short-story-aniler-bharat-yatra

অনিলের ভারত যাত্রার কথা
ওমর কায়সার


১৭ এপ্রিল, ২০১৯

অনীল শীলকে ভারত নিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। ভারতের চেন্নাইয়ে বিজয়া নামে প্রায় ৫০ বছর পুরোনো একটি হাসপাতালের সঙ্গে মেইলে যোগাযোগ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিকঠাক। যাত্রার দিনক্ষণও ঠিক। বিমানবন্দরেও গিয়েছিল তারা। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল তার কিছুই কূলকিনারা করতে পারছে না তার নাতি বিটু শীল। ঠিক এই মুহূর্তে কী করণীয় হতে পারে সেই ভাবনাটাই মাথায় আসছে না। তীরে এসে গতিহারা ঢেউয়ের মতো তার ভাবনাগুলোও যেন কোথাও গিয়ে বার বার মাথা কুটছে। তার পায়ে এসে লাগছে সমুদ্রের লোনা জলের স্পর্শ। আর বুকের গহীন থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে পতেঙ্গার সমুদ্রতীরের বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সূর্য উঠতে কিছু সময় বাকি। কিন্তু পুবের আকাশে একটা নিরাকার আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পতেঙ্গায় নিজের বাড়িতে জন্মের পর কতটা বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু কখনও এরকম শেষ রাতে সমুদ্রের ধারে আসেনি। কোথাও কোনো লোকজন নেই। অন্ধকার। তবুও বহু দূর থেকে ধেয়ে আসা বড় বড় ঢেউগুলোকে এমন আলোহীন পরিবেশে চিহ্নিত করা যাচ্ছে। যেন এক অলৌকিক আলো আলোকিত করে রেখেছে। এই জলরাশির সঙ্গে তার যেন নাড়ির টান। প্রতিবার বাড়ি এলে অন্তত একবার সে এখানে আসবেই। ঢাকার নাগরিক জীবনে যন্ত্রদানবের ভিড়ে, ধুলো ধোঁয়া আর যানজটের ভেতর যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখন চোখ বুজে বাড়ির কাছের সাগরটির ছবি ভাবতে থাকে। সেই ভাবনা তার ভেতরে এক ধরনের সুর জাগায়। সরকারি সংগীত কলেজের এই ছাত্রটিকে তার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলে— সাগরের সৈকতে গিয়ে একা বসলেই তো বুকের ভেতর থেকে সুরের উচ্ছ্বাস আসে। সেই সাগর ছেড়ে তোকে কে বলেছে রাজধানীর এই হট্টগোলের ভেতর সংগীত সাধনা করতে আসতে? এই অন্ধকারে সমুদ্রের অলৌকিক আলোর সামনে বসে বসে ঢাকার বন্ধুদের সেই কথাগুলোকে যথার্থ মনে হচ্ছে। আজ প্রায় দেড়মাসের অধিক হল ঢাকা থেকে চলে এসেছে দাদুর অসুখের জন্য। পিতৃহীন বিটুর জীবনে দাদুর বেঁচে থাকাটা জীবনের আর সকল কিছুর চেয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে। আজ সারা রাত দাদু মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করেছে। দাদু তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাসগুলো বড় কষ্টে টেনে নিচ্ছে। দূরে বহির্নোঙরে বিশাল জাহাজগুলোতে বাতি জ্বলছে। মনে হচ্ছে ওখানে আরেকটা আকাশ। এমন পরিবেশে অন্যসময় হলে মনের গহীন থেকে সুর ভেসে আসতো। কিন্তু সারা রাত ঘুমহীনতার ক্লান্তি তাকে অবশ করে ফেলেছে। দাদুর অদ্ভুত আচরণে সে হতবিহ্বল। কেন এমন ঘটল তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন নিজের অজান্তে হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলে এসেছে বুঝতেই পারেনি। যন্ত্রণাক্লিষ্ট একজন মুমূর্ষ রোগীর মাথার কাছে বসে তার কাতরানো দেখতে দেখতে ঘুম আসে না। বরং রোগীর শরীর আর মনের অসহায়তাটুকু অন্য সবার মনে সংক্রমিত হয়। একজনের কষ্ট ছড়িয়ে যায় অন্য সবার মধ্যে। দাদু সারা রাত অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। শেষ রাতের দিকে ক্লান্ত হয়ে একটু চোখ বুজেছে। মনে হয় একটু ঘুম এসেছে। আর ঠিক সেই সময় খুব সন্তর্পনে, যাতে দাদুর ঘুম না ভাঙে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে অন্ধকারে। ঘর থেকে বেরিয়েই লক্ষ্যহীন ঘুরছিল। কোন্ দিকে যাবে সে? চট্টগ্রাম শহরের একেবারের শেষ সীমান্তে বিটুদের বাড়ি। ডানে যদি সে হাঁটতে থাকে সে পাবে একটি মোহনা। বহু দূর পথ পাড়ি দিয়ে একটি নদী ওখানে এসে সাগরের সঙ্গে মিশে গেছে। বাম দিকে গেলেও সাগর। একদিকে সাগর, অন্য দুই দিকে নদী ঘিরে রেখেছে বিটুর পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিকে। কিন্তু জল তাকে কখনও তেমন টানেনি। এমনকি বংশপরম্পরা ধরে তার বাবা ঠাকুরদাদাদের পেশাও তাকে টানেনি। বিটুর রক্তের ভেতর সুরের নেশা। তার কণ্ঠে স্বরস্বতী যেন নিজের হাত বুলিয়ে দিয়েছে। ধ্রুপদী গানে সে শ্রোতাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। ছোটবেলা থেকে গানের প্রতি আকর্ষণের কারণে দাদু তাকে গান শিখতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। দাদু তার জীবনের, তার সাধনার অনুপ্রেরণা। আর সেই দাদু যখন গত এক-দেড় বছর ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগে ভুগে কাতরাচ্ছে তখন তারও যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে মনে তার শপথ ছিল যেভাবেই হোক দাদুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাবে। সেভাবেই সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

পূর্বসূরীদের প্রতি এই ভালোবাসা, এই যে মায়ার টান, সেটাও সে দাদুর থেকেই পেয়েছে। দাদুর একটা জীবন চলে গেল তার বাবার জন্য আহাজারি করতে করতে। সারা জীবন দাদু তার বাবা উমেশ শীলের জীবনের করুণ কাহিনিই বলে গেছে। দাদু বলে— ‘আঁর বাপর মরণর ভুতুর বাংলাদেশর জন্ম লুকাই রইয়ি।’ (আমার বাবার মৃত্যুর ভেতর বাংলাদেশের জন্ম লুকিয়ে রয়েছে)

টিটু বলে, ‘এই কাহিনি, বহুবার শুনেছি দাদু। বার বার কেন বলো?’

দাদু বলে— ‘কাহিনি নয়, ইতিহাস। আমি বার বার বলব। প্রতিদিন বলব। প্রতিদিন যদি না বলি, তোরা ভুলে যাবি। আমি মরে গেলে তোরাও তাদের পুত নাতিদের শুনিয়ে যাবি কামানটিলার গল্প।’




১৬ এপ্রিল ১৯৭১

পতেঙ্গার শীলপাড়ায় বাড়ির পেছনে বাগিচায় গোল হয়ে চুপচাপ বসে ওরা কয়েকজন। গত কয়েকদিন ধরে তাদের কোনো কাজ নেই, আয়-উপার্জনও নেই। প্রশ্নটা যেখানে বাঁচা-মরার, সেখানে আয়-উপার্জনের কথা কারওর মাথায় আসছে না। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মিলিটারিরা মানুষ খুন করছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। দেশের পরিস্থিতি আসলে কী, কী ঘটতে যাচ্ছে কিছুই অনুমান করতে পারছে না মানুষগুলো। এই অবস্থায় অসহায় হয়ে শুধু সময়ের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে চুপচাপ থাকাই ভালো। একজন আর একজনের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই। ঠিক এই অবস্থায় মৌনতা ভেঙে সবার আগে কথা বলে উঠল পুলিন— ‘অঅন কী উপায় হইবু? আঁরা হন্ডে যাইয়ুম? গাঁ হঅ আর শঅর হঅ, ইয়ানই তো আঁরার ঠাঁই, আঁরার তো আর হনহাইত যাইবার যাগা নাই। অ ঠাকুর আঁরার কী অইবু?’ (এখন কী উপায় হবে? আমরা কোথায় যাব? গ্রাম বলো আর শহর বলো, এটাই তো আমাদের আশ্রয়, আমাদের তো আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, হায় ঠাকুর আমাদের কী হবে?)

অজিত তাকে আশ্বস্ত করে। পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে সবাইকে বিজ্ঞের মতো বোঝাতে চায়, এই পরিস্থিতি আসলে তাদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। অসহায়, নিরীহ আর গরিব নাপিতদের কেন মারবে মিলিটারিরা? তারা তো কোনো রাজনীতি–টাজনীতির মধ্যে নেই।

অজিতের কথার প্রতিবাদ করে সূর্য্য মোহন— ‘তুই তো এক্কানা বেশি বুঝস। তোর হোয়ালত লেহা আছে না, তুই যে নাইতা? ইতারা কেয়ারে নঅ মানের। বেয়াগ্গুনুরে মারি ফালার।’ (তুই একটু বেশি বুঝিস। তোর কপালে কী লেখা আছে যে তুই নাপিত? ওরা কাউকে মানে না। সবাইকে মারছে।)

সূর্যের কথায় রাগ করে না অজিত। সে যে মনে মনে আশাবাদী তার একটা ভিত্তি আছে। পতেঙ্গা এয়ারপোরটের চৌহদ্দিতে অজিতের সেলুনের পাশে গোলাম, আলাউদ্দিন আর ইউসুফের দোকান আছে। ওরা তিন ভাই, বিহারি। ওরাই তো অজিতকে বলেছে তাদের কোনো কসুর নেই। তাদের কিছু করবে না। অজিত সেই কথাই বোঝাতে চাইছে।

অজিতের কথায় কেউ আশ্বস্ত হয়, কেউ আবার সন্দেহ করে। ওদের কথোপকথনে এতক্ষণ চুপ ছিল কৃষ্ণ। সে এবার মুখ খোলে। সেও অজিতকে বোঝাতে চায়, বিহারিদের বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। নাপিতেরা কোনো রাজনীতিতে নেই সে কথা ঠিক। কিন্তু গরিব অশিক্ষিত শ্রমিকেরাও তো রাজনীতিতে নেই। তাহলে মার্চের ২৪ তারিখ বন্দরে অস্ত্রবাহী জাহাজে এতগুলো শ্রমিককে কেন মারল?

এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সেই নেইয়ের হাহাকারের মধ্যে নব বৈশাখের প্রখর তাপের দুপুরে সবার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। উমেশ বলে উঠল— ‘নোয়া বছরখান ঢুকিলদি কী অভিশাপ লই, হায় ভগবান!’ (নতুন বছরটা কী অভিশাপ নিয়ে এল, হায় ভগবান!)

এ প্রশ্নের জবাব কারওর জানা নেই। পড়শি-স্বজনদের মুখে তাই এর উত্তর মেলে না। তারা তো আসলে কেউ জানে না, তাদের জীবনে আর কখনও নতুন বৈশাখ আসবে না। এটাই তাদের জীবনের শেষ বৈশাখ।

সেদিন বিকেলেই তিন বিহারি ভাই গোলাম, আলাউদ্দিন ও ইউসুফ আসে শীলপাড়ায়। ওরা সহাস্যমুখে অজিতকে জড়িয়ে ধরে। অজিত ভালো উর্দু বলতে পারে না। উমেশের মামাতো ভাই পুলিন শীল উর্দু জানে বলে সেই ওদের কাছ থেকে শুনে শুনে সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

বিহারি তিন ভাই সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে, নাপিতদের কোনো ভয় নেই। কাল শনিবার এয়ারপোর্টের কাছে কামানটিলায় মিলিটারিদের ঘাঁটিতে তাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে নাপিতদের পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। এই পরিচয়পত্র দেখালেই কেউ আর তাদের কিছু করবে না। সব কথা বুঝিয়ে বিহারি তিন ভাই ফিরে গেলে ১৬ এপ্রিল শীলপাড়ায় স্বস্তির সন্ধ্যা নেমে আসে।




১৭ এপ্রিল ১৯৭১

এয়ারপোর্টের এই দিকে খুব একটা আসা হয় না উমেশের। এই এলাকার নাম কামানটিলা। ব্রিটিশ আমল শেষ হওয়ার ক’দিন আগে গোটা দুনিয়াব্যাপী এক যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা এখানে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিত। একটা চাঁদমারিও ছিল। সেই চাঁদমারি থেকে দুনিয়া কাঁপানো কামানের গোলা ছাড়ত ব্রিটিশ সৈন্যরা। এসব কথা মুরুব্বিদের কাছ থেকে শুনেছে উমেশ। এখন ব্রিটিশ সৈন্য নেই। আছে পাকিস্তানি সৈন্য। বৈশাখের তীব্র রোদে ওদের গায়ের কাপড় ভিজে যাচ্ছে। তৃষ্ণায় বুক ফাটছে। কিন্তু কোনো খবর নেই কারওর। গোলাম, আলাউদ্দিনদের দেখা নেই। সারাটা সকাল কাটল অপেক্ষায়।

দুপুরের দিকে বিহারি তিন ভাই আসে খোশমেজাজে। ওরা জানাল— দেরি হচ্ছে বলে ঘাবড়াবার কারণ নেই। আসলে মিলিটারি স্যাররা এখানে একটা বাংকার করবে। তার জন্য গর্ত খুঁড়তে হবে। স্যারেরা কষ্ট করে কোদাল যোগাড় করেছে। এখন তারা গর্তটা খুঁড়ে দিলে সবাইকে মজুরি দেওয়া হবে। সঙ্গে পরিচয়পত্রও দেবে।

ওরা বুঝতে পারে। এখানে না বলার কোনো অবকাশ নেই। মধ্যাহ্নের শেষে ওরা সবাই মাটি খোঁড়া শুরু করে। শীল পাড়ার পঁয়ত্রিশজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাইরের আরও কয়েকজন। ওরা সবাই মিলে সেদিন নিজেদের বধ্যভূমি নিজেরাই রচনা করে। সন্ধ্যার অনেক পর ক্ষুধায় কাতর ও পরিশ্রান্ত মানুষগুলো ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে। তখন অদূরে লোনা জল মাখা হাওয়া বইছিল। ওদের সবাইকে গর্তের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে তিন বিহারী বলেছিল— আমরা যাচ্ছি, আইডি কার্ড আর মজুরি এখুনি স্যারেরা দিয়ে যাবে। তোমরা লাইন ধরে দাঁড়াও।

আসার সময় উমেশের ছেলে অনিল বারবার নিষেধ করেছিল। বলেছিল, পরিচয়পত্রের দরকার নাই। তারা কর্ণফুলী পার হয়ে আনোয়ারায় চলে যাবে। ছেলের কথা না শুনে এখন আফসোস হচ্ছে তার। এখন সারাদিন মাটির কাটার পরিশ্রম করে ক্ষিদায় প্রাণ যায়।

এই ভাবনার ঠিক কয়েক সেকেন্ড পর উমেশদের ক্ষুধা চিরতরে নিবে যায় মেশিনগানের গর্জনে। সেই গর্জনের কারণে মানুষের আর্তনাদ চাপা পড়ে গেছে। তবে বাতাসে মেশিনগানের গর্জন বহুদূর অবধি ভেসে গিয়েছিল। সকাল হওয়ার আগেই মাটি চাপা দেওয়া হয় সাঁইত্রিশজন মানুষের লাশ। শুধু তিনজন মানুষ গুলি খেয়ে, রক্তাক্ত অবস্থায় অন্ধকারে পালিয়ে গিয়েছিল।




১৭ এপ্রিল ২০১৯

দাদু বলে— ‘বৈশাখ মাস আইলি কইলজা ফাডি যাইগুই। পরানর ভুতুরে কেয়াই যেন্‌ মেশিনগান চালায়। ও বুক এদুগ্গা মানুষ মারি ফেলাইয়ি ইয়ানর হনঅ চিহ্ন কিল্লাই নঅ তাইবু?’ (বৈশাখ এলে কলিজা ফেটে যায়। প্রাণের মধ্যে কেউ যেন মেশিনগান চালায়। হায় হায়! এতগুলো মানুষ মেরে ফেলল, তার কোনো স্মৃতি কেন থাকবে না?)

বুক চাপড়ে, বিলাপ করতে করতে দাদু প্রায়ই বলে, ‘আঁরা পুত নাতি ছাড়া কামানটিলার হথা কেয়াই মনত ন রাহে।’ (আমরা পুত-নাতি ছাড়া কামানটিলার কথা কেউ মনে রাখেনি)

এখন এই নির্জন সমুদ্র সৈকতে একা একা বসে দাদুর সারা জীবনের বিলাপ তার ভেতর থেকেও উঠে আসছে। আসলেই কেউ মনে রাখেনি এই গণহত্যার কথা।

বিটু ভাবে মানুষ দাদুর কাছে কত রূপকথার গল্প শোনে, রাজারানীর গল্প শোনে। অথচ কী অদ্ভুত তাকে আজীবন শুনতে হল গণহত্যার এক বিভৎস নিষ্ঠুর গল্প। এখন একটি নতুন দিনের উন্মেষের কালে সমুদ্রের তীরে বসে মনে হচ্ছে বিটুর সামনেই কামানটিলার ঘটনা ঘটে চলেছে। অবাক হয়ে সে ভাবে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে সেদিন মেশিনগানের গুলিতে শুধু তার পূর্বপুরুষদের হত্যা করেনি। সেদিন আসলে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও শেষ করে দেওয়া হয়েছে। বাবাকে হারানোর ঘটনা তার দাদুর ওপর কীরকম প্রভাব ফেলেছে সে আজ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পাড়ছে। দেড় বছর আগে ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে দাদু ক্রমশ ফিরে যাচ্ছিল তার জীবনের অতীতে। আর অতীত মানেই নির্মম নিষ্ঠুর কামানটিলার গল্প।

বিটু ঢাকা থেকে এসে দাদুর চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে যাচ্ছিল। ইন্টারনেট ঘেঁটে, ইমেইল করে ভারতে চেন্নাইয়ের বিজয়া হাসপাতালে দাদুর চিকিৎসার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে। সে অনুযায়ী পাসপোর্ট তৈরি করা, ভারতীয় ভিসা লাগানো, বিমানের টিকিট, যাত্রার দিন সব ঠিক হয়ে গেছে। বাড়ির কাছে বিমানবন্দর। ঘর থেকে বেরিয়ে দশ মিনিটের মধ্যেই বিমানবন্দরও পৌঁছে গিয়েছিল দাদুকে নিয়ে। দুপুর বারোটায় ফ্লাইট ছাড়বে। বোর্ডিং পাশ, ইমিগ্রেশনও হয়ে গেছে। তখন শুধু উড়োজাহাজে ওঠার অপেক্ষা। লাউঞ্জে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরই ডাক আসল বিমানে ওঠার। সবকিছু তখনও ঠিকঠাক। বিমানে ওঠার একটু আগে চারপাশে তাকিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে অনিল— ‘আমি যাব না।’

ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ বিটু, তার চিৎকারে ফ্লাইটের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাসহ সচকিত হয়ে উঠল সবাই।

‘কেন? কারণ কী?’ — জানতে চায় বিটু।

বিটুর প্রশ্নের উত্তরে চিৎকার করে বলতে থাকে অনিল— ‘এই এয়াপোটর মাডির নীচে আর বাপর শরির, এডে আঁর বাপখুড়ারে মারি ফেলাইয়ি দে। এই মাডিরে ঠ্যাঙর তলাত দিয়েরে আঁই হনমিক্কা নঅ যাইযুম।’ (এই বিমানবন্দরের মাটির নীচে আমার বাবার শরীর। এখানে আমার বাবা-কাকাদের মেরে ফেলা হয়েছে। এই মাটিকে আমি আমার পায়ের তলায় দিয়ে কোথাও যাব না।)

একরোখা মানুষটিকে নিয়ে ওখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হল বিটুরা। বাড়িতে সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনিল ফিরে এসে দ্বিগুণ অসুস্থ হয়ে গেল। সারা রাত ব্যথায় কঁকিয়েছে।

বিটু ভাবে মানুষের ভবিতব্য আসলে বোঝা দায়। এক মিনিট পরে কী হবে তাও অনুমান করা খুব কঠিন। এই যে সমুদ্রের তীরে বসে আসে ভোরের আলো ফুটবার কিছু আগে, অথচ আজ তার থাকার কথা এখান থেকে হাজার মাইল দূরে ভারতের দক্ষিণে চেন্নাইতে। এর পর কী হবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সমূদ্রের অসীম থেকে ঠান্ডা শীতল বাতাস তাকে জড়িয়ে ধরছে। দাদুর এরকম অদম্য জেদের জন্য এখন তার কেন জানি গর্ব হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর অন্য কোনো ভাষা হয়তো দাদুর আর জানা ছিল না। কী জানি, এতক্ষণে লোকটার ঘুম ভেঙেছে কিনা। ঠান্ডা হাওয়া এসে বিটুকে জড়িয়ে ধরছে।

আকাশ ফর্সা হয়ে উঠছে। সমুদ্রের গর্জনকে উল্লাসের মতো মনে হচ্ছে। নিজের অজান্তে তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে গান — সকাল বেলার আলোয় বাজে বিদায় ব্যথার ভৈরবী।

ভোরের কাগজ ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত। পরিমার্জিত করে প্রকাশিত হল

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *