উঠোনপানে একা
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম পাব তোমার দেখা”

‘বৃষ্টি আমার খুব ভালো লাগে। বৃষ্টিতে ভিজতে, গাছপালাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখতে, জমা জলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে, সব ভালো লাগে।’

‘আরেব্বাস! তুই তো ভীষণ রোম্যান্টিক! কবিতা টবিতা লিখিস নাকি?’

নিষাদের প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল বৃষ্টি, ওর গালে লাগল লজ্জার লালচে আভা। লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখা অনেকদিনের অভ্যাস ওর, আজ পর্যন্ত এই কথা কেউই জানতে পারেনি। সেসব লেখা আজ অবধি লোকচক্ষুর সামনে আসেনি, ফলে সেসব ছাইপাশ আদৌ কবিতা হয়েছে কিনা, সেটা ও নিজেও জানে না। বৃষ্টিকে চুপ করে থাকতে দেখে নিষাদ বলল, ‘চুপ কেন! তার মানে লিখিস, তাই তো?’

‘কী যে লিখি মাথামুণ্ডু আমি নিজেই জানি না।’

‘সেটা বোঝার দায়িত্ব পাঠকের। কাল নিয়ে আসিস লেখাগুলো, আমি না হয় পড়ে মতামত দেব ওগুলো মাথা হয়েছে না কি মুন্ডু।’

কলেজ ফেস্টের জন্য রিহার্সাল চলছিল। ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট নাটক করবে। উদ্যোগটা নিয়েছে নিষাদ, পরিচালক ও নিজে। নাটক করা এবং পরিচালনা করা নাকি নিষাদের সবচেয়ে প্রিয়, ওর নিজের থিয়েটারের দল আছে। কলেজ থেকে ফিরে ওখানেই যায় রোজ। নিষাদ বলেছে, নাটক নিয়েই ও নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে চায়, এটাই ওর স্বপ্ন, এটাই প্রেম।

বৃষ্টি আগে অভিনয় করেনি কখনো, নিষাদের ঝুলোঝুলিতে রাজি হয়েছে। তবে প্রথমবার করতে নেমে ভালোই করছে, খোদ পরিচালক স্বীকার করেছে। ফেস্টের আর ছয়দিন বাকি, জোরতোড় রিহার্সাল চলছে। ক্লাস-টাস আপাতত বন্ধ, কলেজে পৌঁছেই ওরা চলে আসছে কমনরুমে, আর পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত টানা রিহার্সাল করে বাড়ি ফিরছে।

আজ বিকেল থেকেই বৃষ্টি নেমেছে। রিহার্সাল শেষ হবার পর ওর মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে যাচ্ছিল বৃষ্টি, নিষাদ আটকালো।

‘খেপেছিস! কদিন বাকি আছে আর নাটকের? এখন ভিজে যদি জ্বর আসে, কী হবে?’

‘কত্ত ভিজি আমি, জ্বরটর আসে না কখনও আমার। বৃষ্টি আমার খুব ভালো লাগে। বৃষ্টিতে ভিজতে, গাছপালাকে ভিজতে দেখতে, জমা জলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে, সব ভালো লাগে।’

নিষাদের কথাটাকে কাটতে গিয়ে নিজের ইচ্ছের কথাগুলো বলে ফেলেছিল বৃষ্টি। আর তাতেই ওর এতদিনের গোপন কথাটা ফাঁস হয়ে গেল, আর নিষাদও কথা আদায় করে নিল, পরেরদিন বৃষ্টিকে ওর লেখাগুলো আনতেই হবে।

ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হয়ে খুব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল বৃষ্টি, পুরনো বন্ধুরা একজনও ছিল না। তবে এখন ওর কলেজে যেতে খুব ভালো লাগে। এর আগে সাহিত্যপাঠ বলতে গেলে কিছুই হয়নি ওর, না বাংলা না ইংরেজি, এখন সেটা শুরু করেছে। এ ব্যাপারে নিষাদ ওর গাইড। এই বয়সেই ছেলেটা অনেক পড়ে ফেলেছে।

‘আমাদের বাড়ির সবাই সাহিত্যের লোক। মা ইংরেজির দিদিমনি, বাবা বাংলা পড়ায়, বাড়িতে সবসময়ই সাহিত্যের আলোচনা। তাছাড়া আমার বরাবরের ইচ্ছে নাটক নিয়ে কাজ করা। জানিস তো, বড় বড় পরিচালকরা নিজেরাই নাটক লেখেন, আর এজন্য ওয়ার্ল্ড ক্লাসিকগুলো তো জানতেই হবে, তাই না?’

বৃষ্টি চুপ করে থাকল নিষাদের কথা শুনে। এ ব্যাপারে কোনও ধারণাই নেই ওর। এখন অবশ্য অল্প অল্প করে ধারণা তৈরি হচ্ছে, তাও নিষাদের কল্যাণে। বৃষ্টিকে চুপ করে থাকতে দেখে কথা ঘোরালো নিষাদ।

‘তুই কিন্তু বেশ লিখিস। আরও লেখ, হাত তৈরি হবে। সেই সাথে পড়তেও থাক, নলেজ ছাড়া শুধু আবেগ দিয়ে কাব্য, সাহিত্য কোনওটাই হয় না।’

বৃষ্টি লজ্জা পেল, সেই সাথে খুশিও হল। এই প্রথম কেউ ওর কবিতা পড়ে প্রশংসা করল। নিজের মনের আবেগকে প্রকাশ করার জন্য এতদিন লুকিয়ে চুরিয়ে লিখত ও, কারণ ওদের বাড়িতে কবিতারোগকে উঁচু নজরে দেখা হয় না। ওরা মনে করে, ভালো ছাত্রছাত্রী হওয়ার একটাই লক্ষ্মণ, সায়েন্স নিয়ে পড়বে, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। বৃষ্টির বাবা ইঞ্জিনিয়ার, দাদাও বাবার পথে গেছে। সেখানে পাতি অনার্স পড়ুয়া বৃষ্টি, তাও আবার লিটারেচার নিয়ে, ইতিমধ্যেই ‘কুলাঙ্গার’ খেতাব জুটে গেছে ওর। এর মধ্যে যদি আবার কবিতা লেখার কথা জানে তবে বাড়ির লোকজন ওকে যে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই বৃষ্টির।

‘তুই বড্ড ভীতু। একটু প্রাণ খুলে বাঁচতে শেখ।’

বৃষ্টির কথা শুনে হাসতে হাসতে বলেছিল নিষাদ।

‘আমার বাড়িটা যদি তোর হত, তাহলে দেখতাম কেমন প্রাণ খুলে বাঁচতে পারতিস!’

‘দুসস! আমি ঠিক আমার মত করে বদলে নিতাম।’

‘বলতে যতটা সোজা লাগে, করাটা ততটাই কঠিন, বুঝেছিস! এখনও বাপের হোটেলে থাকি। মা বলেই দিয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপরে নিজের ইচ্ছেতে চলতে।’

ঠিকই বলেছিল সেদিন বৃষ্টি, পরবর্তী বছরগুলোতে এটা বার বার ভেবেছে নিষাদ। ‘বদলে দেব’ বলাটা যতটা সোজা, করে দেখানো ততটাই কঠিন। সব জেনেও নিষাদ তো বদলাতে পারেনি ভবিতব্যকে।




“বুকের ভেতর বৃষ্টি নামে নৌকা টলমল
কূল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনই সম্বল।”

আমার একটা গোপন ইচ্ছে ছিল। বহুবার ভেবেছিলাম তোকে সেই ইচ্ছের কথা বলব। তোর পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদিন এমন অবস্থা হয়েছিল যে কথাটা তোকে প্রায় বলেই ফেলছিলাম। তারপর অতিকষ্টে ঢোক গিলে নিয়েছি। আসলে ওই ইচ্ছের কথাটা তোকে বলা উচিত নয় বলে তখন মনে হত আমার। তবু তোকে বলতে চাইতাম বার বার, কারণ আমার দুনিয়ায় তুই একমাত্র মানুষ ছিলিস যে এটা বুঝতে পারবে। সেই দিনটার কথা মনে আছে তোর? যেদিন আমি তোকে দুপুরের পর ক্লাস করতে দিলাম না? বলেছিলাম, একটা দারুণ জায়গায় নিয়ে যাব, চল।

সেদিন মেঘলা দুপুর ছিল, আমি মনে মনে ভেবেছিলাম এমনদিনে তারে বলা যায়, গুরুদেবই বলে দিয়েছেন। অতএব আজ তোকে বলেই দেব আমার সেই গোপন ইচ্ছের কথাটা। দুনিয়ায় কেউ তো অন্তত জানুক, এমনটাই চেয়েছিলাম আমি।

সেদিন শহর ছাড়ার পর ভ্যানে চড়ে আমরা যাচ্ছিলাম গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে, দু’পাশে ধানক্ষেতকে সাক্ষী রেখে। বেশ হাওয়া দিচ্ছিল, আমার ওড়না উড়ে তোর গায়ে লুটোপুটি খাচ্ছিল, সবটাই ছবির মত লাগছিল কিংবা কোনও নাটকের দৃশ্যের মত। আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছিলাম তোকে, সেই জায়গাটায় পৌঁছতে গেলে ভ্যানরিক্সা থেকে নেমে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। তোর পাশে পাশে ওই পথটা হাঁটার সময় আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল তোর হাতটা ধরতে। খুব সরু পায়ে চলা পথ ছিল, দু’একবার আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে গেল, আমি যেন ইলেকট্রিক শক খেলাম, তবুও হাতটা ধরিনি, কষ্ট করে দমিয়ে রেখেছিলাম নিজেকে। যা আমি কোনওদিন দিতে পারব না, সেই দিকে তোকে নিয়ে যাওয়াটা অন্যায়, এই যুক্তি দিয়ে নিজের মনকে শাসন করেছিলাম।

তারপর আমরা এসে পড়লাম সেই বিরাট ফাঁকা মাঠটাতে, যার একপাশে নদী আর উল্টো দিকে মাঠের শেষে অনেক পুরনো একটা মন্দির।

‘কী দারুণ না?’ আমি বলেছিলাম।

‘সত্যিই অসাধারণ’ তোর চোখেমুখেও ছিল মুগ্ধতা।

‘ইসসস! আগে জানলে ক্যামেরা নিয়ে আসতাম!’

তুই আফসোস করছিলি। তোর ফোটোগ্রাফির শখ, ফিল্ম বানানোর স্বপ্ন দেখিস, এটা অজানা ছিল না আমার। কিন্তু আমি তো তোকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, আগে থেকে বলে দিলে সেটা তো হত না।

মুগ্ধ হবার আরও কারণ বাকি ছিল তখনও। হঠাৎ আমরা দেখতে পেলাম, নদীর ওপাড় থেকে ঘন কালো মেঘ এগিয়ে আসছে আমাদের মাঠের দিকে, সেইসঙ্গে বৃষ্টিও। বৃষ্টিকে এভাবে এগিয়ে আসতে আগে কখনও দেখিনি আমি, তাই ক্যাবলার মত সেদিকে তাকিয়েছিলাম। তুই হাত ধরে টানলি, বললি, ‘হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শিগগির দৌড়ে মন্দিরটাতে চল, নাহলে ভিজে যাব একেবারে।’

ছুটলাম দুজনে, আকাশ ভেঙে আসা বৃষ্টিও ছুট লাগাল আমাদের ধরার জন্য, তবে একটুর জন্য আমরাই জিতে গেলাম। আমরা মন্দিরে গিয়ে দাঁড়ানোর পর সে অঝোরে নামল। তখন, তোর খুব কাছে দাঁড়িয়ে, বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমার বলতে ইচ্ছে করছিল মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা ইচ্ছেটার কথা। কিন্তু মন্দিরের পুরোহিত মশাইয়ের উপস্থিতি আর প্রশ্নবাণে তাল কেটে গেছিল আমার, তাই আর বলা হয়নি। সেদিন বাড়ি ফিরে ভেবেছিলাম, ভালই হয়েছে কথাটা বলতে পারিনি তোকে। সেই কথাটা এতবছর বাদে এখন তো বলাই যায় তাই না? এখন তো আমরা দুজনেই ম্যাচিওর, সব দিক থেকেই পরিণতিতে পৌঁছে গেছি। এখন মনে হয় নতুন করে কোনও অসুবিধা হবে না তোর সেই কথাটা শুনলে। শুনবি?

‘পরে কোনওদিন শুনব। এখন তাড়া আছে।’

‘আবার কবে দেখা হবে? যদি আর কোনওদিন না দেখা হয়? যদি আবার হারিয়ে যাস আগের মত? তাহলে বরং তোর নম্বরটা দে, আমি ফোন করব।’

নিষাদ পকেট হাতড়ায়। না বেরয় কাগজ, না পেন।

‘তোর ফোন থেকে বরং আমাকে কল কর একটা, আমার নম্বরটা বলি?’

নিষাদ পকেট হাতড়ে নিজের ফোনটাও পেল না।

‘তুই তাহলে তোর নম্বরটা বল! আমি সেভ করে নিচ্ছি।’

এবার বৃষ্টির হাতড়ানোর পালা। আঁতিপাঁতি করে ব্যাগ খুঁজেও নিজের ফোনটা পেল না। হতাশ হয়ে তাকিয়ে দেখল নিষাদ ততক্ষণে চলে গেছে অনেকটা দূরে, বৃষ্টি ধরে ফেলতে পারবে না, এমন দূরে।

ঘুম ভাঙার পর চুপচাপ শুয়ে রইল বৃষ্টি। এতক্ষণ যা দেখছিল, তাকে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল না ওর। এখনও নিষাদের সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা হওয়ার টাটকা স্মৃতি ওকে জড়িয়ে আছে, কীভাবে তাকে স্বপ্ন বলে অস্বীকার করতে মন রাজি হয়! তখনও সকাল হয়নি। বাকি রাতটা জেগেই কাটিয়ে দিল বৃষ্টি।

‘ওই মেয়েটা নিষাদের গার্লফ্রেন্ড ছিল না?’ বৃষ্টি চোখের আড়াল হতেই ঋষিকে জিজ্ঞেস করল ধৃতি।

‘হুম, ওইরকমই খানিকটা। হাফ গার্লফ্রেন্ড।’

‘খানিকটা আবার কী? ওই মেয়েই তো নিষাদের লাইফটা নষ্ট করে দিয়েছে, আমি জানি না নাকি! সেই সময় কেমন হয়ে গেছিল ছেলেটা! দিনের পর দিন ক্লাবে এসে বসে থাকত, নাটকে মন দিতে পারত না, কত্ত কল শো এর বুকিং ক্যানসেল করে দিয়েছিল তখন! আমার সব মনে আছে। ও নিজে মুখে কিছু বলত না বটে, কিন্তু আমরা সবাই বুঝতে পারতাম কার জন্য ওর এই অবস্থা। তোমাকে ওই মেয়েটা এখন কী বলছিল?’

‘নিষাদের খোঁজ করছিল। ওর ফোন নাম্বার চাইছিল।’

‘আবার? একবার ছেলেটাকে শেষ করে দিয়ে ওর সাধ মেটেনি? তুমি কিন্তু একদম দেবে না নাম্বার। তাহলে আবার ওর সাথে যোগাযোগ করে পুরনো ঘা খুঁচিয়ে তুলবে। ছেলেটা এত কষ্টের পরে এখন থিতু হয়েছে, ওর সুস্থ জীবন আর ব্যস্ত করে লাভ নেই।’

‘দিইনি তো নাম্বার, দেখলে না! আমার কি মাথায় বুদ্ধি নেই!’

‘কী জানি! আমি সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে হয়ত দাওনি, পরে পাঠিয়ে দিতে। তোমাদের ভরসা নেই, সুন্দরী মেয়ে দেখলে গলে যাও, নিজেদের ভালোটাও বোঝ না তখন।’

ঋষি জবাব দিল না এই টিপ্পনীর। কথায় যে কথা বাড়তে থাকে, সেটা ও ভালোই জানে।

‘আর শোনো! বৃষ্টির সঙ্গে যে আমাদের দেখা হয়েছিল, সেই কথাটাও নিষাদকে বলার কোনও দরকার নেই। এই এপিসোডটা মন থেকে পুরো ডিলিট করে দাও।’

ধৃতি সাবধান করে দিল ঋষিকে।




“তোমাকে অধিক ভালোবেসে
মোমবাতি জ্বলে গলে যায়”

আজ জন্মদিন বৃষ্টির। গতকাল বার বার করে বলে গেছে ‘তোকে কিন্তু আসতেই হবে, আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না।’

আজ সকালেও মেসেজ করেছে, ‘আসছিস তো? আমি অপেক্ষা করে থাকব কিন্তু।’

ওর জন্মদিন আমি কখনও ভুলি না। গতকালই কলেজে ওকে জন্মদিনের উপহার দিয়ে এসেছি। ভেবেছিলাম আজ আর ওর বাড়িতে যাব না, অত লোকজনের মধ্যে ভালো লাগবে না আমার। বৃষ্টি ব্যস্ত থাকবে অতিথিদের সামলাতে, আমার নিজেকে ওখানে চূড়ান্ত মিসফিট মনে হবে, ভালো বাংলায় যাকে বলে ‘হংস মধ্যে বক যথা’।

কিন্তু ওই মেয়ে বুঝলে তো! সবসময়ই ও এমন অবুঝ, নিজে যা ভাববে সেটাই করবে আর আমাকে দিয়েও করাবে। আজ যদি না যাই, তবে হয়ত আগামী দশদিন কথাই বলবে না আমার সঙ্গে, সেটা সহ্য করা আবার আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে যাবে।

অথচ এটাই সম্ভব করতে চাই আমি, তাতে আমাদের দুজনেরই ভালো। সেটা আমার বুদ্ধি বুঝলেও, মন বোঝে না। মন ভাবে, যতটুকু সময় চুরি নেওয়া যায় সেটাই প্রাপ্তি, সেটাই সঞ্চয়। এভাবেই একটু একটু করে জড়িয়ে পড়লাম মায়াজালে, চেষ্টা করেও যার থেকে বেরতে পারছি না।

বৃষ্টিকে কোনও দোষ দেওয়া যায় না, ও কোনওদিন বলেনি যে আমাকে ভালোবাসে। তবে সব কথা কি আর মুখে বলতে হয়! কিছু কথা থাকে এমন, যা চোখ থেকে চোখে সংক্রমিত হয়ে যায় ঠিক ছোঁয়াচে অসুখের মত।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র উৎসবের সেই সন্ধ্যাটা আমার জীবনে না এলেই বোধহয় ভালো হত। কী যে ম্যাজিক হয়ে গেল সেই সন্ধ্যায়!

বসন্তের হাওয়া বইছিল, বাতাসে ভেসে আসছিল কী একটা অচেনা ফুলের গন্ধ। মেলার মাঠে ছাউনি ফেলে স্টেজ বানানো হয়েছিল। সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের হলদেটে আলোয় ছাউনির ভেতরটা আলোকিত হয়ে থাকলেও আলো-আঁধারিতে মাঠটাকে অপ্রাকৃত লাগছিল।

আমরা তখন বিশ্বভারতীতে, মাস্টার্স করছি, হোস্টেলে থাকি। ছাত্র উৎসবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সন্ধ্যেবেলা শুরু হয়ে সারারাত ধরে চলবে। আমরা যারা হোস্টেলে থাকতাম তারা তো বটেই, ডে স্কলাররাও আসত সেই অনুষ্ঠানে।

সেই সন্ধ্যায় আমি সাতটা নাগাদ চলে এসেছিলাম মাঠে, অনুষ্ঠান শুরু হতে তখনও ঢের দেরি। হোস্টেলে মন টিকছিল না, কখন যে বৃষ্টির সঙ্গে দেখা হবে সেটা ভেবে ছটফট করছিলাম ভেতরে ভেতরে। মাঠে পৌঁছে গেলেই যে বৃষ্টির সঙ্গে দেখা হবে না জানতাম, তবুও যদি ও তাড়াতাড়ি চলে আসে সেই ভেবে চলে গেছিলাম।

কিছুক্ষণ বাদে দেখা দিল সে। হোস্টেলের আরও মেয়েদের সাথে আসছে দূর থেকে দেখতে পেলাম। সাদা রংয়ের একটা শাড়ি পরেছিল ও, মাথায় ফুল গুঁজেছিল, কী যে সুন্দর লাগছিল! ওর সেই রূপ আমি আজও চোখ বুজলে দেখতে পাই। আমাদের ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে একসাথে বসেছিল, বৃষ্টি এসে সেখানেই বসল। বন্ধুদের অনেকেই মনে করত বৃষ্টির সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের গন্ডি ছেড়ে আরও অনেকদূর পৌঁছে গেছে, আজ বা কাল আমরা সেটা স্বীকার করব, তাই ওরা আমাকে বৃষ্টির আড়ালে ঠাট্টা করত। বৃষ্টিকে আসতে দেখে তাই আমার পাশ থেকে উঠে গেল কাজল, বলল, ‘নে তোর বউ এসে গেছে, এবার পাশে বসা।’

‘যদি সেটা সত্যিই হত!’

আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে হাসলাম কাজলের দিকে তাকিয়ে, মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ওকে ধন্যবাদ দিলাম।

অনুষ্ঠান শুরু হতে তখনও দেরি ছিল, তাই বড় বড় সাউন্ডবক্সগুলোতে গান বাজানো হচ্ছিল সন্ধ্যা থেকেই। বৃষ্টি এসে বসার পর গীতা দত্তের গলায় ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’ শুরু হল। গানটা শুরু হতেই, কী ভেবে কী জানি, বৃষ্টি সকলের নজর বাঁচিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। আর আমিও সেই মুহুর্তে ওর দিকেই তাকিয়েছিলাম। চোখ থেকে চোখে পৌঁছে গেল বার্তা, সেই বার্তা তারপর থেকে আমি আমার বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে চলেছি।

আমি জানতাম, বৃষ্টি কোনওদিন আমার হবে না। তবুও সেইসব দিনগুলোতে নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, ওকে যে কটা দিন, যেটুকু সময় একান্ত আমার করে পাব, সেটাও তো কিছু কম প্রাপ্তি নয়। সেটা নিয়ে না হয় কাটিয়ে দেব বাকি জীবন।

কিন্তু সে কী আর হয়! আমিও তো রক্তমাংসের মানুষ। যখন বৃষ্টিকে ওর আইনসিদ্ধ বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখি, তখন ভালো লাগে না আমার। বৃষ্টি বলেছে আমাকে, মাস্টার্স ডিগ্রি কমপ্লিট হলেই এই ছেলেটির সঙ্গে ওর বিয়ে হবে, তারপর ওরা চলে যাবে বিদেশে। ওখানে ওর ডাক্তার বর আরও পড়াশোনা করবে।

আজ বৃষ্টির বাড়িতে, ওর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ওর সেই আইনসিদ্ধ বয়ফ্রেন্ড নিশ্চয়ই থাকবে (আমি জিজ্ঞেস করিনি, আমার মন বলছে), ওখানে আমার যাওয়াটা কি উচিত! যদিও ওর বাড়ির সকলে আমাকে নিছক বন্ধু হিসাবেই জানে, কিন্তু আমি তো জানি সত্যিটা কী!

সেই রাতে, অনুষ্ঠান শেষ হবার পর যখন আমি ওকে হোস্টেল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলাম, ওই বকবক করা মেয়ে সারাটা পথ কোনও কথা বলেনি। দুজন চুপচাপ ভূতগ্রস্তের মত হেঁটে চলছিলাম, অপার্থিব মনে হচ্ছিল চারপাশের প্রকৃতি, এমনকি নিজেদেরও। আমার বুকের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছিল, বৃষ্টিরও হয়তো তাই। হোস্টেলের দরজায় দাঁড়িয়ে ও চোখ তুলে তাকিয়েছিল আমার দিকে, আমি দেখেছিলাম, ওর চোখে টলটল করছে জল। কালও ওইরকম জলভরা চোখে বৃষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে অনুনয় করেছে, ‘তুই না এলে, আমার জন্মদিনের আনন্দটা পুরো মিথ্যে হয়ে যাবে।’

এই কথার পর আমি কীভাবে আর না গিয়ে পারি!

আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু জানে বৃষ্টির প্রতি আমার এই দুর্বলতার কথা। ওরা আমার ছোটবেলার বন্ধু, তাই ওদের না বলে থাকতে পারিনি। আসলে, মানুষ যখন কারো প্রেমে পড়ে, তখন বোধহয় তার এভারেস্টে গিয়ে চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে জানাতে ইচ্ছে করে এই আনন্দের কথা। আমার তো সে উপায় নেই, পুরোটাই একতরফা, তাই চেপে থাকতে হয় এই ইচ্ছেটা। এই অবস্থায়, কোনও দুর্বল মুহুর্তে বন্ধুদের সামনে মনের কথা মুখে চলে এসেছিল।

ওরা সাবধান করেছিল আমাকে। ঋষি বলেছিল, ‘তুই যখন জানিস, বৃষ্টি একটা রিলেশনে আছে, তাহলে ওর সাথে এত জড়িয়ে পড়ছিস কেন?’

‘চাইছি না। কিন্তু ওই মেয়ে প্রতিদিন একটু একটু করে আমাকে অধিকার করে ফেলছে।’

ধৃতি আরও রূঢ়ভাষী, বলেছিল, ‘মেয়েটাকে মোটেই সুবিধার লাগছে না রে। ও নিজে যখন জানে ওর অন্য রিলেশন আছে, তাহলে ও তোর সাথে এমন করে মেশে কেন? ওর স্বভাবচরিত্র মোটেই ভালো নয় রে। ও তোকে নিয়ে খেলছে।’

ধৃতির কথা শুনে মুখটা তেতো হয়ে গেল। আমার বৃষ্টি আর যাই হোক খারাপ স্বভাবের মেয়ে নয়। হতেই পারে না। ও বড্ড সোজা সরল, সহজভাবেই মেশে আমার সাথে, তার প্রভাবটা যে আমার ওপর কী হতে পারে, সেটা ও বুঝতেই পারে না। আমি সিওর।




“প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকলখানে”

‘কাল এক জায়গায় যাবি? তোর দারুণ লাগবে, গ্যারান্টি।’

‘কোথায়?’

‘কোথায় সেটা কালই বলব। আগে বল যাবি কি না?’

‘মানে আবার দুপুরে কলেজ কাটতে হবে, তাই তো?’

‘ওরে আমার শেক্সপিয়ারের নাতি রে! কলেজ কাটার নাম শুনে কী দুঃখু! কতদিনের শখ আমার এই জায়গাটায় যাওয়ার, আর উনি এখন সিরিয়াস স্টুডেন্ট হয়ে গেলেন!’

‘তা অনেকদিনের শখ যখন আগে যাসনি কেন? তোর তো পার্মানেন্ট লোক আছেই!’

‘সবাইকে নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। এখানে আমি তোর সাথেই যাব, ব্যস্। দশটার মধ্যে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসব আমি, এসে যেন তোকে দেখতে পাই।’

‘মহারানীর হুকুম যখন মানতেই হবে।’

‘কাল কিন্তু তোর ক্যামেরাটা নিয়ে আসিস মনে করে। অনেক সাবজেক্ট পাবি তোর ইন্টারেস্টের, গতবারের মত আফসোস যেন করতে না হয়।’

দশটা বাজার অনেক আগেই বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেল নিষাদ। যদিও বৃষ্টি বলেনি কোথায় অভিযানে যাবে তারা, তবু সারাটাদিন বৃষ্টির সঙ্গে একান্তে কাটাতে পারবে ভেবে উত্তেজনায় রাতে ভালো করে ঘুমই হয়নি নিষাদের।

বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার মুখে অপেক্ষা করছিল নিষাদ আর ঘড়ির কাঁটার দিক থেকে মনকে সরাতে সিগারেটের দিকে মনোযোগ দিয়েছিল।

দুটো সিগারেট শেষ করে তিন নম্বরটা যখন মাঝামাঝি তখন বৃষ্টি এসে পৌঁছল।

‘কটা ফোঁকা হল?’ ওর প্রথম কথা ছিল এটাই।

‘মাত্র আড়াইটে।’ ধরা পড়ে গিয়ে ক্যাবলার মত হাসল নিষাদ।

‘গুড। এবার ফেলে দে। বাসে উঠতে হবে।’

বৃষ্টির পেছন পেছন বাসে উঠল নিষাদ। সামনে দিকে বেশ কিছু সিট ফাঁকা ছিল,তবু বৃষ্টি গিয়ে বসল একদম শেষের টানা লম্বা সিটটাতে।

‘এখানে বসলি কেন? ঝাঁকুনি বেশি লাগবে তো।’

‘গাধা। সামনের দিকে বসলে দুজনকে নদীর দুই পাড়ে বসতে হবে না? এই সিটটাতে পাশাপাশি বসা যাবে।’

‘ওহ! কী বুদ্ধি রে তোর!’ ঝপ করে বৃষ্টির পাশে বসে পড়ল নিষাদ।

‘এবার তো বল কোথায় যাচ্ছি?’

‘বাউল ফকির মেলায়। গিয়ে দেখবি রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে বাউল-বাউলানী, ফকির-ফকিরানীরা এসে আখড়া বানিয়ে আছে। দিনের বেলায় তারা নিজেদের মত থাকে, গানবাজনা, সাধনভজন করে, সকলের সাথে কথা বলে। আর রাতে স্টেজে গানবাজনা হয়। কত জায়গা থেকে যে মানুষ আসে গানবাজনা শুনতে।’

‘তুই কী করে জানলি? গিয়েছিলি আগে?’

‘আমার ড্রইং স্যরের কাছে গল্প শুনেছিলাম। স্যর যেতেন প্রতি বছর। সেই থেকে আমার যাওয়ার ইচ্ছে, এতদিনে সম্ভব হল।’

‘নিশ্চয়ই তুই বাড়িতে বলে আসিসনি?’ নিষাদ জিজ্ঞেস করল।

‘পাগল! তুই বলেছিস নাকি?’

‘বলেছি অগ্যস্ত যাত্রায় যাচ্ছি, পুত্রকে দেখে নাও ভালো করে, আর না-ও ফিরতে পারে। মাকে আমি সবই বলি, মা কোনও কিছুতেই বাধা দেয় না।’

‘কার সঙ্গে যাচ্ছিস সেটাও বলেছিস?’

‘হুম। বলেছি একটা পাগলির সঙ্গে।’

কথাটা শুনে নিষাদের কান মলে দিল বৃষ্টি।

সারাটাদিন অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে কাটল ওদের। একসাথে এতজন বাউল ফকিরের সান্নিধ্য পাওয়া, তাদের কথা শোনা, গান শোনা, এমন সুযোগ আগে কখনও পায়নি ওরা। নিষাদ তো ছবি তোলার সাথে সাথে এমন প্রশ্ন-উত্তর পর্ব শুরু করল যে অনেকেই মনে করছিল ওরা তথ্যচিত্র বানানোর জন্য ফটোশ্যুট করছে।

তাতে অবশ্য ওদের সুবিধাই হচ্ছিল, এত গুরুগম্ভীর একটা জায়গায় পুঁচকে ছেলেমেয়েদের দেখে পাত্তা না দেওয়ার যে প্রবণতা থাকে, সেটা রইল না। মেলার কর্মকর্তাদের একজন জিজ্ঞেসও করেছিল, নিষাদ ওর মুখটাকে যতটা সম্ভব গম্ভীর করে বলেছিল, ‘আমরা জার্নালিজম এর স্টুডেন্ট। আমাদের প্রজেক্টের জন্য একটা ডকুমেন্টরি বানাতে হবে, তাই ইন্টারভিউ নিচ্ছি।’

বাউলদের জীবন, সাধনা সম্পর্কে এত অল্পবয়সী দুজনকে কৌতুহলী হতে দেখে একজন বাউল বৃষ্টিকে বললেন, ‘বুঝলি রে মা! বাউলদের সাধনা হল মনের মানুষকে খোঁজার সাধনা। তাই তো আমাদের সাধনার জন্য সঙ্গী দরকার।’

‘কীভাবে সাধনা করেন আপনারা?’ কৌতুহলী বৃষ্টির প্রশ্ন।

আখড়ায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা মুখ টিপে হাসলেন। একে তো তাঁদের সাধনের তত্ত্ব গোপন রাখতে হয়, বাইরের কাউকে সেসব বলা যায় না, তার ওপরে আবার তাদের দেহতত্ত্বের সাধনার কথা এতটুকু পুঁচকে মেয়েকে কী বলবেন!

নিষাদ বুঝতে পেরেছিল খানিকটা। তাই বৃষ্টিকে ধমকালো, ‘থাম দেখি! একদিন এসেই সব জেনে-বুঝে যাবি নাকি তুই?’

তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘এসব কথা গোপন রাখতে হয় ওঁদের। জিজ্ঞেস করতে নেই।’

গলা নামালেও একজনের কানে ঠিক চলে গেছিল কথাটা। তিনি নিষাদের চিবুক ধরে আদর করে বললেন, ‘বাবা আমার সব জানে। আয় বস দেখি এখানে, তোদের গান শোনাই একটা।’

গান ধরল সেই বাউল।

‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে

আছে সে নয়ন তারায় আলোকধারায় তাই না হারায়

তাই হেরি তায় যেথায় সেথায় তাকাই আমি যেদিক পানে’

রবীন্দ্রনাথের গান এটা, বৃষ্টির শোনা। কিন্তু দোতারা বাজিয়ে এমন করে প্রাণ ঢেলে গাইতে শোনেনি আগে কখনও। শুনতে শুনতে কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গেল বৃষ্টির, মনে হতে লাগল এই গানের কথাগুলো যেন ওরই মনের কথা, গলা মেলাল সেও।

ততক্ষণে বাউল নেমে এসেছেন দাওয়া ছেড়ে, তাঁর ঘুঙুর পরা পা দুটোও আর স্থির নেই। নাচতে নাচতে তিনি গেয়ে চলেছেন,

‘কে তোরা খুঁজিস তারে কাঙাল বেশে দ্বারে দ্বারে

দেখা মেলে না মেলে না

তোরা আয় রে ধেয়ে দেখ রে চেয়ে

দেখ রে আমার দুই নয়ানে’

বৃষ্টিও গেয়ে চলেছে, ওর চোখ বন্ধ। স্থান কাল ভুলে গেছে মেয়েটা, বুঝতে পারছিল নিষাদ। চারপাশে ভীড় জমে গেছিল, মেলায় আসা মানুষজন তো বটেই, আশেপাশের আখড়া থেকেও অনেকে এসে শুনছিল এই যুগলবন্দী।

একসময় ভেঙে গেল এই অপার্থিব ফ্রেমের মুহুর্তগুলো। বৃষ্টি চোখ খুলল, ওর চোখে টলমল করছে জল। এই অশ্রু আনন্দের। বৃষ্টি অনুভব করতে পারছিল, ওর ভেতরে একটা রূপান্তর ঘটে গেছে। যেন চরাচরে কেউ কোথাও নেই, নেই কোনও পিছুটান, কোনও সম্পর্কের বাঁধন। নিজের অজান্তেই ও নিষাদের হাতটা ধরে ফেলল। নিজেকে এমন বন্ধনহীন, হালকা আগে কখনও লাগেনি বৃষ্টির।

দুপুরে মেলা কমিটির ছাউনিতে খাওয়া হল। প্রচুর মানুষ একসাথে বসে খাচ্ছে। সেখানে যেমন বাউল ফকিররা আছেন, তেমনি আছে মেলায় উপস্থিত সাধারণ মানুষ। আয়োজন সামান্য, ভাত ডাল আর পাঁচমিশালি একটা তরকারি।

কলার পাতায় মোটা চালের ভাত, ধোঁয়া ওঠা ডাল, বড়ি দিয়ে তরকারি, অমৃত লাগল ওদের। মেলা শব্দের অর্থ মিলন, ছোটবেলায় পড়েছে বৃষ্টি, আজ প্রথমবার ও উপলব্ধি করতে পারল শব্দটার তাৎপর্য।

নিষাদের সঙ্গে এতটা জড়িয়ে পড়া যে ঠিক হচ্ছে না প্রতিদিনই একবার করে মনে হয় বৃষ্টির। কিন্তু কী যে হয়, বন্ধু হিসাবে এতটাই ভালো ও, এত ভালো বোঝাপড়া দুজনের মধ্যে, যে ওকে বাদ দিয়ে প্রতিদিনের যাপনের কথা ভাবাই যায় না।

ভালো বন্ধু পাওয়া তো সোজা কথা নয়, সবাই পায়ও না, নিজেকেই নিজে বলে বৃষ্টি।

‘আমরা দুজনে যদি খুব ভাল বন্ধু হিসাবেই থেকে যাই সারাজীবন, তাতে অসুবিধা কী!’

একদিন কথাটা বলেই ফেলল নিষাদকে।

‘অসুবিধার কথা আসছে কেন তোর মাথায়?’

নিষাদের উত্তরটা শুনে বৃষ্টি লজ্জায় পড়ে গেল। যদি নিষাদ অন্যরকম কিছু ভেবে থাকে সম্পর্কটা নিয়ে, সেটা ভেবেই ও আগ বাড়িয়ে কথাটা বলেছিল। নিষাদ যখন বন্ধুত্বের বাইরে অন্য কিছু ভাবেনি, তখন আর মানসিক অশান্তির কোনো কারণই নেই। সত্যিই তো, ও অন্য কিছু ভাববেই বা কেন? বৃষ্টি তো আর নিজের এনগেজমেন্টের কথাটা গোপন করেনি।

অতএব সময় এগোতে থাকে, বাড়তে থাকে দু’দিকের টানও। শুধু একটা পর্দা থেকে যায় দুদিকেই, কেউই কাউকে জানতে দেয় না কতটা জড়িয়ে পড়েছে তারা, কারো কাছে স্বীকার করে না পরস্পরকে ছেড়ে থাকা দিন দিন কতটা অসম্ভব হয়ে পড়ছে দুই তরফেই।




“আজ ফির উনকা সামনা হোগা
কেয়া জানে উসকে বাদ কেয়া হোগা’

কলেজ থেকে ফিরে এসে বুবলাকে নিজের ঘরে বসে থাকতে দেখে অবাক হল বৃষ্টি।

‘তুমি?’

‘কেন? খুশি হওনি?’

‘তা কেন! আজ তো তোমার ফেরার দিন নয়, তাই জিজ্ঞেস করলাম। ওরকমভাবে বলছ কেন?’

‘তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করল তাই চলে এলাম। কাল ভোরের ট্রেনে আবার ফিরে যাব।’

‘বেশ করেছ। একটু বসো, আমি চেঞ্জ করে আসছি।’

আসলে চেঞ্জ করার জন্য যেটুকু সময় পাওয়া যাবে সেটা বৃষ্টির খুবই দরকার এখন। ওকে একটা সুইচ অফ করে আর একটাকে অন করতে হবে। কলেজ থেকে ফেরার পথে নিষাদের সঙ্গে যে কথোপকথন হয়েছে, সাহিত্য, নাটক, গান বা নিছক ম্যাগাজিনে পড়া কোনও গল্প কিংবা ফিচার, সেই সবকিছু মন থেকে মুছে ফেলতে হবে এখন। বুবলার সাথে কথা বলার সময় ওসবের বিন্দুমাত্র চিহ্ন থাকা চলবে না।

এমনিতেই বৃষ্টির লিটারেচার নিয়ে পড়াটা ওর খুব একটা ভালো লাগেনি, মেনে নিয়েছে শুধু। তার ওপর ওসব সংক্রান্ত কথাবার্তা বললে মুখে কিছু বলবে না হয়তো কিন্তু মুখ গম্ভীর করে বসে থাকবে।

কিন্তু বুবলা চেঞ্জ করে আসার সময়টুকু দিল না। হ্যাঁচকা টানে বৃষ্টিকে বুকে টেনে নিল।

কোনরকমে বুবলার ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁটটা বার করে বৃষ্টি বলল, ‘ছাড়ো! দরজা খোলা আছে, কেউ দেখে ফেলবে।’

বুবলা গিয়ে দরজাতে ছিটকিনি দিল।

‘আটকে দিলে? যদি মা আসে?’

‘আসলে আসবে। নিজের বউকে একটু আদর করছি, অন্যায় কিছু করছি না।’

‘ইসসস! আমি বউ নাকি তোমার?’

‘হবে তো। কাল নয়ত পরশু। যদি আমার ওপর ভরসা না থাকে, চল রেজিস্ট্রি করে নিই।’

‘আমি মোটেও ভরসা না করার কথা বলিনি। আমি বলছি…’

বৃষ্টিকে বাকি কথা শেষ করতে দিল না বুবলা। চুমুতে বন্ধ করে দিল ওর মুখ।

অনার্স পেপারের শেষ দিন ছিল সেটা। এর পরে দিন পনেরর বিরতি, তারপর পাসের পরীক্ষা শুরু হবে। অনার্সের পরীক্ষার সিট অন্য কলেজে পড়ে, অন্য শহরে। ছেলেদের আর মেয়েদের সিট পড়েছে আলাদা কলেজে, ফলে এই কটা দিন নিষাদের সঙ্গে দেখা হয়নি বৃষ্টির। আজ পরীক্ষা শেষ করে কলেজের বাইরে বেরতেই বৃষ্টি দেখল নিষাদ দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। মনে মনে এরকম একটা কিছু চাইছিল বৃষ্টি, ইচ্ছেপূরণ হওয়ায় দারুণ খুশি হল, হাসতে হাসতে এগিয়ে এল নিষাদের দিকে।

‘কেমন হল?’ বৃষ্টি জিজ্ঞেস করল।

উত্তর দিল না নিষাদ। হাসিমুখে একটা কাগজ এগিয়ে দিল বৃষ্টির দিকে।

‘টুকলি নাকি? তা এখন নিয়ে আর কী করব!’ ঠাট্টা করে কথাটা বলল বৃষ্টি, কাগজের ভাঁজটা খুলে দেখল, দুটো নাটকের টিকিট। চোখ বড় বড় করে নিষাদের দিকে তাকাল বৃষ্টি।

‘এতদিন কষ্ট করে পড়াশোনা করলাম, নিজেদের রিওয়ার্ড দিতে হবে না! বাড়িতে ফোন করে বলে দে, ফিরতে দেরি হবে। পরীক্ষা শেষ, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, খানাপিনা করে ফিরবি।’

‘তাহলেই হয়েছে! মা অমনি বলবে পরীক্ষা কি চিরতরে শেষ? পাসের পরীক্ষাগুলো কি না দিলেও পাস হয়ে যাবে? তার চেয়ে বলছি, মৌসুমীর বাড়িতে যাচ্ছি, ওর কাছ থেকে কিছু নোটস সাজেশন নিতে হবে।’

‘মুক্তধারা’র টিকিট কেটেছিল নিষাদ, দেখতে দেখতে ফিসফিস করে নানান খুঁটিনাটি জিনিস বোঝাচ্ছিল, নাটকের মর্ডান ফর্মের ব্যকরণ। মঞ্চ নির্মাণ, একই মঞ্চ আর প্রপসকে নানাভাবে ব্যবহার করার কৌশল, নিজে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বৃষ্টিকে বলছিল। বৃষ্টির মনে হচ্ছিল, যদি বাকি জীবনটা নিষাদের সঙ্গে থেকে যেতে পারত, কত ভালো হত। নিষাদ ওর স্বপ্নকে ছুঁয়ে ফেলত, পরিচালক হত ও, আর বৃষ্টি ওকে সাহায্য করত। ঠিক যেমন বিজয়া রায় সারাজীবন পেছনে থেকে সব ব্যাপারে সাহায্য করে গেছেন সত্যজিৎ রায়কে।

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল বৃষ্টির বুক থেকে। সেটাকে গিলে ফেলে ও বলল, ‘গ্রেট ট্রিট। আমার তরফ থেকে পাওনা রইল তোর, খেতে যাব একদিন আমরা। সেদিন আমি খাওয়াব। আজ হলেই ভাল হত, কিন্তু মা পিটিয়ে ঠ্যাং ভেঙে দেবে। ঠ্যাং ভাঙলে বাড়ি থেকে বেরতে পারব না আর তোর সাথে দেখাও হবে না।’

‘আমার সাথে দেখা হওয়াটা কি খুব জরুরি?’

‘নয়?’

ভুরু দুটো তুলে চোখ বড় বড় করে তাকাল বৃষ্টি। ওর এই তাকানোর ভঙ্গিটা ভীষণ ভালো লাগে নিষাদের, আরও একবার মরে গেল ও।

রাতে ঘুম আসছিল না। একটা অস্বস্তি ভেতরটাকে শান্ত হতে দিচ্ছিল না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিল নিষাদ, বৃষ্টিকে যতই ভালো লাগুক না কেন, ওকে নিজের করে পাওয়া হবে না কোনওদিন, এটা জেনেও কেন প্রতিদিন আগুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে? পুড়তে হবে জেনেও কেন আগুন জ্বালাতে এত আনন্দ ওর? তবে কি অবচেতন মন আশা করে বসে আছে, ওর ভালোবাসা বৃষ্টিকে ছিনিয়ে আনবে ওর হবু বরের কাছ থেকে? এমন তো হামেশাই হয়ে থাকে, নিষাদের ক্ষেত্রেই বা সেটা হতে অসুবিধা কোথায়? কিন্তু তারপরেই এমন স্বার্থপরের মত ভাবনা ওর মনে বাসা বেঁধে আছে বুঝতে পেরে নিজেকে খুব ছোট মনের মানুষ মনে হতে লাগল নিষাদের।

মাঝেমধ্যে আবার মনে হচ্ছিল, এমন ভাবনার পেছনে বৃষ্টির কি আস্কারা নেই? হয়ত ও নিষাদকে তেমনভাবেই ভালোবাসে যেমনটা নিষাদ ভাবছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না ওর এই দ্বিচারিতাকে নিষাদ কী ভাবে নেবে সেই ভয়ে। হয়ত বৃষ্টিও নিষাদের দিক থেকে কিছুটা প্রশ্রয় পাবার আশায় আছে, নিষাদের ডাক শোনার অপেক্ষায় আছে। নিষাদ একবার হাত বাড়িয়ে দিলেই ও হয়ত সব বন্ধন ছিঁড়ে ফেলে চলে আসবে। বৃষ্টির কাছে যে অর্থ, প্রতিপত্তির তেমন কোনও দাম নেই, সেটা এতদিনে বুঝে গেছে নিষাদ। কাজেই ডাক্তার আর বেকারের মধ্যে তুল্য মূল্য বিচার করে ও যে সম্পর্ক তৈরি করবে না বা রাখবে না এটা নিশ্চিত।

তবে কি নিষাদ ওকে খোলাখুলি বলেই দেবে নিজের মনের কথা আর তারপর ওর কোর্টে বল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে? কিন্তু যদি সবটাই নিষাদের বোঝার ভুল হয়? হয়ত বৃষ্টি তার প্রেমিকের সঙ্গে খুব ভালো আছে, আর নিষাদকে ও কেবল ভালো বন্ধু হিসাবেই দেখে। সেক্ষেত্রে এরকম একটা কথা বৃষ্টিকে বলা মানে ওকে এবং ওর সম্পর্কটাকে অপমান করা। নিষাদের মনোভাব জানার পর যদি বৃষ্টি ওর সাথে আর বন্ধুত্বও না রাখে? দেখলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়? সেটা তো সহ্য করতে পারবে না নিষাদ। তারচাইতে এই ভালো, বন্ধুর মত পাশাপাশি থেকে গেলে অন্তত কথা হবে, চোখের দেখাটুকু হবে। ওটুকুও যদি না থাকে, নিষাদের আর কিছুই থাকবে না।




“তুমি খুব ভালোবেসেছিলে
তুমি খুব কাছে এসেছিলে
এখন তোমারও সৌধ ভেদ করে
চলে যেতে হবে
আরও বড় বেদনার
আরও বড় আগুনের আরতির দিকে”

‘বুবাই তোর বৃষ্টিকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আয়, দেখি। শুধু তো গল্পই শোনাচ্ছিস।’

‘সে যদি তুমি বল, আসতে বলব। তবে ‘আমার বৃষ্টি’ নয় ও, আমরা শুধু খুব ভালো বন্ধু।’

ছেলের কথায় হাসলেন নীলাঞ্জনা। নিজের কলেজ জীবনের দিনগুলো মনে পড়ে গেল। ‘জাস্ট গুড ফ্রেন্ড’ কত দেখেছেন তখন, আর তাদের কদিন বাদে ‘কাপল’ হতেও দেখেছেন।

‘বুবাই! এই কথাটা তোর ক্লাসমেটদের জন্য তুলে রাখ। মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নাকি?’

‘জানি তো! তোমায় কি কোনওদিন কিছু লুকিয়েছি? এটাও সত্যি।’

নিষাদের স্বরের পরিবর্তন শুনে নীলাঞ্জনা ব্যাপারটার গুরূত্ব বুঝতে পারলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

‘মানে? সমস্যাটা কী?’

‘অলরেডি ওর স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে। কলেজে ভর্তি হবার আগে থেকেই আছে। মাস্টার্স ডিগ্রি কমপ্লিট হলেই বিয়ে হবে ওদের, বাড়ি থেকে ঠিক করে রেখেছে।’

নীলাঞ্জনা চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। ছেলের মনের ভেতরকার চাপা কষ্টের তল খানিকটা হলেও তিনি পাচ্ছিলেন। মা হয়ে তিনি কীভাবে কেবলমাত্র দর্শক হয়ে ছেলেকে একটু একটু করে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে দেখতে পারেন!

‘বুবাই! আমার মনে হয় তোমার নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া উচিত। যখন তুমি জানো এর কোনও পরিণতি নেই, তখন আরও জড়িয়ে পড়া একদম উচিত নয়। এতে দুজনেরই ক্ষতি। না তুমি ভালো থাকতে পারবে, না ওই মেয়ে শান্তিতে সংসার করতে পারবে।’ নিষাদ জবাব দিল না মায়ের কথার। কী বলবে? সবটাই তো জানে ও, তবু পারছে কোথায় লাটাইয়ের সুতোগুলোকে উল্টোপাকে ঘোরাতে!

সেদিন নিষাদ ক্লাবে যাবার পর ঋষি বলল, ‘একটি মেয়ে আমাদের দলে থিয়েটার করতে চায়। আগে কখনও গ্রুপ থিয়েটার করেনি, কিন্তু স্কুলে পড়তে অনেক নাটক করেছে বলল।’

‘স্কুলের নাটক মানে তো ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ বা ‘রামের সুমতি’। ওই দিয়ে কি আর গ্রুপ থিয়েটার হয়!’

‘হয় না। তবে ইচ্ছে থাকলে শিখে নিতে তো পারে। তুই, আমি কি নাটক সঙ্গে নিয়ে জন্মেছিলাম?’

‘এঃ! বড্ড ফাটছে দেখছি! তোর কে হয় মেয়েটা?’ নিষাদ জিজ্ঞেস করল ঋষিকে হাসতে হাসতে।

‘কেউ কি হতেই হবে সবসময়? ধরে নে পাড়াতুতো বোন।’

‘আসতে বল। দেখি তাকে।’

পরেরদিন ঋষির সঙ্গে এল সুচেতা। বয়সে বছর তিনেকের ছোটই হবে, সবে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। পরিচালক সুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে নিষাদ ওর সাথে কথা বলল, কথা বলে বেশ ভালো লাগল ওর। কথাবার্তায় কোনও জড়তা নেই, ন্যাকামি নেই, হাবভাব অনেকটা বৃষ্টির মত। হয়ত সেইজন্যই সুচেতাকে পছন্দ হয়ে গেল নিষাদের, ওকে সেদিনই একটা ছোট পার্ট দিয়ে দলে নিয়ে নিল নিষাদ।

অভিনয়টা ভালোই করছিল সুচেতা, শেখার আগ্রহ আছে, এমন মেয়ে দলে থাকলে আখেরে ভালোই। যে নাটকটার রিহার্সাল চলছিল তখন তাতে চারটে মেয়েদের চরিত্র ছিল। সুচেতা আসার পর দেখা গেল, যে মেয়েটি মুখ্য চরিত্রটা করছিল তার চাইতে সুচেতার অভিনয় অনেক বেশি সাবলিল। নিষাদ ভাবছিল, সুচেতাকে দিয়ে ওই চরিত্রটা করাবে কি না। মহুয়া বেশ পুরনো এই দলে, হঠাৎ করে ওকে সরিয়ে নতুন মেয়েকে দিয়ে মুখ্য চরিত্র করালে মহুয়ার হয়ত রাগ হবে, তাই কাজটা করতে পারছিল না নিষাদ।

সেদিন ঋষি আসেনি, সুচেতা রোজ ওর সাথেই বাড়ি ফেরে। রিহার্সালের পর তাই সুচেতা নিষাদকে বলল, ‘দাদা, আমাকে একটু গলির মুখ পর্যন্ত ছেড়ে দেবে? ওখানে কতগুলো বাজে ছেলে বসে আড্ডা দেয়, ভীষণ উল্টোপাল্টা কথা বলে পাশ দিয়ে যাবার সময়।’

নিষাদ ওকে সঙ্গে নিয়ে বেরলো।

সারাটা রাস্তা বকবক করে গেল সুচেতা, নানাবিষয়ে নানারকম কথা। শুনতে শুনতে বৃষ্টির কথা মনে পড়ছিল নিষাদের, কারণ ওর কথা বলার ধরণ ঠিক বৃষ্টির মত। বলব না বলব না করেও একসময় নিষাদ ওর কাছে চরিত্র বদলের কথাটা বলেই ফেলল, শুনেই সুচেতা তীব্র প্রতিবাদ করে উঠল।

‘না দাদা! তুমি এটা কোরো না। মহুয়াদি ঠিক তুমি যেমন চাইছ করে দেবে। ওই দিদি কত পুরনো, আমি সবে এসেছি, ওকে সরিয়ে দিয়ে ওই জায়গায় আমি পার্ট করতে পারব না।’

চমকে উঠল নিষাদ। ঠিক এই রকম প্রতিক্রিয়াই ও পেয়েছিল বৃষ্টির কাছ থেকে, যখন কলেজের নাটকে একটি মেয়েকে সরিয়ে ওই পার্টটা বৃষ্টিকে দিয়ে করাতে চেয়েছিল। ওখানে অবশ্য কারণটা অন্য ছিল, ওই মেয়েটি নিজেকে বিরাট বড় অভিনেত্রী ভাবত আর মাঝেমাঝে রিহার্সালে ডুব দিত। ফলে বাকিদের অসুবিধা হত। সে যা-ই হোক, সুচেতার কেবল কথা বলার ভঙ্গী নয়, মনটাও বৃষ্টির মত বড়, ভাবছিল নিষাদ।

ক্রমে সে সুচেতার মধ্যে আরও বেশি করে বৃষ্টিকে দেখতে শুরু করল।

‘বুঝলি, ভাবছি এবারে একটা প্রেম করব।’

‘যাক! এতদিনে ভেবেছিস জেনে ভালো লাগল। তা প্রেম করতে গেলে তো একটা মেয়ে লাগে, সেটা পেয়েছিস?’

‘খিল্লি করছিস! কত মেয়ে আমার জন্য পাগল জানিস? নেহাৎ আমি কাউকে পাত্তা দিইনি এতদিন, তাই।’

‘তা আর জানি না! আমি নিজেও কি তোর জন্য কম পাগল নাকি! আমি শুধু জানতে চাইছি এতদিন পরে নাক উঁচু বাবুটির কাকে মনে ধরল।’

বৃষ্টির মুখ এই কথা বলল বটে কিন্তু মন বলছিল, ‘খিল্লি করার মত বিষয়ই নয়। আমি কি বুঝি না মেয়েরা কত পছন্দ করে তোকে! নেহাৎ সবসময় তুই আমার সাথে থাকিস বলে ওরা কাছে ঘেঁষতে পারে না।’

নিষাদ তখন মনে মনে বলছিল, ‘তোকে ছাড়া এতদিনের মধ্যে আর কাউকে পছন্দ হয়নি আমার। এবার যাকে মনে ধরেছে সে শুধু তোর মত বলেই।’

বৃষ্টির প্রশ্নের জবাবে বলল নিষাদ, ‘কলেজের কেউ নয়। আমাদের থিয়েটার দলের মেয়ে, সুচেতা।’

‘জানিয়েছিস তাকে?’

‘বলিনি এখনও, বলব। সামনে একটা নাটকের শো আছে, ওটা হয়ে গেলে।’

‘শুভস্য শীঘ্রম। ভালো কাজ ফেলে রাখতে নেই।’

সেদিন বাড়ি ফিরে মনটা ভালো লাগছিল না বৃষ্টির। খুব ভালোবাসার জিনিস হারিয়ে গেলে যেমন কষ্ট হয়, তেমন একটা চিনচিনে কষ্ট হচ্ছিল বুকের মধ্যে।

নিজেকে নিজে শাসন করল কয়েকবার, ‘মন থেকে খুশি হও বৃষ্টি, নিষাদ তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তুমি নিজে অন্য কারো সাথে প্রেম করছ, দু’দিন পর তাকে বিয়ে করতে চলেছ, আর নিষাদ করবে না? এত হিংসুটে নাকি তুমি?’

কখনও আবার নিজেকেই বোঝালো, ‘মন খারাপের তো কোনওই কারণ নেই। নিষাদ তোমার বন্ধু, প্রেম করুক আর যা-ই করুক, ও তোমার বন্ধুই থাকবে। ওই জায়গাটা কি সুচেতা কেড়ে নিতে পারবে? তবে তুমি কেন শুধু শুধু হারিয়ে ফেলার ভয় পেয়ে কষ্ট পাচ্ছ?’

কিন্তু মন কি কম তার্কিক? সে-ই বা চুপটি করে এত শাসন শুনবে? তেড়েফুঁড়ে উঠে মন বলে বসল, হ্যাঁ থাকবে না হাতি। আস্তে আস্তে ওই সুচেতা মেয়েটাই সবটা দখল করে নেবে, আমার জন্য ওর কাছে সময় থাকবে কী করে?

বৃষ্টি আবার মনকে বোঝাল, ‘কেন? যেমন করে নিষাদ হয়ে আমার আছে, তেমন করে ওরও তো আমি থাকতে পারি।‘

এবারে মন ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, তুই একটা আস্ত গাধা! দুটোর মধ্যে পার্থক্যটা তোর চোখে পড়ল না? তুই আগে বুবলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিস, তারপর নিষাদের সাথে। তার মানে তোর কাছে নিষাদের সঙ্গে থাকাটা বেশি পছন্দের। আর নিষাদের ক্ষেত্রে উল্টো কেস। ও যদি তোর সাথে সম্পর্কে খুশি হয়ে থাকত, তবে সুচেতা কী করে এন্ট্রি পেত? যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখ।’

বৃষ্টি চুপ করে থাকল। মন তো একদম ঠিক জায়গাতেই আঙুল তুলেছে। এই কথার ওপর আর কিছু বলা চলে না। কিছুক্ষণ পর মিনমিন করে বলল, ‘ওর তো একটা জীবন আছে, ভবিষ্যৎ আছে। আমি তো আর ওর সঙ্গে থাকতে পারব না সারাজীবন।’

‘সেটা অন্য প্রসঙ্গ।’ মন নিজের জায়গায় অবিচল।




বৃষ্টিকে যে ইদানীং ইউনিভার্সিটিতে একটি ছেলের সঙ্গে খুব ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে সেই কথা বুবলার কানে পৌঁছে গেল। মাঝেমাঝেই বৃষ্টি যে ছুটির দিনেও বাড়িতে না ফিরে হোস্টেলে থেকে যায়, এতদিনে তার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ পাওয়া গেছে বলে মনে হল বুবলার। সন্দেহ বড় দ্রুত ডালপালা মেলে, একবার যাকে আশ্রয় করে তাকে নিংড়ে একেবারে নিঃশেষ করে দেয়। বুবলার মনে হচ্ছিল, তাই ইদানিং বৃষ্টিকে কেমন যেন উদাসীন লাগে, সপ্তাহান্তে বুবলাকে দেখেও তেমন একটা খুশি মনে হয় না। যতই দুজনের অভিভাবকেরা ব্যাপারটাতে যুক্ত থাকুক না কেন, সম্পর্কে যদি কোনওরকম ফাটল ধরে থাকে তবে সেটা শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। কথাটা কানে আসার পর থেকে বৃষ্টিকে হারিয়ে ফেলার কথা ভেবে যতটা না দুঃখিত হয়েছে বুবলা তার চাইতে অনেক বেশি তার অহম আহত হয়েছে। তার মতো একটি সুপুরুষ, যোগ্য ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন বৃষ্টি ক্লাসের কোনও এক ছোকরার সঙ্গে প্রেম করছে, এটা ভেবে ভীষণ রাগ হচ্ছে ওর। এমনিতেই সাহিত্য নিয়ে যেসব ছেলেরা পড়ে তাদের আঁতেল মনে হয়, তাদের একদম সুনজরে দেখে না বুবলা, এখন কিনা তেমন একটা আঁতেলের কাছে ওকে হেরে যেতে হবে, এটা ভেবে আর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছে না ও।

বৃষ্টির বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত আর ধৈর্য রাখতে পারল না বুবলা, ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করার জন্য ও নিজেই চলে গেল ইউনিভার্সিটিতে, এবং সেটা বৃষ্টিকে না জানিয়ে।

ইংরাজি ডিপার্টমেন্টের বাইরে একটু আড়ালে অপেক্ষা করছিল বুবলা। ক্লাস শেষ হবার পর বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ের সঙ্গে বৃষ্টিকে বেরতে দেখে এগিয়ে গেল ও।

‘তুমি?’

থতমত খেয়ে গেল বৃষ্টি। এখানে এসময়ে যে বুবলাকে দেখতে পাবে, ভাবতেও পারেনি ও।

‘এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেব, তাই আর বলিনি।’

‘ও! তা যে কাজে এসেছিলে হয়ে গেছে?’

ততক্ষণে বন্ধুদের ছেড়ে একটু এগিয়ে এসেছে বৃষ্টি। বন্ধুরা চেনে না বুবলাকে, তাই ভেবেছে পরিচিত কেউ, হয়তো দু’একটা কথা বলে চলে যাবে। তাই ওরা একটু দূরে অপেক্ষা করছিল বৃষ্টির জন্য।

বুবলার সন্দিগ্ধ চোখ ততক্ষণে ছেলেগুলোকে এক ঝলক দেখে বুঝে নিতে চেষ্টা করেছে শোনা কথার মধ্যে কতটা সত্যতা আছে। ওরা সবাই নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল ছিল, তাই বুবলার চোখ বিশেষ কাউকে খুঁজে পেল না।

‘হ্যাঁ, হয়ে গেছে কাজ, এবার বাড়ি ফিরব। দেখো তোমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে, ওদের বলে দাও তুমি আজ আমার সাথে বাড়ি যাচ্ছ।’

‘মানে? আমি বাড়ি কেন যাব? কী হয়েছে বাড়িতে?’

হঠাৎ করে বাড়িতে ফিরে যাবার কথা শুনে বৃষ্টির বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠল। খারাপ কিছু কি ঘটেছে ওখানে, যার জন্য বুবলা নিতে এসেছে ওকে, এটা ভেবে মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেল ওর।

‘আরে না না! আমার একা একা ফিরতে ভালো লাগছে না। গাড়ি নিয়ে এসেছি, চল দুজন একসাথে যাই, বেশ রোম্যান্টিক ব্যাপার হবে।’

বৃষ্টির মাঝেমাঝে মনে হয়, নিষাদকে মনে বসবাস করতে দেওয়ায় বোধহয় ও বুবলার প্রতি অন্যায় করে ফেলছে, এ নিয়ে খানিকটা অপরাধ ভোগে ও। সেই বোধ থেকেই বৃষ্টি এখন আর বুবলাকে ফেরাতে পারল না, ইচ্ছে না থাকা সত্বেও বাড়ি যেতে রাজি হয়ে গেল।

বৃষ্টি যখন বন্ধুদের দলের কাছে ফিরে গেল, তখন বুবলার তীক্ষ্ণ নজর আবার পড়ে নিতে চাইছিল ছেলেদের মধ্যে কেউ সত্যিই আছে কি না যে বৃষ্টির বিশেষ বন্ধু হতে পারে। যারা ছিল ওই দলে, তাদের আগে কখনও দেখেনি বুবলা, পরিচয় নেই কারোর সাথে। বৃষ্টির সঙ্গে এবার দলটা পুরো হাসতে হাসতে এগিয়ে এল বুবলার দিকে, পরিচয় করার জন্য। ওদের ভালো করে দেখে, ওদের সাথে কথা বলে বুবলার মনে হল, এর মধ্যে কোনও বিশেষ বন্ধু নেই, যার সন্ধানে এখানে আসা। তবে তার মানেই যে কথাটাকে ভুল বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে, তাও নয়।

কিছু পরে বুবলার সাথে বাড়ির দিকে রওনা হল বৃষ্টি। সমস্ত পথ ওর মনটা খচখচ করতে লাগল, কারণ হঠাৎ করে এই বাড়ি চলে আসার ব্যাপারটা নিষাদকে জানানো হল না। ওর মায়ের শরীরটা ভালো নেই বলে গতকাল বাড়িতে গিয়েছিল নিষাদ, আজ বিকেলে ফিরে আসার কথা ছিল ওর।

বুবলা ড্রাইভিং সিটে, বৃষ্টি পাশে। কিছু রাস্তা চুপচাপ গাড়ি চালালো বুবলা, কথাটা কীভাবে শুরু করবে সেটা মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছিল। বৃষ্টি একতরফা কথা বলছিল, ওদিক থেকে প্রত্যুত্তর না পেয়ে একটু পরে সেও চুপ করে গেল। কাচ বন্ধ গাড়িতে বাইরের শব্দ ঢুকতে পারছিল না, ভেতরেও অখন্ড নীরবতা, যেন বড় কোনও ঝড় আছড়ে পড়ার পূর্বাভাস। সাইক্লোনের ল্যান্ডফলের জন্য বুকে কাঁপন নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল বৃষ্টি।

‘দেখো, সেপারেশন যে কোনও সময়েই নেওয়া যায়। তবে একবার বিয়ে হয়ে গেলে ঝামেলা একটু বেড়ে যায়, তখন আবার কোর্ট কাছারি করতে হয়। যদি তুমি সম্পর্কটা নিয়ে অন্যরকম কিছু ভেবে থাকো তবে কোনওরকম হেজিটেট না করে এখনই বলে দিতে পার। জানোই তো বাবা-মা নেক্সট ইয়ার আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করছে।’

এমন একটা বাউন্সার আচমকা ধেয়ে আসায় বৃষ্টি চমকে গেল, ওর মুখ দিয়ে ছিটকে বেরল একটাই শব্দ, ‘মানে?’

‘সেটা তো তুমি বলবে। আমি শুনেছি তোমার অন্য একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। যদি সত্যি হয় সেটা আমাকে অনায়াসে বলে দিতে পার, আমি তোমাকে ধরে রাখব না।’

এই তো সেই সময়, বৃষ্টি এখন বলে দিতে পারে, সরি বুবলা! আমি আগে জানতাম না আমাদের সকলের জন্য একজন মনের মানুষ নির্দিষ্ট আছে। যদি দৈবাৎ সেই মানুষটা সামনে এসে যায়, নিজে থেকেই প্রেম হয়ে যায়। আমার জীবনে সেই মানুষটা হঠাৎ করে এসে গেল আর আমার অজান্তেই প্রেম হয়ে গেল। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ঠেকিয়ে রাখতে, তবু হয়ে গেল। আর তখনই আমি বুঝতে পারলাম তোমার আর সেই মানুষটার সাথে আমার সম্পর্কের পার্থক্যটা। তোমার সাথে আমি প্রেম ‘করেছি’, আর এখানে প্রেম ‘হয়ে গেছে’। ক্ষমা কোরো আমাকে, আমি সত্যিই খুব খুশি হব যদি আমরা বাকি জীবনটা একসাথে না কাটানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারি।

কিন্তু পারল না বৃষ্টি, কিছুতেই ওর মুখ দিয়ে এই নিষ্ঠুর কথাগুলো বেরলো না। বুবলার তো কোনও দোষ নেই, শুধু শুধু ওকে এত বড় একটা ধাক্কা দিতে মন সায় দিল না। ফলে সেই মুহূর্তে ও আরও বড় একটা ভুল করে ফেলল। বুবলাকে কষ্ট দিতে চায় না বলে সত্য গোপন করে বৃষ্টি ওর প্রতি অন্যায় তো করলই, সেই সঙ্গে ও নিজের প্রতি আর নিষাদের প্রতিও অন্যায় করে ফেলল।

নিজেকে সামলাতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল বৃষ্টি। দৃঢ় গলায় বলল, ‘তুমি কার কাছে কী শুনেছ জানি না, তবে এরকম কোনও কিছু হলে আমি নিজেই আগে তোমাকে বলব। আমাদের কলেজ থেকে ইংলিশে বিশ্বভারতীতে দু’জন শুধু ভর্তি হয়েছি এবার, নিষাদ আর আমি। স্বাভাবিকভাবেই ওর সাথে আমার বন্ধুত্বটা একটু বেশি থাকবে। এতে অনেকেরই গাত্রদাহ হচ্ছে, বিশেষ করে নিষাদ টপার বলে। সেটা যে তোমাকে রং লাগিয়ে পরিবেশন করা হবে, আর তুমিও বিশ্বাস করে নেবে, আমি ভাবিনি।’

‘আমি বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কিছুই করিনি। আমি কেবল তোমার কাছে সত্যিটা জানতে চাইছি।’

‘আমি তো বলেই দিলাম।’

‘এটাই সব?’

‘বললাম তো!’

‘সরি ডিয়ার!’

স্টিয়ারিং থেকে একটা হাত সরিয়ে বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরল বুবলা।


১০


“বন্দরের বন্ধনকাল এবারে মত হল শেষ
পুরানো সঞ্চয় নিয়ে শুধু বেচা কেনা আর চলিবে না
বঞ্চনা বাড়িয়া ওঠে, ফুরায় সত্যের যত পুঁজি”

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর সপ্তাহে দেড়দিন বাড়িতে থাকতে পারে নিষাদ, ফলে থিয়েটারের দলে একদিন করেই যেতে পারে। আপাতত ওদের দল কোনও নতুন নাটক ধরছে না, কোথাও কল শো থাকলে পুরনো নাটকগুলো থেকেই করবে বলে ঠিক করে রেখেছে। আর সেগুলো মাজাঘষা করার দায়িত্ব দেওয়া আছে ঋষিকে, নিষাদ সপ্তাহে একদিন শুধু শেষ তুলির টান দেবে, এভাবেই দুটো বছর চালিয়ে দেওয়া হবে।

সুচেতার সাথে ওই একদিনই দেখা হয় নিষাদের। নিষাদ ওকে কোনওদিন প্রস্তাব দেয়নি, তবে মেয়েটা তার মেয়েলি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে কিছু একটা অনুভব করতে পারে হয়তো। নিষাদ যথেষ্টই আকর্ষণীয় এবং যোগ্য ছেলে, সুচেতার ওকে প্রশ্রয় না দেবার কোনও কারণ নেই।

নিষাদ এখনও মনস্থির করে উঠতে পারেনি, ও বুঝতেই পারছে না সুচেতাকে আদৌ ভালোবাসে কি না। নাকি সুচেতা কেবলই বৃষ্টির পরিবর্ত হিসাবে ওর মনোযোগ কেড়েছে। সপ্তাহে ছয়দিন বৃষ্টির সঙ্গে দেখা হয় আর একদিন সুচেতার সাথে। সুচেতার বাড়িতে নিষাদের অবাধ প্রবেশাধিকার, একান্তে কথা বলারও সুযোগ আছে, তবুও ওর সঙ্গে একটা দূরত্ব রয়েই গেছে। প্রথম প্রথম নিষাদ ভেবেছিল সুচেতার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে আস্তে আস্তে বৃষ্টিকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে মন থেকে। কিন্তু এখন ও বুঝতে পারছে সেটা হবার নয়। কারণ যতক্ষণ ও সুচেতার সাথে থাকে, মনে মনে শুধু বৃষ্টির সাথে ওর তুলনা করতে থাকে। সুচেতার মধ্যে বৃষ্টিকে খুঁজে দেখার খেলায় নিষাদ এতটাই মশগুল হয়ে থাকে যে সুচেতাকে ভালো করে চেনা বা ভালোবাসা কোনওটাই হয়ে ওঠেনি শেষ পর্যন্ত।

নিষাদের অন্যমনস্কতা দেখে রাগ হয়ে যায় সুচেতার, সেও দু’চার কথা শুনিয়ে দেয়। অমনি নিষাদের চোখে ওর সঙ্গে বৃষ্টির পার্থক্য আরো বেশি প্রকট হয়ে ওঠে।

নিষাদ মুখে কিছু না বললেও প্রতিদিন একটু একটু করে বুঝতে পারে বৃষ্টি বৃষ্টিই, সুচেতা কিছুতেই বৃষ্টি হতে পারবে না।

বুবলার সাথে সেদিন গাড়িতে কথা হওয়ার পর বৃষ্টি সচেতন হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে নিজের সাথেও বোঝাপড়ায় নামল।

‘তুমি কি ধ্বংস চাও! তবে এখনো কেন গুটাচ্ছ না নোঙর? কাল থেকে বদলে নাও নিজের ব্যবহার, নিষাদকে নিজের পথে চলতে দাও।’ নিজেকে কড়াভাবে শাসন করল বৃষ্টি।

পরদিন ভোরের বাস ধরে হোস্টেলে পৌঁছল ও। ক্লাসে আলাদা বেঞ্চে বসল ইচ্ছে করেই।

ওর ব্যবহারের পরিবর্তন নিষাদকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। আগেরদিন কিছু না জানিয়ে হঠাৎ বাড়ি চলে যাওয়া, তারপর ফিরে এসেও কিছু না বলে আলাদা বসে ক্লাস করা, এরকম আচরণ বরাবরের পরিচিত বৃষ্টির সঙ্গে মেলে না। অধৈর্য্য হয়ে তাই নিষাদ ক্লাস চলাকালীনই লুকিয়ে মেসেজ করল, ‘এনিথিং রং?’

‘নাথিং’

এবারে একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন পাঠালো নিষাদ। উত্তর এল ‘ক্লাসের পর কথা বলছি।’

বৃষ্টির কাছ থেকে এমন গা ছাড়া উত্তর পেতে অভ্যস্ত নয় নিষাদ। বৃষ্টি যে ইচ্ছে করেই উদাসীনতা দেখাচ্ছে, এটা বুঝতে পারবে না এমন তো বোকা নয় নিষাদ। ওর আর ক্লাসে মন বসছিল না। স্যর বোর্ডে লেখার জন্য পেছন ফিরতেই ও বেরিয়ে গেল ক্লাস ছেড়ে।

নিষাদ যে কেন ক্লাস চলাকালীন বেরিয়ে গেল বৃষ্টির না বোঝার কোনও কারণ নেই। বৃষ্টিরও আর ক্লাসে মন ছিল না, ও মানসচক্ষে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল নিষাদ এখন ক্যান্টিনে বসে একা একা সিগারেট টেনে চলেছে। বৃষ্টিরও ইচ্ছে করছে ক্লাস থেকে বার হয়ে ক্যান্টিনে চলে যেতে কিন্তু জোর করেই শরীরটাকে বসিয়ে রাখল ক্লাসে। এখন বেরিয়ে গেলে সকলেই দুইয়ে দুইয়ে চার করবে। নিষাদের ক্লাস ছেড়ে বেরোনোটা কারোরই চোখ এড়ায়নি। এরপর বৃষ্টি বেরিয়ে গেলে যেটুকু কথা শুরু হয়েছে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মত, সেটা মেঘভাঙা বৃষ্টির মত ছড়িয়ে পড়ে সব ভাসিয়ে দেবে।

ক্লাস শেষ হবার পর ক্যান্টিনে গেল বৃষ্টি, কিন্তু নিষাদ ছিল না সেখানে। এতক্ষণ বেশ নিশ্চিন্ত ছিল, কিন্তু এবার উদ্বেগ শুরু হল বৃষ্টির। নিষাদ কি রেগে গেছে খুব? এমনিতে বিশেষ রাগ করে না নিষাদ কিন্তু রেগে গেলে মারাত্মক। সহজে রাগ পড়ে না ওর। ভয়ে ভয়ে ওকে ফোন করল বৃষ্টি।

‘কোথায় তুই?’

‘কী দরকার?’

‘দরকার ছাড়া কি কথা বলি না আমরা? আমি ক্যান্টিনের সামনে আছি, আয়।’

বৃষ্টির ডাক উপেক্ষা করতে পারে না নিষাদ, আগেও পারেনি, এখনও পারল না।

‘কী হয়েছে তোর?’

শান্তিনিকেতনের লাল কাঁকড় বিছানো পথে উদ্দেশ্যবিহীন এলোমেলো হাঁটছিল ওরা, হয়তো কোনও মাঠের ঘাসে বসবে কিংবা বোলপুরের কোনও চায়ের দোকানে সেরে নিতে পারে বিকেলের সামান্য জলখাবার, তবে কোনওমতেই যে ওরা এখন হোস্টেলে ফিরছে না, এটা নিশ্চিত।

বৃষ্টি কথাটা জিজ্ঞেস করল বটে নিষাদকে, তবে উত্তরটা ওর অজানা এমন নয়। তবু নিষাদ নিজে মুখে কথাটা বললে পরের কথাগুলো বলতে সুবিধা হবে ওর, এটা ভেবেই প্রশ্নটা করেছিল।

নিষাদ কোনও উত্তর দিল না। যেমন দূরের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল তেমনই হাঁটতে লাগল। বৃষ্টি কী করবে বুঝতে পারছিল না, কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর নিরুপায় হয়ে হাতটা ধরল নিষাদের, কাতর গলায় বলল,

‘রাগ করেছিস?’

‘মানুষ যাকে ভালোবাসে তার ওপর রাগ করতে পারে না। কেবল তার ব্যবহারে দুঃখ পায়।’

‘প্লিজ নিষাদ! প্লিজ, প্লিজ! আমার অবস্থাটা একটু বোঝ!’

বৃষ্টি আরও জোরে চেপে ধরল নিষাদের হাত। নিষাদ হাত ছাড়িয়ে নেয়নি, তবে বৃষ্টির হাতটাকে গ্রহণও করেনি। অভিমান গাঢ় হয়ে চেপে বসেছে ওর স্বরে।

‘বোঝার সবটা দায়িত্ব তো বরাবর আমারই। বার বার আমাকেই শুধু স্যাক্রিফাইস করতে হবে, কিন্তু কেন বলতে পারিস?’

বৃষ্টি থমকে গেল। এই কথার পর আর কী বলবে ও! আজকে তো বৃষ্টি আর একটু স্যাক্রিফাইস করার কথা বলতে চেয়েছিল। বলতে চেয়েছিল সম্পর্কের বাঁধনগুলো আর একটু ঢিলে করা দরকার এখন থেকে, যাতে আগামীতে কষ্ট কিছুটা কম হয় দু’তরফেই।

বৃষ্টি চুপ করে যাওয়ায় নিষাদের সম্বিত ফিরল। ও বুঝতে পারল অভিমান আর আবেগের বশে যে কথাটা বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে, সেটা বলা উচিত হয়নি। তাই এবারে, বৃষ্টির হাতটা ধরে অস্ফুটে বলল, ‘সরি’

ওদিক থেকে জবাব না পেয়ে বৃষ্টির দিকে তাকাল নিষাদ, ওর দুচোখের টলটলে জল ততক্ষণে গাল বেয়ে পড়বার উপক্রম করছে। নিষাদ দাঁড়িয়ে পড়ল আর ওর হাতে টান পড়ায় বৃষ্টিও।

‘সরি রে! এরকম বলতে চাইনি আমি!’ নিষাদ থতমত খেয়ে গেল।

‘লজ্জা তো আমার পাওয়ার কথা, তুই কেন সরি বলছিস? ঠিক কথাই তো বলেছিস তুই!’

গতকাল থেকেই মনটা খারাপ ছিল বৃষ্টির, এখন নিষাদের কথায় আর চোখের জল বাঁধ মানল না, দুই গাল বেয়ে পড়তে লাগল।

সমাজ যাকে প্রেম বলে জানে এবং মানে, বৃষ্টি আর নিষাদের সম্পর্ক যদি সেই ব্যকরণসিদ্ধ হত, তবে নিষাদ এখন বৃষ্টিকে বুকে টেনে নিতে পারত, আদর করে মুছিয়ে দিতে পারত ওর চোখের জল। কিন্তু দুজনের মাঝে যে অদৃশ্য বেড়া আছে, সেটা ডিঙিয়ে ওপারে যাওয়া উচিত নয় বলে নিষাদ চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

‘চল, ফিরি’ দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বৃষ্টি বলল।

নিষাদ ফেরার বদলে ধরলো খোয়াইয়ের রাস্তা, বৃষ্টি ওর সঙ্গ নিল। অনিবার্য যা, তাকে ভুলিয়ে না রেখে খোলাখুলি আলোচনা করে নেওয়া ভালো, মনকেও তো প্রস্তুতির সময় দিতে হবে।


১১


“হাথ ছুটে ভি তো রিস্তে নেহী ছোড়া করতে
ওয়াক্ত কি শাখো সে লমহে নেহী তোড়া করতে”

‘আমি আসলে ভুল করেছিলাম। সেইসব দিনে আমার মনে হত সুচেতার মানসিকতা একদম তোর মত, তাই আমি ওর দিকে ঝুঁকেছিলাম। কিছুদিন পরেই অবশ্য সেই ভুল ভেঙে গেল আমার, আমিও গুটিয়ে নিলাম নিজেকে।’

‘বুঝলাম’

‘কিস্যু বুঝিসনি।’

‘তুইও কিস্যু বুঝিসনি। সারাজীবন কেবল আমাকে দোষই দিয়ে গেলি।’

‘তোকে দোষ দিই, কে বলল?’

‘বলবে আবার কে? এই যে, আমার সাথে কথা বলিস না, এড়িয়ে যাস শুধু, বুঝি না আমি?’

‘তাই? বুঝিস তুই?’

‘বুঝি বলেই তো এই পনেরটা বছর ধরে তোকে একটা কথা বলতে চাইছি। কিন্তু পারছি কই? আমি শিওর, কথাটা শুনলে তুই আমার ওপর আর অভিমান করে থাকতে পারবি না।’

‘পরে কোনওদিন শুনব’, নিষাদ উঠে দাঁড়াল, দ্রুত পায়ে এগিয়ে ভীড়ে মিশে গেল।

বৃষ্টি কিছুটা ছুটে গিয়েও আর দেখতে পেল না ওকে। ক্যাবলার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল, এই যে দৃশ্যপটটা রচিত হল একটু আগে, সেটা ওর পূর্ব পরিচিত। আগেও কি এমন ঘটনা ঘটেছিল, নাকি স্বপ্নে এমন একটা দৃশ্য দেখেছিল আগে? সে যা-ই হোক, কথাটা আজও বলা হল না নিষাদকে। জানানো হল না, বৃষ্টির সবকিছু ছেলেখেলা ছিল না, ও যে সুতোয় বাঁধা ছিল তার অপর প্রান্তটা অন্যের হাতে ধরা ছিল বলে প্রতিশ্রুতি রাখতে অপারগ হয়ে পড়েছিল বৃষ্টি। সেই সাথে আরও একটা কথাও বলতে হবে ওকে, যে কথাটা এতগুলো বছর বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছে, সেই কলেজবেলা থেকে বারবার বলতে গিয়েও নিজেকে সংযত করে নিয়েছিল, সেই কথাটা এখন তো বলে দেওয়াই যায়। কিন্তু কী করে বলবে, ও যে শুনতেই চাইছে না। তবে কি ওকে লিখে জানাবে? কিন্তু তার জন্যেও তো ফোন নাম্বারটা দরকার, সেটাও তো দিয়ে গেল না নিষাদ। ঋষির কাছে লজ্জার মাথা খেয়ে বারবার চাওয়া সত্বেও সেও দিল না। তবে কি নিষাদই বারণ করেছে ওকে? নিশ্চয়ই তাই, বৃষ্টি যদি নিষাদের সঙ্গে কথা বলে তাহলে ঋষির কিসের সমস্যা?

ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি বোধ করছিল বৃষ্টি, গলার সমস্তটা জোর এক করে ও নিষাদকে চিৎকার করে ডাকল, যাতে ভীড় পেরিয়ে আওয়াজটা নিষাদের কানে পৌঁছায়, চলে যেতে গিয়েও ও যাতে ফিরে আসে, ঠিক যেমনটা আসত আগে, বৃষ্টির ওপর অভিমান করে চলে গিয়েও আবার এসে দাঁড়াত সামনে, সব রাগারাগি মন কষাকষি ভুলে গিয়ে দুজনে আবার এক হয়ে যেত।

মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত কিন্তু জোরালো আওয়াজ বের হয়ে এসেছিল বৃষ্টির, সেই শব্দে ওর নিজেরই ঘুম ভেঙে গেল। তার মানে আবার সেই স্বপ্ন, যা ওকে দৌড় করাচ্ছে দশটা বছর ধরে।

‘এর মধ্যে একটা ব্যাপার হয়েছিল জানিস, তোকে বলব না ভেবেছিলাম, ধৃতিও বারণ করেছিল’

ঋষির অসম্পূর্ণ কথার শেষটুকু জানার জন্য ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো নিষাদ।

‘গতবছর পুজোর সময় কোচি এয়ারপোর্টে বৃষ্টির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, দু’একটা কথাও’

আবার অসম্পূর্ণ বাক্যে থেমে গেল ঋষি, আসলে নিষাদের প্রতিক্রিয়াটা বুঝে নিতে চাইছিল ও। তেমন বুঝলে বাকি কথা চেপে যাবে, বৃষ্টি যে মাঝেমাঝেই মেসেজ করে নিষাদের ফোন নাম্বারের জন্য, গতকালও করেছে, সেই প্রসঙ্গ তুলবেই না।

নামটা শোনামাত্র নিষাদের বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হল। ভেতরে ঝড় উঠলেও বাইরেটাকে শান্ত দেখানোর কৌশল নিষাদ আয়ত্ত করে নিয়েছে বিগত বছরগুলোতে, তাই আজও ঋষিকে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

ঋষি সিগারেট ধরালো ধীরেসুস্থে, নিষাদকেও দিল। ও আসলে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আরও কিছুটা সময় নিয়ে নিচ্ছিল শেষবারের মতো। কথা হল গুলির মত, একবার বন্দুক থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলে তাকে আর তো ফেরানো যায় না, অতএব কাউকে কিছু বলার আগে প্রত্যেকেরই হিসাব করে নেওয়া উচিত কতটা কী বলা যায়। ঋষির মনে হল, এখন সবারই দেহে মনে ভাঁটার টান, উদ্বৃত্ত আবেগ যা ছিল অল্পবয়সে এখন তার অনেকটাই সংবৃত। কাজেই পোড়খাওয়া নিষাদের মনে বৃষ্টির কথা নতুন করে তেমন ঢেউ তুলবে না। বরং ওকে কথাগুলো বলে দিতে পারলে ঋষি হালকা হতে পারবে।

নিষাদ ভাবলেশহীন মুখে শুনছিল ঋষির কথাগুলো। আর ওর মন ফিরে গেছিল দশবছর আগের সেই দিনগুলোতে, যখন বৃষ্টির একটা ফোনকল, মেসেজ কিংবা কাগজে লেখা লম্বা চিঠির অপেক্ষায় কাটত ওর সারাদিন। শর্ট মেসেজের যুগেও লম্বা চিঠি লেখা শুরু করেছিল বৃষ্টি, বলেছিল, ‘চিঠিতে মানুষটার স্পর্শ থাকে, তাকে অনুভব করা যায়। মেসেজ টেসেজ বড্ড মেকানিকাল।’

এইটুকু নিয়েই তো দিব্যি ছিল নিষাদ, বৃষ্টি বিয়ে করে দূরে চলে যাবার পরেও জুড়ে ছিল। কিন্তু হঠাৎই একদিন ওদিক থেকে নির্দেশ এল, ‘আমি না বলা পর্যন্ত আমাকে আর চিঠি লিখিস না।’

শুধু তাই নয়, ফোন নাম্বারও বদলে গেল বৃষ্টির, ওর কাছে পৌঁছনোর আর কোনো রাস্তাই খোলা থাকল না।

যখন ঘরের ঠিকানা মানুষের জানা থাকে তখন রাত হয়ে গেলেও মন অস্থির হয় না, সে জানে ইচ্ছে করলেই আমি পৌঁছতে পারি আমার গন্তব্যে। কিন্তু যে মানুষ ঠিকানা হারিয়েছে তার আশ্রয়ের, ভুলে গেছে বিশ্রামাগারের পথ, তার মত অসহায় আর কে! ‘শাম হোনে কো হ্যায়, হম কাঁহা যায়েঙ্গে’ ভেবে তার মন হাহাকার করতে থাকে প্রতিদিন।

বৃষ্টির চিঠি পাবার জন্য অসহায়ভাবে অপেক্ষা করেছিল নিষাদ কয়েকটা মাস। অপেক্ষাও ক্লান্তি আনে, ক্রমশ সেই ক্লান্তি গিলে ফেলতে লাগল নিষাদকে, সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় নিষাদের মুখ দিয়ে আপনা আপনি বার হয়ে এল, ‘ঠিক করেছিস।’

ঋষি বোধহয় মনে মনে আশা করেনি নিষাদ এতটা কঠোর হবে বৃষ্টির ওপর, তাই ওর ওই জবাব শুনে ভাবল, সময় মানুষকে কতটা বদলে দেয়! যে মেয়েটার খোঁজ না পাওয়ায় রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছে নিষাদ, আজ তার ফোন নাম্বার হাতের কাছে থাকতেও কোনও উৎসাহ নেই। উপরোন্তু প্রতিশোধপরায়ণতাবশত বলছে বৃষ্টিকে নম্বর না দিয়ে ঋষি ঠিকই করেছে। এই নিষাদকে অচেনা লাগছিল ঋষির।

ঋষির সামনে নিজের দুর্বলতা আড়াল করে রাখতে পেরেছিল বটে নিষাদ, কিন্তু বাড়ি ফিরে নিজের সাথে একলা হতেই সে আবার দখল নিল ওর মনের। অন্যদিন ফিরে এসে ও বাড়ির সবার সাথে বসে গল্পগুজব করে, ছেলের পড়াশোনার খবর নেয়, তারপর নিজের ঘরে যায়। আজ অভ্যাসবশত সকলের সঙ্গে বসল বটে কিন্তু বারবারই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা মায়ের চোখে পড়াতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী রে বুবাই! শরীর খারাপ নাকি?’

‘নাহ্! মাথাটা একটু ধরেছে।’

‘তাহলে ঘরের আলো বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাক না! খাবার সময় ডেকে দেব।’

অন্ধকারের এই আড়ালটাই দরকার ছিল এখন নিষাদের। নিজের ঘরে গিয়ে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল ও।

পনের বছর আগে ছেড়ে চলে যাওয়া বৃষ্টির মুখটা মনে পড়ছে, দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। নিজের স্বামী-সংসার নিয়ে সুখী মেয়েটা এতগুলো বছর বাদে কেন আবার খুঁজছে নিষাদকে, আর কী বলার বাকি রয়ে গেছে ওর, সেটাও জানতে ইচ্ছে করছে। পরক্ষণেই আবার মনের গভীর থেকে গুমরে উঠছে অভিমান। ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী জেনেও খাদের কিনারে ফেলে রেখে চলে গেছিল যে মেয়ে, তাকে আর ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান দিয়ে কি হবে? বরং তাতে যন্ত্রণা আরও বাড়বে। যে সব ক্ষত প্রায় শুকিয়ে এসেছে, পুনরায় রক্তপাত হবে সেখান থেকে। তার চাইতে ওকে ফিরিয়ে দিয়ে ভালোই হয়েছে। তাছাড়া নীলার কাছেও অপরাধী হতে হবে। যদিও মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করেছে নিষাদ, তবুও তার কাছে বৃষ্টির কথা গোপন করেনি। নীলা জানে বৃষ্টি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে নিষাদের জীবন থেকে। এখন আবার ওর সাথে যোগাযোগ করা মানে নীলার সাথে মিথ্যাচার করা।

‘কী গো! শরীর খারাপ না প্রাক্তন প্রেমিকার জন্য মনখারাপ?’

নীলার কথায় চমকে উঠল নিষাদ, যদিও ঘর অন্ধকার ছিল বলে নীলার চোখে সেটা ধরা পড়ল না।

নিষাদের ইচ্ছে করছিল না এখন কারো সাথে কথা বলতে, বিশেষ করে এই প্রসঙ্গে তো নয়ই। তাই ও কোনও উত্তর না দিয়ে যেমন চোখে ওপর হাত চাপা দিয়ে শুয়েছিল তেমনভাবেই শুয়ে রইল।

কোনওরকম সাড়াশব্দ না পেয়ে নিষাদ ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করে নীলা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।


১২


“সেই ভালো, শুধু শব্দে থাকো
সম্বোধনে, শুধু উচ্চারণে”

বইয়ের আলমারী থেকে বাছাই করা কিছু বই বার করে নিয়ে ঘরের মেঝেতে বসে আছে বৃষ্টি। পরম মমতায় একটা একটা করে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে, আঙুল রাখছে উৎসর্গপত্রের নিচে, যেখানে প্রিয় অক্ষরে লেখা আছে ওর নাম।

পাঁচ বছরে বৃষ্টি অনেকগুলো বই উপহার পেয়েছিল নিষাদের কাছ থেকে। সেইসব বইগুলো ওর সংগ্রহের আরও বইয়ের মাঝে লুকিয়ে থাকে ভালোমানুষ সেজে, ঠিক যেমন নিষাদ লুকিয়ে থাকে বৃষ্টির বুকের মধ্যে। যেমন বৃষ্টির ঘুমের সুযোগ নিয়ে গোপন স্থান থেকে বার হয়ে আসে নিষাদ, দাপাদাপি করে ওর স্বপ্নে, তেমনই বৃষ্টি যখন একলা বাড়িতে থাকে তখন বইয়ের পাতা থেকে বার হয়ে আসে অক্ষরগুলো, পেশ করতে থাকে তাদের দাবিদাওয়া। কেউ বলে, ‘বৃষ্টির মুখের একটু হাসি দেখার জন্য নিজের সমস্ত আনন্দ উজাড় করে দিতে পারে’, কেউ আবার বলে, ‘তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ’। বৃষ্টি বিহ্বল হয়ে যায়, অতীতচারী হয় ওর মন।

বৃষ্টি বুঝে গেছে নিষাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হবে না, নিষাদ চায় না বলেই হবে না। নিষাদ বারণ করেছে বলেই ঋষি যে ফোন নাম্বারটা দেয়নি, এটা বুঝতে পেরে প্রথমে একপ্রকার হতাশা গ্রাস করেছিল বৃষ্টিকে, এখন মনে হয়, যা হয়েছে হয়তো ভালোর জন্যই হয়েছে, কয়েকটা বছরের খামখেয়ালিপনাকে অযথা টেনে নিয়ে গিয়ে লাভ কী! যা কিছু নির্মিত হয়েছিল সেইসব দিনে, গোপন সঞ্চয়ের মত সে সব চিরদিনই থেকে যাবে বৃষ্টির মনের গহীনে। সেসব কেড়ে নেবার সাধ্য সময়েরও নেই। শুধু কয়েকটা কথা এ জীবনে নিষাদকে জানানো হল না বলে বৃষ্টির মনে একটা আক্ষেপ থেকে যাবে ঠিকই, তবে দুজনের জীবনে যে স্থিতাবস্থা এসেছে সেটা তো বজায় থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে, যখন বিচ্ছেদ মাত্র কয়েকমাস দূরে, যখন দুজনেই গুমরে মরছে আলাদা আলাদা যন্ত্রণায় অথচ কেউই কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না সেসব কথা, তখন বৃষ্টিই নিয়মিত চিঠি লেখার অঙ্গীকার করেছিল। সেইসব দিনে ই-মেইল এর সুব্যবস্থা ছিল না, কাগজ পেনই ছিল জুড়ে থাকার মাধ্যম।

বরের সঙ্গে বিদেশবাসের প্রথম একটা বছর এই নিয়মের অন্যথা হয়নি কখনও দুই তরফেই, ফলে বিচ্ছেদ তেমন প্রাণঘাতী হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তারপরই ছন্দপতন ঘটে গেল, নিষাদ হারিয়ে গেল একেবারে।

প্রবাসের অপেক্ষার দিনগুলো কাটিয়ে ফিরে আসার পর বৃষ্টি দেখেছিল চারপাশের সবকিছুই এই কয়েকবছরে বড় তাড়াতাড়ি বদলে গেছে। চুরি হয়ে গেছে ছোটবেলার খেলার মাঠ, বদলে গেছে মানুষের ঘরবাড়ি এমনকি আচার আচরণ, ওদের ছোট্ট ঢিলেঢালা জনপদটা স্যুট-বুট পরা অফিসারের মত গম্ভীর আর ব্যস্ত হয়ে গেছে। পরিচিত মানুষজনদের মধ্যে অনেকেই ভোজবাজির মত উবে গেছে তাদের বাড়িঘর সমেত, সেই জায়গায় আছে অন্যসব বাড়ি, অন্য মানুষজন। নিষাদকে আর খুঁজে পায়নি বৃষ্টি এইসব অপরিচিতের ভীড়ে।

খোঁজাখুঁজির এতগুলো বছর পার করে বৃষ্টি এখন ভাবতে বসেছে, কী আর এমন ক্ষতি হবে যদি নিষাদ কোনোদিন নাই জানতে পারে যে নিষাদের লেখা একটা চিঠি কোনওভাবে পড়েছিল বুবলার হাতে আর তার জেরে জেরবার হয়ে গিয়েছিল বৃষ্টির জীবন! তারপর থেকে বৃষ্টির প্রতিটি চিঠিপত্র, ফোনকলের ওপর চলেছিল নজরদারী, বৃষ্টি তাই নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছিল নিষাদের কাছ থেকে। তবে ও মনে আশা জিইয়ে রেখেছিল, দেশে ফিরে ঠিক খুঁজে নেবে নিষাদকে, আবার গড়ে তুলবে ভেঙে ফেলা সেতু।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল বৃষ্টি। একলা ঘরে যেহেতু কেউ শোনার ছিল না, তাই উচ্চারণ করল নিষাদের প্রিয় কবিতার দুটি লাইন, ‘তুমি যে কটা দিন একান্ত আমারই ছিলে/ সেও তো কিছু কম প্রাপ্তি নয় / এখন তাকেই আমি পরম সৌভাগ্য বলে মানি।’

যে আগ্রহ আর উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে কয়েকটা বছর নিষাদকে খুঁজেছে বৃষ্টি, তা এখন প্রশমিত। ও এখন অনেক শান্ত, নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে নিজের আকাঙ্খাগুলোকে।

স্বপ্নে আসুক নিষাদ, স্বপ্নেই চলুক কথোপকথন, ঠিক এখন যেমন চলে। এতে দুজনেরই ভালো, বর্তমানের চলার গানে তাল কাটবে না কারো, কোনও ছন্দপতন হবে না দৈনন্দিন যাপনে।

যে কথাটা বৃষ্টি বলতে চেয়েছিল নিষাদকে, বার বার বলতে গিয়েও শেষ অবধি বলা হয়নি, অনুচ্চারিত যে বাক্যটির কথা জানে সেই বৃষ্টিভেজা দিন, নদীপাড়ের মন্দির কিংবা বাউলমেলার মাঠ, সেই কথাটা না বলা হলে কী আর এমন ক্ষতি হবে এতদিন পরে?

‘প্রেম করা যায় না রে, প্রেম হয়ে যায়। এই সত্য আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি। আমার এই উপলব্ধির কথা যদি তোকে সেইসব দিনে বলতাম, তবে আমাদের তিনটে জীবন ওলটপালট হয়ে যেত না? আমি আসলে তেমন সাহসী নই যে নদীর গতিপথকে বদলে দেবার স্বপ্ন দেখতে পারি।’

দিনের বেলা নিষাদকে যে কথা কখনও বলতে পারেনি বৃষ্টি, রাতের অন্ধকারে সেই কথাটাকে ছিঁড়ে, টুকরো টুকরো শব্দগুলোকে পরম মমতায় উড়িয়ে দিল বাতাসে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

4 thoughts on “novel-bristir-dinratri

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *