সোলমেট
পাক্কা দুদিন পর ক্লাশে এল সোহাগ। সেদিন দুপুরে সে-ই যে ইউনিয়ন রুম থেকে হোস্টেলে ফিরেছিল, তারপর দু-দিন আর বেরোয়নি হোস্টেল ছেড়ে। বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করলে বলেছে শরীর খারাপ। দুদিন পর যখন ক্লাশে এল, তখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে। কাজেই যারা শুনেছিল শরীর খারাপের কারণে ও ক্লাশে আসছে না, তারা ওকে দেখেই বুঝতে পারল, শরীর সত্যিই কতটা খারাপ হয়েছিল! তার হাটাচলা থেকে উধাও আত্মপ্রত্যয়, মুখে নেই ঝলমলে হাসি, চোখের দৃষ্টিতেও নেই সেই জ্যোতি, যেন এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। চোখ তো মনের আয়না, হৃদয়ের আনন্দ দ্যুতির প্রকাশ হয় চোখেই, তাই তার চোখ আজ স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছিল কতটা কষ্ট রয়েছে সোহাগের ভেতরে। সোহাগকে ক্লাশে ঢুকে একা একটা বেঞ্চে বসতে দেখে, রিম্বিক নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে বসল ওর পাশে। রিম্বিককে পাশে বসতে দেখে সোহাগ হাসে তার দিকে তাকিয়ে, বড় ম্লান হাসি। রিম্বিক কিছু একটা বলতে যাবে তার আগে-ই ক্লাশে স্যার চলে এলেন। ক্লাশ শেষ হয়ে যাবার পর রিম্বিক বলল। -আমি জানি, তোর শরীর না, মন খারাপ, তাই তো? সোহাগ কিছু বলে না চুপ করে থাকে। কারণ এরপর প্রশ্ন আসবে, ‘কেন, আমরাতো বন্ধু, আমাদের বল।’ ওর এখন কোনো কথাই বলতে ভালো লাগছিল না। আসলে এমন কিছু কথা থাকে, যেটা দুনিয়ার কাউকে বলা যায় না। এমন কিছু কষ্ট থাকে, যা কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়না। আর এই সত্যি কথাটা কেউ কেউ বুঝতেও চায়না। কাজেই রিম্বিক সহ অন্য বন্ধুদের প্রশ্নগুলো কিভাবে এড়িয়ে যাবে সেটাই ভাবতে থাকে সোহাগ। -”তোর্সা তোকে ফোন করেছিল শরীর খারাপ শুনে; তোর্সা, আয়েশা তোকে দেখতে যাবে হোস্টেলে ভেবেছিল, কিন্তু তুই বারণ করে দিলি যখন, তখনই বুঝে গেছি আমি, তোর অসুখটা কোথায়।” এবারেও কিছু বলে না সোহাগ, কী-ই বা বলার আছে, রিম্বিকের পরবর্তী প্রশ্নটার অপেক্ষা করতে করতে ও ভাবতে থাকে কি উত্তর দেবে, যাতে সত্যি কথাটা না বলেও তার বন্ধুদের মনে আঘাত না দিয়েও সমস্যাটা থেকে বের হয়ে আসা যায়। কিন্তু কিছুই করতে হল না সোহাগকে, রিম্বিকই বাঁচিয়ে দিল ওকে। -”শোন, আমরা কেউ-ই জানতে চাইব না তোর কাছে কেন তোর মন খারাপ। কিন্তু তোকে এরকমভাবে দেখে তো আমরা অভ্যস্ত নই, তাই খুব খারাপ লাগছে। তুই যখন কারো সঙ্গে শেয়ার করবি না, তখন নিজেকে একটু তাড়াতাড়ি সামলে নে প্লিজ।” রিম্বিককে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ জানায় সোহাগ। ওর কাছে এতটা সমঝ্দারি সত্যিই সোহাগ আশা করেনি। মুখে বলে শুধু, -‘চেষ্টা করছি’। আর মনে মনে বলে, ”গভীর ক্ষত সারতে সময় তো লাগবেই, আর সব ক্ষত কি সারে?” তবে রিম্বিকের কথাতে একটা কাজ অবশ্যই হল। সোহাগ বাস্তবটার মুখোমুখি হল। সে বুঝল, ভেতরে যতই নদীর পাড় ভাঙুক যতই বন্যার জল ঢুকে পড়ুক হু-হু শব্দে, বাইরেটাকে আগের মত রাখার চেষ্টা করতে হবে সচেতনভাবে, চেষ্টা করে, নাহলে পরিবর্তনটা কারোর নজরই এড়াবে না। আর তাই সে দ্রুত শিখতে লাগল, দুই চরিত্রের মধ্যে সহজ যাতায়াতের পদ্ধতি। কিভাবে দ্রুত ‘আসল আমি’ থেকে বের হয়ে গিয়ে ঢুকে পড়তে হয় ‘বাইরের আমি’র মধ্যে, কিভাবে সুইচ ‘অফ’, ‘অন’ করার মত ‘অফ’ থাকা মুডকে ঝটপট ‘অন’ করতে হয় জনসমক্ষে, সবই সে অভ্যাস করতে লাগল প্রয়োজনের তাগিদে। ছদ্মবেশ ধারণ সে একদম পছন্দ করত না কোনোকালেই; সবসময় ভাবত, নিজের ভেতর আর বাইরেটা একদম একই রকম রাখবে সে, কাচের মত স্বচ্ছ, কিন্তু পারল না। আর সমস্ত মানুষের মত, খোলস ধারণ করতে শিখতে হল তাকে, বদলে ফেলতে হল নিজেকে। নিজেকে ভুলে থাকার জন্য, ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সোহাগ, ক্লাসমেটদের সঙ্গে বেশী বেশী সময় কাটাতে লাগল, যা আগে কখন করেনি। বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যাওয়া, নাটক দেখতে যাওয়া শুরু করল সে। কখনো বা স্থানীয় কোনো বন্ধুর বাড়ি ক্লাশ এর পর বেড়াতে চলে গেল। এই দিনগুলোতে রিম্বিক ওকে ভীষণই সাহায্য করছিল। ক্লাশের মিস্ হয়ে যাওয়া নোটস দিয়ে যেমন সাহায্য করছিল, তেমনই আবার কখনো ক্লাশ শেষের পর ওকে, ওদের থিয়েটারের গ্রুপের শো থাকলে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিল। সোহাগ ও বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেছে রিম্বিকের সঙ্গে, কারণ একজন বা একাধিক মানুষের উপস্থিতি সেই সময় তার পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক মনে হচ্ছিল। কারণ একা হলেই তো সোহাগের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে অন্য এক সোহাগ, যে কিনা ঈশানেরই খণ্ডিত অংশ বিশেষ। ঈশানকে ছাড়া যার অস্তিত্ব গভীর সংকটে। যতদিন ঈশান তার সঙ্গে ছিল, কাজে কিংবা অকাজে সারাদিন বহুবার বহুরকম কথাবার্তা হত তাদের মধ্যে, ততদিন বোঝেনি সোহাগ, ঈশানের শিকড় তার ভেতরে এতটা গভীরে গেঁথে গেছে। আজ যখন সে আলাদা হয়ে গেছে, তখন তাকে সোহাগ প্রত্যেক প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে অনুভব করতে পারছে। ছেড়ে চলে গেছে বলেই যেন বেশী কাছের হয়ে গেছে, অমূল্য হয়ে গেছে। রিম্বিক তার কথা রেখেছিল। এইসব সংকটের দিনগুলোতে পাশাপাশি চলার সময়, একবারও উচ্চারণ করেনি ঈশানের নাম, জানতে চায়নি কি সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল সোহাগের সঙ্গে ঈশানের, বা কেন তারা এখন পরস্পরকে এড়িয়ে চলে! উপরন্তু, সোহাগের এলোমেলো হয়ে যাওয়া মনটাকে পড়াশোনাতে ফেরানোর জন্য, অন্য বন্ধুদের থেকে একটু বেশীই চেষ্টা করে সে। বইপত্র, নোটস দেওয়া ছাড়াও ওকে সঙ্গে করে নিয়মিত লাইব্রেরী যাওয়া আর সেখানে বসে পড়ার অভ্যাস সোহাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয় সে। রিম্বিককে বুদ্ধিমান, লেখাপড়ায় ভালো বলেই এতদিন জানত সোহাগ, এখন তার সহানুভূতিশীল মনটাকেও দেখতে পেল সে। ধীরে ধীরে মনটাকে পড়াশোনাতে বসিয়ে দিতে পারল সোহাগ, যেটা ভীষণ দরকারি ছিল, কারণ পরীক্ষার বেশীদিন বাকি ছিলনা আর। সংকটের সময় যে বন্ধু একটা সাহায্যের হাত বাড়ায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতার সাথে সাথে ভালোবাসা বোধ ও যে তৈরী হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! মাস্টার্স শেষ করার পর, রিম্বিকের ইচ্ছে ছিল সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার; সেজন্য ভালোরকম পড়াশোনা করা প্রয়োজন। আর সোহাগের ইচ্ছে ছিল গবেষণা করার। এম.এস.সি পড়ার সময়েই তাই সে বিভিন্ন রিসার্চ ইনস্টিটিউট গুলোতে পরীক্ষা দিতে থাকছিল, জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপের জন্য নেট পরীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি। ইউ.জি.সি’র জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপটা যখন পেয়ে গেল সোহাগ, তখন রিম্বিক প্রস্তাবটা দিল। -”চল, বিয়ে করে নিই।” সোহাগের সঙ্গে রিম্বিকের সম্পর্কটা ততদিনে নিছক বন্ধুত্বের গন্ডি পার হয়ে, যতটা এগিয়েছে তাতে এরকম একটা প্রস্তাব দেওয়াটা খুব একটা অনভিপ্রেত কিছু নয়। তবু একটু থতমত খায় সোহাগ। কারণ বিয়ে করার কথা তখন-ও পর্যন্ত ঘুণাক্ষরে ভাবেও নি সে। বিয়ে, সংসার এই সব ব্যাপারগুলো ও একটু এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করতো, কারণ কেরিয়ার তৈরী পড়াশোনা শেষ করাটা-ই তার কাছে পাখির চোখ ছিল। তাই সে বলে, -”এখনই বিয়ের কথা? বিয়ে করা কি পালিয়ে যাচ্ছে? না তোর কেরিয়ার তৈরী হয়েছে, না আমার, সেগুলো কর আগে!” -”একসাথে থাকলে সেগুলো আরো ভালো হবে। কোনো টেনশন থাকবে না তো তোকে ছেড়ে থাকার! তুই তোর পড়াশোনা করবি, আমি আমার। তোর ফেলোশিপের টাকায় খাব, বিন্দাস থাকবো, এনি প্রবলেম?” -”তার জন্য বিয়ের কি দরকার? এমনিই থাক না একসাথে, আগে কিছুদিন আমার সাথে থেকে দ্যাখ্ থাকতে পারিস কি-না, তারপর বিয়ে করিস! যদি দেখিস পোষালো না, নিজের পথ দেখতে পারবি।” -”ঠিক, ঠিক, উকিল মোক্তার কোর্ট কাছারি না করেই তল্পিতল্পা গুছোতে পারব কি বলিস?” সোহাগের প্রস্তাবটা রিম্বিকের মনে ধরে। বিয়ের ভাবনাটা যদিও ওর মাথাতে এসেছিল, তবু চাকরি বাকরি না করে বিয়ে করাটা, বাবা-মা আত্মীয়সেজনরা কেমন ভাবে নেবেন, সেটা ভেবে ওর মনটা একটু খুঁত খুঁত করছিল বৈকি। লিভ ইন সম্পর্কে থাকলে, সাপও মরল, আবার লাঠি ও ভাঙলো না। ইউনিভার্সিটির হোস্টেল আর মেস ছেড়ে তারা যেদিন এই ফ্ল্যাটে উঠে এল, সেদিন সঙ্গে ছিল সোহাগে বাবা মা, আর কাছের বন্ধুরা কজন। এই ফ্ল্যাটটা সোহাগের মামার, যিনি কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন, আর বছরের পর বছর ফ্ল্যাটটা বন্ধই পড়ে থাকে। সোহাগের মায়ের ওপরই মাঝে মাঝে এসে ফ্ল্যাটটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা, ট্যাক্স দেওয়া বিদ্যুতের বিল, ফ্ল্যাটের অন্যান্য বকেয়া দেওয়ার দায়িত্ব ন্যস্ত। এখন সোহাগের থাকার প্রয়োজন শুনে তিনি যেন হাতে চাঁদ পেলেন, অন্তত কেউ তো বসবাস করবে। সোহাগকে নতুন সংসার গোছাতে সাহায্য করার জন্য ওর বাবা মা প্রথমদিন সঙ্গে এলেন। যদি ও সংসার বলতে যা বোঝায়, ওদের ডেরাটাকে সে আখ্যা দেওয়া যায় কি-না সেটা নিয়ে দুবার ভাবতে হবে। কারণ দুজনেরই পড়াশোনার চাপ, তাই রান্নাবান্নার পাট রাখেনি ওরা বাড়িতে। খাওয়া দাওয়া হোমসার্ভিসে। বাড়িতে শুধু চা আর প্রয়োজন হলে ম্যাগি বানানোর বন্দোবস্ত। তাই এটাকে মেসের একটু পরিশীলিত, পরিমার্জিত সংস্করণ বলাটাই শ্রেয়। তবুও সোহাগের মা দারুণ খুশী, কারণ তার ছন্নছাড়া মেয়েটা কোনোদিন কোথাও থিতু হতে পারবে না এটা ভেবে তিনি মনে মনে খুবই শঙ্কিত ছিলেন। এখন এই যে রিম্বিকের সাথে সোহাগের একসাথে থাকার শুরু, না হোক এটা বিয়ে, তবু তো একত্র বসবাস; এই যে দুজনের মধ্যেকার বন্ধন, না হোক তা আইনি তবু তো একটা বন্ধন; এই বন্ধনে যে তার এলোমেলো মেয়েটা বাঁধা পড়েছে, তাতে ও তিনি স্বস্তি পেলেন। সোহাগের রিম্বিকের কাছের বন্ধুরা, ঋষি, তোর্ষা আর আয়েশা, তারাও খুব খুশী, সোহাগ-রিম্বিকের সম্পর্কটা নতুন মাত্রা পাওয়াতে। সোহাগের জন্য বিশেষতঃ তারা স্বস্তি পেয়েছে, কারণ সোহাগের বুনো হাঁসের পেছনে দৌড়নোটা কখনই তারা মন থেকে মানতে পারেনি। সারাটা দিন সবাই একসাথে কাটিয়ে, হৈ হল্লা করে, ওদের নতুন বাসস্থানটা গোছগোছ করে দিয়ে, সন্ধ্যার পর সোহাগের মা, বাবা, আর বন্ধুরা সবাই চলে গেল। এবারে শুধু রিম্বিক আর সোহাগ। এখন থেকে দুজনের দুঃখ, সুখ, ভালো মন্দের ভাগ বাঁটোয়ারা শুধু দুজনের মধ্যেই হবে। যখন তারা শুধুমাত্র বন্ধু ছিল, তখনকার যে পারস্পরিক সমঝোতা ছিল, তা এখন বদলে যাবে, পাবে নতুন মাত্রা। দূরে থাকাকালীন মানুষের অনেক অপছন্দের জিনিস-ই চোখে পড়ে না, কিংবা চোখে পড়লেই সেটা খুব বেশী কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। কিন্তু কাছে এলেই অনেক সূক্ষ্ম, চুলের মত সরু ছিদ্র ও বড় হয়ে দেখা দেয়। এইসব অপছন্দের জিনিসকে বড় করে না দেখে, উপেক্ষা করতে পারলে তবে-ই দৃঢ় হয় বন্ধন, টিকে যায় সম্পর্ক। ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে ধৈর্য্য আর সহনশীলতার পরীক্ষায় পাশ না করলে, দুজন মানুষকে একসাথে বেঁধে রাখতে পারেনা কোনো বন্ধন-ই। এত কিছু ভেবে, কোনো মানুষ কি আর কোনো সম্পর্কে জড়ায়? তবু, সোহাগের মনে তার নিজের প্রকৃতি নিয়ে একটু চিন্তা ছিল-ই। কারণ সে সবসময় যা, তা-ই হয়েই থাকতে চায়, যেমন, মেক-আপ করে নিজের রূপের খুঁত গুলো ঢাকার পক্ষপাতী নয় সে কোনোদিনই, তেমনই, কাছের মানুষের কাছে সে কোনো রকম আড়াল, ভনিতা রাখার পক্ষপাতীও নয়। নিজেকে খোলাখাতার মত মেলে ধরতে চায় রিম্বিকের সামনে, তাই সেদিন সন্ধ্যায়, তারা দুজনে একা হবার পর, সোহাগ ‘শ্রীজাত’র লেখা একটা কবিতা শোনায় রিম্বিককে- আমার একটা ‘তুই’ চাই- একটা সত্যিকারের তুই চাই যে জানবে আমার পুরো ভিতরটা জানবে আমার লুকানো সব দোষ আমার বদমাইশি, আমার নোংরামি আমার কলঙ্ক যে নিজে থেকে আমার ভুলগুলোর অংশীদার হবে… আমার পাপগুলোকে অর্ধেক করে লিখে নেবে নিজের খাতার প্রথম পাতায়… আমি এমন একটি ‘তুই’ চাই যাকে আমি নির্দ্বিধায় উপহার দেব আমার সব অনিয়ম আমার অপারগতা, আমার বদভ্যাস আমার উছৃঙ্খলতা… পুরো কবিতাটা আর শেষ করতে পারেনি সোহাগ, তার আগেই তাকে বুকে টেনে নিয়েছিল রিম্বিক, আর বলেছিল ”তোকে কথা দিচ্ছি সোহাগ, আমি চেষ্টা করব।”
যেদিন বিকেল থেকেই আকাশের রং ছিল ধূসর, বাতাস বইছিল না, থম্থম্ করছিল পরিবেশটা, কেমন যেন একটা কী-হয়, কী-হয় ভাব সর্বত্র। পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে একটা পথসভা হবার কথা ছিল, সন্ধ্যেবেলা তাই ক্যাম্পাস থেকে বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়ে ছিল সোহাগরা সদলবলে। কিন্তু কিছুটা যেতেই হুড়মুড় করে নামল বৃষ্টি, সঙ্গে ঝড়। একেবারে ইয়ার দোস্ত নিয়ে হাজির কালবৈশাখি। এমনিতে ঝড় বৃষ্টি ভালোই লাগে সোহাগের। বৃষ্টিতে ভিজতেও সে ভালোবাসে খুবই, কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অন্য। আজ পথসভাটা সুষ্টুভাবে যাতে হয়, সেটাই সে চাইছিল বলে, এই সময়ে ঝড় বৃষ্টিটা তার একদম ভালো লাগছিল না। একটা দোকানের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে পড়েছিল তারা, বৃষ্টিটা একটু ধরার অপেক্ষায়, কিন্তু আধঘন্টা কেটে যাবার পরও বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। উপরোন্তু দাপট বাড়তে লাগল। দোকানের শেডে দাঁড়িয়েও মাথাটা ছাড়া আর কিছু বাঁচাতে পারল না কেউ। এলো পাথারি ছাঁটে সমস্ত শরীর ভিজে সপসপে, মাঝে মাঝেই বাজ পড়ার শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল, রাস্তাতেও গোড়ালি ডোবা জল। পথসভাটা হবার ব্যাপারে ওদের মনে ক্ষীণতম আশার আলোটুকুও থাকল না, কারণ যে রাস্তার মোড়ে সভাটা ডাকা হয়েছিল, সেটা বেশ নীচু। ফলে ওখানে এতক্ষণে প্রায় হাঁটু জল। তাছাড়া বৃষ্টিতে মাইক ম্যান ও আসবে না স্টেজ-ফেজ ও লন্ডভন্ড। তেলের দাম বাড়ায় মানুষের যতই পকেটে টান পড়ুক না কেন, এই দুর্যোগে কেই বা আসবে মিটিং-এ? সুতরাং মিটিং যে সেদিনের মত বাতিল সেটা ওরা বুঝতেই পেরে গেছিল। কিছুক্ষণ পর জোনাল কমিটির সেক্রেটারী ফোন করে সেটা কনফার্ম ও করে দিল। তবুও আরো আধঘন্টা ওদের অপেক্ষা করতে হল, বৃষ্টিটা মোটামুটি ধরবার জন্য। বৃষ্টিটা একটু ধরলেও বাজ পড়া বন্ধ হয়নি, বিকেল থেকেই বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সেদিন রাস্তার ধারে দোকান পাট ও তেমন খোলেনি। দু-চারটে যা-ও বা খুলে ছিল রাস্তায় জল জমে যাওয়ায় বেচা কেনার সম্ভাবনা না দেখে তাড়াতারি বন্ধ করে দিয়েছিল। রাস্তা অন্ধকার, দুর্যোগ তাই সঙ্গে থাকা মেয়েদের একা না ছেড়ে দিয়ে, দলের ছেলেরা পৌঁছে দেবে ঠিক করেছিল। যেহেতু ঈশান আর সোহাগ দুজনেই হোস্টেলে ফিরবে, তাই দুজনে একসাথে ফেরার পথ ধরল। এমনিতে তারা দুজন নানা বিষয়ে সবসময়ই বক্বক্ করে, সে বিটোফোনের সিম্ফনি হোক, সান্দাকফুতে ট্রেকিং এর ভাবনা-ই হোক কিংবা মৌমাছি চাষ করে গ্রামীণ মহিলাদের স্বনির্ভরতা প্রকল্পের ব্লু প্রিন্ট, যা হোক কিছু একটা নিয়ে ওদের কথা কখনো ফুরোতেই চায়না। কিন্তু সেদিন কি অজ্ঞাত কারণে দুজনের কারো মুখেই কোনো কথা ছিল না। আর তাই, জমা জলে তাদের পা ফেলার শব্দটাই বেশী করে কানে বাজছিল। সেই শব্দে তৈরী হওয়া ছন্দ ভেঙে মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল ব্যাঙ, আর ঝি ঝি পোকারা সবসময়ই যোগ্য সঙ্গত করে চলছিল, মাঝে মাঝে দুই একটা সাইকেলের বেল ছাড়া রাস্তাতেও কোনো মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ-ই সামনে ভেঙে পড়া একটা গাছের ডাল দেখতে না পেয়ে; সোহাগ হোঁচট খায়, আর ও হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার আগেই ঈশান ধরে ফেলে ওকে। জলকাদার মধ্যে সোহাগের আচমকা পতন আটকে দিতে পেরেছিল ঈশান, ওকে হাত ধরে টেনে নিয়েছিল। কিন্তু হোঁচট সামলে ওঠার পরও ওর হাতটা ছাড়েনি সে, বরং আরো শক্ত করে চেপে ধরেছিল। হয়ত ঐ দৃঢ় হয়ে চেপে বসা হাতের মুঠির সাহায্যে, অনেক অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করতে চেয়েছিল সে। সোহাগও ছাড়িয়ে নেয়নি হাত, বরং নিঃশর্তে তা সমর্থন করে দিয়েছিল ঈশানের হাতে। হয়ত ও ও বোঝাতে চেয়েছিল, ”আমি তো তোমার কাছে সমর্পিত অনেক দিন-ই, তোমার গ্রহণ করার অপেক্ষাতে-ই জেগে আছি”। হয়ত বা সেই মুহুর্ত্তেই সোহাগের ভাবনা পড়ে ফেলতে পারল ঈশান, নেমে এল সেই অলৌকিক মুহূর্ত্ত, যা সোহাগের স্মৃতিতে জেগে থাকবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, সোহাগকে প্রবলভাবে বুকে জড়িয়ে ধরল ঈশান, এমন তীব্রভাবে চেপে ধরে যে, সোহাগের মনে হতে থাকে, সে যেন মিশে যাবে ঈশানের সঙ্গে, যেন তাদের দুজনের আত্মা পরস্পরের সঙ্গে মিশে হয়ে যাবে একটাই, তাদের যাত্রা পথ এবার ফুরিয়ে যাবে, তারা পৌঁছে যাবে অন্তিম গন্তব্যে। এভাবে তাদের এই মিলন ছিল অবশ্যম্ভাবী, কারণ ঈশান আর সোহাগ উভয়ই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, তারা পরস্পরের সোলমেট। ঈশান যেদিন রূপকথার গল্প শুনিয়েছিল সোহাগকে, সেটা শুনে সোহাগ হেসেছিল খুব সেদিন, আর জিজ্ঞাসা করেছিল, -”তুমি এ সমস্তে বিশ্বাস কর?” -”করতে ইচ্ছে করে কখনো কখনো। করলেই বা ক্ষতি কি?” ইলেকট্রন পজিট্রন যদি মিলে গেলে, বিলুপ্ত হয়ে যায়, পড়ে থাকে খানিকটা শক্তি, তবে দুজন সোলমেট মিলিত হলে ও তৈরী হবে খানিকটা শক্তি আর পড়ে থাকবে তাদের শরীর দুটো। মজার ব্যাপার হবে না?” হেসেছিল ঈশান ও খুব, হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জলও বেরিয়ে এসেছিল। তখন সোহাগ ব্যাপারটাতে এতটা গভীরে যায়নি। পরে বার বার ভেবেছে, ঈশানদার রূপকথার গল্পটা যদি সত্যি-ই সত্যি হত! আজ সেই অলৌকিক মুহূর্ত্তটাকে দাঁড়িয়ে তারা। সোহাগের মনে হত থাকল, সত্যই সে মিশে যাবে ঈশানের সঙ্গে, আর পড়ে থাকবে কেবল তার শরীর, তার আত্মার আচ্ছাদন, আর তার আত্মা পেয়ে যাবে অনন্তকালের ঘরবাড়ি। এভাবে কতক্ষণ তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ ছিল পরস্পরের সেটা দুজনের কেউই আর মনে করতে পারেনি পরবর্তীতে। কারণ সেই মুহূর্ত্তে, যখন ঈশানের শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে মিশে গেছিল সোহাগের শ্বাস প্রশ্বাস, যখন ঈশান এক পিপাসার্ত মরুভূমির মত শুষে নিচ্ছিল সোহাগের ঠোঁটদুটির নমনীয়তাকে তখন সোহাগের বাহ্যিক চেতনা বিলুপ্ত হয়ে গেছিল। ঈশানও নিশ্চয়ই বাস্তবজ্ঞান হারিয়ে ছিল, নাহলে সে-ই বা কেন ভুলে যাবে, এটা তাদের হোস্টেলে যাবার পথ, হলই বা অন্ধকার সন্ধ্যা, কিন্তু বিদ্যুতের চমকে সবকিছুই পরিষ্কারভাবে দেখা যাবে যদি জনবিরল রাস্তাতে হঠাৎ করে কেউ চলে আসে। সবথেকে বড় কথা ঈশান ভুলে গেছিল তার বর্তমান, বর্তমানের জ্যামিতিক চিত্রে তার অবস্থানের কথা। নাহলে, সেই মুহূর্তে পর্ণার কথা, তার স্থায়ী সম্পর্কের কথা সে ভুলে যায় কি করে? পর্ণাকে না ভুললে, সোহাগকে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে গ্রহণ করতেই বা পারে কি করে? কোনো সদুত্তর পায়নি ঈশান পরবর্তিতে। সেই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়, ঠান্ডা জোলো বাতাসে মাখামাখি হয়ে যে ছবির ফ্রেম তৈরী হয়ে গেল, তা তো শুধুমাত্র সোহাগের মনে নয়, ঈশানের স্মৃতিতেও গেঁথে গেল চিরকালের জন্য। কতক্ষণ পর তারা তাদের মাটিতে গেঁথে যাওয়া পা সরাতে সক্ষম হয়েছিল, কতক্ষণ পরে তাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়ির কাঁটা আবার নড়তে শুরু করেছিল, আর কিভাবে যে তারা নিজের নিজের হোস্টলে পৌঁছতে পেরেছিল সেদিন, পরে অনেক ভেবেও আর মনে করতে পারেনি তারা। তাদের জন্য সময়, সেই কালবৈশাখীর ঝড় জলে ভেজা সন্ধ্যায়, জনবিরল সেই পথে, থমকে আছে এখনও।
আজকাল কলেজ থেকে ফেরার পথে সোহাগ প্রায়শঃই সাহিলের সঙ্গে দেখা করে। ছেলেটার মধ্যে এমন একটা ফ্রেশনেস আছে যে ওর সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভালো লাগে। সবচাইতে যেটা বেশী ভালো লাগে সেটা হল ওর স্বচ্ছতা, আজকালকার দিনে যেখানে বেশীরভাগ লোকের মুখ দেখে, মুখের কথা শুনে, মনের ভেতরটা বোঝা যায় না। যেখানে সাহিলকে একজন ব্যতিক্রম বলে মনে হয় সোহাগের। বিশেষত, দৈনন্দিন জীবনে যাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয় সোহাগকে, ওর সহকর্মীরা, রাজনৈতিক দলের কর্মীরা, যে এন.জি.ও’র সঙ্গে কাজ করে তার কর্মীরা সকলেই এত একরকম, এত পরিশীলিত এবং পালিশ করা ঝক্ঝকে্ যে সেখানে আলো পড়লে প্রতিফলিত হয়ে আবার ফিরে আসে, ভেতরে ঢোকে না। ফলে ভেতরটা দেখা যায় না মানুষটার। তাই সোহাগ একটু দূরত্বই রাখে তাদের সঙ্গে; ওদের কাছে, ওদের মতই থাকে। কিন্তু সোহাগের ভেতরে এখনো যে কিশোরী বাস করে, এত শহুরে কাঠিন্য আর ঘাত প্রতিঘাতেও যে এখনো পরিণত হয়নি, সাহিলের কাছাকাছি, সে সব যেন মুক্তি পায়, বেরিয়ে আসতে পারে খোলস ছেড়ে। দেখা হলে, নানা বিষয়ে গল্প করতে করতে কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় বুঝতেই পারে না সোহাগ। আর গল্পেরও কোনো মাথা মুণ্ডু থাকে না, জটিলতা থাকে না বলে বেশ হালকা ফুরফুরে হয়ে যায় মনটা। কিন্তু সেদিন হঠাৎ-ই কথা প্রসঙ্গে এমন একটা প্রসঙ্গ এসে পড়ল, যে সোহাগ তেমনটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এমনি-ই সে শুধুমাত্র জানার জন্য জিজ্ঞাসা করেছিল, সাহিলরা বাপ ঠাকুর্দার আমল থেকেই কলকাতায় থাকে কি না? তার উত্তরে সাহিল জানায়, -আমার আব্বা যখন খুব ছোট, তখন, দাদাজি আব্বাকে নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন রাতারাতি। তার আগে বিহারের এক গ্রামে থাকতেন শুনেছি দাদাজিরা। -”কেন ? পালিয়ে এলেন কেন?” -”দেশ স্বাধীন হবার পর দাদাজি আর ওখানে থাকতে পারেননি, তার আগে দাঙ্গায় শুনেছি, আমার দাদি ওখানেই মারা যান। আব্বাকে বাঁচানোর জন্য তাই দাদাজি ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। -”কিন্তু স্বাধীনতার পর তো আর বিহারে দাঙ্গা হয়নি। তাহলে তোমার দাদাজি পালিয়ে এলেন কেন?” -” সে অনেক কথা। আমি আব্বার কাছে শুনেছিলাম। দাদাজি বলেছিলেন আব্বাকে। কিন্তু সে সব কথা তোমার শুনতে ভালো লাগবে না।” -”ভালো না লাগলেও শুনব আমি। দুনিয়ার সব কিছু ভালো লাগে না কি? তুমি বল সাহিল।” -”জোর করছ যখন বলছি। খারাপ লাগলে আমার কিন্তু কোনো দোষ নেই।” -”না রে বাবা! তোমাকে দোষ দেব না, বল না তুমি।” সাহিল বলতে শুরু করে। -”আমার দাদাজি তো কংগ্রেস কর্মী ছিলেন, গান্ধীজির অন্ধ ভক্ত। দাদি গ্রামের মেয়েদের নিয়ে চরকা কাটতেন শুনেছি। তারপর যখন মুসলিম লীগ হলো, আমাদের গ্রামের কিছু মাতব্বর যারা লীগে যোগ দিয়েছিল, দাদাজিকে দলে টানার খুব চেষ্টা করেছিল। দাদাজি কিন্তু কোনোমতেই ওদের দলে যোগ দেয়নি। উল্টে তার বিরোধিতা করেছিলেন।” -”তারপর?” -”আমাদের গ্রামের প্রায় সবাই মুসলিম ছিলো, হাতে গোনা কয়েকঘর মাত্র হিন্দু। লীগের লোকেরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে সবাইকে দলে টানার চেষ্টা করতে লাগল। তারা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে লাগল, পাকিস্থান হলে মুসলমানদের কোনো কষ্ট থাকবে না, ওদেশে গিয়ে সবাই বাদশা হয়ে যাবে। আর পাকিস্থান তৈরী করতে পারে শুধু মুসলীম লীগ, তাই যেন তারা সকলে লীগের পক্ষেই থাকে।” -”মানুষ বিশ্বাস করল, পাকিস্থান হলে কারো আর দুঃখ কষ্ট থাকবে না? -”সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝানো খুব সোজা, জানো না? বেশীর ভাগ মানুষ-ই লীগের নেতাদের দেখানো স্বপ্নে বিশ্বাস করতে শুরু করে দিল। আমার দাদাজির তো গ্রামের মানুষের ওপর বেশ ভালো প্রভাব ছিল, দাদাজি তখন বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে মানুষকে বোঝাতে লাগলেন, ওদের কথাতে বিশ্বাস না করতে। কারণ পাকিস্থান কিছুতেই হতে পারেনা, দেশ ভাগ অসম্ভব ব্যাপার।” -”দেশভাগ তো হল! উনি কিভাবে এত নিশ্চিত হয়েছিলেন, যে দেশভাগ হবে না?” -”গান্ধিজী তো তখন বলেছিলেন, দেশভাগ হতে হলে তাঁর মৃতদেহের ওপর দিয়ে হতে হবে। কাজেই দাদাজি কেন, সব কংগ্রেস কর্মীই বিশ্বাস করেছিলেন সেই কথা। গান্ধিজীর কথা কখনো মিথ্যা হতে পারে, সে কথা কেউ কি ভাবতে পারে? দাদাজি ও পারেননি। দাদাজি তো শুধু আমাদের গ্রামে নয়, পাশাপাশি অনেক গ্রামে ঘুরেই প্রচার করেছিলেন এই কথা।” -”তারপর?” -”তারপর আর কি? এমনিতেই দাদাজি লীগ নেতাদের চক্ষুশূল ছিলেন, তারপর যখন সত্যি সত্যিই দেশভাগ হল, পাকিস্থান তৈরী হল, মানুষের টিট্কারিতে দাদাজির পক্ষে সেখানে থাকা অসম্ভব হয়ে গেল; একেবারে উভয়সঙ্কট।” -”মানুষের টিট্কারি কেন?” -”হবে না? পাকিস্থান হয়ে যাবার পর হিন্দুরা বলতে লাগল, দেশভাগ করে মুসলমানদের আলাদা দেশ তৈরী করে নেবার পরও কেন এদেশে পড়ে আছে? আর মুসলমানরা বলতে লাগল, পাকিস্থান ও হল, আর গান্ধিজীও বহাল তবিয়তে বেঁচে রইলেন, তাহলে মিথ্যাবাদী কারা? শুধু আমার দাদাজি একা নয়, দাদাজির মত আরও যারা মুসলিম কংগ্রেস কর্মী ছিলেন, যেসব সাধারণ মুসলিম মানুষজন ছিলেন যারা আলাদা দেশ চাননি, শুধুমাত্র ভারতের স্বাধীনতা চেয়ে ছিলেন, যারা ভারতকেই নিজেদের দেশ বলে মেনে এসেছেন, তাদের প্রত্যেকের অবস্থাই খুব কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। বলতে গেলে একঘরে হয়ে গেছিল তারা। সেইজন্য দাদাজি সামান্য টাকায় জমি জায়গা ভিটে বেচে দিয়ে আব্বাকে নিয়ে কলকাতায় একরকম পালিয়েই চলে আসেন। একটানা এতক্ষণ কথা বলে সাহিল হাঁপিয়ে উঠেছিল বোধহয়, নিজের না-দেখা অতীত হলেও, ব্যাপারটা নিয়ে ওর দুঃখ বোধ থাকাটা স্বাভাবিক। সোহাগ বোঝে, সাহিলের দাদাজি অনেক দুঃখে আর অভিমানে নিজের অতীত থেকে পালানোর জন্য-ই ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তিনি আরও চেয়েছিলেন হয়ত, সাহিলের আব্বা বা তার উত্তরসূরীদের ওপর এই সবের প্রভাব না পড়ুক। তারা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে মাথা উঁচু করে বাঁচুক। কিন্তু সাহিলের দাদি-কিভাবে দাঙ্গায় মারা গেলেন, সেটাও জানতে ইচ্ছে করে তার। তাই আবার জিজ্ঞাসা করে, -”কিছু মনে না করলে আর একটা কথা বলবে?” -”না, না, মনে করব কেন? কি কথা বলব বল?” -”তোমার দাদি যে দাঙ্গায় মারা গেছিলেন বললে, সেটা কখন?” -”সে কথাটা কি শুনতেই হবে?” -”না, অসুবিধা থাকলে বোলো না। আসলে এই সব কথাগুলো তো সবসময় বইয়ে পড়েছি। কখনো কোনো মানুষকে পাইনি যাদের সঙ্গে সরাসরি এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেই জন্য জানতে চাইছি।” -”না আমার বলতে কোনো অসুবিধা নেই। তোমার ভালো লাগবে না শুনে, তাই বললাম। তাহলে চলো একটু বসি।” বাসযাত্রীদের জন্য তৈরী প্রতীক্ষালয়ের বেঞ্চে এসে বসে ওরা। সাহিল শুরু করে। -”এই ঘটনাটার কথা দাদাজির কাছ থেকেই শুনেছি আমি। একবার না অনেকবার। ছোটবেলায় বুঝতাম না তো, বারবার দাদাজির কাছে বায়না করতাম দাঙ্গার গল্প, দাদির মারা যাবার গল্প বলার জন্য। এখন বুঝি, না বুঝে ওনাকে কত কষ্ট দিয়েছি আমি! যতবার উনি আমাকে গল্পটা করেছেন, ওনার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে, সেই দুঃসহ স্মৃতি।” সাহিল একটু সময় চুপ করে থাকে। দাদাজিকে না বুঝে দেওয়া কষ্টের জন্য ও নিজেও কষ্ট পাচ্ছে বোঝে সোহাগ। আলতো করে ওর কাধে হাতের ওপর তাই রাখে নিজের হাতটা। সোহাগের স্পর্শে সম্বিত ফিরে প্রায় সাহিল, তারপর বলতে শুরু করে। -”নোয়াখালিতে দাঙ্গা হয়ে যাবার পর, নানান জায়গা থেকেই দাঙ্গার খবর আসছিল, দাদাজিদের গ্রামে। কিন্তু উনি এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা-ই ঘামান নি, ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, কারণ ওদের গ্রামে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল। দাদাজির কাছে, আব্বার কাছে শুনেছি, আমাদের ঐ গ্রামের বাড়িতে অনেক হিন্দুর ছেলে, খেয়ে পরে বড় হয়েছে। কিন্তু দাঙ্গাবাজরা এসেছিল বাইরে থেকে। একদিন রাতে হঠাৎ করে তারা এসে গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল, আর মুসলমানদের বাড়িগুলোর দরজা ভেঙ্গে ঢুকে, তাদের মেরে, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।” একটু চুপ করে সাহিল। তারপর বলে, -”কিন্তু আমাদের গ্রামের বাড়ির দরজা, দাঙ্গাবাজদের আর কষ্ট করে ভাবতে হয়নি।” -”কেন?” -”যেসব হিন্দুর ছেলেরা দাদাজির বাড়িতে থেকে খেয়ে পরে, পড়া শোনা শিখে বড় হচ্ছিল, তাদের কেউ-ই দরজা খুলে, দাঙ্গাবাজদের ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করেছিল।” -”তারপর ওরা তোমার দাদিকে মেরে ফেলল?” -”না। ওরা বাড়িতে ঢুকে সামনে পেয়েছিল আমার আব্বার বড় ভাইকে। তলোয়ারের এক কোপে তার ধড় থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে দিয়েছিল। আর দাদি সম্মান বাঁচাতে, বাড়ির কুয়োতে ঝাঁপ দিয়েছিল। দাদাজি আব্বাকে বাঁচানোর জন্য, তাকে নিয়ে পালিয়ে গেছিল।” সাহিল চুপ করে যায়। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে দুজনের মধ্যেকার। সোহাগের হাত যদিও সাহিলের হাতের ওপর রাখা, তবুও তার মনে হতে থাকে, যেন তাদের মধ্যেকার দূরত্ব অনতিক্রম্য, কারণ, তারা দুজন যেন এখন তার বর্তমানকালের বাসিন্দা নয়, দুজনেই চলে গেছে অতীতে; যেখানে একজন অত্যাচারিত আর অন্যজন অত্যাচারী সম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়া কিছু নয়। পূর্বপুরুষদের কৃতকর্মের সমস্ত দায় যেন সেই মুহূর্ত্তে বর্তায় সোহাগের ওপর, আর তাই, সাহিলের সামনে সে ভীষণ ছোট হয়ে যায়, লজ্জিত বোধ করতে থাকে। সোহাগ যেন সেইসব হিন্দুর উত্তরাধিকার বহন করছে যারা পাকিস্থানে যেতে অনিচ্ছুক একজন দেশপ্রেমী মুসলিমকে যন্ত্রণা দিয়েছে শুধুমাত্র মুসলমান বলে, কিংবা সেইসব হিন্দুর ছেলেদের যারা মুসলমানের অন্নে প্রতিপালিত হয়ে, তাদের সঙ্গে বিশ্বসঘাতকতা করেছে, অথবা সেই ঘাতক হিন্দুটির, যে বাবা মায়ের সামনে তলোয়ারের এককোপে মাথা কেটে ফেলেছে সন্তানের, শুধুমাত্র মুসলিম বলে। একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে, পূর্ব পুরুষদের সব পাপ সোহাগের ওপর-ই যেন বর্তায়। এত পাপের ভারে সে যেন তার মুখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারেনা, সাহিলের দিকে। শুধু শক্ত করে চেপে ধরে সাহিলের হাত। যেন স্পর্শ দিয়ে সে বলতে চায়, -”আমি তোমার সঙ্গে আছি সাহিল। আমার ধর্মের মানুষের কাজের জন্য, তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি আমি।” কিছুক্ষণ দুজনেই নির্বাক থাকার পর, সাহিলই নীরবতা ভেঙ্গে বলে,- ”চলো, ওঠা যাক।” সোহাগ কিছু বলে না, যন্ত্রচালিতের মত হাঁটতে থাকে সাহিলের পাশে পাশে।
পাপ! সত্যিই ভীষণ পাপ হয়ে যাচ্ছে। পর্ণার বিপদ এখন কেটে গেছে ঠিকই, কিন্তু যদি কিছু হয়ে যেত, তবে তো এই পাপের বোঝা সারাজীবন বইতে হত। নার্সিং হোমে, অচেতন পর্ণাকে দেখে ফেরার সময়, এই ভাবনাটা-ই মাথায় আসে ঈশানের। ব্যাপারটার সূত্রপাত হয়েছে যখন থেকে সে বাইরে পড়তে যাবার ব্যাপারে ভাবতে শুরু করেছে। ঈশানের ইচ্ছার কথা জানা মাত্রই পর্ণার মুখ গম্ভীর, কোনোমতেই ও ঈশানকে কাছ ছাড়া করতে চায়না। পর্ণার বিশ্বাস, একটা মানুষকে ভালোবাসার অর্থ তাকে পুরোপুরি অধিকার করে ফেলা; এমন ভালোবাসায় যে দমবন্ধ হয়ে যায়, সে কথা ও বুঝতেই পারে না। দুটো আলাদা মানুষ, ভালোবাসার টানে কাছাকাছি আসলে ও, তারা আলাদা-ই থাকে, তাদের পছন্দ অপছন্দ খুশী, স্বপ্ন, গন্তব্য সব কিছু-ই আলাদা থাকে। সেইগুলোকে পূরণ করতে না দিলে, মানুষটা তার নিজস্বতা হারায়, দম দেওয়া পুতুলে পরিণত হয়। তাই প্রেমের সম্পর্ক হোক বা বন্ধুত্ব, দুজন মানুষের মধ্যে, কিছুটা ফাঁকা জায়গা থাকাটা জরুরী। ধরে রাখলে কেবল হাতেই ধরা যায়, কিন্তু ছেড়ে দিলে, তবে-ই তার পুরোটা পাওয়া যায়। একথা পর্ণাকে বোঝানো যায়নি কখনো, আর যাবে ও না। কারণ এটা মানুষের নিজস্ব উপলব্ধি বাইরে থেকে বুঝিয়ে দেওয়া যায়না কাউকে। ছোটোখাটো ঝামেলা এড়ানোর জন্য, ঈশান তাই সব কথা পর্ণাকে বলেনা সব সময়। এই যেমন, পোস্ট ডক্টরেট ফেলোশিপের জন্য যে ও বিদেশে অ্যাপ্লাই করেছে সে কথা পর্ণাকে বলেই নি। নাহলে প্রথম থেকেই ও এমন একটা কান্ড শুরু করবে যে ঈশানের যাওয়ার ইচ্ছাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এই সময়গুলোতে সোহাগকে ভীষণ মিস্ করে সে। কারণ সে, বা তার পরিবারের কেউ কখনও ভাবেই নি, সায়েন্টিস্ট হবার কথা। ঈশান ভাবত, পড়াশোনা শেষ করে গবেষণা করবে, তারপর কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর চাকরি নেবে। সোহাগই প্রথম তার ডানায় এঁকে দিয়েছিল উড়ানের স্বপ্ন। -”তুমি যদি বিজ্ঞানী না হও, তাহলে কে হবে বলতো ঈশানদা! আমার ইচ্ছা, তুমি এদেশ থেকে পি.এইচ.ডি করে, বাইরের কোনো ভালো ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করবে, পোস্ট ডক্টরেট করবে, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হয়ে কাজ করবে। তোমার গবেষণাপত্রের সুবাদে সবাই তোমাকে চিনবে, আমার তখন খুব আনন্দ হবে।” -”আর তুই কি করবি? তোর অ্যাম্বিশান টা শুনি?” -”আমি তো ছাপোষা মাষ্টারনি হব, কলেজ বা স্কুলের। আমি তো তোমার মত এত ব্রিলিয়ান্ট না। তবে আমার তো অন্য স্বপ্ন আছে জানোই, সমাজ বদলানোর স্বপ্ন।” হেসে ফেলে সোহাগ। ঈশান ও হেসেছিল খুব। হাসলে সোহাগকে খুব সুন্দর দেখাত। মনে পড়ে যায় ঈশানের, ভীষণ নিষ্পাপ হাসি ছিল ওর। মনের ভেতরটা হু হু করে ওঠে ঈশানের। এই যে ফেলোশিপ নিয়ে ফ্রান্সে যাচ্ছে সে, এই খবরটা সোহাগ জানলে কী ভীষণ খুশী হত! হয়ত ঈশানের চেয়েও বেশী খুশী হত সে। কিন্তু জানানোর সব রাস্তাই তো নিজের হাতে বন্ধ করে দিয়েছে সে নিজেই। ঈশান নিজে হাতেই তো সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে সোহাগের সঙ্গে। হয়ত বাধ্য হয়েই করতে হয়েছে, তবু তো করেছে! এটা তো সম্পূর্ণ তার নিজের ব্যর্থতা। নিজের জীবনের রাশ নিজের হাতে সে রাখতে পারেনি। সোহাগকে সে সবচাইতে বেশী দুঃখ দিয়েছে, সুতরাং আর সামনে গিয়ে তার দাঁড়ানো যায় না, বলা যায় না-”আমি মেরুদণ্ডহীন মানুষ সোহাগ, আমাকে ক্ষমা করে দে তুই।” কিন্তু এটাও মনে মনে বিশ্বাস করে ঈশান, যদি একবার সে গিয়ে দাঁড়াতে পারে সোহাগের সামনে, যদি একবার বলতে পারে, ”প্রতিদিনের অশান্তির চাপ আমি আর নিতে পারিনি সোহাগ, তাই তোকে অ্যাভয়েড করতে চেয়েছিলাম। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম, পরস্পরের থেকে দূরে থাকলে আমাদের দুজনেরই ভালো হবে তাই তোকে ঐ কথা বলেছিলাম,” তাহলে সোহাগ ঠিকই বুঝবে তাকে! তবু বলা হয়নি কখনো। ফেলোশিপ পাওয়ার পর পাসপোর্ট, ভিসা সব রেডি করে তবে পর্ণাকে বাইরে যাবার ব্যাপারটা জানিয়েছিল ঈশান। ঈশানের ডক্টরেট হয়ে যাবার পর, পর্ণা চাইছিল, ও চাকরিতে জয়েন করুক, আর বিয়েটা করে নিক। কিন্তু ঈশান বিয়ের ব্যাপারে একটু সময় চাইছিল নিজেকে ভালো করে বোঝার জন্য। কারণ তার মন চাইছিল না নিজেকে এবং পর্ণাকে ঠকাতে। ঈশান ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল তাকে বিয়ে করে পর্ণা কখনোই সুখী হবে না। সে কথা পর্ণাকে বলতে গেলেই বা অন্যভাবে রিঅ্যাক্ট করেছে, -”আমার সুখের ভাবনা তুমি আমাকেই ভাবতে দাও। তোমার এত চিন্তা না করলেও চলবে। আসলে তুমি নিজেই চাওনা সম্পর্কটা নিয়ে এগোতে। আর চাইবে-ই বা কেন বল, তোমার তো আবার সোহাগ আছে।” কথা আর এগোতে পারেনি। কারণ পর্ণার মুখে, সোহাগের নাম উচ্চারিত হলে, সেটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত লাগে ঈশানের কাছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ঈশান। পর্ণার সঙ্গে বাদানুবাদ আরো না বাড়ানোর জন্য-ই। পর্ণা ও আসে পেছন পেছন। -”রাগ করলে?” -”নতুন করে আর রাগ করার কি আছে? একথা তো তুমি আজ প্রথমবার বলছ না! তুমি চাওনা বলে, তোমার কথা রাখার জন্য মেয়েটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি আমি, সম্পর্ক রাখিনা, তবু ও তুমি ওর কথা বলা বন্ধ করতে পারলে না!” -”সরি। আসলে তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারি না তো আমি। তাই তুমি যখন ঐ কথা বললে, ভীষণ রাগ হয়ে গেছিল। কথা দিচ্ছি, আর কোনোদিন বলব না, দেখো।” ফ্রান্সে যাবার কথা যেদিন পর্ণাকে জানালো ঈশান, সে-ও সঙ্গে যাবার বায়না ধরল। রেজিস্ট্রি বিয়ে করে ঈশানের সঙ্গে-ই চলে যাবে। ঈশান শুনে ধমক লাগায়। -”কি ছেলেমানুষি করো না! আমি সারা জীবনের জন্যে যাচ্ছি?” -”সাত দিনের জন্য-ই যাও, আমিও যাব।” -”আরে আমি তো পড়াশোনার জন্য যাব, সারাটা দিন আমার ল্যাবেই কেটে যাবে, তুমি কি করবে গিয়ে?” -”আমিও একটা কিছু জুটিয়ে নেব। আর না জোটাতে পারলে বাড়িতে-ই থাকব; তবু তো তোমার কাছে থাকতে পারব। এইসব বায়না, জেদ সবসময়ই ঝগড়ায় এসে শেষ হয়। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হল না। ঝগড়ার ফলাফল অমীমাংসিত রেখেই ঈশান চলে আসে ওদের বাড়ি থেকে। ঈশান ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার দুঘন্টার মধ্যেই পর্নার মায়ের ফোন পায়, পর্ণা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছে, ওকে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছে। ঈশান যেন চলে আসে নার্সিংহোমে। পর্ণার বাবা নামকরা সার্জেন, নিজের নার্সিংহোমও আছে। সেখানেই ভর্তি করে ওর চিকিৎসা করানোতে ব্যাপারটা চাপা দেওয়া সম্ভব রয়েছে, থানা পুলিশ হয়নি। নাহলে, ভাবে ঈশান, আরো কত দুর্ভোগ যে ছিল ওর কপালে। নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে থাকা পর্ণাকে দেখে, ঈশানের বড্ড খারাপ লাগে। স্টমাক ওয়াশ করে সমস্ত বার করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু প্রেশার কমে যাওয়াতে ড্রিপ আর অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। অ্যানাস্থেসিয়ার ঘোর লাগানো চোখ দুটো খুলে একবার ও তাকায় ঈশানের দিকে, কিন্তু কিছু বুঝতে পারছে কিনা বোঝা যায় না। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। নার্স ওকে ঘুমোনোর জন্য ছেড়ে দিতে বলায়, ঈশান সহ সকলেই কেবিন ছেড়ে বের হয়ে আসে। পর্ণার মাকে দেখে ঈশান, কেঁদে কেঁদে ভদ্রমহিলার চোখ দুটো লাল টকটকে, মুখ চোখ ফুলে গেছে। এই সমস্ত কিছুর জন্য কেউ তাকে সরাসরি দায়ী না করলেও, ঈশানের নিজেকে-ই অপরাধী মনে হয়। মাথা নিচু করে, অপরাধীর মত সে বেরিয়ে আসে নার্সিংহোম থেকে। বাড়ি ফেরার পথে, একে একা ভাবতে থাকে ঈশান, পর্ণাকে বোঝানো যাবে না, কাউকে ভালোবাসতে হবে বলে ভালোবাসা, তার কাউকে ভালো না বেসে থাকা যায় না বলে ভেতর থেকে উঠে আসে যে ভালোবাসা, এ দুইয়ের মধ্যে কত পার্থক্য। যা কিছু প্রথম দেখায় ভালো লাগে, তা যে সারাজীবন ভালো লাগবে, এমন কোনো শাশ্বত সত্য ও হয়না। তাছাড়া, দুজন মানুষের পরস্পরকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে, একসাথে থাকার ক্ষেত্রে বাইরের সৌন্দর্য্যের চাইতে, ভেতরের সৌন্দর্য্য বেশী জরুরী। সোহাগের সঙ্গে সচেতন ভাবে পর্ণার তুলনা করতে না চাইলেও বার বার-ই নানা বিষয়ে আপনা থেকেই তুলনাটা চলে আসে ঈশানের মনে। যেমন, এখন এই সৌন্দর্য্যের কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ঈশানের মনে হল, পর্ণার সৌন্দর্য্যে চোখ মুগ্ধ হয়। কিন্তু চোখ বন্ধ করলে, যখন সোহাগের মুখটা ভেসে ওঠে চোখে, তখন মনের ভেতরটা জুড়িয়ে যায়, শান্ত হয়ে আসে হৃৎস্পন্দন, যেন নতুন জীবন পায় সে। সোহাগের কথা ভাবলে, ঈশানের মনে হয় যেন মাত্র কয়েক বছর আগে নয়, ওর সাথে কয়েক যুগ আসে থেকে পরিচয় তার। ওকে ভীষণ রকম কাছের মানুষ বলে মনে হয়। ওর প্রতি এমন এক অপার্থিব আকর্ষণ বোধ করে ঈশান, যে মনে হয়, জন্মজন্মান্তর ধরে যেন সোহাগকেই খুঁজে চলেছে সে। আর এ জন্মে তাকে খুঁজে পেয়েও ধরে রাখতে পারলনা বলে, তার ভীষণ রকম কষ্ট হয়। ঈশান জানে, তার এসব অদ্ভুত অনুভূতির কথা, পর্ণা কেন, কাউকেই বোঝাতে পারবে না সে। কারণ সে নিজেই বোঝে না তার যুক্তিবাদী মনে এরকম সব অলীক ভাবনা কিভাবে আসে। তাই সে কাউকে বোঝানোর কথা ভাবেও না। নিজের এলোমেলো ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে ফেলার জন্য ঈশান নার্সিংহোমে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা পর্ণাকে দেখে সংকল্প করে এবার থেকে পর্ণা যা চাইবে, তা-ই করবে সে। ওর প্রাণকে বাজীতে রেখে কোনোরকম পাশার দান খেলার অধিকার তার নেই। পর্ণা যেরকমই হোক না কেন, সে ঈশানকে ভালোবাসে, আর তাই, তাকে সুখী রাখার চেষ্টাই সে করবে সবসময়।
-”এই রিম্বিক নেক্সট মান্থে, কয়েকদিনের জন্য মুম্বাই যাচ্ছি আমি, শুনেছিস?” রিম্বিক একমনে খেলা দেখছিল, উত্তর দেয়না কোনো। সোহাগের কথাটা আদৌ সে শুনেছে কি-না বোঝা ও যায় না। এবার সোহাগ কাছে এসে ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি লাগায়, -”কিরে, আমি কি বললাম তোকে শুনলি?” -”কি বললি?” -”আমি নেক্সট মান্থ মুম্বাই যাচ্ছি।” -”আবার?” -”আবার মানে? আগে কখন গেলাম?” -”এই কদিন আগে?” -”রিম্বিক এদিকে তাকা! কদিন আগে এলাহাবাদ গেছিলাম। এবার যাব মুম্বাই, টি.আই.এফ.আর এ একটা ভালো সেমিনার আছে। বাইরে থেকেও অনেকে আসবেন। -”তোর স্যারের তো আরও অনেক স্কলার আছে। সব সময় তোকেই পাঠায় কেন সেমিনারে?” -”কি যে বলিস না! আমার টপিকের ওপর সেমিনারটা হচ্ছে, অন্য কাউকে পাঠিয়ে কি হবে? আর তাছাড়া আমি যত সেমিনারে যাব, আমারই তো ভালো। বুঝিস না।” -”তোর ভালো, কিন্তু আমার খারাপ, আমি সারাদিন ঘরে বসে একা একা পড়ব, তার তুই বাইরে বাইরে ঘুরবি, আমার জাস্ট ভালোলাগে না।’ রিম্বিকের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। সোহাগ পাশে এসে বসে, রেগে গেলি?” উত্তর দেয় না রিম্বিক। এবার সোহাগ ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে রিমোট টা নিয়ে নেয়। আর টিভিটা বন্ধ করে দেয়। -”রিমোট দে সোহাগ।” -”দেব না। আগে বল, রাগ করেছিস কি-না।” -”করেছি-ই তো! আমার বউকে আমি কোথাও যেতে দেবো না” বলে রিম্বিক কোমরটা চেপে ধরে সোহাগের। সোহাগ হাসে, হাসতে হাসতে বলে, ”তোর বউ কিন্তু এখনও হই নি, ভুলে যাস না।” -”পুরো না হলেও আধা তো হয়েছিস, আধা-বউকেও ছাড়ব না আমি। আমার সোহাগকে আমি এখন একটু সোহাগ করব”, রিম্বিক জড়িয়ে ধরে সোহাগকে। -”আরে ছাড় ছাড়, দেরী হয়ে যাবে তো।” -”কিছুতেই না।” তখনকার মত জল অন্যদিকে গড়িয়ে গেলেও। একটা কাঁটা দুজনের মনেই খচ্খচ্ করতে থাকে। সোহাগ ভাবে ‘রিম্বিক একটু বেশী পজেসিভ হয়ে যাচ্ছে তার ওপর, যেটা এখন খারাপ না লাগলেও পরে দম বন্ধ করে দেবে।” আর রিম্বিক ভাবে, সে যেমন বউ এর কথা ভেবে এসেছে এতকাল, সোহাগ সেরকম মোটে ও নয়। বড্ড বেশী কেরিয়ার কনসাস্, এরকম মেয়েরা বাইরে বন্ধু হিসাবে ভালো, কিন্তু ঘরে বউ হিসাবে খুব ভালো হবে না! সব সময় যদি নিজের কেরিয়ারের পেছনেই দৌড়য়, তবে, আমার খেয়াল রাখবে কখন! সেদিন সন্ধ্যেবেলা আয়েশারা এল সোহাগদের ফ্ল্যাটে। আয়েশা আর ইন্দ্রদা। ইন্দ্রদা মানে ইন্দ্রনীল মুখার্জ্জী তিন বছরের সিনিয়র ছিল ওদের। আয়েশার সঙ্গে ইন্দ্রদার সম্পর্ক অনেক দিনের। আয়েশার কাছের বন্ধু হবার সূত্রে সোহাগরা সবাই খুব ভালো করে, কাছের থেকে চেনে, ইন্দ্রদাকে। ইন্দ্রদা আর আয়েশার সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে ওদের দুজনের মতো বন্ধুরাও সবাই খুবই চিন্তিত ছিল। একদিকে রক্ষণশীল হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবার, অন্যদিকে খাঁটি মুসলিম আয়েশারা। শুধু দুজনের পরিবারের লোকেরাই শেষ কথা নয়, আত্মীয় স্বজন স্মপ্রদায়ের লোকজন, সবার মেনে নেওয়ার ব্যাপারটা রয়েছে। প্রথম প্রথম সবাই যেমন করে, আয়েশাও তেমন লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করত; কিন্তু সব প্রেমের ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, বাড়িতে খবর পৌঁছে দেবার জন্য কোনো না কোনো শুভানুধ্যায়ী ঠিকই পাওয়া যায়, আয়েশার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হিন্দু ব্রাহ্মণের ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে জানতে পেরে আয়েশার বাবা মা ও আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া জানাতে কসুর করেনি। মহা অশান্তি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছে আয়েশা। ইন্দ্রদা ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করার পর ছমাস এদেশে চাকরি করে, তারপর স্টেটসে চলে যায়। এবার এসেছে, একেবারে আয়েশাকে বিয়ে করে ফিরবে। আয়েশা খাতুন এবার আয়েশা মুখার্জ্জী হবে, তা-ও বাড়ি থেকে পালিয়ে, ফিল্মি কায়দায় নয়, একদম দুই পরিবারের সম্মতিতে। ওরা দুজনে এই কঠিন কাজটা, ধৈর্য্য ধরে করতে পেরেছে। তাই ওদের বিয়েটা ভীষণ আনন্দের। প্রথমে রেজিস্ট্রি হবে বিয়েটা, তারপর দুই পরিবারের একসাথে রিসেপশন। রেজিস্ট্রির দিন আর রিসেপশনে যাবার জন্য নেমতন্ন করতে এসেছে ওরা। সোহাগ দারুণ খুশী। আনন্দে জড়িয়ে ধরে আয়েশাকে। বলে, ”এই রকম একটা দিনের স্বপ্নই তো আমরা দেখতাম বল! যেদিন ভালোবাসার কাছে সমাজের প্রথাগুলো হেরে যাবে। তোরা পেরেছিস আয়েশা, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে!” আনন্দে চোখে জল চলে আসে তার। রিম্বিক ইন্দ্রদাকে বলে-”জানো তো, তোমাদের রিলেশনের কথাটা যখন জেনেছিলাম, আমরা সবাই আয়েশাকে এগোতে বারণ করতাম। পাপের কথা আজ নিজমুখে নত মস্তকে স্বীকার করছি।” হেসে ফেলে রিম্বিক। ইন্দ্র ও হেসে ফেলে রিম্বিকের বলার ধরণে। তারপর বলে, -”কেন? বারণ কেন করতিস? আমাকে কি দেখতে খারাপ?” -”সে খারাপ কি ভালো, আয়েশা বুঝবে। আমরা ওকে বলতাম যে বার বার ‘বোম্বে’ সিনেমা হয়না। আয়েশার বাবা জানলে ওকে তলোয়ার দিয়ে কচুকাটা করবে, আর তোমার বাবা মা তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র। আর ত্যাজ্যপুত্র হবার ভয়ে তুমি ওকে মাঝপথে ছেড়ে পালাবে। তাই সাবধান করতাম ওকে।” সবাই মিলে প্রাণখুলে হাসে। সোহাগ কফি বানিয়ে আনে সবার জন্য, সঙ্গে মুড়ি চানাচুর। বলে, -”আজ কিন্তু রাতে এখানেই খাবে ইন্দ্রদা। না হলে ছাড়ব না।” -”আবার খাওয়া দাওয়া ঝামেলাতে যাওয়ার কি দরকার?” ইন্দ্র বলে। ইন্দ্রর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রিম্বিক বলে, ”আরে ঝামেলায় কিছু নেই, সবাই মিলে একটা পিকনিক মত হয়ে যাবে, রান্না ও হবে, আড্ডা ও হবে, অনেক দিন জমাটি আড্ডা হয়না।” আয়েশাকে বেশ খুশী দেখায় রিম্বিকের প্রস্তাবে। বলে, সেই ভালো, তাহলে ঋষি আর তোর্সাকে ও ডাক, সারারাত আড্ডা হবে।” ঋষি আর তোর্ষাকে ফোন করার ঘন্টা খানেকের মধ্যে এক এক করে দুজনেই এসে পড়ল। তারপর বাজার, রান্না। হৈ হৈ করে হাত লাগাল সবাই। মেনু যদিও শুধু ভাত আর মাংস, কিন্তু তাতেই জমে গেল। রান্না আর আড্ডা চলল সমানতালে। ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর এমন জমাটি আড্ডা বহুদিন হয়নি। ইন্দ্রদা আবার এক ফাঁকে বেরিয়ে একটা স্কচ নিয়ে এসেছিল, বলল, ‘এটা ছাড়া সেলিব্রেশন টা ঠিক জমবে না। ধরে নে, এটা আমার ব্যাচেলরস পার্টি হচ্ছে, সেই জন্য আমার তরফ থেকে এই সামান্য অবদান।” ইন্দ্রদা যদিও ওদের থেকে সিনিয়র, কিন্তু আয়েশার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে ওদের গ্রুপটার সঙ্গে ইন্দ্রদার বন্ধুত্বের-ই সম্পর্ক। তাছাড়া, ওদের প্রেমের সংকটময় দিনগুলোতে, যখন আয়েশা প্রায় নজর বন্দী, তখন বন্ধুরাই ছিল যোগাযোগ রক্ষাকারী, ইন্দ্রদার পরিত্রাতা; কাজেই রিম্বিকদের এই গ্রুপটা ইন্দ্রনীলের খুব প্রিয়। আড্ডার মাঝে তোর্সা জিজ্ঞেস করে, -”ইন্দ্রদা তোমাদের আত্মীয় স্বজনদের কিভাবে মানালে?” -”শোন, মিয়া বিবি রাজী থাকলে কাজী কি করবে রে, মিঁয়া বিবি মানে আমার বাবা মা কে রাজী করানোটা-ই চাপ ছিল। সেটা যখন হয়ে গেল, তখন বাকি আর কোনো কিছুরই পরোয়া নেই আমার। আমার মা তো সবাই কে বলেই দিয়েছে আমার ছেলে যাতে খুশী হবে সেটাই আমি মানব; তাতে আর কে কি ভাবল, কিছু আসে যায় না আমার।” ”আর আয়েশা তোর বাবা মাকে শেষ পর্যন্ত কি করে রাজী করলি?” এবার ঋষি প্রশ্ন করে। -”আমার মা যে প্রথমে কি সাংঘাতিক ঝামেলা শুরু করেছিল, তোরা তো জানিস-ই। বাবার ততটা বিরোধিতা না থাকলেও তখন মায়ের ভয়ে আমাকে সাপোর্ট করতে পারেনি। তারপর আমি দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে বাবাকে বোঝালাম।” আয়েশা বলে। -”কি বোঝালি?” সোহাগ জানতে চায়। -”বললাম, বাবা, এখন তো লোকে হামেশাই অন্য দেশের মানুষকে বিয়ে করছে, একজন সাদা চামড়ার মানুষকে বিয়ে করলে সবাই হাসতে হাসতে মেনে নেয়, গর্বিত হয়। কিন্তু সেখানে দেখ, কত পার্থক্য, কত সমস্যা, ভাষা, কালচার, রুচি পছন্দ সব আলাদা। আর আমিতো একজন বাঙালীকেই বিয়ে করতে চাইছি। আমার আর ইন্দ্রর ভাষা, কালচার সব এক। শুধু ধর্মটাই আলাদা। তাতে কি সমস্যা বল, আমি বা ইন্দ্র কেউই তো ধর্ম অন্ত প্রাণ নই। তখন আমার মা বলল, ইন্দ্র একা কি ওদের গোটা পরিবার? ওর মা তো চাইবে, একমাত্র ছেলের বউ তার সঙ্গে পূজো পাঠে বসুক, বাড়ির ধারাটা ধরে রাখুক। তাহলে তুই ধর্ম পাল্টাবি?” -”তুই কি বললি তখন?” রিম্বিক জানতে চায়। -”বললাম, মা বিয়ে মানে কি দুটো মানুষকে একসঙ্গে জলে গুলে একটা বোতলে পুরে, ঝাঁকিয়ে মিক্সচার বানানো? ওর ধর্ম ও থাকবে আমারটা আমার। কেউ কারো নিজস্ব জায়গাগুলোতে কেন ঢুকব? আর তাছাড়া, সব হিন্দুর মেয়েই কি বউ হবার পর শাশুড়ির সঙ্গে পূজো করতে বসে? আমি মুসলিম জেনেশুনেও ইন্দ্রর মা কখনো বলবে ওনার সঙ্গে পূজোতে বসতে? সবচেয়ে বড় কথা বিয়ের পর তো আমি স্টেটসে-ই চলে যাবে, এত চিন্তার কি আছে?” -”তুই তো দারুণ লেকচার দিয়েছিস রে! এত ভালো কথা বলা কবে শিখলি?” ঋষি বলে। আয়েশা কিছু বলে না। চুপচাপ হাসে শুধু। তোর্সা বলে, -”ধর্ম-ধর্ম করে দুনিয়াটা গেল। দেখ গোটা পৃথিবীতে যত মারামারি কাটাকাটি চলছে, সবই ধর্মের নামে। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ধর্ম মানে হল, যা ধারণ করে। এখন তো দেখছি ধারণের বদলে মারণ করছে।” -”তবে আমরা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ততটা কানসার্ন নই ধর্ম নিয়ে, পরবর্তী প্রজন্ম আরো কম হবে। এই ভাবে -”ঋষি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, তারা আগেই রিম্বিক তেড়ে ওঠে। -”কোথায় রে কনসার্ন নয়? তুই কয়েকটা শহুরে লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েদের দেখে গোটা প্রজন্ম সম্পর্কে ভবিষ্যতবানী করে দিলি? তাহলে আইসিস জঙ্গীরা সারা পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যেসব আত্মঘাতী জঙ্গী হানাদাররা, বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগারকে যারা খুন করছে; ধর্মের নামেই তো তারা এসব করে বেড়াচ্ছে। তাহলে তুই কি বলতে যাস, ওরা এই প্রজন্মের নয়? নাকি এই দুনিয়ার নয়?” -”আহা, ওরা তো নিজেদের বোধবুদ্ধিতে একাজ করেনা। আমি পড়েছি, ওদের নানা রকম ওষুধ খাইয়ে, ব্রেন ওয়াশ করা হয়। ওষুধ মাদকের প্রভাবে, ওদের ব্রেন ঠিকমত কাজ করে না, উগ্রতা হিংস্রতা বেড়ে যায়।” তোর্সা বলে। -”আচ্ছা, এবারে খেয়ে নিলে হয়না, আয়েশা কাঁচুমাচু মুখে বলে। ”আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়ে গেছে। তাছাড়া তোরা যেদিকে যাচ্ছিস, সারারাতে এ আলোচনা থামবে বলে তো মনে হচ্ছে না।” -”হ্যাঁ, হ্যাঁ চল খেয়ে নিই’, সোহাগ বলল, ”তাছাড়া এখনই প্রসঙ্গ টা না পাল্টালে, রিম্বিক আর ঋষি যে কোথায় গিয়ে থামবে, বোঝা যাচ্ছে না।” খাওয়ার পরেও অনেক রাত পর্যন্ত চলল আড্ডা, রাতটা সেদিন সবাই সোহাগদের ফ্ল্যাটে-ই কাটাবে ঠিক করে এসেছিল। সোহাগ রিম্বিকের বাসা যদিও ছোটো, কিন্তু বন্ধুরা যারা এসেছিল তারা প্রত্যেকেই সুজন, তাই তেঁতুল পাতাতেও স্থানাভাব হলনা। ভোর রাতের দিকে দেখা গেল, যে যেখানে পেরেছে কাত হয়ে পড়েছে, তাতে কার পা কার পেটের ওপর আর কার হাত যে কার পিঠের নিচে চাপা পড়েছে, কোনো খেয়াল নেই। মাথার নিচে দু একজনের বালিশ রয়েছে, কারো আছে বই, কেউ বা জামাকাপড়কে পুঁটলি পাকিয়ে বেশ বালিশের কাজ চালিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ঘুমন্ত ছেলেমেয়ের গুলোর মুখের দিকে তাকালে মনে হবে ওরা দারুণ আরামে, শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। জীবনের সবচেয়ে ভাল সময়, ছাত্রজীবনের দিনগুলোতে ওরা তখন ফিরে গেছে স্বপ্ন পথে।
বাড়ি থেকে বের হয়েছে সোহাগ ভোরের আলো ভালো করে ফোটার আগেই। শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছানো দরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সেখান থেকে ট্রেন ধরে পৌঁছতে হবে লালগোলা। লালগোলায় নেমে যেতে হবে একটা গ্রামে। সেখানকার কাজ সেরে রাতের মধ্যে আবার ফিরতে হবে কলকাতায়। তাই দিনটা যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়, তত ভালো। শিয়ালদা থেকে এখন একাই যাবে সোহাগ। পথে কৃষ্ণনগর থেকে এই ট্রেনে উঠবে স্নিগ্ধাদি আর সঞ্জয়দা, ট্রেনে ওদের সঙ্গে দেখা না হবার সম্ভাবনা-ই বেশী, তাই লালগোলা পৌঁছে ওরা সোহাগের সঙ্গে দেখা করবে। লালগোলা থেকে আরও ভেতরে যে জায়গাটাতে যেতে হবে, সেটা সোহাগ তো চেনেই না, স্নিগ্ধাদিরা ও চেনে না, তাই ওদের সংগঠনের একজন স্টেশনে অপেক্ষা করবে, সে-ই নিয়ে যাবে ওদের সবাইকে। খবরটা এসেছিল দিন পাঁচেক আগে, লালগোলা লোকাল কমিটি থেকে। ভীষণ-ই অমানবিক একটা খবর, শুনে খুব খারাপ লেগেছিল সোহাগের। স্থানীয় একটি মেয়ে, নাম উমা, এবছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, তাকে তার বাবা মা মারধর করে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে। অপরাধ তার ভীষণ গুরুতর; সে কোন নির্দিষ্ট একটি লিঙ্গ নিয়ে জন্মায়নি। ছোট বেলা থেকে মা বাবা তাকে মেয়ে বলে জেনে এসেছে, সেও নিজেকে মেয়ে বলেই জানে, কিন্তু আঠার বছর হয়ে যাবার পরও যখন তার শরীর নারীত্বের বিশেষ চিহ্নগুলো প্রকাশ করল না, ঋতুমতীও হল না সে, তখন তার মা তাকে স্থানীয় হেলথ্ সেন্টারে নিয়ে আসে। সেখানেই ডাক্তারেরা উমাকে ভালো করে পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন এই সত্য। উমার নিরক্ষর মাকে ডাক্তারবাবুরা বোঝান, শরীরের যেসব অঙ্গ প্রতঙ্গ থাকলে, একটি মেয়ে মা হতে পারে, উমার শরীরে সেগুলো দিতে ভগবানের ভুল হয়ে গেছে। তাই এই মেয়ে কখনোই পুরোপুরি মেয়ে হতে পারবে না, ঋতুস্রাবও হবে না তার, আর কোনোদিন মা-ও হতে পারবে না সে। এসব কথা শুনে উমার মা হেলথ্ সেন্টার থেকে বাড়ি ফেরার সমস্ত পথটুকু একবার উমাকে একবার নিজের ভাগ্যকে শাপশাপান্ত করতে করতে বাড়ি ফেরেন। ভগবান তার পেটে হিজড়ে সন্তান না দিয়ে, তাকে সারাজীবন বাঁজা করে রাখতে পারতেন, এইসব কথা বলে তিনি বিলাপ শুরু করে দেন বাড়িতে পা রাখা মাত্র। যদিও উমা ছাড়াও তার আরও চারটে সন্তান আছে, তাই ‘হিজড়ে’ সন্তানটি না থাকলেও তিনি ‘বাঁজা’ থাকতেন না, সে কথা তিনি তখন বিস্মৃত হয়ে পড়েছিলেন। হতেই পারে, বড় বড় শোকের সময় এরকম ছোটোখাটো ভুলের কথা মাথায় রাখা সম্ভব! কত বড় একটা ধাক্কা তিনি খেয়েছেন যাতে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়াটা-ই স্বাভাবিক! যাকে এতদিন ”নিজের মেয়ে” বলে জেনে এসেছেন, তাকে হঠাৎ করে ‘হিজড়ে’ জানলে মাথা ঠিক রাখা যায়? ‘হিজড়ে’ রা তো ‘হিজড়ে’ই, তারা তো কারো সন্তান নয়, মেয়ে নয়! তারা কেবল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নয়, অন্য পৃথিবীর মানুষ! তাদের বাবা, মা, ঘর সংসার, আত্মীয়স্বজন কিছুই থাকে না, থাকতে নেই, তারা অন্য কোনো গ্রহ থেকে পথ ভুলে পৃথিবীতে এসে পড়েছে তো, তাই পৃথিবীর কোনো সম্পদে তাদের কোনো অধিকার নেই। তারা আর পাঁচটা মানুষের মত স্কুল কলেজে পড়তে পারবে না; পড়াশোনা শেষ করে চাকরী পেতে বা স্বাধীন ব্যবসা করতে পারবে না, কোনো সম্মানজনক পথে জীবিকা অর্জন করে বেঁচে থাকতে পারবে না; লোকের ব্যঙ্গ আর বক্রদৃষ্টির মধ্যে, ভিক্ষাই একমাত্র বাধ্যতামূলক বৃত্তি হবে তাদের। এতকথা উমার মা ভাবেন নি নিশ্চয়ই, কিন্তু সোহাগ ভাবে, আগে বহুবারই ভেবেছে, উমার ঘটনাটা সামনে আসার পর আবারও ভাবে। ট্রেনের চাকার সঙ্গে সঙ্গে তার ভাবনারা ও গড়িয়ে যায়। ভগবান নামক লোকটা না হয়, এই মানুষগুলোকে বানানোর সময় ঠিকঠাক জননাঙ্গ গুলো দিতে ভুলে গেছেন, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, তাদের মাথায় কিছু কোষ, মানে ছাই রঙা কোষগুলো দিতে ভুলে গেছেন! কিংবা শরীরের কোষে কোষে খাদ্য, জ্বালানী সরবরাহ করে যে পাম্পটি তার কর্মক্ষমতা কিছু কম করে দিয়েছেন! হার্ট, কিডনি, লিভার, মস্তিষ্ক একটা মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন, সেগুলো সবাই ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও, আর পাঁচটা স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মত কেন তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই, সেটা ভীষণ ভাবায় সোহাগকে। টিউমার বা ক্যানসার হওয়ার জন্য, কত মহিলারই তো ইউটেরাস, ওভারি বাদ যায় শরীর থেকে, তখন তো তাদের ঋতুস্রাব, নারীত্বের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে যে হরমোন, সবই নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়, নারী হিসাবে, সেইসব মহিলারও তো তখন অসম্পূর্ণ। কই, তখন তো সমাজ তাদের আলাদা ব্রাকেটে রাখে না? অনেক মানুষই আছেন যারা স্বেচ্ছায় যৌন জীবন যাপন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন, তাদের কি সমাজ ‘অচ্ছুৎ’ মনে করে? যেমন করে যৌন জীবন যাপনে অক্ষম এই মানুষগুলোকে? সবচেয়ে যেটা ভাবায় সোহাগকে সেটা হল, মানুষ এত কিছু নিয়ে আন্দোলন করে, পিছিয়ে পড়া শ্রেণী তক্মা লাগিয়ে এত সংরক্ষণ করে, সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর কথা ভাবে, অথচ, যেসব মানুষের গায়ে ‘হিজড়ে’ লেবেল সেঁটে, সমাজ থেকে তাদের একদম বাইরে বার করে রেখে দেওয়া হয়েছে, তাদের সকলের সঙ্গে একসারিতে বসানোর জন্য কেন কেউ কিছু ভাবে না? অন্য মানুষের মনুষ্যত্বকে এমনভাবে অমর্যাদা করার অধিকার, তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ মানুষেরা কোথায় পেয়েছে? সোহাগ নিজে সে-ই ‘স্বাভাবিক’ মানুষের সমাজের একজন প্রতিনিধি বলে, যখনই কোনো অ-লিঙ্গ ধারী মানুষ তার সামনে আসে, লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায় তার। উমার মায়ের বিলাপে, গ্রামের অন্যান্য লোকেদের জানতে দেরী হলনা ঘটনাটা, আর তাছাড়া উমার মা ব্যাপারটা গোপন করতেও চাননি; কারণ সেই মুহূর্ত্ত থেকে উমা তো আর তার মেয়ে নয়, ‘পেটের শত্তুর’, বিজাতীয় কোনো মানুষ। এক গ্রাম লোকের সামনে উমার ‘বিচার’ হল। ওর বাবা সহ গ্রামের মাথারা বিধান দিলেন উমাকে ঘর ছাড়তে হবে, গ্রাম ছাড়তে হবে। সে আসলে যে দলের মানুষ, সেখনেই চলে যেতে হবে তাকে। হিজড়েদের দলে ভিড়ে গিয়ে, তাদের মত করেই জীবন কাটাতে হবে। এটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। যে স্কুলে সে পড়ত ক্লাশ টুয়েলভে, সেখানকার হেডমাস্টারমশাই ও তাকে আর স্কুলে রাখতে চাইলেন না। এক মুহূর্ত্তে উমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল, তার এতদিনের চেনা পৃথিবী, মা বাবা, ভাইবোন, বন্ধুরা সব এক লহমায় হারিয়ে গেল তার কাছ থেকে। ওর চোখের সামনে তখন শুধু কতগুলি শবদেহের সারি, যাদের মন নেই, হৃদয় নেই। তাই তারা শুধু তার শরীরটাই দেখল, শরীরের খুঁত গুলো দেখল। শরীর পার করে যাকে যে মন, সেই মনের সন্ধান নিল না, শরীর, মন সব পেরিয়ে থাকে যে আত্মা সেই আত্মায় পৌঁছে দিল চরম আঘাত। আঠার বছর ধরে গড়ে ওঠা, ভালোবাসা মায়া মমতা দিয়ে তৈরী সম্পর্কের বন্ধনগুলো একটানে ছিঁড়ে দেবার সময়, একবার ও কেউ তার মনের অবস্থাটা বোঝো তো দূরের কথা, জানতে পর্যন্ত চাইল না। কোনোমানুষ যখন জানতে পারে তার ক্যান্সার হয়েছে, সে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন সেই ভেঙে পড়া মানুষটার পাশে এসে দাঁড়ায় তার আত্মীয় বন্ধু পরিজনরা। তাকে আশ্বাস দেয়, ভরসা যোগায়, আরোগ্য কামনা করে। এতে সেই রোগগ্রস্থ মানুষটির রোগ যন্ত্রণা না কমলেও, মানসিক যন্ত্রণা কিছুটা কমে। জীবনের আঠারটা বছর পার হয়ে যাবার পর যখন উমা জানতে পারল যে, সে স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ নয়, তখন তার মনের অবস্থা যে কি হতে পারে, সেটা সহজেই বোঝা যায়। সেই সময় তাকে আশ্বাস দেওয়া, ভরসা যোগানোর বদলে, তার পায়ের তলা থেকে মাটি আর মাথার ওপর থেকে আকাশটা কেড়ে নিল তারা, যাদের সে বাবা, মা বলে জেনে এসেছে। উমার ওপর তার পরিবার তার গ্রামবাসীর এই নির্যাতনের করুন কাহিনী ওদের গ্রাম ছেড়ে শহরেও ছড়িয়ে পড়ে। লোকমুখে সোহাগদের সংগঠনের একজন কর্মী মানসদা এই কথা জানতে পেরে উমাকে নিয়ে এসে রাখে তার মাসির বাড়ি অন্য গ্রামে। গত পাঁচদিন ধরে মেয়েটি, মানসদার মাসির গ্রামের বাড়িতে-ই আছে। কিন্তু সেখানে সারাজীবন রাখা সম্ভব নয় উমাকে, কারণ ঐ গ্রামের মানুষরা জানতে পারলে, মানসদার মাসীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, তাকে একঘরে করে দেবে, আর তাছাড়া, ওখানে থাকলে, মেয়েটার পড়াশোনাও হবে না। কলকাতায় বসে এই কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে সোহাগ ঠিক করে, উমাকে এনে নিজের কাছে রাখবে। আবার নতুন করে ক্লাশ ইলেভেনে ভর্তি করবে, যেহেতু এই বছরটা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব হবে না। মেয়েটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য যা যা করা প্রয়োজন সবটাই সে করবে ঠিক করেছে। কারণ একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে সে এতদিন যা কিছু করেছে সবটাই তাত্ত্বিক। নিজে যা বিশ্বাস করে, তা যদি নিজের জীবনে প্রয়োগ না করে তবে কিভাবে সে অন্যকে সেই কাজ করার কথা বলবে? সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন শুধু দেখলে তো চলবে না, বা সে ব্যাপারে লম্বা চওড়া বক্তৃতা দিলেও চলবে না, হাতে কলমে কাজটা করতে হবে। বাস্তব জীবনে ছোট ছোট কাজ করলে তবে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যের দিকে এগোনো সম্ভব। উমার খবরটা পাওয়া মাত্র তাই আর দেরী করেনি, উমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার ব্যাপারে মনস্থির করে নিয়েছিল। এ ব্যাপারে অবশ্য মা, বাবা আর রিম্বিকের সাথেও আলোচনা করেছিল সে। বাবা কখনোই ওর কাজে বাধা দেননি। এবারও তাই বলেছিলেন, -”জীবনটা একটা এক্সপেরিমেন্ট মা, আমি সবসময়ই চেয়েছি তুমি নিজের ইচ্ছেতে বাঁচো। তোমার মন যা বলবে, তা-ই করবে। যদি ভুল করো, ঠকে শিখবে।” আর মা-ও ওর সিদ্ধান্তে খুশী হয়েছিলেন, বলেছিলেন, ”মেয়েটাকে তোদের ফ্ল্যাটে না রেখে আমাদের বাড়ি রাখতে পারিস। তুই বাড়িতে থাকিস না, ওর কি একা থাকতে ভালো লাগবে? তার থেকে এখানে থাকলে, ওর ভালো লাগবে।” মায়ের কথায় সোহাগ খুব খুশী হয়েছিল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ”এই জন্যই তো তোমাকে এত ভালোবাসি। আগে নিয়ে তো আসি, অসুবিধা হলে তোমাদের এখানে পাঠিয়ে দেব।” রিম্বিক শুধু সাবধান করে দিয়েছিল ওকে-”দেখিস ঝামেলায় পড়ে যাস না আবার। লোকের মেয়ে তুলে আনার দায়ে থানা পুলিশ না হয়। একটা এফ.আই.আর করে যাস বরং।” সোহাগ হেসেছিল, বলেছিল, -কি যে বলিস না তুই। মেয়ে বলেই মানতে চাইছে না যারা, তারা করবে থানা পুলিশ!” ট্রেন থেকে নেমে, সবার সঙ্গে মিলিত হয়ে, একটু চায়ে গলা ভিজিয়ে নিয়ে, ভ্যান রিকশা ধরে যখন মানসদার মাসির গ্রামের বাড়িতে ওরা সদলবলে পৌঁছল তখন ভর দুপুর। গৃহস্থের বাড়ি দুপুরবেলা অতিথি এসেছে, সুতরাং ভাত খেয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক। মাসিমা কোনো কথা-ই শুনলেন না। ওরা গিয়ে পৌঁছতেই উনি জোর করে আগে ওদের হাত মুখ ধুইয়ে খেতে বসালেন। সোহাগ একটু ইতস্ততঃ করছিল। এত জন লোক একসাথে এসে গেছে, মাসিমার অসুবিধা হবে, এই সব ভাবছিল ও। মাসিমা ধমক দিলেন, – যা আছে তা-ই খাবে। সেই কোন সকালে বেরিয়েছ তোমরা, একটু ভাত না খেলে চলে? তোমরা হাত মুখ ধুয়ে আগে খেয়ে নাও, পরে কথা হবে।” আর কথা না বাড়িয়ে খেতে বসে পড়ে ওরা। সত্যিই খুব খিদে খেয়ে পেয়ে গেছিল। উমাই খেতে দিল ওদের সবাইকে। মাসিমা বললেন, সব রান্নাবান্না উমা একা হাতেই করেছে। যখন মাথা নিচু করে, ওদের পরিবেশন করছিল উমা, তখন, লম্বা, রোগা একহারা চেহারার এই কালো মেয়েটির সরল, অসহায় মুখখানা দেখে সোহাগের খুব কষ্ট হচ্ছিল। কারণ উমা তো জানে, শহর থেকে যে দাদাদিদিরা এসেছে তারা সবই তার লজ্জাকর শারীরিক খুঁতের কথা জানে। আর এ-ও জানে, তার নিজের বাবা মা তাকে এই কারণে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে। বাবা মায়ের এই অমানবিক কাজের জন্য তাদের পরিবারকে এই অপরিচিত ছেলেমেয়ে গুলোর কাছে কতটা ছোট হয়ে যেতে হয়েছে সেটা ভেবেও নিশ্চয়ই উমা লজ্জিত হচ্ছে। কিন্তু তার কোনো উপায় নেই আর লজ্জা পাওয়া ছাড়া। খাওয়া দাওয়া পর উমাকে নিয়ে বসল ওরা। সোহাগ সরাসরি তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি তো জানো উমা, কেন আমরা এসেছি, তুমি কি আমার সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে থাকবে?” উমার গলা ধরে আসে উত্তর দেবার আগেই। এই কদিন ধরে যে অমানবিক ব্যবহার সে পেয়েছে, যত অপমান সে সহ্য করেছে, তা যেন কান্না হয়ে বের হয়ে আসতে চায়, একটু সহমর্মিতা পেয়ে, একটা আশ্রয়ের আশ্বাস পেয়ে, তাই একবারের জন্য ও সে জানতে চায় না, কোথায় থাকতে হবে তাকে, সেখানে থাকার শর্ত হিসাবে তাকে কি করতে হবে, এসব সঙ্গত কথাগুলো। কারণ সে জানে, তার বাবা মা তাকে যে নরকে পাঠাতে চাইছিল তার চাইতে দুনিয়ার সব জায়গাই তার পক্ষে ভালো। কান্নাটাকে ঢোঁক গিলে নিয়ে, কোনোরকমে সে শুধু বলতে পারে, দিদি, আমি পড়া শোনা করতে চাই, মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই আর সবার মত।” সোহাগের ও ভীষণ কান্না পেতে থাকে। এরকম কত যে উমা রয়েছে চারপাশে, সবার খোঁজ তো পাওয়াও যায় না। তাছাড়া মাত্র দুটো হাতে, কতজন উমার স্বপ্নকে সে বাঁচাতে পারবে। বেলা থাকতে থাকতেই উমাকে নিয়ে বের হয়ে এল ওরা, মানসদার পরামর্শমত, স্থানীয় থানায় একটা এফ.আই.আর ও করে নিতে হল। ফেরার পথে এক এক করে দল থেকে বিযুক্ত হল মানসদা, সঞ্জয়দা, স্নিগ্ধাদি, শুধু রয়ে গেল সোহাগ। উমাকে নিয়ে এখন অনেক দূরের পথ তাকে পাড়ি দিতে হবে যে!