prabandho-meyeder-adhikar

মেয়েদের অধিকার বনাম রাষ্ট্র
অনিতা অগ্নিহোত্রী
 

এবার স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের দেশজোড়া উৎসবে দু’টি ঘটনার বাস্তব মনকে আচ্ছন্ন করে রাখল। মানবাধিকার কর্মী তিস্তা শেতলবাদের এই দিনটি কাটল কারাগারে। কবে তিনি জামিনে মুক্তি পাবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এহসান জাফরির হত্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত হয়তো প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু চিহ্নিত কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে জন অসন্তোষ জাগিয়ে রাখা এবং জনমানসে অসত্যের ছবি তৈরি করার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করার নির্দেশ ছিল কোর্টের রায়ে। এর অব্যবহিত পরেই রাজ্য প্রশাসন তিস্তা ও পূর্ব পুলিশ অফিসার শ্রীকুমার কে-কে গ্রেফতার করল। তৃতীয় ব্যক্তিও প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, তিনি জেলেই ছিলেন।

তিস্তা মানবাধিকার কর্মী। নারীও। তিনি দু’দশক ধরে জাকিয়া জাফরির পাশে থেকে বিভিন্ন আদালতে মামলাটি চালাতে ও কোর্টের নির্দেশ পেতে সাহায্য করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য, কেউ কেউ আঁচ চালু রাখতে সাহায্য করেছেন— দীর্ঘদিন ধরে বিচারের প্রত্যাশা নাকি, বিচারপতিদের মতে, কিপিং দ্য পট বয়েলিং— যে কোনও সংবেদনশীল মানুষ কে আহত করবে। আমরা কি জানি না কত দিন লাগে একটি বিচারধীন মামলার নিষ্পত্তি হতে? তা ত্বরাণ্বিত করার চেষ্টা কি অপরাধ? এই অধ্যবসায়ের পিছনে উদ্দেশ্য থাকলে বিচার ব্যবস্থা তার পরিণাম বুঝতে পারতেন না?

আরও বেদনাদায়ক ও ক্রোধ উদ্রেককারী বিষয় হল বিলকিস বানোর গণধর্ষণ ও তার সন্তানের হত্যাকারীদের মুক্তি।

দীর্ঘ লড়াই করেছেন বিলকিস বানো। এক দশকের বেশি সময় ধরে। গুজরাতের এক সাধারণ পশু ব্যবসায়ীর স্ত্রী। তাঁর উপর নির্মম গণধর্ষণের প্রতিটি অপরাধীকে শনাক্ত করে, নিজের কোলের শিশুর হত্যাকারীকে চিহ্নিত করে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে দরখাস্ত করে কেসের বিচার নিয়ে গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রে, গুজরাতের বাইরে। মহারাষ্ট্র হাইকোর্ট অপরাধীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব উপলক্ষে অপরাধীরা সবাই মুক্তি পেয়েছে। ১৪ বছর ন্যূনতম শাস্তির মেয়াদ তারা পূর্ণ করেছিল ঠিকই। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের পূর্ববর্তী নির্দেশ অনুযায়ী, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে যারা দোষী, তাদের সময়ের আগে মুক্ত করা যাবে না। স্বাধীনতা দিবসে তাদের মুক্তি দিয়ে এমন উল্লাসের রাজকীয় নাটক সংঘটিত করা কতদূর জরুরি ছিল? বিশেষ করে, বিলকিস ও তাঁর আইনজীবিরা কখনোই এদের ফাঁসি চায়নি। উৎসাহী রাজনৈতিক কর্মীরা ধর্ষক ও হত্যাকারীদের মুক্তির পর সংবর্ধনা জানিয়ে নারীর সমানাধিকার আন্দোলনকেই অপমানিত করেছেন।

রাষ্ট্র কি মেয়েদের কোনও সংকেত দিচ্ছে? নীচু হও, নত হও, আত্মসমর্পণ করো। না হলে অদৃষ্টে আছে কঠিনতম শাস্তি। নারী অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রের ভাবনা চিন্তা কোন পথে যায় তার আভাস কি এই দু’টি ঘটনা থেকে পাওয়া সম্ভব? আইন, সংবিধান ও সমস্ত ব্যবস্থা সমন্বিত রাষ্ট্র তার অন্তর্গত সরকারকে দিয়ে নীতি নিয়ম ঠিক করায়। সরকার চায়, জাতীয় আয়ের বিকাশ। কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি সংখ্যায় মেয়েরা এলে অর্থনীতি সুদৃঢ় হবে। কিন্তু মেয়েদের চলার পথে যে পদ্মের পাপড়ি নয়, পাথর ছড়ানো, তাও নিশ্চয়ই রাষ্ট্রর জানা। পশ্চিমবঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীর যোগদান সবচেয়ে কম। ২৬.৭ শতাংশ শহরে, ২১ শতাংশ গ্রামে। সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস-এর সমীক্ষায় পাওয়া গেছে— গত দু’ বছরে সারা পৃথিবীতে এবং ভারতেও নারীর যোগদান কমে গিয়েছে। বেকারত্ব আরও তীব্র হয়েছে। মেয়েরা ফিরে গিয়েছে ঘরে। ভারতীয় সমাজে পরিবারে উন্নতি হলে মেয়েদের পরিবারের ভিতরে ডেকে নেওয়ার পন্থা আছে। সম্পন্ন ঘরের মেয়েরা ভিতরে থাকবে, বাইরে কেন? ঘরের ভিতরে একটি গড়পড়তা মেয়ের জীবন কেমন? তা সে কর্মরতা হোক বা না হোক। গৃহশ্রমে মেয়েদের যোগদান চিরন্তন, কিন্তু তার যথার্থ মূল্যায়ন দূরে থাক, কোনও স্বীকৃতিও নেই। শ্রমজীবি পরিবারে তাঁত বা হস্তশিল্পের মতো কুটির শিল্পে বাড়ির মেয়েরা যে শ্রম দেন, তার হিসেব পণ্যের মূল্যের মধ্যে ধরা হয় না। তার উপর আছে গার্হস্থ্য হিংসা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসার নানা ঘটনা, যা ঘরে, ক্ষেতে, ইঁটভাটায়— যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে। তার বিরুদ্ধে থানায় নালিশ দর্জ করা একটি কঠিন ও জটিল পদক্ষেপ। কারণ, যে মেয়ে আক্রান্ত তাকেই সমঝোতা, সালিশি এসবের পরামর্শ, আয়োজন, ইত্যাদি আসতে পারে থানা, পঞ্চায়েত যে কোনও স্তর থেকে।

শহরে কাজের ক্ষেত্রে একজন শ্রমজীবি নারী সাধারণ সুযোগ সুবিধে, যা তাঁর অধিকারের মধ্যেই পড়ে, আশাই করতে পারেন না। পরিষ্কার শৌচাগার, স্নানের জায়গা, বিশ্রাম কক্ষ, শিশুর ক্রেশ, তাকে স্তন্যপান করানোর সুবিধে অনুপস্থিত অধিকাংশ ক্ষেত্রে। গণপরিবহন ব্যবস্থা অপ্রতুল। বাসে-মেট্রোয়-ট্রেনে বসার জায়গা খুঁজলে টিটকিরির মুখোমুখি হতে হয়। লেডিজ কম্পার্টমেন্ট তো একটি ঢিল মারার জায়গা। অত সুবিধে চাই তো কাজ করতে আসা কেন? গাড়ি না চড়ে যাঁরা গণপরিবহন ব্যবহার করেন, সেই মেয়েদের ভাগ্যে এই প্রশ্ন ললাট লিখনের মতো। অসংগঠিত ক্ষেত্রে মেয়েরা ন্যূনতম মজুরি পান না, পুরুষের চেয়ে তাঁর কম বেতন পান, কাজের আউটপুট কম এই অজুহাতে। মাতৃত্বের সবেতন ছুটির প্রশ্ন নেই। তার উপর কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বিষয়ক আইনের অনুপালন সরকারি বেসরকারি সব অফিসেই শ্লথ ও নারীর প্রতি সহমর্মিতাহীন। তবু মেয়েরা কাজ করেন। বৈষম্য, উপহাস সহ্য করে। বিশ্রাম, উপযুক্ত মজুরি, পুষ্টিকর খাবার কিছুই না পেয়ে। কেন যে তাঁরা এত কষ্ট করেন, রক্তের মধ্যে ক্লান্তি বহন করে, শিশুদের, সংসারের সদস্যদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য এবং তা সত্ত্বেও তাঁদের বিরুদ্ধে বৈষম্য দূর করার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা একটি কড়ে আঙুলও তোলে না।

অসংগঠিত ক্ষেত্রের কথা এই জন্য উল্লেখ করলাম, যে কাজের ৮০ শতাংশই এখন অসংগঠিত ক্ষেত্রে, এবং কর্মীদের ৮২ শতাংশ ১০ হাজার টাকা বা তার কম উপার্জন করেন। এ সব কাজের শর্ত ও নির্ভর করে মালিকের মর্জির উপর। এখন কার দামে ১০ হাজার টাকা মাসিক রোজগারে কি হয়? যদি কারওর প্রতিবন্ধী সন্তান থাকে বা শিশুর জন্য সেবিকার ব্যবস্থা করতে হয়? গ্রামাঞ্চলে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা জানেন, সন্তান প্রতিবন্ধী হলে তার যাবতীয় দায়িত্ব মায়ের উপর এসে পড়ে। অনেক সময়, বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটে যায়। এই প্রতিকূল অবস্থার রকমফের ঘটে শিক্ষিত, উপার্জনশীল মেয়েদের ক্ষেত্রেও। প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে মায়ের জন্য কোনও আলাদা পোস্টিং বা বদলি নীতি তৈরি হয় না।

দেশান্তরী শ্রমিকদের কী দুর্দশা হয়েছিল অতিমারী ও লকডাউনের কালে আমরা দেখেছি। হাঁটা পথে, ট্রেনের নীচে কাটা পড়ে, দীর্ঘ ট্রেনযাত্রায় অনেকে মারা যান। বাকিরা বহু কষ্টে ঘরে ফিরেছিলেন। গণ পরিবহণ ব্যবস্থার সুযোগ এঁরা পাননি। বহু রাজ্য মুখ ফিরিয়ে বসেছিল, রাজ্যের বাসিন্দা শ্রমিকদের ঘরে আনতে চায়নি। এদের মধ্যে বালিকা, নারী, গর্ভবতী মহিলা, প্রসূতি অনেকে ছিলেন। দেশান্তরী শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রীয় আইন আছে, আছে গোটা একটি কার্যালয়। কিন্তু কত শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, রাজ্য অনুসারে তাঁদের সংখ্যা কত, এ সব নিয়ে কোন তথ্য সংসদে ওঠানো প্রশ্নেও পাওয়া যায়নি। এমনকি জামলো মাকদমের মতো একটি বালিকা তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে কীভাবে পড়শি রাজ্যের লঙ্কা ক্ষেতে কাজ করতে চলে গেল, তার বাবা মা জানতে পারলেন, ক্লান্তিতে পথে পড়ে থাকা তার মৃত্যু সংবাদে জনসমক্ষে আসার পর, তার কোনও দায়িত্বই শ্রম আধিকারিকরা নিলেন না।

আইন থাক বা না থাক, এসব বিষয়ে মেয়েদের জন্য তাদের যে আলাদা করে কিছু করার আছে, তা রাষ্ট্র বা সরকার মনেই করে না। যেমন পুলিশ আধিকারিকরা মনে করেন না, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা নিয়ে কোনও আলাদা ব্যবস্থার প্রয়োজন। ক্রাউড কন্ট্রোল আর ভিআইপি ডিউটি যে দেশে পুলিশের কাজে অগ্রাধিকার পায়, সেখানে আর কী প্রত্যাশিত? সংবিধান যেখানে নারীর সমানাধিকারকে পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে এরকম বেশ কিছু বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ না নিলে অধিকারের সাম্য সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের দেশে সমাজ ও পরিবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যকে স্বাভাবিক মনে করে। ফলে রাষ্ট্রর চিন্তা ধারা ও সমাজের মনোভাব দিয়ে প্রভাবিত হতে থাকে। কিন্তু এই সাধারণ, প্রোৎসাহনহীন, এমনকি দ্রোহপূর্ণ পরিবেশে তিস্তা বা বিলকিস বানোর ঘটনার কি কোনও আলাদা তাৎপর্য আছে? অবশ্যই আছে। প্রশাসনের কাছে ব্যর্থ হয়ে যে দুই নারী (তিস্তা শেতলভাদের মাধ্যমে জাকিয়া জাফরি, বিলকিস বানো) আক্রমণের, হত্যার ও ভয়াবহ নির্মমতার প্রতিকার চাইতে গিয়েছিলেন বিচার ব্যবস্থার কাছে, তাদের খালি হাতে ফেরানো হয়েছে। ফিরিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ কোর্ট এবং নাগরিক বর্গের সংবেদনশীল অনুরোধে পুনর্বিচার করতে এখনও রাজি হয়নি।

এই খালি হাতে ফেরানোর বিরূপ পরিণাম হয়েছে। শাসক দলের রাজনীতি প্রভাবিত নাগরিক সমাজের এক অংশ উৎসব পালন করেছে, তাদের অধিকার হরণের। জাকিয়া আর বিলকিস দু’জনেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলা। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো নিজের ভাগ্যকে নত শিরে মেনে না নিয়ে তাঁরা যে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে গেছেন, রাষ্ট্রর পক্ষে তা সহজভাবে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার অর্থ, নারীর পাশে দাঁড়াবার সময় তার জাতি, ধর্ম, সামাজিক অবস্থা বিচার্য হতে পারে, যা তার মানবাধিকার উল্লঙ্ঘনের সমান।এই অবস্থায় একজন শ্রমজীবী সাধারণ মেয়ে কীসের ভরসায় কাজে যাবে, ঘরে থাকবে, জীবিকার জন্য লড়াই করবে? সংখ্যালঘু, দলিত, প্রতিবন্ধী মেয়েদের অধিকার রক্ষায় পাশে দাঁড়াবে কেবল নারী আন্দোলনের কর্মীরা। কারণ তাঁদের ভবিষ্যৎ সবচেয়ে অনিশ্চিত। রাষ্ট্র মুখ ফিরিয়ে থাকবে। সরকারের পালাবদলে মেয়েদের অধিকার আলোচনায় উঠে আসবে না।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “prabandho-meyeder-adhikar

  1. Harassment of women must be stopped at any cost whatsoever.Nationwide protest is indispensable for discrimination against males and females.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *