onubad-jhogra

ঝগড়া
মূল রচনা – পার্ল বাক
অনুবাদ – বৈশাখী ঠাকুর

চিত্র সৌজন্যে – উইকিপিডিয়া

লেখক পরিচিতি – (১৮৯২-১৯৭৩) পার্ল বাক ছিল পার্ল নি সিডেনস্টীকার ওয়ালশ-এর ছদ্মনাম। তিনি আমেরিকান লেখিকা এবং ঔপ্যনাসিক। জন্ম থেকে তিনি চীনে বাস করতেন এবং সেখানকার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তাঁর প্রথমদিকের গল্প উপন্যাস।তাঁর “গুড আর্থ” অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি উপন্যাস। তিনি পুলিতটজার প্রাইজ পেয়েছিলেন ১৯৩২ সালে। নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন সাহিত্যের জন্য ১৯৩৮ সালে।

গ্রামের ছোট্ট রাস্তায় তীব্র রাগে লোকটা ভিড়ের দিকে তাকালো যেখানে তার বাড়ি ছিল। সেখানে তার প্রতিবেশীরা তার এবং তার স্ত্রীর আশেপাশে দাড়িয়ে, প্রায় তিরিশ চল্লিশজনের জটলা, পুরুষ এবং স্ত্রী, তাঁদের মুখ গম্ভীর এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে। ছোট্ট বাচ্চারা, গরমের দাবদাহে নগ্ন হয়ে অস্থিরভাবে নিজেদের ঠেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল গুরুজনদের পায়ের ফাঁক দিয়ে যাতে মধ্যিখানের ফাঁকা এলাকাটায় পৌঁছতে পারে যেখানে লোকটা আর তার স্ত্রী অবস্থান করছিল, এই উদ্দেশ্যে যে ঝগড়ার কোন অংশ বাদ না যায়। লোকটা তার ক্রন্দনরতা স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছিল না, এবং নিজে মাথাটা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল এবং বাচ্চাগুলোকে দেখতে পেল, এবং দেখার পর, খেয়াল করল তার এক সন্তান ছিল ওই ঝাঁকের মধ্যে, আট বা নয় বছরের। হ্যাঁ, তার থেকেও আরো দুটো কনিষ্ঠ সন্তানও সেখানে উপস্থিত ছিল, এসেছে দেখতে কি হচ্ছে, এবং তিনটে বাচ্চাই মুখ তুলে পিতা-মাতার দিকে তাকিয়ে অপার বিস্ময় নিয়ে।

হঠাৎ লোকটার আর সহ্য হল না। যথেষ্ট আরো অনেক কারণ ছিল, ইদানীংকালে স্ত্রীর কান্না আর বকুনি, তাঁর লুকোনো রাগ এবং সন্দেহ যেটা সে বলতে পারত না। লোকটা একটা ধমক দিয়ে ছুটে গেল তার তৃতীয় সন্তানের দিকে, কষে এক থাপ্পড় মেরে চীৎকার করে বলল, “যা বাড়ি যা, বজ্জাত কোথাকারের!”

বাচ্চাটা কান্নায় ফেটে পড়ল, চোখে আঙ্গুল রগরাতে লাগল, কামানো মাথায় হাত বোলাতে থাকল এবং দাঁড়িয়ে রইল, নিশ্চিত যে ভিড় থেকে সে সমবেদনা ঠিক পাবেই পাবে। মহিলাটি তখন ভিড়ের উদ্দেশ্যে, একবার তাঁর কান্না ভেজা মুখটা একপাশে আর তারপর তাঁর কান্নাভেজা মুখটা ভিড়ের অন্যপাশে নিয়ে গিয়ে, বাচ্চার প্রায় স্তিমিত কান্নার মাঝখানে বলে উঠল, “এবার দেখতে পাচ্ছেন মানুষটি কেমন প্রতিবেশীরা, —- ইদানীংকালে তিনি এখন এরকমই হয়েছেন।”

জনতা মুখে কুলুপ এঁটে নির্নিমেষে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারা সব কিছু শুনেছে, মহিলার অভিযোগ, লোকটার ছোট উত্তর, অতঃপর নীরবতা। কিন্তু লোকটার প্রতি অসমর্থনে বাতাস ভারী ছিল, এবং সে সেটা বিলক্ষণ অনুভব করতে পারছিল। সে তাঁর আঁশের মত চামড়া ওঠা খালি পায়ের দিকে তাকাল এবং গোড়ালি দিয়ে ধূলোর মধ্যে আগে পেছনে করতে লাগল। ধূলোরাশি তাকে তার শুকনো ক্ষতের কথা মনে করিয়ে দিল, যারা জল পাওয়ার জন্য অপেক্ষারত। সে বিড়বিড় করে উঠল,

—-আমার সমস্ত কাজ আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে আর আমি কিনা এখানে আস্ত সুন্দর একটা বিকেল নষ্ট করছি।” এই চিন্তাপ্রবাহটা তাঁর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তাঁর গোল কৃষ্ণাঙ্গ মুখটা লালচে বর্ণ ধারণ করল, এবং তাঁর রগের শিরাগুলো ফূলে উঠল তৎক্ষণাৎ। সে দ্রুত মাথা তুলে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তার স্ত্রীর দিকে আর চীৎকার করে উঠল,

—- তুই ঠিক কি চাস হারামজাদী? আমাকে বল আর আমাকে মাঠে ফিরে যেতে দে! আমি কি করে টাকা রোজগার করব তোকে খাওয়ানোর জন্য আর তোর যত…তোর…তোর…।

—– আপনারা সব দেখতে পাচ্ছেন ও কিরকম! মহিলাটি ফোঁপাতে থাকল। আপনারাই দেখুন এখন আমার সাথে কিভাবে কথা বলে। দু মাস আগেও এই মানুষটা দয়ার শরীরে সেরা ভদ্রলোক ছিল। বোনেরা, আপনারা আমার মুখ থেকে প্রায়ই শুনেছেন যে আমি নিজেকে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য মনে করতাম যে আমাকে এরকম একটা মানুষ জীবনে দিয়েছেন। প্রতিটা পয়সা যা তিনি রোজগার করেছেন আমার হাতে এসে দিয়েছেন এবং একটা বালকের মত আমার কাছে এসে অল্প পয়সা চাইতেন চুল কাটার জন্য কোন ভোজের আগে বা একটু খেলবে বলে অথবা খানিক তামাক খাবার আগ্রহে। আর আমি খুশী মনে তাকে এই আনন্দটুকু দিয়েছি। এখন, গত দুই মাসে, আমি একটা পয়সাও তাঁর থেকে পাইনি, যদিও সে যে শেষ ধানটা বিক্রি করেছিল, বেশ ভাল দামেই বিক্রি করেছিল, এবং সে আমাকে বলে পর্যন্ত নি যে কত লাভে সেটা বিক্রি হল!

মহিলাটি আরো জোরে কাঁদতে লাগল, তাঁর ছোট্ট বাদামী বলিরেখাযুক্ত মুখে অঝোর বারিধারা, আর তারপর সে তাঁর নীল অ্যাপ্রনটা মাথার ওপর চাপা দিয়ে আরো জোরে কাঁদতে লাগল।

তবুও জনসাধারণ নীরব ছিল আর বাচ্চারা হাঁ করে তাকিয়ে তাঁদের দিকে। লোকটার অন্য দুটো বাচ্চা মায়ের কাছে ঘেঁষে এল, এবং মায়ের সুতির নীল ঢোলা পাজামার ভেতর মুখ গুঁজে আওয়াজ করে সাথে কাঁদতে শুরু করল। এই নীরবতা আর কান্নার মাঝে লোকটা চোখের কোণা দিয়ে তাকাল, যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে রাস্তার একটা দরজার দিকে।

হ্যাঁ, সেখানে একজন দাঁড়িয়ে ছিল, একটা অল্পবয়সী মেয়ে সবুজ লম্বা জোব্বার পোশাক পরে, যেমনটা আজকালকার দিনে শহরে মেয়েরা পরে, এবং তাঁর চুল ছোট করে ছাঁটা গলা পর্যন্ত। তাঁর একটা দুষ্টুমি মাখানো মিষ্টি মুখ ছিল এবং সে মৃদু হাসছিল ঝগড়াটা শুনতে শুনতে, দরজায় হেলান দিয়ে আলস্য ভরা চোখে। এবার যখন সে লোকটার চোরা দৃষ্টিটা খেয়াল করল, সে তাঁর চকচকে কালো চুলের ভেতর থেকে একটা গোলাকার চিরুনি বের করল আর তাঁর চুলের ভেতর দিয়ে চালিয়ে দিল।

কিন্তু এই লোকটা আবার নীচের দিকে তাকিয়ে রইল। তাঁর মুখ আগের চেয়ে আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আর সে তখন বলল,

—– আমি জানি না তোমার এত কেন পয়সা লাগে সব সময়? বাড়িতে চাল আছে আর গম আছে আর আছে বীনের তেল, আর আমাদের বাগানে বাঁধাকপিও মজুত।

মহিলাটি তাঁর মাথার ওপর থেকে তালি দেয়া অ্যাপ্রনটা আচমকা সরিয়ে দিল আর তাঁর দিকে ঝুঁকল, তাঁর চোখের জল শুকিয়ে গেছে অতর্কিত এক রাগের জ্বালায়। তাঁর ছোট, শক্ত, কুঁচকে যাওয়া হাত দুটো কোমরে রাখল আর ঝুঁকে তারস্বরে বলল,

—- হ্যাঁ, খাবারটাই কি যথেষ্ট? বাচ্চাদের পা থেকে জুতোগুলো চলে গেছে দেখতে পাও না? আমার দিকে তাকান প্রতিবেশীরা, এই তাপ্পিগুলো খেয়াল করুন আমার কোটে। কবে আমি শেষ নতুন জামা কাপড় পরেছিলাম? তিন বছর আগে ও মানি ক্লাব থেকে কিছু মুনাফা করেছিল— দশটা রূপোর পয়সা সে পেয়েছিল আর তাই দিয়ে দুই বোল্ট অমসৃণ, সাদা কাপড় কিনেছিল, সবচেয়ে শক্ত এবং সস্তায় যেটা পেয়েছে। আমি সেগুলোকে নীল রঙে ছুপিয়েছিলাম এই হাতগুলো দিয়ে আমার। তাই দিয়ে আমি দুটো পোশাক কেটে বানিয়েছিলাম—আমার একটা আর আমার বড় ছেলের একটা আর আমরা এখনও সেটা পরি আর আমি তাপ্পি মেরেই চলেছি, মেরেই চলেছি। আর আমি তাপ্পি মারতে পারছি না—-তাপ্পি মারার জন্যও তো কাপড় লাগে তাই না, আমার পায়ে পরার কোন জুতো নেই, আর আমার বাঁধা পায়ে আমি কি বাচ্চাদের মত খালি পায়ে বেরোতে পারি!! কেবলমাত্র আজ সকালে আমি অল্প পয়সা চেয়েছিলাম জুতো কেনার জন্য এবং সে কি করল? সে আমাকে তো দিলই না, উলটে শাপশাপান্ত করল এবং সে এতই রেগে গেছিল যে দুপুরে খেতেই এল না, কোন এক সরাইখানায় গিয়ে খেয়ে এসেছে আর যত ভালমন্দ খাবার তাঁর জন্য আমি বানিয়েছিলাম সেগুলো এখন সব নষ্ট হবে। এদিকে সে বলেছিল তাঁর কাছে কোন পয়সা নেই, অথচ সে গিয়ে ঠিক খাবার কিনতে পারল আমার ওপর রাগ দেখানোর জন্য—।

তাঁর রাগ আচমকা কান্নায় রূপান্তরিত হল।

—– ব্যাপারটা এমন নয় যে আমি তাঁর কাছে পয়সা চেয়েছিলাম কোন হাল ফ্যাশানের লম্বা জোব্বার মত পোশাকের জন্য যেমনটা আজকাল অনেক মহিলা পরে। আহ! আমি খুব ভাল করে জানি কোন মহিলার জন্য লম্বা পোশাক কেনার পয়সা আছে, কিন্তু তাঁর বৌয়ের জন্য বরাদ্দ নেই।

এই কথাতে একটা সাংঘাতিক অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল লোকটার চোখেমুখে। সে লাফিয়ে সামনে গেল, বাহু উদ্ধত মহিলাটিকে আঘাত করবে বলে, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে থেকে অনেকেই এগিয়ে এসে তাঁর হাতটা ধরে নিল, আর মহিলাগণ তাঁর স্ত্রীকে টেনে পেছনে সরিয়ে দিল। তাঁর মধ্যে একটি লোক যে তাঁর হাত ধরে ছিল মৃদু স্বরে বলল,

—- মনে রেখ তিনি তোমার স্ত্রী এবং তোমার সন্তানের জননী।

—–আমি ওকে পুত্র সন্তান দিয়েছি—-আমি ওকে পুত্র সন্তান দিয়েছি,” বলে কাতর স্বরে কাঁদতে লাগল তার স্ত্রী।

ঠিক সেই মুহূর্তে এক মোলায়েম স্বর শোনা গেল। সেটা এক বৃদ্ধার কণ্ঠ নির্গত যার মুখ বিস্তীর্ণ বলিরেখায় ভর্তি, যিনি এতক্ষন ভিড় থেকে একটু দূরে এক ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার তিনি উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলেন,

—-তোমরা দুজন কিন্তু আর ছোটটি নেই। লি, তুমি প্রথমে, তোমার পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স, আমি জানি, আমি ছিলাম তোমার মায়ের সাথে যখন তুমি জন্মেছিলে। তোমার স্ত্রী চুয়াল্লিশ। আমি এটা জানি কারণ আমি তাঁর বিয়েতেও উপস্থিত ছিলাম। তোমাদের আঠাশ বছর বিয়ে হয়ে গেছে এবং তোমাদের বারোটা সন্তান হয়েছিল যার মধ্যে এখন মাত্র সাতজন এই পৃথিবীর বুকে আছে। তোমার জ্যেষ্ঠ সন্তানের সাতাশ বছর বয়স হত যদি আজ সে বেঁচে থাকত এবং তুমি এতদিনে দাদু হয়ে যেতে আর তোমার স্ত্রী ঠাকুরমা। আর তোমার সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তান কিনা এখন তিন বছরের। সেই সব দিনের কথা চিন্তা কর আর এই এতগুলো বছর যে একসাথে পার করলে ওই জমিকে সম্বল করে এবং ভগবান তোমাদের মধ্যে শান্তি বজায় রাখুক।

এই কথাগুলি প্রাচীণা কাঁপা অথচ পরিষ্কার গলায় বললেন এবং যেহেতু তিনি সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন সেই গ্রামে এবং সর্বাপেক্ষা ধনী সন্তানের মা, তাই সকলেই ওনাকে সম্মান করতেন এবং শুনতেন উনি যা উপদেশ দিতেন। ওনার কথা বলা শেষ হলে লোকটির স্ত্রী নরম গলায় বলল,

—– ঠাকুমা, আপনি ত জানেন আমি বরাবর বলে এসেছি আমার মানুষটি ভাল—সবচেয়ে ভাল এবং দয়ালু লোক। তাই ছিল সে এই দুই মাস আগেও। এখন দেখুন ওর চাহনি!

সে তাঁর দৃষ্টি লোকটার দিকে ঘোরাল, আর জনতার চোখও লোকটার দিকে ঘুরে গেল। লোকটা আবার মাথা হেঁট করল।

—–দেখুন ঠাকুমা কেমন চেহারা হয়েছে ওর! যে ভদ্র সজ্জন ব্যক্তি সে ছিল, আর এখন তার তিরিক্ষি মেজাজ আর রাগ। হ্যাঁ, ও বেরিয়ে হেসে মজা করতে পারে কিছুজনের সামনে, কিন্তু বাড়িতে এলেই গোমড়া মুখে চুপ করে থাকে আর মুখে একটা ভাল কথা নেই, আর ও বাড়িতে কথাই বলে না যদি না সেটা আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ হয় যে আমার চুল মসৃণ নয় অথবা আমার কোট অপরিষ্কার কিংবা অন্য কোন খুঁতের ব্যাপারেই সে মুখ খোলে। আর আমার তো শরীরে দেওয়ার মত এই একটা কোটই, আমি কি করে সব সময় পরিষ্কার থাকব? আমাকে ঘর সংসার দেখতে হয়, বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে হয়, মাঠে কাজ থাকে— আমি কি করে অন্য কিছু মহিলাদের মত চামড়ায় পাউডার ঘষব ফরসা হবার জন্য বা চুলে তেল দেব মসৃণ করার জন্য?

হঠাৎ লোকটা আর সহ্য করতে পারল না।

—– আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি চাও আমার থেকে? এই এত কথা আওয়াজ— যুক্তিহীন সবকিছু—কি চাও কি তুমি?

—– আমি তোমার থেকে কি চাই? আবেগমথিত গলায় মহিলাটি বলে উঠল। আমি একটা জিনিস কেবল তোমার থেকে চাই। দু মাস আগে, তুমি যা ছিলে আমার প্রতি আমি সেই তোমাকে ফিরে পেতে চাই। আমার এইটুকুই চাহিদা। তুমি বদলে গেছ, তোমার মন আমার থেকে সরে গেছে। আমি এই একটা জিনিসই চাইছি—আমি সেই তোমাকে চাই যা তুমি ছিলে আগে।

এখন যেন সেই ভিড়, মানুষজনের জটলা ছিল না। কেবল তারা দুজন পারস্পারিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, একলা এই পৃথিবীতে আবেগ উজাড় করে কথা বলছে, এক নারীর আবেগ। তাঁর ছোট শক্ত কড়া পরা হাত দুটো সে মেলে ধরল,

—– তুমি আবার সেই আগের মত হয়ে যাও, আমার প্রতি যেমন ছিলে সেই তোমাকে আমি চাই।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ভিড়ের মধ্যে। লোকটা দ্রুত তাঁর ঠোঁট ভেজাল দু তিনবার আর তার অবাধ্য সামনের কিছু কালো চুলের গুচ্ছ থেকে দু তিন ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ল। সে আবার তাকাল, গোপনে, সেই দরজাটার দিকে— ছিপছিপে ফরসা সবুজ অবয়ব বিকেলের পড়ন্ত রোদে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার পোশাকের সবুজটা ছিল বসন্তে আসা নতুন কিশলয়ের মত, যখন ফুলে ফলে গাছ ভরে থাকে, বিশুদ্ধ সতেজ সবুজে চারিদিক আচ্ছাদিত। সে মুখ উচু করে সরাসরি তাঁর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল না। কিন্তু সে যথাযথ ভাবে জানত তাঁর মুখমণ্ডল কেমন, তাঁর ফর্সা ত্বক, লাল ভরা ওষ্ঠে সদা হাসি লেগে আছে, তাঁর অকুতোভয় কালো চোখ, কখনও তাঁর দিক থেকে ফিরিয়ে থাকত না। ওই চোখের দৃষ্টিই তাঁর বুকে বিঁধে গেছিল যখনই সে পাশ দিয়ে যেত। সে প্রায়ই যাতায়াত করত শুধু মাত্র ওই চাহনির জন্য, যদিও একদিনও সে একটা কথাও বলেনি তাঁর সাথে। কি করে সে কথা বলত? মেয়েটি যে সেই গ্রামের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তির নাতনি আর সে কিনা একটা চাষী যার নিজস্ব এক ফালি জমি পর্যন্ত নেই, যা তাঁর আছে ওই অন্যের জমিতে ফসল ফলানোর ধন। সে গত দু মাস ধরে জমাচ্ছে একটা লম্বা নীল সুতির গাউনের জন্য যেমন বেশীর ভাগ লোকেরা এখন পরে, আর এক জোড়া সাদা শহরে তৈরি স্টকিংস আর শহুরে জুতো জোড়া কিনবে বলে।

যখনই সে এই তিক্ত সঞ্চয়ের কথা ভাবে, তখনই সে ক্রন্দনরতা স্ত্রীকে তার হৃদয় থেকে সরিয়ে দেয়। সে এত বছর তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ছিল। তার পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েস হতে চলল অথচ সে তার নিজের সুখের জন্য কোনদিনও কিছু করেনি—ন্নাহ! সে একদিনের জন্যেও কোন সাধারন মনোরঞ্জনের জায়গাতেও পা দেয়নি যেখানে খুব গরীব মানুষেরাও গেছে কিছু আনন্দ আর পরিবর্তনের জন্য ছোট এক টুকরো রুপোর বিনিময়ে। দিন রাত এক করে সে তার স্ত্রী এবং বাচ্চাদের জন্য পরিশ্রম করেছে আর এখন তার পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েস আর থাকার মধ্যে আছে তার একটা পুরনো জোব্বা তার শরীরে জড়িয়ে, আর এর বাইরে কক্ষনো কোন কিছু নয়, কেবল মাঠে কাজ করার জন্য তাপ্পি দেওয়া পুরনো এক সেট কাপড়জামা।

কিন্তু তার পরেও একটা জিনিস তাকে ভাবাচ্ছে। সে কি সব পুরুষের দিকেই ওইভাবে তাকিয়ে থাকে, ওই বড় বড় চোখ দিয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী দৃষ্টি নিয়ে, নাকি সেটা শুধু তার দিকেই? এটাই যা তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে এই সব দিন এবং রাতে। যতবার সে তাঁর দরজার পাশ দিয়ে গেছে, চোরা চোখে তাঁর দিকে তাকিয়েছে, সে ততবারই ওই দৃষ্টি বিনিময় করেছে, কি সাহসী, কি স্বচ্ছন্দ। সে আড্ডায় লোকেদের বলতে শুনেছে, যেমন কিছু লোক বলে যে আজকালকার রমণীরা বদলে গেছে, আগের মত পুরুষদের ভয় পায় না, যাকে পছন্দ হয় তাকেই নির্বাচন করে, স্বাধীন এবং প্ররোচনাময়ী। সে ফের ঠোঁট ভেজালো। সে কি করে জানবে যে মেয়েটা কেবল তাঁর জন্যেই ওই দৃষ্টি সঞ্চয় করে রাখে নাকি সব পুরুষদের দিকেই ওই কটাক্ষ হানে? তাকে কোনভাবে এই সত্যি জানতেই হবে।

সে আচমকা মাথা উঁচু করল আর সোজাসুজি ওই দরজার দিকে তাকাল। তার সত্যিটা জানা উচিত কি উচিত না?

জনতাজনার্দনের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু এখন সে যখন তারা দেখল যে লোকটা মাথা উঁচু করে তাকিয়েছে। এবার মাথা ঘুরিয়ে সে যেদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছে, জনগণও সে দিকেই তাকিয়েছে। সেইখানে সেই মেয়েটি দরজার রাস্তায় দাঁড়িয়ে, নিজেকে আরো আকর্ষণীয় করতে ব্যস্ত। তাঁর হাতে ছিল হাড়ের সাদা একটা চিরুণি যা দিয়ে সে তাঁর ফর্সা হাত তুলে কালো চুলের মধ্যে দিয়ে চালিয়ে আঁচড়াচ্ছিল তাঁর ফর্সা কানের পাশ দিয়ে যার থেকে সোনার দুল ঝুলছিল। ভিড়ের মধ্যে থেকে এক মহিলা হঠাৎ বলে উঠল, “ওই লম্বা জোব্বা পুরুষদের মত……”। কিন্তু প্রতিটা পুরুষ নীরবে গোপন এক বিস্ময় নিয়ে মেয়েটার দিকে অপলক তাকিয়ে।

এবার ওই বয়স্কা মহিলা যিনি ভিড়ের একধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন সকলের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলেন মেয়েটিকে এবং আশ্চর্য হলেন। মেয়েটি আসলে তাঁর নাতির মেয়ে অর্থাৎ পুঁতি যে কিনা যথেষ্ট দুষ্ট আর তাঁর শহুরে বাবা মা তাকে নষ্ট করে দিয়েছে। কতবারই না তিনি বলেছেন ওনার ছেলেকে যেভাবে মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কোন ছেলে আর থাকবে না তাকে বিয়ে করার মতন আর ওনার করুনা হবে সেই ছেলেটির প্রতি যার ঘরণী হয়ে সে যাবে। কিন্তু এই প্রথম তিনি খেয়াল করলেন যে ওই সুন্দর মুখটা কিরকম নষ্টামি আর যৌনতায় আলোকিত। প্রাচীনার কুঁচকে যাওয়া গাল লাল হয়ে উঠল। তিনি ওই দরজার দিকে এগোতে লাগলেন, নুড়ি পাথরের ওপর তাঁর লাঠি ঠকঠক করতে করতে আর খেয়াল করলেন তাঁর পুঁতির দৃষ্টিটা ঠিক কোথায়। তাতে তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর সরাইখানার মালিকের ছেলের ওপর তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ। প্রথমে যুবকটি ঝগড়াই শুনছিল কিন্তু তারপর ভিড়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেই মেয়েটির দিকে তাকাতে শুরু করেছিল।

বৃদ্ধ মহিলাটি লাঠি উঁচিয়ে বললেন,

—– যাও, ঘরের ভেতরে যাও। নির্লজ্জ, বদমাইশ মেয়ে! বৃদ্ধার গলায় এমন রাগ আর দাপট ছিল যে মেয়েটা দরজার আড়ালে ছায়ায় মিলিয়ে গেল। কিন্তু তখনও তাঁর হাত দরজার ওপরের রাখা ছিল, ছোট, নমনীয়, ফর্সা একটা হাত, সোনার আংটি পরে, একদম কড়ে আঙ্গুলে। বৃদ্ধা সোজা গিয়ে লাঠি দিয়ে এক বাড়ি মারল সেই হাতে, তখন বাধ্য হল সরিয়ে নিয়ে।

—– এমন মেয়ে আমি আগে কখনও দেখিনি। বাগদত্তা হওয়া সত্ত্বেও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আর যে পুরুষ যাচ্ছে তাঁর দিকে তাকাচ্ছে। তা অবশ্য শুনতে পাচ্ছি আজকালকার মেয়েরা এমনই সব করছে, আরও যে কত কি হবে তা সত্যিই আমার জানা নেই। চীৎকার করে তিরস্কার করে বললেন সেই বৃদ্ধা।

ভিড়ের মধ্যে উত্তেজনাটা ধীরে ধীরে মরে গেল। লোকটার স্ত্রী অল্প হাসল, মনে একটু শান্তি পেল সে যে অন্যান্য মহিলারা মেয়েটির প্রতি বিরুপ ছিল, কিন্তু পুরুষের দল এবার এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘোরালো, ওপরে আকাশে অথবা মাঠে কিংবা রাস্তায় এক দলা থুতু ফেলল। একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল এবং ভিড়টা পাতলা হয়ে আসছিল, ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত—সব আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলেছে। কেবল সরাইখানার মালিকের ছেলেটা বিমুগ্ধ হয়ে তখনও দাঁড়িয়ে চেয়েছিল শূন্য দরজার দিকে।

শুধু সে নয় আরো একজন ওরকম বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল। তাঁর মুখাবয়ব এখন পিঙ্গলবর্ণ। মুখের রক্ত কে যেন শুষে নিয়েছে। নীচে ধুলোর দিকে এখন তাকিয়ে সে। এবার সে জানে।

কিন্তু বৃদ্ধার কাজ এখনও শেষ হয়নি। তিনি সব বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি ঘুরে তাকিয়ে লাঠি উঁচিয়ে লোকটার দিকে ইঙ্গিত করলেন।

—–লি, তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, তুমি একটা বোকা। যাও, মাঠে ফিরে যাও। কিন্তু তাঁর আগে তোমার কোমরবন্ধে যা টাকা আছে তা তোমার স্ত্রীকে দিয়ে যাও।

ধীরে লোকটা কোমরের বেল্ট হাতড়ে চারটে ছোট রুপোর কয়েন বের করল। সে তার মাথা ঘোরাল না কিন্তু হাত মেলে ধরল। তাঁর হাতে সে অনুভব করল তার স্ত্রীর আঙ্গুলের ডগা। সেখানে সে তার পয়সার সাথে সাথে তাঁর স্বপ্নকেও বিলিয়ে দিল।

তারপর ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে, চারিপাশের মানুষের দিকে তাকাল। স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল,

—— আমি জানি না কেন আমার স্ত্রী এই এত সব ঝগড়াঝাঁটি করল। যা ওর প্রয়োজন ছিল করার হচ্ছে পরিষ্কার করে বলা যে তাঁর টাকাপয়সার দরকার। যেমনটা সে বলেছে আমি যা রোজগার করি সব তো তাঁর হাতেই তুলে দিই।

লোকটা ঝুঁকে তার কাস্তেটা তুলে নিল যেটা সে মাটিতে ছুঁড়ে দিয়েছিল যখন তাকে এখানে ডাকা হয়েছিল। সেটা কাঁধে নিয়ে সে চলে গেল, একবারও পেছন ফিরে না তাকিয়ে, তাঁর নিজের জীবনে, নিজস্ব যাপনে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *