নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
(পুরাণের কচ-দেবযানী-শুক্রাচার্য, এবং তারা-বৃহস্পতি-চন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে)
হেমপর্বতের উপর সূর্যোদয় হচ্ছে। বাতাস জলকণা মুক্ত। মর্ত্যে এখন বসন্ত ঋতু সমাগত। বড় আনন্দময় এই সময়। প্রকৃতিও সাময়িক বিরতি নিয়েছে শীত ও গ্রীষ্মের তীব্রতা থেকে। বরং তিনি এখন হালকা ফুলের গয়নায় সাজিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। পাহাড়ের চূড়ার নিচে সমতলে নেমে এসেছে দেবলোকের যান। দেবযান। এবার অবতরণের পালা। দেবযানের দরজা খুলে গেল ধীরে ধীরে। সেখান থেকে মর্ত্যের মাটিতে পা রাখলেন একজন সুদর্শন তরুণ যুবক। তার মুখে বিমর্ষতার ছায়া। দেবলোক থেকে বহুদিনের জন্য মর্ত্যে চলে এসেছে সে। একটা বিশেষ অতি গুরুতর কর্মভার দেওয়া হয়েছে তাকে। সেটি যথা সময়ে শেষ করতে হবে তাকে। প্রয়োজনে আত্মবিসর্জন দিতে হলেও কাজটি দক্ষতার সঙ্গে শেষ করতেই হবে। তার পরনে এখনও দেবলোকের অদ্ভুত পোশাক। এই পোশাকের রং নিজের ইচ্ছেমতো যখন খুশি পরিবর্তন করা যায়। এমনকী এই পোশাক পরলে শীত বা গ্রীষ্মে কোনও অসুবিধা হয় না। শরীরের প্রয়োজনে পোশাকটি শীতল ও উষ্ণ হয়ে ওঠে। তবে মর্ত্যে এখনও এমন পোশাক তৈরি করা হয়ে ওঠেনি। পৃত্থীর প্রাণীরা এখনও বহু প্রাচীন যুগের কর্মকুশলতায় কাজ করছে। সুতরাং দেবযানের ভেতর থেকে সূতীর ক্ষৌমবস্ত্র বের করা হল। তরুণটি পোশাক পরিবর্তন করে নিল। সে নিজের দীর্ঘ কেশ এবার মাথার উপর গুটিয়ে নিল। গলায় পরে নিল রুদ্রাক্ষের মালা। তাকে এখন একজন ব্রাহ্মণ কুমারের মতোই দেখতে লাগছে। দেবযানের প্রধান চালক মাতলি তাকে বিদায় জানালো।
“বিদায় কচ! সফলকাম হও!”
কচ মাতলিকে প্রতিশুভেচ্ছা জানালো। তারপর বড় বড় পা ফেলে পাহাড়ের বুকের উপত্যকায় ঘন বনের ভেতর অদৃশ্য হল।
এই ঘটনার বেশ কিছু আগেকার ঘটনা। দেবলোক। এটিও সুন্দর একটি সকালের মুহূর্ত। দেবলোকের বাতাস মধুগন্ধবাহী। সম্পূর্ণ অঞ্চলটি কীট ও জীবানুমুক্ত। বড় বড় পাথরের সজ্জিত ক্ষুদ্রাকার আধারে ফুটে আছে দুর্লভ ও সুগন্ধী নানা রংয়ের ফুল। বসন্তের দূত বিকশিত মাধবী ও অশোক ফুটেছে পাশাপাশি দুটি সুনিয়ন্ত্রিত আধারে। অশোকের রক্তিম আভা আর মাধবীর শ্বেত মনোহর শোভা যেন প্রেমের দুই মহান রূপের প্রতীক। সুগন্ধী মাধবী যেন আপনাকে বিলিয়ে দিয়েই সুখী। সে যেন প্রেমে ত্যাগের বার্তাবহ। অপরদিকে গাঢ় রক্তবর্ণ অশোক হৃদয় মথিত করে ভালবাসা উচ্চারণ করে। সে আত্মবিসর্জন দেয়, তবে ভালবাসার অধিকার ছাড়ে না। কচ দুটি আধারের বিকশিত পুষ্পিত লতাদুটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে এমনটাই চিন্তা করল। কচের হাতে এখন অফুরন্ত সময়। নিজেকে জানতে, বুঝতেই তো সে এখানে ছুটে এসেছে। কচ নিজের মনকে যাচাই করতে চায়।
কচ এখন একটি বিখ্যাত চিকিৎসা-কেন্দ্রে এসেছে। এই চিকিৎসা-কেন্দ্রটি খুবই উন্নত পরিকাঠামো বিশিষ্ট। সার্গ প্ল্যানেটের এই লোকে কেবল ব্যাধির চিকিৎসা হয়। পরিচালিত হয় অশ্বিনীকুমারদ্বয় নামক দুজন যমজ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে। তাঁদের অধীনে আছেন শত শত চিকিৎসক, সেবক এবং সেবিকাদের দল। এখানে কায়গত এবং মনোগত দু’রকম চিকিৎসাই করা হয়। এই লোকের নাম ব্যাধিলোক।
কচ সুঠাম, সুন্দর এবং দারুণ মেধাবী একজন যুবক। তবে সে যেন ছোট থেকেই কারো দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত। তার কখনও কোনও ভুল প্রায় হয় না বললেই চলে এবং সে মিথ্যে কথা বলতে পারে না। আশ্চর্য বিষয় হল, সে অনেক চেষ্টা করলেও তার গলা দিয়ে তার অজান্তেই সত্যি কথাগুলো বেরিয়ে আসে। এতদিন তার মনে নিজের কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগেনি। তবে শ্রুতশ্রবার কাছ থেকে অভিশাপ পেয়ে সে নিজেকে নিয়ে হঠাৎ নতুন করে ভাবতে বসেছে। প্ল্যানেট সার্গে সেই বোধহয় একমাত্র তরুণ যার মন কখনও এক পলকের জন্যেও কোনও নারীর প্রতি দুর্বল হয়নি। আজও। কচের বয়স এখন বাইশ। সে তরুণ এবং সুদর্শন।
শরীরের লক্ষণবাহী তন্তু, যেটি বংশ পরম্পরায় পিতা মাতার বৈশিষ্ট্য বহন করে চলে, তাকে দেবলোকে বলা হয় জিন। সেই জিন-তত্ত্ব নিয়ে উচ্চপর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সে। শিক্ষকদের অনেক আশা কচকে নিয়ে। শুধু যে কচের বাবা বৃহস্পতি সার্গের একজন স্বনামধন্য বিরাট বিজ্ঞানী সেজন্য নয়, কচের মধ্যেও আশ্চর্যরকম মেধা ও নিষ্ঠা আছে। তাছাড়া সে শ্রুতিধর। শোনামাত্রই সবকিছু অবিকল মনে রাখতে পারে।
উচ্চপর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীদের পড়া ছাড়াও তাদের যাবতীয় বিনোদন ও আবশ্যকীয় সমস্ত খরচ মেটায় সার্গ। এমনকী তাদের মাসিক মন-মানচিত্রের খরচও তারাই মেটায়। নিন্দুকেরা বলেন, এভাবেই তরুণ-প্রজন্ম কী ভাবছে, সে বিষয়েও ওয়াকিবহাল থাকে এসএআরজি গ্রহের নিয়ন্ত্রাগণ।
কচ অবশ্য কখনও নিজের মনের মানচিত্র করিয়ে গাদা গাদা সময় নষ্ট করে না। বিনা খরচে হলেও সে এইসবে অনাগ্রহী। তার মন তো কোনও নারীতে আগ্রহীই নয়, সুতরাং কী হবে এই মানচিত্র তৈরি করিয়ে নিজের মনের মত মেয়েদের খুঁজে নিয়ে তাদের সঙ্গে চ্যাট করে! তবে শ্রুতশ্রবা নাকি ম্যাপিং করেই কচকে নির্বাচন করেছিল। ওকে নাকি সাজেস্টেড হিসেবে যাকে দেখিয়েছে তার নাম হল, কচ-তারা। এসএআরজি প্ল্যানেট এ মায়ের নাম ও সন্তানের নাম পাশাপাশি থাকে। সুতরাং মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, কচের সঙ্গে তার মা তারার নাম চিরকালের মত জুড়ে গেছে। যদিও বর্তমানে কচের সঙ্গে তার মায়ের কোনও সম্পর্ক নেই। তারা দেবলোক থেকে নির্বাসিত হয়েছে।
কয়েকদিন আগে কচের নিজস্ব গণমাধ্যমে যোগাযোগ করে শ্রুতশ্রবা ওর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। কচ ভদ্রতাবশত ওকে ওর গবেষণাগারে ডেকেছিল। সে রোজই অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে কাজ করে। তার কাজে কোনও ক্লান্তি নেই। সে স্মৃতি নিয়ে একটা অসাধারণ কাজ শুরু করছে। প্রাণীর মৃত্যুর পরেও তার স্মৃতি নিয়ে তার কাজ। স্মৃতি নিয়ে একটা ডেটা ব্যাঙ্ক তৈরি করতে চায় সে গণকযন্ত্রে। রাতের দিকে শ্রুতশ্রবা কচের দরজায় এসে শব্দ করল। দরজা খুলে দিয়ে কচ দেখল, শ্রুতশ্রবা অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে স্বল্পবাস। প্রথম কারো সঙ্গে আলাপের জন্য এমন পোশাক পরে আসাটা বেশ অস্বাভাবিক। সম্ভবত সে নেশাও করেছে। কারণ তার শরীর মৃদু মৃদু দুলছে। কচ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, সে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবে না। হয়তো সে একজন গোপন খবর সরবরাহকারীও হতে পারে। দেবলোকে ও নরলোকে তার পিতার শত্রুর অভাব নেই। তাছাড়া কচ মন-মানচিত্র করায় না। দেবলোকের নিয়ন্ত্রকেরা তার মনের খবর পায় না। সুতরাং এই শ্রুতশ্রবার উদ্দেশ্য শুধু প্রেমজনিত নাও হতে পারে।
শ্রুতশ্রবা কচকে বলল, “কচ আমাকে মানসিক অবক্ষেপণ-যন্ত্র বলেছে, আমিই হলাম তোমার মতো একজন সুন্দর পুরুষকে পাবার জন্য এই দেবলোকের একমাত্র যোগ্যতম নারী। আজ রাতে আমাকে গ্রহণ করো। আমরা দুজন মিলে একজন সার্থক বিজ্ঞানীর জন্ম দিতে পারি, যে হবে এই দেবলোকের ত্রাতা ও ভবিষ্যতের রক্ষাকর্তা! হে সুন্দরের প্রতিভূ! আমি বর্তমানে গর্ভধারণের সঠিক এবং উপযুক্ত সময়ে আছি!”
কথাগুলো কষ্ট করে বলেই সে কচের শরীরের উপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
কচ শ্রুতশ্রবাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে ল্যাবের দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিল।
বাইরে থেকে অশান্ত হয়ে শ্রুতশ্রবা তার দরজায় বারবার শব্দ করতে লাগল। কচ ভেতর থেকে বলল, “দুঃখিত শ্রুতি। তুমি নেশা করে এসেছো, এমনটা ঠিক শোভন নয়। তোমার সাথে আমার এখন নয়, পরে কখনও কথা হবে। এখন তোমার চেতনা নেশার কারণে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাছাড়া আমি তোমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি আমার বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত বলে আমার ধারণা।”
দরজার বাইরে থেকে শ্রুতশ্রবা কচকে অভিশাপ দিয়ে বলল, “তুমি কি অস্বাভাবিক? কেমন পুরুষ তুমি? একজন আবেদনময়ী নারীকে এমন করে ফিরিয়ে দাও! এত অবিশ্বাস কেন তোমার মনে? আমি তোমাকে অভিশাপ দিলাম, তুমি আজীবন নারীসঙ্গ বঞ্চিত হবে।”
ঘরের ভেতর থেকে কচ মৃদু হাসল। তবে সে তবুও দরজা খুলল না। পরদিন সে হাসপাতালে গেল। সত্যিই সে জানতে চায়, সে কি অস্বাভাবিক? কেন কোনও নারীকে দেখলে তার যুক্তিবুদ্ধি, শীল, শোভনতা এতকিছুর কথা মনে পড়ে? কেন সে কখনো নারীদের প্রতি মোহিত হয় না? তাই কয়েকদিন ব্যাধিলোকে থেকে নিজের সম্পূর্ণ পরীক্ষা করাতে চায় কচ।
বাড়িতে তার একমাত্র পরিজন বলতে পিতা বৃহস্পতি আছেন। তার মা তাকে পিতার কাছে ফেলে রেখে চলে গেছেন, চন্দ্রের কাছে। চন্দ্রদেব সার্গের একজন বিখ্যাত বণিক। অসম্ভব সুপুরুষ। বয়স তাঁর শরীরকে ছুঁতে পারেনি। পৃত্থী পর্যন্ত তার বিরাট ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপ্ত। চন্দ্রের অনেকগুলি স্ত্রী বর্তমান। সকলেই থাকেন পৃত্থীতে। কচের মা তারা চন্দ্রের বাকি পরিবারের সঙ্গে থাকে না। সার্গ আর পৃত্থীর মাঝখানে একটা নতুন জায়গায় সদ্য তৈরি হয়েছে চন্দ্রের একটি প্রমোদ ভবন, তারাদেবী এখন সেখানেই থাকে। বৃহস্পতির বহু অনুনয়ের পরেও তারাদেবী বৃহস্পতির কাছে ফিরে আসেনি। তারার সঙ্গে থাকে শিশু বুধ। সে চন্দ্র এবং তারার সন্তান। কচের আর মায়ের মুখটাও মনে পড়ে না। মাকে ফিরে পাবার জন্য বাবার অসীম লড়াই সে বরাবর দেখেছে। হয়তো সে কারণেই সমস্ত নারীজাতির উপর তার মনে এক ধরণের বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়েছে।
তারা চলে যাবার পর বৃহস্পতি আরও নিবিড়ভাবে গবেষণাকে আশ্রয় করেছেন। তিনি দিনরাত গবেষণায় এতই ব্যস্ত থাকেন যে খাবার খেতেও অনেক সময় ভুলে যান। দাসীরা তাঁর খাবার নিয়ে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। বিভিন্ন রকম খাবারের সুগন্ধ পেলে বৃহস্পতির খেতে হবে, এ কথা মনে পড়ে যায়। এই দাসীদের দেবরাজ ইন্দ্র নিজে নিয়োগ করেছেন।
সার্গবাসীদের বলা হয় দেবতা। এই গ্রহের ব্যবস্থাপনা এত অভিনব ও ব্যাপ্ত যে এই গ্রহ ছেড়ে কেউ কখনো নরলোকে যেতে চায় না। একমাত্র বিশেষ শাস্তি স্বরূপ দেবতাদের নরলোকে পাঠানো হয়। অনেক সময় তুচ্ছ নরলোকের জীবদের শিক্ষা দেবার জন্যও কোনও কোনও দেবতা সেখানে গিয়ে জীবদের প্রভাবিত করে থাকেন।
সার্গের বাতাস পরিষ্কার, দূষণের নামগন্ধও নেই। বাতাসে ফুল, চন্দন, ধুনো ও মধুর সুগন্ধ ভেসে আসে দিনের বিভিন্ন সময়ে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই গ্রহ অতিমাত্রায় সচেতন। বাতাস ও জলের শুদ্ধতা নিয়ে বিরাট বিরাট দুটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দল নিয়ে কাজ করছেন, যথাক্রমে পবনদেব ও বরুণদেব। দেববিজ্ঞানী বৃহস্পতির শরীরের সুস্থতা বিশেষভাবে কাম্য এই দেবলোকে। তাঁর সংসার জীবনে পাওয়া আঘাত যাতে তাঁকে ন্যুব্জ না করে দিতে পারে, তাই বৃহস্পতিকে দেখাশোনা করার জন্য নিয়োজিত আছে একটি সেবিকাদের টিম। তারাই সময় মতো নানারকম সুখাদ্য তাঁকে সরবরাহ করে থাকে।
সার্গ আর পৃত্থী গ্রহের প্রতিদ্বন্দ্বীতা এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বৃহস্পতি কিছু যন্ত্রমানব বানিয়েছেন, তবে তা শুক্রের মতো এত কার্যকরী হয়নি। দুর্জনেরা বলেন, বৃহস্পতি নিজের পুত্র কচকে ঠিক একটা যন্ত্রের মতো করেই তৈরি করেছেন! কচ মানুষ হলেও যেন অবিকল একটি যন্ত্র। কারণ যন্ত্রের মতোই কচের ভুল খুবই কম হয় এবং তার স্মৃতিশক্তি অবিস্মরণীয়। বৃহস্পতি এইসব কথা শুনে কেবল হেসেছেন।
কচের খুব ছোটবেলায় বৃহস্পতি তার মস্তিষ্কের গঠনগত একটা অবিশ্বাস্য পরিবর্তন করেছিলেন। নিজের মানসিক টানাপোড়েনের ফলে তার জীবনের অনেকটা সময় দুঃখ যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হয়ে কেটেছে। ফলে গাদাগুচ্ছের সময় নষ্ট হয়েছে। তাই আবেগে অনুত্তেজিত ও শান্ত থাকার জন্য কচের মস্তিষ্কে তিনি একধরণের বাফার বা নিয়ন্ত্রক ইমপ্লান্ট করেছেন। মানব শরীরে স্মৃতি থাকে প্রধানত তিনটি অংশে। নরলোকে তাদের বলা হয় যথাক্রমে হিপোক্যাম্পাস, নিয়োকর্টেক্স এবং অ্যামিগডালা, বেসাল গ্যাংলিয়া এবং সেরিবেলাম। স্মৃতিরও আবার তিনটি ভাগ। যেগুলিকে নরলোকে বলা হয়, এক্সপ্লিসিট মেমোরি, ইমপ্লিসিট এবং ওয়ার্কিং মেমোরি। এক্সপ্লিসিট মেমোরি হল বাহ্যিক পরিবেশের মাধ্যম থেকে যে স্মৃতি সঞ্চিত হয়। ইমপ্লিসিট হল অল্পস্থায়ী স্মৃতি। যা হল অধীত বিদ্যা। এটির জন্য কাজ করে বেসাল গ্যাংলিয়া ও সেরিবেলাম। এখানেই বসানো হয়েছে একটি খুব সূক্ষ্ম যন্ত্র। যা অধীতবিদ্যাকে মনে রাখতে সাহায্য করবে। স্মৃতির ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। সেটা একধরণের ন্যানো কম্পিউটার। যেটি তার স্মৃতিকেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত। আঘাতে বা কোনও কারণে কচের মৃত্যু হলে সেই চুলের মত সূক্ষ্ম কম্পিউটারটি থেকে কচের বুদ্ধিমত্তার সম্পূর্ণ একটি ডেটাবেসও পাওয়া যাবে। সেইমতো কচের মাথায় ছিদ্র করে সেই ন্যানো বা অতি ক্ষুদ্রতম যন্ত্রটিকে তার স্মৃতিকেন্দ্রে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। যন্ত্রটির আরও একটা কাজ হল এটি অতিরিক্ত আবেগকে যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে অগ্রাহ্য করতেও সাহায্য করবে। অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে বলা যায়, কারণ কচ বৃহস্পতির মনমতো আচার আচরণ বিশিষ্ট হয়েছে। বৃহস্পতিও কচকে নিয়ে আনন্দিত।
কচ বর্তমানে তরুণ, সে আবেগে ভেসে কোনও সুন্দরী নারীর প্রতি এখনও আকৃষ্ট হয়নি। প্রতিটা কাজ করার আগে তুল্যমূল্য বিচার করার পর সে তাতে অগ্রবর্তী হয়। সুতরাং তার পরীক্ষা সফল হয়েছে মোটামুটি বলা যায়। কচের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য এছাড়াও একটা আরক দ্রব্য এখনও তাকে পান করানো হয় পানীয় জলের সঙ্গে। কচ পানীয় জলের স্বাদ বলতে এটাই জানে। জন্ম থেকে তাকে জল বলে নানা ঔষধি বৃক্ষের নির্যাস খাওয়ানো হয়েছে। নানা দুর্লভ জড়িবুটি পৃত্থী থেকে তাকে সরবরাহ করেছিল চন্দ্র। সেই সময় থেকেই প্রথম তার গবেষণাগারে চন্দ্রের আসা-যাওয়া শুরু হয়েছিল। কচকে নিয়ে ইচ্ছে মতো পরীক্ষার সেই সবে শুরু হয়েছিল। তারার এতে প্রথম থেকেই আপত্তি ছিল। নিজের সন্তানকে সে কোনও মেধাবর্ধক আরক পান করাতে চায়নি। এই নিয়েই প্রথম বিবাদ শুরু হয়েছিল তাদের। বৃহস্পতির মন জুড়ে এখনও বিরাজ করছে তারার স্মৃতি। তারা বলেছিল, “আমাদের সন্তান স্বাভাবিকভাবেই মেধাবী ও ধীমান হবে। তাকে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠতে দিন, দেব বৃহস্পতি!”
বৃহস্পতি বলেছিলেন, “আমি চাই অতি অসাধারণ মেধাবী হয়ে উঠুক কচ। ও হবে দেবলোকের ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, একজন রত্ন। তুমি হবে রত্নগর্ভা দেবীতারা! তাই আমি ওকে এই আরক পান করাচ্ছি। ওর বিচারবুদ্ধি যাতে কখনও আবেগে বশীভূত না হয়, এমন একটা যন্ত্র তৈরি করতে শুরু করেছি আমি।”
“কী সেই যন্ত্র?”
“সেই যন্ত্র মনের শুভচেতনাকে সর্বদা জাগিয়ে রাখে। বিচারবোধ হারাতে দেয় না।”
“আমার পুত্রকে নিয়ে এমন কোনও অভিনব পরীক্ষা হোক, আমি তা চাই না। আমি ওর জন্মদাত্রী। আমি দেব ইন্দ্রের দরবারে অভিযোগ জানাব।”
“হা হা হা। আমার নতুন এই পরীক্ষার জন্য যাবতীয় অনুমতিপত্র স্বয়ং ইন্দ্রদেবই যে আমাকে পাঠিয়েছেন!”
তারা স্থির দৃষ্টিতে চেয়েছিল বৃহস্পতির দিকে। ইন্দ্রের সমকক্ষ আরও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তিনলোকে এরপর সে জানিয়েছিল তার প্রতিবাদ। বৃহস্পতির এই স্বেচ্ছাচার বন্ধ হোক! একটি প্রতিবেদন লিখে চেষ্টা করেছিল দেবতাদের অভিমত তার দিকে ঘোরানোর। লাভ হয়নি। সব দেবতারাই বৃহস্পতিকেই সমর্থন করেছিল। উপরন্তু তারার কাছ থেকে কচকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। কচ বেড়ে উঠছিল বিশেষভাবে নির্মিত পৃথক একটি গবেষণাগারে। অন্ধক্রোধে সাপিনীর মতো ফনা তুলেছিল তারা। প্রতিশোধ চাই তার। কিন্তু একলা নারী কী করতে পারে শক্তিমান দেবলোকের বুকে?
বৃহস্পতি যখন গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত, তখন তারা একবার চেষ্টা করছিল পালানোর।
কচকে নিয়ে দেবলোক ছেড়ে পালাতে চেয়েছিল তারা।
২
নীল আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে আছে দিকদিগন্ত ব্যাপ্ত হয়ে। এখানে চির মায়াবী সন্ধ্যা। অপ্সরালোক। সবসময় উজ্জ্বল জোছনার মত আলো থাকে এখানে। সেই কৃত্রিম আলোয় চলে অপূর্ব নৃত্যগীত। ব্যর্থ ও শোকাচ্ছন্ন দেবতারা অপ্সরালোকে এসে দু’দিন কাটিয়ে শোক ভুলে আবার কর্মক্ষম হয়ে ওঠেন। একজায়গায় চলছে রাগসঙ্গীত ও নৃত্য। যেখানে রাগগুলি গীত হচ্ছিল আপনা আপনি প্রস্ফুটিত হচ্ছিল কমলের পাপড়ি। পাহাড়ের গায়ে উন্মুক্ত হচ্ছিল ছোট ছোট জলধারা। কখনও আবার সাজানো দীপগুলি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠছিল। সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের দিক থেকে স্রোতের মতো শব্দে করতালি বাজছিল। অপ্সরা ও কন্দর্পদের দল সুরের ঝর্ণায় যেন অবগাহন করছিলেন। শ্রোতারা সকলেই বিমোহিত, স্তব্ধবাক।
দেবী তারা একটি কারুকার্য করা কাঠের সিংহাসনে বসে নৃত্যগীত পরিবেশনে চোখ রেখেছিল। কিন্তু সেদিকে তার মন নেই। তার দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছিল সে, এত বড় দেবলোকে কি কেউ তার পাশে থাকবে না? সেই সময় চন্দ্রদেব এসে তারার পাশে একটি অপর একটি কাষ্ঠাসনে বসে বলেছিলেন,
“আমাকে সব সময় আপনার পাশে পাবেন দেবী তারা!”
“কী আশ্চর্য আপনি যে অন্তর্যামী!”
“দেবলোকে এই বিদ্যায় কি সকলেই কম বেশি পারদর্শী নয়? তাছাড়া আমি দেব ও মানব মনের উপর বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপর্যায়ের পাঠ নিয়েছি। লোকে বলে থাকে চন্দ্র হল মনের কারক, চন্দ্র কূপিত হলে সে নাকি পাগল হয়ে যায়! দেবী তারা এখানে আপনাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি। আমি আপনার মনোবেদনা বুঝতে পারছি। আপনার দাবী একেবারেই ন্যায়সঙ্গত বলে আমার মনে হয়।”
তারা চোখের জল আটকাতে পারল না। ক্রন্দনরত তারার হাতে হাত রেখেছিলেন চন্দ্রদেব।
“বলুন দেবী আপনি ঠিক কি চান? কচকে চুরী করে মর্ত্যলোকে নিয়ে যাবেন? আমি আপনাকে সহায়তা করব। তবে কচকে নিয়ে যাওয়া শক্ত খানিকটা। সে এখন বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে আছে। তবে আমি কিন্তু আপনাকে সহজেই উদ্ধার করতে পারি। পরে সুযোগ দেখে কচকেও না হয় এনে দেব আপনার কাছে। আমার রথের সঙ্গে বিশেষ একরকম কোষ সূর্যালোক থেকে দিনে ফোটনকণা শোষণ করে সংরক্ষিত করে রাখে। রাতেও তাই সেটি অত্যন্ত দ্রুত চলতে সক্ষম। আমি আপনাকে মর্ত্যে নিয়ে যাব। আমার সূর্যের আলো দিয়ে গড়া পোশাকের নাম হল দ্যুতি। সেই আভাযুক্ত পোশাক পরলে আপনি নিজে স্বয়ংপ্রভ হবেন, কিন্তু আপনাকে কেউ চিনতে পারবে না। বাইরে থেকে আপনার কেবল একটা আলোকমণ্ডিত অবয়ব থাকবে। মর্তে আমি আপনাকে ধার্মিক মানবদের দেশে গিয়ে রেখে আসব। আপনার এতটুকু অযত্ন হবে না। মানবজাতি স্বল্পায়ু ও লোভী। এছাড়া তারা খুব একটা ক্ষতিকর জীব নয়, আমার মনে হয়, তারা কিছুটা ভীরু এবং শান্তিপ্রিয় জাতিও বটে। বৃহস্পতি আপনাকে সেখানে খুঁজে পাবেন না। আরও একটা বিষয় হল, সেখানে একজন অতিদক্ষ বিজ্ঞানী থাকেন। তিনি যদিও একসময় দেবলোকেরই বিজ্ঞানী ছিলেন। তবে বর্তমানে তিনি অসুরদের সহায়তা করছেন। দেবলোক ছেড়ে মর্ত্যলোকেই বসবাস করছেন তিনি। তাঁর নাম শুক্রদেব। আপনাকে আমি তাঁর প্রাসাদে রেখে আসব, যদি প্রয়োজন হয়! কিংবা আপনি চান।”
চন্দ্রের ব্যবহার সুমধুর। তারা মুগ্ধ হয়ে গেল চন্দ্রের কথা শুনে। রূপবান তরুণ চন্দ্রকে বৃদ্ধ ও জেদি বৃহস্পতির চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়তর মনে হল তারার। এক অপূর্ব প্রেম জেগে উঠল তার মনে। চন্দ্রকে হঠাৎ কাছে পেতে ইচ্ছে হল তার। এ কথা মনে আসতেই তারা লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল। অন্তর্যামী চন্দ্রের কাছে তার মন অজানা থাকবে না! সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্র তারার দিকে প্রেমপূর্ণ চোখে চেয়ে বলল, “দেবী আমিও আপনার রূপে ও গুণে মুগ্ধ হয়েছি। এখন প্রবলভাবে মধুর মিলন-প্রত্যাশী। যদি অনুমোদন করেন আজ রাতেই আমার অপূর্ব প্রমোদভবনটি আপনাকে একবার ঘুরিয়ে আনতে পারি। আপনার পাদস্পর্শে আমার ভবনটি সার্থক হবে। একদা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যোগ্য কোনো দেবলোকধন্যা আমাকে যদি কোনওদিন অন্তর থেকে প্রত্যাশা করেন, তাঁকেই করব আমি আমার প্রমোদ ভবনের সঙ্গিনী। এতদিন পর্যন্ত কেউ সেখানে পা রাখেনি।”
তারা অবনত মস্তকে মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। লজ্জার লালিমায় তার মুখটি রাঙা হয়ে উঠেছে। বহুদিন তারা পুরুষসঙ্গ বর্জিত। বৃহস্পতির কেবল জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিয়ে চিন্তা। বিজ্ঞান ছাড়া মানুষটা কিছুই বোঝে না। কচ জন্মলাভের পর থেকে সম্পূর্ণ দুটি বছর কেটে গেছে, বৃহস্পতি এখনও তার কাছে একবারও মিলনেচ্ছা জানায়নি।
চন্দ্রের প্রেমালাপে অনেকদিন পর তারার শরীর চেতনা জেগে উঠেছে। চন্দ্র কি তার প্রতিটি শ্বাসের খবর জানেন? আর চোখ তুলে তাকাতে পারল না তারা। চন্দ্র পরম সমাদরে তার হাতদুটো ধরে চন্দ্রযান প্রভায় তুলে নিল তারাকে। তারপর পালকের মত হালকা বস্ত্র, ‘দ্যুতি’ দিয়ে তারা ও নিজের শরীর ঢেকে দিল চন্দ্র। রথের ভেতর কেবল চন্দ্র আর তারা। দুজনেই চাদরের মত একটিই পাতলাবস্ত্র দ্যুতিতে তাদের শরীর ঢেকেছে। নরম আলোয় ভরে গেছে চারদিক। রথ তীব্র গতিতে ছুটতে শুরু করতেই ভয়ে তারা চোখ বন্ধ করে ফেলল।
চন্দ্র সহাস্যে তারার মুখ চুম্বন করল। তারা থরথর করে কেঁপে উঠল। রথ তীব্র গতি সম্পন্ন। মুহূর্তে লোক লোকান্তর পার হয়ে চলেছে। কোটি কোটি তারা, গ্রহ, উল্কা, ছায়াপথ দূরে সরে যাচ্ছে পলকের মধ্যে। তারা ও চন্দ্র রথের ভেতর পরমসুখে মিলিত হল। চন্দ্রের স্পর্শ কোমল এবং উত্তেজক। এত সুখ লুকিয়ে ছিল শরীরে? এভাবেও শরীর গ্রহন করা যায়! চন্দ্র না জানালে তারা কখনও জানতে পারত না।
মিলনপর্বের শেষে চন্দ্র তারাকে বলল, “আমাদের এই প্রেমপূর্ণ মিলন ব্যর্থ হয়নি। আপনি গর্ভধারণ করেছেন দেবী! অনাগত সন্তানকে আমি আশীর্বাদ করছি। সে জীবনে সফল হোক। তার যেন শুভবুদ্ধি জাগ্রত হয়। বোধ থেকেই হয় বুদ্ধি। তাই আমি ওর নাম দিলাম বুধ। ও যখন আদিত্য অর্থাৎ সূর্যের সঙ্গে কারো জাতচক্রে একত্রে অবস্থান করবে, সে হবে জ্ঞানী এবং জ্ঞানপিপাসু, মেধাবী ও বুদ্ধিমান। বুদ্ধি জাগ্রত করার জন্য ওকে কখনও কোনও আরক পান করতে হবে না, বুধ স্বভাবমেধাবী হবে। আজ থেকে তুমি আমার প্রাণপ্রিয়া হলে। জীবনের কোনও অবস্থায় আমি তোমাকে ত্যাগ করব না। যদি এতে সমস্ত দেবলোক আমার বিপক্ষে চলে যায়, তবুও আমি তোমাকে ও আমার এই সন্তানকে অস্বীকার করব না। এখন থেকে তুমি আমার প্রমোদ ভবনে সসম্মানে থাকবে। আমার কয়েকজন মানবী স্ত্রী আছেন। তবে দেবলোক থেকে তুমিই আমার জীবনে প্রথম। এসো তারা! আমরা আমাদের অভীষ্ট স্থানে চলে এসেছি।”
দেবলোক থেকে কেউ বেরিয়ে গেলে মুহূর্তে সে খবর চলে আসে সেখানকার মূল গণনাকেন্দ্র বা ডেটাবেসে। বৃহস্পতিও জানতে পেরেছেন যে তারা দেবলোক ত্যাগ করেছে। তবে কচকে সঙ্গে নিয়ে যায়নি সে! মা কেমন করে তার সন্তানকে ভুলে থাকতে পারে? বৃহস্পতি গণক যন্ত্রের সামনে বসল। তারাকে চলে যেতে কারা বা কে সাহায্য করতে পারে? মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করে দিল গণকযন্ত্র। চলে যেতে সাহায্যকারীর মধ্যে নাম আছে কচ, বৃহস্পতি, চন্দ্র এবং প্রায় সব দেব দেবতাদের। আশ্চর্য! গণক কি খারাপ হয়ে গেছে? নাকি প্রসেসর ঠিক করে কাজ করছে না? বৃহস্পতি ভাবতে থাকেন। সত্যিই তার মনে অজস্র কথা ভেসে আসে, যা এবার যন্ত্রগণকের মতটাকে সমর্থন করতে থাকে।
তারার সঙ্গে বহুবছর প্রেমপূর্ণ ব্যবহার করা হয়নি। তাদের শরীরী সম্পর্কও হয়নি বহুকাল। তারাকে ছেড়ে সংসার ছেড়ে দিনের পরদিন তিনি পড়ে থেকেছেন গবেষণা নিয়ে। কচকে নিয়ে অযথা জেদ করেছেন। তারার কথায় সামান্য গুরুত্বও দেওয়া হয়নি। মানা হয়নি তার কোনও মতামত। ভুল হয়েছে। সত্যিই বড় ভুল হয়ে গেছে তার। বৃহস্পতি তাড়াতাড়ি রথে উঠে ইন্দ্রলোকের দিকে ছুটলেন। ইন্দ্রকে গুরুতর কিছু কথা বলা দরকার এখনই।
চন্দ্র আলিঙ্গনাবদ্ধ তারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। চন্দ্রের সঙ্গিনীর দেহেও এখন শোভা পাচ্ছে সূক্ষ্ম আলোকময় দ্যুতি-বস্ত্র। তারার মাথায় ফুলের মুকুট, সেই মুকুটে শোভিত একটি উজ্জ্বল তারা। চন্দ্র ভাবতে তাকেন, চন্দ্রের নিজস্ব নারী তারাই তো হবে। চন্দ্র সে তো তারা শোভিতই! তারা একজন অসামান্যা নারী। তার মনে জ্ঞান, বুদ্ধি, ভালবাসা, আবেগ সবই আছে। সে পরমা সুন্দরী। এমন রত্ন পেয়েও অবহেলায় হারালেন দেব বৃহস্পতি। সে একমাত্র তাকে ভরসা করে দেবলোক ত্যাগ করেছে। তবে দেব-বৃহস্পতি ব্যাপারটা সহজে মেনে নেবেন না। তিনি জেদি এবং অহঙ্কারী। গ্রহের কারকতা ফুটে ওঠে মানব মনে। চন্দ্র জানেন বৃহস্পতির প্রভাববিশিষ্ট মানবেরা সাত্ত্বিক, ধার্মিক ইত্যাদি হলেও যেমন অহঙ্কারী হন, বৃহস্পতিও তেমনই উগ্র অহঙ্কারী। নিজের স্ত্রীকে অন্য কেউ হরণ করেছে এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। অনর্থ হয়ে যাবে। প্রমোদ ভবনে একা তারাকে রেখে যাওয়া এখন তাই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তারাকে কোথায় রাখবেন? ভাবতে লাগলেন চন্দ্র। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য? হ্যাঁ একমাত্র ইনিই বৃহস্পতির কোপ থেকে তারাকে রক্ষা করতে পারবেন। সম্প্রতি একমাত্র কন্যা, শিশু দেবযানীকে নিয়ে শুক্রাচার্য বড় বিপদে পড়েছেন। সন্তান জন্মের সময় দেবযানীর মাতার মৃত্যু হয়েছে, তিনি অতি স্বল্পায়ু ছিলেন। অনাথা শিশুটি কেবল তার পিতাকেই চেনে। তাকে ফেলে গবেষণায় মন দিতে পারছেন না শুক্রাচার্য। অতএব এখন যদি দেবী তারা সেখানে যায়, তাহলে তারার আশ্রয় এবং দেবযানীর প্রতিপালন, দুটি কাজই সহজ হয়ে যাবে। তারা হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে চন্দ্রের দিকে তাকাল।
“কী হয়েছে নাথ? আপনি নিদ্রামগ্ন হননি? আপনি কি চিন্তিত? আমাকে নিয়েই চিন্তিত? আমি আপনার চিন্তার কারণ হলাম! হায় হায়!”
“না দেবী! আপনি আমার চিন্তায় আছেন, তবে তা উদ্বেগ জনিত কারণে নয়, বরং তা প্রেম ও মুগ্ধতাবশত সুখস্মৃতি জাগরিত হওয়ায়। আপনি আমার প্রেয়সী, আপনি তাইতো আমার চিন্তায় সর্বদা থাকবেন! আপনার সুন্দর নিদ্রিত মূর্তি দেখে একটু আগেই আমাদের সুমধুর মিলন আমার স্মৃতিপটে জাগরিত হয়েছিল। আমি সর্বদা আপনার প্রণয় প্রত্যাশী!”
তারা লজ্জিত হল। চন্দ্র তাকে শুক্রাচার্যের বিজ্ঞান সাধনার কথা বলতে লাগলেন। চন্দ্রের প্রেম ও বন্ধুত্ব তারার মন থেকে সমস্ত শঙ্কা দূর করে তাকে অপূর্ব শান্তি দিল। তারা দেবলোক হারিয়েও চন্দ্রের ভালবাসায় আনন্দিত থাকল।
দূরে হেমগিরি পর্বতের উপর সোনালি আভায় ভোর হচ্ছে। হেমবর্ণ সেই বরফের রাজ্যে, মৃদু সোনালি আলো বড় মনোরম হয়ে প্রতিভাত হয়েছে। শুক্রাচার্য হোমের জন্য যজ্ঞের কাঠ কাটতে বনে এসেছেন। চন্দন বনে কাঠ কাটতে কাটতেও তিনি গবেষণার কথাই ভাবছেন। এমন সময় চন্দ্র এসে তাঁকে প্রণাম জানালেন। শুক্রাচার্য এবং চন্দ্রের সম্পর্ক বন্ধুত্বের। চন্দ্রকে ছাড়া বিজ্ঞানের কোনও গবেষণা সম্ভব নয়। সে সমস্ত দ্রব্যের সংগ্রাহক এবং সরবরাহকারী। সার্গ এবং পৃত্থী দুদিকেই দরকারী অত্যন্ত আবশ্যক পণ্য নিয়ে ছোটে চন্দ্রের রথ। চন্দ্র সরাসরি কাজের কথায় এলেন। দৈত্যগুরু অযথা দেরি পছন্দ করেন না। শুক্রাচার্য চন্দ্রের কথা শোনামাত্র অনুমোদন জানিয়ে তারাকে আশ্রয় দেবার অঙ্গীকার করলেন।
শুক্রাচার্য মহান বিজ্ঞানী। বর্তমানে মানব মস্তিষ্কের ক্লোন বা প্রতিরূপ তৈরি করে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছেন দেব ও নরলোকে। অসুর নামক একরকম যন্ত্রমানবও তৈরি করেছেন তিনি। তারা দেখতে মানুষের মতো। তবে আসলে তারা হল অতি জটিলযন্ত্র। এমন সুন্দর ভাবে মৌমাছির মোম ও রং দিয়ে তাদের তৈরি করা হয়েছে যে দেখলে দূর থেকে তাদের মানুষ বলেই মনে হয়। এরাই তার রক্ষী। এরা নষ্ট হলে শুক্রাচার্য আবার তৈরি করতে পারেন মোটামুটি কয়েকদিনের মধ্যে। বলা যতটা সহজ এই কাজ করা তেমনই এককথায় অসম্ভব একটি কাজ। এজন্য দরকার হয় অতি দক্ষকর্মী এবং সর্বোপরি শুক্রাচার্যের উপস্থিতি। তাঁর উপস্থিতি ছাড়া কোনও কাজ সফল হয় না।
বৃহস্পতি ইন্দ্রের সভায় অসময়ে উপস্থিত হতেই ইন্দ্র বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করলেন। ইন্দ্র জানতেন তারা চলে গেছেন। বৃহস্পতি যাতে ক্রুদ্ধ না হন, তিনি তাড়াতাড়ি বললেন,
“চিন্তা করবেন না, দেবসেনাপতি! দেবলোক থেকে সব দেবতাদের সহায়তায় তারাকে উদ্ধার করা হবে। চন্দ্র জোর করে তারাকে তার রথে চাপিয়ে নিয়ে গেছে। দেবী তারা অপ্সরালোকে সে সময় কিছুটা নেশাচ্ছন্ন ছিলেন। চন্দ্র তার কথার জাল বিছিয়ে তারাকে প্রলুব্ধ করেছেন। বৃহস্পতি দেবরাজের কথা ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি জানেন তারা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ও বুদ্ধিমতী নারী। তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কি চন্দ্র কখনও জোর করে নিয়ে যেতে পারবে? তাছাড়া চন্দ্রদেবও অতি সজ্জন এবং বুদ্ধিমান। দেবলোকে এমন অনৈতিক কাজ করে কি সে নিজের এমন শত্রুবৃদ্ধি করতে চাইবে?
সেই মুহূর্তে মন্ত্রণাসভার আহ্বান করা হল। ছুটে এলেন দেবতাদের বিশিষ্ট নীতি নির্ধারকগণ। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সকলেই দেরি না করে এখনই চন্দ্রের প্রমোদভবনে যাবেন।
ইন্দ্রের রথ নিয়ে ছুটে এল তাঁর সারথি মাতলি। ঘরঘর ধ্বনি তুলে রথের কক্ষের দরজা উন্মুক্ত হল। দেবতারা সকলে রথের ভেতর প্রবেশ করতেই সশব্দে দরজা বন্ধ হল। অগ্নিসম রক্তিম আলো বিকিরণ করতে করতে সেই রথ উল্কার বেগে ছুটে গেল চন্দ্রের প্রমোদ ভবনের দিকে।
প্রমোদ ভবনের কক্ষগুলি শূন্য। কেবল একটি কক্ষে মৃদু আলোমাখা তার সূক্ষ্ম বেশটি পরে চন্দ্র একা বসেছিল। বৃহস্পতির চন্দ্রের গৃহে নিজের পত্নীর অনুসন্ধানে আসতে সংকোচ হচ্ছিল। তিনি অধোবদনে দরজার কাছে দাঁড়ালেন। দেবরাজ ইন্দ্র কয়েকজন দেবতাদের নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন। চন্দ্র সব দেবতাদের দেখে যথোচিত সম্মান জানিয়ে বললেন,
“দেবরাজ আমিই দেবী তারাকে এখানে এনেছিলাম। তবে বর্তমানে তিনি যেখানে আছেন, তা প্রকাশে আমি অসমর্থ। তারা স্বেচ্ছায় আমার এখানে এসেছেন। আমি তাঁকে জোর করে ধরে আনিনি। এই বিষয়ে তর্ক উপস্থিত হলে, আমি যথাসময়ে তারাকে দেবলোকে উপস্থিত করব। বর্তমানে তারাদেবী অন্তর্বর্তী। তাঁর পরিচর্যার প্রয়োজন হওয়ায়, আমি তাঁকে একটি গোপন জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আপাতত আমার এবং দেবীরও ইচ্ছা নয়, সকলে সে কথা জানুক!”
বৃহস্পতি শিহরিত হলেন। চন্দ্র যে সত্য বলছেন, তা তিনি উপলব্ধি করলেন। তারা মা হতে চলেছে! তাঁর কানে কে যেন ভীষণ উত্তপ্ত গলিত ধাতু ঢেলে দিয়েছে। বৃহস্পতি টলতে টলতে বাইরে যেতে যেতে বললেন, “আমি কেবল তারার মুখ থেকে তার কথা শুনতে চাই। অন্য কারো বাক্য আমার মনে শান্তি আনতে পারবে না। তারা একবার বললেই আমি ফিরে যাব। কোনও বিতর্ক বা অভিযোগ করব না।”
দেবতারা দেখলেন, বৃহস্পতির মুখ রক্তবর্ণ। ভীষণ যন্ত্রণায় তাঁর শরীর কাঁপছে। ইন্দ্র ছুটে এসে বৃহস্পতিকে দু’হাতে ধরে ফেললেন। তারপর সকলে রথে উঠে চলে গেলেন। আগামী নির্ধারিত দিনে দেবলোকে চন্দ্র, তারা ও বৃহস্পতির উপস্থিতিতে আলোচনা সভার আহ্বান করা হল। দেবলোকের জটিল ও স্পর্শকাতর এই বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে মীমাংসা করা হবে।
তারা বসে আছেন ইন্দ্রের সভা অমরাবতীর মাঝখানে মধ্যবর্তিনী হয়ে। লম্বা একবেণীবদ্ধ তারার কেশ। চুলে বেঁধেছে মর্ত্যের সুগন্ধী জাতিপুষ্পের মালা। মাথার উপর একটি উজ্জ্বল হীরকখণ্ড শোভা পাচ্ছে। অনন্ত যৌবনা তারা। এই কয়েক মাসের মধ্যেই তার গর্ভলক্ষণ বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। তারার মুখে একরকম নরম ও কোমল শ্রী ফুটে উঠেছে। এমন মমতাময় রূপ মেয়েরা যখন মা হতে যায়, একমাত্র তখনই দেখা যায়। বৃহস্পতি সতৃষ্ণের মতো তারার দিকে তাকালেন। এই নারীকে বিস্মৃত হওয়া তার পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। দেবরাজ বললেন, “দেবসেনাপতি বৃহস্পতি! আপনি কি গর্ভবতী তারাকে পুনরায় আপনার সংসারে ফিরিয়ে নিতে চান?”
“আমি তারাকে গ্রহন করতে চাই। তবে তারার গর্ভের সন্তানটি আমার নয়। আমরা দীর্ঘ দুই বৎসরাধিক মিলনসুখ বর্জিত। কারণ বিজ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত থাকায়, সময়াভাব। দেবী তারাকে আমি কখনও অন্তর থেকে বর্জন করিনি। তবে তার গর্ভের অবাঞ্ছিত সন্তানটিকে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি সেই সন্তানের দায়িত্ব নিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছি। তারা যখনই চায় আমার সংসারে ফিরে আসতে পারে। আমার সংসার তো তারারই সংসার। বিশেষত তারার শাসনেই আমার সংসারটি এতদিন পরিচালিত হত। আমি ঘরকন্নার বিষয়ে সর্বদাই অনভিজ্ঞ। আজ আমি তারাকে নিতেই এখানে এসেছি, তবে প্রসবের পর তারাকে এই সন্তানটিকে ত্যাগ করতে হবে। তারার প্রতি আমি স্বামীর কর্তব্যে অবহেলা করেছি। তার প্রতি আরও খানিকটা মনোযোগী হওয়াও আমার উচিত ছিল। আমি আমার দোষ স্বীকার করছি, এবং সুন্দরী অভিমানিনী তারার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
ইন্দ্র এবার চন্দ্রের দিকে তাকালেন, “বলুন চন্দ্রদেব! তারাকে নিয়ে আপনার সিদ্ধান্ত কী?”
“আমি দেবী তারাকে গ্রহন করেছি। তিনি আমার দয়িতা। দেবী তারা আমার অহঙ্কার! আমি তাঁকে সমস্ত অবস্থাতেই কাছে চাই। তারার গর্ভের এই সন্তানের পিতা আমি। আমি আমার সন্তানসহ তারাকে আমার পাশে চাইছি। তবে আমি তারা দেবীর ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা করি। এক্ষেত্রে তিনি যা চাইবেন, আমি আমৃত্যু তাতেই সমর্থন জানাব। কখনও কোনও অভিযোগ করব না। তিনি যদি এখন তাঁর পূর্বের সংসারে ফিরে যেতে চান, আমি বাধা দেব না। তারা দেবীর সন্তান বিষয়ে যে কোনও সিদ্ধান্তেও আমি কোনও বাধা দেব না। সন্তানের উপর সর্বথা মায়ের অধিকারকে আমি স্বীকার করি।”
ইন্দ্র তারার দিকে চাইলেন।
“বলুন দেবী! এই পরিস্থিতিতে আপনার সিদ্ধান্ত কী?”
“আমার সিদ্ধান্ত হল চন্দ্র। আমি চন্দ্রদেবকে ভালবাসি। তাকেই পতিত্বে বরণ করেছি। দেব বৃহস্পতি আমার প্রতি অন্যায় করেছেন। আমার সন্তানকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে তিনি পরীক্ষাগারে নিজের গবেষণার কাজে লাগিয়েছেন। আমি কচকেও তাই ত্যাগ করেছি। আমার সুখ ও সম্পদ যা আমি হারিয়েছি, তা আমি আবার অর্জন করেছি। আমি দেব বৃহস্পতিকে ত্যাগ করেছি। তিনি চাইলেও আমি কোনও অবস্থাতেই তাঁর কাছে ফিরে যেতে চাই না। যদি দেবলোক আমার ও চন্দ্রের এই মিলন সমর্থন না করে, আমি দেবলোক চিরকালের জন্য ত্যাগ করতেও প্রস্তুত।”
বৃহস্পতি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। চন্দ্রের মতো করে নারী-হৃদয় জয় করবার শক্তি তাঁর নেই, কখনও হবেও না। ইন্দ্র তারাকে দেবলোক থেকে নির্বাসন দিলেন, স্বেচ্ছাচারিতার অপরাধে। তারা এই শাস্তিতে যেন পুলকিত হয়েছে। সে সগর্বে চন্দ্রের রথ প্রভায় উঠে বসল। তার মুখে চোখে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। পরাজিত বৃহস্পতি ফিরে এলেন ঘরে। একা। তাঁর জন্য এখন পড়ে আছে প্রেমহীন অনন্ত কর্তব্য।
৩
কচ ব্যাধিকেন্দ্রের শয্যায় শুয়ে গণকযন্ত্রের পর্দায় চোখ রাখল। নিজের মস্তিষ্কের ভেতরটা সে দেখতে পাচ্ছে। নরলোকে মাথার কর্টিক্যাল রিজিয়ন যাকে বলা হয়, তাকে এখানে একটা গোল চিহ্নের মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে। বাকি লোবগুলি বিভিন্ন মাপে বোঝানো হয়েছে। শ্বেত অঞ্চল ও ধূসর অঞ্চলদুটিকে রেখাচিত্রের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। তার মাথার ভেতর একটা বাফার মেটিরিয়াল ও একটা খুব সূক্ষ্ম যন্ত্র বসানো আছে। যাতে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীর চিন্তাগুলির একটা ডেটাবেস পাওয়া যায়, তার মৃত্যুর পরে। তাছাড়া যন্ত্রটি তাকে স্মৃতি বৃদ্ধিতেও সাহায্য করছে। যন্ত্রের জন্যই সে কখনো বিচার না করে আবেগে ভাসে না। পিতা তাকে নিয়ে কত গভীর ভাবে চিন্তা করেছেন! কচের বুকের ভেতরটা বৃহস্পতির জন্য আর্দ্র হয়ে উঠল। পিতা তাকে লালন পালন করেছেন, চেয়েছেন সে যাতে ভবিষ্যতে একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হয়ে ওঠে। কচ মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে নিল।
সে ভাবছিল তার মায়ের কথা। মা বুধকে পেয়ে তাকে ভুলে গেছেন। কখনও তিনি দেবলোকে আসেন না। অবশ্য তিনি চাইলেও এখানে আসতে পারবেন না, কারণ তিনি নির্বাসিতা। অথচ চন্দ্রের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হয়নি। অনেকে বলেন এখানকার আইন একপেশে, এ কথাই বোধহয় সত্যি। চন্দ্রদেবেরও নির্বাসন হওয়া উচিত ছিল।
হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসতেই বাড়ির দাসী, ধী ও অনুপ্রিয়া কচকে জানালো পিতা বৃহস্পতি তার সাক্ষাতপ্রার্থী। কচ স্বয়ংচলমান সিঁড়ির উপর দাঁড়াতেই সিঁড়ি চলতে চলতে মাটির তলায় এসে একজায়গায় থামল। বৃহস্পতি গবেষণাগারে মানব কোষ নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। কচ আসতেই তাকে নিয়ে পাশের ঘরে এলেন, “শোনো কচ! দেবরাজ ইন্দ্র একটা বিশেষ কাজের জন্য তোমাকে নির্বাচন করেছেন। তোমাকে মর্তে গিয়ে একটি বিদ্যা শিখে আসতে হবে। তোমার একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল, কয়েকদিন আগে। তুমি সেই পরীক্ষায় সফল। একজন নর্তকী শ্রুতশ্রবাকে পাঠানো হয়েছিল তোমার পরীক্ষা নিতে। আমি গর্বের সঙ্গে বলছি, তুমি সেই পরীক্ষায় শতভাগ সফল। প্রমাণ হয়েছে, নারীর আবেদন তোমাকে বশীভূত করতে পারে না। এর থেকে মহান বিষয় আর কী হতে পারে! তুমি সুন্দর, বিবেকবান, বুদ্ধিমান এবং শিক্ষিত। তোমার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। তুমি সত্যবাদী। আমি তোমাকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। এবার তোমাকে দেবরাজের আদেশ পালন করে দেবলোকে পিতার মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। আর হ্যাঁ, শ্রুতশ্রবার অভিশাপটি কিন্তু সত্য নয়, সে সেদিন কেবল তোমার পরীক্ষা নিয়েছিল।”
কচ বৃহস্পতিকে প্রণাম করল। বৃহস্পতি বললেন, “এই কাজ কীভাবে হবে এবং তোমাকে কেমন আচরণ করতে হবে সবই দেবরাজ তোমাকে বলবেন। আমাদের একবার এখনই অমরাবতীতে দেবরাজ ভবনে যেতে হবে।”
কচের বর্তমান কাজ হল সঙ্গীত এবং নৃত্য শিক্ষা করা। এই কাজে তাকে সাহায্য করতে এসেছে শ্রুতশ্রবা। কচ তাকে দেখে মৃদু হাসল। শ্রুতশ্রবা দেবরাজের অপ্সরালোকের একজন প্রথম স্তরের কর্মী। সে কচকে নমস্কার জানাল। তার পরনে রত্নখচিত নৃত্য পরিবেশনের পোশাক। শ্রুতশ্রবাকে দেখে কচ বলল, “আমি তোমার বন্ধুত্বের প্রত্যাশী। নারীর মন বুঝতে তুমি আমাকে সাহায্য করবে। আমি পিতার মনে দুঃখ দিতে চাই না। যে কাজ তিনি আমাকে বিশ্বাস করে দিচ্ছেন, আমি চাই তাতে সফল হতে।”
শ্রুতশ্রবা নীরবে হেসে মাথা নাড়িয়ে তার কথায় সমর্থন জানালো।
ইন্দ্র তাকে দেবযানীর মনের গঠন দেখিয়েছেন। দেবযানী শুক্রাচার্যের কন্যা। সে নৃত্য, গীত এবং বাদ্য পছন্দ করে। শুক্রাচার্যের একমাত্র দুর্বলতা হল তাঁর কন্যা দেবযানী। তিনি দেবযানীর অনুরোধ ফেরাতে পারেন না। সুতরাং শুক্রাচার্যের কাছ থেকে মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রটি শিখতে হলে তাকে দেবযানীর মন আগে জয় করতে হবে।
ইন্দ্র বলেছেন, “মনে রাখবে, নারীর পছন্দ হল প্রিয়-বচন। তর্ক-বিবাদ তারা অপছন্দ করে। দেবযানীর অনুরোধ তুমি সর্বদা রক্ষা করবে। তাকে কাজে সাহায্য করবে এবং নৃত্য গীত ও বাদ্য সহকারে তার তুষ্টি বিধান করবে। এভাবেই তুমি সর্বদা দেবযানীর মন জয় করার চেষ্টা করবে। এতেই তোমার কার্যসিদ্ধি হবে। তবে সাবধান, পদে পদে সেখানে মৃত্যুর হাতছানি থাকবে। তোমার ন্যায় ও সত্যই তোমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।”
পৃত্থীর বাদ্যযন্ত্রগুলি বাজাতে শিখতে হবে কচকে। দেবরাজের এই সিদ্ধান্ত মেনে কচ এখন অপ্সরালোকের অধিবাসী হয়েছে। একদল অপ্সরা ও গন্ধর্ব তার শিক্ষক। শ্রুতশ্রবা মাঝে মাঝে দূর থেকে কচকে দেখে যায়। তার মুখ কেন যেন ম্লান। কচ নৃত্য শিক্ষার পরে একদিন শ্রুতশ্রবাকে ডেকে পাঠাল। বিনীত হাসি নিয়ে সে উপস্থিত হল কচের সামনে। কচ বলল,
“একটা বিষয় দেখছি, তুমি যেন আমার এই নৃত্য গীত শিক্ষার অগ্রগতিতে খুশি নও। কেন?”
শ্রুতশ্রবা নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে তার চোখের কোন থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। কচ অবাক হয়ে গেল। তার মনে হল শ্রুতশ্রবা বোধহয় তাকে ভালবাসে। সে মনে মনে বলল, “মাধবী!” শ্রুতশ্রবা যেন প্রেমের ত্যাগের প্রতীক!
ধরা গলায় শ্রুতশ্রবা বলল, “কচ তুমি কি তোমার কাজের বিপদ কতখানি বুঝতে পারছো না? নাকি বুঝেও স্বীকার করতে চাও না?”
“বিপদ তো আছেই শ্রুতি। বিপদ আছে বলে কি কাজ করবো না? নাকি বিপদের ভয়ে পিছিয়ে ঘরে ফিরে যাব?”
“পৃত্থীতে তোমার বিপদ পদে পদে। দেবলোকের অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হলেই তোমার অবধারিত মৃত্যু। অথচ তুমি মিথ্যেও বলতে পারো না! তোমার জন্য আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।”
“চিন্তা কোরো না। তোমার এই দুশ্চিন্তা দেখে আমার মনে হচ্ছে, তোমার মনে আমার জন্য বিশেষ কিছু অনুভূতি আছে। আর তা জেনে আমার এখন বেশ আনন্দ হচ্ছে।”
“আহ্! এই ধরণের কথা বলে বুঝি তুমি নারীর মন জয় করবে? হায় হায় কথা বলার পদ্ধতিকে খানিকটা জটিল করতে হয় কচ! এখন তোমাকে প্রেমালাপ আমি কেমন করে শেখাব?”
“চিন্তা করো না শ্রুতি! আমি পৃত্থী ও সার্গের যাবতীয় সাহিত্য অধ্যয়ন করে এই সম্বন্ধে বিশিষ্টতা লাভ করব। অধ্যয়নে আমার কোনো ক্লান্তি নেই।”
শ্রুতশ্রবা কলকন্ঠে হেসে উঠল।
“বেশ। অধ্যয়ন করে জ্ঞান আহরণ করে নাও, কাল এসে তোমার কাছ থেকে না হয় খানিক প্রেমালাপ শুনব। কেমন শিক্ষালাভ করেছো তার পরীক্ষা হবে!”
কচ সার্গ এ পরবর্তী তিনবছর ধরে নৃত্য, গীত ও বাদ্য শিক্ষা করল। শরীরের যত্ন নিল। তার মাথায় এখন বেশ দীর্ঘ কুঞ্চিত কেশরাশি। সে মর্ত্যের মানবদের মতো করে কেশশয্যা করাও শিখেছে। শিখেছে যজ্ঞ ও হোম, গাভীদের পরিচর্যা, গৃহকর্ম ইত্যাদি। সেইসঙ্গে গোপনতথ্য সংগ্রহ করতে গুপ্তলিপিতে দ্রুত মনে রাখার পদ্ধতিরও চর্চা করেছে।
অবশেষে এক শুভদিনে মৃগশিরা নক্ষত্রে কচ নরলোক পৃত্থীতে যাত্রা করল।
যাবার আগে কচ শ্রুতশ্রবার সঙ্গে দেখা করতে গেল। শ্রুতশ্রবা কখনও তাকে প্রেমপ্রস্তাব দেয়নি বটে, তবে এই কয়েকটি বছরে শ্রুতশ্রবাকে ভালবেসে ফেলেছে কচ। তার ভালবাসা যুক্তিবুদ্ধিহীন মোহমুগ্ধ নয়। সে ধীরে ধীরে শ্রুতশ্রবাকে ভালোবেসেছে। তবে কখনও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি, বা নিজের মনের কথাও তাকে কখনও জানায়নি কচ। কারণ সে জানে তার ফিরে আসা অনিশ্চিত। হয়তো এই যাত্রায় সে সফলতা পাবে না। তবে সে প্রবল চেষ্টা করবে। চালাকি দিয়ে নয়, সততা দিয়ে সে নিজের পথ সুগম করবে। করে নেবেই। এ তার দৃঢ় প্রত্যয়।
“শ্রুতি, আমার যাবার সময় হয়ে এল। আগামী কালই যাত্রা করছি। জানো তো?”
“শুনেছি।”
ম্লান মুখে শ্রুতশ্রবা বলল।
“যদি সফলতা পাই, ফিরে আসব। নাহলে নয়। এই আমার সংকল্প।”
“তুমি সফল হবে কচ। তোমার মধ্যে কোনো মিথ্যে নেই। তোমার সততাই তোমাকে জয়ের মুকুট পরিয়ে দেবে একদিন। তুমি দেখো!”
“সফল হয়ে ফিরে এসে যদি তোমাকে চাই, তখন পাশে পাবো কি?”
“আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”
শ্রুতশ্রবার কথায় কচে বুকের ভেতর সহস্র পদ্ম যেন ফুটে উঠল। সে আনন্দে দু’চোখ বন্ধ করল। শ্রুতশ্রবাকে এই প্রথম সে নিজের বুকের মধ্যে মনের গহীনে জড়িয়ে নিল। পরম নির্ভরতায়, ভালবাসায়।
মনে মনে বলল, “মাধবী! আশা রাখি আমাদের ঠিক দেখা হবে, আমার অনিশ্চিত যাত্রার পরে।”
মহাকাশযান যাত্রা করেছে পৃত্থীর দিকে। কত সহস্রদিন ধরে ছুটে চলেছে সেই যান। যানের ভেতরে কোনো গতির অনুভূতি থাকে না। সেখানে দিনরাতের হিসেবও থাকে না। সময় সেখানে থমকে থাকে। কচ সঙ্গে এনেছে বিভিন্ন পুঁথিপত্র। আয়ুর্বেদপাঠ, ঔষধি গাছের বিবরণ এইসব তাকে জানতে হবে। পৃত্থীর আবহাওয়া, সেখানকার গাছপালার জ্ঞানও তার দরকার। যানের স্বচ্ছ দেওয়ালের ভেতর দিয়ে গ্রহ তারা নক্ষত্র চোখে পড়ছে কচের। যাত্রাপথের এক জায়গায় আকাশের বুকে চন্দ্রের প্রমোদ-ভবনের দিকে চোখ পড়ে গেল কচের। এখানে তার মা আর ভাই থাকে। আজ আর তার মনে মায়ের প্রতি কোনো বিতৃষ্ণা নেই। সে আজ জীবনে প্রথম একটা বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজ করতে চলেছে। কচ তার মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালো।
হেমগিরি পর্বতের চূড়ায় এসে দেবলোকের রথ থেকে নীচে অবতরণ করে রথটিকে ফিরে যেতে বলল কচ। সে নরলোকের উপযুক্ত সাজ পোশাক পরেছে এখন। দীর্ঘাকৃতি সৌম্য দর্শন এক ব্রাহ্মণ বিদ্যার্থীর মতো লাগছে তাকে। সে বনের ভেতর নিভৃতে যেখানে শুক্রাচার্য তাঁর গবেষণাগার গড়ে তুলেছেন সেখানে গেল। শুক্রাচার্য বাড়িতে নেই। তাঁর কন্যা দেবযানী তাদের কাঠের বাড়িটির সামনের উঠোনে বসে পুজোর জন্য তোলা ফুল দিয়ে মালা গাঁথছিল। কচ তাকে নমস্কার জানিয়ে দূরে অপ্রতিভ মুখে দাঁড়িয়ে রইল।
সকাল থেকেই আজ দেবযানীর বাঁ চোখের পাতা কাঁপছে। এই অরণ্যে কে আসবে? নতুন কোনও অতিথি? তার কোনও প্রেমাস্পদ? তবে কি আজ কোনো তরুণ বিদ্যার্থী আসবেন পিতার কাছে শিক্ষালাভ করতে? শুক্রাচার্যের কাছে এর আগেও মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীরা এসেছে। তবে পিতা পরীক্ষা না করে কাউকে বিদ্যার্থী হিসেবে গ্রহণ করেন না। দেবযানী কচের রূপে প্রথমেই মুগ্ধ হয়েছিল। তার বিনীত ব্যবহার তার আরও ভাল লাগল। সে কচকে বসতে দিয়ে ভেতরে গেল জল আনতে। কচ নামটি কয়েকবার মনে মনে উচ্চারণ করল দেবযানী।
কচ ফুলগুলি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তিনটি গোড়ের মালা গেঁথে ফেলল। গাঢ় লাল কুঞ্জলতার ফুল দিল সে শ্বেতশুভ্র মালতী ফুলের মালার মাঝখানে। দেবযানী একটু পরে কচের জন্য একটা থালায় অনেক রকম ফল কেটে আনল, সঙ্গে একটা মাটির ঘটে এনে দিল খাবার জল। কচের মালাগাঁথা দেখে দেবযানী হতবাক। এত সুন্দর মালা সে আগে দেখেইনি।
“চমৎকার! তুমি কোথা থেকে এসেছো? পিতা এখন গেছেন অসুররাজ বৃষপর্বার কাছে। পিতার গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র দরকার। তিনি এখনই ফিরে আসবেন। ততক্ষণ তুমি স্নান করে এসো কচ!”
কচ দেবযানীর কথায় আশ্বাস পেয়ে সামনে বয়ে চলা হেমকণা নদীর জলে ডুব দিয়ে স্নান সেরে নিল।
শুক্রাচার্য এলে কচ তাঁকে প্রণাম করে বলল, “দেব! আমি দেবলোকের অধিবাসী, কচ-তারা। আপনার কাছে থেকে বিদ্যার্জন করতে চাই। আমার পিতা হলেন দেবসেনাপতি বৃহস্পতি। আমার মাতা তারাদেবী। আপনার বিজ্ঞান সাধনার কথা সুদূর দেবলোকেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ। আপনি মৃত জীবের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারেন।”
“দেখো কচ! আমি প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারি এটা ঠিক, কিন্তু আমার ছাত্র হলেও আমি কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বা পদ্ধতি কাউকে শিক্ষা করাই না। এটাই আমার নীতি। যদি এতে সম্মত থাকো এখানে থেকে শিক্ষা করতে হবে। আমিই একমাত্র জানলাম তুমি দেবলোকবাসী। তবে সাবধান! আমার কন্যা দেবযানীও যেন কখনও না জানে তুমি দেবলোকের অধিবাসী। জানলে সে তোমাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করবে, আর অসুরেরা জানতে পারলে তারা তোমাকে অবশ্যই হত্যা করবে। আমি তোমাকে শিক্ষা দেব, কারণ তুমি সত্যবাদী। আমার কাছে তুমি কোনও ছলনা করোনি।”
“আমি সম্মত গুরুদেব! আপনি যেমন বলবেন তেমনই হবে।”
এরপর কচের শিক্ষা শুরু হল। সকাল থেকে ধ্যান, জপ শেষ করে সে দেবযানীকে কাজে সাহায্য করে। জল আনে, কাঠ কাটে। বাসস্থানের পালিত গরুদের সেবাযত্ন করে। বিকেলে গরুগুলোকে গোয়ালে ফিরিয়ে আনে। তারপর বেদ, বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ ইত্যাদি নানা বিষয় শুক্রাচার্যের কাছে শিক্ষা করে। সূর্যাস্তের পর দেবযানী পাকশালায় কাঠকুটো জ্বেলে রান্না করে। খাবার বলতে মূলত যব। কখনও চাল, বা ঘাসের দানা দুধে ফুটিয়ে মধু মিশিয়ে খাওয়া হয়। বনের ফলমূল ও কন্দও খাওয়া হয়। উষণ, বারাহী, ক্ষুদ্রক, ক্ষীরিকা এমন বহুরকমের কন্দ বা মূল পাওয়া যায় বনে, আর ফলের তো কোনও সীমা পরিসীমা নেই। প্রতিটি ঋতুতে আছে সেই ঋতুর বিশেষ ফল।
বিভিন্ন তিথিতে উপোস করে দেবযানী। কচ তা মনে রেখে সেদিন বন থেকে অনেকরকম ফল এনে রাখে। সেদিন সে রান্নার দায়িত্বও নেয়। রাত বাড়লে শুক্রাচার্য তাকে নির্মেঘ আকাশ দেখিয়ে তারা চিনিয়ে দেন। কচ তার পিতার সঙ্গও এত গভীরভাবে আগে কখনও পায়নি। দেবলোকে সন্তান তার মাতা পিতার এত নিবিড় সাহচর্য পায় না। নরলোকের সর্বত্র মায়ার বড় টান। কচ কিছুদিনের মধ্যেই নির্লোভ, নিরাসক্ত ও সত্যদ্রষ্টা শুক্রাচার্যকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলল।
এক একদিন বনের ভেতর ফুল তুলতে গিয়ে দেবযানী উঁচু ডালের নাগাল পায় না। কোথা থেকে ছুটে আসে কচ। সে এসেই উঁচু ডালগুলিকে নত করে দেয়। কখনও সে গাছে উঠে ফুল পেড়ে আনে। বনের ভেতর চলতে চলতে উদার গলায় গান করে কচ। গানের সময় সে তার দু’চোখ বন্ধ করে রাখে, ভাগ্যিস! নাহলে দেবযানীর মুগ্ধ দৃষ্টি তার চোখে পড়ে যেত। এভাবেই কয়েক বছর কেটে গেল। দেবযানী রান্না করতে বসলে কচ শূন্য কলসী বাজিয়ে গান করে। সে এত সুন্দর তালবাদ্য বাজাতে পারে! দেবযানী ক্রমশ মুগ্ধ হয়ে পড়ছে কচের প্রতি। এই যুবকটি যেন সবার থেকে আলাদা। যেমন সে সুন্দর, তেমনই ভদ্র, শোভন। তেমনই মনোহর তার আচার আচরণ। দেবযানী ঘুমালেও কচের স্বপ্ন দেখে। সে রোজ রাতে কচের নিবিড় আলিঙ্গন উপভোগ করে। সে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে কচকে। তারপর ঘুম ভেঙে সে ভাবে হায় কেন ঘুম ভেঙে গেল? স্বপ্ন কেন বাস্তব হয় না! এমন কেন হয় না? তবে গুরুকন্যা হওয়ার জন্য সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কচকে কিছু বলতে পারে না। তার মুগ্ধতা তাকে গোপনে সিক্ত করে, কেবলই আপ্লুত করে চলে।
একদিন বনের ভেতর দেবযানী বিপদে পড়ে গেল। ফুল তুলতে গিয়ে একটা কাঁটা ডালে তার কাপড় এমন জড়িয়ে গেল কিছুতেই সে ছাড়াতে পারল না। শেষে কাপড়খানা ফালাফালা হয়ে ছিঁড়ে গেল তার। যদিও কাপড় ছিঁড়ে যেতে দেবযানীর মনে একরকম উল্লাস হল। সে আশা করল কচ যেন তার সামনে এই মুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়! আজ সে তার মনের কথা কচকে বলবে। তার বিকশিত-যৌবন শরীর দেখে কচ আজ কিছুতেই ঋষিসুলভ উদাসীনতায় তাকে অবজ্ঞা করতে পারবে না! এই মস্ত উঁচু ডালের উপর কর্ণিকারের হলুদ ফুল ঝরণার মত ছড়িয়ে আছে। কর্ণিকার ফুলের দুল পরে কচকে চমকে দেবে ভেবেছিল দেবযানী। এখন ফুল তো পেলই না উপরন্তু প্রিয় শাড়িটাও ছিঁড়ে গেল। শাড়ির গায়ে শিয়ালকাঁটার পাতা আর ডাল লেগে গেছে ছাড়াতে গিয়ে হাতও রক্তাক্ত হয়ে গেল দেবযানীর। অজান্তেই দেবযানীর গলা দিয়ে বেরিয়ে গেল, “বাঁচাও কচ! কোথায় আছো, আমাকে বাঁচাও!”
কচ দূর থেকে দেবযানীর গলা পেয়ে ছুটে এল। তাড়াতাড়ি তার সাদা নরম রেশমের উর্ধ্ববাসটা দেবযানীকে দিয়ে দেবযানীকে কাঁটা থেকে উদ্ধার করতে দুহাতে কোলে তুলে নিল। বলশালী কচের হাতে দেবযানী যেন পক্ষিশাবকের মত আশ্রয় নিল। তারপর দেবযানীকে নিয়েই তরতর করে কর্ণিকার বৃক্ষের উপর উঠে পড়ল কচ। সে বুঝতে পেরেছে দেবযানী ফুল নিতেই অন্যমনস্ক হয়ে ওই কাঁটার বনে ঢুকেছিল।
“এবার আপনি পুষ্পচয়ন করুন দেবী! যত ইচ্ছে ফুল সংগ্রহ করে নিন।”
দেবযানী খিলখিল করে হাসল। কচ মনে মনে বলল,
“মুগ্ধা মর্ত্যের নারী! দু’দিন একটু হেসে নাও। আমার কার্যসিদ্ধি হয়ে গেলে আমার চিহ্নও আর কোথাও তুমি পাবে না।”
কচ চোখ বন্ধ করে একবার শ্রুতশ্রবার মুখটা মনে করলো। তার বুকের ভেতর তীব্র একরকম যন্ত্রণা হল।
কচ বুঝতে পেরেছে, দেবযানী তার বশবর্তী হয়েছে। সে এবার একটু রঙ্গ করল, তবে অবশ্যই শোভনীয়তা বজায় রেখে। কচ দেবযানীকে একহাতে তুলে ধরে গাছের ডালে বসল, অন্যহাতে কর্ণিকার ফুল তুলে এনে দেবযানীর সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দিতে লাগল। বাসন্তী হলুদ ফুলের বৃষ্টিতে দেবযানীর সেই শ্বেতরেশম বস্ত্রখানি ভরে গেল। দেবযানী চোখ মেলে চাইল, দেখল কচের মুখে স্মিত হাসি। গৌরবর্ণ উন্মুক্ত পেশীবহুল শরীর তার! তার শরীরে উর্ধবাস নেই। সেখানা সে দেবযানীকে দিয়েছে। দেবযানীর বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন শিরশির করে উঠল। সে হঠাৎ আরক্ত মুখে বলল, “কচ এবার আমাকে ছেড়ে দাও, আমার ভয় করছে!”
কচ একটা বসন্ত রাগের গান গাইতে গাইতে গাছ থেকে নেমে এল। দূরে দুটো চিতল হরিণ গাছের নীচে সঙ্গমরত। সেদিকে একবার তাকিয়ে দেবযানী আরও আরক্ত হয়ে দ্রুত আশ্রমের দিকে ছুটে গেল। কচ বুঝল, দেবযানী তার মিলন প্রত্যাশী। কচের মুখ বিকৃত হল। মনে মনে সে বলল, “এই মিলন অসম্ভব দেবী দেবযানী! আমি একজনের প্রতি আগেই আমার চিত্তটিকে অর্পণ করেছি। তাকে কিছুতেই আমি প্রবঞ্চনা করতে পারব না।!”
বৃষপর্বার নিযুক্ত অসুরেরা এই হেমগিরি বনটি সর্বক্ষণ পাহারা দেয়। যাতে দেবলোকের কেউ এই বনে কখনও পা রাখতে না পারে। একদিন অসুরেরা কচকে দেখতে পেল। কচ গরুদের নদীর কাছে ছাড়তে এসেছিল। বর্ষার জল পেয়ে নদীর ধারে সবুজ ঘাস হয়েছে। অসুরেরা কচকে জিজ্ঞাসা করল,
“তুমি কে? এখানে কোথা থেকে এসেছো?”
কচ মিথ্যা বলতে পারে না। সে প্রথমে উত্তর দিল না। তবে অসুরদের বার বার প্রশ্নের উত্তরে এক সময় সে বলে ফেলল, “আমি দেবলোকবাসী কচ।”
অসুরেরা আবার জিজ্ঞাসা করল, “কে তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন?”
সত্যবাক্যে অটল কচ বলল, “দেবরাজ ইন্দ্র।”
সঙ্গে সঙ্গে আর কোথায় যায়! অসুরেরা ভয়ানক ক্রোধে তরবারি দিয়ে তক্ষুণি কচের শরীর তিন টুকরো করে কেটে দিল। অসুররূপী যন্ত্রমানবদের এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে। তারা দেবলোকবাসী দেখলেই হত্যা করবে। কচের মৃত্যু হয়েছে তখনও কেউ জানে না। সন্ধ্যা হয়ে গেলে গরুর দল হাম্বা হাম্বা রব তুলে গোয়ালে ফিরে এল। কিন্তু কচ তবুও ফিরে এল না। দেবযানী ভয়ানক চিন্তায় ছটফট করতে লাগল। দূরের গ্রাম থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ফিরে এলেন শুক্রাচার্য। দেবযানী তখন বসে বসে কাঁদছিল। শুক্রদেব বললেন,
“কী হয়েছে মা? কেউ বুঝি তোমার মনে ব্যথা দিয়েছে?”
“পিতা কচের মনে হয় কোনও ভয়ানক বিপদ হয়েছে। সেই দুঃখেই আমি কাঁদছি। সে বড় শান্ত। অসুরেরা নিশ্চয় তার কোনও ক্ষতি করেছে।”
“চিন্তা কোরো না। আমি দেখছি।”
শুক্রাচার্য কয়েকজন অসুরদের সঙ্গে নিয়ে সেই মুহূর্তে বনের ভেতর গেলেন। দেবলোকের দেহ হওয়ায় বনের পশুপাখিরা কচের দেহের কোনো ক্ষতি করেনি। অসুরেরাই দেখিয়ে দিল কচের মৃতদেহ কোথায় পড়ে আছে। শুক্রাচার্য অসুরদের দিয়ে কচের দেহটি বহন করিয়ে দ্রুত ফিরে এলেন। মৃত কচকে দেখেই দেবযানী আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে গেল।
কচের মস্তিষ্ক এখনও জীবিত আছে। সুতরাং ভয় নেই। একজন সুঠাম যুবকের শরীর সংগ্রহ করা হল, যার সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে। এবার মস্তিষ্ক স্থানান্তর করতে হবে। পাঁচটি বিশেষ উদ্ভিদ প্রয়োজন। সুষুম্না নাড়ির উপর যে পাঁচটি চক্র আছে পর পর যেমন মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধাক্ষ এবং এদের উপরে কূটস্থ, যা মানবদেহে দুই ভুরুর মাঝখানে থাকে। এই পাঁচটি চক্র পর পর প্রকৃতির পাঁচটি তত্ত্বকে চিহ্নিত করে। যেমন ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম। অর্থাৎ মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ বা শূন্যতত্ত্বের প্রতীক। এবার নামধারী উদ্ভিদগুলি হল অর্ক, বরুণ, ভৃঙ্গরাজ, ঘৃতকুমারী, নির্গুণ্ডি। এছাড়া সহায়ক উদ্ভিদ দরকার হয় যেমন হরিদ্রা, নিম্ব, ত্রিফলা ইত্যাদি। এরা জীবানু নাশক। ওষুধ প্রস্তুত করাই ছিল। পাঁচটি ভেষজ বৃক্ষকে প্রণাম করে তাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হল। বৃক্ষের মঙ্গলকারী শক্তি অনিবার্য। এবার রক্তবাহী ধমনীগুলিকে যুক্ত করে পাঁচটি ঔষধি গাছের নির্যাস দিয়ে বন্ধন দেওয়া হল। নাসাপান করানো হল রক্তচন্দনের ক্বাথ। ঘরের বাইরে আগুন রাখা হল লোহার পাত্রে। যে ঘরে ঢুকবে হাত পা গরম করে তবেই ঢুকবে। নিশিন্দার শেকড় হল কোষের পুনরায় উৎপত্তির কারক। এটি একটি অসামান্য রসায়নও। যা দেহে নতুন কোষ তৈরি করতে পারে। এটি আকাশ তত্ত্বের প্রতীক এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ। নিশিন্দা এবং ভৃঙ্গরাজ এইদুটিই মস্তিষ্ককে রক্ষা করবে। নাশারন্ধ্র দিয়ে সূক্ষ্মাকারে নীল নিশিন্দা ও ভৃঙ্গরাজের রস চালনা করা হল ঘন্টায় পাঁচ ফোঁটা এই হিসেবে। সাতদিন সাতরাত্রি শুক্রাচার্য জেগে বসে রইলেন কচের পাশে।
দেবযানী পাগলের মতো হয়ে গেছে। খাওয়া, ঘুম ইত্যাদি আবশ্যকীয় কোনো কাজও সে করতে পারছে না। কচ কবে তার এমন করে সর্বস্ব দখল করে বসেছে তা দেবযানী জানতেও পারেনি। সারাদিন সে প্রার্থনা করেছে আর কেঁদেছে। পিতাও কয়েকদিন ধরে খাননি। দেবযানীর সে কথা মনেও নেই। শুক্রাচার্যও যেন ধ্যানমগ্ন। কচের শরীর পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যার দেহে কচ প্রতিস্থাপিত হয়েছে, তার গায়ের রং কচের মত অতটা উজ্জ্বল নয়। অবশ্য দরকারও নেই, দেবযানীর। কচ শুধুমাত্র জীবিত থাকুক। সে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করলেও সে অন্তত প্রাণে বেঁচে থাকুক!
অবশেষে চোখ মেলে চাইল কচ। সফল হয়েছেন শুক্রাচার্য। কচ তার স্মৃতি ও মেধা ফিরে পেয়েছে। এই কয়েকদিনে শুক্রাচার্য কচের মস্তিষ্কের মানচিত্র তৈরি করেছেন। এবার থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে কচকে। বললেন শুক্রাচার্য।
একবছর বেশ নিশ্চিন্তে কাটল। এই সময় কচ খুব একটা একা বাইরে যায়নি। সে বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। দেবযানী পাগলের মত সেবা করেছে তার। কচও দুর্বল শরীরে দেবযানীকেই যেন অবলম্বন করেছে। ধীরে ধীরে উঠে বসল কচ। শুক্রাচার্য একদিন তাকে ডেকে একটা জিনিস দেখালেন। বললেন, “কচ আমি একটা কাজ করেছি। তোমার ক্ষতি হলেও যাতে তোমার অধীত বিদ্যার ক্ষতি না হয়, তাই আমার বিরাট গণক যন্ত্রের সঙ্গে তোমার মস্তিষ্কের ভেতরে থাকা সূক্ষ্ম বিশেষ যন্ত্রটির সংযুক্তি সাধন করেছি। এবার তুমি ধ্বংস হলেও এই যন্ত্রের সাহায্যে তোমার খোঁজ পাওয়া যাবে। এই যন্ত্র কোনওভাবেই ধ্বংস হবে না, এমনভাবেই তৈরি। মানবদেহের জিনবাহক তন্তুও যেমন আগুনে পুড়েও ধ্বংস হয় না, খানিকটা তেমনই এটা। কচ দেখল গণকযন্ত্রের সাহায্যে তার সম্পর্কে প্রশ্নের সব উত্তর পাওয়া যাচ্ছে, সে কোনও কিছু উত্তর না দিলেও। যে উত্তরগুলো আসছে তা কোনোভাবেই কচ ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কারণ প্রশ্নগুলোও অন্যরকম। এবার সে চাপমুক্ত। অন্তত তার মৃত্যুর পর দেবলোক জানতে পারবে, সে অগ্রবর্তী হতে কী কী চেষ্টা করেছিল।
তার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন বিষয়ে কোনো স্মৃতি নেই। তবে এই বিশেষ বিষয়টা শিক্ষা করতেই সে এখানে এসেছে। তবে কিছু ছিন্ন উদ্ভিদের দেহাংশ সে সংগ্রহ করেছে। দেবলোকের গবেষণাগারে সেই উদ্ভিদগুলির পরীক্ষা হতে পারে। কয়েকটি সে চিহ্নিত করতে পেরেছে। কয়েকটি পারেনি। তাকে এ বিষয়ে আরও একটু অনুসন্ধান করতে হবে। কচ শুক্রাচার্যের আসা যাওয়ার সময় তাঁকে অনুসরণ করা শুরু করল। সবসময় সম্ভব হয় না। বৃদ্ধ হলেও শুক্রাচার্য খুবই কর্মঠ। দারুণ জোরে এগিয়ে যান। দূর থেকে তাঁকে লক্ষ্য করা বেশ কঠিন। একদিন শুক্রাচার্য বাইরে যেতেই কচ তাঁকে অনুসরণ করতে লাগল। শুক্রাচার্য এগিয়ে যেতেই আবার অসুরদের দল এসে ঘিরে ধরল কচকে।
“কে তুমি?”
“কচ।”
“বৃহস্পতি পুত্র? অঙ্গিরার পৌত্র?”
“হ্যাঁ।”
সঙ্গে সঙ্গে ঝলসে উঠল তরবারি। এবার কচকে যাতে সহজে না পাওয়া যায়, তেমন ব্যবস্থাই করল অসুরেরা। তারা কচের দেহ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলল এবং বনে, প্রান্তরে ও নদীতে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিল।
সন্ধ্যা হতেই দেবযানীর ডানচোখ বারবার কেঁপে উঠতে লাগল। দেবযানী পরম বিপদের আশঙ্কায় ভীত হয়ে উঠল। তার কেবল চিন্তা কচকে নিয়েই। শুক্রাচার্য ফিরে আসতেই দেবযানী ছুটে এল, “পিতা! কচের বোধহয় আবার কোনও বিপদ হয়েছে। একটু আগে আমার ডানচোখ কাঁপছিল। এত রাত হয়েছে, তবু কচ এখনও ফিরে আসেনি। যদি ওর কিছু হয়, আমি আর বাঁচব না। আপনি যেমন করে হোক আমার কাছে কচকে এক্ষুণি ফিরিয়ে দিন!”
“কল্যাণী! শোক করো না। আবারও যদি কচের একই রকম বিপদ হয়, তাহলে মনে করবে কচের আয়ু শেষ হয়েছে। কারণ আমি বাঁচিয়ে দেওয়ার পরেও ওর যদি একই রকম বিপদ হয়, তবে তা খুবই অস্বাভাবিক।”
শুক্রাচার্য অসুরদের ডেকে পাঠালেন। তারা এসে স্বীকার করল যে কচকে তারা সূর্যাস্তের ঠিক আগে সকলে মিলে হত্যা করেছে। এবারও দেবযানী করজোড়ে তার পিতার কাছে কচের জীবনভিক্ষা চাইল। শুক্রাচার্য তক্ষুণি অসুরদের প্রণোদিত করে পাঠালেন তারা কচের দেহের টুকরোগুলি আহরণ করে আনল। কচের মস্তিষ্ক এবারেও অক্ষত ও সজীব আছে। এবারেও বহু চেষ্টায় একইভাবে কচের মাথাটি একজন সদ্যমৃতের শরীরে সংযুক্ত করা হল। জীবনের লক্ষণ ফিরে এলে নির্গুণ্ডি ও ভৃঙ্গরাজকে জীবনদায়ী ভেষজ হিসেবে স্বীকৃতী দেওয়া হবে ঘোষণা করা হল। ভৃঙ্গরাজকে অবশ্য শিরোরোগের মহৌষধি বলা হয়। মাথার যে কোনো রোগে পীত, নীল ও শ্বেত ভৃঙ্গরাজ সমান ফলদায়ী না হলেও সবকটিই স্মৃতিহ্রাস, কেশহ্রাস, চুলের অকাল পক্কতা, এবং শরীরের বার্ধক্য দূর করতে পারে। গ্রহণের সবথেকে ভাল উপায় হল নাসাপান করা। সম্ভব না হলে গণ্ডুষধারণেও উপকার পাওয়া যায়।
শুক্রাচার্য খাওয়া দাওয়া ভুলে কচের শয্যার পাশে পড়ে রইলেন। দিন কাটতে লাগল। দীর্ঘ সময় পরে কচের শরীরে জীবনের লক্ষণ ফিরে এল। শুক্রাচার্যের অধীনে যারা কাজ করছিলেন সকলেই একত্রে হর্ষধ্বনি করে উঠলেন। দেবযানীর সেবায় কচ আবার সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল।
দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশেই শুক্রাচার্যের নিষেধ জেনেও অসুরের দল কচকে হত্যা করেছিল। ইন্দ্রই লোক নিযুক্ত করে তাদের স্মৃতিধারকের ভেতরে সূক্ষ্ম পরিবর্তন করেছিলেন। সেইজন্য অসুরেরা শুক্রাচার্যের নিষেধ ভুলে গিয়েছিল। কচ একবার মৃত্যুবরণ করেও মৃত্যুর হাত থেকে কীভাবে ফিরে আসতে হয়, তা এখনও হাতেকলমে শিখতে পারেনি, এইজন্যই ইন্দ্রের ইচ্ছায় তাকে বারবার হত্যা করানো হচ্ছে।
কচের শরীর এবার খানিকটা দ্রুত সেরে উঠল। অসুস্থ অবস্থায় প্রায় দু’বছর সময় যদিও কেটে গেছে। সুস্থ হয়েই সে দেবযানীকে আবারও সংসারের কাজে সাহায্য করতে চায় আর দেবযানী কচকে কোনও কাজ করতে দিতে চায় না। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কচের শরীর তার আগের সৌষ্ঠব ফিরে পায়নি। তবুও সে প্রাণে বেঁচে আছে, এটাই দেবযানীর কাছে অনেক আনন্দের। সে কচের জন্য দুধ-পথ্যের ব্যবস্থা করেছে। দুধ ও কৃষ্ণ তুলসীর রস সকালে মধুর সঙ্গে সে কচকে পান করতে দিয়েছে। কচের জীবনীশক্তি আশ্চর্য! সে কি এই পৃথিবীর কেউ নয়? সন্দেহ হচ্ছে দেবযানীর। কারণ মানব শরীর দু’দুবার এই ভয়ানক শল্যচিকিৎসা সহ্য করতে পারে না। দেবলোকের অধিবাসীরাই একমাত্র এমন শক্তিধর হয়ে থাকে, শুনেছিল দেবযানী।
কচের নিঃস্বার্থ আচরণ, শ্রদ্ধা প্রদর্শন, মেধা, সৌন্দর্য্য প্রতিটি গুণাবলীই এখন তার মনে একই সন্দেহ এনে দিচ্ছে। কচ যদি দেবলোকবাসীই হয়, তবে কি এখানে সে কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে? সে কি মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র শিখতে চায়? এর অর্থ কচকে দেবরাজ ইন্দ্রই এখানে পাঠিয়েছেন! সর্বনাশ! তবে কি কচ পিতারও কোনও ক্ষতি করতে চায়? দেবযানী কচের দিকে তাকালো। ভাগ্যিস এখনও কচের মুখমণ্ডল একই রকম আছে! সেই পবিত্রতায় আলোকিত চোখমুখ! এমনটা কি কখনও হওয়া সম্ভব? তবুও দেবযানী ভাবল, একবার সে তার মনের সন্দেহের কথা পিতাকে জানাবে।
দেবযানী ধীরে ধীরে পিতার কক্ষে প্রবেশ করল। দেখল এসে, পিতা জটিল চিন্তায় মগ্ন। দেবযানীকে দেখে হাসলেন।
“কল্যাণী বলো? এখানে কী দরকারে এসেছো?”
“পিতা কচ কি দেবলোকবাসী?”
“মা এখন সে নরলোকবাসী! এই প্রশ্ন করার এটা উপযুক্ত সময় নয়। কচ এখনও খুব দুর্বল। তার তোমাকে প্রয়োজন। যাও তাকে সময়মতো পথ্য দিয়ে সেবা করো।”
আরও একটা বছর কোথা থেকে কেটে গেল। আবার ফুলের ডালি নিয়ে বসন্ত এসেছে। কর্ণিকার, মন্দার, অতসী, অপরাজিতা, গোধূম রূপে, রঙে, রসে বিকশিত হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের মাথায় বরফ গলে জেগে উঠেছে সবুজের ইশারা। নদীর জল কলকল ছলছল শব্দে বনের ভেতর পাথরে তান তুলে বয়ে যাচ্ছে। খুব ভোরে দেবযানী স্নান সেরে নিল নদীর জলে। গা মুছে গাছের নীচে তার কঞ্চুকীটি পরে তাতে একটা রক্তরঙা শিমূল ফুল আটকে নিল। গায়ে দিল ঘননীল নীবীবন্ধনী। তার উর্ধ্ববাসটি ধুম্রবর্ণের। তবে তা খুব সূক্ষ্ম রেশম দিয়ে তৈরি। সেটি যেন তার যৌবনদীপ্ত শরীরকে আরও উন্মোচিত করে তুলল। দেবযানী ভেজা চুলে একটা কবরী বেঁধে নিল খুব আলগা করে। তাতে একটা শ্বেত অগস্তের ফুল দিল। আজ এই অগস্ত পুষ্প দিয়েই ব্যঞ্জন হবে। সঙ্গে মুদ্গ অবলেহ। পাকা দাড়িম্ব আর তীক্ষ্ণ-ঝাল লতার ডাল দিয়ে হরিণের মাংস রান্না করবে। আজ তাদের বাড়িতে ভোজের রান্না হবে। আজ বসন্ত পঞ্চমী। শুভ বিদ্যারম্ভের দিন। এইদিনে অঙ্গনে মঙ্গলারতি হয়। ঘরে শালিত ধানের অন্নপাক হয়।
কচ এখন মাঝে মাঝে বনের ভেতর গরুগুলোকে নিয়ে যায়। অসুরেরা এখন তাকে শুক্রাচার্যের শিষ্য হিসেবে বেশ চিনে নিয়েছে। সুতরাং আর কোনও মৃত্যুভয় নেই। বৃষপর্বাও অসুরদের এই অনভিপ্রেত কাজের জন্য নিজে অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছেন। তিনি তাদের সকলকে বসন্তপঞ্চমীর দিন বিকেলবেলা কচের সুস্থতা উপলক্ষে ভোজের নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
সারাদিন দেবযানীর ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। পিতার সহায়কদেরও খেতে বলা হয়েছে। কচ তাকে রান্নায় সাহায্য করল। মশলা বেটে দিল, মাংস কেটে দিল। চাল ধুয়ে আনলো। দেবযানী বারণ করলেও সে কিছুতেই শোনে না। সন্ধ্যাবেলা তার শরীরে সামান্য জ্বর দেখা দিল। কচের শরীর দুর্বল, সামান্য কাজের ফলেও তার শরীরে ক্লান্তি দেখা দেয়। দেবযানী কচের মাথায় জলপট্টি দিয়ে মাথা মুছিয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। রাজার ডাককে উপেক্ষা করা যাবে না। সুতরাং দেবযানী ও শুক্রাচার্য যাবেন, এটাই ঠিক হল। দেবযানী রাজা বৃষপর্বাকে একবার প্রণাম জানিয়েই ফিরে আসবে ঠিক হল। কারণ কচ খুবই অসুস্থ। সে ফিরেই কচের জন্য রাতের পথ্য রান্না করবে। যাবার আগে দেবযানী কচকে ঘরে থাকতে বলে, খুবই বিষণ্ণ মনে বিদায় নিল।
সবাই বিদায় নিতেই কচ বিছানায় উঠে বসল। তার শরীর এখন অতি রুগ্ন হয়ে গেছে। এই শরীর বেশিদিন রক্ষা করা যাবে না, এটা সে বুঝে গেছে। সার্গ তাকে যে কাজের জন্য পাঠিয়েছে তা সফল হয়নি। সম্ভবত সে বিফল হতেই চলেছে। কচ বিষণ্ণ মনে ধীরে ধীরে শুক্রাচার্যের গবেষণাগারে প্রবেশ করল। গবেষণাগারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসুরটি কচকে কিছু বলল না। কীভাবে মস্তিষ্ক স্থানান্তরিত হয়, তা তাকে জানতেই হবে। একটিবার চোখে দেখলেই তার দক্ষতা চলে আসবে। কী কী উদ্ভিদ এই কাজে ব্যবহার করা হয়, এবং কেনই বা করা হয়, তাও জানতে হবে। কচ শুক্রাচার্যের গবেষণার লিখিত পুঁথিগুলি পাঠ করে তা সাংকেতিক ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ বাইরে দাঁড়ানো অসুরটির শরীরে সংযুক্ত বিশেষ ঘন্টা বেজে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে কচকে ঘিরে ধরল প্রায় দশ বারোজন যন্ত্রমানব। এবার তারা শত্রুর কোনো অবশেষ রাখল না। কচের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিল তারা। সম্পূর্ণ ভস্ম হওয়া পর্যন্ত সকলে অপেক্ষা করল। তারপর সেই ভস্ম একটি আধারে ভরে সুরার সঙ্গে মিশ্রিত করল এবং সেখান থেকে সকলে বৃষপর্বার সভায় চলে গেল।
অনেকদিন পরে ঘরের পরিসীমার বাইরে এসেছে দেবযানী। বৃষপর্বা ও রাজপরিবারের সকলে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করেছেন তাদের। পিতার গর্বে দেবযানীর মন ভরে গেল। মেয়েরা তাকে সকলে অভ্যর্থনা করে অন্দরমহলে নিয়ে গেল। সেখানে তাদের রত্নালঙ্কার দেখে দেবযানী হতবাক হয়ে গেল। রাজকন্যা শর্মিষ্ঠার সঙ্গে আলাপ হল তার। শর্মিষ্ঠা অপরূপ সুন্দরী। তার উপর অসংখ্য মূল্যবান অলঙ্কারে ভূষিতা। দেবযানীর সামান্য হিংসে হল তা দেখে। শর্মিষ্ঠা দেবযানীর গলায় অলঙ্কার নেই দেখে একটা হীরে ও মুক্তো বসানো হার এনে তাকে পরিয়ে দিল। দেবযানী ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে বলল, “এমন অলঙ্কার তোমরা কিনে পরে থাকো। আমার পিতা চাইলে তার গবেষণাগারে এর চেয়েও দুর্লভ রত্ন অগণিত সংখ্যায় তৈরি করতে পারেন।”
দেবযানীর এই উদ্ধতবাক্য শর্মিষ্ঠার ঠিক পছন্দ হল না। তারা দুজনেই দুজনের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হল। তাদের মধ্যে যেন এক দীর্ঘকালীন শত্রুতার সূত্রপাত হল।
এমন সময় একটি বিশ্ববন্দিত সুরা এনেছে বলে অসুরেরা শুক্রাচার্যকে তা পান করাল। স্বভাবে সরল শুক্রদেব তা বিনা দ্বিধায় গ্রহন করলেন। আসলে সেটাই ছিল কচের দেহাবশেষ। একটু রাতের দিকে পালকি বাহকেরা শুক্রাচার্য ও দেবযানীকে বনের ভেতর তাদের আবাসে পৌঁছে দিল। ঘরে তখন কেউ নেই। পাহারাদার অসুরেরা ততক্ষণে পালিয়েছে। কোথাও কচের চিহ্নও নেই। দেবযানী হাহাকার করে উঠল।
শুক্রাচার্য বললেন, “কচের আর মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। তার মৃত্যুকে এবার মেনে নাও দেবযানী।”
দেবযানী হঠাৎ তীব্র গলায় বলল, “না পিতা, তার মৃত্যু আমি কিছুতেই মানতে পারব না। আমি মনে মনে কচকে পতিত্বে বরণ করেছি। যদিও আমার প্রেম কখনোই তার কাছে আমি আজও প্রকাশ করিনি, তবুও আমি তাকে মনে মনে প্রত্যাশা করে এসেছি বিগত বহুবছর ধরে। এ কথা জানলে কচেরও আমাকে গ্রহণে আপত্তি থাকবে না। আমি জানি কচও মনে মনে আমাকে ভালবাসে। সে গুরুকন্যা বলে মুখ ফুটে হয়তো তার প্রেম প্রকাশ করেনি, এও আমি জানি। কচ কোথায়? আপনি গণকযন্ত্রের মাধ্যমে খুঁজে দেখুন। শুনেছি আপনি ওর মস্তিষ্কে থাকা যন্ত্রের সঙ্গে আপনার গণকযন্ত্রটির সংযোগ করেছিলেন।”
“ঠিক বলেছো দেবযানী!” শুক্রাচার্য সেই মুহূর্তে গণক যন্ত্র খুলে কচকে আহ্বান জানালেন।
গণকের পর্দার উপর ফুটে উঠল, কচের বাক্য।
“গুরুদেব! শান্ত হোন। আমার পুনরায় ফিরে আসা আর সম্ভব নয়। আমার দেহ নাশ হয়েছে। নতুন করে কোনওভাবেই তা গড়ে ওঠা সম্ভব নয়।”
“তুমি এখন কোথায়?”
“গুরুদেব অসুরেরা আমার দেহ ছাই করে দিয়েছে। তবে আমার স্মৃতিধারকটি কেবল নষ্ট হয়নি। আপনি ক্ষান্ত হোন। আপনি সেই ভস্ম মিশ্রিত সুরা পানও করেছেন।”
“সর্বনাশ! এখন উপায়?”
“উপায় আর নেই গুরুদেব! আপনি শোকগ্রস্তা দেবী দেবযানীকে শান্ত করুন।”
“উপায় আমি ঠিক বের করব কচ। হয়তো অনেক সময় লাগবে। তবে হাল আমি ছেড়ে দেব না। অসুরেরা বারবার আমার ক্ষতি করছে। এখন আপাতত আমি তোমাকে এই মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন বিদ্যাদান করছি। লিখিত তথ্যগুলো তোমার স্মৃতিধারকে প্রতিস্থাপিত করছি। আপাতত। অসুরদের আর ভরসা কী! হয়তো কয়েকদিন পরে তারা আমারও প্রাণ হরণ করবে!”
শুক্রাচার্য তথ্যগুলি দেওয়ামাত্রই কয়েকজন অসুর কচকে বেঁধে তার সামনে নিয়ে এল।
“এ কী! কচ যে দেখছি জীবিত আছে?”
“গুরুদেব! এরা আমাকে বন্দী করে নিয়ে গেছিল। তারপর আপনার প্রাণনাশের ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়েছে। এরা সবাই ইন্দ্রের নিয়োজিত অসুর। আপনার অসুরদের সরিয়ে গোপনে এরা গবেষণাগারে প্রবেশ করেছিল। ওরা কেবল এই দিনটির জন্যই প্রতীক্ষা করছিল। তবে শঠতা দ্বারা শিক্ষা করা এই বিদ্যা আমি কিছুতেই গ্রহণ করতে চাই না। আপনি আমাকে দেওয়া তথ্যগুলি স্মৃতিআধার থেকে এক্ষুণি মুছে দিন। আমি এখনও সবটা অধীত করিনি।”
“ধন্য কচ! ধন্য তোমার সত্যবাক্য! ধন্য তোমার সংযম। আমি এমনিতেই এই শিক্ষা তোমাকে দান করতাম। তোমার গুণাবলী আমাকে মুগ্ধ করেছে। তুমিই হলে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ছাত্র। এসো! তোমাকে আমি এই পরমজ্ঞান দান করতে চাই, সেই সঙ্গে চিনিয়ে দিই সৃষ্টির আদিগুণ বিশিষ্ট সব ভেষজদেরও।”
শুক্রাচার্যের কাছ থেকে বিদ্যাগ্রহন করে কচ তাঁকে প্রনাম করল। শুক্রাচার্য যেন এতদিনে তার পিতারও অধিক হয়ে উঠেছিলেন। এই প্রণম্য দেবতাকে বারবার প্রণাম করলেও শান্তি হবে না কচের। সে গুরুদেবের পদতলে বসে বলল, “আপনি অশেষ কষ্ট সহ্য করে আমাকে বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। আজ বিদায়বেলায় আপনাকে ছেড়ে আমার দেবলোকও ভাল লাগবে না।”
“আশীর্বাদ করি জীবনে সফলতা পাও। আশা করি দেবলোকে ফিরে গেলে সেখানকার বাতাসে তুমি তোমার শারীরিক এইসব দুর্বলতাটুকু জয় করবে। তবে কখনও এই মন্ত্রের অপব্যবহার কোরো না। সত্যবাদীর জীবন ফিরিয়ে আনতে সর্বদা সাহায্য করবে। আমার কাছে সত্যের চেয়ে মূল্যবান অনন্ত বিশ্বে আর কিছুই নয়।”
কচ দেবযানীর কাছে গেল। এবার তার বিদায়ের পালা। দেবলোক থেকে ইন্দ্রের রথ নিয়ে মাতলি অনেক আগেই রওনা হয়েছে। তাকে ফিরে যেতে হবে। কচের মনে পড়ছে শ্রুতশ্রবার কথা। শ্রুতশ্রবা বহুকাল কচের অপেক্ষায় আছে! ইন্দ্রের অসুরেরা এসে জানিয়ে গেল কচকে, মহাকাশযান পৃত্থীর কাছাকাছি এসে পড়েছে। এবার তাকে ফিরে যেতে হবে দেবলোকে। কচ কিছুক্ষণ দেবযানীর দিকে চেয়ে রইল। দুজনেই চিত্রার্পিত। দুজনেই বাক্যহারা। দেবযানী বলল,
“কচ তাহলে তুমি কি একজন দেবদূত? কী আশ্চর্য! প্রথমদিকে এ কথা আমার একবারও মনে আসেনি। তুমি কি আমার কাছে এবার বিদায় নিতে এসেছো?”
“হ্যাঁ দেবযানী। এবার আমাকে বিদায় দাও। আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা জানানোর সাধ্যও নেই আমার। আমি তোমাকে উৎকন্ঠিত করেছি, কষ্ট দিয়েছি, কাঁদিয়েছি, ব্যথিত করেছি। তোমার সেবা গ্রহণ করে বারবার জীবন ফিরে পেয়েছি। এখন হাসিমুখে বিদায় দাও। সার্গে দেবরাজ দীর্ঘকাল আমার প্রতীক্ষা করছেন।”
“বিদায়! তোমাকে ছাড়া জীবনে বেঁচে থাকার কোনও অর্থই হয় না আমার। আমি প্রথমে তোমাকে বন্ধু হিসেবে এবং পরে তোমাকে দয়িত হিসেবে ভালবেসেছি। এখানে তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়! এই বনের প্রতিটি বৃক্ষে যে তোমার স্পর্শ আছে! এখানে আমি তোমাকে ছাড়া এখন কেমন করে বাস করব কচ?”
“দেবী! আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনেই এখানে এসেছিলাম। এখানে থাকার আমার উপায় নেই। আমার পিতা বৃহস্পতি আমার অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন। তিনি এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, তাঁর আমাকে এখন প্রয়োজন। যেমন তুমি তোমার পিতার পরিচর্যা করো, আমিও ফিরে গিয়ে পিতার সেবা করতে চাই। তুমি মহান ও গুণী নারী, তবে তুমি আমার গুরুদেব কন্যা। সুতরাং তোমার প্রেমপ্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারছি না। শুক্রাচার্য আমার পিতা-সমান, আমি তাঁর হাতেই বারবার জীবনলাভ করেছি। সুতরাং তুমি আমার দয়িতা কিছুতেই হতে পারো না। আমি তোমাকেও শ্রদ্ধা করেছি, তবে কখনোই ভালবাসিনি। হে চারুমুখী! এবার তুমি আমাকে বিদায় দাও!”
“না না না… আমি তোমাকে বিদায় অনুমতি দিলাম না। যদি তবুও তুমি আমার কথা না শুনে আমাকে ছেড়ে জোর করে চলে যাও, আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি…”
“না কল্যাণী! আমাকে শাপ দিও না। মিনতি করছি! আমি নিজের জীবন তুচ্ছ করেছি এই শিক্ষালাভ করতে। আমাকে দয়া করো!”
“আমি তোমাকে অভিশাপ দিলাম, তুমি কখনও এই অধীতবিদ্যা প্রয়োগ করে সফলতা পাবে না।”
“বিনা দোষে এতবড় অভিশাপ দিলে আমাকে? এত কষ্টে শেখা বিদ্যার প্রয়োগে সফলতা পাব না আমি? বেশ। তাই হোক। তবে আমি যাকে শিক্ষা দেব সে অবশ্যই সফল হবে। আমিও তোমাকে বলে গেলাম, তোমার মতো বিলাসী, রুষ্টা ও অহঙ্কারী, মুগ্ধা নারীর কখনো কোনও ব্রাহ্মণ ঋষির সঙ্গে বিবাহ হবে না। তোমাকে ক্ষত্রিয় রাজপরিবারেই মানাবে ভালো। তোমার বিবাহ হবে একজন ক্ষত্রিয় রাজার সঙ্গে। এটা আমার ভবিষ্যতবাণী বলো, বা শাপ বলো যা কিছু বলতে পারো। বিদায় দেবযানী! মর্ত্যলোক থেকে চিরবিদায়।”
হঠাৎ সমস্ত বন আলোকিত হয়ে উঠল। আকাশ থেকে আলোকিত চক্রের মতো নেমে এল মাতলি চালিত রথ। দেবলোকের দূত, দেবদূত কচ তাতে অবতরণ করতেই ঘরঘর শব্দে রথের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। দেবযানী চোখের জলে ভাসতে ভাসতে দেখল কচকে নিয়ে রথ উল্কার বেগে মেঘের রাজ্যে হারিয়ে গেল। দেবদূত কচ দেবলোকে যাত্রা করল।
“বিদায় কচ! সফলকাম হও!”
কচ মাতলিকে প্রতিশুভেচ্ছা জানালো। তারপর বড় বড় পা ফেলে পাহাড়ের বুকের উপত্যকায় ঘন বনের ভেতর অদৃশ্য হল।
এই ঘটনার বেশ কিছু আগেকার ঘটনা। দেবলোক। এটিও সুন্দর একটি সকালের মুহূর্ত। দেবলোকের বাতাস মধুগন্ধবাহী। সম্পূর্ণ অঞ্চলটি কীট ও জীবানুমুক্ত। বড় বড় পাথরের সজ্জিত ক্ষুদ্রাকার আধারে ফুটে আছে দুর্লভ ও সুগন্ধী নানা রংয়ের ফুল। বসন্তের দূত বিকশিত মাধবী ও অশোক ফুটেছে পাশাপাশি দুটি সুনিয়ন্ত্রিত আধারে। অশোকের রক্তিম আভা আর মাধবীর শ্বেত মনোহর শোভা যেন প্রেমের দুই মহান রূপের প্রতীক। সুগন্ধী মাধবী যেন আপনাকে বিলিয়ে দিয়েই সুখী। সে যেন প্রেমে ত্যাগের বার্তাবহ। অপরদিকে গাঢ় রক্তবর্ণ অশোক হৃদয় মথিত করে ভালবাসা উচ্চারণ করে। সে আত্মবিসর্জন দেয়, তবে ভালবাসার অধিকার ছাড়ে না। কচ দুটি আধারের বিকশিত পুষ্পিত লতাদুটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে এমনটাই চিন্তা করল। কচের হাতে এখন অফুরন্ত সময়। নিজেকে জানতে, বুঝতেই তো সে এখানে ছুটে এসেছে। কচ নিজের মনকে যাচাই করতে চায়।
কচ এখন একটি বিখ্যাত চিকিৎসা-কেন্দ্রে এসেছে। এই চিকিৎসা-কেন্দ্রটি খুবই উন্নত পরিকাঠামো বিশিষ্ট। সার্গ প্ল্যানেটের এই লোকে কেবল ব্যাধির চিকিৎসা হয়। পরিচালিত হয় অশ্বিনীকুমারদ্বয় নামক দুজন যমজ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে। তাঁদের অধীনে আছেন শত শত চিকিৎসক, সেবক এবং সেবিকাদের দল। এখানে কায়গত এবং মনোগত দু’রকম চিকিৎসাই করা হয়। এই লোকের নাম ব্যাধিলোক।
কচ সুঠাম, সুন্দর এবং দারুণ মেধাবী একজন যুবক। তবে সে যেন ছোট থেকেই কারো দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত। তার কখনও কোনও ভুল প্রায় হয় না বললেই চলে এবং সে মিথ্যে কথা বলতে পারে না। আশ্চর্য বিষয় হল, সে অনেক চেষ্টা করলেও তার গলা দিয়ে তার অজান্তেই সত্যি কথাগুলো বেরিয়ে আসে। এতদিন তার মনে নিজের কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগেনি। তবে শ্রুতশ্রবার কাছ থেকে অভিশাপ পেয়ে সে নিজেকে নিয়ে হঠাৎ নতুন করে ভাবতে বসেছে। প্ল্যানেট সার্গে সেই বোধহয় একমাত্র তরুণ যার মন কখনও এক পলকের জন্যেও কোনও নারীর প্রতি দুর্বল হয়নি। আজও। কচের বয়স এখন বাইশ। সে তরুণ এবং সুদর্শন।
শরীরের লক্ষণবাহী তন্তু, যেটি বংশ পরম্পরায় পিতা মাতার বৈশিষ্ট্য বহন করে চলে, তাকে দেবলোকে বলা হয় জিন। সেই জিন-তত্ত্ব নিয়ে উচ্চপর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সে। শিক্ষকদের অনেক আশা কচকে নিয়ে। শুধু যে কচের বাবা বৃহস্পতি সার্গের একজন স্বনামধন্য বিরাট বিজ্ঞানী সেজন্য নয়, কচের মধ্যেও আশ্চর্যরকম মেধা ও নিষ্ঠা আছে। তাছাড়া সে শ্রুতিধর। শোনামাত্রই সবকিছু অবিকল মনে রাখতে পারে।
উচ্চপর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীদের পড়া ছাড়াও তাদের যাবতীয় বিনোদন ও আবশ্যকীয় সমস্ত খরচ মেটায় সার্গ। এমনকী তাদের মাসিক মন-মানচিত্রের খরচও তারাই মেটায়। নিন্দুকেরা বলেন, এভাবেই তরুণ-প্রজন্ম কী ভাবছে, সে বিষয়েও ওয়াকিবহাল থাকে এসএআরজি গ্রহের নিয়ন্ত্রাগণ।
কচ অবশ্য কখনও নিজের মনের মানচিত্র করিয়ে গাদা গাদা সময় নষ্ট করে না। বিনা খরচে হলেও সে এইসবে অনাগ্রহী। তার মন তো কোনও নারীতে আগ্রহীই নয়, সুতরাং কী হবে এই মানচিত্র তৈরি করিয়ে নিজের মনের মত মেয়েদের খুঁজে নিয়ে তাদের সঙ্গে চ্যাট করে! তবে শ্রুতশ্রবা নাকি ম্যাপিং করেই কচকে নির্বাচন করেছিল। ওকে নাকি সাজেস্টেড হিসেবে যাকে দেখিয়েছে তার নাম হল, কচ-তারা। এসএআরজি প্ল্যানেট এ মায়ের নাম ও সন্তানের নাম পাশাপাশি থাকে। সুতরাং মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, কচের সঙ্গে তার মা তারার নাম চিরকালের মত জুড়ে গেছে। যদিও বর্তমানে কচের সঙ্গে তার মায়ের কোনও সম্পর্ক নেই। তারা দেবলোক থেকে নির্বাসিত হয়েছে।
কয়েকদিন আগে কচের নিজস্ব গণমাধ্যমে যোগাযোগ করে শ্রুতশ্রবা ওর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। কচ ভদ্রতাবশত ওকে ওর গবেষণাগারে ডেকেছিল। সে রোজই অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে কাজ করে। তার কাজে কোনও ক্লান্তি নেই। সে স্মৃতি নিয়ে একটা অসাধারণ কাজ শুরু করছে। প্রাণীর মৃত্যুর পরেও তার স্মৃতি নিয়ে তার কাজ। স্মৃতি নিয়ে একটা ডেটা ব্যাঙ্ক তৈরি করতে চায় সে গণকযন্ত্রে। রাতের দিকে শ্রুতশ্রবা কচের দরজায় এসে শব্দ করল। দরজা খুলে দিয়ে কচ দেখল, শ্রুতশ্রবা অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে স্বল্পবাস। প্রথম কারো সঙ্গে আলাপের জন্য এমন পোশাক পরে আসাটা বেশ অস্বাভাবিক। সম্ভবত সে নেশাও করেছে। কারণ তার শরীর মৃদু মৃদু দুলছে। কচ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, সে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবে না। হয়তো সে একজন গোপন খবর সরবরাহকারীও হতে পারে। দেবলোকে ও নরলোকে তার পিতার শত্রুর অভাব নেই। তাছাড়া কচ মন-মানচিত্র করায় না। দেবলোকের নিয়ন্ত্রকেরা তার মনের খবর পায় না। সুতরাং এই শ্রুতশ্রবার উদ্দেশ্য শুধু প্রেমজনিত নাও হতে পারে।
শ্রুতশ্রবা কচকে বলল, “কচ আমাকে মানসিক অবক্ষেপণ-যন্ত্র বলেছে, আমিই হলাম তোমার মতো একজন সুন্দর পুরুষকে পাবার জন্য এই দেবলোকের একমাত্র যোগ্যতম নারী। আজ রাতে আমাকে গ্রহণ করো। আমরা দুজন মিলে একজন সার্থক বিজ্ঞানীর জন্ম দিতে পারি, যে হবে এই দেবলোকের ত্রাতা ও ভবিষ্যতের রক্ষাকর্তা! হে সুন্দরের প্রতিভূ! আমি বর্তমানে গর্ভধারণের সঠিক এবং উপযুক্ত সময়ে আছি!”
কথাগুলো কষ্ট করে বলেই সে কচের শরীরের উপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
কচ শ্রুতশ্রবাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে ল্যাবের দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিল।
বাইরে থেকে অশান্ত হয়ে শ্রুতশ্রবা তার দরজায় বারবার শব্দ করতে লাগল। কচ ভেতর থেকে বলল, “দুঃখিত শ্রুতি। তুমি নেশা করে এসেছো, এমনটা ঠিক শোভন নয়। তোমার সাথে আমার এখন নয়, পরে কখনও কথা হবে। এখন তোমার চেতনা নেশার কারণে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাছাড়া আমি তোমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি আমার বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত বলে আমার ধারণা।”
দরজার বাইরে থেকে শ্রুতশ্রবা কচকে অভিশাপ দিয়ে বলল, “তুমি কি অস্বাভাবিক? কেমন পুরুষ তুমি? একজন আবেদনময়ী নারীকে এমন করে ফিরিয়ে দাও! এত অবিশ্বাস কেন তোমার মনে? আমি তোমাকে অভিশাপ দিলাম, তুমি আজীবন নারীসঙ্গ বঞ্চিত হবে।”
ঘরের ভেতর থেকে কচ মৃদু হাসল। তবে সে তবুও দরজা খুলল না। পরদিন সে হাসপাতালে গেল। সত্যিই সে জানতে চায়, সে কি অস্বাভাবিক? কেন কোনও নারীকে দেখলে তার যুক্তিবুদ্ধি, শীল, শোভনতা এতকিছুর কথা মনে পড়ে? কেন সে কখনো নারীদের প্রতি মোহিত হয় না? তাই কয়েকদিন ব্যাধিলোকে থেকে নিজের সম্পূর্ণ পরীক্ষা করাতে চায় কচ।
বাড়িতে তার একমাত্র পরিজন বলতে পিতা বৃহস্পতি আছেন। তার মা তাকে পিতার কাছে ফেলে রেখে চলে গেছেন, চন্দ্রের কাছে। চন্দ্রদেব সার্গের একজন বিখ্যাত বণিক। অসম্ভব সুপুরুষ। বয়স তাঁর শরীরকে ছুঁতে পারেনি। পৃত্থী পর্যন্ত তার বিরাট ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপ্ত। চন্দ্রের অনেকগুলি স্ত্রী বর্তমান। সকলেই থাকেন পৃত্থীতে। কচের মা তারা চন্দ্রের বাকি পরিবারের সঙ্গে থাকে না। সার্গ আর পৃত্থীর মাঝখানে একটা নতুন জায়গায় সদ্য তৈরি হয়েছে চন্দ্রের একটি প্রমোদ ভবন, তারাদেবী এখন সেখানেই থাকে। বৃহস্পতির বহু অনুনয়ের পরেও তারাদেবী বৃহস্পতির কাছে ফিরে আসেনি। তারার সঙ্গে থাকে শিশু বুধ। সে চন্দ্র এবং তারার সন্তান। কচের আর মায়ের মুখটাও মনে পড়ে না। মাকে ফিরে পাবার জন্য বাবার অসীম লড়াই সে বরাবর দেখেছে। হয়তো সে কারণেই সমস্ত নারীজাতির উপর তার মনে এক ধরণের বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়েছে।
তারা চলে যাবার পর বৃহস্পতি আরও নিবিড়ভাবে গবেষণাকে আশ্রয় করেছেন। তিনি দিনরাত গবেষণায় এতই ব্যস্ত থাকেন যে খাবার খেতেও অনেক সময় ভুলে যান। দাসীরা তাঁর খাবার নিয়ে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। বিভিন্ন রকম খাবারের সুগন্ধ পেলে বৃহস্পতির খেতে হবে, এ কথা মনে পড়ে যায়। এই দাসীদের দেবরাজ ইন্দ্র নিজে নিয়োগ করেছেন।
সার্গবাসীদের বলা হয় দেবতা। এই গ্রহের ব্যবস্থাপনা এত অভিনব ও ব্যাপ্ত যে এই গ্রহ ছেড়ে কেউ কখনো নরলোকে যেতে চায় না। একমাত্র বিশেষ শাস্তি স্বরূপ দেবতাদের নরলোকে পাঠানো হয়। অনেক সময় তুচ্ছ নরলোকের জীবদের শিক্ষা দেবার জন্যও কোনও কোনও দেবতা সেখানে গিয়ে জীবদের প্রভাবিত করে থাকেন।
সার্গের বাতাস পরিষ্কার, দূষণের নামগন্ধও নেই। বাতাসে ফুল, চন্দন, ধুনো ও মধুর সুগন্ধ ভেসে আসে দিনের বিভিন্ন সময়ে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই গ্রহ অতিমাত্রায় সচেতন। বাতাস ও জলের শুদ্ধতা নিয়ে বিরাট বিরাট দুটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দল নিয়ে কাজ করছেন, যথাক্রমে পবনদেব ও বরুণদেব। দেববিজ্ঞানী বৃহস্পতির শরীরের সুস্থতা বিশেষভাবে কাম্য এই দেবলোকে। তাঁর সংসার জীবনে পাওয়া আঘাত যাতে তাঁকে ন্যুব্জ না করে দিতে পারে, তাই বৃহস্পতিকে দেখাশোনা করার জন্য নিয়োজিত আছে একটি সেবিকাদের টিম। তারাই সময় মতো নানারকম সুখাদ্য তাঁকে সরবরাহ করে থাকে।
সার্গ আর পৃত্থী গ্রহের প্রতিদ্বন্দ্বীতা এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বৃহস্পতি কিছু যন্ত্রমানব বানিয়েছেন, তবে তা শুক্রের মতো এত কার্যকরী হয়নি। দুর্জনেরা বলেন, বৃহস্পতি নিজের পুত্র কচকে ঠিক একটা যন্ত্রের মতো করেই তৈরি করেছেন! কচ মানুষ হলেও যেন অবিকল একটি যন্ত্র। কারণ যন্ত্রের মতোই কচের ভুল খুবই কম হয় এবং তার স্মৃতিশক্তি অবিস্মরণীয়। বৃহস্পতি এইসব কথা শুনে কেবল হেসেছেন।
কচের খুব ছোটবেলায় বৃহস্পতি তার মস্তিষ্কের গঠনগত একটা অবিশ্বাস্য পরিবর্তন করেছিলেন। নিজের মানসিক টানাপোড়েনের ফলে তার জীবনের অনেকটা সময় দুঃখ যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হয়ে কেটেছে। ফলে গাদাগুচ্ছের সময় নষ্ট হয়েছে। তাই আবেগে অনুত্তেজিত ও শান্ত থাকার জন্য কচের মস্তিষ্কে তিনি একধরণের বাফার বা নিয়ন্ত্রক ইমপ্লান্ট করেছেন। মানব শরীরে স্মৃতি থাকে প্রধানত তিনটি অংশে। নরলোকে তাদের বলা হয় যথাক্রমে হিপোক্যাম্পাস, নিয়োকর্টেক্স এবং অ্যামিগডালা, বেসাল গ্যাংলিয়া এবং সেরিবেলাম। স্মৃতিরও আবার তিনটি ভাগ। যেগুলিকে নরলোকে বলা হয়, এক্সপ্লিসিট মেমোরি, ইমপ্লিসিট এবং ওয়ার্কিং মেমোরি। এক্সপ্লিসিট মেমোরি হল বাহ্যিক পরিবেশের মাধ্যম থেকে যে স্মৃতি সঞ্চিত হয়। ইমপ্লিসিট হল অল্পস্থায়ী স্মৃতি। যা হল অধীত বিদ্যা। এটির জন্য কাজ করে বেসাল গ্যাংলিয়া ও সেরিবেলাম। এখানেই বসানো হয়েছে একটি খুব সূক্ষ্ম যন্ত্র। যা অধীতবিদ্যাকে মনে রাখতে সাহায্য করবে। স্মৃতির ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। সেটা একধরণের ন্যানো কম্পিউটার। যেটি তার স্মৃতিকেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত। আঘাতে বা কোনও কারণে কচের মৃত্যু হলে সেই চুলের মত সূক্ষ্ম কম্পিউটারটি থেকে কচের বুদ্ধিমত্তার সম্পূর্ণ একটি ডেটাবেসও পাওয়া যাবে। সেইমতো কচের মাথায় ছিদ্র করে সেই ন্যানো বা অতি ক্ষুদ্রতম যন্ত্রটিকে তার স্মৃতিকেন্দ্রে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। যন্ত্রটির আরও একটা কাজ হল এটি অতিরিক্ত আবেগকে যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে অগ্রাহ্য করতেও সাহায্য করবে। অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে বলা যায়, কারণ কচ বৃহস্পতির মনমতো আচার আচরণ বিশিষ্ট হয়েছে। বৃহস্পতিও কচকে নিয়ে আনন্দিত।
কচ বর্তমানে তরুণ, সে আবেগে ভেসে কোনও সুন্দরী নারীর প্রতি এখনও আকৃষ্ট হয়নি। প্রতিটা কাজ করার আগে তুল্যমূল্য বিচার করার পর সে তাতে অগ্রবর্তী হয়। সুতরাং তার পরীক্ষা সফল হয়েছে মোটামুটি বলা যায়। কচের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য এছাড়াও একটা আরক দ্রব্য এখনও তাকে পান করানো হয় পানীয় জলের সঙ্গে। কচ পানীয় জলের স্বাদ বলতে এটাই জানে। জন্ম থেকে তাকে জল বলে নানা ঔষধি বৃক্ষের নির্যাস খাওয়ানো হয়েছে। নানা দুর্লভ জড়িবুটি পৃত্থী থেকে তাকে সরবরাহ করেছিল চন্দ্র। সেই সময় থেকেই প্রথম তার গবেষণাগারে চন্দ্রের আসা-যাওয়া শুরু হয়েছিল। কচকে নিয়ে ইচ্ছে মতো পরীক্ষার সেই সবে শুরু হয়েছিল। তারার এতে প্রথম থেকেই আপত্তি ছিল। নিজের সন্তানকে সে কোনও মেধাবর্ধক আরক পান করাতে চায়নি। এই নিয়েই প্রথম বিবাদ শুরু হয়েছিল তাদের। বৃহস্পতির মন জুড়ে এখনও বিরাজ করছে তারার স্মৃতি। তারা বলেছিল, “আমাদের সন্তান স্বাভাবিকভাবেই মেধাবী ও ধীমান হবে। তাকে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠতে দিন, দেব বৃহস্পতি!”
বৃহস্পতি বলেছিলেন, “আমি চাই অতি অসাধারণ মেধাবী হয়ে উঠুক কচ। ও হবে দেবলোকের ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, একজন রত্ন। তুমি হবে রত্নগর্ভা দেবীতারা! তাই আমি ওকে এই আরক পান করাচ্ছি। ওর বিচারবুদ্ধি যাতে কখনও আবেগে বশীভূত না হয়, এমন একটা যন্ত্র তৈরি করতে শুরু করেছি আমি।”
“কী সেই যন্ত্র?”
“সেই যন্ত্র মনের শুভচেতনাকে সর্বদা জাগিয়ে রাখে। বিচারবোধ হারাতে দেয় না।”
“আমার পুত্রকে নিয়ে এমন কোনও অভিনব পরীক্ষা হোক, আমি তা চাই না। আমি ওর জন্মদাত্রী। আমি দেব ইন্দ্রের দরবারে অভিযোগ জানাব।”
“হা হা হা। আমার নতুন এই পরীক্ষার জন্য যাবতীয় অনুমতিপত্র স্বয়ং ইন্দ্রদেবই যে আমাকে পাঠিয়েছেন!”
তারা স্থির দৃষ্টিতে চেয়েছিল বৃহস্পতির দিকে। ইন্দ্রের সমকক্ষ আরও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তিনলোকে এরপর সে জানিয়েছিল তার প্রতিবাদ। বৃহস্পতির এই স্বেচ্ছাচার বন্ধ হোক! একটি প্রতিবেদন লিখে চেষ্টা করেছিল দেবতাদের অভিমত তার দিকে ঘোরানোর। লাভ হয়নি। সব দেবতারাই বৃহস্পতিকেই সমর্থন করেছিল। উপরন্তু তারার কাছ থেকে কচকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। কচ বেড়ে উঠছিল বিশেষভাবে নির্মিত পৃথক একটি গবেষণাগারে। অন্ধক্রোধে সাপিনীর মতো ফনা তুলেছিল তারা। প্রতিশোধ চাই তার। কিন্তু একলা নারী কী করতে পারে শক্তিমান দেবলোকের বুকে?
বৃহস্পতি যখন গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত, তখন তারা একবার চেষ্টা করছিল পালানোর।
কচকে নিয়ে দেবলোক ছেড়ে পালাতে চেয়েছিল তারা।
নীল আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে আছে দিকদিগন্ত ব্যাপ্ত হয়ে। এখানে চির মায়াবী সন্ধ্যা। অপ্সরালোক। সবসময় উজ্জ্বল জোছনার মত আলো থাকে এখানে। সেই কৃত্রিম আলোয় চলে অপূর্ব নৃত্যগীত। ব্যর্থ ও শোকাচ্ছন্ন দেবতারা অপ্সরালোকে এসে দু’দিন কাটিয়ে শোক ভুলে আবার কর্মক্ষম হয়ে ওঠেন। একজায়গায় চলছে রাগসঙ্গীত ও নৃত্য। যেখানে রাগগুলি গীত হচ্ছিল আপনা আপনি প্রস্ফুটিত হচ্ছিল কমলের পাপড়ি। পাহাড়ের গায়ে উন্মুক্ত হচ্ছিল ছোট ছোট জলধারা। কখনও আবার সাজানো দীপগুলি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠছিল। সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের দিক থেকে স্রোতের মতো শব্দে করতালি বাজছিল। অপ্সরা ও কন্দর্পদের দল সুরের ঝর্ণায় যেন অবগাহন করছিলেন। শ্রোতারা সকলেই বিমোহিত, স্তব্ধবাক।
দেবী তারা একটি কারুকার্য করা কাঠের সিংহাসনে বসে নৃত্যগীত পরিবেশনে চোখ রেখেছিল। কিন্তু সেদিকে তার মন নেই। তার দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছিল সে, এত বড় দেবলোকে কি কেউ তার পাশে থাকবে না? সেই সময় চন্দ্রদেব এসে তারার পাশে একটি অপর একটি কাষ্ঠাসনে বসে বলেছিলেন,
“আমাকে সব সময় আপনার পাশে পাবেন দেবী তারা!”
“কী আশ্চর্য আপনি যে অন্তর্যামী!”
“দেবলোকে এই বিদ্যায় কি সকলেই কম বেশি পারদর্শী নয়? তাছাড়া আমি দেব ও মানব মনের উপর বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপর্যায়ের পাঠ নিয়েছি। লোকে বলে থাকে চন্দ্র হল মনের কারক, চন্দ্র কূপিত হলে সে নাকি পাগল হয়ে যায়! দেবী তারা এখানে আপনাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি। আমি আপনার মনোবেদনা বুঝতে পারছি। আপনার দাবী একেবারেই ন্যায়সঙ্গত বলে আমার মনে হয়।”
তারা চোখের জল আটকাতে পারল না। ক্রন্দনরত তারার হাতে হাত রেখেছিলেন চন্দ্রদেব।
“বলুন দেবী আপনি ঠিক কি চান? কচকে চুরী করে মর্ত্যলোকে নিয়ে যাবেন? আমি আপনাকে সহায়তা করব। তবে কচকে নিয়ে যাওয়া শক্ত খানিকটা। সে এখন বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে আছে। তবে আমি কিন্তু আপনাকে সহজেই উদ্ধার করতে পারি। পরে সুযোগ দেখে কচকেও না হয় এনে দেব আপনার কাছে। আমার রথের সঙ্গে বিশেষ একরকম কোষ সূর্যালোক থেকে দিনে ফোটনকণা শোষণ করে সংরক্ষিত করে রাখে। রাতেও তাই সেটি অত্যন্ত দ্রুত চলতে সক্ষম। আমি আপনাকে মর্ত্যে নিয়ে যাব। আমার সূর্যের আলো দিয়ে গড়া পোশাকের নাম হল দ্যুতি। সেই আভাযুক্ত পোশাক পরলে আপনি নিজে স্বয়ংপ্রভ হবেন, কিন্তু আপনাকে কেউ চিনতে পারবে না। বাইরে থেকে আপনার কেবল একটা আলোকমণ্ডিত অবয়ব থাকবে। মর্তে আমি আপনাকে ধার্মিক মানবদের দেশে গিয়ে রেখে আসব। আপনার এতটুকু অযত্ন হবে না। মানবজাতি স্বল্পায়ু ও লোভী। এছাড়া তারা খুব একটা ক্ষতিকর জীব নয়, আমার মনে হয়, তারা কিছুটা ভীরু এবং শান্তিপ্রিয় জাতিও বটে। বৃহস্পতি আপনাকে সেখানে খুঁজে পাবেন না। আরও একটা বিষয় হল, সেখানে একজন অতিদক্ষ বিজ্ঞানী থাকেন। তিনি যদিও একসময় দেবলোকেরই বিজ্ঞানী ছিলেন। তবে বর্তমানে তিনি অসুরদের সহায়তা করছেন। দেবলোক ছেড়ে মর্ত্যলোকেই বসবাস করছেন তিনি। তাঁর নাম শুক্রদেব। আপনাকে আমি তাঁর প্রাসাদে রেখে আসব, যদি প্রয়োজন হয়! কিংবা আপনি চান।”
চন্দ্রের ব্যবহার সুমধুর। তারা মুগ্ধ হয়ে গেল চন্দ্রের কথা শুনে। রূপবান তরুণ চন্দ্রকে বৃদ্ধ ও জেদি বৃহস্পতির চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়তর মনে হল তারার। এক অপূর্ব প্রেম জেগে উঠল তার মনে। চন্দ্রকে হঠাৎ কাছে পেতে ইচ্ছে হল তার। এ কথা মনে আসতেই তারা লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল। অন্তর্যামী চন্দ্রের কাছে তার মন অজানা থাকবে না! সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্র তারার দিকে প্রেমপূর্ণ চোখে চেয়ে বলল, “দেবী আমিও আপনার রূপে ও গুণে মুগ্ধ হয়েছি। এখন প্রবলভাবে মধুর মিলন-প্রত্যাশী। যদি অনুমোদন করেন আজ রাতেই আমার অপূর্ব প্রমোদভবনটি আপনাকে একবার ঘুরিয়ে আনতে পারি। আপনার পাদস্পর্শে আমার ভবনটি সার্থক হবে। একদা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যোগ্য কোনো দেবলোকধন্যা আমাকে যদি কোনওদিন অন্তর থেকে প্রত্যাশা করেন, তাঁকেই করব আমি আমার প্রমোদ ভবনের সঙ্গিনী। এতদিন পর্যন্ত কেউ সেখানে পা রাখেনি।”
তারা অবনত মস্তকে মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। লজ্জার লালিমায় তার মুখটি রাঙা হয়ে উঠেছে। বহুদিন তারা পুরুষসঙ্গ বর্জিত। বৃহস্পতির কেবল জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিয়ে চিন্তা। বিজ্ঞান ছাড়া মানুষটা কিছুই বোঝে না। কচ জন্মলাভের পর থেকে সম্পূর্ণ দুটি বছর কেটে গেছে, বৃহস্পতি এখনও তার কাছে একবারও মিলনেচ্ছা জানায়নি।
চন্দ্রের প্রেমালাপে অনেকদিন পর তারার শরীর চেতনা জেগে উঠেছে। চন্দ্র কি তার প্রতিটি শ্বাসের খবর জানেন? আর চোখ তুলে তাকাতে পারল না তারা। চন্দ্র পরম সমাদরে তার হাতদুটো ধরে চন্দ্রযান প্রভায় তুলে নিল তারাকে। তারপর পালকের মত হালকা বস্ত্র, ‘দ্যুতি’ দিয়ে তারা ও নিজের শরীর ঢেকে দিল চন্দ্র। রথের ভেতর কেবল চন্দ্র আর তারা। দুজনেই চাদরের মত একটিই পাতলাবস্ত্র দ্যুতিতে তাদের শরীর ঢেকেছে। নরম আলোয় ভরে গেছে চারদিক। রথ তীব্র গতিতে ছুটতে শুরু করতেই ভয়ে তারা চোখ বন্ধ করে ফেলল।
চন্দ্র সহাস্যে তারার মুখ চুম্বন করল। তারা থরথর করে কেঁপে উঠল। রথ তীব্র গতি সম্পন্ন। মুহূর্তে লোক লোকান্তর পার হয়ে চলেছে। কোটি কোটি তারা, গ্রহ, উল্কা, ছায়াপথ দূরে সরে যাচ্ছে পলকের মধ্যে। তারা ও চন্দ্র রথের ভেতর পরমসুখে মিলিত হল। চন্দ্রের স্পর্শ কোমল এবং উত্তেজক। এত সুখ লুকিয়ে ছিল শরীরে? এভাবেও শরীর গ্রহন করা যায়! চন্দ্র না জানালে তারা কখনও জানতে পারত না।
মিলনপর্বের শেষে চন্দ্র তারাকে বলল, “আমাদের এই প্রেমপূর্ণ মিলন ব্যর্থ হয়নি। আপনি গর্ভধারণ করেছেন দেবী! অনাগত সন্তানকে আমি আশীর্বাদ করছি। সে জীবনে সফল হোক। তার যেন শুভবুদ্ধি জাগ্রত হয়। বোধ থেকেই হয় বুদ্ধি। তাই আমি ওর নাম দিলাম বুধ। ও যখন আদিত্য অর্থাৎ সূর্যের সঙ্গে কারো জাতচক্রে একত্রে অবস্থান করবে, সে হবে জ্ঞানী এবং জ্ঞানপিপাসু, মেধাবী ও বুদ্ধিমান। বুদ্ধি জাগ্রত করার জন্য ওকে কখনও কোনও আরক পান করতে হবে না, বুধ স্বভাবমেধাবী হবে। আজ থেকে তুমি আমার প্রাণপ্রিয়া হলে। জীবনের কোনও অবস্থায় আমি তোমাকে ত্যাগ করব না। যদি এতে সমস্ত দেবলোক আমার বিপক্ষে চলে যায়, তবুও আমি তোমাকে ও আমার এই সন্তানকে অস্বীকার করব না। এখন থেকে তুমি আমার প্রমোদ ভবনে সসম্মানে থাকবে। আমার কয়েকজন মানবী স্ত্রী আছেন। তবে দেবলোক থেকে তুমিই আমার জীবনে প্রথম। এসো তারা! আমরা আমাদের অভীষ্ট স্থানে চলে এসেছি।”
দেবলোক থেকে কেউ বেরিয়ে গেলে মুহূর্তে সে খবর চলে আসে সেখানকার মূল গণনাকেন্দ্র বা ডেটাবেসে। বৃহস্পতিও জানতে পেরেছেন যে তারা দেবলোক ত্যাগ করেছে। তবে কচকে সঙ্গে নিয়ে যায়নি সে! মা কেমন করে তার সন্তানকে ভুলে থাকতে পারে? বৃহস্পতি গণক যন্ত্রের সামনে বসল। তারাকে চলে যেতে কারা বা কে সাহায্য করতে পারে? মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করে দিল গণকযন্ত্র। চলে যেতে সাহায্যকারীর মধ্যে নাম আছে কচ, বৃহস্পতি, চন্দ্র এবং প্রায় সব দেব দেবতাদের। আশ্চর্য! গণক কি খারাপ হয়ে গেছে? নাকি প্রসেসর ঠিক করে কাজ করছে না? বৃহস্পতি ভাবতে থাকেন। সত্যিই তার মনে অজস্র কথা ভেসে আসে, যা এবার যন্ত্রগণকের মতটাকে সমর্থন করতে থাকে।
তারার সঙ্গে বহুবছর প্রেমপূর্ণ ব্যবহার করা হয়নি। তাদের শরীরী সম্পর্কও হয়নি বহুকাল। তারাকে ছেড়ে সংসার ছেড়ে দিনের পরদিন তিনি পড়ে থেকেছেন গবেষণা নিয়ে। কচকে নিয়ে অযথা জেদ করেছেন। তারার কথায় সামান্য গুরুত্বও দেওয়া হয়নি। মানা হয়নি তার কোনও মতামত। ভুল হয়েছে। সত্যিই বড় ভুল হয়ে গেছে তার। বৃহস্পতি তাড়াতাড়ি রথে উঠে ইন্দ্রলোকের দিকে ছুটলেন। ইন্দ্রকে গুরুতর কিছু কথা বলা দরকার এখনই।
চন্দ্র আলিঙ্গনাবদ্ধ তারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। চন্দ্রের সঙ্গিনীর দেহেও এখন শোভা পাচ্ছে সূক্ষ্ম আলোকময় দ্যুতি-বস্ত্র। তারার মাথায় ফুলের মুকুট, সেই মুকুটে শোভিত একটি উজ্জ্বল তারা। চন্দ্র ভাবতে তাকেন, চন্দ্রের নিজস্ব নারী তারাই তো হবে। চন্দ্র সে তো তারা শোভিতই! তারা একজন অসামান্যা নারী। তার মনে জ্ঞান, বুদ্ধি, ভালবাসা, আবেগ সবই আছে। সে পরমা সুন্দরী। এমন রত্ন পেয়েও অবহেলায় হারালেন দেব বৃহস্পতি। সে একমাত্র তাকে ভরসা করে দেবলোক ত্যাগ করেছে। তবে দেব-বৃহস্পতি ব্যাপারটা সহজে মেনে নেবেন না। তিনি জেদি এবং অহঙ্কারী। গ্রহের কারকতা ফুটে ওঠে মানব মনে। চন্দ্র জানেন বৃহস্পতির প্রভাববিশিষ্ট মানবেরা সাত্ত্বিক, ধার্মিক ইত্যাদি হলেও যেমন অহঙ্কারী হন, বৃহস্পতিও তেমনই উগ্র অহঙ্কারী। নিজের স্ত্রীকে অন্য কেউ হরণ করেছে এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। অনর্থ হয়ে যাবে। প্রমোদ ভবনে একা তারাকে রেখে যাওয়া এখন তাই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তারাকে কোথায় রাখবেন? ভাবতে লাগলেন চন্দ্র। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য? হ্যাঁ একমাত্র ইনিই বৃহস্পতির কোপ থেকে তারাকে রক্ষা করতে পারবেন। সম্প্রতি একমাত্র কন্যা, শিশু দেবযানীকে নিয়ে শুক্রাচার্য বড় বিপদে পড়েছেন। সন্তান জন্মের সময় দেবযানীর মাতার মৃত্যু হয়েছে, তিনি অতি স্বল্পায়ু ছিলেন। অনাথা শিশুটি কেবল তার পিতাকেই চেনে। তাকে ফেলে গবেষণায় মন দিতে পারছেন না শুক্রাচার্য। অতএব এখন যদি দেবী তারা সেখানে যায়, তাহলে তারার আশ্রয় এবং দেবযানীর প্রতিপালন, দুটি কাজই সহজ হয়ে যাবে। তারা হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে চন্দ্রের দিকে তাকাল।
“কী হয়েছে নাথ? আপনি নিদ্রামগ্ন হননি? আপনি কি চিন্তিত? আমাকে নিয়েই চিন্তিত? আমি আপনার চিন্তার কারণ হলাম! হায় হায়!”
“না দেবী! আপনি আমার চিন্তায় আছেন, তবে তা উদ্বেগ জনিত কারণে নয়, বরং তা প্রেম ও মুগ্ধতাবশত সুখস্মৃতি জাগরিত হওয়ায়। আপনি আমার প্রেয়সী, আপনি তাইতো আমার চিন্তায় সর্বদা থাকবেন! আপনার সুন্দর নিদ্রিত মূর্তি দেখে একটু আগেই আমাদের সুমধুর মিলন আমার স্মৃতিপটে জাগরিত হয়েছিল। আমি সর্বদা আপনার প্রণয় প্রত্যাশী!”
তারা লজ্জিত হল। চন্দ্র তাকে শুক্রাচার্যের বিজ্ঞান সাধনার কথা বলতে লাগলেন। চন্দ্রের প্রেম ও বন্ধুত্ব তারার মন থেকে সমস্ত শঙ্কা দূর করে তাকে অপূর্ব শান্তি দিল। তারা দেবলোক হারিয়েও চন্দ্রের ভালবাসায় আনন্দিত থাকল।
দূরে হেমগিরি পর্বতের উপর সোনালি আভায় ভোর হচ্ছে। হেমবর্ণ সেই বরফের রাজ্যে, মৃদু সোনালি আলো বড় মনোরম হয়ে প্রতিভাত হয়েছে। শুক্রাচার্য হোমের জন্য যজ্ঞের কাঠ কাটতে বনে এসেছেন। চন্দন বনে কাঠ কাটতে কাটতেও তিনি গবেষণার কথাই ভাবছেন। এমন সময় চন্দ্র এসে তাঁকে প্রণাম জানালেন। শুক্রাচার্য এবং চন্দ্রের সম্পর্ক বন্ধুত্বের। চন্দ্রকে ছাড়া বিজ্ঞানের কোনও গবেষণা সম্ভব নয়। সে সমস্ত দ্রব্যের সংগ্রাহক এবং সরবরাহকারী। সার্গ এবং পৃত্থী দুদিকেই দরকারী অত্যন্ত আবশ্যক পণ্য নিয়ে ছোটে চন্দ্রের রথ। চন্দ্র সরাসরি কাজের কথায় এলেন। দৈত্যগুরু অযথা দেরি পছন্দ করেন না। শুক্রাচার্য চন্দ্রের কথা শোনামাত্র অনুমোদন জানিয়ে তারাকে আশ্রয় দেবার অঙ্গীকার করলেন।
শুক্রাচার্য মহান বিজ্ঞানী। বর্তমানে মানব মস্তিষ্কের ক্লোন বা প্রতিরূপ তৈরি করে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছেন দেব ও নরলোকে। অসুর নামক একরকম যন্ত্রমানবও তৈরি করেছেন তিনি। তারা দেখতে মানুষের মতো। তবে আসলে তারা হল অতি জটিলযন্ত্র। এমন সুন্দর ভাবে মৌমাছির মোম ও রং দিয়ে তাদের তৈরি করা হয়েছে যে দেখলে দূর থেকে তাদের মানুষ বলেই মনে হয়। এরাই তার রক্ষী। এরা নষ্ট হলে শুক্রাচার্য আবার তৈরি করতে পারেন মোটামুটি কয়েকদিনের মধ্যে। বলা যতটা সহজ এই কাজ করা তেমনই এককথায় অসম্ভব একটি কাজ। এজন্য দরকার হয় অতি দক্ষকর্মী এবং সর্বোপরি শুক্রাচার্যের উপস্থিতি। তাঁর উপস্থিতি ছাড়া কোনও কাজ সফল হয় না।
বৃহস্পতি ইন্দ্রের সভায় অসময়ে উপস্থিত হতেই ইন্দ্র বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করলেন। ইন্দ্র জানতেন তারা চলে গেছেন। বৃহস্পতি যাতে ক্রুদ্ধ না হন, তিনি তাড়াতাড়ি বললেন,
“চিন্তা করবেন না, দেবসেনাপতি! দেবলোক থেকে সব দেবতাদের সহায়তায় তারাকে উদ্ধার করা হবে। চন্দ্র জোর করে তারাকে তার রথে চাপিয়ে নিয়ে গেছে। দেবী তারা অপ্সরালোকে সে সময় কিছুটা নেশাচ্ছন্ন ছিলেন। চন্দ্র তার কথার জাল বিছিয়ে তারাকে প্রলুব্ধ করেছেন। বৃহস্পতি দেবরাজের কথা ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি জানেন তারা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ও বুদ্ধিমতী নারী। তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কি চন্দ্র কখনও জোর করে নিয়ে যেতে পারবে? তাছাড়া চন্দ্রদেবও অতি সজ্জন এবং বুদ্ধিমান। দেবলোকে এমন অনৈতিক কাজ করে কি সে নিজের এমন শত্রুবৃদ্ধি করতে চাইবে?
সেই মুহূর্তে মন্ত্রণাসভার আহ্বান করা হল। ছুটে এলেন দেবতাদের বিশিষ্ট নীতি নির্ধারকগণ। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সকলেই দেরি না করে এখনই চন্দ্রের প্রমোদভবনে যাবেন।
ইন্দ্রের রথ নিয়ে ছুটে এল তাঁর সারথি মাতলি। ঘরঘর ধ্বনি তুলে রথের কক্ষের দরজা উন্মুক্ত হল। দেবতারা সকলে রথের ভেতর প্রবেশ করতেই সশব্দে দরজা বন্ধ হল। অগ্নিসম রক্তিম আলো বিকিরণ করতে করতে সেই রথ উল্কার বেগে ছুটে গেল চন্দ্রের প্রমোদ ভবনের দিকে।
প্রমোদ ভবনের কক্ষগুলি শূন্য। কেবল একটি কক্ষে মৃদু আলোমাখা তার সূক্ষ্ম বেশটি পরে চন্দ্র একা বসেছিল। বৃহস্পতির চন্দ্রের গৃহে নিজের পত্নীর অনুসন্ধানে আসতে সংকোচ হচ্ছিল। তিনি অধোবদনে দরজার কাছে দাঁড়ালেন। দেবরাজ ইন্দ্র কয়েকজন দেবতাদের নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন। চন্দ্র সব দেবতাদের দেখে যথোচিত সম্মান জানিয়ে বললেন,
“দেবরাজ আমিই দেবী তারাকে এখানে এনেছিলাম। তবে বর্তমানে তিনি যেখানে আছেন, তা প্রকাশে আমি অসমর্থ। তারা স্বেচ্ছায় আমার এখানে এসেছেন। আমি তাঁকে জোর করে ধরে আনিনি। এই বিষয়ে তর্ক উপস্থিত হলে, আমি যথাসময়ে তারাকে দেবলোকে উপস্থিত করব। বর্তমানে তারাদেবী অন্তর্বর্তী। তাঁর পরিচর্যার প্রয়োজন হওয়ায়, আমি তাঁকে একটি গোপন জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আপাতত আমার এবং দেবীরও ইচ্ছা নয়, সকলে সে কথা জানুক!”
বৃহস্পতি শিহরিত হলেন। চন্দ্র যে সত্য বলছেন, তা তিনি উপলব্ধি করলেন। তারা মা হতে চলেছে! তাঁর কানে কে যেন ভীষণ উত্তপ্ত গলিত ধাতু ঢেলে দিয়েছে। বৃহস্পতি টলতে টলতে বাইরে যেতে যেতে বললেন, “আমি কেবল তারার মুখ থেকে তার কথা শুনতে চাই। অন্য কারো বাক্য আমার মনে শান্তি আনতে পারবে না। তারা একবার বললেই আমি ফিরে যাব। কোনও বিতর্ক বা অভিযোগ করব না।”
দেবতারা দেখলেন, বৃহস্পতির মুখ রক্তবর্ণ। ভীষণ যন্ত্রণায় তাঁর শরীর কাঁপছে। ইন্দ্র ছুটে এসে বৃহস্পতিকে দু’হাতে ধরে ফেললেন। তারপর সকলে রথে উঠে চলে গেলেন। আগামী নির্ধারিত দিনে দেবলোকে চন্দ্র, তারা ও বৃহস্পতির উপস্থিতিতে আলোচনা সভার আহ্বান করা হল। দেবলোকের জটিল ও স্পর্শকাতর এই বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে মীমাংসা করা হবে।
তারা বসে আছেন ইন্দ্রের সভা অমরাবতীর মাঝখানে মধ্যবর্তিনী হয়ে। লম্বা একবেণীবদ্ধ তারার কেশ। চুলে বেঁধেছে মর্ত্যের সুগন্ধী জাতিপুষ্পের মালা। মাথার উপর একটি উজ্জ্বল হীরকখণ্ড শোভা পাচ্ছে। অনন্ত যৌবনা তারা। এই কয়েক মাসের মধ্যেই তার গর্ভলক্ষণ বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। তারার মুখে একরকম নরম ও কোমল শ্রী ফুটে উঠেছে। এমন মমতাময় রূপ মেয়েরা যখন মা হতে যায়, একমাত্র তখনই দেখা যায়। বৃহস্পতি সতৃষ্ণের মতো তারার দিকে তাকালেন। এই নারীকে বিস্মৃত হওয়া তার পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। দেবরাজ বললেন, “দেবসেনাপতি বৃহস্পতি! আপনি কি গর্ভবতী তারাকে পুনরায় আপনার সংসারে ফিরিয়ে নিতে চান?”
“আমি তারাকে গ্রহন করতে চাই। তবে তারার গর্ভের সন্তানটি আমার নয়। আমরা দীর্ঘ দুই বৎসরাধিক মিলনসুখ বর্জিত। কারণ বিজ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত থাকায়, সময়াভাব। দেবী তারাকে আমি কখনও অন্তর থেকে বর্জন করিনি। তবে তার গর্ভের অবাঞ্ছিত সন্তানটিকে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি সেই সন্তানের দায়িত্ব নিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছি। তারা যখনই চায় আমার সংসারে ফিরে আসতে পারে। আমার সংসার তো তারারই সংসার। বিশেষত তারার শাসনেই আমার সংসারটি এতদিন পরিচালিত হত। আমি ঘরকন্নার বিষয়ে সর্বদাই অনভিজ্ঞ। আজ আমি তারাকে নিতেই এখানে এসেছি, তবে প্রসবের পর তারাকে এই সন্তানটিকে ত্যাগ করতে হবে। তারার প্রতি আমি স্বামীর কর্তব্যে অবহেলা করেছি। তার প্রতি আরও খানিকটা মনোযোগী হওয়াও আমার উচিত ছিল। আমি আমার দোষ স্বীকার করছি, এবং সুন্দরী অভিমানিনী তারার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
ইন্দ্র এবার চন্দ্রের দিকে তাকালেন, “বলুন চন্দ্রদেব! তারাকে নিয়ে আপনার সিদ্ধান্ত কী?”
“আমি দেবী তারাকে গ্রহন করেছি। তিনি আমার দয়িতা। দেবী তারা আমার অহঙ্কার! আমি তাঁকে সমস্ত অবস্থাতেই কাছে চাই। তারার গর্ভের এই সন্তানের পিতা আমি। আমি আমার সন্তানসহ তারাকে আমার পাশে চাইছি। তবে আমি তারা দেবীর ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা করি। এক্ষেত্রে তিনি যা চাইবেন, আমি আমৃত্যু তাতেই সমর্থন জানাব। কখনও কোনও অভিযোগ করব না। তিনি যদি এখন তাঁর পূর্বের সংসারে ফিরে যেতে চান, আমি বাধা দেব না। তারা দেবীর সন্তান বিষয়ে যে কোনও সিদ্ধান্তেও আমি কোনও বাধা দেব না। সন্তানের উপর সর্বথা মায়ের অধিকারকে আমি স্বীকার করি।”
ইন্দ্র তারার দিকে চাইলেন।
“বলুন দেবী! এই পরিস্থিতিতে আপনার সিদ্ধান্ত কী?”
“আমার সিদ্ধান্ত হল চন্দ্র। আমি চন্দ্রদেবকে ভালবাসি। তাকেই পতিত্বে বরণ করেছি। দেব বৃহস্পতি আমার প্রতি অন্যায় করেছেন। আমার সন্তানকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে তিনি পরীক্ষাগারে নিজের গবেষণার কাজে লাগিয়েছেন। আমি কচকেও তাই ত্যাগ করেছি। আমার সুখ ও সম্পদ যা আমি হারিয়েছি, তা আমি আবার অর্জন করেছি। আমি দেব বৃহস্পতিকে ত্যাগ করেছি। তিনি চাইলেও আমি কোনও অবস্থাতেই তাঁর কাছে ফিরে যেতে চাই না। যদি দেবলোক আমার ও চন্দ্রের এই মিলন সমর্থন না করে, আমি দেবলোক চিরকালের জন্য ত্যাগ করতেও প্রস্তুত।”
বৃহস্পতি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। চন্দ্রের মতো করে নারী-হৃদয় জয় করবার শক্তি তাঁর নেই, কখনও হবেও না। ইন্দ্র তারাকে দেবলোক থেকে নির্বাসন দিলেন, স্বেচ্ছাচারিতার অপরাধে। তারা এই শাস্তিতে যেন পুলকিত হয়েছে। সে সগর্বে চন্দ্রের রথ প্রভায় উঠে বসল। তার মুখে চোখে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। পরাজিত বৃহস্পতি ফিরে এলেন ঘরে। একা। তাঁর জন্য এখন পড়ে আছে প্রেমহীন অনন্ত কর্তব্য।
কচ ব্যাধিকেন্দ্রের শয্যায় শুয়ে গণকযন্ত্রের পর্দায় চোখ রাখল। নিজের মস্তিষ্কের ভেতরটা সে দেখতে পাচ্ছে। নরলোকে মাথার কর্টিক্যাল রিজিয়ন যাকে বলা হয়, তাকে এখানে একটা গোল চিহ্নের মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে। বাকি লোবগুলি বিভিন্ন মাপে বোঝানো হয়েছে। শ্বেত অঞ্চল ও ধূসর অঞ্চলদুটিকে রেখাচিত্রের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। তার মাথার ভেতর একটা বাফার মেটিরিয়াল ও একটা খুব সূক্ষ্ম যন্ত্র বসানো আছে। যাতে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীর চিন্তাগুলির একটা ডেটাবেস পাওয়া যায়, তার মৃত্যুর পরে। তাছাড়া যন্ত্রটি তাকে স্মৃতি বৃদ্ধিতেও সাহায্য করছে। যন্ত্রের জন্যই সে কখনো বিচার না করে আবেগে ভাসে না। পিতা তাকে নিয়ে কত গভীর ভাবে চিন্তা করেছেন! কচের বুকের ভেতরটা বৃহস্পতির জন্য আর্দ্র হয়ে উঠল। পিতা তাকে লালন পালন করেছেন, চেয়েছেন সে যাতে ভবিষ্যতে একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হয়ে ওঠে। কচ মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে নিল।
সে ভাবছিল তার মায়ের কথা। মা বুধকে পেয়ে তাকে ভুলে গেছেন। কখনও তিনি দেবলোকে আসেন না। অবশ্য তিনি চাইলেও এখানে আসতে পারবেন না, কারণ তিনি নির্বাসিতা। অথচ চন্দ্রের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হয়নি। অনেকে বলেন এখানকার আইন একপেশে, এ কথাই বোধহয় সত্যি। চন্দ্রদেবেরও নির্বাসন হওয়া উচিত ছিল।
হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসতেই বাড়ির দাসী, ধী ও অনুপ্রিয়া কচকে জানালো পিতা বৃহস্পতি তার সাক্ষাতপ্রার্থী। কচ স্বয়ংচলমান সিঁড়ির উপর দাঁড়াতেই সিঁড়ি চলতে চলতে মাটির তলায় এসে একজায়গায় থামল। বৃহস্পতি গবেষণাগারে মানব কোষ নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। কচ আসতেই তাকে নিয়ে পাশের ঘরে এলেন, “শোনো কচ! দেবরাজ ইন্দ্র একটা বিশেষ কাজের জন্য তোমাকে নির্বাচন করেছেন। তোমাকে মর্তে গিয়ে একটি বিদ্যা শিখে আসতে হবে। তোমার একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল, কয়েকদিন আগে। তুমি সেই পরীক্ষায় সফল। একজন নর্তকী শ্রুতশ্রবাকে পাঠানো হয়েছিল তোমার পরীক্ষা নিতে। আমি গর্বের সঙ্গে বলছি, তুমি সেই পরীক্ষায় শতভাগ সফল। প্রমাণ হয়েছে, নারীর আবেদন তোমাকে বশীভূত করতে পারে না। এর থেকে মহান বিষয় আর কী হতে পারে! তুমি সুন্দর, বিবেকবান, বুদ্ধিমান এবং শিক্ষিত। তোমার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। তুমি সত্যবাদী। আমি তোমাকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। এবার তোমাকে দেবরাজের আদেশ পালন করে দেবলোকে পিতার মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। আর হ্যাঁ, শ্রুতশ্রবার অভিশাপটি কিন্তু সত্য নয়, সে সেদিন কেবল তোমার পরীক্ষা নিয়েছিল।”
কচ বৃহস্পতিকে প্রণাম করল। বৃহস্পতি বললেন, “এই কাজ কীভাবে হবে এবং তোমাকে কেমন আচরণ করতে হবে সবই দেবরাজ তোমাকে বলবেন। আমাদের একবার এখনই অমরাবতীতে দেবরাজ ভবনে যেতে হবে।”
কচের বর্তমান কাজ হল সঙ্গীত এবং নৃত্য শিক্ষা করা। এই কাজে তাকে সাহায্য করতে এসেছে শ্রুতশ্রবা। কচ তাকে দেখে মৃদু হাসল। শ্রুতশ্রবা দেবরাজের অপ্সরালোকের একজন প্রথম স্তরের কর্মী। সে কচকে নমস্কার জানাল। তার পরনে রত্নখচিত নৃত্য পরিবেশনের পোশাক। শ্রুতশ্রবাকে দেখে কচ বলল, “আমি তোমার বন্ধুত্বের প্রত্যাশী। নারীর মন বুঝতে তুমি আমাকে সাহায্য করবে। আমি পিতার মনে দুঃখ দিতে চাই না। যে কাজ তিনি আমাকে বিশ্বাস করে দিচ্ছেন, আমি চাই তাতে সফল হতে।”
শ্রুতশ্রবা নীরবে হেসে মাথা নাড়িয়ে তার কথায় সমর্থন জানালো।
ইন্দ্র তাকে দেবযানীর মনের গঠন দেখিয়েছেন। দেবযানী শুক্রাচার্যের কন্যা। সে নৃত্য, গীত এবং বাদ্য পছন্দ করে। শুক্রাচার্যের একমাত্র দুর্বলতা হল তাঁর কন্যা দেবযানী। তিনি দেবযানীর অনুরোধ ফেরাতে পারেন না। সুতরাং শুক্রাচার্যের কাছ থেকে মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রটি শিখতে হলে তাকে দেবযানীর মন আগে জয় করতে হবে।
ইন্দ্র বলেছেন, “মনে রাখবে, নারীর পছন্দ হল প্রিয়-বচন। তর্ক-বিবাদ তারা অপছন্দ করে। দেবযানীর অনুরোধ তুমি সর্বদা রক্ষা করবে। তাকে কাজে সাহায্য করবে এবং নৃত্য গীত ও বাদ্য সহকারে তার তুষ্টি বিধান করবে। এভাবেই তুমি সর্বদা দেবযানীর মন জয় করার চেষ্টা করবে। এতেই তোমার কার্যসিদ্ধি হবে। তবে সাবধান, পদে পদে সেখানে মৃত্যুর হাতছানি থাকবে। তোমার ন্যায় ও সত্যই তোমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।”
পৃত্থীর বাদ্যযন্ত্রগুলি বাজাতে শিখতে হবে কচকে। দেবরাজের এই সিদ্ধান্ত মেনে কচ এখন অপ্সরালোকের অধিবাসী হয়েছে। একদল অপ্সরা ও গন্ধর্ব তার শিক্ষক। শ্রুতশ্রবা মাঝে মাঝে দূর থেকে কচকে দেখে যায়। তার মুখ কেন যেন ম্লান। কচ নৃত্য শিক্ষার পরে একদিন শ্রুতশ্রবাকে ডেকে পাঠাল। বিনীত হাসি নিয়ে সে উপস্থিত হল কচের সামনে। কচ বলল,
“একটা বিষয় দেখছি, তুমি যেন আমার এই নৃত্য গীত শিক্ষার অগ্রগতিতে খুশি নও। কেন?”
শ্রুতশ্রবা নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে তার চোখের কোন থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। কচ অবাক হয়ে গেল। তার মনে হল শ্রুতশ্রবা বোধহয় তাকে ভালবাসে। সে মনে মনে বলল, “মাধবী!” শ্রুতশ্রবা যেন প্রেমের ত্যাগের প্রতীক!
ধরা গলায় শ্রুতশ্রবা বলল, “কচ তুমি কি তোমার কাজের বিপদ কতখানি বুঝতে পারছো না? নাকি বুঝেও স্বীকার করতে চাও না?”
“বিপদ তো আছেই শ্রুতি। বিপদ আছে বলে কি কাজ করবো না? নাকি বিপদের ভয়ে পিছিয়ে ঘরে ফিরে যাব?”
“পৃত্থীতে তোমার বিপদ পদে পদে। দেবলোকের অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হলেই তোমার অবধারিত মৃত্যু। অথচ তুমি মিথ্যেও বলতে পারো না! তোমার জন্য আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।”
“চিন্তা কোরো না। তোমার এই দুশ্চিন্তা দেখে আমার মনে হচ্ছে, তোমার মনে আমার জন্য বিশেষ কিছু অনুভূতি আছে। আর তা জেনে আমার এখন বেশ আনন্দ হচ্ছে।”
“আহ্! এই ধরণের কথা বলে বুঝি তুমি নারীর মন জয় করবে? হায় হায় কথা বলার পদ্ধতিকে খানিকটা জটিল করতে হয় কচ! এখন তোমাকে প্রেমালাপ আমি কেমন করে শেখাব?”
“চিন্তা করো না শ্রুতি! আমি পৃত্থী ও সার্গের যাবতীয় সাহিত্য অধ্যয়ন করে এই সম্বন্ধে বিশিষ্টতা লাভ করব। অধ্যয়নে আমার কোনো ক্লান্তি নেই।”
শ্রুতশ্রবা কলকন্ঠে হেসে উঠল।
“বেশ। অধ্যয়ন করে জ্ঞান আহরণ করে নাও, কাল এসে তোমার কাছ থেকে না হয় খানিক প্রেমালাপ শুনব। কেমন শিক্ষালাভ করেছো তার পরীক্ষা হবে!”
কচ সার্গ এ পরবর্তী তিনবছর ধরে নৃত্য, গীত ও বাদ্য শিক্ষা করল। শরীরের যত্ন নিল। তার মাথায় এখন বেশ দীর্ঘ কুঞ্চিত কেশরাশি। সে মর্ত্যের মানবদের মতো করে কেশশয্যা করাও শিখেছে। শিখেছে যজ্ঞ ও হোম, গাভীদের পরিচর্যা, গৃহকর্ম ইত্যাদি। সেইসঙ্গে গোপনতথ্য সংগ্রহ করতে গুপ্তলিপিতে দ্রুত মনে রাখার পদ্ধতিরও চর্চা করেছে।
অবশেষে এক শুভদিনে মৃগশিরা নক্ষত্রে কচ নরলোক পৃত্থীতে যাত্রা করল।
যাবার আগে কচ শ্রুতশ্রবার সঙ্গে দেখা করতে গেল। শ্রুতশ্রবা কখনও তাকে প্রেমপ্রস্তাব দেয়নি বটে, তবে এই কয়েকটি বছরে শ্রুতশ্রবাকে ভালবেসে ফেলেছে কচ। তার ভালবাসা যুক্তিবুদ্ধিহীন মোহমুগ্ধ নয়। সে ধীরে ধীরে শ্রুতশ্রবাকে ভালোবেসেছে। তবে কখনও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি, বা নিজের মনের কথাও তাকে কখনও জানায়নি কচ। কারণ সে জানে তার ফিরে আসা অনিশ্চিত। হয়তো এই যাত্রায় সে সফলতা পাবে না। তবে সে প্রবল চেষ্টা করবে। চালাকি দিয়ে নয়, সততা দিয়ে সে নিজের পথ সুগম করবে। করে নেবেই। এ তার দৃঢ় প্রত্যয়।
“শ্রুতি, আমার যাবার সময় হয়ে এল। আগামী কালই যাত্রা করছি। জানো তো?”
“শুনেছি।”
ম্লান মুখে শ্রুতশ্রবা বলল।
“যদি সফলতা পাই, ফিরে আসব। নাহলে নয়। এই আমার সংকল্প।”
“তুমি সফল হবে কচ। তোমার মধ্যে কোনো মিথ্যে নেই। তোমার সততাই তোমাকে জয়ের মুকুট পরিয়ে দেবে একদিন। তুমি দেখো!”
“সফল হয়ে ফিরে এসে যদি তোমাকে চাই, তখন পাশে পাবো কি?”
“আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”
শ্রুতশ্রবার কথায় কচে বুকের ভেতর সহস্র পদ্ম যেন ফুটে উঠল। সে আনন্দে দু’চোখ বন্ধ করল। শ্রুতশ্রবাকে এই প্রথম সে নিজের বুকের মধ্যে মনের গহীনে জড়িয়ে নিল। পরম নির্ভরতায়, ভালবাসায়।
মনে মনে বলল, “মাধবী! আশা রাখি আমাদের ঠিক দেখা হবে, আমার অনিশ্চিত যাত্রার পরে।”
মহাকাশযান যাত্রা করেছে পৃত্থীর দিকে। কত সহস্রদিন ধরে ছুটে চলেছে সেই যান। যানের ভেতরে কোনো গতির অনুভূতি থাকে না। সেখানে দিনরাতের হিসেবও থাকে না। সময় সেখানে থমকে থাকে। কচ সঙ্গে এনেছে বিভিন্ন পুঁথিপত্র। আয়ুর্বেদপাঠ, ঔষধি গাছের বিবরণ এইসব তাকে জানতে হবে। পৃত্থীর আবহাওয়া, সেখানকার গাছপালার জ্ঞানও তার দরকার। যানের স্বচ্ছ দেওয়ালের ভেতর দিয়ে গ্রহ তারা নক্ষত্র চোখে পড়ছে কচের। যাত্রাপথের এক জায়গায় আকাশের বুকে চন্দ্রের প্রমোদ-ভবনের দিকে চোখ পড়ে গেল কচের। এখানে তার মা আর ভাই থাকে। আজ আর তার মনে মায়ের প্রতি কোনো বিতৃষ্ণা নেই। সে আজ জীবনে প্রথম একটা বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজ করতে চলেছে। কচ তার মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালো।
হেমগিরি পর্বতের চূড়ায় এসে দেবলোকের রথ থেকে নীচে অবতরণ করে রথটিকে ফিরে যেতে বলল কচ। সে নরলোকের উপযুক্ত সাজ পোশাক পরেছে এখন। দীর্ঘাকৃতি সৌম্য দর্শন এক ব্রাহ্মণ বিদ্যার্থীর মতো লাগছে তাকে। সে বনের ভেতর নিভৃতে যেখানে শুক্রাচার্য তাঁর গবেষণাগার গড়ে তুলেছেন সেখানে গেল। শুক্রাচার্য বাড়িতে নেই। তাঁর কন্যা দেবযানী তাদের কাঠের বাড়িটির সামনের উঠোনে বসে পুজোর জন্য তোলা ফুল দিয়ে মালা গাঁথছিল। কচ তাকে নমস্কার জানিয়ে দূরে অপ্রতিভ মুখে দাঁড়িয়ে রইল।
সকাল থেকেই আজ দেবযানীর বাঁ চোখের পাতা কাঁপছে। এই অরণ্যে কে আসবে? নতুন কোনও অতিথি? তার কোনও প্রেমাস্পদ? তবে কি আজ কোনো তরুণ বিদ্যার্থী আসবেন পিতার কাছে শিক্ষালাভ করতে? শুক্রাচার্যের কাছে এর আগেও মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীরা এসেছে। তবে পিতা পরীক্ষা না করে কাউকে বিদ্যার্থী হিসেবে গ্রহণ করেন না। দেবযানী কচের রূপে প্রথমেই মুগ্ধ হয়েছিল। তার বিনীত ব্যবহার তার আরও ভাল লাগল। সে কচকে বসতে দিয়ে ভেতরে গেল জল আনতে। কচ নামটি কয়েকবার মনে মনে উচ্চারণ করল দেবযানী।
কচ ফুলগুলি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তিনটি গোড়ের মালা গেঁথে ফেলল। গাঢ় লাল কুঞ্জলতার ফুল দিল সে শ্বেতশুভ্র মালতী ফুলের মালার মাঝখানে। দেবযানী একটু পরে কচের জন্য একটা থালায় অনেক রকম ফল কেটে আনল, সঙ্গে একটা মাটির ঘটে এনে দিল খাবার জল। কচের মালাগাঁথা দেখে দেবযানী হতবাক। এত সুন্দর মালা সে আগে দেখেইনি।
“চমৎকার! তুমি কোথা থেকে এসেছো? পিতা এখন গেছেন অসুররাজ বৃষপর্বার কাছে। পিতার গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র দরকার। তিনি এখনই ফিরে আসবেন। ততক্ষণ তুমি স্নান করে এসো কচ!”
কচ দেবযানীর কথায় আশ্বাস পেয়ে সামনে বয়ে চলা হেমকণা নদীর জলে ডুব দিয়ে স্নান সেরে নিল।
শুক্রাচার্য এলে কচ তাঁকে প্রণাম করে বলল, “দেব! আমি দেবলোকের অধিবাসী, কচ-তারা। আপনার কাছে থেকে বিদ্যার্জন করতে চাই। আমার পিতা হলেন দেবসেনাপতি বৃহস্পতি। আমার মাতা তারাদেবী। আপনার বিজ্ঞান সাধনার কথা সুদূর দেবলোকেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ। আপনি মৃত জীবের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারেন।”
“দেখো কচ! আমি প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারি এটা ঠিক, কিন্তু আমার ছাত্র হলেও আমি কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বা পদ্ধতি কাউকে শিক্ষা করাই না। এটাই আমার নীতি। যদি এতে সম্মত থাকো এখানে থেকে শিক্ষা করতে হবে। আমিই একমাত্র জানলাম তুমি দেবলোকবাসী। তবে সাবধান! আমার কন্যা দেবযানীও যেন কখনও না জানে তুমি দেবলোকের অধিবাসী। জানলে সে তোমাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করবে, আর অসুরেরা জানতে পারলে তারা তোমাকে অবশ্যই হত্যা করবে। আমি তোমাকে শিক্ষা দেব, কারণ তুমি সত্যবাদী। আমার কাছে তুমি কোনও ছলনা করোনি।”
“আমি সম্মত গুরুদেব! আপনি যেমন বলবেন তেমনই হবে।”
এরপর কচের শিক্ষা শুরু হল। সকাল থেকে ধ্যান, জপ শেষ করে সে দেবযানীকে কাজে সাহায্য করে। জল আনে, কাঠ কাটে। বাসস্থানের পালিত গরুদের সেবাযত্ন করে। বিকেলে গরুগুলোকে গোয়ালে ফিরিয়ে আনে। তারপর বেদ, বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ ইত্যাদি নানা বিষয় শুক্রাচার্যের কাছে শিক্ষা করে। সূর্যাস্তের পর দেবযানী পাকশালায় কাঠকুটো জ্বেলে রান্না করে। খাবার বলতে মূলত যব। কখনও চাল, বা ঘাসের দানা দুধে ফুটিয়ে মধু মিশিয়ে খাওয়া হয়। বনের ফলমূল ও কন্দও খাওয়া হয়। উষণ, বারাহী, ক্ষুদ্রক, ক্ষীরিকা এমন বহুরকমের কন্দ বা মূল পাওয়া যায় বনে, আর ফলের তো কোনও সীমা পরিসীমা নেই। প্রতিটি ঋতুতে আছে সেই ঋতুর বিশেষ ফল।
বিভিন্ন তিথিতে উপোস করে দেবযানী। কচ তা মনে রেখে সেদিন বন থেকে অনেকরকম ফল এনে রাখে। সেদিন সে রান্নার দায়িত্বও নেয়। রাত বাড়লে শুক্রাচার্য তাকে নির্মেঘ আকাশ দেখিয়ে তারা চিনিয়ে দেন। কচ তার পিতার সঙ্গও এত গভীরভাবে আগে কখনও পায়নি। দেবলোকে সন্তান তার মাতা পিতার এত নিবিড় সাহচর্য পায় না। নরলোকের সর্বত্র মায়ার বড় টান। কচ কিছুদিনের মধ্যেই নির্লোভ, নিরাসক্ত ও সত্যদ্রষ্টা শুক্রাচার্যকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলল।
এক একদিন বনের ভেতর ফুল তুলতে গিয়ে দেবযানী উঁচু ডালের নাগাল পায় না। কোথা থেকে ছুটে আসে কচ। সে এসেই উঁচু ডালগুলিকে নত করে দেয়। কখনও সে গাছে উঠে ফুল পেড়ে আনে। বনের ভেতর চলতে চলতে উদার গলায় গান করে কচ। গানের সময় সে তার দু’চোখ বন্ধ করে রাখে, ভাগ্যিস! নাহলে দেবযানীর মুগ্ধ দৃষ্টি তার চোখে পড়ে যেত। এভাবেই কয়েক বছর কেটে গেল। দেবযানী রান্না করতে বসলে কচ শূন্য কলসী বাজিয়ে গান করে। সে এত সুন্দর তালবাদ্য বাজাতে পারে! দেবযানী ক্রমশ মুগ্ধ হয়ে পড়ছে কচের প্রতি। এই যুবকটি যেন সবার থেকে আলাদা। যেমন সে সুন্দর, তেমনই ভদ্র, শোভন। তেমনই মনোহর তার আচার আচরণ। দেবযানী ঘুমালেও কচের স্বপ্ন দেখে। সে রোজ রাতে কচের নিবিড় আলিঙ্গন উপভোগ করে। সে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে কচকে। তারপর ঘুম ভেঙে সে ভাবে হায় কেন ঘুম ভেঙে গেল? স্বপ্ন কেন বাস্তব হয় না! এমন কেন হয় না? তবে গুরুকন্যা হওয়ার জন্য সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কচকে কিছু বলতে পারে না। তার মুগ্ধতা তাকে গোপনে সিক্ত করে, কেবলই আপ্লুত করে চলে।
একদিন বনের ভেতর দেবযানী বিপদে পড়ে গেল। ফুল তুলতে গিয়ে একটা কাঁটা ডালে তার কাপড় এমন জড়িয়ে গেল কিছুতেই সে ছাড়াতে পারল না। শেষে কাপড়খানা ফালাফালা হয়ে ছিঁড়ে গেল তার। যদিও কাপড় ছিঁড়ে যেতে দেবযানীর মনে একরকম উল্লাস হল। সে আশা করল কচ যেন তার সামনে এই মুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়! আজ সে তার মনের কথা কচকে বলবে। তার বিকশিত-যৌবন শরীর দেখে কচ আজ কিছুতেই ঋষিসুলভ উদাসীনতায় তাকে অবজ্ঞা করতে পারবে না! এই মস্ত উঁচু ডালের উপর কর্ণিকারের হলুদ ফুল ঝরণার মত ছড়িয়ে আছে। কর্ণিকার ফুলের দুল পরে কচকে চমকে দেবে ভেবেছিল দেবযানী। এখন ফুল তো পেলই না উপরন্তু প্রিয় শাড়িটাও ছিঁড়ে গেল। শাড়ির গায়ে শিয়ালকাঁটার পাতা আর ডাল লেগে গেছে ছাড়াতে গিয়ে হাতও রক্তাক্ত হয়ে গেল দেবযানীর। অজান্তেই দেবযানীর গলা দিয়ে বেরিয়ে গেল, “বাঁচাও কচ! কোথায় আছো, আমাকে বাঁচাও!”
কচ দূর থেকে দেবযানীর গলা পেয়ে ছুটে এল। তাড়াতাড়ি তার সাদা নরম রেশমের উর্ধ্ববাসটা দেবযানীকে দিয়ে দেবযানীকে কাঁটা থেকে উদ্ধার করতে দুহাতে কোলে তুলে নিল। বলশালী কচের হাতে দেবযানী যেন পক্ষিশাবকের মত আশ্রয় নিল। তারপর দেবযানীকে নিয়েই তরতর করে কর্ণিকার বৃক্ষের উপর উঠে পড়ল কচ। সে বুঝতে পেরেছে দেবযানী ফুল নিতেই অন্যমনস্ক হয়ে ওই কাঁটার বনে ঢুকেছিল।
“এবার আপনি পুষ্পচয়ন করুন দেবী! যত ইচ্ছে ফুল সংগ্রহ করে নিন।”
দেবযানী খিলখিল করে হাসল। কচ মনে মনে বলল,
“মুগ্ধা মর্ত্যের নারী! দু’দিন একটু হেসে নাও। আমার কার্যসিদ্ধি হয়ে গেলে আমার চিহ্নও আর কোথাও তুমি পাবে না।”
কচ চোখ বন্ধ করে একবার শ্রুতশ্রবার মুখটা মনে করলো। তার বুকের ভেতর তীব্র একরকম যন্ত্রণা হল।
কচ বুঝতে পেরেছে, দেবযানী তার বশবর্তী হয়েছে। সে এবার একটু রঙ্গ করল, তবে অবশ্যই শোভনীয়তা বজায় রেখে। কচ দেবযানীকে একহাতে তুলে ধরে গাছের ডালে বসল, অন্যহাতে কর্ণিকার ফুল তুলে এনে দেবযানীর সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দিতে লাগল। বাসন্তী হলুদ ফুলের বৃষ্টিতে দেবযানীর সেই শ্বেতরেশম বস্ত্রখানি ভরে গেল। দেবযানী চোখ মেলে চাইল, দেখল কচের মুখে স্মিত হাসি। গৌরবর্ণ উন্মুক্ত পেশীবহুল শরীর তার! তার শরীরে উর্ধবাস নেই। সেখানা সে দেবযানীকে দিয়েছে। দেবযানীর বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন শিরশির করে উঠল। সে হঠাৎ আরক্ত মুখে বলল, “কচ এবার আমাকে ছেড়ে দাও, আমার ভয় করছে!”
কচ একটা বসন্ত রাগের গান গাইতে গাইতে গাছ থেকে নেমে এল। দূরে দুটো চিতল হরিণ গাছের নীচে সঙ্গমরত। সেদিকে একবার তাকিয়ে দেবযানী আরও আরক্ত হয়ে দ্রুত আশ্রমের দিকে ছুটে গেল। কচ বুঝল, দেবযানী তার মিলন প্রত্যাশী। কচের মুখ বিকৃত হল। মনে মনে সে বলল, “এই মিলন অসম্ভব দেবী দেবযানী! আমি একজনের প্রতি আগেই আমার চিত্তটিকে অর্পণ করেছি। তাকে কিছুতেই আমি প্রবঞ্চনা করতে পারব না।!”
বৃষপর্বার নিযুক্ত অসুরেরা এই হেমগিরি বনটি সর্বক্ষণ পাহারা দেয়। যাতে দেবলোকের কেউ এই বনে কখনও পা রাখতে না পারে। একদিন অসুরেরা কচকে দেখতে পেল। কচ গরুদের নদীর কাছে ছাড়তে এসেছিল। বর্ষার জল পেয়ে নদীর ধারে সবুজ ঘাস হয়েছে। অসুরেরা কচকে জিজ্ঞাসা করল,
“তুমি কে? এখানে কোথা থেকে এসেছো?”
কচ মিথ্যা বলতে পারে না। সে প্রথমে উত্তর দিল না। তবে অসুরদের বার বার প্রশ্নের উত্তরে এক সময় সে বলে ফেলল, “আমি দেবলোকবাসী কচ।”
অসুরেরা আবার জিজ্ঞাসা করল, “কে তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন?”
সত্যবাক্যে অটল কচ বলল, “দেবরাজ ইন্দ্র।”
সঙ্গে সঙ্গে আর কোথায় যায়! অসুরেরা ভয়ানক ক্রোধে তরবারি দিয়ে তক্ষুণি কচের শরীর তিন টুকরো করে কেটে দিল। অসুররূপী যন্ত্রমানবদের এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে। তারা দেবলোকবাসী দেখলেই হত্যা করবে। কচের মৃত্যু হয়েছে তখনও কেউ জানে না। সন্ধ্যা হয়ে গেলে গরুর দল হাম্বা হাম্বা রব তুলে গোয়ালে ফিরে এল। কিন্তু কচ তবুও ফিরে এল না। দেবযানী ভয়ানক চিন্তায় ছটফট করতে লাগল। দূরের গ্রাম থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ফিরে এলেন শুক্রাচার্য। দেবযানী তখন বসে বসে কাঁদছিল। শুক্রদেব বললেন,
“কী হয়েছে মা? কেউ বুঝি তোমার মনে ব্যথা দিয়েছে?”
“পিতা কচের মনে হয় কোনও ভয়ানক বিপদ হয়েছে। সেই দুঃখেই আমি কাঁদছি। সে বড় শান্ত। অসুরেরা নিশ্চয় তার কোনও ক্ষতি করেছে।”
“চিন্তা কোরো না। আমি দেখছি।”
শুক্রাচার্য কয়েকজন অসুরদের সঙ্গে নিয়ে সেই মুহূর্তে বনের ভেতর গেলেন। দেবলোকের দেহ হওয়ায় বনের পশুপাখিরা কচের দেহের কোনো ক্ষতি করেনি। অসুরেরাই দেখিয়ে দিল কচের মৃতদেহ কোথায় পড়ে আছে। শুক্রাচার্য অসুরদের দিয়ে কচের দেহটি বহন করিয়ে দ্রুত ফিরে এলেন। মৃত কচকে দেখেই দেবযানী আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে গেল।
কচের মস্তিষ্ক এখনও জীবিত আছে। সুতরাং ভয় নেই। একজন সুঠাম যুবকের শরীর সংগ্রহ করা হল, যার সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে। এবার মস্তিষ্ক স্থানান্তর করতে হবে। পাঁচটি বিশেষ উদ্ভিদ প্রয়োজন। সুষুম্না নাড়ির উপর যে পাঁচটি চক্র আছে পর পর যেমন মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধাক্ষ এবং এদের উপরে কূটস্থ, যা মানবদেহে দুই ভুরুর মাঝখানে থাকে। এই পাঁচটি চক্র পর পর প্রকৃতির পাঁচটি তত্ত্বকে চিহ্নিত করে। যেমন ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম। অর্থাৎ মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ বা শূন্যতত্ত্বের প্রতীক। এবার নামধারী উদ্ভিদগুলি হল অর্ক, বরুণ, ভৃঙ্গরাজ, ঘৃতকুমারী, নির্গুণ্ডি। এছাড়া সহায়ক উদ্ভিদ দরকার হয় যেমন হরিদ্রা, নিম্ব, ত্রিফলা ইত্যাদি। এরা জীবানু নাশক। ওষুধ প্রস্তুত করাই ছিল। পাঁচটি ভেষজ বৃক্ষকে প্রণাম করে তাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হল। বৃক্ষের মঙ্গলকারী শক্তি অনিবার্য। এবার রক্তবাহী ধমনীগুলিকে যুক্ত করে পাঁচটি ঔষধি গাছের নির্যাস দিয়ে বন্ধন দেওয়া হল। নাসাপান করানো হল রক্তচন্দনের ক্বাথ। ঘরের বাইরে আগুন রাখা হল লোহার পাত্রে। যে ঘরে ঢুকবে হাত পা গরম করে তবেই ঢুকবে। নিশিন্দার শেকড় হল কোষের পুনরায় উৎপত্তির কারক। এটি একটি অসামান্য রসায়নও। যা দেহে নতুন কোষ তৈরি করতে পারে। এটি আকাশ তত্ত্বের প্রতীক এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ। নিশিন্দা এবং ভৃঙ্গরাজ এইদুটিই মস্তিষ্ককে রক্ষা করবে। নাশারন্ধ্র দিয়ে সূক্ষ্মাকারে নীল নিশিন্দা ও ভৃঙ্গরাজের রস চালনা করা হল ঘন্টায় পাঁচ ফোঁটা এই হিসেবে। সাতদিন সাতরাত্রি শুক্রাচার্য জেগে বসে রইলেন কচের পাশে।
দেবযানী পাগলের মতো হয়ে গেছে। খাওয়া, ঘুম ইত্যাদি আবশ্যকীয় কোনো কাজও সে করতে পারছে না। কচ কবে তার এমন করে সর্বস্ব দখল করে বসেছে তা দেবযানী জানতেও পারেনি। সারাদিন সে প্রার্থনা করেছে আর কেঁদেছে। পিতাও কয়েকদিন ধরে খাননি। দেবযানীর সে কথা মনেও নেই। শুক্রাচার্যও যেন ধ্যানমগ্ন। কচের শরীর পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যার দেহে কচ প্রতিস্থাপিত হয়েছে, তার গায়ের রং কচের মত অতটা উজ্জ্বল নয়। অবশ্য দরকারও নেই, দেবযানীর। কচ শুধুমাত্র জীবিত থাকুক। সে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করলেও সে অন্তত প্রাণে বেঁচে থাকুক!
অবশেষে চোখ মেলে চাইল কচ। সফল হয়েছেন শুক্রাচার্য। কচ তার স্মৃতি ও মেধা ফিরে পেয়েছে। এই কয়েকদিনে শুক্রাচার্য কচের মস্তিষ্কের মানচিত্র তৈরি করেছেন। এবার থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে কচকে। বললেন শুক্রাচার্য।
একবছর বেশ নিশ্চিন্তে কাটল। এই সময় কচ খুব একটা একা বাইরে যায়নি। সে বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। দেবযানী পাগলের মত সেবা করেছে তার। কচও দুর্বল শরীরে দেবযানীকেই যেন অবলম্বন করেছে। ধীরে ধীরে উঠে বসল কচ। শুক্রাচার্য একদিন তাকে ডেকে একটা জিনিস দেখালেন। বললেন, “কচ আমি একটা কাজ করেছি। তোমার ক্ষতি হলেও যাতে তোমার অধীত বিদ্যার ক্ষতি না হয়, তাই আমার বিরাট গণক যন্ত্রের সঙ্গে তোমার মস্তিষ্কের ভেতরে থাকা সূক্ষ্ম বিশেষ যন্ত্রটির সংযুক্তি সাধন করেছি। এবার তুমি ধ্বংস হলেও এই যন্ত্রের সাহায্যে তোমার খোঁজ পাওয়া যাবে। এই যন্ত্র কোনওভাবেই ধ্বংস হবে না, এমনভাবেই তৈরি। মানবদেহের জিনবাহক তন্তুও যেমন আগুনে পুড়েও ধ্বংস হয় না, খানিকটা তেমনই এটা। কচ দেখল গণকযন্ত্রের সাহায্যে তার সম্পর্কে প্রশ্নের সব উত্তর পাওয়া যাচ্ছে, সে কোনও কিছু উত্তর না দিলেও। যে উত্তরগুলো আসছে তা কোনোভাবেই কচ ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কারণ প্রশ্নগুলোও অন্যরকম। এবার সে চাপমুক্ত। অন্তত তার মৃত্যুর পর দেবলোক জানতে পারবে, সে অগ্রবর্তী হতে কী কী চেষ্টা করেছিল।
তার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন বিষয়ে কোনো স্মৃতি নেই। তবে এই বিশেষ বিষয়টা শিক্ষা করতেই সে এখানে এসেছে। তবে কিছু ছিন্ন উদ্ভিদের দেহাংশ সে সংগ্রহ করেছে। দেবলোকের গবেষণাগারে সেই উদ্ভিদগুলির পরীক্ষা হতে পারে। কয়েকটি সে চিহ্নিত করতে পেরেছে। কয়েকটি পারেনি। তাকে এ বিষয়ে আরও একটু অনুসন্ধান করতে হবে। কচ শুক্রাচার্যের আসা যাওয়ার সময় তাঁকে অনুসরণ করা শুরু করল। সবসময় সম্ভব হয় না। বৃদ্ধ হলেও শুক্রাচার্য খুবই কর্মঠ। দারুণ জোরে এগিয়ে যান। দূর থেকে তাঁকে লক্ষ্য করা বেশ কঠিন। একদিন শুক্রাচার্য বাইরে যেতেই কচ তাঁকে অনুসরণ করতে লাগল। শুক্রাচার্য এগিয়ে যেতেই আবার অসুরদের দল এসে ঘিরে ধরল কচকে।
“কে তুমি?”
“কচ।”
“বৃহস্পতি পুত্র? অঙ্গিরার পৌত্র?”
“হ্যাঁ।”
সঙ্গে সঙ্গে ঝলসে উঠল তরবারি। এবার কচকে যাতে সহজে না পাওয়া যায়, তেমন ব্যবস্থাই করল অসুরেরা। তারা কচের দেহ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলল এবং বনে, প্রান্তরে ও নদীতে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিল।
সন্ধ্যা হতেই দেবযানীর ডানচোখ বারবার কেঁপে উঠতে লাগল। দেবযানী পরম বিপদের আশঙ্কায় ভীত হয়ে উঠল। তার কেবল চিন্তা কচকে নিয়েই। শুক্রাচার্য ফিরে আসতেই দেবযানী ছুটে এল, “পিতা! কচের বোধহয় আবার কোনও বিপদ হয়েছে। একটু আগে আমার ডানচোখ কাঁপছিল। এত রাত হয়েছে, তবু কচ এখনও ফিরে আসেনি। যদি ওর কিছু হয়, আমি আর বাঁচব না। আপনি যেমন করে হোক আমার কাছে কচকে এক্ষুণি ফিরিয়ে দিন!”
“কল্যাণী! শোক করো না। আবারও যদি কচের একই রকম বিপদ হয়, তাহলে মনে করবে কচের আয়ু শেষ হয়েছে। কারণ আমি বাঁচিয়ে দেওয়ার পরেও ওর যদি একই রকম বিপদ হয়, তবে তা খুবই অস্বাভাবিক।”
শুক্রাচার্য অসুরদের ডেকে পাঠালেন। তারা এসে স্বীকার করল যে কচকে তারা সূর্যাস্তের ঠিক আগে সকলে মিলে হত্যা করেছে। এবারও দেবযানী করজোড়ে তার পিতার কাছে কচের জীবনভিক্ষা চাইল। শুক্রাচার্য তক্ষুণি অসুরদের প্রণোদিত করে পাঠালেন তারা কচের দেহের টুকরোগুলি আহরণ করে আনল। কচের মস্তিষ্ক এবারেও অক্ষত ও সজীব আছে। এবারেও বহু চেষ্টায় একইভাবে কচের মাথাটি একজন সদ্যমৃতের শরীরে সংযুক্ত করা হল। জীবনের লক্ষণ ফিরে এলে নির্গুণ্ডি ও ভৃঙ্গরাজকে জীবনদায়ী ভেষজ হিসেবে স্বীকৃতী দেওয়া হবে ঘোষণা করা হল। ভৃঙ্গরাজকে অবশ্য শিরোরোগের মহৌষধি বলা হয়। মাথার যে কোনো রোগে পীত, নীল ও শ্বেত ভৃঙ্গরাজ সমান ফলদায়ী না হলেও সবকটিই স্মৃতিহ্রাস, কেশহ্রাস, চুলের অকাল পক্কতা, এবং শরীরের বার্ধক্য দূর করতে পারে। গ্রহণের সবথেকে ভাল উপায় হল নাসাপান করা। সম্ভব না হলে গণ্ডুষধারণেও উপকার পাওয়া যায়।
শুক্রাচার্য খাওয়া দাওয়া ভুলে কচের শয্যার পাশে পড়ে রইলেন। দিন কাটতে লাগল। দীর্ঘ সময় পরে কচের শরীরে জীবনের লক্ষণ ফিরে এল। শুক্রাচার্যের অধীনে যারা কাজ করছিলেন সকলেই একত্রে হর্ষধ্বনি করে উঠলেন। দেবযানীর সেবায় কচ আবার সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল।
দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশেই শুক্রাচার্যের নিষেধ জেনেও অসুরের দল কচকে হত্যা করেছিল। ইন্দ্রই লোক নিযুক্ত করে তাদের স্মৃতিধারকের ভেতরে সূক্ষ্ম পরিবর্তন করেছিলেন। সেইজন্য অসুরেরা শুক্রাচার্যের নিষেধ ভুলে গিয়েছিল। কচ একবার মৃত্যুবরণ করেও মৃত্যুর হাত থেকে কীভাবে ফিরে আসতে হয়, তা এখনও হাতেকলমে শিখতে পারেনি, এইজন্যই ইন্দ্রের ইচ্ছায় তাকে বারবার হত্যা করানো হচ্ছে।
কচের শরীর এবার খানিকটা দ্রুত সেরে উঠল। অসুস্থ অবস্থায় প্রায় দু’বছর সময় যদিও কেটে গেছে। সুস্থ হয়েই সে দেবযানীকে আবারও সংসারের কাজে সাহায্য করতে চায় আর দেবযানী কচকে কোনও কাজ করতে দিতে চায় না। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কচের শরীর তার আগের সৌষ্ঠব ফিরে পায়নি। তবুও সে প্রাণে বেঁচে আছে, এটাই দেবযানীর কাছে অনেক আনন্দের। সে কচের জন্য দুধ-পথ্যের ব্যবস্থা করেছে। দুধ ও কৃষ্ণ তুলসীর রস সকালে মধুর সঙ্গে সে কচকে পান করতে দিয়েছে। কচের জীবনীশক্তি আশ্চর্য! সে কি এই পৃথিবীর কেউ নয়? সন্দেহ হচ্ছে দেবযানীর। কারণ মানব শরীর দু’দুবার এই ভয়ানক শল্যচিকিৎসা সহ্য করতে পারে না। দেবলোকের অধিবাসীরাই একমাত্র এমন শক্তিধর হয়ে থাকে, শুনেছিল দেবযানী।
কচের নিঃস্বার্থ আচরণ, শ্রদ্ধা প্রদর্শন, মেধা, সৌন্দর্য্য প্রতিটি গুণাবলীই এখন তার মনে একই সন্দেহ এনে দিচ্ছে। কচ যদি দেবলোকবাসীই হয়, তবে কি এখানে সে কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে? সে কি মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র শিখতে চায়? এর অর্থ কচকে দেবরাজ ইন্দ্রই এখানে পাঠিয়েছেন! সর্বনাশ! তবে কি কচ পিতারও কোনও ক্ষতি করতে চায়? দেবযানী কচের দিকে তাকালো। ভাগ্যিস এখনও কচের মুখমণ্ডল একই রকম আছে! সেই পবিত্রতায় আলোকিত চোখমুখ! এমনটা কি কখনও হওয়া সম্ভব? তবুও দেবযানী ভাবল, একবার সে তার মনের সন্দেহের কথা পিতাকে জানাবে।
দেবযানী ধীরে ধীরে পিতার কক্ষে প্রবেশ করল। দেখল এসে, পিতা জটিল চিন্তায় মগ্ন। দেবযানীকে দেখে হাসলেন।
“কল্যাণী বলো? এখানে কী দরকারে এসেছো?”
“পিতা কচ কি দেবলোকবাসী?”
“মা এখন সে নরলোকবাসী! এই প্রশ্ন করার এটা উপযুক্ত সময় নয়। কচ এখনও খুব দুর্বল। তার তোমাকে প্রয়োজন। যাও তাকে সময়মতো পথ্য দিয়ে সেবা করো।”
আরও একটা বছর কোথা থেকে কেটে গেল। আবার ফুলের ডালি নিয়ে বসন্ত এসেছে। কর্ণিকার, মন্দার, অতসী, অপরাজিতা, গোধূম রূপে, রঙে, রসে বিকশিত হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের মাথায় বরফ গলে জেগে উঠেছে সবুজের ইশারা। নদীর জল কলকল ছলছল শব্দে বনের ভেতর পাথরে তান তুলে বয়ে যাচ্ছে। খুব ভোরে দেবযানী স্নান সেরে নিল নদীর জলে। গা মুছে গাছের নীচে তার কঞ্চুকীটি পরে তাতে একটা রক্তরঙা শিমূল ফুল আটকে নিল। গায়ে দিল ঘননীল নীবীবন্ধনী। তার উর্ধ্ববাসটি ধুম্রবর্ণের। তবে তা খুব সূক্ষ্ম রেশম দিয়ে তৈরি। সেটি যেন তার যৌবনদীপ্ত শরীরকে আরও উন্মোচিত করে তুলল। দেবযানী ভেজা চুলে একটা কবরী বেঁধে নিল খুব আলগা করে। তাতে একটা শ্বেত অগস্তের ফুল দিল। আজ এই অগস্ত পুষ্প দিয়েই ব্যঞ্জন হবে। সঙ্গে মুদ্গ অবলেহ। পাকা দাড়িম্ব আর তীক্ষ্ণ-ঝাল লতার ডাল দিয়ে হরিণের মাংস রান্না করবে। আজ তাদের বাড়িতে ভোজের রান্না হবে। আজ বসন্ত পঞ্চমী। শুভ বিদ্যারম্ভের দিন। এইদিনে অঙ্গনে মঙ্গলারতি হয়। ঘরে শালিত ধানের অন্নপাক হয়।
কচ এখন মাঝে মাঝে বনের ভেতর গরুগুলোকে নিয়ে যায়। অসুরেরা এখন তাকে শুক্রাচার্যের শিষ্য হিসেবে বেশ চিনে নিয়েছে। সুতরাং আর কোনও মৃত্যুভয় নেই। বৃষপর্বাও অসুরদের এই অনভিপ্রেত কাজের জন্য নিজে অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছেন। তিনি তাদের সকলকে বসন্তপঞ্চমীর দিন বিকেলবেলা কচের সুস্থতা উপলক্ষে ভোজের নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
সারাদিন দেবযানীর ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। পিতার সহায়কদেরও খেতে বলা হয়েছে। কচ তাকে রান্নায় সাহায্য করল। মশলা বেটে দিল, মাংস কেটে দিল। চাল ধুয়ে আনলো। দেবযানী বারণ করলেও সে কিছুতেই শোনে না। সন্ধ্যাবেলা তার শরীরে সামান্য জ্বর দেখা দিল। কচের শরীর দুর্বল, সামান্য কাজের ফলেও তার শরীরে ক্লান্তি দেখা দেয়। দেবযানী কচের মাথায় জলপট্টি দিয়ে মাথা মুছিয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। রাজার ডাককে উপেক্ষা করা যাবে না। সুতরাং দেবযানী ও শুক্রাচার্য যাবেন, এটাই ঠিক হল। দেবযানী রাজা বৃষপর্বাকে একবার প্রণাম জানিয়েই ফিরে আসবে ঠিক হল। কারণ কচ খুবই অসুস্থ। সে ফিরেই কচের জন্য রাতের পথ্য রান্না করবে। যাবার আগে দেবযানী কচকে ঘরে থাকতে বলে, খুবই বিষণ্ণ মনে বিদায় নিল।
সবাই বিদায় নিতেই কচ বিছানায় উঠে বসল। তার শরীর এখন অতি রুগ্ন হয়ে গেছে। এই শরীর বেশিদিন রক্ষা করা যাবে না, এটা সে বুঝে গেছে। সার্গ তাকে যে কাজের জন্য পাঠিয়েছে তা সফল হয়নি। সম্ভবত সে বিফল হতেই চলেছে। কচ বিষণ্ণ মনে ধীরে ধীরে শুক্রাচার্যের গবেষণাগারে প্রবেশ করল। গবেষণাগারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসুরটি কচকে কিছু বলল না। কীভাবে মস্তিষ্ক স্থানান্তরিত হয়, তা তাকে জানতেই হবে। একটিবার চোখে দেখলেই তার দক্ষতা চলে আসবে। কী কী উদ্ভিদ এই কাজে ব্যবহার করা হয়, এবং কেনই বা করা হয়, তাও জানতে হবে। কচ শুক্রাচার্যের গবেষণার লিখিত পুঁথিগুলি পাঠ করে তা সাংকেতিক ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ বাইরে দাঁড়ানো অসুরটির শরীরে সংযুক্ত বিশেষ ঘন্টা বেজে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে কচকে ঘিরে ধরল প্রায় দশ বারোজন যন্ত্রমানব। এবার তারা শত্রুর কোনো অবশেষ রাখল না। কচের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিল তারা। সম্পূর্ণ ভস্ম হওয়া পর্যন্ত সকলে অপেক্ষা করল। তারপর সেই ভস্ম একটি আধারে ভরে সুরার সঙ্গে মিশ্রিত করল এবং সেখান থেকে সকলে বৃষপর্বার সভায় চলে গেল।
অনেকদিন পরে ঘরের পরিসীমার বাইরে এসেছে দেবযানী। বৃষপর্বা ও রাজপরিবারের সকলে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করেছেন তাদের। পিতার গর্বে দেবযানীর মন ভরে গেল। মেয়েরা তাকে সকলে অভ্যর্থনা করে অন্দরমহলে নিয়ে গেল। সেখানে তাদের রত্নালঙ্কার দেখে দেবযানী হতবাক হয়ে গেল। রাজকন্যা শর্মিষ্ঠার সঙ্গে আলাপ হল তার। শর্মিষ্ঠা অপরূপ সুন্দরী। তার উপর অসংখ্য মূল্যবান অলঙ্কারে ভূষিতা। দেবযানীর সামান্য হিংসে হল তা দেখে। শর্মিষ্ঠা দেবযানীর গলায় অলঙ্কার নেই দেখে একটা হীরে ও মুক্তো বসানো হার এনে তাকে পরিয়ে দিল। দেবযানী ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে বলল, “এমন অলঙ্কার তোমরা কিনে পরে থাকো। আমার পিতা চাইলে তার গবেষণাগারে এর চেয়েও দুর্লভ রত্ন অগণিত সংখ্যায় তৈরি করতে পারেন।”
দেবযানীর এই উদ্ধতবাক্য শর্মিষ্ঠার ঠিক পছন্দ হল না। তারা দুজনেই দুজনের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হল। তাদের মধ্যে যেন এক দীর্ঘকালীন শত্রুতার সূত্রপাত হল।
এমন সময় একটি বিশ্ববন্দিত সুরা এনেছে বলে অসুরেরা শুক্রাচার্যকে তা পান করাল। স্বভাবে সরল শুক্রদেব তা বিনা দ্বিধায় গ্রহন করলেন। আসলে সেটাই ছিল কচের দেহাবশেষ। একটু রাতের দিকে পালকি বাহকেরা শুক্রাচার্য ও দেবযানীকে বনের ভেতর তাদের আবাসে পৌঁছে দিল। ঘরে তখন কেউ নেই। পাহারাদার অসুরেরা ততক্ষণে পালিয়েছে। কোথাও কচের চিহ্নও নেই। দেবযানী হাহাকার করে উঠল।
শুক্রাচার্য বললেন, “কচের আর মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। তার মৃত্যুকে এবার মেনে নাও দেবযানী।”
দেবযানী হঠাৎ তীব্র গলায় বলল, “না পিতা, তার মৃত্যু আমি কিছুতেই মানতে পারব না। আমি মনে মনে কচকে পতিত্বে বরণ করেছি। যদিও আমার প্রেম কখনোই তার কাছে আমি আজও প্রকাশ করিনি, তবুও আমি তাকে মনে মনে প্রত্যাশা করে এসেছি বিগত বহুবছর ধরে। এ কথা জানলে কচেরও আমাকে গ্রহণে আপত্তি থাকবে না। আমি জানি কচও মনে মনে আমাকে ভালবাসে। সে গুরুকন্যা বলে মুখ ফুটে হয়তো তার প্রেম প্রকাশ করেনি, এও আমি জানি। কচ কোথায়? আপনি গণকযন্ত্রের মাধ্যমে খুঁজে দেখুন। শুনেছি আপনি ওর মস্তিষ্কে থাকা যন্ত্রের সঙ্গে আপনার গণকযন্ত্রটির সংযোগ করেছিলেন।”
“ঠিক বলেছো দেবযানী!” শুক্রাচার্য সেই মুহূর্তে গণক যন্ত্র খুলে কচকে আহ্বান জানালেন।
গণকের পর্দার উপর ফুটে উঠল, কচের বাক্য।
“গুরুদেব! শান্ত হোন। আমার পুনরায় ফিরে আসা আর সম্ভব নয়। আমার দেহ নাশ হয়েছে। নতুন করে কোনওভাবেই তা গড়ে ওঠা সম্ভব নয়।”
“তুমি এখন কোথায়?”
“গুরুদেব অসুরেরা আমার দেহ ছাই করে দিয়েছে। তবে আমার স্মৃতিধারকটি কেবল নষ্ট হয়নি। আপনি ক্ষান্ত হোন। আপনি সেই ভস্ম মিশ্রিত সুরা পানও করেছেন।”
“সর্বনাশ! এখন উপায়?”
“উপায় আর নেই গুরুদেব! আপনি শোকগ্রস্তা দেবী দেবযানীকে শান্ত করুন।”
“উপায় আমি ঠিক বের করব কচ। হয়তো অনেক সময় লাগবে। তবে হাল আমি ছেড়ে দেব না। অসুরেরা বারবার আমার ক্ষতি করছে। এখন আপাতত আমি তোমাকে এই মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন বিদ্যাদান করছি। লিখিত তথ্যগুলো তোমার স্মৃতিধারকে প্রতিস্থাপিত করছি। আপাতত। অসুরদের আর ভরসা কী! হয়তো কয়েকদিন পরে তারা আমারও প্রাণ হরণ করবে!”
শুক্রাচার্য তথ্যগুলি দেওয়ামাত্রই কয়েকজন অসুর কচকে বেঁধে তার সামনে নিয়ে এল।
“এ কী! কচ যে দেখছি জীবিত আছে?”
“গুরুদেব! এরা আমাকে বন্দী করে নিয়ে গেছিল। তারপর আপনার প্রাণনাশের ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়েছে। এরা সবাই ইন্দ্রের নিয়োজিত অসুর। আপনার অসুরদের সরিয়ে গোপনে এরা গবেষণাগারে প্রবেশ করেছিল। ওরা কেবল এই দিনটির জন্যই প্রতীক্ষা করছিল। তবে শঠতা দ্বারা শিক্ষা করা এই বিদ্যা আমি কিছুতেই গ্রহণ করতে চাই না। আপনি আমাকে দেওয়া তথ্যগুলি স্মৃতিআধার থেকে এক্ষুণি মুছে দিন। আমি এখনও সবটা অধীত করিনি।”
“ধন্য কচ! ধন্য তোমার সত্যবাক্য! ধন্য তোমার সংযম। আমি এমনিতেই এই শিক্ষা তোমাকে দান করতাম। তোমার গুণাবলী আমাকে মুগ্ধ করেছে। তুমিই হলে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ছাত্র। এসো! তোমাকে আমি এই পরমজ্ঞান দান করতে চাই, সেই সঙ্গে চিনিয়ে দিই সৃষ্টির আদিগুণ বিশিষ্ট সব ভেষজদেরও।”
শুক্রাচার্যের কাছ থেকে বিদ্যাগ্রহন করে কচ তাঁকে প্রনাম করল। শুক্রাচার্য যেন এতদিনে তার পিতারও অধিক হয়ে উঠেছিলেন। এই প্রণম্য দেবতাকে বারবার প্রণাম করলেও শান্তি হবে না কচের। সে গুরুদেবের পদতলে বসে বলল, “আপনি অশেষ কষ্ট সহ্য করে আমাকে বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। আজ বিদায়বেলায় আপনাকে ছেড়ে আমার দেবলোকও ভাল লাগবে না।”
“আশীর্বাদ করি জীবনে সফলতা পাও। আশা করি দেবলোকে ফিরে গেলে সেখানকার বাতাসে তুমি তোমার শারীরিক এইসব দুর্বলতাটুকু জয় করবে। তবে কখনও এই মন্ত্রের অপব্যবহার কোরো না। সত্যবাদীর জীবন ফিরিয়ে আনতে সর্বদা সাহায্য করবে। আমার কাছে সত্যের চেয়ে মূল্যবান অনন্ত বিশ্বে আর কিছুই নয়।”
কচ দেবযানীর কাছে গেল। এবার তার বিদায়ের পালা। দেবলোক থেকে ইন্দ্রের রথ নিয়ে মাতলি অনেক আগেই রওনা হয়েছে। তাকে ফিরে যেতে হবে। কচের মনে পড়ছে শ্রুতশ্রবার কথা। শ্রুতশ্রবা বহুকাল কচের অপেক্ষায় আছে! ইন্দ্রের অসুরেরা এসে জানিয়ে গেল কচকে, মহাকাশযান পৃত্থীর কাছাকাছি এসে পড়েছে। এবার তাকে ফিরে যেতে হবে দেবলোকে। কচ কিছুক্ষণ দেবযানীর দিকে চেয়ে রইল। দুজনেই চিত্রার্পিত। দুজনেই বাক্যহারা। দেবযানী বলল,
“কচ তাহলে তুমি কি একজন দেবদূত? কী আশ্চর্য! প্রথমদিকে এ কথা আমার একবারও মনে আসেনি। তুমি কি আমার কাছে এবার বিদায় নিতে এসেছো?”
“হ্যাঁ দেবযানী। এবার আমাকে বিদায় দাও। আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা জানানোর সাধ্যও নেই আমার। আমি তোমাকে উৎকন্ঠিত করেছি, কষ্ট দিয়েছি, কাঁদিয়েছি, ব্যথিত করেছি। তোমার সেবা গ্রহণ করে বারবার জীবন ফিরে পেয়েছি। এখন হাসিমুখে বিদায় দাও। সার্গে দেবরাজ দীর্ঘকাল আমার প্রতীক্ষা করছেন।”
“বিদায়! তোমাকে ছাড়া জীবনে বেঁচে থাকার কোনও অর্থই হয় না আমার। আমি প্রথমে তোমাকে বন্ধু হিসেবে এবং পরে তোমাকে দয়িত হিসেবে ভালবেসেছি। এখানে তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়! এই বনের প্রতিটি বৃক্ষে যে তোমার স্পর্শ আছে! এখানে আমি তোমাকে ছাড়া এখন কেমন করে বাস করব কচ?”
“দেবী! আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনেই এখানে এসেছিলাম। এখানে থাকার আমার উপায় নেই। আমার পিতা বৃহস্পতি আমার অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন। তিনি এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, তাঁর আমাকে এখন প্রয়োজন। যেমন তুমি তোমার পিতার পরিচর্যা করো, আমিও ফিরে গিয়ে পিতার সেবা করতে চাই। তুমি মহান ও গুণী নারী, তবে তুমি আমার গুরুদেব কন্যা। সুতরাং তোমার প্রেমপ্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারছি না। শুক্রাচার্য আমার পিতা-সমান, আমি তাঁর হাতেই বারবার জীবনলাভ করেছি। সুতরাং তুমি আমার দয়িতা কিছুতেই হতে পারো না। আমি তোমাকেও শ্রদ্ধা করেছি, তবে কখনোই ভালবাসিনি। হে চারুমুখী! এবার তুমি আমাকে বিদায় দাও!”
“না না না… আমি তোমাকে বিদায় অনুমতি দিলাম না। যদি তবুও তুমি আমার কথা না শুনে আমাকে ছেড়ে জোর করে চলে যাও, আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি…”
“না কল্যাণী! আমাকে শাপ দিও না। মিনতি করছি! আমি নিজের জীবন তুচ্ছ করেছি এই শিক্ষালাভ করতে। আমাকে দয়া করো!”
“আমি তোমাকে অভিশাপ দিলাম, তুমি কখনও এই অধীতবিদ্যা প্রয়োগ করে সফলতা পাবে না।”
“বিনা দোষে এতবড় অভিশাপ দিলে আমাকে? এত কষ্টে শেখা বিদ্যার প্রয়োগে সফলতা পাব না আমি? বেশ। তাই হোক। তবে আমি যাকে শিক্ষা দেব সে অবশ্যই সফল হবে। আমিও তোমাকে বলে গেলাম, তোমার মতো বিলাসী, রুষ্টা ও অহঙ্কারী, মুগ্ধা নারীর কখনো কোনও ব্রাহ্মণ ঋষির সঙ্গে বিবাহ হবে না। তোমাকে ক্ষত্রিয় রাজপরিবারেই মানাবে ভালো। তোমার বিবাহ হবে একজন ক্ষত্রিয় রাজার সঙ্গে। এটা আমার ভবিষ্যতবাণী বলো, বা শাপ বলো যা কিছু বলতে পারো। বিদায় দেবযানী! মর্ত্যলোক থেকে চিরবিদায়।”
হঠাৎ সমস্ত বন আলোকিত হয়ে উঠল। আকাশ থেকে আলোকিত চক্রের মতো নেমে এল মাতলি চালিত রথ। দেবলোকের দূত, দেবদূত কচ তাতে অবতরণ করতেই ঘরঘর শব্দে রথের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। দেবযানী চোখের জলে ভাসতে ভাসতে দেখল কচকে নিয়ে রথ উল্কার বেগে মেঘের রাজ্যে হারিয়ে গেল। দেবদূত কচ দেবলোকে যাত্রা করল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
পড়লাম। কিছু তথ্য বাদে সবটাই জানা কিন্তু তোমার লেখার গুণে অসাধারণ হয়ে উঠেছে।