মোহিত কামাল
ইচ্ছে থাকার পরও হাতের কাজটা শেষ করার তাগিদ বোধ করল না রাহুল। ইচ্ছার ফাঁকফোকর দিয়ে অনীহা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে লাগল বিরক্তি। নিজের ভেতরের আবর্জনার স্তূপ চোখে না পড়লেও অদৃশ্য নোংরা ময়লার ভারে ক্লান্ত হতে হতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের চলমান চাকায় ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে, সেটাও টের পাচ্ছে না ও। তবে ইচ্ছের সলতেয় মৃদু শিখা এখনও জ্বলছে বলেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ভেতরের সাড়া শূন্য হয়ে যায়নি। কিন্তু মস্তিষ্কের ভেতর থেকে কোনও গতি-সঞ্চারি সংকেত আসছে না। বসে আছে তো আছেই। অথচ অনুভব-অনুভূতির সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ ছিল একসময়। এখন তরঙ্গহীন অনুভবের স্থির জলে ডুবেও যাচ্ছে না, ভেসে আছে কেবল। তবে কি আবেগের ঘূর্ণির ভেতর থাকে আরেক ঘোর, জলধারা? ভিন্ন স্রোতের জীবন? ভেতর থেকেই কি তা উপরিতলে ঠেলে রাখে মানুষকে? ডুবতে দেয় না অতলে?
গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ঢেউয়ের মধ্যে ডুবে গিয়েও যেন ভেসে আছে রাহুল।
কে ওকে ভাসিয়ে রাখছে?
তলে তলে কি অন্য কোনো প্লবতা কিংবা সম্পর্কের ডালপালা ধরে ঝুলে আছে নিজে?
প্রশ্নটার কণাতরঙ্গ উঁকি দিল মনে। আর তখনই রাহুল দেখল নিজের আরেক রূপ। চোখের সামনে ভেসে এল সেই রূপগাথা। দেখার মতো করে তা দেখা হয়নি চোখ মেলে। অনুভবের চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে নামতে-উঠতে কখনও মনে পড়েনি সেই কথা। এখন হঠাৎ বিন্দু বিন্দু আলোর কণা ছড়িয়ে যেতে লাগল চারপাশে। আলোর উদ্ভাসে নতুন চিন্তা মাথায় ঢুকল, কেউ নেই কাছে, দূরে সরে গেছে সবাই।
হঠাৎ উঠে কক্ষের জানালা খোলার পর ও দেখল রোদের বাড়াবাড়ি। সেদিকেই তাকিয়ে রইল।
চোখ পুড়ে যাচ্ছে দুপুরের কড়া রোদে। তবু চোখ সরানোর তাগিদ পেল না। বরং রোদের তীব্রতা ঠেকানোর জন্য পকেটে রাখা রোদচশমা লাগিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল জানালার পাশে।
আচমকা মনে হলো, রোদেরও ছায়া আছে।
এ ছায়ার মতোই নিজের ছায়াজীবনকেও আবিষ্কার করে ফেলল ও। সেই ছায়াসঙ্গীকে চেনার চেষ্টা করে চমকে উঠল রাহুল। কড়া রোদ দেখতে দেখতে অনুভব করল রোদের ভেতর থেকে প্রবলভাবে বেরিয়ে এসেছে রোদ-ছায়া; আর নিজের মধ্যে লুকোনো ছায়াটা তার চেয়েও ক্ষিপ্রগতিতে সামনে এসে সরিয়ে দিল রাহুলের আসল সত্ত্বা আর ছায়া সত্ত্বার মধ্যে ওত পেতে থাকা কালো পর্দা। কেঁপে কেঁপে উঠল রাহুল। প্রকৃতি, সড়ক-জনপদ-লোকালয় ভূকম্পনে যেভাবে কাঁপতে কাঁপতে চুরমার হয়ে যায়, তার চেয়েও বড় কম্পনের শিকার হয়ে ও চোখ বন্ধ করে ফেলল। জানালার পাশ থেকে নিজেকে সরিয়ে রোদচশমা খুলে বসে পড়ল পড়ার টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে। আসল-রাহুল আর ছায়া-রাহুলের মাঝখানের কালো পর্দা সরে যাওয়ার পর এক অচেনা শুদ্ধতার ছাট লাগায় আকাঙ্খার তলানিতে থাকা বারুদ আচমকা একবার জ্বলে উঠল। অলীক আলোকতরঙ্গমালার দাপটে নিজের উদ্যম লুটে নেওয়া উৎস-শেকড় পর্যন্ত ছলকে উন্মোচিত হয়ে গেল চোখের সামনে।
কী দেখল রাহুল! ব্যভিচারী কোনও বহ্নি? নাকি ব্যভিচারী শিখা ওম দিচ্ছে দেহহীন শুদ্ধতর দেহের ভিতে? কামরিপুর মুখোশ পরেই কি ও বসে থাকে রাত-দিন? ভাবতে ভাবতে সচেতনমনের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নিচে যেতে লাগল রাহুল। প্রশ্নের উত্তর খোলাসা হলো না।
নিজের শুদ্ধতার আভরণের স্তরে স্তরে ব্যভিচারী কোনো ছাপও দেখতে পেল না। ও দেখল থরে থরে সাজানো যাপিত জীবনের প্রতিটা ঘটনার মধ্যে স্থায়ীভাবে বসে আছে ত্রিমাত্রিক জীবন্ত আঁচড়। যা সে করে, শুদ্ধতার লেপন লেগে যায় সেই আভরণে। তাহলে কি কালিমার কোনো লেপন নেই জীবনে? নাকি নিজের কালিমা ছুঁতে পারে না অঙ্গহীন অঙ্গকলা? নিজের মধ্যে জেগে ওঠা প্রশ্নের মধ্যে থেকেও দ্বন্দ্বের ঘূর্ণি উঠল। দ্বন্দ্বের মীমাংসা খুঁজে পাওয়ার সাহস না-পেলেও নিজেকে আবিষ্কারের নেশায় ছায়াসঙ্গীকে প্রশ্ন করল, ‘কীভাবে আমার সঙ্গী হলে তুমি?’
অলীক কোনও প্রশ্ন নয়, বাস্তবের নখরে খোঁচা খেয়ে ছায়াসঙ্গী শুদ্ধ শব্দের স্ফুরণ ঘটিয়ে বলল, ‘আমি তো তোমার সঙ্গীই নই কেবল, তোমার সত্তার ভিত্তি হচ্ছে আমার অস্তিত্ব। যা তুমি করো তার একটা প্রতিদৃশ্য চিত্রিত হয়ে বসে যায় আমার ভিতে।’
‘বলো কী? আমায় সব কাজের প্রতিলিপিই কি ছাপ মেরে দেয় তোমার দেয়ালে?’
‘হ্যাঁ। সবই থেকে যায় আমার অনন্ত গভীরে। তোমার স্ববিরোধী-আকাঙ্খার ব্যভিচারী তাড়নাও আসন নেয় আমার অনঙ্গ শরীরের অঙ্গকলায়। আর দেহ-চোখের মণি ফুঁড়ে বেরোনো ব্যভিচারী আলোকতরঙ্গও আশ্রয় নেয় আমার আঁধারজগতে। সেই জগৎ তখন আলোকিত হয়ে ওঠে। সুযোগ পেলেই সেই আলোতরঙ্গ হুসহুস বেরিয়ে যেতে পারে তোমার অগোচরে।’
‘সর্বনাশ! তাহলে তো সবাই দেখে ফেলবে আমার একান্ত নিজস্ব মনঘর!’
‘হ্যাঁ। এ জগতে ভালো-খারাপ দুটোরই দাগ বসে যায়। কোনও কর্মই লুকোনো থাকে না, যা গোপনে করছ, তা গোপন থাকবে না। গোপনে যা করে মানুষ, তা প্রকাশিত হবেই।’
অনীহার উৎস খুঁজতে গিয়ে, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোনোর মতো, গোখরার ছোবল খেল রাহুল। স্বর্ণার জন্য নিজেকে যেভাবে প্রস্তুত করছিল, শুদ্ধতার পোশাক পরে নিজেকে যেভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছিল, সেই তাগিদের ডালে উড়াল দিয়ে এসে বসল এক বাজপাখি। বাজের চোখের অভেদ্য নিশানা ছিঁড়েখুঁড়ে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে আগোচরে থাকা ছায়াসঙ্গীর দেহাভরণ।
ব্যস্ত হয়ে রাহুল বলল, ‘তোমাকে দেখতে চাই না। কথা বলতে চাই না তোমার সঙ্গে। পালাও, প্লিজ পালাও এখন।’
‘তুমি থাকলে তোমার ছায়াও থাকবে। বাইরের ছায়া থেকে ভেতরের ছায়া আরও বেশি ক্ষমতাধর, আরও বেশি তেজস্বী। আগোচরে থাকলেও তাকে অবহেলা করা ঠিক নয়, তাকে তাড়ানো যায় না।’
‘অবহেলা করছি না। ভয় পাচ্ছি। প্লিজ, ভয় দেখিও না আমাকে। সরে যাও তুমি।’ রাহুলের কথায় আকুতি ঝরে পড়ল।
ছায়াসঙ্গী সরল না, পালাল না। আকুলতাভরা কথায় গলল না। বরং মাটি ফুঁড়ে বেরোতে থাকা অজস্র শাখা-প্রশাখার মতো সম্পর্কের নানামুখী ডালপালা ছড়িয়ে রাহুলকে জড়িয়ে ফেলল। বিরক্তি নয়, অস্বস্তি নয়, নিভু নিভু ইচ্ছার তাড়না কমে গেলেও তাই নিভে গেল না রাহুল―মনের গভীর-তল দেখার সুযোগ পেয়ে ছায়ার মধ্যে জড়রূপে বিলীন হয়ে নিশ্চুপ বসে রইল।
আচমকা ছায়াসঙ্গী গভীর-তল থেকে নড়ে উঠে বলল, ‘আমার কাছ থেকে আলাদা হতে চাও? আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাও?’
‘চাই।’
‘আলাদা হলে ভুলের পরিমাণ কেবল বাড়বে। তোমার সম্পর্কে সম্পর্কে জটিলতা বাড়বে; মহত্ত্ব হারিয়ে যাবে, জৈবিক দানবের শৃঙ্খলে আটকা পড়ে যাবে তুমি। মৃতদেহের পচনের মতো কিংবা দেহে ছত্রাক গজানোর মতো পরজীবী অস্তিত্বের দাপটের ভারে আটকে যাবে জীবন। কেবল মৃত্যু, এমনকি মৃত্যুও আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না তোমাকে।’
‘সবাই কি নিজের ভেতরের এমন কঠোর ছায়াসঙ্গীকে দেখতে পায়?’
‘যারা পায় না, পাওয়ার চেষ্টা করে না, তারা ডুবতে থাকে ঘোলাজলে; জানে না যে জলের ভেতরও জল থাকে, জানে না যে সম্পর্কের ভেতর থেকেই বেড়ে উঠতে পারে আরেকটা সম্পর্ক।’
‘উহ্! আমি আর পারছি না। আর কিছু শুনিও না আমাকে। এক সম্পর্কের ভেতরে থেকেও তো আরেক সম্পর্কের জাল বিছিয়ে ফেলেছি। শুদ্ধতার চাষ করতে গিয়েও অশুদ্ধতার লেপনে নিশ্চয় ভরে তুলেছি তোমার ফাউন্ডেশন, ভিত। আমাকে রেহাই দাও।’
হো হো শব্দে হেসে উঠল ছায়াসঙ্গী। হাসতে হাসতে বলল, ‘হ্যাঁ। নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছ তুমি। এখন নিশ্চয় অশুদ্ধতার পথে যাওয়ার সুযোগ পাবে না। এখন নিশ্চয় শুদ্ধ পথটা চিনে নিতে পারবে। অসৎ পথে হাঁটতে গেলে তোমার ফাউন্ডেশনে প্রতিচ্ছাপ খাওয়া জীবনের টুকরো তোমাকে আটকে দেবে। আমি খুশি, এখন আর আমার গায়ে অশ্লীল বর্বরতার ছোঁয়া লাগবে না, প্রকৃতির রঙিন আর স্বচ্ছ-শুভ্র আলপনার আঁচড় খেতে খেতে আমার আমিকে অন্য রকমভাবে পাব, তোমাকে অভিনন্দন রাহুল!’
টেবিলে ফাইলের পর ফাইল জমে স্তূপ হয়ে গেছে। লালফিতার দৌরাত্ম্যের বিষয়ে নানা কথা প্রচলিত থাকলেও এখানকার ফাইলের বাঁধনগুলো সাদা ফিতায় মোড়ানো। রাহুল হঠাৎ দেখল উপরের ফাইলের ওপর কী যেন নড়াচড়া করছে।
কী এটা?
না-বুঝে বাঁ হাতে ফাইলটা টেনে নিয়ে ফিতা খুলে সেকশন অফিসারের নোটে চোখ রাখল। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিটা বর্ণমালা শব্দের বাঁধন থেকে ছুটে এসে এক ঝটকায় কামড় বসিয়ে দিতে লাগল রাহুলের চোখে। ফাইলটা দ্রুত বন্ধ করে দুহাতের তালুতে ও চেপে ধরল চোখজোড়া। আশ্চর্য! সব ব্যারিকেড ফুঁড়ে আঙুলের তালুতলে আটকানো চোখের দৃষ্টি ঝপঝপ করে আছড়ে পড়তে লাগল সংক্ষিপ্ত নোটের প্রতিটা বাক্যের ওপর। সাদা ফিতায় মোড়ানো ফাইলের ভেতর অজগরের মতো হেলেদুলে এগোতে দেখল প্রতিটা বাক্যকে। বুকে কামড় বসে গেল এবার। এ অজগরকে সামাল দিয়ে কীভাবে নিজে অগ্রবর্তী করবে এ ফাইল? গঠনমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কীভাবে ফাইলটা হাজির করাবে বসের টেবিলে?
নিজেদের প্রতিষ্ঠানটিকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার প্রয়োজন। সন্ত্রাসে ভরা এ সময়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী জোরদার করা জরুরি, সন্দেহ নেই। তাই বলে ত্রিশ লাখ টাকার বাজেট পেশ করতে হবে! সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে বড়জোর তিন লাখ টাকা খরচ হতে পারে। এ মুহূর্তে তিনের পাশে বসা বাড়তি শূন্যটাকে অজগরের বিশাল হাঁ বলে মনে হলো ওর। সব গিলে ফেলবে এ হাঁ? শূন্যের এত শক্তি! তিনের পাশে বসে অতিরিক্ত সাতাশ লাখ টাকার ঘণ্টাধ্বনি বাজাতে পারে কোনও শূন্য? শূন্যের শক্তি দেখে মুগ্ধ হলো না রাহুল; বরং তার চোখের পাতার ভাঁজ কপালের ভাঁজের সঙ্গে মিলেমিশে স্ফীত করে তুলল চোখের মণি। এর কেন্দ্রে জাগিয়ে তুলল এক কম্পমান ঢেউ। সে ঢেউ ছড়িয়ে যেতে লাগল আর ভোঁতা হয়ে যেতে লাগল ওর বোধের শান। মস্তিষ্কের ভাবনাতরঙ্গেও জেগে উঠল বিশৃঙ্খলা। চট করে মাথা জ্যাম হয়ে গেল। ব্যস্ত সড়কে যানজটের মতো মুহূর্তেই জট বেঁধে গেল ওর ব্রেনওয়েভের সুশৃঙ্খল গতিতেও।
অদৃশ্যে ঘটতে থাকা বিশৃঙ্খল ঝড়ের তাণ্ডব আকস্মিক থেমে গেল পাশে এসে দাঁড়ানো সেকশন অফিসারের কথা শুনে।
‘স্যার, ফাইলটা ছেড়ে দিলে হয় না?’
স্থির হতে কিছুটা সময় লাগল রাহুলের।
পাশে দাঁড়ানো সেকশন অফিসারের মুখভর্তি দাড়ি, নূরানি চেহারা আর মাথায় টুপি দেখে এক ফোঁটাও প্রশান্তির বাতাস বইল না প্রাণে, বরং অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রাহুল জবাব দিল, ‘ফাইল কি আটক করে রেখেছি আমি?’
পালটা প্রশ্ন শুনে থতোমতো খেয়ে শরীরটাকে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে নত হয়ে বিগলিত স্বরে দু’বার অ্যাঁ অ্যাঁ শব্দ করে সেকশন অফিসার বলল, ‘ওপরের নির্দেশ আছে, আজই ফাইলটা দেখতে চেয়েছেন ওপরওয়ালারা। তাড়াতাড়ি করতে বলেছেন।’
কথা বলার সময় তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল জর্দামাখা চিবানো পানের কয়েকটা টুকরো; টেবিলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাত দিয়ে সে মুছতে শুরু করল। আর মুখে বলতে লাগল, ‘সরি, স্যার। সরি, স্যার।’
সেকশন অফিসারের বলা ওপরের নির্দেশের ইঙ্গিত অদৃশ্য চড় বসিয়ে দিল রাহুলের গালে। ভেতরের কথা আর মুখ ফুটে বেরোনোর সুযোগ পেল না।
সেকশন অফিসার চলে যাওয়ার পরই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসকক্ষের একলা ঘরে অবিরাম সঙ্গে থাকা নিজের নিজেকে চোখ বুজে খোঁজার চেষ্টা করল রাহুল। আশ্চর্য! ভেতরে কোনো ছায়া নেই। ছায়াহীন অস্তিত্বের ছায়ায় নিজেকে শূন্য মনে হতে লাগল। স্বর্ণাকে ঘিরে মনের গভীরে সম্পর্কের যে জটিল জালে ও জড়িয়ে গেছে, জটিলতা যেভাবে ধাপে ধাপে বাড়ছে, মিথ্যার পর মিথ্যা সাজিয়ে যে জটিলতা মোকাবিলা করা যাচ্ছে না; ‘ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দে’র মতো উড়ে উড়ে এসে জমা হচ্ছে আনুষঙ্গিক যেসব প্রমাণচিহ্ন, সময়ের সিঁড়ি টপকে নিশ্চয় তা উপচে পড়বে জীবনকল্পনার বাইরে, এ মুহূর্তে ফাইলসংক্রান্ত বিভ্রান্তির চাপে পড়ে কিংবা সেকশন অফিসারের কথার ইঙ্গিত ধরে পৃথিবীর ভূভাগের প্লেট সরে যাওয়ার মতো নিজের ছায়াসঙ্গীও যেন সরে গেল। কাঁপন উঠল তার বুকে। ঠেক দিয়ে কি তবে আর চালানো যাবে না দেহকাঠামো?
নিজের মধ্য থেকে উগরে বেরিয়ে আসা প্রশ্নের শান ধারালো না ভোঁতা, বোঝার আগেই রাহুল দেখল আবার ফিরে আসছেন সেকশন অফিসার। হাত বাড়িয়ে একটা প্যাকেট রাখল টেবিলে।
‘স্যার, এটা আপনার পাওনা।’
সেকশন অফিসারের দিকে চোখ তুলে তাকাল রাহুল। ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে থেকে আচমকা নড়ে উঠে প্রশ্ন করল, ‘এত অনিয়ম? এত বড় লুটপাট? কোথায় তিন লাখ আর কোথায় ত্রিশ লাখ! এভাবেই কি চলছে সব?’
‘স্যার, মাফ করবেন, ধাপে ধাপে সবখানে…’
‘থামুন, আমাকে আর শেখাতে হবে না।’
‘শেখানোর কথা না স্যার, অডিট অবজেকশন থেকে শুরু করে টাকা বরাদ্দের সব ধাপের জন্য টাকা ধরে না রাখলে তো কাজ এগোবে না। প্রজেক্ট ব্যর্থ হবে। তার চে…’
‘শুনুন, প্যাকেটটা হাতে তুলে নিন, আর রুম থেকে যেতে পারেন এখন!’
সেকশন অফিসার ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বসের আদেশ মানতে কিছুটা সময় নিল সে। তারপর বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।
ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে উঠতে লাগল রাহুল। আর তখনই টের পেল নিজের আড়ালে থাকা অনন্য আরেক নিজেকে।
‘বাহ্! তোমার তুমি তো নতুন রং মেখে দিলে আমার অস্তিত্বে।’
‘রং মাখালাম কোথায়? মেজাজ দেখালাম। অভদ্র আচরণের ব্যবহার অভদ্রভাবে না-হলেও কড়া গলায় দিলাম।’
‘কড়া ভাষা মোটেও ব্যবহার করোনি, নিয়ন্ত্রিত ঢঙেই কথা বলেছ সেকশন অফিসারের সঙ্গে।’
‘এ নিয়ন্ত্রণে আমার কোনো ভালো গুণ কাজ করেনি, বরং ওপরওলার ভয় কাজ করেছে।’
‘তোমার কী মনে হয়? গভীর করে কি ভেবেছ―সেকশন অফিসার কি ওপরের ইঙ্গিতের বিষয়ে আসল কথা বলেছে? নাকি তোমার সরলতাকে পুঁজি হিসেবে খাটিয়ে তার আখের গোছাতে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে?’
‘এমন করে তো ভাবিনি!’
‘বাহ্! ভাবতে হবে না! যে-লোক প্যাকেট অফার করতে পারে তার ইঙ্গিত কি বিশ্বাস করা উচিত, ভয় পাওয়া উচিত? ইঙ্গিতের আড়ালে অন্য কোনও ঘটনা থাকতে পারে না?’
‘ভয় পাইনি, তবে নিজের ভেতর একটা পরিবর্তন টের পেয়েছি। গোপনে বদলে যাওয়া আমার আমি যে কে তা চিনতে পেরেছি বলা ঠিক হবে না। তবে স্বর্ণার সঙ্গে যে একটা লুকোছাপা খেলা চলছে, আড়ালে-আবডালে যা করে ফেলেছি, এ মুহূর্তে নিজের সেই অস্বচ্ছতাকে দেখে ফেলেছি, দেখার মধ্য দিয়েই বোধ হয় জেগে উঠেছি আপন জঞ্জাল সরিয়ে, কী বলো, হে ছায়াবন্ধু?’
‘জঞ্জাল কি আসলেই সরে গেছে, নাকি অন্যপথে আবর্জনার স্তূপ পচে-গলে দুর্গন্ধ বের করবে?’
‘তা তো জানি না, তবে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার ইচ্ছা হচ্ছে, আর যেন ভুল না-করি, প্রতিজ্ঞা করতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
‘ভালো লক্ষণ। ভালো ইচ্ছে ধরে রাখতে চেষ্টা করছ, বেশ, বেশ ভালো।’
আকস্মিক চুপ হয়ে গেল ছায়াসঙ্গী।
ইন্টারকমে সুপিরিয়র বসের কল আসার সঙ্গে সঙ্গে ছায়াসঙ্গী সরে গেল মনের তল থেকে। রিসিভারের বাটন টিপে রাহুল বলল, ‘জি স্যার।’
‘শোনেন, ত্রিশ লাখ টাকা বরাদ্দের একটা ফাইল আসবে। ভালো করে পড়ে ফরোয়ার্ড করবেন আপনার স্পষ্ট মতামতসহ। ওপর থেকে চাপ আসছে, চাপের কারণ বুঝতে পারছি না। চাপের আড়ালে গলদ থাকে, নিশ্চয় এ অভিজ্ঞতা আছে আপনার।’
বসের কথার পিঠে কথা বলা হলো না। লাইন কেটে দিয়েছেন তিনি। নতুন প্রশ্ন হানা দিল মনে, একটা ফাইল কেন দু’ধারা শানে চকচক করছে? ওপরে-নিচে কী ঘটছে? দু’ধারি তলোয়ার কি মোকাবিলা করা সম্ভব?
ভেতরের প্রশ্নের দাপটে আচমকা হুসহুস করে দ্বন্দ্ব ছুটে এল বাইরে। কেবল নিজের দেহকাঠামোতে নয়, মনের কাঠামোর খুঁটিতেও দু’দিকে দু’রকম ধার টের পেল; একধারে কাটছে সে স্বর্ণাকে, আরেক ধারে কাটছে ফেসবুকে সখ্য গড়ে ওঠা মিতালিকে। স্বর্ণার সঙ্গে কি ও বিশ্বাসঘাতকতা করছে না? গোপন জগৎ দখল করে কি নিচ্ছে না মিতালি? জীবন শুরুর আগেই স্বর্ণার জীবনে বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে না প্রতারণার জাল? প্রতারণা করে কি গড়া যায় সুন্দর সম্পর্ক? মন কি গাইবে তখন সততার সঙ্গীত? সুখী হওয়া যাবে?
আত্ম-অবলোকনের সুযোগ ঘটার কারণে নিজের দেহতলে দেখল এঁকেবেঁকে চলা দুটো পথ―এক পথের ইট-সুরকি হচ্ছে চুম্বককণা, টানছে। আরেক পথে বিছানো আছে আলোর কণা, আলোকিত করছে নিজেকে।
চুম্বকটানে বিভ্রান্ত হলো না, প্রলুব্ধ হলো রাহুল। ইচ্ছে করছে সে পথে এগোতে, লাগাম টেনে রাখতে পারছে না নিজের।
হঠাৎ দেখল ভাইব্রেশন মোডে রাখা সেলফোনটা কাঁপছে। মনিটরে ভেসে উঠেছে মিতালির নাম। চুম্বক টান খেল চোখ। একটানে খুলে গেল স্বর্ণার সঙ্গে মনের বাঁধন। আলগা হয়ে গেল স্বর্ণার সঙ্গে সেঁটে থাকা মন। ফোনসেট হাতে তুলে কল ব্যাক করল মিতু, মানে মিতালিকে।
‘হাই! কী করছ?’ প্রশ্ন করল মিতালি।
‘অফিসে কাজ করছি।’
‘কী ব্যাপার? তোমার গলার টোনে এত বিভ্রান্তি কেন? উচ্ছ্বাস নেই কেন, নক করেছি তোমাকে, খুশি হওনি?’
খুশি টের পেল না রাহুল। তবে খুশি খুশি ভাব নিয়ে বলল, ‘ইয়ে, খুশি হয়েছি।’
‘নাহ্! উচ্ছ্বাস নেই তোমার টোনে। কী পেলে উচ্ছ্বসিত হবে? যা চাইবে পেয়ে যাবে অথবা পাওয়ার প্রতিশ্রুতিও পেয়ে যেতে পারো এখন।’
শরীরের অজগরটা একটা মোচড় দিল। সেটা টের পেল রাহুল।
ঠিক এ সময় সেকশন অফিসার আবার ঢুকল রুমে। দেহে অজগরের মোচড়টা উপেক্ষা করে চট করে লাইন কেটে দিয়ে ফোন অফ করে দিল ও। মিতালির প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিতে কেঁপে কেঁপে উঠেছিল, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিল দানবটা। প্রায় বলেই বসেছিল কী দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে চাও? প্রশ্নটার উত্থান নিয়ন্ত্রণ করে সেকশন অফিসারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আবার কী চান?’
‘কিছু চাই না। প্যাকেটটা যদি আপনার হাতে গছাতে না পারি, তাহলে আমার মাথার খুলি উড়ে যেতে পারে।’
ভীতসন্ত্রস্ত সেকশন অফিসারের গলা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল রাহুল।
ভেঙে না পড়ে জোর গলায় বলল, ‘শুনুন, কৌশলে কাবু করবেন না আমাকে। প্রলোভন কিংবা ভয় দেখিয়ে আমাকে নরম করার চেষ্টা করবেন না। ভয় ঠেকাতে জানি আমি। প্যাকেটটি ফিরিয়ে নিন। বেরোন এখন এখান থেকে!’
প্যাকেটটা হাতে তুলে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেল সেকশন অফিসার।
মস্তিষ্কের নিউরনের বনাঞ্চলে ঘটে গেল আট রিখটার স্কেলের কম্পন। এ কম্পনে গাছপালা উপড়ে পড়ল না। পড়তে পড়তে আবার ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ আঁধারে ঢেকে যাওয়া চারপাশে আলো ফুটতে লাগল। রাহুল কল্পচোখে দেখল আলোর ঢেউয়ে ভেসে আসছে স্বর্ণা, সোনালি রং ছড়িয়ে সাফ করে দিচ্ছে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের যতসব আবর্জনা। আবার চোখ গেল টেবিলের ওপর। যেখানে প্যাকেটটা ছিল সেখানে দেখল কিলবিল করছে অসংখ্য জোঁক। জোঁকগুলো এগিয়ে আসছে ওর দিকে!
ভয় পেয়ে গেল রাহুল। চট করে উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। টিস্যু পেপার হাতে নিয়ে পরিষ্কার করে দেওয়ার চেষ্টা করল টেবিল, পারল না। হাজার হাজার জোঁক একসঙ্গে এগিয়ে আসছে ওর দিকে! ভয় পাওয়ায় চিৎকারের তাড়নাটা হুস করে বেরিয়ে এল। তবে চিৎকার দেওয়ার সুযোগ পেল না রাহুল। হঠাৎ শুনল গুলির আওয়াজ!
একি! পিস্তলের গুলির শব্দ হলো কেন অফিসে!
ছুটে ও অফিসকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আওয়াজ শুনে আরও অনেকে জড়ো হয়েছে লবিতে।
একজন উঁকি দিয়ে দেখল সেকশন অফিসারের কক্ষ। পাথরের মতো স্থির হয়ে তিনি বসে আছেন চেয়ারে। আর তার ঠিক মাথার পাশে পেছনের দেয়াল ফুটো হয়ে আছে। কাছ থেকে বুলেট ছোড়া হয়েছিল তাকে লক্ষ্য করে। মাথায় লাগেনি, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে দেয়ালে লেগেছে। লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেটের কারণে কেবলই সেকশন অফিসারের জীবন রক্ষা পায়নি, রক্ষা পেল রাহুলের ভেতরের রাহুলও।
সে বলে উঠল, ‘হার ঠেকাতে হবে। এভাবে হারলে চলবে না।’
সঙ্গে সঙ্গে রাহুল অনুভব করল উড়ে গেছে তার দেহের অবসাদ। উড়ে গেছে ক্লান্তি। নিজের কক্ষে ফিরে দেখল জোঁকগুলোও উধাও হয়ে গেছে টেবিল থেকে। মিতালিকে ঘিরে নিউরনের ঘন অঞ্চলে যে দূষিত চিন্তার জাল বিস্তার করছিল, প্রবৃত্তির দানব যেভাবে ওকে ভ্রষ্ট পথে টেনে নামাচ্ছিল, আঁধারে যেভাবে ডুবে যাচ্ছিল, স্বর্ণার স্বর্ণালি স্বপ্নকে যেভাবে গুঁড়িয়ে দিতে চলেছিল, সেই জাল ছিঁড়ে গেছে মুহূর্তেই। দেহ-মনে আলোর নতুন পরশ পেয়ে ফোনসেট হাতে নিয়ে কল করল স্বর্ণাকে। আর তখনই গহনতলের অন্ধকারের স্তর ঠেলে হঠাৎ কে যেন নড়ে উঠল, সংক্ষিপ্ত শব্দ তেড়ে এল ভেতর থেকে, ‘বাহ্! রাহুল, বাহ্!’
‘ওহ্! তুমি?’ ছায়াসঙ্গীকে প্রশ্ন করল রাহুল।
‘হ্যাঁ। আমি, তোমার তুমি। আমার আকাশে দিনদুপুরেও বসে গেছে নক্ষত্রের হাট। সেই হাটে আমি দেখছি আলো আর আলো, তোমারই আলো, স্বর্ণার আলো।’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন