short-story-abichuari

অবিচুয়ারি
ওয়াসি আহমেদ

বছর তিরিশ-বত্রিশের গগন মারা যাওয়ার পর মৃত্যুটা যে অকালমৃত্যু এ নিয়ে চেনা-জানা মানুষের কথাবার্তায় মনোকষ্টের আভাস পাওয়া গেলেও গগনকে নিয়ে অন্য রকম কিছু ভাববার তেমন কেউ ছিল না। একজন ছাড়া। সাপ্তাহিক সত্যবার্তার সম্পাদক গাজী আশরাফ আলী যিনি বছর পাঁচেক ধরে গগনকে জানতেন, মৃত্যুর দিন দুই বাদে চমকে উঠে ভাবলেন গগনের ওপর একটা অবিচুয়ারি না ছাপলেই নয়। চার পৃষ্ঠার সত্যবার্তায় বেতনভোগী সাংবাদিক বলতে কেউ নেই। লেখাজোখা বা কাট-পেস্টের কাজ সম্পাদক আশরাফ আলী একাই করেন, অবশ্য কোম্পাজ ও মেকআপে সাহায্য করতে পরেশ সাহা নামে একজন পার্টটাইমার রয়েছেন। আর রয়েছেন কয়েকজন শখের সাংবাদিক যারা নিজেদের আগ্রহেই এলাকার নানা বিষয়আশয় নিয়ে রিপোর্ট লিখে জমা দেন। আশরাফ আলী কোনওটা ছাপেন, কোনওটা লেখকের উপস্থিতিতেই দলা পাকিয়ে ফেলে দেন। যেসব রিপোর্ট ছাপা হয়, সেসবে সাংবাদিকরূপী লেখকদের নাম থাকে। গগন ওরফে গগন হাজরা সত্যবার্তায় লিখত, তবে শখের সাংবাদিকরা যেখানে আজ রূপা আমনে মাজরা পোঁকা, কাল মাদারটেক হাই স্কুলে তরুণী বিএসসি বিএড শিক্ষিকার যোগদান, বা ঘনশ্যামপুরে অমুকের হরিয়ানা ছাগলের জোড়া মেষশাবক প্রসব, এ রকম বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক বিষয়ে রিপোর্ট করতেন, সেখানে গগনের লেখার বিষয় ছিল একটাই। পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতো বলেই যে অবিচুয়ারির কথা আশরাফ আলীর মাথায় এল তা মোটেও না।

গগনকে আশরাফ আলী শোকগাথার ইংরেজি অবিচুয়ারি শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘তোর যখন মরা মানুষ নিয়ে কারবার, ইংরেজিটা শিখে রাখ।’ শিখেওছিল, তবে উচ্চারণে গন্ডগোল করত, বলত অবিচারি। ধমক-টমকে কখনও ঠিকঠাক বললেও ভুলে যেতে সময় লাগত না।

ঘটনার শুরুটা বলতে গেলে মৃত গগনের পক্ষ থেকেই বলতে হবে, সে কীভাবে লেখালেখিতে, মানে সাংবাদিকতায় জড়াল। যদিও সে বেঁচে নেই, তার বৃত্তান্ত আশপাশের মানুষের জানা, আশরাফ আলীর বেশিই জানা।

গগন দুইবার এসএসসিতে বসে ইংরেজিতে ফেল মেরে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলে মনের দুঃখে প্রায়ই একটা কথা বলত, ‘ভাষার জইন্য রক্ত দিয়া যারা অমর হইছে তারা জানল না বাংলায় সত্তর পাইলেও কাম হয় না, ইংরেজিতে টাইনাটুইনা তেত্রিশ পাইলে কথা নাই।’

আশ্চর্য হলেও সত্যি, গগন বাংলায় একবার সত্তর, একবার ঊনসত্তর পেয়েছিল। সে কথা থাক। পাশের চিন্তা বাদ দিয়ে গগন এখানে ওখানে চাকরির জন্য ঘোরাফেরা করল বেশ কিছু দিন। খামোখা ঘোরাঘুরি, সে জানত চাকরি তাকে কে দেবে! তবে বাংলাটা মোটামুটি ভালো লিখতে পারে, বানান-টানান বড় একটা ভুল করে না, এ দিয়ে যদি কিছু হয় ভেবে সাপ্তাহিক সত্যবার্তায় ধর্ণা দিয়েও লাভ হয়নি। আশরাফ আলী এক কথায় বিদায় করে দিয়েছিলেন। একে ম্যাট্রিক ফেল, তার ওপর পত্রিকায় চাকরি! আর আসল কথা তিনি তো বেতন দেন এক পরেশ সাহাকে, তাও পার্টটাইমারের বেতন, শুক্রবারে পত্রিকা বেরোনোর আগে বুধ আর বিষ্যুদ দুই দিন কয়েক ঘণ্টার কাজ।

কাজ-কর্ম নেই, গগন এলাকার উঠতি মস্তানদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করল কিছু দিন। মদ-গাঁজার ঠেকেও তাকে দেখা গেল, তবে মস্তানি তার ধাতে ছিল না। দুপুরের দিকে প্রায়ই এক এনজিওর লাইব্রেরিতে বইপত্র নাড়াচাড়া করত, পছন্দের বই পেলে ঘাড় গুঁজে বসে পড়ত। এসএসসি-ফেল হলেও সে যে পড়ালেখার জগতের মানুষ এ নিয়ে তার অহংকারের কথা চেনাজানা সবাই জানত। আর তাই আড়ালে-আবডালে তো বটেই, সামনাসামনিও আন্ডারমেট্টিক মাস্টের বলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি কম হতো না। এদিকে বাড়িতে অভাব, বাবা কাজ করে এক চটকলে। বাবা-মা, সে আর ছোট দুই ভাইসহ খাওয়ার মুখ কম না। উপজেলার মতো জায়গায় রুজি-রোজগারের সুযোগ নেই বললেই চলে। অল্প-স্বল্প যা ছিল তাতে তার রুচিতে বাধত। একবার এক গরুর খামারি তার খামারের কাজে লেগে যেতে বলেছিল। বেতন ছাড়াও খাওয়া মিলবে ফাও। গগন রেগেমেগে বলেছিল রাখালি করতে তার জন্ম হয়নি; এতই খেপে গিয়েছিল, পারে তো এসএসসির মার্কশিট দেখিয়ে বলে, আছে কেউ ধারেকাছে বাংলায় সত্তর পাইছে! কাছের লোকজনকে দুঃখ করে বলত আশরাফ আলী জ্ঞানী মানুষ, কিন্তু তিনি তার মূল্য বুঝলেন না, কত ভুলভাল ছাপা হয় পত্রিকায়! একটা সুযোগ পেলে সে পত্রিকার চেহারা বদলে দিত।

আশরাফ আলীর কানে কিভাবে যেন কথাটা পৌঁছেছিল। মজা পেয়েই হয়তো তিনি তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। গগন অবশ্য খবর পেয়ে দৌড়ে যায়নি। একবার তো নিজে থেকেই গিয়েছিল, তিনি মাছি তাড়ানোর মতো বিদায় করেছিলেন। সে গিয়েছিল দিন তিনেক পরে। দেরি কেন করেছিল এ নিয়ে আশরাফ আলী কৈফিয়ৎ না চেয়ে অনেকটা যেন তার বাংলা জ্ঞানের বহর যাচাই করতে বলেছিলেন, ‘পারবি একটা মৃত্যুসংবাদ লেখতে?’ খুব নাকি বাংলার বড়াই তোর। মৃত্যুসংবাদ লেখার কথায় গগন ঘাবড়ে গিয়েছিল। আগের দিন একজন প্রাক্তন উপজেলা চেয়ারম্যান বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গিয়েছেন। খবরটা সে শুনেছিল, মুখে মুখে শোনা সেই খবরকে পত্রিকার সংবাদ বানানো। গগন অপেক্ষা করছিল তিনি আর কিছু বলেন কিনা, মৃত্যুসংবাদ কী করে লিখতে হয় তার জানা ছিল না। আশরাফ আলী আগের বারের মতো মাছি তাড়ালেন না বটে, তবে হাবভাবে বোঝালেন খামোখা বসে আছে কেন?

পরদিন ফুলস্কেপ কাগেজের মাথায় গোটা গোটা অক্ষরে ‘একজন জনহিতৈষীর প্রয়াণ’, নিচে ঝকঝকে হাতের লেখায় কাগজের এপিঠ ওপিঠ জুড়ে মৃত ব্যক্তির ওপর প্রশস্তির ফুলঝুরি নিয়ে গগন কাঁচুমাচু মুখে আশরাফ আলীর সামনে দাঁড়িয়েছিল। ভুরু কুঁচকে কাগজটা হাতে নিয়ে তিনি একবার গগনের মুখে, একবার ঠাসবুনোট অক্ষরের সারির দিকে তাকিয়ে কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কাগজটা ধরে দৃষ্টি ওপর-নিচ করে গোড়া থেকে পড়তে শুরু করেছিলেন। পড়ার ফাঁকে এক-আধবার চোখ তুলে গগনকেও দেখছিলেন। পড়া শেষ, কাগজটা পেপাওয়েট চাপা দিয়ে তিনি হো হো হেসে উঠেছিলেন। ভড়কে গিয়ে গগন দৌড়ে পালাবে কিনা ভাবছিল, কিন্তু তিনি তাকে অবাক করে বললেন, ‘হুম, বাংলা তোর ভালো, যা সাটিফিকেট দিয়া দিলাম। কিন্তু এইটা কী! বললাম মৃত্যুসংবাদ লেখতে, তুই লিখলি অবিচুয়ারি! আর এত মিছা কথাও লেখতে পারলি! উনি সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন মানলাম, মরা মানুষের গিবত করা ঠিক না, কিন্তু মহাপরোপকারি, দান-দক্ষিণায় জুড়ি মেলা ভার, এলাকার গরিব ছাত্রদের জন্য সাহায্যের হাত উপুড় করে রাখতেন–এইসব কই পাইলি! আর এই যে এলাকার মানুষের কল্যান চিন্তায় রাতে শান্তিতে ঘুমাইতে পারতেন না, তুই কি উনার খাটের ধারে পাহারায় থাকতি? লেখবি সাত-আট লাইন, মানুষটা কে, কিসে মরলেন, মৃত্যুর সময় বয়স কত হইছিল, স্ত্রী-সন্তান কয়জন থুয়ে গেলেন, গুণগ্রাহী থাকুক না থাকুক, আছে অনেক এ পর্যন্ত আপত্তি নাই। তোরে তো অবিচুয়ারি লেখতে বলি নাই!’

বাংলা ভালোর সার্টিফিকেট পেয়ে গগনের ভয় অনেকটা কেটে গিয়েছিল। সে সাহসভরে জানতে চেয়েছিল, ‘অবিচারি কী?’

‘আরে বাংলার জাহাজ, বিচার-টিচার না, অবিচুয়ারি, কেউ কয় অবিচুয়েরি। মানে শোকগাথা। মানে মরা মানুষের মরার খবরই শুধু না, সঙ্গে সংক্ষেপে জীবনী, আর ভালো কাম-কাজ যদি কিছু থাকে সেইসবও। তুই বানাইয়া বানাইয়া এত কথা লেখলি কেন?’

কিছুক্ষণ পরে কী ভেবে আশরাফ আলী বলেছিলেন, ‘আচ্ছা যা।’

গগন ফেরার পথে ভাবছিল মরা লোকটার খোঁজ-খবর নিয়ে রাত জেগে এত কিছু লিখে কী লাভ হলো! আশরাফ আলী ওটা ফেলে দেবেন। কপাল ভালো, তার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারেননি। পরদিন অবাক কাণ্ড! লেখাটা ছাপা হয়েছিল। কিছু কাটছাট করেছিলেন, তবে শিরোনামটা সে যা দিয়েছিল হুবহু তাই রেখেছিলেন, সঙ্গে তার নামও। আসল কথা, মৃত্যুসংবাদ না, তিনি শোকগাথা, তার ভাষায় অবিচুয়ারিই ছেপেছিলেন। হঠাৎ তার মতিগতির পরিবর্তনে গগন খুব অবাক হলেও এর ওর মুখে শুনেছিল এতে নাকি তার লাভ হবে বলেই তিনি কাজটা করেছিলেন।

আবার ডাক পেয়েছিল গগন। আশরাফ আলী মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন, ‘লেখক বানায়া দিলাম তোরে। এই নে’, বলে পকেট থেকে দশ টাকার দুটো ময়লা নোট বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘লেখার জন্য কাউরে টাকা দেই না, তোরে দিলাম। লেখার টাকা, সোজা কথা না। এর নাম সম্মানি বুঝলি। আসিস মাঝে মাঝে, বানান-টানান দেখে দিবি, আমার তো আজকাল সব বানানেই খটকা লাগে। সারা জীবন মূর্ধন্য-ণ দিয়া ঠাণ্ডা লেখলাম, এখন নাকি দন্ত্য-ন।’

সম্মানির টানে না হলেও গগনের বাংলাজ্ঞানকে এলাকার অন্তত একজন মূল্যায়ন করেছেন এ প্রেরণা যে তাকে সত্যবার্তায় আরো শোকসংবাদ ওরফে অবিচুয়ারি লিখতে উৎসাহ জোগাবে কে জানত! আশরাফ আলীও কি জানতেন?

হয়েছিল তাই। গগন মাসে কম করে হলেও দুটো মৃত্যু, খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে, কভার করত। বড় উপজেলা, কয়েক লাখ মানুষের বাস, প্রতি সপ্তায় কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। গরিব, অবস্থাপন্ন, শিক্ষিত, অশিক্ষিত। তবে সবার সংবাদ পত্রিকায় ছাপানোর উপায় নাই, গগনকে তাই তক্কেতক্কে থাকতে হতো। হেল্থ কমপ্লেক্সে কঠিন অসুখ বা অ্যক্সিডেন্টে গুরুতর অবস্থায় কারা ভর্তি হচ্ছে সেসব খবর যেমন সে নিজে নিয়মিত রাখত, তেমনি মৃত্যুসংবাদ লিখে এলাকায় পরিচিতির সুবাদে অনেকে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর খবর তাকে জানাত। গগন খোঁজ-খবর নিত, মৃত ব্যক্তি তার লেখার বিষয় হওয়ার যোগ্যতা রাখে কিনা। সে যেহেতু কেবল মৃত্যুসংবাদই দিত না, তার লেখার ধরনে সংবাদটা সংবাদের অতিরিক্ত শোকগাথা অর্থাৎ অবিচুয়ারি হয়ে যেত, তাকে সাবধান হতে হতো। এর পেছনে অবশ্য আশরাফ আলীর হুঁশিয়ারিই বড় কারণ। মৃত ব্যক্তির পরিচয়ে একটা বড় বিষয় ছিল কোন পার্টির সমর্থক, গত ইউপি নির্বাচনে কার হয়ে কাজ করেছে, আদৌ করেছে কিনা। মহিলা হলে, বাবা, স্বামী বা সন্তানের রাজনৈতিক পরিচিতির খোঁজ করতে হতো। গগনের এতে কিছু যেত আসত না। সে লিখছে, লেখা ছাপা হচ্ছে এটাই বড় কথা।

গত বছর পাঁচেকে অন্তত একশ জন মৃত মানুষকে নিয়ে লিখেছে সে। তবে প্রথমবার যেমন ভারী শিরোনাম দিয়ে বড় লেখা লিখেছিল, তার বদলে আশরাফ আলীর ধমক-ধামকে ছোট করে পৃষ্ঠাখানেক লিখত, তারপরও গুণগান কিছু বেশিই তার লেখায় চলে আসত। চলে আসত বলা ঠিক না, অনেকটা যেন ভর করত। মৃত্যু ব্যাপারটা ছিল তার কাছে রহস্যময়। মৃত্যু কথাটাও তার কলমে পারতপক্ষে আসতে চাইত না, লিখত ইহধাম ত্যাগ বা না-ফেরার দেশ। এ নিয়ে আশরাফ আলী হাসাহাসি কম করতেন না। ‘ইহধাম কি রে গাধা? মরা মানুষের আবার ত্যাগ-ফ্যাগ কী! না ফেরার দেশ কথাটা আজকাল বেশ চালু হইছে, ফালতু কথা, মরেই গেছে, ফিরবে কী করতে! তোরে কোন্ ভূতে পায়, এই সব গাঁজাখুরি জিনিস লেখোস! আর যুদি ইহধাম-ফিহদাম দেখি…’

কী করা! গগন বাধ্য হয়ে মৃত্যুকে মৃত্যুই লিখত।

কিন্তু মৃত মানুষকে নিয়ে গুণগান থামাতে তার কলম সহজে রাজি হয়নি। যেমন তার স্কুলের হেডস্যার আলতাফ হোসেনকে নিয়ে লিখেছিল, বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও বাংলাটা তিনি এত ভালো জানতেন, একবার এক মন্ত্রীর মানপত্র লিখে গুণীজনের অকুন্ঠ প্রশংসাই অর্জন করেননি, খোদ মন্ত্রী মহোদয় তাঁর পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন তাঁর মতো বিদ্যানুরাগী শিক্ষক রয়েছেন বলেই দেশে শিক্ষার মান আজ এত উন্নত। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি তাঁর কথা বলবেন।

গগনের লেখার এ কথাগুলো লাল কালিতে গোল্লা পাকিয়ে আশরাফ আলী বলেছিলেন, ‘ফাইজলামি? বাংলা ভালো জানতেন কই, আমি তো জানতাম না, এলাকার অন্য কাউর মুখেও তো শুনলাম না। আর মন্ত্রী যে উনার পিঠ… থাউক তোরে এইসব বলে লাভ নাই। মানুষ মরার পরে তোর কী মনে অয় ফিরেস্তা অইয়া যায়, না দেপতা?’

হেডস্যার আলতাফ হোসেন না হয় তার নিজেরও শিক্ষক ছিলেন, তাই কিছু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল। কিন্তু গিরিন সুতারের মা সতুবুড়িকে নিয়ে সে রীতিমতো কিস্সা ফেঁদেছিল। হাঁপানির রোগী সতুবুড়ির বয়স আশি না একশ কে বলবে, গগন ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখে আসছে লাঠিতে কুঁজো পিঠ সামলে বাড়ির উঠানে হাঁটাহাঁটি করতে। মরার বয়স অনেক আগেই হয়েছিল, তবে শেষমেশ যখন তাকে খালপাড়ের শ্বশানে পুড়িয়ে গিরিন মাগো ওমা বলে ঘরে ফিরে কতক্ষণ চিল্লাচিল্লি করল, পাড়া-পড়শিরা সান্ত্বনা দেবে কী, মনে মনে হয়তো বলেছে হারামজাদার ঢং দেখো, বুড়ি মরার আগে দিনে চৌদ্দবার মরে না ক্যান, মরে না ক্যান জপ করত। সেই সতুবুড়িকে নিয়ে গগন শোকগাথা লিখবে আশরাফ আলী ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি, আর লিখল যখন, দেখা গেল গাঁজায় দম দিয়ে গপ্পো ফেঁদেছে। সতুবুড়ির নাম যে সত্যবতী, মহাভারতের পঞ্চ পান্ডবের মায়ের নামে নাম এ তথ্য থেকে শুরু করে সে বুড়িকে নিয়ে এমন সব খবর দিয়েছে যাকে মিথ্যা বললে কম বলা হয়। সতুবুড়ি ওরফে সত্যবতীর নাকি জীবজন্তুর প্রতি বেজায় ভালোবাসা ছিল, নিজের খাবার-দাবার অল্প-স্বল্প যা জুটত তার প্রায় সবটাই কুকুর, বেড়াল, শালিক, চড়ুই, এমনকি কাককেও খাওয়াত। এঁটোকাটা বেড়াল-কুকুরকে দেবে, বা খুদকুড়ো কখনো-সখনো পাখিদের, এ না হয় মানা গেল, তাই বলে এলাকায় জীব-জন্তুদের সেই ছিল একমাত্র সহায়, তাদের কথা পর্যন্ত বুঝতে পারত, এমন গুলগল্প কাঁহাতক সহ্য করা যায়! সতুবুড়ি নাকি একবার মরো মরো একটা কাককে সেবা-শুশ্রূষায় সুস্থ করার পর কাকটা তার আশেপাশে সারাক্ষণ ঘোরাঘুরি করত, আর পরিষ্কার গলায় মা ডাকত। আশরাফ আলী গগনের কাণ্ড দেখে মুখে প্রথমে কিছু বলেননি, পরে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোর সমুস্যাটা কি ক তো!’

গগন জবাব না দিয়ে চুপ করেছিল। এক সময় নিচু গলায় বলেছিল, ‘সতুবুড়ি জীবনে সুখ পায় নাই, একে হাঁপানির কষ্ট, তার বাদে গিরিন আর গিরিনের বউয়ের জ্বালাতন।’

আশরাফ আলী খেপে উঠে বলেছিলেন, ‘যার জ্বালা তার, তুই কে যে তারে নিয়া ফালতু কিস্সা বানাবি! আমি কাগজে সত্য কথা ছাপি, নামটাও সেই জন্য সত্যবার্তা। তুই তো আস্ত মিথ্যুক। এই নে তোর সত্যবতীর কাহিনি’, বলে দলামোচা করে লেখাটা ছুঁড়ে ফেলেছিলেন।

বকাঝকা খেয়ে মন খারপ হলেও গগন সত্যবার্তায় যাওয়া ছাড়েনি। পয়সাকড়ি নাই, তরপরও কাজটা তার জন্য মানানসই। দিনের বেশ খানিকটা সময় সে সত্যবার্তায় কাটাত, আর আশরাফ আলী যদি কিছু করতে বলতেন, বানান দেখে দেওয়া বা হেডিং জুতমতো হয়েছে কিনা সে মাথা ঝুঁকিয়ে এমনভাবে লেগে পড়ত, আশরাফ আলী মনে মনে হাসতেন। মাঝে মাঝে তাকে অল্প-স্বল্প কিছু দিতেন, দুপুরে কোনও দিন খাওয়াতেনও। কয়েকদিন ডায়রিয়ায় ভুগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরপরই গগন মরে যাবে কে ভাবতে পেরেছিল!

কম করে হলেও যদি একশ জনের অবিচুয়ারি গগন লিখে গিয়ে থাকে, তাহলে তার মৃত্যুর দুই দিন পরে আশরাফ আলীর মাথায় যে চিন্তাটা বেদম ঘোরপাক খেতে লাগল তা গগনের অবিচুয়ারি কে লিখবে? অনেক ভাবনা-চিন্তা করে তার মনে হলো উপজেলার একমাত্র সাপ্তাহিকের সম্পাদক হিসাবে কাজটা তারই করা উচিত।

কী লিখবেন ভাবতে গিয়ে গগন সম্বন্ধে প্রথমেই যে কথাটা মাথায় এল তা মৃত মানুষের গুণকীর্তণে তার অদম্য আগ্রহ। অদম্য ছাড়া কী! সে নিশ্চয় মৃত মানুষদের কথা ভেবে তাদেরকে জাগতিক ভালো-মন্দের উর্দ্ধে স্থান দিত, যে-কারণে কণামাত্র গুণের হদিস পেলে সে নিজেকে সামলাতে পারত না। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অবান্তর, এমনকি মিথ্যা কথাও লিখত। আশরাফ আলী অবশ্য সেসব যতটা সম্ভব ফেলে দিতেন, তারপরও তিনি খেয়াল করেছেন গগনের লেখার ধরনের কারণে মৃত্যুসংবাদগুলো শোকগাথায়, অবিচুয়ারিতে রূপ নিত। তিনি মেনে নিয়েছিলেন। গোড়াতে আপত্তি করলেও পরে তিনি অবিচুয়ারিই ছাপতেন। গগনের অবিচুয়ারি লিখতে গেলে সে যে মানুষের গুণের তারিফ করত, সে বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যের গুণপণায় মুগ্ধ হওয়া সাধারণ মানুষের কাজ না। সেই সঙ্গে এও ঠিক, তিনি, আশরাফ আলী যে গগনের গুণপণাকে প্রশংসা করে লিখবেন তাতে তিনিও সাধারণের পর্যায়ে পড়েন না তা যারা বোঝার বুঝবে।

আশরাফ আলী মোটামুটি তার চিন্তাকে গুছিয়ে এনেছেন, আগে হাতে লিখে পরে কম্পোজ করে মেকআপ সেরে ফেলবেন। একটা ছবি যে লাগবে, আছে কি ঘরে ওর কোনও ছবি? এ কথা যখন ভাবছেন তখন গগনের ছোট ভাইকে আসতে দেখে ভাবলেন ছবির কথাটা ওকে বলবেন। কিন্তু বছর দশেকের ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে একটা মলিন কাগজ বাড়িয়ে ধরে জানাল গগনের তোষকের নিচে তার মা কাগজটা পেয়েছেন, পত্রিকার দরকারি কাগজ ভেবে তাকে দিয়ে পাঠিয়েছেন।

পত্রিকার কাগজ গগনের কাছে যাবে কী করে! কাগজটা হাতে নিয়ে এক নজর তাকিয়ে আশরাফ আলী দেখলেন গগনের হাতের লেখা। তোষকের চাপ খেয়ে কাগজটার গায়ে বাঁকাচোরা প্রচুর ভাজ, আর কালির কলমে লেখার কারণেই সম্ভবত অক্ষরগুলো ছেতরে গেছে। হাতের ঘষায় ভাজ ভেঙে কাগজটা মেলে ধরতে ছেতরানো অক্ষরগুলো চোখ খুলে গুটিগুটি ফুটে উঠতে আশরাফ আলী চমকালেন। এ যে ওর নিজের মৃত্যুসংবাদ। অবিচুয়ারি না, মৃত্যুসংবাদ। কবে লিখেছে, কাগজের যে চেহারা, নিশ্চয় অনেক দিন আগে। গত পাঁচ বছর হাজার চেষ্টা করেও তাকে দিয়ে সোজাসাপটা মৃত্যুসংবাদ লেখাতে পারেননি, সে লিখেছে শোকগাথা অবিচুয়ারি; আর এখন তার নিজের সম্বন্ধে যা পাওয়া গেল তা নিখুঁত মৃত্যুসংবাদ।


মৃত্যুসংবাদ

অত্র উপজেলার মধ্যগ্রাম নিবাসী চটকল শ্রমিক নিবারণ হাজরার বড় ছেলে গগন হাজরা গত … তারিখ, রোজ … বার, সকাল/দুপুর/রাত … টায় মৃত্যুবরণ করেছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল … বছর। সে সাপ্তাহিক সত্যবার্তায় বিশিষ্ট মানুষজনের মৃত্যুতে শোকগাথা লিখত। দুই-দুইবার এসএসসি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হওয়ায় এলাকায় আন্ডারমেট্রিক সাংবাদিক হিসাবে সে পরিচিত ছিল।


পাদটিকা: (ছাপার জন্য নয়)
আমার মৃত্যুর পর মৃত্যুসংবাদ লেখার কেউ থাকবে না চিন্তা করে আগেভাগেই লিখে গেলাম। কবে মরি ঠিক নাই, সে জন্য দিন-তারিখ, বয়সের জায়গা ফাঁকা রাখলাম। মরা মানুষের গিবত করা ঠিক না, তবে আমি নিজে যেহেতু নিজেরটা লিখলাম, একটা সত্য কথা বলা দরকার– সেটা গিবত হলেও কিছু যায় আসে না। শোকগাথা লেখার সময় আমি অনেক বাড়তি, এমনকি বানোয়াট কথাও লিখতাম। এ জন্য অনেকে আমাকে গুলবাজ বলত। আশরাফ আলী কাকা তো বলতেনই। আমি ভাবতাম শোকগাথাই একজন মানুষের জীবনের শেষ প্রাপ্তি– মরার পরে খালি হাতে বিদায় কেমন লাগে!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *