novel-srimati-singhi

শ্রীমতী সিংহী
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

অফিসের প্রথম অর্ধ ভিজিটরদের জন্য বরাদ্দ রাখে বিক্রম, এগারোটা থেকে একটা৷ দ্বিতীয় অর্ধ বরাদ্দ অফিসকর্মী ও টেবিলে স্তূপীকৃত ফাইলদের জন্য৷

বিক্রম সিংহের বর্তমান পোস্টিং উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরে, ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে নতুন যোগদান করেছে৷ রিফিউজি কলোনির বাসিন্দাদের অভিযোগ ও ঝামেলা দেখভাল করার জন্যই তার নিযুক্তি, তার অন্যতম কাজ প্রতি কলোনির প্রতি প্লটের মালিকানা স্থির করা৷ অতঃপর মালিকের নামে দলিল দেওয়া৷ কাজটা খুব ঝামেলার৷

ভিজিটর মানেই কিছু জটিল সমস্যা, কিছু লড়াই, কিছু মাথার যন্ত্রণা৷ প্রথমে অর্ধে মাথাটা একটু ঠাণ্ডা থাকে, পরিষ্কার থাকে, তখন লড়াই করতে সুবিধে হয়৷ আজ সকালে চেম্বরে ঢুকেই দেখল তার প্রবেশর আগেই ভিজিটরের চেয়ারে আসীন এক প্রৌঢ়৷

দৃশ্যটা পছন্দ হল না বিক্রমের৷ তার আর্দালিকে বলাই আছে সে অফিসের চেয়ারে আসীন না হওয়া পর্যন্ত কেউ যেন তার চেম্বারে না ঢোকেন৷ প্রাথামিক উষ্মা হজম করে নিজের চেয়ারে আসীান হল বিক্রম৷ একবার তেরচা চোখে মানুষটিকে দেখে প্রথমেই হাত বাড়াল জলের গেলাসের দিকে৷ এক চুমুকে গেলাস নিঃশেষ করে দ্বিতীয়বার চোখে রাখে তাঁর অভ্যিবক্তির কাঠিন্যের দিকে৷ তারপর হাতে তুলে নিল তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া টাইপ করা আরজিটি৷ স্বাক্ষরকারীর নাম বিশ্বদীপ সিংহ৷ সামনের কাঁচাপাকা চুল হালকা হয়ে যাওয়ায় বেশ উঁচু কপাল৷ পিছনের দিকের চুল একটু লম্বা৷ চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা৷ কালো রঙের মোটা ফ্রেম৷ ভাঁজ–ভাঙা শার্ট–প্যান্ট৷ কোনও বাক্যালাপ শুরু হওয়ার আগেই বিশ্বদীপ সিংহ কঠিন গলায় বললেন, ‘এটা আপনাকে আজই করে দিতে হবে৷’

বিক্রম এই প্রথম দেখছে লোকটিকে, অবাক হয়ে বলল, ‘এখনও পড়িনি আপনার আরজি৷ না পড়েই বলব আজই করে দেব৷’

সিংহবাবু একইরকম শক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘যদি না করেন, দ্যাট বিচ কখন কী করে বসবে ভাবতে পারবেন না।’

বিক্রম তখন পড়তে শুরু করেছে তিন পৃষ্ঠার আরজিটি৷

যার সম্পর্কে এই বিশেষণটি প্রয়োগ করা হল তিনি গতকাল কোর্টের রায় বেরোনোর আগে পর্যন্ত বিশ্বদীপ সিংহের স্ত্রী ছিলেন৷ বিক্রম বিস্মিত হয়ে ভাবছিল জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক কীভাবে যেন সবচেয়ে অসুন্দর সম্পর্কে পরিণত হয়৷

আরজি পড়া শেষ করেই বিক্রম সেকশন থেকে আনিয়ে নিল তাঁর সম্পর্কিত ফাইলটি৷ ততক্ষণে বিক্রম টেনে নিয়েছ মুখার্জির সামনে খোলা পেটমোটা একটি ফাইল৷ উপরে লেখা ডি বাই নাইনটিন৷ এই নম্বরটা জমির প্লটের৷ কলকাতার উদ্বাস্তু কলোনিগুলোর প্লটগুলো এরকম সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত৷ এটা দক্ষিণ কলকাতার বাঘাযতীন কলোনির একটি প্লটের বিবাদের ফাইল৷ মাত্র আড়াই কাঠার একটি প্লট৷ তবে প্রধান রাস্তার ধারে৷ দখল করার সময় চিহ্নিত হয়েছিল চিত্তরঞ্জন সিংহের নামে৷ তিনি বিশ্বদীপ সিংহের পিতা৷ চিত্তরঞ্জন সিংহ প্রয়াত হয়েছেন প্রায় দশ বছর আগে, বিশ্বরঞ্জন সিংহ তাঁর একমাত্র সন্তান, তাঁর নামেই মিউটেশন হওয়ার কথা, কোনও জটিলতা থাকার কথা নয়। জটিলতা বেড়েছে হঠাৎ বছর চারেক আগে বিশ্বরঞ্জন সিংহের আবেদনে সাড়া দিয়ে ওই প্লটের অন্যতম দাবিদার হিসেবে তাঁর স্ত্রী অবন্তিকা সিংহের অন্তর্ভুক্তির পর৷

স্বাধীনতার অন্যতম অভিশাপ দেশভাগ, লক্ষ লক্ষ পরিবার বাস্তুভিটা হারিয়ে এপারের মাটিতে আছড়ে পড়েছিল সম্বলহীন অবস্থায়৷ বেশ কয়েকটি উদ্বাস্তু সমিতি নেতৃত্ব দিয়ে কলকাতার উপান্তে ফাঁকা জমি দখল করে বিলি করে দিয়েছিল উদ্বাস্তুদের মধ্যে৷ গড়ে উঠেছিল এক একটি উদ্বাস্তু কলোনি৷ কলকাতার উত্তরে দমদম থেকে বিরাটি–নিমতা, কলকাতার দক্ষিণে যাদবপুর–টালিগঞ্জ বিশাল এলাকা জুড়ে শুধু উদ্বাস্তু আর উদ্বাস্তু৷

অসংখ্য কলোনি, অসংখ্য পরিবার৷ উদ্বাস্তু কলোনিতে প্লট বিতরণের পর প্রথমদিকে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রযোজ্য ছিল, তখনও পর্যন্ত যিনিই দখলদার তাঁর নামে ছিল প্লট৷ পরবর্তীকালে বদলে যেতে শুরু করল উত্তরাধিকারীদের জটিলতা৷ যারা দখল করেছিলেন প্লট, তাঁদের মধ্যে বহুজনই ত্যাগ করেছেন ধরাধাম৷ তাঁদের উত্তরাধিকারীরা বর্ধিত কলেবরে এখনও আছেন৷ অনেকের ছেলেমেয়েরা– কেউ চাকুরিসূত্রে, কেউ বিবাহসূত্রে প্লট ছেড়ে চলে গেলেন বাইরে৷ অনেকেই কলোনিতে বাস করব না এই ভেবে কলোনির মায়া ত্যাগ করে, বাড়িঘর করে বা ফ্ল্যাট কিনে থিতু হলেন অন্যত্র৷

মূল প্লটের উত্তরাধিকারীদের সবাইকে খুঁজে না পাওয়ায় দলিল দিতে সমস্যা হচ্ছিল৷ দলিল না দিতে পারায় তাঁরা না পারছিলেন বাড়ির প্ল্যান মঞ্জুর করতে, না পারছিলেন বাঙ্ক থেকে বাড়ি তৈরির লোন নিতে৷ দলিল দিতে যত দেরি হচ্ছিল, প্লট–হোল্ডারদের মধ্যে জমা হচ্ছিল ক্ষোভ, ফলে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল ক্রোধ৷ ক্রোধ আছড়ে পড়ছিল কলোনি কমিটির নেতাদের উপর৷ তাঁরা আবার চাপ দিচ্ছিলেন উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সমিতির নেতাদের উপর৷ তাঁরা আবার চাপ সৃষ্টি করছিলেন সরকারের উপর৷

বাংলা ও পাঞ্জাব এই দুটি রাজ্যের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল যাবতীয় ঝড়৷ পাঞ্জাবও দু–টুকরো হয়েছিল, কিন্তু সেখানে জন–বিনিময় সম্পন্ন হয়েছিল অধিকতর সুষ্ঠু ও পরিকল্পনামাফিক৷ অপেক্ষাকৃত বেশি অর্থ বরাদ্দ হওয়ায় তাদের পুনর্বাসন হয়েছিল ঠিকঠাক৷ কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে অর্থও বরাদ্দ হয়েছিল যেমন অপ্রতুল, তেমনই বিলম্বিত হয়েছিল পুনর্বাসনের কাজ৷

দীর্ঘ বছর পরে পরিবারগুলি ভেঙে খান খান হয়ে যাওয়ায় এখনকার নামে প্লট মিউটেশন হবে সেই প্রশ্নে সরকার জেরবার৷ উত্তরাধিকার আইন প্রযোজ্য করতে গিয়ে বহু সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার পর অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে প্লটে যিনি বা যাঁরা এখন আছেন, সেই দখলদারদের নামেই প্লটের মিউটেশন হবে৷

সিদ্ধান্তটি হয়তো বাস্তবানুগ৷ তার ফলে প্রায় আশিভাগ প্লটের মিউটেশন সম্ভব হলেও কিছু প্লটে এমন সব জটিলতা দেখা দিচ্ছে যে, খুবই দুরূহ হয়ে পড়ছে মিউটেশন করা৷ তেমনই একটি প্লট ডি বাই নাইনটিন৷ চার বছর আগে প্লটটির উত্তরাধিকারী হিসেবে চিঠি দেওয়া হয়েছিল বিশ্বদীপ সিংহ ও অবন্তিকা সিংহ, দুজনের নামে৷ তারপর বেশ চলছিল, তার ঠিক মাস ছয়েক পরে হঠাৎ একদিন বিশ্বদীপ সিংহ দপ্তরে এসে একটি চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, অবন্তিকাকে এখন আর কোনও সুযোগসুবিধে যেন না দেওয়া হয়, কেননা তিনি অবন্তিকার নামে বিবাহ–বিচ্ছেদের মামলা করেছেন৷ ডিভোর্সের মামলাটি চলেছে গত তিন বছর, এতদিন পরে বিশ্বদীপ ডিক্রি পেয়েছেন অবন্তিকার বিরুদ্ধে৷ এখন একটি দরখাস্ত দিয়ে বলছেন, অবন্তিকার নাম বাতিল করে ডি বাই নাইনটিন প্লটটি হবে শুধুমাত্র বিশ্বদীপ সিংহের নামে৷

ঢাউস আকারের নথিটি বিক্রম আগাগোড়া আগেই পড়েছিল, এখন আর একবার চোখ বুলিয়ে তাকায় প্রৌঢ় মানুষটির দিকে৷ নথিটি ক্রমশ মোটা হচ্ছে কেন না আদালতে মামলার গতি প্রকৃতিজনিত সমস্ত কাগজই এসে জমা হচ্ছে৷ বিশ্বদীপ সিংহের দরখাস্তটিতে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘দরখাস্তের সঙ্গে আপনি লইয়ার’স লেটার দিয়েছেন৷ ফাইল লেখার আগে কোর্টের আদেশনামাটা একবার দেখে নিই৷ আছে নাকি মূল অদেশনামাটি?’

‘না৷ এখনও হাতে পাইনি৷ তবে উকিলের চিঠিকেই আপনি কোর্টের আদেশ বলে মনে করতে পারেন৷’

উকিলের চিঠিকে গুরুত্ব দিয়ে ফাইল লেখা যেতে পারে তা বিক্রম জানে, কিন্তু…

‘তবু আমরা সরকারি অফিসার, মামলাটা গত তিন বছর ধরে চলছে, তিন বছর ধরে ফাইলে একটি বর্ণও লিখতে পারিনি কারণ আপনার স্ত্রী বার বার আমাদের দপ্তরে চিঠি দিচ্ছিলেন যেন কোর্টের মামলা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত কোনও মিউটেশন না করি৷’

মি. সিংহ বললেন, ‘এখন তো ডিভোর্স পেয়ে গেছি৷ এখন আর চিঠি দিতে কোনও অসুবিধে নেই৷ আপনি এখনই চিঠিটা দিন৷’

বিক্রম ইতস্তত করে বলল, ‘এখনই চিঠি দিতে পারছি না৷ কোর্টের আদত অর্ডারের একটা কপি এনে দিন৷ পড়ে ভালো করে বুঝি৷’

বিশ্বদীপ সিংহ কিছুটা অস্থির হয়ে বললেন, ‘আমার লইয়ারের চিঠিতে খুব স্পষ্ট করে বলা আছে কোর্টের অর্ডার৷’

বিক্রম তার সিদ্ধান্তে অনড় হয়ে বলল, ‘তবু আর দু–তিনদিন অপেক্ষা করি৷’

‘আপনি অপেক্ষা করবেন, আর তিনি এর মধ্যে হাইকোর্টে গিয়ে স্টে অর্ডার নিয়ে আসবেন৷ পুরো ব্যাপারটাই কেঁচে যাবে৷’

‘তার মানে উনি আপনাকে ডিভোর্স দিতে চাইছেন না।’

‘চাইছে না তো সেই কারণেই। যে মামলা সাতদিনে ফয়সালা হতে পারত, তিন বছর টেনে নিয়ে গেল। অনেক জ্বালিয়েছে৷ এবার আমি রেহাই চাই৷ আপনি এখনই চিঠিটা করে দিন৷ আপনি ডিকটেশন দিলে টাইপ হয়ে আসতে বড়জোর আধঘন্টা৷’

‘আপনি সরকারি অফিসের প্রোসিডিওর নিশ্চয়ই জেনে ফেলেছেন এতদিনে৷ এত চট করে ফাইলে নোট লিখে উপরওয়ালার অনুমোদন নেওয়া সম্ভব নয়৷ সময় লাগবে৷ আগের মিউটেশনে দুজনের নাম লেখা আছে৷ এখন একজনের নাম বাদ দিতে গেলে তার একটা লম্বা প্রোসিডিওর আছে৷’

বিশ্বদীপ সিংহ মানতেই চাইলেন না কথাটা, বললেন, ‘বাহ, আমিই দরখাস্ত দিয়ে আমার সঙ্গে আমার স্ত্রীর নাম যোগ করেছিলাম৷ এখন আমিই আবার বলছি অবন্তিকার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে৷ অবন্তিকার নাম বাদ দিয়ে শুধু আমার নামে মিউটেশন করুন৷ ভেরি সিম্পল৷’

‘দেখুন, মি. সিংহ, আপনি যে কাজটাকে ভেরি সিম্পল ভাবছেন, সরকারি অফিসের ভাষায় অত সোজা নয়৷ আপনাদের দুজনের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে, কিন্তু আমাদের খাতায় রেকর্ড আছে ওই প্লটে আপনারা দুজনেই বসবাস করেন৷’ বিশ্বদীপ সিংহ হঠাৎ গলা চড়িয়ে বললেন, ‘না, তিনি এখানে থাকেন না৷ আমি তাঁর নামে ডিভোর্সের মামলা রুজু করার পর তিনি এখান থেকে চলে যান৷’

‘তা হলেও স্পটে একজন অফিসার পাঠিয়ে আমাকে জানতে হবে সত্যিই তিনি সেখানে বাস করেন, না করেন না।’

বিশ্বদীপ সিংহ স্তম্ভিত হয়ে বললেন, ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?’

‘দেখুন, সরকারি অফিসে মুখের কথায় কোনও ফাইল লেখা হয় না৷ আমাকে এখন দুটো কাজ করতে হবে৷ এক, কোর্টের আদত আদেশনামার কপি পেতে হবে৷ দুই, একজন অফিসার আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখে আসবে সেখানে এখন কে বা কারা বসবাস করেন৷ তারপর ফাইল লেখা শুরু হবে৷’

বিশ্বদেব সিংহ কিছুক্ষণ জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, ‘আমি জানি অবন্তিকা মাঝেমধ্যে আপনাদের অফিস আসে, সুকৌশলে আপনার অফিসের সবার সঙ্গে একটা র‍্যাপো করে নিয়েছে৷ এখন বলুন তো, কত টাকা চাইছেন আমার কাছ থেকে?’

বিক্রম একটা ঝাঁকুনি খেয়ে গেল, কিছুক্ষণ প্রৌঢ়ের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আপনি ভুল করছেন৷ সব মানুষকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না৷ আমরা পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে এসেছি৷ এখনও মূল্যবোধ নষ্ট হতে দিইনি৷ স্যরি, আপনাকে অনেক বেশি সময় দিয়ে ফেলেছি৷ আপনি এখন আসুন৷ কোর্টের রায় না দেখা পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসব না৷ দু–একদিনের মধ্যে আমাদের একজন অফিসার আপনার বাড়ি গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে আসবেন এখন আপনার বাড়িতে কে কে বসবাস করছেন৷ ঠিক আছে, এখন আপনি আসতে পারেন৷’

বিশ্বদেব সিংহ জ্বলন্ত চোখে ডঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘আদালতের রায় না মানা হলে আপনার কনটেম্পট অফ কোর্ট হতে পারে৷’

বিশ্বদীপ সিংহ চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মুহূর্তে বিক্রম বেল বাজিয়ে আর্দালিকে ডেকে বলল, ‘চ্যাটার্জিবাবুকে ডেকে আনো তো৷’

মিনিট তিনেকের মধ্যে চ্যাটার্জিবাবু হাসি–হাসি মুখে ঢুকলেন বিক্রমের চেম্বারে, বললেন, ‘স্যার, তা হলে আপনার চেম্বারে সিংহের প্রবেশ ঘটল!’

চ্যাটার্জিবাবুর কথার মধ্যে একধরনের হিউমার থাকে তা ক’দিনেই বুঝে নিয়েছে বিক্রম৷ বলল, ‘আপনি বহু পুরোনো অফিসার, আপনি তো জানেন কেসটা৷’

বলে উকিলের চিঠিটা তাঁর দিকে এগিয়ে বলল, ‘প্লটটায় একবার গিয়ে দেখে আসতে হবে অবন্তিকা সিংহ ওখানে এখনও বাস করছেন কি না৷’

চিঠিটায় একবার দ্রুতপঠন দিয়ে চ্যাটার্জিবাবু হেসে বললেন, ‘কী সর্বনাশ আপনি ওই বাড়িতে আমাকে যেতে বলছেন! একবার গেলে আর পৈতৃক প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব?’

বিক্রম অবাক হয়ে বলল, ‘কেন খুব ডেঞ্জারাস লোক?’

‘উনি কিছুটা ডেঞ্জারাস, কিন্তু আরও বিপজ্জনক ওর বাড়ির কুকুরটা৷’

‘কুকুর!’

‘হ্যাঁ৷ ওঁর বাড়িতে একখানা বিশাল অ্যালসেশিয়ান আছে৷ আমি তা না জেনেই ওঁর বাড়ির কলিং বেল টিপেছি৷ উনি খুলে আমাকে দেখে সোফায় বসতে বলে কী কাজে ভিতরে গেছেন, অমনি ভিতরে থেকে একটা রয়াল বেঙ্গল সাইজের আলসেশিয়ান হাঁই হাঁই করতে করতে এসে সোজা দু’পা তুলে দিল আমার দুই কাঁধে৷’

বিক্রম আঁতকে উঠে বলল, ‘সে কী!’ ‘আমি তখন এক ভয়ংকর মৃত্যুর প্রতীক্ষায় মুহূর্ত গুনছি, যে কোনও সময় আমার মুণ্ডুটা মুখের মধ্যে পুরে নিতে পারে৷ একটু পরেই মি. সিংহ এ ঘরে এসে বললেন, অ্যাই ম্যাকবেথ, এদিকে এসো৷ উনি আমাদের গেস্ট৷ কিন্তু তাতেও কুকুর নামল না দেখে আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, ও কিছু করবে না৷ আপনার সঙ্গে ভাব করতে চাইছে৷’

বিক্রম অবাক হয়ে বলল, ‘ম্যাকবেথ!’

চ্যাটার্জিবাবু হেসে বললেন, ‘উনি ডাকলেন ম্যাকবেথ নামে৷’

বিক্রম বলল, ‘ডেঞ্জারাস৷’

চ্যাটার্জিবাবু বললেন, ‘আমি বললাম, কিন্তু আমার এখন ওর সঙ্গে ভাব করার কোনও ইচ্ছে জাগছে না৷ আপনি যদি দয়া করে ওকে নিয়ে অন্য ঘরে বেঁধে রেখে আসেন তো বেঁচে যাই এ যাত্রা৷ তাতে উনি দয়া করে উঠে কুকুরটাকে নিয়ে পাশের ঘরে রেখে এসে বললেন, ও ভালো লোকদের কিছু করে না৷ তবে দুষ্টু লোকদের যম৷’

বিক্রম হাঁ হয়ে গিয়ে বলল, ‘অদ্ভুত তো!’

‘আমি বললাম, তা ও কী করে বোঝে কে ভালো লোক, কে মন্দ লোক? শুনে মি. সিংহ হাহা করে হেসে বললেন, বুঝতে পারে৷ সেরকমই ওকে ট্রেনিং দেওয়া আছে৷ অবশ্য ট্রেনিং আমি দিইনি৷ আমি জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম, তা হলে কে ট্রেনিং দিয়েছে? তিনি সে প্রসঙ্গে না গিয়ে হাতের একটা ফাইল খুলে সমস্ত কাগজপত্র বিছিয়ে বললেন, নিন, কী তথ্য চাই আপনার বলুন৷ প্লটের দখল নেওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত ইতিহাস ও নথি রেখে দিয়েছি সাজিয়ে৷’

‘তারপর পেলেন সব রেকর্ডস?’

‘তা পেয়েছি৷ কিন্তু ওঁদের রেকর্ড তো রোজই পরিবর্তমান৷ আপনি নিশ্চয় নথিটা ভালো করে পড়েছেন৷ আপনি তো সিংহকে দেখলেন, খুব শিগগির সিংহীকেও দেখতে পাবেন৷’

চ্যাটার্জিবাবুর কথার স্বরে অনুচ্চারিত থাকলেও সিংহী কে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি৷ তবু নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসা করল, ‘সিংহী বলতে কাকে বোঝালেন?’

‘মিসেস সিংহ৷ দুজনের মধ্যে খারাখারি যথেষ্ট হলেও একটা বিষয়ে দুজনের খুব মিল৷’

‘কী মিল?’ বিক্রম উদ্বিগ্ন৷

‘একজন যেদিনই আমাদের অফিসে আসেন, সেদিনই বা পরের দিন অন্যজনও উপস্থিত হবেন৷’

‘কাকতালীয়?’

‘না মনে হয়৷ সম্ভবত দুজন দুজনের উপর নজরদারি করেন৷ কে কী জন্য এসেছেন অফিসে, কোন মতলব নিয়ে, তা জেনে ফেলে তার মোকাবিলা করতে আসেন অন্যজন৷’

বিক্রম কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘তাঁদের কোনও নিকট–আত্মীয় এটা করতে পারেন৷ যিনি দুজনের সঙ্গেই যোগাযোগ রেখে চলেন,অথচ দুজনকেই তা বুঝতে দেন না৷ অখবা…’

‘অথবা?’ চ্যাটর্জিবাবু নতুন আধিকারিকের অনুমানশক্তি বুঝতে চাইছিলেন৷

‘এই অফিসের কেউ আছেন যিনি দুজনকেই ভালোমতো চেনেন বা দুজনের সঙ্গেই যোগাযোগ আছে৷’

চ্যাটার্জিবাবু একটু গুম হয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘হতেও পারে৷ না হলে কী করে একজনের আসার খবর পেয়ে যাচ্ছেন অন্যে!’

বিক্রম ফিরে এল তদন্তের প্রসঙ্গে, বলল, ‘তা হলে ওই খবরটা নিতে হবে৷ মিসেস সিংহ ওখানে বাস করছেন কি না।’

চ্যাটার্জিবাবু তাঁর চেম্বারে ফিরে যাওয়ার আধঘন্টা পরে বিক্রমের চেম্বারের দরজা ঠেলে মুখ বাড়ালেন এক মহিলা, ‘ভিতরে আসতে পারি?’

বিক্রম হ্যাঁ বলতে যিনি ভিতরে ঢুকে এলেন তাঁকে সুন্দরী বললে কম বলা হবে৷ চোখে রোদচশমা থাকায় প্রকৃত বয়স একটু অন্তরালে৷ তাঁর গায়ের রং উজ্জ্বল রোদরঙের, মাথায় কোঁকড়াচুলের রাশি, পরনে ঘন সমুদ্র রঙের শাড়ি–ব্লাউজ। তাতে গায়ের রঙের উজ্জ্বলতা আরও বহুগুণ বর্ধিত৷ দোহারা স্লিম চেহারা বলে বয়সটা ধরে রেখেছেন। যার ফলে বত্রিশ থেকে বাহান্ন, যা কিছু হতে পারে তাঁর বয়স৷ ঠোঁটদুটো অস্বাভাবিক লাল৷ লালতম লিপস্টিক পরার কারণেই৷

মহিলা ঘরে ঢুকে চেয়ারের কাছে গিয়ে বললেন, ‘বসছি’৷ পরক্ষণে বললেন, ‘আমার নাম অবন্তিকা সিংহ৷ বাঘা যতীন কলেনিতে বাস করি৷ নিশ্চয়ই আমাদের নথি আপনার নজরে এসেছে৷ শুনলাম আপনি নতুন এসেছেন এই দপ্তরে৷’

বিক্রম সামান্য হ্যাঁ–বোধক ঘাড় নাড়তে বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে খবর পেয়েছেন আমাদের ডিভোর্সের মামলাটার ডিক্রি হয়ে গেছে?’

বিক্রম ঘাড় নড়ল, ‘হ্যাঁ৷’

‘নিশ্চয়ই মি. সিংহ আপনার কাছে এসে বলে গেছেন আমাদের যৌথ নামের প্লটটা ওনার একার নামে করে দিতে?’

বিক্রম বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে অবন্তিকা সিংহের দিকে৷ ঘন্টাখানেকও হয়নি বিশ্বদীপ সিংহ তার চেম্বার থেকে বেরিয়েছেন৷ তার মধ্যে সব খবর পৌঁছে গেছে মিসেস সিংহর কাছে। নিশ্চয়ই এই দপ্তরেরই কেউ খবরটা পৌঁছে দিয়েছে তাঁর কাছে৷ কিন্তু কে সেই ব্যক্তি যিনি দুজনকেই খবরটা পৌঁছে দেন? বিক্রম ভাবল তা হলে কি তাকে এখন একস্ট্রা নজরদারি রাখতে হবে কার মারফত খবরগুলো যাচ্ছে দু’পক্ষের কাছে?

‘মি. মুখার্জি, আপনি কি এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন?’

বিক্রম পড়ছিল মহিলার হাবভাব, বলল, ‘কী সিদ্ধান্ত?’

‘মানে, কার নামে আমাদের প্লটটা করবেন?’

বিক্রম একটুও অসহিষ্ণু না হয়ে বলল, ‘আপনার কি ধারণা যে কেউ এসে কোনও একটা অ্যাপ্লিকেশন দিলেন, আর ম্যাজিকের মতো তার উত্তর দিয়ে দেব!’

‘কিছুই অসম্ভব নয়৷ এর আগে এমন এমন সব সিদ্ধান্ত এই দপ্তরে হয়েছে, এত দ্রুততার সঙ্গে যে, আমি খবর পাওয়ার আগেই চিঠি বেরিয়ে গেছে বিপক্ষের হাতে৷’

বিক্রম জানে মহিলার অভিযোগ অসত্য নাও হতে পারে৷ কত অফিসে কত কাণ্ড হয়ে যায়, পরে কেঁচো খুঁড়তে সর্পের আবির্ভাব৷ বলল, ‘সদ্য আপনাদের ডিভোর্সের মামলার ডিক্রি হাতে পেয়েছি৷ এখনও আদত আদেশনামার নকল পাইনি৷ আগে দেখি কী লেখা অছে তাতে?’

অবন্তিকা সিংহ তৎক্ষণাৎ তাঁর হাতের ব্যাগ খুলে একটা খাম বার করে দিলেন বিক্রমের হাতে৷ বিক্রম খুলে দেখল সেটিও উকিলের চিঠি, তবে অবন্তিকা সিংহের উকিল৷ তার বয়ান একটু অন্যরকম৷ আদালতের আদেশনামার শেষ কয়েক লাইন উদ্ধৃত করে নীচে লেখা, দ্য অথরিটি ইজ রিকোয়েস্টেড নট টু ইন্টারফেয়ার উইথ দ্য পজেশন অফ মাই ক্লায়েন্ট অন দ্য ডিসপিউটেড প্লট৷

বিক্রম কিছুক্ষণ বিষয়টা অনুধাবন করে বলল, ‘শেষ কয়েক লাইন কিন্তু কোর্টের অর্ডার নয়৷’

‘নয় তবে আমার লইয়ার বলেছেন ডিভোর্সে ডিক্রি পাওয়া মানে প্লটের পজেশন চলে যাওয়া নয়৷ ওই প্লটে আমার পজেশন আছে৷’

‘আছে নাকি?’ বিক্রম কৌতূহলী হয়, ‘আপনি ওই প্লটে বসবাস করেন?’

অবন্তিকা একটু থেমে বলল, ‘হ্যাঁ, করি৷’

বিক্রম আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘করেন?’

অবন্তিকা লক্ষ করছিলেন আধিকারিকের প্রতিক্রিয়া, বললেন, ‘প্লটের একটা অংশ আমার পজেশনে আছে৷’

‘পজেশনে আছে তাই নাকি? আমাদের অফিসার আগামীকালই আপনাদের প্লটে এনকোয়ারি করতে যাবেন৷’

অবন্তিকা একটু যেন আশ্চর্য হলেন, ‘তদন্তে গিয়ে কী দেখবেন?’

‘দেখবেন আপনি সেখানে বাস করছেন কি না।’

‘সবসময় সশরীরে বাস করা সম্ভব হয় না৷ কাজের খাতিরে অন্য কোথাও থাকতে হতে পরে৷’

বিক্রম কিছু অনুমান করে বলল, ‘তার মানে আাপনি ওখানে বাস করছেন না?’

‘দেখুন, ওখানেই আমার পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস৷ আমার ঘর আছে৷ কিন্তু আপাতত আন্ডার লক অ্যান্ড কি৷’

‘লক অ্যান্ড কি তার মানে আপনি ওখানে থাকেন না।’

অবন্তিকা সিংহের অভ্যিবক্তি হঠাৎ বদলে গেল, চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে নিলেন, গলা সামান্য চড়িয়ে বললেন, ‘প্লটে থাকা বলতে আপনি কী ইন্টরপ্রিট করছেন? ওই প্লটে আমি দীর্ঘদিন বসবাস করেছি৷ কিছুদিন হল কাজের খাতিরে আমি অন্যত্র বসবাস করছি৷’

‘অন্যত্র কলকাতার মধ্যে?’

‘হ্যাঁ৷ কলকাতার মধ্যেই৷’

‘তা হলে যে বললেন, বাঘা যতীনের প্লটে আপনি থাকেন?’

‘আমি তো বললাম ওটাই আমার পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস৷ একটা ঘরে আমার যাবতীয় জিনিসপত্র রাখা আছে৷ আপাতত তালা দেওয়া৷ একটা কাজের খাতিরে বাইরে থাকতে হচ্ছে কিছুদিনের জন্য৷ কাজ শেষ হলেই ফিরে আসব এ বাড়িতে৷’

বিক্রম বেশি কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে৷ কাল আমার অফিসার ওই প্লটে গিয়ে দেখে আসবেন কে কোন ঘরে আছেন, কার স্ট্যাটাস কী।’

‘তা দেখতে পারেন৷ কিন্তু তিনি যেন দেখে আসেন কোন ঘরটা আমার৷ ঘরটা তালাবন্ধ আছে কি না।’

‘ঠিক আছে৷ সরেজমিনে সব দেখে এসে তিনি আমাকে রিপোর্ট দেবেন৷ ওকে?’

অবন্তিকা সিংহকে প্রকারন্তরে উঠে যেতেই বলল বিক্রম, তবু তিনি বসেই রইলেন, বললেন, ‘দেখুন, আপনি যখন বললেন আমি কাল অফিস কামাই করে বাড়িতে থাকতেই পারতাম আমার পজেশন দেখাতে৷ কিন্তু দ্যাট ম্যান, এত ডেঞ্জারাস, হয়তো আমার উপরে কুকুর লেলিয়ে দেবেন৷’

বিক্রম স্তম্ভিত হয়ে বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করল৷ চ্যাটার্জিবাবু একটু আগেই শুনিয়ে গেলেন বিশ্বদীপ সিংহের কুকুরের কাহিনী৷ তিনি বলেছিলেন মন্দলোক হলে ককুরটা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে৷ কী সর্বনাশ৷ অবন্তিকা একদা তাঁর স্ত্রী ছিল, এখন সম্পর্ক এমনটাই দাঁড়িয়েছে, প্রয়োজনে তার উপর কুকুর লেলিয়ে দেবেন!

‘ঠিক আছে, আগে আমার অফিসার বিষয়টি দেখে আসুন, তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে৷’

অবন্তিকা সিংহ চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চেম্বারে ঢুকলেন চ্যাটার্জিবাবু, হাসি–হাসি মুখে বললেন, ‘সিংহীকে কেমন বুঝলেন?’

বিক্রম তখনও একরাশ বিস্ময়ের ঘোরে, বলল, ‘কে বেশি বলবান বুঝতে পারছি না এখনও সিংহ, না সিংহী!’

‘ফলেন পরিচীয়তে৷’ চ্যাটার্জিবাবুর মুখে রহস্যের হাসি৷

‘ঠিক আছে, আপনার রিপোর্ট পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷’

চ্যাটার্জিবাবু হাসলেন, ‘স্যার, আমি এই ফাইল নিয়ে দীর্ঘকাল লেখালিখি করছি, অন্তত বার চারেক গেছি সরেজমিনে তদন্ত করতে৷ কলোনির বাড়ি৷ ছোটো প্লট, কাঠা আড়াইয়ের মতো৷ তার মধ্যে একটা দোতলা বাড়ি, উপর–নীচে মিলিয়ে খান ছয়েক ঘর৷ তার মধ্যে দোতলার একটা ঘরে মিসেস সিংহ তাঁর সমস্ত ফার্নিচার, পোশাকআসাক ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে রেখে অন্য কোথাও থাকছেন৷’

পরের দিন বিকেলের দিকে ফাইল হাতে চ্যাটার্জিবাবুর প্রবেশ, হাতে সেই পেটমোটা ফাইল, বিক্রমের সামনে মেলে ধরতেই বিক্রম মনঃসংযোগ করল ফাইলে৷ চ্যাটার্জিবাবু পুরোনো অফিসার, যাকে বলে সিজনড অফিসার, গত কাল পাওয়া দুটি উকিলের চিঠি ফাইলে দিয়ে, সরেজমিনে তদন্ত করে রিপোর্টে লিখেছেন, বিষয়টি ক্রমশ জটিল হচ্ছে৷ প্লটটি এখন রেকর্ড করা আছে মি. ও মিসেস সিংহের নামে৷ বহুকাল যাবৎ বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায় রত ছিলেন, অবশেষে মি. সিংহ তাঁর অনুকূলে ডিক্রি পেয়েছেন৷ ডিক্রি পাওয়ার পর মি. সিংহ দপ্তরে জানিয়েছেন এখন ওই প্লটে আর মিসেস সিংহের কোনও দাবিদাওয়া থাকতে পারে না৷ প্লটটি যেন তাঁর একার নামেই রেকর্ড করা হয়৷ অপরপক্ষে মিসেস সিংহ চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন তিনি এখনও ওই প্লটে দখলদার আছেন৷ বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রির সঙ্গে পজেশনের কোনও সম্পর্ক নেই৷ কোনওক্রমেই যেন তাঁর নাম ওই প্লট থেকে বাতিল না করা হয়৷ বিষয়টি যেহেতু আইনি–জটিলতায় আক্রান্ত, ফাইলটি প্রথমে দপ্তরের ল অফিসারের কাছে পাঠিয়ে এ–বিষয়ে তাঁর মতামত জানা হোক, তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে নতুনভাবে মিউটেশন করতে হবে, না পুরোনো মিউটেশনই বহাল থাকবে৷

বিক্রমের স্বাক্ষর হয়ে ফাইল চলে গেল ল অফিসার সুজাতা মৈত্রর কাছে৷

সারাদিনে এরকম অসংখ্য ফাইল বিক্রমের টেবিলে আসে, এক এক প্লটে এক একরকম জটিলতা৷ হিন্দু উত্তরাধিকার আইন একরকম, আবার উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের উত্তরাধিকার আইন একরকম৷ হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের জটিলতার কথা ভেবেইে উদ্বাস্তুদের জন্য আলাদা আইন করা হয়েছে যাতে উদ্বাস্তুদের জমি মিউটেশন করতে হয়রানি না হতে হয়৷ তবু উত্তরধিকার যেরকমই হোক না কেন তা নির্ণয় করা সর্বাদাই দুরূহ৷

অতএব প্রতিটি ফাইলেই আলাদাভাবে মনঃসংযোগ করতে হয়, উত্তরাধিকার নির্ণয় করতে গিয়ে সামান্যতম ভুল হলেই মামলা–মোকদ্দমা হয়ে যাবে৷

পরদিন দুপুর নাগাদ বিক্রমের চেম্বার খুলে যিনি মুখ বাড়ালেন তিনি দপ্তরের ল অফিসার সুজাতা মৈত্র৷ মধ্যবয়স্ক মহিলা সামান্য গম্ভীর হলেও বেশ খোলামেলা কথা বলেন৷ বিক্রম দেখেই বুঝল তাঁর হাতে বাঘা যতীনের সেই ফাইলটিই৷

সুজাতা মৈত্র চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললেন, ‘দেখুন, এই ফাইলটা আমার টেবিলে যাওয়ার একটু পরেই আমার কাছে ফোন, বিশ্বদীপ সিংহ বললেন, ফাইলটা তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন৷ দেরি হলেই সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে৷’

বিক্রম বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কী ভণ্ডুল হয়ে যাবে?’

‘ওঁর আশঙ্কা ওঁর স্ত্রী, মানে এখন ভূতপূর্ব স্ত্রী অবন্তিকা সিংহ দু–একদিনের মধ্যে হাইকোর্টে গিয়ে বিবাহ–বিচ্ছেদের ডিক্রির উপর স্টে–অর্ডার নিয়ে আসবেন৷’

‘আমাকেও কাল তাই বললেন৷ আমি ওঁকে বলেছি যথাশীঘ্রসম্ভব নিম্ন আদালতের আদেশনামার কপি সংগ্রহ করে আনতে৷’

‘হ্যাঁ৷ উনি আমাকে তা বলেছেন৷ সেই কারণে আজ ফার্স্ট আওয়ারে একজন লোক মারফত সেই কপিও পাঠিয়ে দিয়েছেন৷’

‘তাই নাকি? দেখি কী লেখা আছে অর্ডারে?’

সুজাতা মৈত্র ফাইলটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই যে।’

ফাইলের মধ্যেই অর্ডারের কপি রাখা আছে, সেটি বার দুই পড়ে নজর রাখলেন ল অফিসারের নোটে:

অনুধাবন করা গেল বিশ্বরূপ সিংহ ও অবন্তিকা সিংহেব বিয়েটা একটু দেরিতেই হয়েছিল, কিন্তু কোনও কারণে বিয়েটা টেকেনি৷ অবন্তিকাকে বিয়ে করার পর বিশ্বদীপ সিংহই তাঁদের প্লটে অবন্তিকা সিংহের নাম মিউটেশন করিয়েছিলেন, এখন বিবাহবিচ্ছেদের পর তিনিই আবার অবন্তিকার নাম বাদ দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন৷ সরেজমিনে তদন্তে দেখা যাচ্ছে দোতলা বাড়িটা বিশ্বরূপ সিংহের দখলে থাকলেও তার একটি ঘর তালাবন্ধ করে রেখেছেন অবন্তিকা সিংহ৷ তিনি বর্তমানে প্লটে বসবাস না করলেও প্লটের একটি অংশ দখল করে আছেন৷ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তালাবন্ধ হলেও উক্ত ঘরটি অবন্তিকা সিংহের দখলে৷ তাঁর ডকিলের চিঠি অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদের পরও তিনি ওই প্লটের দাবিদার থাকতে চাইছেন৷ এই দপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী অবন্তিকা যদি কোনও অংশ দখল করে থাকেন, তা হলে তাঁকে আইন অনুযায়ী উচ্ছেদ না–করা পর্যন্ত তাঁর নাম প্লটের সঙ্গে যুক্ত না রাখার কোন কারণ নেই৷

ল অফিসারের নোট পাওয়ার পর বিক্রমের দুশ্চিন্তা কমল কিছুটা৷ সেই মতো একটা চিঠি উভয়পক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হোক, এই মর্মে নোট দিয়ে পাঠিয়ে দিল তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ডেপুটি কমিশনারের টেবিলে৷ ফাইলটি এখন ডেপুটি কমিশনার হয়ে যাবে কমিশনারের টেবিলে, সেখান থেকে সর্বোচ্চ নীতি–নির্ধারক দপ্তরের মন্ত্রীর টেবিলে৷ সবার সই হয়ে গেলে তবেই ডেপুটি ডিরেক্টর চিঠি দিতে পারবেন দরখাস্তকারীদের৷

ফাইলটি সবার সই হয়ে ফিরে আসতে অন্তত সাতদিন৷ ততদিনে কম করে আরও একশো–দেড়শো ফাইলের মোকাবিলা করতে হবে তাদের সেকশনে৷ দিন দুই অন্য ফাইল ও ভিজিটরদের মোকাবিলা করতে ব্যস্ত, সেই মুহূর্তে একটা রেজিস্টার্ড খাম এল বিক্রমের কাছে৷ খামের আবরণ ছিঁড়ে বার করল ভিতরের চিঠিটা৷ তার সারমর্ম আরও অবাক করল বিক্রমকে৷

চিঠিটা লিখেছেন রত্নদীপ সিংহ, তাঁর পরিচয় তিনি বিশ্বদীপ সিংহের পুত্র, বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরে চাকুরিরত। লিখেছেন,

ডি বাই নাইনটিন বাড়িতে আমার জন্ম, আমার ঠাকুরদা–ঠাকুমা গত হওয়ার পর ওই বাড়িতে বাবা ও মায়ের সঙ্গে আমি বসবাস করতাম৷ ওখানেই আমার যাবতীয় লেখাপড়া৷ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় আমার মা হঠাৎ হার্টফেল করে মারা যান, তার বছর দুই পরে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমি ব্যাঙ্গালোরে চাকরি নিয়ে চলে আসি৷ এখানে এসে আমি বিবাহ করেছি৷ আমার একটি পুত্রসন্তানও হয়েছে, তার বয়স দু’বছর৷ বাবার রিটায়ারমেন্টের পর উনি বাড়িতে একাই থাকতেন৷ এক বছরও হয়নি, হঠাৎ বাবার চিঠি পেয়ে আমি বিস্মিত৷ বাবা জানালেন তিনি একা থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছেন, জীবনের বাকি দিনগুলো একজনের সঙ্গে কাটাতে চান৷ সঙ্গে একটা ছবিও পাঠালেন সেই মহিলার৷ ছবি দেখে মনে হল তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট৷ কিন্তু আমার আর কী বলার আছে৷ তারপরে জানলাম বাবা আমাদের প্লটের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম যুক্ত করেছেন৷ তার ফলে ওই প্লটের উপর আমার আর কোনও অধিকার আছে কি না বুঝতে পারি না৷ বাবাকে চিঠি দিয়েও তার কোনও উত্তর পাইনি৷ সম্প্রতি জানলাম বাবার সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ মঞ্জুর হয়েছে আদালতে৷ এও শুনলাম বাবাকে বাধ্য হতে হয়েছে মামলা করতে৷ আমি দীর্ঘদিন কলকাতার বাইরে, ফলে ঠিক জানতে পারিনি কেনই বা বাবা আবার বিয়ে করলেন, কেনই বা এত দ্রুত বিবাহ–সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাইলেন৷ তবে অনুমান করছি ওই মহিলা ইতিমধ্যে বাবার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স শূন্য করে দেওয়ার পথে এগোচ্ছিলেন। এখন ব্যাঙ্কে কতটা কী আছে তা বুঝতে পারছি না৷ আমার বোঝার দরকারও নেই৷

যাই হোক, বাবার ব্যক্তিগত বিষয়ে আমি উৎসাহী নই৷ যে কারণে এই চিঠি লেখা তা হল, ওই বাড়িতে আমি আজন্ম মানুষ, নিশ্চয়ই আমারও কিছু অধিকার আছে ওখানে৷ ব্যাঙ্গালোরে কতদিন থাকতে হবে তার কোনও স্থিরতা নেই৷ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমি আবেদন করেছি যাতে আমাকে অতি শীঘ্র কলকাতায় বদলি করে দেওয়া হয়৷ আমার আবেদন মঞ্জুর হলে সপরিবারে কলকাতায় ফিরব৷ আমার পুত্রকে কলকাতার কোনও স্কুলে পড়াতে চাই৷

মহাশয়, সবিনয়ে জানাই, এই ভূভারতে আমার থাকার কোনও জায়গা নেই৷ বাঘা যতীন কলোনির প্লটেই আমার একমাত্র জায়গা৷ আমার নিবেদন ওই প্লটে আমার নাম সংযুক্ত করে যাতে আমি ভবিষ্যতে কলকাতা ফিরে আমাদের বাড়িতে বসবাস করতে পারি তার ব্যবস্থা করবেন৷

ভবদীয় ইতি

রত্নদীপ সিংহ৷

চিটিটা পড়ে খুব বিচলিত বোধ করল বিক্রম৷

সঙ্গে সঙ্গে বেল বাজিয়ে খবর দিল চ্যাটার্জিবাবুকে৷ তিনি এলে রত্নদীপের চিঠিটা দেখিয়ে বলল, ‘আপনি জানতেন বিশ্বদীপ সিংহের কোনও পুত্র আছে?’

চ্যাটার্জিবাবু চিঠিটা উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, ‘বিশ্বদীপবাবু কোনওদিন বলেননি তাঁর ছেলের কথা৷ চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে আবেদনকারীর বক্তব্য সত্য৷ কিন্তু আমাদের এনিউমারেশন রেজিস্টারে লেখা ছিল প্লটের যিনি দখলদার সেই চিত্তরঞ্জন সিংহের নাম৷ তঁর মৃত্যুর পর প্রথমে লেখা হয়েছিল বিশ্বদীপ সিংহের নাম৷ পরে যুক্ত হয়েছে অবন্তিকা সিংহের নাম৷’

‘তা হলে এখন রত্নদীপ সিংহের আবেদনও তো বিবেচনা করতে হবে৷’

‘আবেদন যখন জমা পড়েছে, নিশ্চয়ই বিবেচনা করতে হবে৷ তবে প্লট হোল্ডার বিশ্বদীপ সিংহের মতামত নেওয়াটাও জরুরি৷’

রত্নদীপের চিঠির খবর কী করে যেন পৌঁছে গেল বিশ্বদীপের কানে৷ পরদিনই তিনি এসে হাজির দপ্তরে, চেয়ারে বসেই বললেন, ‘রত্নদীপের কোনও চিঠি এসেছে?’

বিক্রম অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি কী করে জানলেন?’

‘যে করেই হোক জেনেছি৷ কিন্তু এই প্লটের উপর ওর কোনও অধিকার নেই৷’

বিক্রম অবাক হচ্ছিল, অবাক হচ্ছিলও না, বলল, ‘কেন?’

‘ব্যাঙ্গালোরে হুট করে চলে গেল, আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি৷’

বিক্রম বুঝে নিতে চাইছিল পিতা–পুত্রের সম্পর্ক৷

‘সেখানে গিয়ে নিজের পছন্দমতো বিয়ে করেছে, তাও আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।’

‘হুঁ৷’

‘গত চার বছরে আমাকে একটা ফোন পর্যন্ত করেনি৷’

বিক্রম অনুমান করছিল গত চার বছরে এমন অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে গেছে যার কারণে পিতাপুত্রের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে৷

‘ঠিক আছে৷ কিন্তু ও বাড়িতে রত্নদীপের দখলীকৃত কোনও ঘর আছে?’

বিশ্বদীপ সিংহ থমকে গিয়ে বললেন, ‘একটা ঘরে তালা দিয়ে রেখে গেছে৷ ভিতরে কিছু আছে কী না জানি না৷’

বিক্রম চোখ পেতে পড়ছিল টেবিলের উল্টোদিকে বসে থাকা প্রৌঢ় মানুষটিকে৷ বেশ গোলমেলে লাগছে তাঁর কথাবার্তা, আচার–আচরণ৷ বলল, ‘ঠিক আছে, বিষয়টা নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি৷’

‘কিন্তু দেখবেন মিউটেশনে যেন রত্নদীপের নাম যুক্ত না হয়৷’

বিক্রম চুপ করে থাকে৷

‘আর অবন্তিকার নাম বাদ দিতে বলেছিলাম, তার কী হল?’

‘এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি৷ ফাইল উপরে গেছে৷’

‘উপরে মানে কোথায়? রাইটার্সে?’

‘এখন আপনাকে সব কথা বলা যাবে না৷ ফাইল আগে ফিরুক৷ সিদ্ধান্ত কী হয় দেখি৷’

‘আমার দেওয়া লইয়ার্স লেটার পেয়েও যদি আপনারা তার নাম রেখে দেন, আমি কিন্তু কোর্টে মুভ করব৷’ অর্থাৎ হুমকি দিচ্ছেন বিশ্বদীপ সিংহ৷

বিক্রম বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, ‘আদালত তো সবার জন্য৷ যেতেই পারেন৷’

‘তার মানে আপনারা চাইছেন অবন্তিকা ডিভোর্স মামলার ডিক্রির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গিয়ে স্টে-অর্ডার নিয়ে আসুক।’

‘দেখুন মি. সিংহ, প্লটটা প্রথমে আপনার বাবার নামে এনিউমারেট হয়েছিল, তাঁর প্রয়াণের পর আপনিই তাঁর উত্তরাধিকারী, সেইমতো আপনার নামে মিউটেশন করা হয়েছিল৷ তারপর আপনিই অবন্তিকা সিংহের নাম যুক্ত করতে বলেন, যদিও তাঁর নাম যুক্ত করার কোনও প্রয়োজন ছিল না৷ আমি সেকশনে খবর নিয়ে জানলাম আপনারই পীড়াপীড়িতে অবন্তিকার নাম যুক্ত করা হয়েছে৷’ বিশ্বদীপ সিংহ দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘দ্যাট বিচ তখন আমাকে এত ইনসিস্ট করতে লাগলো!’

‘আমি ফাইল পড়ে দেখলাম দপ্তর প্রথমে আপনাকে বলেছিল আপনার স্ত্রী হিসেবে ওই প্লটে থাকার অধিকার তাঁর আছে৷ তাঁর নামে মিউটেশন না করলেও চলবে৷ কিন্তু আপনি প্রায় জোর করেই তাঁর নাম ঢুকিয়েছিলেন৷’

বিশ্বদীপ সিংহ বোধ হয় এখন নিজের হাত কামড়াতে চাইছেন, বললেন, ‘এখন বুঝতে পারছি কেন এত জোর করছিল ওর নাম ঢোকাতে৷ আমাকে সব দিক দিয়ে পপার করে দিয়েছে।’

রত্নদীপ সিংহের চিঠিতে বাবা সম্পর্কে ঠিক এরকমই ছিল, বিক্রম জরিপ করছিল বিশ্বদীপ সিংহকে৷ হঠাৎ বেশি বয়সে দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করলে তার ফল অধিকাংশ সময়েই বিষময় হয়৷ বলল, ‘শুনলাম আপনার কুকুর নাকি তাঁর ঘাড়ে লাফ দিয়ে পড়ে।’

‘আমার কুকুর? মাই গড আপনাকে তাই বলেছে নাকি! কুকুরটা তো ওর৷’

‘সে কী?’ বিক্রম অবাক৷

‘হ্যাঁ৷ ও তো কুকুর নিয়ে শুত৷ কুকুর ওর ধ্যানজ্ঞান সব৷ আমি বলেছিলাম, হয় কুকুর, নয় আমি, একটা বেছে নাও৷’

বিক্রমের চোখ বড় বড় হয়ে যয়৷

‘ভাবতে পারেন হাজব্যান্ড আর ওয়াইফের মাঝখানে একটা অ্যালসেশিয়ান শুয়ে দিনের পর দিন রাতে তাকে জড়িয়ে ধরে কী আদর… শেমলেস!’

বিক্রম আর কিছু ভাবতে চায় না৷ পেটমোটা ফাইলটা ক্রমশ যেন তার কাঁধে চেপে বসছে, আর জড়িয়ে পড়ছে এক আশ্চর্য মাকড়সার জালে৷ বিক্রম চাইল জাল কেটে বেরোতে৷ আপাতত৷ বলল, ‘ঠিক আছে, এখন আপনি আসুন৷ ফাইল আগে ফিরুক৷’

একরকম জোর করেই তাঁকে চেম্বার থেকে তুলে দিল বিক্রম৷

সবে মাত্র কয়েকদিন এই দপ্তরে যোগদান করেছে, এই ক’দিনের মধ্যে অনেকগুলো জটিল সমসার মুখোমুখি হয়েছে, তাদের মধ্যে এটি বোধ হয় জটিলতম৷

খোঁজ নিয়ে দেখল ওঁদের ফাইলটা এখনও ক্যামাক স্ট্রিটের হার্ডল পেরিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে যাত্রা শুরু করেনি৷ বিক্রমও উতলা হল না৷ যে কোনও জটিল সমস্যাকে থিতোতে দিতে হয়, তা হলে মোকাবিলা করতে সুবিধা৷

কিন্তু থিতোবার সুযোগ হল না৷ বিক্রমের চেম্বারের দরজা ঠেলে যিনি হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন তিনি অবন্তিকা সিংহ, বেশ রাগ–রাগ মুখে বসে বললেন, ‘আপনারা কি আমার নাম বাদ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন?’

বিক্রম একটু সময় নিল যাতে অবন্তিকা জিরেন নিতে পারেন৷ লিফট থেকে নেমে বেশ জোরেই দৌড়ে এসেছেন যার কারণে হাঁপাচ্ছেন একটু একটু৷ হয়তো তাঁর কাছে খবর পৌঁছেছে যে, দপ্তর তাঁর নাম বাদ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন ফাইলে৷

অবন্তিকার পরনে আজ নেভি ব্লু রঙের শালোয়ার–কামিজ, গলায় লাল টুকটুকে ওড়না, টুকটুকে লাল ঠোঁট, তাতে আরও বয়স কম দেখাচ্ছে৷ কত বয়স হবে তাঁর আজ আবারও মনে হল, বত্রিশ, না বাহান্ন বলা খুব মুশকিল৷ তার উপরে চোখে সানগ্লাস পরে থাকায় প্রকৃত বয়স সাত হাত জলের তলায়৷

বিক্রম একটু ভালো করে লক্ষ করল মহিলাকে৷ আজ একটু অন্যরকম দৃষ্টিতে৷ বলল, ‘দেখুন, এই প্লটের উত্তরাধিকার বিষয়ে বেশ কিছু জটিলতা আছে৷ আরও জটিলতা বাড়ছে৷ অতএব চট করে কোনও সিদ্ধান্ত হবে না৷’

অবন্তিকার কণ্ঠে উষ্মা, বলল, ‘বুঝেছি৷ রত্নদীপের চিঠি পেয়ে আপনারা ঘাবড়ে গেছেন।’

‘ঘাবড়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই৷ সরকারি অফিস চলে আইনকানুন, সার্কুলার, গভর্নমেন্ট অর্ডার ইত্যাদি অনুসারে৷ যে কোনও সিদ্ধান্ত হবে নিয়মনীতি অনুসারে৷ তাতে যিনি অধিকার পাওয়ার হকদার, তাঁর অনুকূলেই রায় হবে৷’

অবন্তিকা সিংহ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বোঝার চেষ্টা করলেন বিষয়টা৷ বললেন, ‘আপনারা কি জানেন বিশ্বদীপ সিংহ তাঁর পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিয়েছেন?’

বিক্রম তা জানে না, বিশ্বদীপ কিছু বলেননি এ বিষয়ে৷ বলল, ‘লিখিতভাবে, না মৌখিক?’



‘আমি অত জানি না৷ তবে ওঁর ছেলে ওঁর সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করছে যে, ত্যাজ্যপুত্র করাটাই স্বাভাবিক৷’

‘দেখুন, এগুলো ওঁদের ব্যক্তিগত বিষয়৷ লিখিত কোনও কাগজ আমাদের কছে এলে তখন বিষয়টা নিয়ে আমরা ভাবব৷’

‘বাহ৷ ত্যাজ্যপুত্র কি কেউ লিখিতভাবে দেয়? যখন কোনও পুত্র বাবা–মায়ের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে, বাবা–মায়ের কথা মানতে চায় না, নিজের ইচ্ছেমতো চলে, বাবা–মায়ের অমতে বিয়ে করে, বাবা–মায়ের অমতে বাইরে চাকরি নিয়ে চলে যায়, কাউকে বলে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করে না, তখন ত্যাজ্যপুত্র করা ছাড়া উপায় থাকে না বাবা–মায়ের৷’

বিক্রমের ঠোঁটে এসে গিয়েছিল জিজ্ঞাসা করে, কোন মা? সেই মা কি আপনি? কিন্তু নিজেকে নিবৃত্ত করে বলল, ‘দেখুন, এ সব বিষয় একেবারেই ব্যক্তিগত৷ কার বা কাদের নামে মিউটেশন হবে তা নির্ভর করে যিনি দখল করেছিলেন প্লট বা তাঁর উত্তরাধিকারীদের মতামত বা অবস্থানের উপর৷’

‘তাই নাকি? তার মানে এখন যাদের নামে মিউটেশন করা আছে তাদের অধিকার আছে এ বিষয়ে বলার?’

বিক্রম দ্রুত বুঝে ফেলল মিসেস সিংহের কথার গতিপ্রকৃতি৷ বলল, ‘হ্যাঁ৷ যেমন তাঁদের কথাও শুনব, তেমনই দপ্তরের গাইডলাইনও অনুসরণ করা হবে৷’

মিসেস সিংহ একটু উত্তপ্ত হয়ে বললেন, ‘কিন্তু যাদের নামে মিউটেশন করা আছে, তাদের বক্তব্যের নিশ্চয় গুরুত্ব থাকবে৷ কেননা ওই প্লটে যারা বসবাস করে তারা নিশ্চয় বাইরের কাউকে অ্যালাও করবে না৷’

বিক্রম স্তম্ভিত হচ্ছে ক্রমশ৷ রত্নদীপকে ‘বাইরের লোক’ বলে দিলেন কী অবলীলায়৷ অথচ আশ্চর্য এই যে, বিশ্বদীপ এখন অবন্তিকাকেই ‘বাইরের লোক’ বলে তাঁর নাম কেটে দিতে চাইছেন৷ একেই কি বলে প্যারাডক্স? অসম্ভব অথচ সত্যি বিষয়টা ক্রমশ জটিল হচ্ছে।

পরদিন আর একটা উকিলের চিঠি এসে পৌঁছোল বিক্রমের কাছে৷ অবন্তিকা সিংহের উকিল মস্ত একটা চিঠি দিয়ে বলছেন, তাঁর ক্লায়েন্ট অবন্তিকা সিংহ আজ সকালেই হাইকোর্টে একটি আপিল–মামলা রুজু করেছেন বিশ্বদীপ সিংহের বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে, আগামী পনেরো দিন পরে তার শুনানি হবে, ততদিন পর্যন্ত বাঘা যতীন কলোনির ডি বাই নাইনটিন প্লটের মিউটেশন বিষয়ে যেন কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়৷

বিক্রম বেয়ারা মারফত চ্যাটার্জিবাবুকে খবর দিতে তিনি হাসি–হাসি মুখে সে চিঠিটা দেখে–পড়ে বললেন, ‘ব্যস, হয়ে গেল৷ এই মামলার রায় বেরোতে কম করে তিন বছর, ততদিন আমরা আর কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারব না৷’

বিক্রম আরও বার দুই খুঁটিয়ে চিঠিটা পড়ে বলল, ‘হাইকোর্ট কিন্তু কোনও স্টে অর্ডার এখনও দেননি৷’

‘তা দেননি এখনও৷ কিন্তু ক’দিন পর যখন শুনানি হবে হয়তো স্টে অর্ডার দিয়ে দেবে৷’

বিক্রম উপলব্ধি করছিল বিষয়টি এখন একগলা জলে৷

আর যা ভেবেছিল তাই৷ পরদিন প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে দপ্তরে এলেন বিশ্বদীপ সিংহ৷ বললেন, ‘আপনাদের বলে গেলাম এখনই যদি অবন্তিকার নাম প্লট থেকে খারিজ না করেন, ওকে এখান থেকে হঠানো কঠিন হবে৷’

বিক্রম উদ্বিগ্ন হল না, বলল, ‘তা এখন কী করতে পারি আমরা?’

‘স্টে অর্ডার দিয়ে দিতে পারে হাইকোর্ট৷ তার আগেই আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে চিঠি দিন৷ নইলে দ্যাট বিচ এই বাড়িতে কায়েম হয়ে বসবে৷’

একদা–স্ত্রী সম্পর্কে বিশ্বদীপ সিংহর মন্তব্য শুনে বিক্রম স্তম্ভিত হচ্ছিল৷ স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে একজন আর একজন সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ বিশ্বদীপ ও অবন্তিকা৷

‘দেখুন, আপনার সুবিধেমতো অফিস চলে না৷ সব অফিসের কিছু নিয়মনীতি থাকে৷ সেভাবেই ফাইল লেখা হয়, অনেকগুলো স্তরে ফাইল ঘোরে, অবশেষে ফাইনাল অথরিটির স্বাক্ষর হলে তবেই সিদ্ধান্তটি পাকা হবে৷ সর্বোচ্চ স্তরের অনুমোদন পাওয়ার পর তবেই চিঠি দেওয়া হবে প্লট–হোল্ডারকে৷’

বিশ্বদীপ সিংহ হতাশ হয়ে বললেন, ‘সে কি অনেক দেরি হবে?’

‘আমরা আপনাকে কোনও নির্দিষ্ট তারিখ বলতে পারব না৷ ফাইল সই হয়ে ফিরলেই চিঠি যাবে৷’

‘আপনারা কি আমাকে ফাইল নম্বর আর তারিখ দেবেন? আমি মহাকরণে গিয়ে খোঁজ করব কোথায় আটকে আছে ফাইল৷’

‘না৷ তাতে আমাদের বড় কর্তারা কূপিত হবেন৷ কেন ফাইল নম্বর দিয়েছি এই বলে প্রচুর গালমন্দ করতে পারেন৷’

বিশ্বদীপ সিংহও কূপিত হয়ে বললেন, ‘তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে আপানরা সবাই অবন্তিকার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন।’

বিক্রমের ভিতরে রাগ উথলে ডঠছিল, লোকটা সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে, তবু চুপ করে রইল৷ বেশি কড়া কথাও বলা যাবে না৷ তা হলে বিষয়টা নিয়ে আরও জলঘোলা হতে পারে৷

‘শুনুন, হাই কোর্টে আমার উকিলও থাকবে৷ একতরফা রায় হবে না৷ আমিও দেখিয়ে দেব মহিলার আসল রূপ কী, লোয়ার কোর্টের জাজ শুনে চমকে উঠেছিলেন৷’

বিক্রম কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, দেখি এর মধ্যে ফাইলে কী অর্ডার হয়।’

‘অর্ডার যাই হোক, উনি তো এই প্লটের মূল দখলদার নন৷ দখলদার তো আমার বাবা৷’

বিক্রম অসহিষ্ণু হয়ে বলল, ‘তাই লেখা আছে সেকশনের এনিউমারেশন রেজিস্টারে৷ কিন্তু আপনারই জোরাজুরিতে তখন অবন্তিকা সিংহর নাম ঢোকানো হয়েছিল৷ এখন আপনিই আবার তার নাম কাটার জন্য জোর করছেন। এরকম ইচ্ছেমতো একবার নাম ঢোকানো, আবার কেটে দেওয়া কি সম্ভব?’

বিশ্বদীপ সিংহ থমকে গিয়ে বললেন, ‘তা হতেই পারে৷ পারিবারিক পরিস্থিতি চিরদিন একরকম থাকে না৷ তা হলে আপনারা ফাইল নম্বর দেবেন না?’

‘দেখুন, ফাইল নিজের গতিতে এগিয়ে চলে৷ আমাদের উপরওয়ালাদের কারও টেবিলে ফাইল পড়ে থাকে না৷ তবে জটিল কেস হলে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হতে পারে৷’

‘এটা মোটেই জটিল কেস নয়৷ অবন্তিকার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল৷ তার নাম যুক্ত করা হয়েছিল৷ এখন তার সঙ্গে আমার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে, তার নাম বাদ যাবে৷ সিম্পল৷’

‘আপনি বিষয়টা যত সহজে বললেন, তত সহজ নয়৷ ফাইলের মধ্যে আইনের জটিলতা ঢুকে গেছে৷ আপনার বিপক্ষ এর মধ্যে ফোনে হুমকি দিয়েছন তাঁর নাম কাটা গেলে কনটেম্পট অফ কোর্ট করবেন আমার বিরুদ্ধে৷’



‘কনটেম্পট অফ কোর্ট শব্দটর মানে জানে? উকিল যা বোঝাচ্ছে তাই বলছে৷’

‘দেখুন, আমরা চাকরি করি৷ যে ফাইলে আইনের জটিলতা থকে, অতি সাবধানে কাজ করতে হয়৷’

‘ও৷ কিন্তু আমি যদি বলি আমার প্রেয়ার যদি আপনারা গ্রহণ না করেন, আমিই আপনাদের নামে কনটেম্পট অফ কোর্ট করব৷’

বিক্রম বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল বিশ্বদীপ সিংহের দিকে৷ বলল, তা হলে দেখেছেন এগোলেও বিপদ, পিছোলেও বিপদ৷ কনটেম্পট অফ কোর্ট প্রমাণিত হলে জেলহাজত অনিবার্য৷

‘আমি তো কোনও বিপদের কারণ দেখছি না৷ এই মুহূর্তে ফাইলের যা পরিস্থিতি তাতে অবন্তিকার এই প্লটে কোনও অধিকারই নেই৷’

‘এই ওপিনিয়ন আপনার৷ আপনার বিপরীত পক্ষের অভিমত ঠিক এর উল্টো৷ অতএব বুঝতেই পারছেন, বন্দুক আমাদের কাঁধে রাখব না৷ প্রয়োজন হলে লিগ্যাল রিমেমব্রাঞ্চারের ওপিনিয়ন নিতে হবে৷ তিনি যা বলবেন সেইমতো এগোতে হবে৷ তাঁর অভিমত নিয়ে কাজ করলে আমাদের নামে কনটেম্পট অফ কোর্ট করলেও আমাদের অন্তত জেল–হাজত হবে না।’

বিশ্বদীপ সিংহ বহুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ‘তা হলে এটা কি বলতে পারবেন কবে নাগাদ ফাইল ফিরবে৷ আমি কিন্তু রোজ একবার করে আসব ফাইল ফিরল কি না জানতে৷’

বিক্রম ধৈর্য হারাচ্ছিল, বলল, ‘আপনি সারাদিনই অফিসে এসে বসে থাকতে পারেন৷ আপনার জন্য অফিসে একটা চেয়ার রাখতে পারি৷ তাতে লাভের লাভ কিছু হবে বলে মনে হয় না৷’

বিশ্বদীপ সিংহের মুখটা তেতে উঠল, বললেন, ‘বুঝেছি, আপনারা সবাই অবন্তিকাকে ফেভার করতে চাইছেন৷’

বিক্রম খুবই উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল লোকটির খোঁচানো স্বভাব দেখে৷ কিন্তু আধিকারিকের চেয়ারে বসে মেজাজ হারানো কোনও মতে যুক্তিযুক্ত নয়৷ নিজেই নিজের কথাগাড়িতে ব্রেক কষে বলল, ‘ঠিক আছে, ফাইলটা ফেরত আসুক৷’

বিশ্বদীপ সিংহ মুখ লাল করে চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতে বিক্রম কিছুক্ষণ বসে রইল থম হয়ে৷ প্রতিদিন অজস্র ফাইল আসে নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে৷ মাত্র কিছুদিনেই সড়গড় হয়ে ডঠছে নতুন দপ্তরর প্যাঁচপয়জারগুলি৷ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সমিতির নেতারা ঘন ঘন আসছেন বিভিন্ন বিষয়ে তদ্বির–তদারকি করতে৷ তাদের তদ্বির নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, তার মধ্যে এই ফাইলটা খুব জ্বালাচ্ছে তাকে৷ একটু পরেই বিক্রম উঠে গেল পাশের চেম্বারে, যেখানে তার উর্ধ্বতন কর্তা চৌধুরী সাহেব খুব ব্যস্ত হয়ে টেলিফোন করছেন কাউকে৷ ফোন রাখার পর তাকালেন বিক্রমের দিকে, ভুরু নাচিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার?’

বিক্রম ঘটনাটা বিবৃত করে বলল, ‘ফাইলটা আপনার সই হয়ে কমিশনারের কাছে যাওয়ার কথা৷ দিন সাতেক হয়ে গেল এখনও রাইটার্স থেকে ফিরছে না।’

‘কোন ফাইলটা বলো তো?’

বিক্রম ফাইল নম্বর ও বিষয় বলতে চৌধুরী সাহেব তাঁর টেবিলে স্তূপ হয়ে থাকা ফাইলসম্ভারের নীচে থেকে একটা ফাইল বার করে বলল, ‘এই ফাইলটা?’

বিক্রমের ধারণা হল ফাইলটা ইতিমধ্যে উপর থেকে ফিরে এসেছে সই হয়ে৷ উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ৷ কমিশনারের সই, মন্ত্রীর সই হয়ে ফিরে এসেছে?’

চৌধুরী সাহেব উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?’

বিক্রম বুঝে উঠতে পারল না তার কেন মাথা খারাপ হবে।

‘লোকটা রোজ একটা করে বিয়ে করবে, তারপর দুদিন পর তাকে ডিভোর্স করবে, আর তার কথায় আমাদের ওঠবোস করতে হবে!’

‘রোজ একটা করে মানে?’ বিক্রম হতভম্ব৷

‘মানে এর আগেও গোটা দুই বিয়ে করেছিল৷ একটা মরে গেছে, আর একটা বিয়ের একমাস পরে পালিয়ে গেছে৷ এটা তিন নম্বর বউ৷ তিন নম্বরকে বিয়ে করে এনে বলেছিল এক্ষুনি এর নামে প্লটের মিউটেশন করা হোক৷ খুব তদ্বির–তদারকি করে তার নাম ঢুকিয়েছিল, এখন আবার তার নাম এক্ষুনি কেটে দিতে হবে বলে চাপ দিচ্ছে৷’

‘খুব চাপ দিচ্ছে৷ তবে চাপ দু’পক্ষেই আছে৷’

‘হ্যাঁ, একপক্ষ চাইছে এক্ষুনি নাম কেটে দেওয়া হোক, অন্যপক্ষ চাইছে নাম যেন কিছুতেই কাটা না হয়৷’ বিক্রম হাসি–হাসি মুখে তকিয়ে থাকে চৌধুরী সাহেবের দিকে৷ চৌধুরী সাহেব বেশ মজা করে কথাগুলো বলছিলেন৷

‘এখন একটা লোক একবার করে বিয়ে করবে, আর তার নামে মিউটেশন করতে চাইবে এই বায়নাক্কা কতবার মানবে তুমি?’

বিক্রম বুঝতে চাইল বসের কথা৷ ফাইলটার ভবিতব্য কী হয়েছে তা খোলসা করে বলছেন না তিনি৷

‘ধরো আজ তুমি অবন্তিকা সিংহের নাম কেটে দিয়ে চিঠি দিলে৷ দু’দিন পরে অবন্তিকা সিংহ ডিভোর্সের বিরুদ্ধে স্টে অর্ডার পেয়ে বলল, তার নাম যেন কিছুতেই কাটা না হয় তখন কী করবে?’

বিক্রম বলল, ‘খুব সমস্যার কথা৷ কিন্তু বিশ্বদীপ সিংহ এত চাপ দিচ্ছেন যে…’

বলেই বলল, ‘তা হলে কী অর্ডার হল?’

চৌধুরী সাহেব ঘাড় নাড়লেন, ‘কোনও অর্ডারই হয়নি৷’

‘তার মানে?’

‘ফাইলটা আমি ধরে রেখেছি৷ উপরে পাঠাইনি৷’

‘পাঠাননি!’ বিক্রম আঁতকে ওঠে৷

‘পাঠিয়ে কী হবে? একটা নোট দিয়ে পাঠালাম উপরে৷ সিদ্ধান্ত হয়ে এল৷ চিঠি দিলে৷ পরক্ষণে কোনও একজন পটভূমিতে আবির্ভূত হয়ে বলল, আমিও ওই প্লটে থাকি৷’

‘তাহলে?’

‘তাহলে এখন কিছুই করব না৷ ফাইল পড়ে থাক৷ আগে ওরা কোর্টে ফয়সালা করুক৷’

বিক্রম বুঝে উঠতে পারল না ফাইল পড়ে থাকলে কী করে হবে, দু’পক্ষই এদিকে হুমকি দিচ্ছে আদালত অবমাননার৷ শেষপর্যন্ত কী হবে কে জানে৷

সে কথা বলতে চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘কোর্ট তো আর বলেনি, তোমাকে অমুক দিনের মধ্যে মিউটেশন করতে হবে। ওরা আবেদন করেছেন, আমরা ফাইল শুরু করেছি৷ দি ম্যাটার ইজ আন্ডার দি অ্যাকটিভ কনসিডারেশন অফ দি গভর্নমেন্ট৷ কোর্ট কিছু বললে এটাই হবে আমাদের উত্তর৷’

বিক্রম উঠতে যাচ্ছিল, চৌধুরী সাহেব আরও বললেন, ‘জটিল কেসে চট করে সিদ্ধান্ত নিতে নেই৷ লক্ষ রাখতে হয় মামলা কোনদিকে গড়াচ্ছে৷’

বিক্রম এই দপ্তরে সবেমাত্র এসেছে৷ চৌধুরী সাহেবের এই নিয়ে অষ্টম বছর৷ তাঁর অভিজ্ঞতা অনেক বেশি৷ নিজের চেম্বারে ফিরে এসে বিক্রম ভাবছিল বিশ্বদীপ সিংহ পরের দিন এলে কী উত্তর হবে৷ ‘এখনও ফাইল ফেরেনি’ শুনলে তাঁর মুখের অবস্থা কীরকম হবে৷ তারপর কি অনন্তকাল এই একই উত্তর দিয়ে যাবে তাঁকে!

বিশ্বদীপ অবশ্য কয়েকদিন আর এলেন না, হয়তো ডিভোর্সের আপিল–মামলা নিয়ে খুবই ব্যস্ত৷ ডি বাই নাইনটিন ফাইল ক্রমশ মোটা থেকে মোটাতর হচ্ছে৷ চ্যাটার্জিবাবু একদিন হাসতে হাসতে বললেন, এই দপ্তরের ফাইল মাঝেমধ্যে এরকম গর্ভবতী হয় বটে, ক্রমশ জটিল হয়, তবে এই ফাইলটা যেন বড্ড বেশি…

বিশ্বদীপ অনেকদিন এলেন না ঠিকই, কিন্তু দিন পাঁচেক পরে এলেন অবন্তিকা, হাতে একটা উকিলের নোটিস, মুখেচোখে যুদ্ধজয়ের চিহ্ন, বললেন, ‘আপনারা কি আমার নাম বাদ দিয়ে চিঠি দিয়ে দিয়েছেন? এই নিন ডিভোর্সের মামলার আপিলের অর্ডার৷’

বিক্রম চিঠিটা পড়ল মন দিয়ে৷ এটা মূল অর্ডারের সারাংশ৷ হাই কোর্ট স্টে অর্ডার দিয়েছে ডিভোর্সের আপিল কেসে৷ বিক্রম বুঝতে পারিছল ঝঞ্ঝাট বাড়ছে ক্রমশ৷ অবন্তিকা আবার মিসেস সিংহ হয়ে গেলেন কি না সেটাই এখন বিবেচনার বিষয়৷

‘এখন আর কিছুতেই আমার নাম বাদ দিতে পারবেন না৷ ডিভোর্স স্টে হওয়া মানে এখনও আমি ওঁর স্ত্রী৷ ওই প্লটে আমার সমান অধিকার৷’

বলে লাল টুকটুকে ঠোঁটে এক অদ্ভুত বাঁকানো হাসি ঝুলিয়ে চলে গেলেন চেম্বারের বাইরে৷

অবন্তিকার চিঠিটা ফাইলে রেখে বিক্রম অপেক্ষা করতে থাকল বিশ্বদীপ সিংহের৷ একজনের চিঠি এলে তার পিছু পিছু আর একজনের আগমন হয়৷ কীভাবে যেন জেনে ফেলে একে অপরের গতিবিধি৷ দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ, অথচ দুজনের মধ্যে এক অদৃশ্য গাঁটছড়া৷ ডি বাই নাইনটিন ফাইলের ভবিতব্য অগাধ জলে, দুই বিবদমান পক্ষ কোর্টে ছোটাছুটি করছেন নিজেদের ভবিতব্য নির্ধারণে৷

চ্যাটার্জিবাবুকে খবর পাঠায় একবার আসতে৷ তিনি এসে হাসি–হাসি মুখে বললেন, ‘স্যার, দেখলেন তো, কেস কীরকম জটিল হচ্ছে৷ ডিভোর্সের ডিক্রিতে স্টে হওয়া মানে বিষয়টা ঝুলে রইল আপাতত৷ ফাইনাল অর্ডার কবে হবে দেবা ন জানন্তি, কোর্ট নিজেও জানে না৷ কবে এই মামলা উঠবে, কবে দু’পক্ষের শুনানি হবে, কবে তার চূড়ান্ত আদেশ হবে কেউ বলতে পারবে না৷’

‘অতএব আপাতত মিউটেশনের বিষয়টাও শিকেয়৷’

‘কিন্তু স্যার, বিশ্বদীপ সিংহের আগমন ঘটছে না এটা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে৷ এরা দুজনে গজ আর ঘোড়ার মতো৷ একে অপরের পিছনে ছুটছে কিস্তি মাত করতে৷’

‘তা হলে অবন্তিকার চিঠিটা কী করবেন? আপাতত একটা পার্ট–ফাইল করে রেখে দিন তার ভিতর৷ মূল ফাইল ফিরলে তখন আবার নোটানুটি করা যাবে৷’

‘স্যার, রত্নদীপ সিংহ আবার ফোন করেছিল তার আবেদনের উত্তরে আমরা কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি… রত্নদীপ কিন্তু ওই প্লটে বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ৷’

‘রত্নদীপকে কি আলাদা করে চিঠি দেওয়ার দরকার আছে? তার বাবার নামে প্লট৷ উত্তরাধিকারসূত্রে পাবে৷ তা ছাড়া এই মুহর্তে বিষয়টা সাব–জুডিস৷ কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ল–সেকশনে দেখিয়ে নিতে হবে৷’

‘সেটাই ভালো৷ তা হলে আমরা বলতে পারব রত্নদীপের আর্জি আমরা বিবেচনা করছি৷’

চ্যাটার্জিবাবু চেম্বার থেকে উঠে যাওয়ার একটু পরেই ডেপুটি কমিশনার চৌধুরী সাহেব ডাকলেন বিক্রমকে৷ বিক্রম ঢুকতেই বললেন, ‘দেখেছ, কেন ফাইলটা আটকে রেখেছি আমি। যদি সময়মতো ফাইলটা পাঠাতাম, ফাইলটা অনুমোদন হয়ে ফিরে আসত এতদিনে৷ এখন ডিভোর্সের ডিক্রি স্টে হয়ে যাওয়ায় আবার নতুন করে ফাইল পাঠাতে হত কশিনারের কাছে৷ কমিশনার নিশ্চয়ই বিরক্ত হতেন।’

বিক্রম ঘাড় নাড়ে, সত্যিই তো একই ফাইল দু’দিন পর পর বসের টেবিলে পাঠালে বিরক্ত হতেই পারেন৷ বস বিরক্ত হলে মুশকিল৷ বস ইজ বস৷ তাঁকে সন্তুষ্ট রাখা অধস্তনদের কর্তব্য৷ চেম্বারে ফিরে এসে বিক্রম অন্য ফাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইল৷ কিন্তু পরদিন যে খবর পেল তা বেশ দুশ্চিন্তার৷ বিশ্বদীপ সিংহ নাকি হাসপাতালে ভর্তি আছেন, কন্ডিশন ইজ ভেরি সিরিয়াস৷

চ্যাটার্জিবাবু খবরটা দিয়ে বললেন, ‘শুনলাম হার্ট অ্যাটাক৷’

‘সে কী হঠাৎ?’

‘হঠাৎ নয়৷ দীর্ঘকাল কোর্টে ছোটাছুটি করে যাও বা ডিভোর্সের ডিক্রি পেলেন তাও স্টে হয়ে গেল৷ শুনলেন না সেদিন বলছিলেন ‘বিচ’, তার হাত থেকে রেহাই পেয়েও পেলেন না৷ যে মুহূর্তে খবর পেলেন হাই কোর্ট স্টে অর্ডার দিয়েছে, অমনি বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়লেন৷’

‘তা হলে তো খুব সমস্যা।’

‘খুবই সমস্যা৷ শুনলাম অবস্থা বেশ ক্রিটিকাল৷ আইসিসিইউতে আছেন৷ ওঁর ছেলে রত্নদীপ ছুটে এসেছে বাবার এরকম অবস্থা শুনে৷’

বিক্রম বেশ চিন্তিত হয়, বলল, ‘তার মানে আমাদের ফাইলের অবস্থাও ক্রিটিকাল৷’

স্যার, সাংঘাতিক ক্রিটিকাল৷ যদি বিশ্বদীপ সিংহের কিছু হয়ে যায়, তা হলে তো প্লটটা শুধু অবন্তিকা সিংহের নামে হয়ে গেল৷ অথচ রত্নদীপ ওই প্লটে বাস করেছে তার প্রমাণও আছে৷’

‘বিষয়টা সব লিখে আইনজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে৷’

বিশ্বদীপ সিংহের কোনও খবর পাওয়া গেল না আরও দু’দিন৷ বিক্রম উদ্বিগ্ন হচ্ছিল৷ মাত্র কয়েকদিনে বিষয়টা এমন জট পাকিয়ে গেল, তার জটিলতা ছাড়াতে বেশ বেগ পেতে হবে৷

হঠাৎ সেদিন বিকেলে একট ফোন এল, রিসিভার তুলতে ওপাশে নারীকণ্ঠ, বলল, ‘আমি মধুজা সিংহ৷ বার্লিন থেকে বলছি।’

বিক্রম থমকে গেল হঠাৎ অর্ন্তদেশীয় ফোন পেয়ে, বলল, ‘বলুন…’

‘আমি অবন্তিকা সিংহের মেয়ে৷’

বিক্রম চমকে উঠল কথাগুলো শুনে৷

‘আপনারা জানেন বাঘা যতীনের ডি বাই নাইনটিন প্লট আমার মায়ের নামে মিউটেশন করা আছে৷ শুনলাল আপনারা সেখান থেকে আমার মায়ের নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।’

বিক্রম স্তম্ভিত হয়ে বলল, ‘মানে আপনি বিশ্বদীপ সিংহের কন্যা?’

‘না, মানে আমি অবন্তিকা সিংহের কন্যা৷’

বিক্রম বুঝে উঠতে পরল না মধুজা বলছেন তিনি অবন্তিকা সিংহের কন্যা, অথচ বিশ্বদীপ সিংহের কন্যা নন।’

ওপাশ থেকে সন্দেহ নিরসন করল মধুজা, বলল, ‘না, মানে আমি আমার মা অবন্তিকা সিংহের আগের হাজব্যান্ডের মেয়ে৷ চাকুরিসূত্রে জার্মানিতে আছি বেশ কয়েক বছর৷ খুব শিগগির কলকাতার অফিসে বদলি হব৷ কিন্তু আমার কলকাতায় থাকার কোনও জায়গা নেই৷ কলকাতায় ফিরে মায়ের কাছেই উঠতে হবে আমাকে৷ প্লিজ, মায়ের নাম যেন ওই প্লট থেকে কাটা না যায়৷’

বিক্রম বিস্মিত, স্তম্ভিত৷ হঠাৎ কোথা থেকে মধুজা সিংহ ঢুকে পড়লেন এই সমস্যার মধ্যে তা ভেবে আর এক জটিল আবর্তে৷ বলল, ‘কিন্তু আপনার মা তো এখন ওই প্লটে থাকেন না।’

‘জাানি আমি৷ কিন্তু সেই অনুপস্থিতি সাময়িক৷ আমি যা শুনেছি বিশ্বদীপ সিংহের সঙ্গে সামান্য কারণে অবনিবনা চলছে৷ খুব শিগগির মিটে যাবে৷ মা আমাকে তাই বললেন৷’

বিক্রম অনুমান করল বিশ্বদীপ সিংহ যে এখন আইসিসিইউতে ভর্তি, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তা মধুজার কানে পৌঁছয়নি। সে নিজে থেকে সে খবর দিতেও চাইল না এই মুহূর্তে৷ বলল, ‘হাই কোর্টে একটা মামলা আছে দুজনের মধ্যে৷ সেই মামলার রায় না বেরোন পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না৷’

‘আচ্ছা’, ওদিকে লাইন কেটে গেল৷

বিক্রম নিজের মনে হাসতে থাকে৷ বিশ্বদীপ সিংহ এমন জটিল একটা কাহিনির সৃষ্টি করেছেন যা মহাভারতের একটি পর্ব হতে পারে৷ এদিকে নিজে হার্ট আ্যাটাকের পেশেন্ট হয়ে হাসপাতালে ভর্তি৷

রিসিভার রেখে দেখল চেম্বারের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে চ্যাটার্জিবাবু৷ নিশ্চয়ই তার শেষ কথাগুলো শুনেছেন, চেয়ারে বসে বললেন, ‘বিশ্বদীপবাবু নিজের অজান্তে তাঁর বংশলতিকা নানভাবে বিস্তার করেছেন৷ কে ফোন করেছিল, বনশ্রী?’

‘বনশ্রী আবার কে?’

‘অবন্তিকা সিংহর এক কন্যা৷’

‘তাই নাকি? অবন্তিকা সিংহর কতগুলো কন্যা?’

‘তা স্যার বলতে পারব না৷ আমি বনশ্রীর কথা জানতাম৷ আপনাকে কে ফোন করেছিল?’

‘মধুজা৷ বলল, মধুজা সিংহ৷’

চ্যাটার্জিবাবু হোহো করে হেসে বললেন, ‘এখন সবাই সিংহ হয়ে গেছে৷ এরা কেউই বিশ্বদীপ সিংহের কন্যা নন৷ হয়তো কোনও এক ঘোষ বোস মুখুজ্জে বা গাঙ্গুলীর কন্যা৷ এখন সবাই প্লটের ভাগ পেতে সিংহ হয়ে যাচ্ছে৷’

‘চ্যাটার্জিবাবু, সমস্ত বিষয়টা ভালো করে লিখে একটা নোট তৈরি করতে হবে৷ এত জট ছাড়াতে হলে আমাদের ল অফিসার দিয়েও হবে না৷ লিগ্যাল রিমেমব্রান্সার এর শরণাপন্ন হতে হবে৷’

চ্যাটার্জিবাবু ঘাড় নাড়লেন, ‘স্যার, তার আগে বিশ্বদীপ সিংহের ঘরে ফেরা দরকার৷ নইলে আরও জটিল হয়ে যাবে বিষয়টা৷’

চ্যাটর্জিবাবু ফাইলটা বগলে নিয়ে চলে গেলেন তাঁর সিটে৷

পরের দিন ফার্স্ট আওয়ারে বিক্রম তার চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে দেখল পিতৃবিয়োগের চিহ্নসহ এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে উত্তেজিত মুখে৷ বিক্রম চিনল রত্নদীপ৷ বুকের ভিতরটা ছাঁত করে উঠল, বলল, ‘আসুন ভিতরে৷’

রত্নদীপ চেয়ারে বসেই বলল, ‘বাবাকে মেরে ফেলা হল৷’

‘মেরে ফেলা হল?’ বিক্রম চমকে ওঠে৷

‘হ্যাঁ৷ ওই মেয়েছেলেটা চাইছিল বাবাকে মেরে ফেলতে৷ একদম সেন্ট পারসেন্ট সাকসেসফুল৷’

বিক্রম বুঝতে চাইছিল রত্নদীপের কথা৷

‘জানেন, গত তিন বছর ধরে বাবাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে৷ বাবা ডিভোর্সের মামলা রুজু করার পর দিনের পর দিন যায়নি কোর্টে৷ উকিল দিয়ে ডেট নিয়েছে৷ তারপর যা হল…’

‘কী হল?’ বিক্রম জিজ্ঞাসু৷

‘বাবা ডিভোর্সের ডিক্রি পাওয়ার পর বাবাকে রোজ ফোনে থ্রেট করত৷ বলত দেখে নেব তোমার কত মুরোদ৷ বাবা আমাকে কোনওদিন এ সব কথা বলেনি৷ কিন্তু আমি সব খবর পেয়ে যেতাম৷ তারপর হাইকোর্ট থেকে স্টে অর্ডার পাওয়ার পর রাতে বাবাকে ফোন করে এমন বিশ্রী ভাষায় আক্রমণ করেছে যে, বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ল৷ তখনই হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যেত৷ কিন্তু কেউ ছিল না আশেপাশে৷ বাড়ির পাশের এক ভদ্রলোক কীভাবে যেন জেনে ফেলে তখনই বাবাকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন৷ তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে৷’

‘ভেরি স্যাড’, বিক্রম বিড়বিড় করল৷

‘তারপর কী করল জানেন?’

‘কী?’

‘যেইমাত্র খবর পেল বাবা মারা গেছেন, অমনি আমাদের বাড়িতে হাজির৷’

‘তারপর?’ বিক্রম সোজা হয়ে বসে৷

‘আমাকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেল৷ ভেবেছিল বাড়িতে কেড নেই৷ আমি যে ব্যাঙ্গালোর থেকে এসে গেছি তা ভাবতে পারেনি৷’

‘হুঁ’, বিক্রম উৎকর্ণ৷

‘বললাম, কী চাই? আমার কাছা–পরা চেহারা দেখে বলল, আমিও ওনার শেষ কাজ করব৷ বললাম, তা এতদিন পরে ওনাকে মনে পড়ল? তো বলল, আমি তো ওনার সঙ্গে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ রাখতাম৷ উনিই তো কথা বলতে চাইতেন না৷ আমার উপর কেন কে জানে রাগ দেখাতেন৷ বলেই বললেন, আমি এখন থেকে এখানেই থাকব৷ আমি বললাম, ‘আপনি এখনই বেরিয়ে যাবেন, না পাড়ার লোক জড়ো করব৷ তো কিছুতেই যাবে না, বলল, আমি হাইকোর্ট থেকে স্টে অর্ডার পেয়েছি, এখন এই বাড়ির উপর আমার ন্যয্য অধিকার৷ শেষে আমি প্রায় জোর করেই তাকে বার করে দিয়েছি বাড়ি থেকে৷ চলে গেছে, কিন্তু যাওয়ার সময় বলে গেছে, পুলিশ প্রোটেকশন অর্ডার নিয়ে এসে ঢুকবে বাড়িতে৷’

বিক্রম উপলব্ধি করছিল সমস্যা পাকিয়ে ডঠেছে বেশ৷

‘এও বলে গেছে এই প্লটের মিউটেশনে এখন শুধু আমার নাম লেখা৷ বাইরের আর কাউকে এ বাড়িতে থাকতে দেব না৷ বুঝুন একবার, আমার ঠাকুর্দার তৈরি বাড়ি, আমি এই বাড়িতে জন্মেছি, বড় হয়েছি, এখন শুনতে হচ্ছে আমাকে এ বাড়িতে থাকতে দেবে না! তবে তার বলার মধ্যে যৌক্তিকতা আছে কারণ আপনারা শেষবার যখন মিউটেশন করেছেন, বাবার সঙ্গে বাইরের একটা মেয়েছেলের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন।’

‘মেয়েছেলে’ শব্দটা বিক্রমের কানে খটখট করে বাজছিল৷ কারও বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করলে এরকমই বিবমিষার সৃষ্টি হয় সন্তানদের মনে৷

‘কিন্তু আমি ওই ডাইনির ইচ্ছে পূরণ হতে দেব না৷ আপনাদের কাছে আমি সমস্ত বিষয়টা লিখিত আকারে রেখে যাচ্ছি৷ ওই প্লট থেকে অবন্তিকা সিংহের নাম কেটে আমার নাম করতে হবে৷ আমি ‘হ্যাঁ’, কিংবা ‘না’, যে কোনও একটা উত্তর চাই৷ ‘না’ উত্তর পেলে আমি কোর্টে গিয়ে ফয়সালা করব৷’

রত্নদীপ সিংহ একটা তিন পৃষ্ঠার চিঠি বাড়িয়ে দিল বিক্রমের দিকে৷ বলল ‘এটা আপনার হাতে দিয়ে গেলাম৷ আর একটা কপি আপনার অফিসে রিসিভ করিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷’

বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল রত্নদীপ৷

পরক্ষণে বলল, ‘আমি অবন্তিকা সিংহের নামে খুনের মামলা করব৷ বাবাকে ইচ্ছে করে খুন করেছে যাতে পুরো প্লটটার দখল নিতে পারে৷’

বিক্রম চেষ্টা করছিল বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করতে৷

‘আমি সেই রাতের কল রেকর্ড জোগাড় করেছি৷ বাবার সঙ্গে পঁয়ত্রিশ মিনিট কথা হয়েছে ওই ডাইনির৷ নিশ্চয়ই তীব্র বাদানুাবাদ৷ বারবার থ্রেট করেছে৷ তার ফলেই হার্ট অ্যাটাক৷’

বলে উঠে পড়ল রত্নদীপ৷

বিক্রম অনেকক্ষণ বিষয়টা নিয়ে ভাবল৷ উত্তরাধিকার সম্পর্কে এই দপ্তরের নিয়ম একটু অন্যরকম হওয়ায় হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না৷ এই দপ্তরের সার্কুলার অনুযায়ী প্লট কার দখলে আছে, সেইটেই বড় করে দেখা হয়৷ প্রয়োজনে আইনি পরামর্শ নেওয়া হয় সেই নিয়মকেই কার্যকরী করতে৷ এ ক্ষেত্রে অবন্তিকা ও রত্নদীপ, দুজনেই দুটো ঘর তালাবন্ধ করে দখল বজায় রেখেছে৷ বাকি ঘরগুলো ছিল বিশ্বদীপ সিংহের হেপাজতে৷ সেই ঘর এখন কার অধিকারে বর্তাবে সেটাই বিবেচ্য বিষয় ৷

রত্নদীপ সিংহের চিঠিটা পড়ে সেটি পাঠিয়ে দিল দপ্তরে, ডি বাই নাইনটিন প্লটের একটি পার্ট ফাইল করে ‘পুট আপ’ করতে৷

ঠিক পরের দিন ফার্স্ট আওয়ারে বিক্রম চেম্বারে ঢ়ুকে বিস্মিত হয়ে দেখল একটা লাল টকটকে ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে বসে আছেন অবন্তিকা সিংহ৷ তাঁর ব্যাগটি লাল, ঠোঁটদুটোও টুকটুকে লাল, কিন্তু পরনে সাদা শাড়ি, নীল পাড়৷ মাথর চুলও বেশ উশকো খুশকো৷ যেন ঠিকমতো স্নান–খাওয়া হয়নি৷ অভিব্যক্তিতেও শোক–শোক প্রকাশ৷

সাধারণত অফিসারের অনুপস্থিতিতে তাঁর চেম্বারে কোনও ভিজিটরের প্রবেশ করার নিয়ম নেই, কিন্তু অবন্তিকা সিংহ বোধ হয় নিয়মের বাইরে৷ বিক্রমকে ঢুকতে দেখে বললেন, ‘স্যরি, প্রায় একঘন্টা বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম, পা এত টনটন করছিল যে, বাধ্য হয়ে…’

বিক্রম তার চেয়ারে বসল, মহিলাকে দু’দণ্ড নিরিখ করে বলল, ‘অফিস শুরু হয় সাড়ে দশটায়, আপনি যদি তারও একঘন্টা আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন তা হলে আমরা আর কী করতে পারি বলুন, কী বলবেন?’

মিসেস সিংহর গলাটা এবার কান্না–কান্না শোনাল, ‘আপনি তো সব শুনেছেন৷ আশ্চর্য কী জানেন, আমার স্বামী মারা গেলেন, আমি বাড়িতে গিয়েছিলাম তাঁর শেষ কাজ করতে, তাতে রত্ন বাধা দিয়ে বলল, আপনি যে ঠিকানায় থাকছিলেন এ ক’মাস, শেষ কাজ সেখানেই করুন গিয়ে৷ দেখুন, বিশ্বদীপের সঙ্গে আমার তো কোনও অবনিবনা ছিল না, ঝামেলা বাধল ম্যাকবেথকে নিয়ে৷ বিশ্বদীপ চাইছিল ম্যাকবেথকে অন্য কোথাও রেখে আসতে, আমি রাজি হইনি৷ ম্যাকবেথ আমার প্রাণের প্রাণ৷ ওকে কোথায় পাঠিয়ে দেব বলুন৷’

বিক্রম আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘শুধু কুকুর নিয়ে সমস্যা?’

‘একদম৷ আমাকে বলল, ম্যাকবেথ থাকলে তোমাকে আমার দরকার নেই৷ তা আমি ম্যাকবেথকে ওখানেই রেখে নিজে চলে গেলাম অন্য একটা ফ্ল্যাটে৷ ব্যস, প্রবলেম সল্ভ্ড৷’

‘সল্ভ্ড?’

‘হ্যাঁ৷ উনি একদম টাইট৷ ম্যাকবেথ এই পৃথিবীকে দুজনকে চেনে৷ আমাকে আর বিশ্বদীপকে৷ তৃতীয় কোনও ব্যক্তি ওর ধারেকাছ ঘেঁষতে পারবে না৷ একদম টুঁটি ছিঁড়ে ফেলবে৷ ওই প্লটে আমি না থাকলেও ম্যাকবেথ আছে আমার প্রতিনিধি হয়ে৷ ওকে ওখান থেকে কেউ উৎখাত করতে পারবে না৷’

বিক্রম শিউরে উঠছিল৷

‘এখন বলুন, আমাকে যে রত্ন ফ্ল্যাটে ঢুকতে দিল না তার কী হবে? আমি কি বিশ্বদীপের শেষ কাজে থাকতে পারব না?’

বিক্রম সমস্যাটা গা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল, বলল, ‘ওটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার৷’

‘মোটেই ব্যক্তিগত বাাপার নয়৷ আপনার দপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী আমিই এখন একমাত্র প্লট– হোল্ডার৷ আপনাদের দপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী রত্ন এখন আউটসাইডার৷ সেই আউটসাইডার আমাকে ওই বাড়িতে ঢ়ুকতে দিতে চাইছে না৷ যদিও আমি পারতাম ওই বাড়ির পজেশন নিতে৷ শুধু ঘর খুলে ম্যাকবেথকে একবার ছেড়ে দিলেই প্রবলেম সল্ভড। কিন্তু আইন আমি নিজের হাতে নিতে চাইনি৷ আপনাদেরই আমকে ওই বাড়িতে বাস করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷’

শিরশির করছিল বিক্রমের শরীর৷ চোখ রাখছিল অবন্তিকা সিংহের চোখের দিকে৷ তাঁকে কি খুনি মনে হচ্ছে?

বিক্রম আবারও গা থেকে ঝেড়ে ফেলল সমস্যাটা, বলল, ‘আপনার কাছে নিশ্চয়ই মিউটেশনের চিঠি আছে৷ ওই চিঠির বলে আপনি আপনার বাড়িতে ঢুকে পড়ুন৷ তাতে আমাদের কী করণীয় বলুন!’

‘কিন্তু এখন রত্ন বলছে ওই বাড়িতে আমার কোনও রাইট নেই৷ আপনি বলুন, আমার কি রাইট নেই? আমারই একমাত্র রাইট৷’

‘তা হলে আর আমার কাছে এসেছেন কেন?’

‘কারণ রত্ন পাড়ার ছেলেদের জোগাড় করে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে৷ বলছে, কিছুতেই ঢুকতে দেবে না৷ আর আমার ম্যাকবেথকে একটা ঘরে আটকে রেখেছে৷ সে রাতদিন কাঁদছে৷’

‘কাঁদছে তা আপনি কী করে জানলেন?’

‘আমি তো গিয়েছিলাম বাড়িতে৷ দেখি একটা স্টিরিও সেটে গাঁক গাঁক করে গান চালিয়ে রেখেছে যাতে ম্যাকবেথের কান্না না শোনা যায়৷ কিন্তু আমি গেছি বুঝতে পেরে ম্যাকবেথের কী কান্না!’

‘কী করে বুঝবে? আপনাকে কি দেখতে পেয়েছিল?’

‘দেখতে পাবে কেন আমি গেলেই ও দূর থেকে গন্ধ পায়৷ সেদিনও গন্ধ পেয়ে ডাক ছেড়ে কী কান্না! কতদিন আমাকে দেখেনি বলুন তো আগে এক রাত্রিও আমাকে ছাড়া ঘুম হত না ওর৷’

এ সব গল্প আগেই শোনা হয়ে গেছে বিক্রমের৷

‘এবার বলুন আমি কী করে ও বাড়িতে ঢুকব?’

বিক্রম বিরক্ত হচ্ছিল মহিলার একই কথা বারবার শুনে৷ আবারও বলল, ‘এটা আমার দেখার বিষয় নয়৷ প্রয়োজনে আপনি পুলিশে যেতে পারেন৷’

‘আমি কি পুলিশে যাইনি ভাবছেন?’

‘গিয়েছিলেন নাকি? তা হলে তো ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন৷ আবার আমার কাছে এসেছেন কেন?’

‘পুলিশ বলছে কোর্ট থেকে পুলিশ প্রোটেকশন অর্ডার নিয়ে আসুন৷’

বিক্রম এতক্ষণে বুঝল কেন মহিলা তার কাছে এসে চেঁচামেচি করছেন।

বলল, ‘তা হলে কোর্টে যান৷ পুলিশ তে ঠিকই বলেছে৷’

অবন্তিকা রাগে টগবগ করে ফুটছিলেন, বিক্রমের কথা শুনে এমন ক্রুদ্ধ চোখে তাকালেন যেন ভস্ম হয়ে যাবে বিক্রম৷

কিছুক্ষণ বিক্রমকে রাগের আগুনে পুড়িয়ে লাল ভ্যানিটি ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, ও–বাড়িতে আমার রাইট আছে কি না দেখিয়ে দিচ্ছি৷’ বলে খটখট শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলেন চেম্বার থেকে৷

চ্যাটার্জিবাবু নিশ্চয়ই দূর থেকে খেয়াল করছিলেন অবন্তিকা সিংহের গতিবিধি৷ অবন্তিকা বেরিয়ে যেতেই মুচকি হাসি ঝুলিয়ে ঢুকলেন চেম্বারে৷ বললেন, ‘মিসেস সিংহ এবার ঘোর সমস্যায়৷’

‘সমস্যা হওয়ারই কথা৷ কিন্তু উনি তো সব নিয়মের বাইরে হাঁটেন।’

‘এখন থানা কী করে সেটাই দেখার৷’

বিক্রম সমস্যাটাকে মাথা থেকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পুরো যায় না, বিনবিন করে ঠোক দিতে থাকে বারবার৷ উড়িয়ে দেওয়া গেলও না, কারণ পরের দিনই বার্লিন থেকে মধুজা সিংহের ফোন, বলল, ‘আপনি তো শুনেছেন বাবা দেহ রেখেছেন৷ মা আমাকে বললেন, যত কাজই থাকুক, শ্রাদ্ধের দিন অবশ্যই যেন আসি৷’

বিক্রম শুনে কী করবে, বলল, ‘হুঁ৷’

‘আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন দাদা মাকে বাড়িতে এন্ট্রি দেয়নি৷ আমি কাল দাদাকে ফোন করে বললাম, কেন এরকম করছিস৷ হাজার হোক, মা তো৷ কিন্তু দাদা অ্যাডামেন্ট৷ ফট করে ফোনটা কেটে দিল৷’

বিক্রম বোঝার চেষ্টা করছিল রত্নদীপের সঙ্গে মধুজার সম্পর্ক কতটা আন্তরিক৷ মধুজা কি এ বাড়িতে থাকত, থাকলে কতদিন?

‘এখন বলুন আমাকে কী করতে হবে?’

‘আমাকে বলুন, আমার মা যখন ওই প্লটের একমাত্র উত্তরাধিকারী, তা হলে নিশ্চয়ই আমার আর আমার বোন বনশ্রীর নাম ওই প্লটে থাকবে?’

বিক্রমের এবার পাগল–পাগল লাগছে৷ বলল, ‘এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না৷ যত দিন যাচ্ছে বিশ্বরূপবাবুর উত্তরাধিকারীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে৷ কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে!’

মধুজা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘ক’জন আর উত্তরাধিকারী আমি আর অমার বোন বনশ্রী, ওদিকে দাদা রত্নদীপ আর বোন শুভ্রলেখা৷’

বিক্রম চমকে উঠে বলল, ‘শুভ্রলেখা! কই, তার নাম তো শুনিনি?’

‘শোনেননি সে কি! নিউ ইয়র্কে থাকে৷ বলেছে সামনের সামারে আসবে৷ আমাকেও আসতে বলেছে ওই সময়৷ বোনও আসবে মালয়েশিয়া থেকে৷ সবাই মিলে খুব হইহই করব৷’

বিক্রমের ভিতরটাও হইহই করে ডঠল৷ একটা গাছ থেকে প্রচুর ডালপালা, লতাপাতা৷ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে সেই উত্তরাধিকার৷ তাদের সামলানো মুশকিল৷

‘বেশ আপনারা হইহই করুন৷ আমাদের একটু বিশ্রাম দিন৷’

ফোনটা রেখে একটু স্বস্তি পেতে চাইল, কিন্তু কোথাও স্বস্তি নেই৷ ডাক পড়ল চৌধুরি সাহেবের ঘরে৷ অফিসে কী ঘটছে না ঘটছে সব তার কানে পৌঁছায়৷

বিক্রম যেতেই চৌধুরিসাহেব বললেন, ‘বুঝলে, এই কারণেই ফাইলটা রেখে দিয়েছি টেবিলে৷ ওরা সবাই মিলে কোর্টে গিয়ে লাঠালঠি করুক৷ যে জিতে আসবে, প্লট তার৷ আমরা এর মধ্যে থাকব না৷ যাই সিদ্ধান্ত নেব, হেরো পক্ষ কোর্টে গিয়ে ইনজাংশন নিয়ে আসবে৷ তার চেয়ে ফাইলটা জিরোক৷ আজ প্রায় চার–পাঁচ বছর ধরে ফাইলটার পেটমোটা হয়ে চলেছে, এখনও ডেলিভারি হল না৷’

বলে হা হা করে হাসলেন কিছুক্ষণ৷

বিক্রমের মনে হচ্ছিল এ এক আশ্চর্য জীবনপঞ্জি৷ কী করে ফয়সালা হবে কে জানে!

কী আশ্চর্য, কয়েকদিন সবাই চুপচাপ৷ বোধ হয় বিশ্বদীপ সিংহের শেষ কাজ নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিলেন, বিক্রমও ব্যস্ত ছিল অন্য ফাইলগুলোর সদগতি করতে৷ হঠাৎ এক বিকেলে মুচকি হাসিটি প্রসারিত করে চ্যাটার্জিবাবু ঢুকে পড়লেন চেম্বারে, ‘স্যার, প্রবলেম এখনকার মতো সল্ভ্ড৷’

‘তাই নাকি?’ বিক্রম কৌতূহলী হল, ‘কীভাবে?’

‘মিসেস সিংহ সত্যিই সিংহী৷’

‘মানে?’

‘মিসেস সিংহ তাঁর দুই মেয়েকে আসতে বলেছিলেন জার্মানি আর নিউ ইয়র্ক থেকে৷ শ্রাদ্ধের দিন সকালে তিনজনে মিলে গিয়ে হাজির ডি বাই নাইনটিন বাড়িতে৷ তখন বাড়িতে বেশ কিছ আমন্ত্রিত অতিথি৷ তাদের সামনে রত্নদীপ কিছু বলতে পারেনি, সে নিজেও ব্যস্ত ছিল পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণে৷ মিসেস সিংহ অমনি তাঁর ঘরের চাবি খুলে ঢুকে পড়েছেন দুই মেয়ে নিয়ে৷ কুকুরটাকেও বার করে নিয়ে এসেছেন বিশ্বদীপ সিংহের ঘর থেকে৷ কাজ শেষ হয়ে গেলে দু’পক্ষের কিছ চেঁচামেচি হলেও রত্নদীপ খুব সুবিধে করতে পারেনি৷ কারণ কি জানেন? ওই ম্যাকবেথ৷ রত্নদীপ যতবার মিসেস সিংহের দিকে তেড়ে আসে, অমনি ম্যাকবেথ দু’পায়ে দাঁড়িয়ে আক্রমণের ভঙ্গিতে রত্নদীপকে থামিয়ে দেয়৷ বুঝলেন অ্যালসেশিয়ানটার ভয়ে রত্নদীপ বেশি কিছু ঝামেলা করতে পারেনি৷ তা ছাড়া তার ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ পরদিন সকালেই ছিল তার ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার ফ্লাইট৷ বাড়িটার একটা ঘর তালা দিতে পারলেও বাকি বাড়ি মিসেস সিংহের হেপাজতে রেখেই চলে যেতে হয়েছে তাকে৷’

বিক্রম হাঁ করে শুনছিল রোমহর্ষক কাহিনির শেষাংশ৷ হেসে বলল, ‘তা হলে ম্যাকবেথই বাঁচিয়ে দিল মিসেস ম্যাকবেথকে। তা হলে ফাইলের কী হবে?’

চ্যাটার্জিবাবু হেসে বললেন, ‘আমাদের বস সব শুনে বললেন, যাক, শেষপর্যন্ত একটা কিছু ডেলিভারি হয়েছে৷ মামলাটা শেষ হলে পরে দেখা যাবে বাকি সব৷ অন্তত তিন বছর পর৷ ততদিনে লেডি ম্যাকবেথ তাঁর ম্যাকবেথকে নিয়ে সুখে সংসার করুন৷’



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *