short-story-an-evening-in-paris

অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়


‘অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্য মার্জনা করবেন।’

ভিতরের ঘর থেকে বসবার ছোট ঘরটিতে এসে বলে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ।

গ্রীকবংশোদ্ভবা কোঁমতেস দ্য নোয়াই সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর খোলা চুলে ঢেউ উঠল। তাঁর কালো আয়ত চোখে খেলে গেল সাতরঙা রামধনুর ঝলক। খানিকটা বোঝা গেল কেন তিনি ফ্রান্সের বৌদ্ধিক সমাজের মনোহারিণী। কেন কবিতার পাশাপাশি তাঁর উপস্থিতির কারণেও আলো জ্বলে ওঠে, যেখানে তিনি যান, সেখানেই। তাঁর যে কটাক্ষে অসংখ্য বীরপুরুষ পরাভূত সেই কটাক্ষই কি হানলেন তিনি, বিশ্বকবির দিকে?

রবীন্দ্রনাথ কোঁমতেস দ্য নোয়াইকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। জানলার দিকে চোখ চলে গেল তাঁর এই সময়; প্যারিসের সন্ধ্যা বড় মোহময়, রং আর রোশনাইয়ের মেলবন্ধন তো কত জায়গাতেই দেখা যায় কিন্তু উজ্জ্বলতা আর উদাসীনতার এই যুগলবন্দি কি প্যারিস ছাড়া অন্য কোথাও আছে?

সুসান কারপ্লেস নামে এক যুবতী তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারির কাজ করছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একটু কফির ব্যবস্থা করতে বললেন অভ্যাগতদের জন্য। তারপর পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন কোঁমতেস এবং তাঁর সঙ্গে আসা ভদ্রলোকটির দিকে।

কোঁমতেস’এর সঙ্গে আসা লোকটির বয়স বত্রিশ থেকে বিয়াল্লিশ যা খুশি হতে পারে। একরকম পাকানো চেহারা আছে, বয়স যাতে ধরা পড়ে না, এই লোকটি খানিকটা সেই আকৃতির। মুখটা একটু সরু হওয়ায় বয়স খানিকটা কম লাগে আবার গালের হনু কিছুটা উঁচু বলে বেশিও লাগে একেকসময়।

‘আমি, অঁরি প্রেভর, ফরাসি ভাষায় সাংবাদিকতা করি। কোঁমতেস’এর সঙ্গী বিনীতভাবে উচ্চারণ করলেন।’

‘আপনার কাছে আসছি শুনে অঁরি কিছুতেই পিছু ছাড়ল না। ও আসলে আপনার কবিতার বিরাট ভক্ত।’ কোঁমতেস বললেন।

‘ভক্তি ঈশ্বরের জন্যই রাখা থাকলে ভাল। কবিতার পাঠক হলেই যথেষ্ট।’

রবীন্দ্রনাথের উত্তর শুনে, হেসে উঠলেন, কোঁমতেস। সেই হাসি দু-এক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা শারীরিক চেহারা নিয়ে নিল। যেন কোনও ঝর্না নামছে, তার বিচ্ছুরণ এমনই প্রবল যে ফেনা গায়ে এসে লাগার পরেও বেশ কিছুক্ষণ প্রতীতি হচ্ছে না যে ওটা আসলে জল।

‘এই হোটেলে বোধহয় আপনার অসুবিধে হচ্ছে? আরও খানিকটা খোলামেলা, বিস্তৃত থাকার ঘর হলে…’

রবীন্দ্রনাথ কোঁমতেসকে থামিয়ে দিলেন, ‘আমি যে দেশ থেকে আসছি সেখানে হাজারো লোক মাথার তলায় একটি হাত দিয়ে গাছতলায় শুয়ে থাকে। অতএব, থাকার জায়গা পেলেই অনেক পাওয়া হয়েছে মনে হয়। সেই জায়গা কেমন, সে বিচারে নাই বা গেলাম।’

কোঁমতেস আবারও হেসে উঠলেন, খানিকটা যেন অকারণেই। সেই হাসির দোলায় বসার সোফা কেঁপে উঠল সামান্য, জানলার পর্দার গায়ে লাগল অন্তর্গত এক পূর্ণিমার আঁচ যা অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে বাইরের চন্দ্রালোকের সঙ্গে।

ওই ঘরেই উপস্থিত সুসান’এর মনে হচ্ছিল ফরাসী সংস্কৃতি জগতের মায়াহরিণী একটি মুগ্ধতার জাল রচনা করতে চাইছেন, বিশ্বের দরবারে ভারতের সবচেয়ে পরিচিত প্রতিনিধির সঙ্গে। তাঁর মাথার স্বর্ণালী শিরাবরণটি মেঘবরণ চুলের উচ্ছ্বাসে সরে সরে যাচ্ছে সামান্য, তাঁর গাঢ় ভেলভেটের ঢিলে পরিচ্ছদের ভিতর থেকে স্বর্ণাভ ত্বক ঝলমল করে উঠছে আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোঁমতেস আরও লাস্যময়ীর রূপ ধারণ করছেন। কিন্তু ওই শিখরদশনা চঞ্চলার সামনে ক্রমেই আরও অচঞ্চল হয়ে প্রতিভাত হচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

‘আপনার একটি ছোট সাক্ষাৎকার পেলে আমার পত্রিকার ভীষণ লাভ হত।’ কোঁমতেস’এর সঙ্গী সাংবাদিক বলে উঠলেন।

‘কাব্যরচনা ব্যাপারটাই এমন যে অনেক লোকসান না হলে কেউ এই পথে বিশেষ অগ্রসর হয় না। এ বার এই লোকসানের কারবারিকে দিয়ে আপনার কতখানি লাভ হবে তা এক গভীর সংশয়ের ব্যাপার। তবে আপনি, ইংরেজি, ‘লাভ’এর কথা বলে থাকলে স্বতন্ত্র।’ রবীন্দ্রনাথ একটু থেমে থেমে বললেন।

‘আমি খামোখা ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করতে যাব কেন?’ অঁরির গলায় কেমন একটা আক্রোশ।

‘অঁরির ভীষণ রাগ ইংরেজি ভাষার উপর। ওর ধারণা ফরাসির তুলনায় ইংরেজি খুবই নিম্নমানের একটি ভাষা, তেমন কোনও উঁচুদরের সাহিত্যও রচিত হয়নি ওতে…’

কোঁমতেস মাঝপথে থেমে যেতেই রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কিন্তু ওই ইংরেজিই যে এখন দুনিয়ার প্রায় অর্ধেক লোকের কাজের ভাষা। আর তাছাড়া উনি নিজেও তো দেখছি, ইংরেজিতে সাবলীল।’

‘সে আপনারা ফরাসি শিখবেন না তো আমরা কী করব?’ অঁরি ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল।

রবীন্দ্রনাথ মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে বললেন, ‘আপনি বুঝি বাংলা শিখেছেন?’

কোঁমতেস কথাটা শুনেই আবারও প্রগলভা হয়ে উঠলেন। কখনও হাসিতে নুইয়ে পড়ে, কখনও হাওয়ায় তর্জনী চালিয়ে নিজের ভাবনাকে শব্দ যোগাতে থাকলেন।

সুসানের ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি খেলে গেল কারণ গ্রীস দেশের কন্যা, বিবাহসূত্রে ফরাসি এই সুন্দরী যত লাবণ্যমুখরা হয়ে মোহমায়ার কুয়াশা রচনা করতে চাইছে, রবীন্দ্রনাথ ততই সুদূর, অনালভ্য হয়ে উঠছেন, তাঁকে দেখে কীরকম দেবতার মতো দুর্জ্ঞেয় বোধ হচ্ছে।

পরিস্থিতি জটিল হয়ে গেছে আন্দাজ করেই হয়তো অঁরি দ্রুত সামাল দেবার চেষ্টা করলেন, ‘আমার কথায় আপনি কোনওভাবে আঘাত পেয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম যে একটি ভাষা গৌরবের আসনে বসতে পারে তার গুণাবলীর কারণে। কেবলমাত্র সাম্রাজ্য বিস্তারের দৌলতে যে ভাষার প্রচার এবং প্রসার তাকে কখনওই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেওয়া যায় না।’

রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে বললেন, ‘সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রাণান্তকর চেষ্টা পশ্চিম ইওরোপের কোন দেশ করেনি? ক্লাইভের সঙ্গে যুদ্ধে ডুপ্লে জিতে গেলে, আমি হয়তো ফরাসি ভাষাতেই আমার কবিতাগুলি অনুবাদের চেষ্টা করতাম।’

‘সে এক দুর্দান্ত ব্যাপার হত। অবশ্য আপনার লেখালিখি ফরাসি ভাষাতেও অনুদিত হচ্ছে এবং হবে তবু…’

কোঁমতেস’এর কথার শেষদিকে রবীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন, ‘জন্মসূত্রে আপনিও তো ফরাসি নন।’

‘আমরা মনে করি, পৃথিবীর সব ইন্টেলেকচুয়ালই অন্তরের অন্তরে ফ্রেঞ্চ। রুশো কিংবা ভলতেয়্যর না থাকলে আজকের আধুনিকতার জন্মই হত না। অঁরির গলায় গর্বের রেশ টের পাওয়া গেল।

‘একইসঙ্গে তোমায় স্বীকার করতে হবে যে সক্রেটিস কিংবা প্লেটো না থাকলে জগতে দর্শনশাস্ত্র বলে কিছুর অস্তিত্বই হয়তো থাকত না। ফরাসি সংস্কৃতিকে আত্মায় গ্রহণ করলেও আমি তো গ্রীসের কন্যা। আমি কী করে ভুলব যে সক্রেটিস সবার আগে নিজেকে জানতে বলেছিলেন? আমি তাই সর্বদা যুক্তিতে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করি, সমস্ত ছায়ামূর্তি দূর করে দিয়ে। কিন্তু এও আমি বুঝতে পারি যে আত্মার নির্দেশ কেবলমাত্র এটুকুই নয়। তাই সেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার মুগ্ধতা যিনি তাঁর কলমে সকল নিয়ম অগ্রাহ্য করেছেন, নিজেই নিজের নিয়ম হয়ে উঠেছেন। যা তাঁর স্বপ্ন দিয়ে গড়া তাঁকেই শিল্পরূপ দিয়েছেন বলে ওঁর বিপুল সৃষ্টি বিচিত্ররূপে আমাদের সামনে এসেছে, প্রকাশ পেয়েছে কবির অন্তরচারী গোপন দৃশ্যমূর্তি – অসংখ্য, অগণ্য, অত্যাশ্চর্য।’

সুসান খেয়াল করলেন, কথাগুলো বলতে বলতে কোঁমতেস দ্য নোয়াই’এর রূপান্তর ঘটল যেন বা। মোহময়ী সাজার সুখের খেলা পরিত্যাগ করে তিনি যেন এক আনন্দরাজ্যে প্রবেশ করলেন। দেহবদ্ধ প্রেমের কামনা যেমন পাত্রে রাখা ধূপের মতো জ্বলতে জ্বলতে সহসা ঊর্দ্ধগতি প্রেমের শিখায় বদলে যায়, কোঁমতেস অনেকটা সেভাবেই বদলে গেলেন সুন্দরী থেকে স্রষ্টায়।

ঘর নীরব রইল কিছুক্ষণ। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সেই নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, ‘লেখার মুহূর্তে কবি বোধহয় তারার ভাষার অর্থ জেনে যান, তরুর নীরবতার বাণী উপলব্ধি করতে পারেন। আমারও তাই মনে হয় যে একদিন আমি আমার দেহের বাইরে আলোর যবনিকার ওপারে যে পরমানন্দ আছে তার সন্ধান পাব।’

‘আসলে চতুর্দিকে সবাই যখন ‘রিসার্চ’ নিয়ে ব্যস্ত আপনি তখন, ‘সার্চ’এর প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। আপনার সৃষ্টির সামান্যই আত্মস্থ করতে পেরেছি তবুও বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, আপনার কল্পনাও বুদ্ধিপ্রাণিত, নইলে তা মনকে কীভাবে নিয়ে যায় সেই রাজ্যে যেখানে কাল্পনিক বস্তু বাস্তবের চেয়ে বেশি সত্য?’

‘আমার মনে হয় যে ভারতবর্ষের বাস্তব এত ভয়াবহ যে কবি বাধ্য হন সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে কল্পনার আশ্রয় নিতে। এই ক’দিন আগেই যে জালিওয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ড ঘটে গেল সভ্য পৃথিবীর ইতিহাসে তার কি কোনও জুড়ি আছে? একটা ঘেরা জায়গার ভিতরে সমবেত মানুষের উপর প্রায় পনেরো মিনিট ধরে টানা গুলি চালিয়ে…’

‘সেই নারকীয় ঘটনা এক হাজারের বেশি মানুষের খুনের কারণ হয়েছে, যদিও ব্রিটিশ প্রেস এবং পার্লামেন্ট সংখ্যাটাকে অনেক কমিয়ে দেখাতে চাইছে।’ অঁরির কথার ভিতরেই উত্তেজিত গলায় বলে উঠলেন কোঁমতেস।

‘আমি সেটাই বলতে চাইছি।’ অঁরি একটা বাঁকা হাসি হাসলেন।

‘কিন্তু আমি বলতে চাইছি, সম্পূর্ণ অন্য কথা। রবীন্দ্রনাথ কি ওই হত্যাকাণ্ডের পর চুপ করে বসেছিলেন? তিনি কি ইংরেজের দেওয়া ‘নাইটহুড’ খেতাব ত্যাগ করেননি?’

‘সে তো করেইছিলেন। লর্ড চেমসফোর্ডকে লেখা তাঁর চিঠি নিয়ে আজও আলোচনা হয়। আর সেখানেই শেষ নয়, গত বছর জুলাই মাসে বৃটিশ পার্লামেন্টে জালিওয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ড নিয়ে প্রভূত তর্ক-বিতর্ক হবার পরও শেষমেশ যখন জেনারেল ডায়ার’এর বিরুদ্ধে আনা নিন্দাপ্রস্তাবটি পাশ হয় না তখনও লন্ডনে উপস্থিত রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন।’

‘ব্বাবা! আপনি দেখছি ব্রিটিশ সরকার এবং রবীন্দ্রনাথের অনেক খবর রাখেন।’ সুসান একটা অকৃত্রিম বিস্ময়ের গলায় বলে উঠলেন।

‘আমার পেশা সাংবাদিকতা, খবর আমাকে রাখতেই হয় ম্যাডাম।’ অঁরি একটি বিড়ম্বিত হাসি হাসলেন।

‘খবর তুমি অনেক কিছুরই রাখো না। এই যেমন তোমার জানা নেই যে রবীন্দ্রনাথ আগামী সপ্তাহেই প্যারিসে দু’জায়গায় বক্তৃতা দেবেন এবং নিজের রচনা পাঠ করবেন। সেই দু’টি অনুষ্ঠান থেকে সংগৃহীত অর্থ জালিওয়ানওয়ালাবাগের নিহত মানুষগুলোর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ কোঁমতেস’এর গলায় খুশি ধরা পড়ল।

‘চমৎকার উদ্যোগ। যদিও ওই হত্যাকাণ্ডে নিহতর সংখ্যা অগণিত তবু তাঁদের কয়েকজনের পরিবারও যদি শোকের ভিতরে খানিকটা সান্ত্বনা পায় তাহলে তা অবশ্যই প্রশংসনীয় এক কাজ। ব্যবস্থাপনায় কারা আছেন, জানতে পারি?’ অঁরির চোখদুটো কেমন জ্বলজ্বল করে উঠল।

‘কাজটাই আসল কথা, কারা করছে সেটা নয়।’ রবীন্দ্রনাথ শান্ত গলায় বললেন।

‘আমি আসলে চাইছিলাম আপনার পাশাপাশি ওদের কথাও ছাপতে, মানে যারা এই জালিয়ানওয়ালাবাগের জন্য কিছু করছে।’

‘আপনি খবর করতে চাইলে, জালিয়ানওয়ালাবাগে যে পৈশাচিক নৃশংসতা ঘটেছে তাই নিয়ে খবর করুন। কীভাবে বাষট্টি বছরের বৃদ্ধ ডাক্তার নাথকে ভরা রোদে মাইল কে মাইল হাঁটিয়ে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আর বন্দী অবস্থায় শৌচালয়ে যাবার সময়েও হাত আর পায়ের লোহার শিকল খুলে দেওয়া হয়নি তাই নিয়ে লিখুন; লিখুন কীভাবে আর এক ষাটোর্দ্ধ গোলাম জিলানির শরীরে লাঠি ভরে দেওয়া হয়েছিল তাই নিয়ে; তেরোই এপ্রিলের গণহত্যার আগে দশই এপ্রিল অমৃতসর শহরে প্রায় তিরিশজন মানুষকে খুন করেছিল বৃটিশ পুলিশ, জানেন তো? সৎকারের আগে তাঁদের যাতে রীতি মেনে স্নান না করানো যায় তার জন্য জলের লাইন বন্ধ করে দিয়েছিল মাইকেল ও’ডায়ার’ এবং তার সহযোগীরা। চাইলে তাই নিয়েও লিখতে পারেন।’ কথা শেষ করে কপালের ঘাম মুছলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে দৃশ্যত ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।

‘মৃতদের পর্যন্ত সম্মান জানাতে দেয়নি? আমার তো গ্রিক মহাকাব্যের আন্তিগোনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মৃতের সম্মানের দাবিতেই তো আন্তিগোনে পথে নেমেছিল রাজা ক্রেয়নের বিরুদ্ধে।’ কোঁমতেস’এর মুখ সহসা গম্ভীর হয়ে গেল।

‘আমার দেশের লোকের পথে নামারও উপায় নেই। নির্দিষ্ট কিছু রাস্তায় ভারতীয়দের হাঁটাও নিষেধ। পশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে পার হতে হয় সেই রাস্তা আমার দেশের মানুষের।’ রবীন্দ্রনাথের গলা অবরুদ্ধ হয়ে এল।

‘কী বলছেন কবি?’ কোঁমতেস দ্য নোয়াই উঠে দাঁড়ালেন সোফা ছেড়ে।

‘আমি যা বলছি তা হয়তো সবার মনোমতো হবে না। অঁরি সাহেবই তো মনে করেন যে এমনটা করা ঠিক হয়েছে।’ রবীন্দ্রনাথ গলা এক পর্দা নামিয়ে আনলেন।

‘অঁরি এরকমটা মনে করে?’ কোঁমতেস’এর গলায় বিস্ময়।

‘আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।’ অঁরি বিড়বিড় করে উঠলেন।

‘কিন্তু নিজের কথা তো বুঝবেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার পর ভারতে গিয়ে আপনি এরকম মন্তব্য করেছিলেন। দু’টি নামে ভারতীয় কিন্তু আসলে ব্রিটিশ খবরের কাগজে প্রকাশিতও হয়েছে সেই মন্তব্য।’ রবীন্দ্রনাথ বিষণ্ণ কন্ঠে বললেন।

‘জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পর ভারতবর্ষে গিয়েছিলে তুমি? কই আমরা কেউ কিছু জানি না তো! সেখানে গিয়ে ব্রিটিশের এই নারকীয় হত্যালীলার সমর্থনে কথা বলে এসেছ? তারপর এখন আবার আমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে, ওই ঘটনার প্রতিবাদের শরিক হতে চাইছ? মানে কী এসবের?’

সুসান মুখ খুললেন এতক্ষণে, ‘মানে খুবই সহজ এবং সরল। জালিয়ানওয়ালাবাগের শহিদ পরিবারগুলির জন্য কারা ত্রাণ সংগ্রহ করছে, মাইকেল ও’ডায়ারের গ্যাং’কে সেই তথ্য জানানোর ব্রত নিয়েছেন অঁরি সাহেব।’

‘ছিঃ ছিঃ! শেষে নিজেকে এতটা নিচে নামালে অঁরি? আমাকে এভাবে ব্যবহার করলে? তার চাইতেও বড় কথা, ফ্রেঞ্চ হয়ে ব্রিটিশের গুপ্তচরের ভূমিকা নিলে? কত পাউন্ডের বিনিময়ে কিনেছে ওই বানিয়ারা তোমাকে, কত হাজার, কত লক্ষ? বলো, আমাদের সবাইকে বলো!’ কোঁমতেস’এর চোখমুখ থেকে একটু আগেকার ঝর্না সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়ে দিয়ে যেন বিদ্যুৎ ফেটে বেরোচ্ছিল।

‘শাট আপ! আমাকে কিনবে তেমন কেউ জন্মায়নি এখনও।’ অঁরি পালটা চিৎকার করে উঠল।

‘বোকা বানাবার চেষ্টা করছ আবারও?’ কোঁমতেস ফুঁসে উঠলেন।

‘কে কাকে বোকা বানায় এই দুনিয়ায়? নিয়তির হাতে আমরা সবাই বোকা। যেমন বোকা ছিল আমার মা। হ্যাঁ, সেই মহিলা ব্রিটিশ ছিল। ভালবেসে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে থাকা একটা লোক আর তার দেশকে আপন করে নিয়েছিল। বুঝতে পারেনি যে লোকটা একদিন নিজের ছেলেকে নিয়ে ভেগে যাবে, এমনভাবে কেটে পড়বে যে ওই লরা আর তার খোঁজই পাবে না কোনওদিন। আরও বোকা কে শুনবে? সেই মহিলার গর্ভজাত এই আমি! যে মৃত্যুশয্যায় থাকা বাবার মুখ থেকে সবটা শুনে, নিজের মা’কে খুঁজতে যাবে বৃটিশদের দেশে। কিন্তু মা তো তখন অ্যাসাইলামে, বদ্ধ পাগল। আর আমি লিডসে গিয়ে পাগল হলাম মারসেলার প্রেমে। ও তখন ওখানকার একটা স্কুলে পড়ায়। এবার মারসেলার বাড়ি থেকে মানবে কেন? চালচুলোহীন একটা ছেলে, যার মৃত বাবা স্ত্রীকে ছেড়ে পালিয়েছিল আর মা পাগলাগারদে বসে জাল বুনছে স্মৃতির, তার সঙ্গে অভিজাত একটি পরিবার মেয়ের বিয়ে দেয়?’

‘কী বলছ তুমি এইগুলো?’

‘কেন কোঁমতেস, ইতিহাস বলছি নিজের। ইতিহাস কি শুধু রাজারাজড়ার থাকে, আমাদের থাকে না? না থাকলে পরে, আমাকে ইতিহাসে ঠেলে দিতে পারলেও মারসেলার বাড়ি আর ওর বিয়ে দিতে পারল না কেন? কেন মারসেলা অমৃতসর মিশন স্কুলের সুপারিন্টেনডেন্ট হয়ে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে চলে গেল?’

‘তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল?’

‘না। কিন্তু আমি ব্রিটিশ পুলিশে থাকা আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে ওর খবর পেতাম।’

‘ব্রিটিশ পুলিশে তোমার বন্ধু আছে তাহলে?’

‘থাকবে না কেন? আমি তো অর্ধেক ব্রিটিশ। আর তুমি যদি সম্পূর্ণ গ্রিক হয়েও আজ ফরাসি কাব্যজগতের নক্ষত্র হতে পারো, আমি মায়ের রক্ত শরীরে আছে বলেই ফ্রেঞ্চ হতে পারব না কেন?’

‘পারাটা কঠিন কারণ গ্রিক আর ফ্রেঞ্চদের মধ্যে ওয়াটারলু’র যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ইংরেজ আর ফরাসির মধ্যে…’

সুসানকে থামিয়ে দিল অঁরি, ‘জানি জানি। আমার শিরা-উপশিরাতেও ওই যুদ্ধ চলে সারাক্ষণ। ভলত্যের শেক্সপিয়ারকে ‘মাতাল বর্বর’ বলেছিলেন শুনে মদের আড্ডায় হেসে উঠি আমি, আবার সেই আমারই মারসেলাকে বহুবছর পরে হাসপাতালের বেডে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় দেখে নিজের অজান্তে ঠোঁটে এসে যায় শেক্সপিয়ারের সনেটের সেই লাইন, ‘বসন্তদিনের সঙ্গে করব কি তোমার তুলনা?’’

‘‘শ্যাল আই কম্পেয়ার দি টু আ সামারস ডে’ তো বুঝলাম কিন্তু মারসেলা হাসপাতালের বেডে কেন?’ সুসান জানতে চাইলেন।

অঁরি রবীন্দ্রনাথের দিকে তর্জনী তাক করে বললেন, ‘সেই প্রশ্নটা বিশ্বকবিকে জিজ্ঞেস করুন। জিজ্ঞেস করুন, কেন ওঁর দেশের উন্মত্ত মব পাথর ছুড়েছিল মারসেলা শেরউডের দিকে? লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল কেন?’

‘এর উত্তর কবিকে দিতে হবে না, আমিই দিচ্ছি। কারণ ঘটনাটা প্রথম কাগজে আসার পর থেকেই আমি নজর রাখছিলাম। পুলিশের মার খেতে খেতে সাধারণ জনতা যখন ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে উঠেছে তখন মারসেলা সাইকেলে চেপে অনবধানবশত সেই ভিড়ের মধ্যে গিয়ে পড়েছিলেন। ফলে ব্রিটিশ পুলিশের দিকে তাক করা ইট কিংবা পাথর যে ওর কপালও ফাটাবে সেটা খুব স্বাভাবিক নয় কি?’

‘স্বাভাবিক হলেও ভীষণই দুর্ভাগ্যজনক। একজন শিক্ষিকা, যিনি আমার দেশের বাচ্চাদেরই পড়াতে এসেছেন, তাঁকে আমার দেশের মানুষের হাতে আহত হতে হল, আমি এই ব্যাপারটার জন্য ক্ষমা করতে পারি না নিজেকে।’ বললেন রবীন্দ্রনাথ।

‘আপনি যা বললেন তা বোধহয় আপনিই বলতে পারেন বিশ্বকবি কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংসতার কারণে সারা পৃথিবীর কাছে উলঙ্গ হয়ে যাওয়া ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ, একটা খড়কুটো ধরে বাঁচতে চাইছে বলে মারসেলার ঘটনাটাকে রঙে রাংতা চড়িয়ে ফিরি করতে চাইছে দুনিয়ার হাটে। অ্যাকসিডেন্টকে বানিয়ে তোলা হচ্ছে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র আর সেই কথাটাই যদি অঁরির মতো ফরাসি নামধারী সাংবাদিককে দিয়েও বলানো যায় তাহলে যে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে তা তো বলাই বাহুল্য!’ সুসান’এর গলায় রাগ যেন দপদপ করে উঠল।

‘আমি ইংরেজ কিংবা ফরাসি হয়ে মারসেলাকে দেখতে ছুটে যাইনি ম্যাডাম, আমি গিয়েছিলাম কারণ আমি ওর প্রেমিক। ও আমাকে স্বীকার করলেও প্রেমিক আর প্রত্যাখ্যান করলেও তাই। নইলে পাঞ্জাব থেকে তার আসা মাত্র আমি প্যারিস থেকে রওনা হয়ে যাব কেন?’

‘তা তোমার প্রেমিকা কী বললেন তোমাকে, হাসপাতালে শুয়ে? হতভাগা ইন্ডিয়ানগুলোর উপর প্রতিশোধ নিতে?’

‘না নোয়াই, মারসেলা কথা বলার অবস্থাতেই ছিল না। কিন্তু ওকে দেখে রাস্তায় বেরিয়েই আগুন জ্বলতে থাকল আমার মাথার ভিতর। হয়তো জ্বলত না যদি পরদিন গিয়েও ফের দেখা পেতাম ওর। কিন্তু আমাকে গেটেই আটকে দিয়ে বলা হল যে মারসেলা এখন এক ব্রতচারিণীর জীবনযাপন করে তাই আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াই সেটা ওর কাঙ্ক্ষিত নয়।’

‘তার মানে তুমি প্রথম যে দিন হাসপাতালে ওকে দেখতে গেলে, সেদিনই ও চিনতে পেরেছিল তোমায়?’ কোঁমতেস’এর জিজ্ঞাসা সারা ঘরে বেজে উঠল।

‘হ্যাঁ। আর চিনতে পেরেও ওই যে আমার ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবার দরজা বন্ধ করে দিল, তাতেই মানুষ থেকে জন্তু হয়ে উঠলাম আমি। আমার মনে হতে লাগল যে সরু গলিটার মুখে মারসেলার মুখে ইট এসে পড়েছিল, সেই গলিটায় থাকা নেটিভগুলো অনন্তকাল উবু হয়ে হাঁটু ছেঁচড়ে এই মাথা থেকে ওই মাথা যাক, আবার ফিরে আসুক। ওই গলির এক গঙ্গাদেবী না যমুনাদেবী ওরকমভাবে জল আনতে যেতে পারেনি বলে তৃষ্ণায় বুক ফেটে মরেছে আর বিশ্বাস করো, সেই মৃত্যু তৃপ্তি দিয়েছে আমাকে। আমি প্যারিসে ফিরে এসে একগ্লাস শ্যাম্পেইন বেশি খেয়েছি।’

‘চমৎকার!’ সুসান আলতো করে বললেন।

‘হ্যাঁ, চমৎকারই। কারণ যে ভালবাসার প্রেমে প্রকাশ পাবার উপায় নেই, সে তো ঘৃণার সাহায্য নেবেই। তবে তার মধ্যেও, সাংবাদিক বলেই আমি ভুলিনি যে জালিয়ানওয়ালাবাগের কাণ্ড ঘটার আগে, অমৃতসরে পাঁচ-পাঁচজন ইওরোপিয়ান মানুষ গণরোষে মারা গেছেন। আমার কাছে তাঁদের নাম, ঠিকানা, পেশা সবকিছু নথিবদ্ধ আছে।’

কোঁমতেস আবারও জ্বলে উঠলেন শুনে, ‘কিন্তু সেই পাঁচটা মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য যে হাজারের উপর মানুষকে গুলি করে মারা হল, পুলিশি লক-আপ’এ নির্মমতম অত্যাচার করা হল শয়ে শয়ে মানুষকে, তাদের নাম ঠিকানা তোমার কাছে নেই! কারণ তারা তো কালো চামড়ার নেটিভ। কী দাম তাদের জীবনের?’

‘তুমি সেই প্রথম থেকে সংখ্যাটা অনেকটা বাড়িয়ে বলছ নোয়াই! হাউজ অফ লর্ডসে আলোচনার সময়ও যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে তাতে…’

‘আসলে মূর্খ, দরিদ্র ভারতবাসীরা তো কারও বাবা, মা, ভাই, বোন নয়, কেবলই পরিসংখ্যান, ইংরেজ সাম্রাজ্যের কাছে। আর তারা এমনই হাড়হাভাতে যে তাদের ঠিকানা কিংবা পেশা কিছুই কোথাও নথিবদ্ধ থাকে না। তাই হাজারের উপরে মানুষ মেরেও সেটাকে তিনশো-চারশো বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।’ সুসান কেটে কেটে বললেন।

‘এখানে সবাই দেখছি ভারতীয়দের পক্ষে। আমি একাই…’

‘না, অঁরি সাহেব। ভারতীয় কিংবা ইংরেজ অথবা ফরাসি কারও পক্ষে বা বিপক্ষে নই আমরা, কেবল জীবনের পক্ষে। আরও আরও আরও দাও প্রাণ, এই একটাই আমাদের প্রার্থনা। আর আপনার জন্যেও সেই একই প্রার্থনা করব।’

‘আমার জীবনে প্রার্থনার আর কোনও ভূমিকা নেই, মিস্টার টেগোর। আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন কেবলই জীবনমৃত্যুর মাঝখানে আটকে থাকা একটি প্রাণী যার কোনওদিকে যাবার স্বাধীনতা নেই।’

‘কে বলল নেই? আপনি কীভাবে জানলেন যে প্রেমের ধারা ফুরিয়ে গেছে আপনারই সম্মুখে এসে, ঘৃণার সাহচর্যেই আপনাকে চলতে হবে বাকি রাস্তা?’

‘বিকল্প কী আছে বলুন?’

‘প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্নই আছে ধরে নিন। আপনি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন যে মারসেলা কাউকে চিঠি লিখে আপনাকে এই প্রতিশোধের রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনতে বলেননি? কেমন করে আপনি জানছেন, যে মারসেলার হাতে অজস্র শিশু চারা থেকে বৃক্ষ হয়ে ওঠে তিনি আপনার প্রতিহিংসার আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়া আটকাতে চাইবেন না?’

‘আপনি কী বলছেন মিস্টার টেগোর, আমার মাথা ঘুরছে। কিন্তু এটা তো সত্যি যে মারসেলা আপনাকে চিঠি না দিলে আপনি আমার প্রকৃত পরিচয় জানবেনই বা কী করে? তবে আপনাকে ও চিঠি দেবেই বা কেন? কী আবোলতাবোল ভাবছি! বিশ্বজুড়ে আপনিই এখন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিকার চেয়ে মুখ খোলা, প্রধান ব্যক্তিত্ব। মারসেলা আপনাকেই তো সর্বাগ্রে বলবে, আমায় ফিরিয়ে আনার কথা।’

‘হত্যার কোনও প্রতিকার হয় না অঁরি, হত্যার কেবল প্রতিবাদ হয়। আর সেই প্রতিবাদের নামই প্রেম।’

‘সেই প্রেম আছে বলেই না মারসেলাও আমার খবর রাখে, আমি যে জ্বলেপুড়ে মরছি ওর জন্য তা জানে আর জানে বলেই আপনাকে…’

‘কিন্তু আমাকে উনি চিনবেন কী করে, এই প্রশ্নও আপনার মনে আসা উচিত।’

অঁরি হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘আপনাকে এই মুহূর্তে চেনে না কে? কে আছে যে আপনাকে চেনে না?’

কোঁমতেস মাথা নিচু করে বসে রইলেন সোফায়, সুসান জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন।

রবীন্দ্রনাথ দু’চোখ বন্ধ করে কোলের উপর নিজের দুই আজানুলম্বিত বাহু রাখলেন।

‘আপনাকে তবে চিঠি লেখেননি মারসেলা শেরউড?’ সুসান জানতে চাইলেন।

আপন মনে কথা বলতে বলতে অঁরি বেরিয়ে গেছেন খানিকক্ষণ আগে। অঁরি’কে ওই অবস্থায় একা ছেড়ে দেওয়া বিপজ্জনক বিবেচনা করে কোঁমতেস দ্য নোয়াই, খানিকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও, সঙ্গী হয়েছেন। তারপর থেকেই রবীন্দ্রনাথ এমনভাবে বসে আছেন যেন উপাসনা চলছে মনে মনে। তবু সুসান যখন মারসেলা চিঠিতে কী লিখেছেন জানতে চাইলেন তখন উত্তর দিতেই হল ওঁকে।

‘আমি কী একবারও আমার চিঠি পাওয়ার কথা বলেছি? আমি বলেছি, মারসেলা কি অঁরিকে মানবিকতায় ফিরিয়ে আনার জন্য কোনও চেষ্টা করতেন না, কাউকে বলতেন না কিছু?’

‘কিন্তু কবি, অঁরি যখন ধরে নিল যে আপনাকেই ওর হৃদয়বেদনার প্রতিবিধান করতে বলেছে মারসেলা, আপনি তখন তা নস্যাৎ করলেন না কই?’

‘নস্যাৎ করে কী বলতাম? ইংল্যান্ডে আমার অনুরাগী পাঠক আছেন বহু, তাঁদের অনেকেই উচ্চপদে কর্মরত আর তাঁদেরই একজন আমি লণ্ডনে থাকাকালীন অঁরি প্রেভরের ছবি দেখিয়ে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল? সেটা বললে পরে ওঁর মনে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা প্রতিশোধের আগুন আরও অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হত না কি?’

‘এই লোকটির বিষয়ে সতর্কিত হয়েও আপনি ওঁকে আপ্যায়ন করলেন? ঘরে বসিয়ে কথা বললেন এতক্ষণ? ও তো বড় বিপদে ফেলে দিতে পারত আপনাকে। তখন কোন ঈশ্বর এসে রক্ষা করতেন?’

‘বিপদে আমায় রক্ষা করুন এই প্রার্থনা তো আমি ঈশ্বরের কাছে করিনি কখনও। বিপদে আমি ভয় না পাই, সেইটুকুই যাচনা করেছি।’

‘কোঁমতেস’এরও বলিহারি। তুমি কাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছ, খোঁজ নেবে না একবার?’

‘কোঁমতেস নিয়ে না এলে ও একাই আসত আমার কাছে। দরজা বন্ধ পেলে আরও বেশি করে হিংস্রতার দিকে ঝুঁকত। আর ব্যক্তি অঁরিকে বাদ দিয়ে দেখলে, মানুষ মানুষের ঘরের দরজা বন্ধ পাবেই বা কেন? হাত যদি দরজা নাও খোলে, গান দরজা খুলবে না?’

‘পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের চাইতেও বড় এক আশ্চর্য আপনি, রবীন্দ্রনাথ।’ সুসান’এর চোখ জলে ভরে উঠল।

‘না, এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই সুসান। কিছুক্ষণ আগে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই দেখা যাচ্ছিল যে আকাশ লাল আর কালো দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। প্রতিটি গোধূলিতেই হয়। মানুষের ভিতরেও তেমন দু’টো ভাগ আছে।’

‘কীরকম?’

‘যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ হয় তারা সেই অন্যায়ের কথা ভুলতে পারে না। আর যারা ওই অপরাধ করে তারা সেই অন্যায়ের কথা মনে করতে পারে না। শিল্প, সে গান-গল্প-কবিতা-চিত্রকলা যাই হোক না কেন, এই স্মৃতি আর বিস্মৃতিকে মেলাতে চায়। কিন্তু তারা মেলে না, অনন্ত সমান্তরাল হিসেবে চলতেই থাকে।’

‘মেলে কবি, আপনার কলমে, আপনার কথায় মেলে। না মিললে পরে শিল্প শান্তিতে উত্তীর্ণ হয় কী করে? আমার রুক্ষ চোখই বা আবার জলে ভরে ওঠে কেন?’ সুসান কারপ্লেস চোখে রুমাল চাপা দিলেন।

প্যারিস এর আকাশে সেই বিকেল থেকেই মেঘের পরে মেঘ জমছিল। এতক্ষণে বৃষ্টি নামল তোড়ে।

এটা অগাস্ট মাস। শান্তিনিকেতনেও এখন বৃষ্টি হচ্ছে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে শিলাইদহে।

সুসান সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর, রবীন্দ্রনাথ হোটেলের অপ্রশস্ত ঘরটির জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন।

জানলার কাচে বৃষ্টির ছাঁট কি কখনও কোনওদিন জালিয়ানওয়ালাবাগের অনন্ত রক্ত মুছে দিতে পারবে? সম্ভবত পারবে না, কিন্তু পারলে পরে বৃষ্টিই পারবে। বাইরের বৃষ্টি, বুকের ভিতরের বৃষ্টি।

রবীন্দ্রনাথ গেয়ে উঠলেন, ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে…’।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *