উম্মে মুসলিমা
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওঠার ক’দিন পরেই নববর্ষ। মফস্বল থেকে আসা ভালো ছাত্রী দীবা জানতো না নববর্ষের আগের রাতে হলের দুষ্টু মেয়েরা একজোট হয়ে বিশেষ বিশেষ মেয়েদের নামের পাশে খেতাব জুড়ে দেয়ালে দেয়ালে লটকে দিত। যেমন নিভৃতচারী রওনক আপাকে রহস্যময়ী, শাদা ফ্যাটফেটে নীলা আপাকে ওগো বিদেশিনী, কুটনি টাইপের নিগার আপাকে লেডি ম্যাকবেথ, ফাইনাল ইয়ারের একটু বয়স্ক দেখতে সাথী আপাকে বেলা বয়ে যায় – এইরকম। টুলু আপার খেতাব দিয়েছিল শুভ্রবসনা রজনীগন্ধা। দীবা জানতো ওটার মানে। কারণ টুলু আপা দীবার দূর সম্পর্কের খালাতো বোন। ওর মায়ের মামাতো বোনের মেয়ে। বড় একটা যোগাযোগ ছিল না কিন্তু দীবা জানতো টুলু আপা বিধবা মেয়ে। দীবা ওর নিজের খালার কাছ থেকে যদ্দুর শুনেছে সে অনুযায়ী টুলু আপার সালাম নামের এক যুবকের সাথে প্রেম ছিল। সালাম যেমনি সুপুরুষ, টুলু আপা তেমনি সুন্দরী। সে আমলে যত যোগ্য যত সুন্দর ছেলেই হোক না কেন কোনও মেয়ের সাথে যদি তার ভালবাসা গড়ে ওঠে সে মেয়ের অভিভাবকরা কিছুতেই ওই ছেলের সাথে বিয়েতে রাজি হবে না। প্রেম জানতে পারলেই হয় মেয়েটির স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাবে, নয় অন্যত্র বিয়ের সম্মন্ধ দেখা চলতে থাকবে কিংবা দূর গ্রামে নানা-মামাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে। যেন অদেখায় প্রেম মরে ভূত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে জোড়া ধরে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে বা মেয়েকে নিয়ে পালালে ছেলেকে জেলের ভাতও খেতে হয়েছে। তো টুলু আপাকে গ্রামে মামার বাড়ি রেখে আসা হলো। তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের দামামা। ইন্টার পরীক্ষার্থী টুলু আপা মামার বাড়ি থেকেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে। টুলু আপার মেজমামী খারে দজ্জাল। তার চোখ এড়িয়ে কোনো বেচাল করার জো নেই। ওই সময় স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। বেশিরভাগ উঠতি বয়সী মেয়েদের গ্রামে রেখে আসছিল মা বাবা। দীবার খালাও টুলুর মামাবাড়ীর কাছে তার নানাবাড়িতে গিয়ে উঠেছিল।
নায়ক সালামরা তখন মুক্তিযুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সালাম এক পত্রবাহক মারফত টুলু আপার কাছে চিঠি পাঠালো। পড়বি পড় মেজমামীর হাতে। তিনি বাড়ির নারীদের সবাইকে সামনে বসিয়ে চিঠিটা পড়া শুরু করলেন। সম্মোধন ‘ওগো মোর পাপিয়া’। তারপর টুলু আপার অদর্শনে তার বিরহের দিন কীভাবে কাটছে তার লম্বা ফিরিস্তি। পত্রবাহক দাঁড়িয়েই ছিল। সে টুলু আপার কাছ থেকে জবাব নিয়ে যাবে। ছোটমামী চুপিচুপি মেজমামীকে বললেন-
‘মেজবুবু, ভালোমন্দ একটা জবাব টুলু লিখে দিক। ওরা মুক্তি। মেজ ভাইজান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। মিলিটারিদের সাথে উঠাবসা। গেরিলারা কখন হামলা করে বসে তার ঠিক নেই’।
মেজমামী খানিক দম ধরে থেকে বললো ‘তোর তো জবর বুদ্ধি ছোট। ঠিক বলেছিস। টুলু, কাগজ কলম এনে আমাদের সামনে বসে যা বলি তাই লিখে দাও’।
সম্মোধনে লিখতে হলো ‘শ্রদ্ধেয় সালাম ভাই’। তারপর মেজমামী বললেন, ‘লেখ যে আমরা ভালো আছি। আব্বা আম্মা আমাকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখানে থেকে লেখাপড়া করছি। আমার মামা মামীরা আমাকে খুব আদর করেন। ভাইজান, আপনি ভাল থাকবেন। ইতি টুলু’।
টুলু বললো ‘মামী, লিখে দিই আপনি শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন’।
মেজমামী হা হা করে উঠলেন, ‘কী দরকার বাপু এতো আহ্লাদের! ওতে আরো লাই পাবে। এবার ছোঁড়াটাকে বিদেয় করো’ – বলে মামী কোনও জরুরি কাজে রান্নাঘরে চলে গেলে টুলু আপা দ্রুত ‘ইতি টুলু’ লেখাটা কেটে ‘ইতি আপনার পাপিয়া’ লিখে পত্রবাহকের হাতে দিয়ে দিল।
দেশ ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠলে টুলু আপার বাবা মা ও ছোট ভাইবোনরা গ্রামে নানার বাড়ি চলে এলো। দীবারাও সবাই ওই একই গ্রামে মামার বাড়িতে উঠলো। টুলু আপা মেজমামীর দৌরাত্ম থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু মামাতো ভাইয়ের সহায়তায় একদিন সন্ধ্যায় দীবার নানাবড়ির বাগানে সালাম ভাইয়ের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করলো। টুলু আপার ছোটমামার কাজের ছেলে ওই পথ দিয়ে বাজার থেকে ফিরছিল। আর যায় কোথায়? বাড়ি ফিরে সে অতি উৎসাহে সবার সামনে ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলো। পরদিন খুব ভোরে টুলু আপাকে নিয়ে ওর মা বাবা নদী পার হয়ে টুলু আপার দাদার বাড়ি চলে গেল। সেখানে গিয়েও রক্ষা হলো না। সাতদিনের মাথায় সালাম গিয়ে হাজির। সবাই মুখ গোমড়া করে বসে থাকলো, কেবল টুলু আপার দাদার সম্মতিতে কাজি এসে বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে গেল। সালাম দেখতে ভালো, ভালো ফুটবল খেলে, ডিগ্রি পড়ে। পাত্র হিসেবে আগেকার মানুষ সবার আগে দেখতো চেহারা, পরে যোগ্যতা। সালামের একটাই কমতি তা হলো ও এতিম। মানে ওর মা ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। বাবা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। মামার বাড়ি মানুষ। ওখানে সে সারাজীবনই অনাহুত। অমন সোনার কান্তি ছেলের মুখ দেখে টুলুর মায়ের অপত্য স্নেহ উথলে উঠলো। কেবলমাত্র দুটো রাত সালাম ভাই টুলু আপাকে দিতে পেরেছিল। পাক হানাদাররা ওই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান পেয়েছিল। সালাম ভাই ভোর হতে না হতেই পালিয়ে গেল। ভারতে চলে গিয়েছিল এটুকুই সবাই জানতো। টুলু আপা কেবল একটা চিঠি পেয়েছিল। সালাম ভাই ভারতে ট্রেনিং শেষ করে গেরিলা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে আর রাতদিন বুকের মধ্যে দুটো রাতের স্মৃতির বই একবার শেষ করছে আবার শুরু করছে। স্বাধীনতার লাল সূর্য হাতে নিয়ে দেশে ফেরার স্বপ্ন দেখছে।
ওদিকে টুলু আপার বিরহী মেঘে ছাওয়া চোখ দুটোর দিকে বাবা মা তাকাতে পারে না। কেমন উদভ্রান্ত চোখে আকাশ দেখে। হঠাৎ বিয়ের লাল শাড়ি পরে চুল বাঁধতে বসে। এ যেন বিরহী রাধা-
‘সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ পানে
না চলে নয়ান তারা
বিরতি আহারে রাঙা বাস পরে
যেমত যোগিনি পারা।’
কোথাও বোমা পড়ার আওয়াজ হলে ছুটে গিয়ে বাগানে গাছের আড়ালে লুকায়। নিশ্চয়ই সালাম গেরিলা হামলায় অদূরের ব্রিজ উড়িয়ে দিল। একটু পরেই ছদ্মবেশ নিয়ে হাজির হবে। বাড়িতে বুড়ো ভিক্ষুক এলে টুলু আপা খাবার দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিক্ষুকের ছদ্মবেশ নিয়ে যদি সালাম এসে ফিরে যায়? একটা নির্দিষ্ট সময়ে ডাকপিয়ন ওদের বাড়ির গলি ধরে যায়। কোনওদিন যায়, কোনওদিন যায়ও না। টুলু আপা ওই সময় ঝুলবারান্দা্র থামের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। যদি ডাকপিয়ন কাউকে না দেখে ফিরে যায়? কিংবা নিচে দরজা গলিয়ে চিঠি ঢুকাতে গিয়ে বাইরেই রেখে চলে যায়? খামটা উড়তে উড়তে বিচ্ছু চাচাতো ভাইটার হাতে পড়ে? ও যদি জোরে জোরে পড়ে ফেলে – ‘প্রিয়তমা আমার, তোমার বিরহে আমার দিন কাটে না, রাত কাটে না। তোমার শরীরের সুবাস বিনে কোনও গোলাপ আমাকে আপ্লুত করে না। তোমার ঠোঁটের তৃষ্ণায় আমার ঠোঁট-গলা শুকিয়ে সাহারা। একবার তিতির পাখি হয়ে উড়ে উড়ে তোমাকে যদি দেখে আসতে পারতাম! তোমার থিরথির কাঁপা কবোষ্ণ জোড়া কপোতে মুখ গুঁজে থাকতে পারতাম। এ যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ হবে দেখো। আমাদের জয় হবে। কেবল তোমার কাছে যাবার জন্যই এ সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হতে পারে না প্রিয়তমা।’
এরকম কোনো চিঠি টুলু আপা পায়নি। একে একে তিনটা ১৬ই ডিসেম্বর চলে গেছে সালাম ফেরেনি। কে বা কারা সালামের শার্ট, ঘড়ি আর চশমা নিয়ে এসেছিল ৭১ এর নভেম্বরের শেষে। টুলু আপা তিন বছর সেই ফিরে পাওয়া স্মৃতি আঁকড়ে মৃতবৎ জীবন কাটাচ্ছিল। অমনধারা রজনীগন্ধার জন্য কত বিয়ের প্রস্তাব! কিন্তু টুলু আপার সাদা শাড়ির সিগনালে সবাই ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ভালো ছাত্রী টুলুকে তার বাবা অগত্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার কথা বললে টুলু আপা কোনো দ্বিধা ছাড়াই রাজি হয়ে যায়।
দীবা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলো তখন টুলু আপা ফাইনাল ইয়ারে। টুলু দীবাকে ছোটবেলায় দেখেছিল কিন্তু চেহারা মনে ছিল না। পরিচয় দিতেই জড়িয়ে ধরলো। দীবার মনে হলো ও যেন টুলু আপার সাদা শাড়িতে কেমন রজনীগন্ধার গন্ধ পেল। হতে পারে ওটা টুলু আপার নিজের গায়ের গন্ধ। পদ্মগন্ধা মেয়ে।
টুলু আপা দীবার আত্মীয় শুনে দীবার রুমমেট সিনিয়র তানি আপু বলছিল-
‘টুলু আপাকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের মমিন স্যার খুব পছন্দ করে। টুলু আপার জন্য একেবারে পাগল। তার জীবনের কাহিনি সব জানে।’
‘টুলু আপা তার স্বামীকে ভুলতে না পেরে এখনও সাদা শাড়ি পরে বেড়ায়। সে কি আর বিয়ের কথা ভাবে?’
‘আমার কেন জানি মনে হয় আমাদের ডিপার্টমেন্টে এমফিল করছে মিলন ভাই, ওকে টুলু আপার একটু আধটু পছন্দ হলেও হতে পারে। আমি দু’দিন দেখেছি লাইব্রেরির সামনে বসে ওরা কথা বলছে।’
‘হলেই তো ভালো। একটা স্বপ্নের মত বিয়ে আর মৃত স্বামীর স্মৃতি আগলে কতদিন চলা যায়? ওসব শুভ্রবসনা রজনীগন্ধা-টন্ধা বলে ওর বৈধব্যকে আরও গ্লোরিফাই করলে ও নিজেও তো সে মোহ থেকে বেরোতে পারবে না’।
‘হুম। তুই তো ভালো বিশ্লেষক মনে হচ্ছে। তোকে দেখলে বেশ মারদাঙ্গা মনে হয়।’
‘আমার কাছে বুদ্ধি টুদ্ধি নিও আপু। তবে তোমার পছন্দও মন্দ না। দেখলাম সেদিন।’
‘আমার বাপ জানতে পারলে কেটে ফেলবে। বুড়োগুলো কবে যে একটু আধুনিক হবে! আরে বাবা, রেডিমেট জামাই দেব, যৌতুক নেই ফৌতুক নেই, বিয়ের খরচাপাতি মিনিমাম। শুনে লুঙ্গি তুলে ধেই ধেই করে নাচবে, তা না প্রেম করেছ তো একদম জবাই। তুই ভাই এ ভুল করিস না। বাবার পছন্দের সুপাত্রে ঝুলে পড়িস’।
টুলু আপারা ফাইনাল দিয়ে বাড়ি চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল-
‘যোগাযোগ রাখিস। চিঠি দিস। ঢাকাতে আমাদের আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। কখনো কোনও দরকার পড়লে তোর এখানে এসে উঠবো’।
‘নিশ্চয় উঠবে টুলু আপা। তুমি কি মিলন ভাইকে নিয়ে কিছু ভাবছো?’
‘ধ্যাত, বেশি পাকামো করিস না’- বলেই টুলু আপার সাদা মুখ একটু আরক্তিম হয়ে উঠেছিল, দীবার চোখ এড়ায়নি।
দীবা ভালো ছাত্রী। পড়াশোনার চাপে প্রেম-ট্রেম সেভাবে হয়নি। একজনকে ভালো লেগেছিল, খানিক এগিয়েওছিল। সে বেটা এক জুনিয়ারের সাথে লটকে গিয়ে পাল্টি মেরেছিল। ওর কপালে বোধহয় বাপের পছন্দের পাত্রের গলায় ঝুলে পড়ার লিখন, যেমনটা ওর প্রথম বর্ষের রুমমেট তানি আপু বলেছিল। সেই তানি আপু প্রেমিককে বিয়ে করে চাকরি বাকরি সন্তান নিয়ে জমিয়ে সংসার করছে। সবচেয়ে ভালো খবর টুলু আপা সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব বিরহ বেদনা বৈধব্য সাদা শাড়ি আলগোছে সরিয়ে রেখে পরিবারের সম্মতিতে মিলন ভাইকে বিয়ে করে কুষ্টিয়ায় সংসার শুরু করেছে। ওরা নাকি ভারি সুখি!
হলের হাউজ টিউটরের চাকরি হলো দীবার। সাথে ডিপার্টমেন্টে এমফিলের সুযোগ। হলের ভেতরে একটা ছোট বাসায় ও শিফট করলো। বাড়ি থেকে পাত্র দেখা হচ্ছিল জোরেসোরে। গরমের ছুটিতে হল প্রায় খালি। দীবার খানিক ফুরসৎ। গেটের দারোয়ান দাদু খবর দিল মেহমান আসার। গেস্টরুমে এসে বসেছেন। কে হতে পারে? বাবার তো এসময় আসার কথা না। অবশ্য কেউ কোনও চিঠিপত্রে জানিয়ে বা ফোন করে আসার প্রয়োজন বোধ করে না। ফোন করা তো আর এক ঝক্কি। প্রোভাস্টের অফিস রুমে একটাই টেলিফোন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঢাকার বাইরে ট্রাঙ্ককল করে ফোন করার কোনও সুযোগ নেই, ফোন এলেও সেটা অফিস টাইমের মধ্যে হলে রক্ষে। কোনও পাত্র-টাত্র কনে দেখতে হাজির হলো নাকি? দীবা বেশ গুছিয়ে মাড়ভাঙা তাঁতের ডুরে শাড়ি পরে কপালে ছোট্ট একটা টিপ দিয়ে গেস্টরুমে ঢুকলো। একমুখ দাড়ি গোঁফ নিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সত্যজিত রায়ের মত লম্বা একজন বসে আছে। সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা তেমন ধোপদুরস্ত নয়। দারোয়ান দাদুর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে দাদু দীবাকে বললো-
‘হ্যাঁ, উনিই আপনাকে ডাকতে বললেন’।
‘স্লামালেকুম’-দীবা দ্বিধান্বিত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললো। এমন সুপুরুষ ও কমই দেখেছে।
‘খুব দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। আমাকে আপনি চিনবেনও না। আমি একজনের খোঁজ নেবার জন্য এসেছি। আমার নাম সালাম’।
সালাম? সালাম যেন কে? কে যেন? খুব পরিচিত নামটা! দীবা ঝরা পাতার ঢিবি সরিয়ে সরিয়ে তার নিচ থেকে একটা তাজা ফুল তোলার চেষ্টা করতে লাগলো। ফুলটা তখনও পায়নি। ভদ্রলোক ভরাট গলায় বললেন- ‘আফরোজী জাহান?’
এ মা! এ নামে তো ও কাউকে চেনে না। এক আফরোজা আপা আছেন হলের মেট্রন। বেশ বয়স তার। তিনি কি?
‘ডাক নাম টুলু?’
‘টুলু আপা?’ দীবাকে কে যেন আচমকা ধাক্কা দিল। সে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলো – ‘আপনি সালাম ভাই? আপনি বেঁচে আছেন? কোথায় ছিলেন? টুলু আপা কতদিন আপনার জন্য একা ছিল। কী গভীর বেদনা নিয়ে ছিল! সে প্রায় দীর্ঘ এক দশক সাদা শাড়িতে বৈধব্য লালন করে গেছে’।
‘আমি সব শুনেছি। আমার গ্রামে আমার জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই। তাই বন্ধুর সহযোগিতায় ঢাকা চলে এসেছি। ওর কাছেই সব জেনেছি। আপনি তাকে কাছ থেকে দেখেছেন। আপনার মুখ থেকে তার কথা শোনার জন্য এসেছি।’
‘কিন্তু বেঁচে থেকেও আপনি তখন ফেরেননি কেন?’
‘আপনার যদি সময় থাকে তাহলে বাইরে কোথাও বসে সবকিছু বলতে পারি। আজ না হোক, যেদিন সময় দেবেন’ – বলে সালাম ভাই উঠে দাঁড়ালেন। দেয়ালে দাঁড় করানো তার ক্রাচটা টেনে নিলেন। তার বামপাহীন পাজামার বাম অংশ ফ্যানের বাতাসে পতাকার মত পতপত করতে লাগলো। ডান কাঁধে ব্যাগ তুলে তিনি যাবার অনুমতি চাইলেন।
সে এক লম্বা ইতিহাস। তার প্রিয়তমাকে দেখার তাড়নায় শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে সে পাগলের মত সীমান্ত অতিক্রম করতে চেয়েছিল। একাত্তরের নভেম্বরে ভারতের সীমান্ত পেরোতে গেলে বাংলাদেশ প্রান্ত থেকে গুলি এসে বিদ্ধ হয় সালামের উরুতে। ওই অবস্থায় সাথিরা তাকে টেনে এনে এক ঘুপচি বাড়ির মধ্যে ফেলে রেখে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যায়। ওটা ছিল এক বারবনিতার ঘর। বাংলাদেশ থেকে পরিবারের সাথে পালিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এক তরুণী তাকে আশ্রয় আর সেবা দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছিল। পুরোটাই সোফিয়া লরেন অভিনীত ‘সানফ্লাওয়ার’ সিনেমাটার মত। সালামের সেরে উঠতেই দু’বছর লেগে যায়। মেয়েটি তাকে একটা মুদির দোকান করে দেয়। দুজন মিলে সেটা চালাতো। গ্রামের মাঠে কিশোর ছেলেদের ফুটবল খেলার তালিম দিত। ওইসব কিশোরদের কাছে সালাম যেন দেবতা হয়ে উঠেছিল। মেয়েটি তার পেশাও ছেড়ে দিয়ে সালামের জন্য নতুনভাবে জীবন শুরু করে। ওই মেয়েটি সেদিন না থাকলে কেবল রক্তক্ষরণেই সালাম মারা যেত। অত অকৃতজ্ঞ সালাম হতে পারেনি বলে সে আর দেশে ফেরেনি। গুলিবিদ্ধ হবার দিন সহযোদ্ধাদের কেউ তার শার্ট আর চশমা-ঘড়ি দেশে টুলু আপাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। তারা নিশ্চিত ছিল সালাম রক্তক্ষরণেই শেষ হয়ে যাবে।
তাহলে এতদিন পর ফেরার কি দরকার ছিল? ফিরে আবার টুলু আপার খোঁজ নিতেই বা হবে কেন?
লতা মানে ওই উদ্ধারকারী মেয়েটিকে একরাতে পুলিশের লোকজন এসে ধরে নিয়ে গেল। সালাম কিশোর ফুটবল টিমের সাথে সেদিন শহরে একটি ম্যাচের জন্য গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে তাদের ডেরা তছনছ। লতা কোথাও নেই। পাশের দোকানদার তাকে দ্রুত কেটে পড়তে বললো। তারা পেলে ওর লাশ ফেলে দেবে বলে গিয়েছে।
প্রতি সপ্তাহে সালাম দীবার সাথে দেখা করতে আসতে লাগলো। প্রথম প্রথম কয়েকদিন কেবল টুলু আপার কথা শোনা। কোন ডিপার্টমেন্টে টুলু পড়তো, কোন করিডোর দিয়ে হেঁটে যেত, কোথায় দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খেত, চুল ওর আগের মতই ঘন লম্বা ছিল কিনা – এসব নানা খোঁজখবর। লতাকে হারানোর বেদনাও বারবার উঠে আসতো তার কথায়। ওর সেই বন্ধু একটা ফুটবল ক্লাবের সাথে ওকে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সে সরকারি সুবিধাদিও পাবার চেষ্টা করছে।
কিছুদিন পর সালামের যখন সব জিজ্ঞাসা ফুরিয়ে গেল তখনও সপ্তাহে ওরা একদিন দেখা করতে লাগলো। কেন করতে লাগলো ওরা জানে না। কিন্তু দেখা না হলে অস্থির লাগতো। এর নাম কী? সালাম মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি। একে সে পঙ্গু, তার ওপরে এত ঘটনার ঘনঘটা, বয়স ও শিক্ষার পার্থক্য। দীবাকে এড়িয়ে যাওয়াই সমীচীন মনে করে একদিন বলেই ফেলে –
‘দীবা, আমাদের আর দেখা না হওয়াই ভালো। একটা সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তোমার প্রতি আমার শুভকামনা থাকবে। তুমি খুব ভালো মেয়ে।’
‘ভালমন্দ বুঝার বয়স ও শিক্ষা দুটোই আমার হয়েছে। আমি অনেক ভেবেছি। আমি নিজের কাছে হারতে রাজি নই। আপনার কোনো আপত্তি না থাকলে আমরা দ্রুতই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’
সালামের নিঃসন্দেহে ভালো লাগে দীবাকে। ভালোবেসেও ফেলেছে সে। কিন্তু তাই বলে বিয়ে? কী আছে ওর? একটা পঙ্গু শরীর, দগদগে স্মৃতি আর বেঁচে থাকার মত সামান্য উপার্জন।
‘তোমার সাথে দেখা না হলেই ভালো ছিল দীবা। আমি কি তোমার সামান্যতমও যোগ্য? তোমার পরিবার তোমাকে পুরোপুরি বয়কট করবে। আর টুলু জানতে পারলে কী হবে ভেবে দেখেছ?’
‘আমি কি ভাবিনি এসব? যে যার মত ভালো থাকুক। আমার আর কোনো উপায় নেই’।
দীবা ও সালামের কয়েকজন বন্ধু মিলে কাজি অফিসে গিয়ে ওরা বিয়ে সেরে ফেললো। দীবার দু’রুমের ছোট্ট বাসায় সালাম কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দীবার হাত ধরে প্রবেশ করলো। দীবার বাড়িতে, হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, সহকর্মীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হলো বা হবে তা নিয়ে দুঃসাহসী দীবার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। সে সালামের কাটা হাঁটুর ওপর মাথা দিয়ে জীবন কাটানোর স্বপ্নে বিভোর। সে জানে এ সংবাদ তার বাবা মা আত্মীয় স্বজনের কাছে পৌঁছালে কেউ তাকে ক্ষমা করবে না।
ওদের উত্তাল যৌথজীবনের মাস দেড়েক পার হবার পর একদিন ছুটির দুপুরে কলিং বেলের শব্দে সালামের বাহুমুক্ত হয়ে দীবা দরজা খুলতে যায়। হঠাৎ গা গুলিয়ে ওর ঠেলে বমি আসার উপক্রম। দরজা খুলে চৌকাঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে যাদের সামনে দেখলো তারা আর কেউ নয়, হাস্যোজ্জ্বল টুলু আপা আর মিলন ভাই।
‘ওখানকার ডাক্তাররা বললো ঢাকার ভালো গাইনোকোলোজিস্ট দেখাতে। বয়স তো কম হলো না। মিলনের একটা বাচ্চার খুব শখ। তোর এখানে থেকেই দেখিয়ে টেখিয়ে যাই’।
টুলু আপা ঘরে ঢোকার আগেই দীবা হড়হড় করে বমি করে মেঝে ভাসিয়ে দিল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন