দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
আরে অরুণদা না? হ্যাঁ, অরুণদাই তো! সেই হন্তদন্ত হাঁটার ধরন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত টানটান সোজা রেখে হাঁটা চলা। থেকে থেকে ঘাড় তুলে আকাশের দিকে তাকানো।
সময় বয়ে গেছে, বয়স বেড়েছে, জীবন পাল্টেছে। চেহারাও আগের মতো নেই। তবু মানুষ বিশেষে কিছু বিশেষত্ব স্মৃতিতে গেঁথে থাকে। অরুণদা আমার ছোটবেলার গৃহশিক্ষক ছিল। ফেলে আসা গ্রামতুতো দাদা। গ্র্যাজুয়েট। লাইব্রেরি সায়েন্সে ডিপ্লোমা। অরুণদা গ্রামের সাধারণ পাঠাগারে অস্থায়ীভাবে সহকারী লাইব্রেরীয়ান পদে চাকরি করছিল।
লাইব্রেরিতে অরুণদা শুধু চাকরি করত না, সে যেন বইয়ের মধ্যে তলিয়ে যেত। চোখের দৃষ্টিতে বইয়ের ভেতর হারিয়ে যাওয়া মানুষটার প্রস্থান-চিহ্ন দেখতে পাওয়া যেত। লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখতাম অরুণদা চেয়ারে বসে বই পড়ছে, বারবার ডাক দিয়ে সাড়া পাওয়া যেত না। যখন সাড়া দিত ‘হ্যাঁ’ বলে চমকে উঠে চারপাশে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখত, যেন অন্য কোনও জগতে এসে পড়েছে। অরুণদা আমার সাহিত্যপাঠের একটা অবিস্মরণীয় অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছিল ওই সময় থেকেই। এখনও বই নিয়ে না শুলে আমার রাতে ঘুম আসে না। রাত্রিবেলা টেবিল ল্যাম্পের আলোতে বইয়ের পাতার মধ্যে থেকে অচেনা একরকম গন্ধ ভেসে আসে কোন সে সুদূর অতীত থেকে, আমি গন্ধটার পরিচয় খুঁজতে খুঁজতে ঘুমের মধ্যে হারিয়ে যাই।
এই মুহূর্তে ছোটবেলার প্রাইভেট টিউটর অরুণদা আমার দিকেই আসছিল। স্টেশনে মোটা শিমূল গাছটার নীচ থেকে একের পর বসার বেঞ্চ পার হয়ে যখন একেবারে সামনে এসে হাজির হল তখন আমার মুখ দিয়ে উদ্বেগের জিজ্ঞাসা বেরিয়ে এল, “কী হয়েছে অরুণদা?”
“তোর কাছে কিছু টাকা হবে? এই পাঁচশো মতো? বর্ধমান যাচ্ছিলাম, এমারজেন্সি। একজন নিকটাত্মীয় মারা গেছে। হঠাৎ স্টেশনে এসে দেখছি মানি-ব্যাগটা চুরি হয়ে গেছে। কোথায় যে পকেটমারি হল….”, বলে অরুণদা ঘাড় তুলে আকাশের দিকে তাকাল। খুবই অসহায় সেই দৃষ্টি।
আমি অরুণদার হাতে তৎক্ষণাৎ পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।
অরুণদা টাকা পেয়ে স্বস্তি পেল যেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে পিঠ চাপড়ে আশীর্বাদ করল। বলল, “তোর ঠিকানা দে? টাকাটা মানিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিতে হবে তো।”
বললাম, “ছাড়ো তো। ওসব নিয়ে পরে ভাববে। আমাদের বাড়ি এই পিছনের রাস্তা দিয়ে সোজা হাঁটা দিলে পাঁচ মিনিট। একদিন এসো গল্প হবে।”
“আচ্ছা।” অরুণদা সংক্ষিপ্ত জবাব দিল।
এরপর কোনও কুশল বিনিময়ের অবকাশ না দিয়ে হনহন করে প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে এগিয়ে গেল, ঠিক যেমন দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসেছিল সেই ভঙ্গীতেই। আমি ওর মনের অবস্থা বিচার করে এই নিয়ে তেমন আশ্চর্য হলাম না। হঠাৎ করে পকেটমারি হয়ে বিপদে পড়ে যাওয়া মানুষের পক্ষে পুরোনো সম্পর্ক ঘেঁটে আলাপচারিতায় মেতে ওঠা সহজসাধ্য নয়।
তবু এতকাল পরে দেখা হল। কোথাও একটা প্রত্যাশা ছিল কিছু বাক্যালাপের। গ্রামের চেনা মানুষদের সংবাদ শোনার। প্রত্যাশার অবশেষটুকু আটকে রইল চিন্তায়। অরুণদা কেমন আছে? কী করছে? লাইব্রেরীর চাকরীটা পাকা হয়েছে? এখন নিশ্চয়ই বউ বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত মানুষ। বউয়ের চাপে বইয়ের সঙ্গে সেই প্রেমে হয়তো ছেদ পড়েছে। নাকি অরুণদা অরুণদার মতোই আছে? যেমন কিছু মানুষ থেকে যায় পুরনো সময়ের সঙ্গে একটা যোগসূত্রের মতো। বর্তমান সময়ে তাদের কোনও উপস্থিতি থাকে না। তাদের গল্প মানে না-দেখা এক সময়ের কথা।
অরুণদার বাবা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ছিল। দেশ-গ্রামে ভালই পশার ছিল তাঁর। আর অরুণদার ছিল ফুলগাছের সখ। শীতের সময় বাড়ির ছাদের টবে গাঁদা, ডালিয়া, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমূখী, স্যালভিয়া, ক্যালেন্ডুলা, পিটুনিয়া। গরমে অরুণদার বাড়ির পিছনের বাগানে কনকচূড়া, করঞ্জা, কামিনী, নাগকেশর, জুঁই, পারুল, স্বর্ণচাঁপা। লাইব্রেরীতেও একটুকরো ফাঁকা জায়গা খুঁজে ফুলগাছ বসিয়েছিল। শহরের কোন নার্সারি থেকে এনে একটা হাসনুহানা গাছ। একবার স্বাধীনতা দিবস ও আরেকবার প্রজাতন্ত্র দিবসে লাইব্রেরীতে পতাকা উত্তোলনের সময় বাচ্চারা মাড়িয়ে দিয়েছিল হাসনুহানা গাছটাকে। অরুণদা অনেক যত্ন করে গাছটাকে আবার নিজের কাণ্ডের জোরে উঠে দাঁড় করিয়েছিল।
আপ লাইনের ট্রেন প্লাটফর্ম ছাড়ল। অরুণদাও নিশ্চয়ই ট্রেনে, বর্ধমান যাবার আছে যখন।
ট্রেন চলে গেলেও রেশ রয়ে গেল। ধুলোর ঝাপটে। ধুলো উড়িয়ে জোরে ফুঁ দেবার মতো হাওয়া বইছিল থমকে থমকে। স্টেশনের পাশে শিমূল গাছে লাল ফুল ধরেছে। এমন দৃশ্যের একটা আকর্ষণ আছে হঠাৎ মনকে বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার।
মনে হল গ্রামে একবার ঘুরে এলে কেমন হয়। যদিও কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বাড়ি জমি সবই বিক্রি হয়ে গিয়েছে শহরে উঠে আসার পরপর। তবু বেড়িয়ে তো আসাই যায়, নিছক বাইরের লোক হিসেবেই।
খুব বেশি তো নয়, বড়জোর চব্বিশ পঁচিশ কিলোমিটার রাস্তা হবে। রবিবার রোদ একটু পড়তেই বাইক হাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গ্রামে অনেকদিন যাওয়া হয় না। শিকড় ছেড়ে চলে গেলে সেই জায়গা সঙ্গে অন্য যোগাযোগের সুতোগুলো আস্তে আস্তে ছিঁড়ে যায়। সেই বিচ্ছিন্নতার বদলে রয়ে যায় কিছু স্মৃতি আর ঠাঁইনাড়া জীবনের রাশিরাশি অজুহাত। গ্রামে ঢোকার পর চারপাশের পরিবর্তনগুলোর মধ্যে একটা দুটো চমক ছিল। ঢালাই রাস্তা। স্কুলের নতুন ভবন। মাছের ভেড়ি – বোস পুকুরে, ঘোষ পুকুরে।
নিজেদের বিক্রি হয়ে যাওয়া বাড়িটা দূর থেকে দেখে পাশ কাটালাম। লাইব্রেরীটা ছিল গলির শেষে মাঠের কাছে, জমিদারদের দান করা জমিতে। লাইব্রেরির গলির কাছে বড় রাস্তার ওপর পুরনো পাড়াটা জমজমাট হয়েছে। দোকান বেড়েছে। নতুন চপ, শিঙাড়া, চায়ের দোকান হয়েছে। চা খেলাম। একসময়ের চেনা লোকেদের উত্তরপুরুষদের চিনতে কষ্ট হয়। এদের এতটুকু বাচ্চা অবস্থায় দেখে গ্রাম ছেড়েছিলাম। তারা আজ সব পরিণত যুবক যুবতী। বাইক ঠেলে লাইব্রেরীর গলিতে ঢুকতেই তাদের কেউ কেউ আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল।
লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়াতেই একটা সব-হারানো বিষণ্ণতার ঝটকা সোজা উড়ে এসে ধাক্কা দিল বুকে। হায়! লাইব্রেরিটার এই হাল হয়েছে! রোদে জলে বাইরের দেওয়ালের রঙ ফিকে হয়ে উঠে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়েছে। ছাদের একপাশে ফাটলে একটা বটগাছ শিকড় মেলছে। কতদিন লোহার গেটের ভেতরে মানুষের আনাগোনা বন্ধ কে জানে। গেটের ভেতরের এক টুকরো জমিটা আগাছায় ভরে গেছে। সেখানে দুটো সুপুরি গাছ শুধু মাথা তুলে ছাদ ছুঁয়েছে। তাদের গা জড়িয়ে ঘন হয়েছে বুনো লতাপাতা। এলোমেলো হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। বিকেল সাড়ে পাঁচটা।
একসময় বিকেলের দিকে কত জমজমাট থাকত। বইয়ের ইস্যু সেকশন। রিডিং রুম। তখন দামী বই ইস্যু করা হত না। রিডিং রুমে বসে নোটস নেওয়া যেত।
হরি হালদার আসত শিবকালী ভট্টাচার্যের ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ পড়তে। কবিরাজির সখ ছিল তাঁর। বঙ্কা মাষ্টার ইতিহাস পড়তেন। নিহাররঞ্জন রায়। রমেশ চন্দ্র মজুমদার। ‘বৃহৎবঙ্গ’ বইটা খুলে বসে থাকতেন সারাক্ষণ। সমর সুরের নকশাল আন্দোলন নিয়ে রোমান্টিকতা ছিল। সত্তর দশক নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করত ক্লাবের বিতর্কের আসরে চমকপ্রদ কিছু খবর ভাসিয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষায়।
রমা ঠাকুরমা এক এক দিনে এক একটা উপন্যাস পড়ে শেষ করে ফেলত। তাই ঠাকুমার হয়ে নাতি চঞ্চল রোজ নতুন নতুন বই তুলে নিয়ে যেত। বারোয়ারির দুর্গাপুজোর পুরোহিত আন্নাকালী মুখুজ্জে সাধু ভাষায় কথা বলতেন। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য বাংলা অনুবাদে পড়তে খুব পছন্দ করতেন। একে একে মনে পড়তে লাগল সবার স্মৃতি। আমরা স্কুল ফেরত ছোটরা ম্যাগাজিন নিয়ে কাড়াকাড়ি করতাম। অরুণদা গুপ্তধনের সিন্দুক থেকে এক একটা মোহর বার করে দেবার মতো আমাদের বাবাদের কার্ডে বই ইস্যু করত, চাঁদের পাহাড়, যখের ধন, ভোম্বল সর্দার, হলদে পাখির পালক……।
পুরনো মানুষগুলো বেঁচে নেই কেউ? নতুন প্রজন্মের কেউই আসেনি তাঁদের হাত ধরে? আর আমার কিশোর বেলার গ্রামের বন্ধুরা? সবাই কী শহরে উঠে চলে গেছে?
মনখারাপের হলুদ রঙ পড়ন্ত রোদে মিশে ছড়িয়ে যাচ্ছিল চারপাশে।
আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। মনখারাপের গলি থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম। চায়ের দোকানের ছেলেটার নাম সঞ্জয়। তাকেই সবার আগে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “লাইব্রেরি আর খোলা হয় না?”
“না। এখানে দোকান দিয়েছি তিন বছর হয়ে গেল। আমি খুলতে দেখিনি।”
আমি বললাম, “সে কী! এখানে নিমাই মাকাল সরকারি লাইব্রেরিয়ান ছিল।
‘নিমাইবাবু….’, ভাবতে একটু সময় নিল ছেলেটা, “নিমাইবাবু মনে হয় স্ট্রোক হয়ে মারা গেছে। তাঁর বদলে আর কাউকে তো আসতে দেখনি।”
“আর অরুণদা?”
সঞ্জয় নামে ছেলেটা দোকানে আর পাঁচজনের দিকে চোখ বুলিয়ে আমার অজ্ঞতার ওপর মুচকে হাসল।
“তার যে মাথার ব্যামো!”
সঞ্জয়ের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে অন্য একজন যুবক ছেলে বলল, “খুব কঠিন টাইপের নাম রোগটার। আমাদের কলেজের সাইকোলজির স্যার বলেছিল, ভুলে গেছি। এই রোগীরা নিজে খুব বিপদে পড়েছে এমন অভিনয় করে লোকের থেকে টাকা ধার করে আর শোধ দেয় না।”
সঞ্জয় আলোচনা মুখোরচক করতে আরও যোগ করল, “শহরের বাসস্টপে, স্টেশনে, বড় মার্কেটের সামনে, সিনেমা তলায় মাসে দুবার করে ঘুরতে যাবেই। গ্রামের পুরনো চেনা লোক, অনেকদিন আগে চলে গেছে, এমন দেখতে পেলেই হল। বলবে, আত্মীয় ভীষণ অসুস্থ কিংবা মারা গেছে। এক্ষুনি টাকা দরকার কিন্তু পার্স হারিয়ে ফেলেছে বা পকেটমার হয়ে গেছে। বলে টাকা ধার নেবে, আবার ফিরিয়ে দেওয়ার ঠিকানাটাও টুকে নেবে। তারপর…।”
আলোচনা করতে করতে উপস্থিত সবাই হাসতে লাগল। সেই হাসিতে খোরাক জুগিয়ে অন্য একজন বলল, “ওই জন্য বাস স্ট্যান্ডে ওষুধের দোকানের হিরেনকাকা গ্রাম থেকে অন্যত্র চলে গেছে এমন কোনও পুরনো লোক গ্রামের দিকে এলেই বলে, ‘অরুণকে খবর পাঠা। মরা আত্মীয়ের ডেথ সার্টিফিকেট দেখতে লোক এসেছে।’ একবার কথাটা কানে গেলেই হল…। অরুণ বিশ্বাস। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দে ছুট, দে ছুট!”
চায়ের দোকানে উপস্থিত সবাই হাসছিল। শুধু আমি ভেতরে ভেতরে কোথাও ভাঙ্গনের শব্দ পাচ্ছিলাম। খুব ক্যাজুয়ালি চলে এসেছিলাম গ্রামে। ছোটবেলার কিছু ফ্রেমে-বাঁধানো স্মৃতি জমা ছিল, সেটুকুই সঞ্চয় করে। অতীতের কিছু অদলবদল দেখে মিহি বিষাদ, সামান্য নস্টালজিয়া। এই নিয়েই একটা বিকেল কাটবে এই আশা ছিল। সেই ছোট ছোট চড়ুই, টুনটুনি অভিজ্ঞতার প্রত্যাশা ছিঁড়ে চারপাশে যেন একটানা কাকের কর্কশ চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম।
সহ্য করতে না পেরে চায়ের দোকান থেকে উঠে চলে গেলাম। বলা যায় পালালাম। কাছাকাছি খুড়তুতো পিসির বাড়ি ছিল। ছোটবেলায় পিসির বাগানে কত দুপুর কেটেছে পেয়ারা আর জামরুল গাছের ডালে। অনেককাল পর পিসি আমায় দেখে আপ্লুত হয়ে পড়ল। সে কিছুতেই ছাড়বে না।
‘একটা রাত তোকে থেকে যেতেই হবে। বউ নেই, সংসার নেই। তোর আবার কিসের ঘরে ফেলার তাড়া। মোবাইলে বাবা-মাকে বলে দে যে বেলাপিসি আজ ধরে রেখেছে।’
সন্ধ্যে নামছিল, পিসি খুব যত্ন নিয়ে চানাচুর, তেল, আলু সিদ্ধ, শশা, পেঁয়াজ কুচি দিয়ে মুড়ি মাখল। পিসি তার বিখ্যাত মুড়ি মাখা খাওয়াতে খাওয়াতে শোনাল গ্রামের কত কী বদলে গেছে। এখন ম্যাজিক গাড়ি চলে শহর পর্যন্ত। বিশালাক্ষ্মী মায়ের মন্দির চত্তর শ্বেতপাথরে বাঁধানো হয়েছে।
বেলাপিসির কাছে গ্রামের নানা পরিচিত মানুষের সুখ দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে অরুণদার কথা তুললাম। ভাবতেই খারাপ লাগছিল যে অরুণদা আমার গ্রামে ঢোকার খবরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অরুণদা আমার কেউ না। অসংখ্য গৃহশিক্ষকের মধ্যে একজন মাত্র। তাও কত বছর আগের। সে সময় দূরে চলে গেছে, ফিকে হয়ে গেছে স্মৃতি।
আমি ওই সামান্য পাঁচশ টাকার ধার ফেরত নিতে আসিনি। পিসির কাছে আসার আগে অরুণদার বাড়ির সামনে দিয়ে কতবার ঘুরলাম ফিরলাম। একটু বলার জন্য আমি তুচ্ছ খেয়ালে ভর করে গ্রামে এসেছি। কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। অরুণদাকে নিয়ে হাসি মজাগুলো কাঁটার মতো বিঁধছিল। লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যেতেই কি অরুণদা এরকম অদ্ভুত পাগলাটে হয়ে গেল?
বেলাপিসি অন্তঃপুরে থাকে, অতশত জানে না। বলল, মাথা খারাপ বলে তো শুনিনি। আগেও সাইকেল চালাতে পারত না বলে ছেলে ছোকরার দল রাগাত। এখনও কী সব বলে রাগায়। কে দেখবে ওকে? বাপ মা মরেছে, দাদা বৌদি আলাদা। ডাক্তার মরে রোজগার গেছে, ওরা অনেক গরীব হয়ে গেছে। তার ওপর ওই বেখেয়ালি ছেলে, একলা থাকে, স্বপাক খায়। বেলাপিসি লেখাপড়া জানে না। বই পড়েনি কোনও দিন। লাইব্রেরি নিয়ে আলোচনা বুঝতে পারবে না। তাই প্রসঙ্গ বাড়ালাম না।
প্রসঙ্গ তুলেই বা কী হবে? কিন্তু কেন যে নিতান্ত সাধারণ পাঠাগারটির বন্ধ ভগ্ন দশা আমাকে এতটা বিব্রত করছিল বুঝতে পারছিলাম না। ওই লাইব্রেরির সূত্র ধরেই অরুণদার গল্পগুলো উড়ে আসছিল বারবার। মিথ্যে গল্প ফেঁদে টাকা ধার নিয়ে ……দে ছুট, দে ছুট।
হা হা হা!
চায়ের দোকানে হাসির দৃশ্য কেন এত আঘাত করছে ভেতরে? যেন আমার যত্নে লালিত কিছু সুখস্মৃতিকে সম্মিলিত বিদ্রুপ করা হচ্ছে।
সন্ধ্যা গাঢ় হতে বেলাপিসিকে বলে গ্রাম ঘুরতে বেরোলাম। পাড়ার দোকানগুলো ঝাঁপি নামিয়েছে, এক্ষেত্রে এখনও ‘আর্লি টু বেড’ পল্লীর নিয়মই বহাল রয়েছে।
রাস্তাঘাট নিঝুম। কেউ কেউ ফিরছে কাজ থেকে। সামনের একটা বাড়ি থেকে একই কথা বারবার আওড়ে পড়া মুখস্ত করে চলেছে কোনও ছোট ছেলে। আমার যাওয়ার জায়গা বলতে অরুণদার বাড়ি। সেখানে গিয়ে দরজার কড়া নাড়তেই অরুণদার বউদি বেরিয়ে এল। অরুণদা বাড়িতে নেই, কোথায় থাকে, কখন ফেরে কিছুই ঠিক নেই বলে কর্কশ ও বিরক্তি ভরা জবাব দিল।
দুঃখিত! বলে পিছিয়ে এসে রাস্তায় এলোমেলো ঘোরাঘুরি করলাম। এরপর কী মনে করে লাইব্রেরি গলিতে আনমনে হাঁটলাম এপাশ ওপাশ। হঠাৎ মনে হল লাইব্রেরির বন্ধ ঘরের দরজার নিচে একটা কাঁপা আলোকরেখা।
আমি কিছুক্ষণ থমকে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম। কোনও ফুলের ঘোর লাগানো গন্ধ সময়কে থামিয়ে রেখেছিল। এমন বন্ধ অবহেলিত আধুনিক সমাজে অপ্রয়োজনীয় লাইব্রেরিতে রাত নটার সময় আলো জ্বালালো কে?
ঘরের ভেতরে মানুষ আছে?
ভেতরে মানুষের উপস্থিতি ছাড়া এই আলোর আভাস সম্ভব নয়। আমি জং ধরা লোহার গেট যতটা সম্ভব সাবধানে খুলে ভেতরে ঢুকলাম। অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ যেন মোহিত করে রেখেছে চারপাশ। প্রবল কৌতূহল নিয়ে খোলা বারান্দা পেরিয়ে লাইব্রেরীর ঘরের দরজায় প্ৰথমে আলতো ঠেলা দিলাম। তাতে দরজা একটু ফাঁক হোল। ভরসা পেয়ে এবার ঠেলা দিয়ে দরজা খুলে লাইব্রেরীর হল-ঘরটায় ঢুকলাম। অরুণদা হ্যারিকেনের আলোয় কিছু বাঁধিয়ে আনা বই র্যাকে তুলছিল। দরজার আওয়াজ পেয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। তারপর আমাকে প্রায় ধাক্কা মেরে ঠেলে দিয়ে দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। আমি ধাক্কা সামলে বাইরে এসে চিৎকার করে অরুণদাকে ডাকলাম, ‘অরুণদা আমি টাকা ফেরত নিতে আসিনি। ফিরে এসো। আমি তোমার লাইব্রেরি দেখতে এসেছি।’
আমার ডাক অরুণদার কানে পৌঁছল বলে মনে হল না। সে হনহনিয়ে নিমেষের মধ্যে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। আমি হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের আলোয় চারপাশে গন্ধবিধুর বিষন্নতা। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে থাকার পর কী মনে করে লাইব্রেরির মধ্যে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকে মনে হল বর্হেস বলেছিলেন, I have always imagined that Paradise will be a kind of library.
মনে হল আমি তেমনই কোনও স্বর্গে একলা ঢুকে পড়েছি। মেঝেতে বেশ কিছু ধুলো মাখা বই। পাশে সেগুলো মোছার জন্য ছেঁড়া কাপড় পড়ে রয়েছে। সেটুকু দৃশ্যমান করেছে হ্যারিকেন নামের বিলুপ্ত আলোকবর্তিকা। হ্যারিকেন! কত কাল যে হ্যারিকেন দেখিনি। অরুণদা যত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাঁচিয়ে রেখে চলেছে বন্ধ হয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত পাঠাগারের কয়েক হাজার বই। প্রতিদিন ধুলো ঝেড়ে, একটা দুটো করে বাইরে নিয়ে গিয়ে খুলে যাওয়া মলাট বাঁধিয়ে এনে। কয়েকটা বইয়ের সারিতে আনমনেই হাত বোলালাম।
অরুণদা পালালে কেন? তুমিই তো এই স্বর্গের দেবদূত। হয়তো এটাই নিয়তি। দেবদূতরা পালায় অভিশপ্ত হয়ে। তাদের পালাতেই হয়।
কারও পায়ের শব্দে চমকে দরজার দিকে ফিরে তাকালাম। অরুণদা ফিরে এল? দেখলাম একজন বৃদ্ধ লোক দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি আমায় চিনলেন না। বললেন, “অরুণ বেরিয়ে আয়। চাবি দেব!”
আমি বেরিয়ে এলাম। বললাম, “আমি অরুণ নই। অরুণদার ছাত্র।”
“ও।” ভদ্রলোক লাইব্রেরীর দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে নিরাসক্তভাবে বললেন, “অরুণ ভেতরে রয়ে গেল না তো?”
“না। আমায় দেখে দৌড়ে পালাল।”
“বিপদে পড়েছে বলে আপনার থেকে টাকা ধার করেছিল নিশ্চয়ই?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আমি টাকা ফেরত নিতে আসিনি।”
“ও ওইরকম করে। ছুটে পালায়। কিসের অপরাধবোধ জানি না। কতবার বলি, তুই তো নিজের প্রয়োজনে টাকা নিসনি। বইগুলো রক্ষা করতে নিয়েছিস। তোর নিজের বলতে কে আর রয়েছে? সবাই তোকে ছেড়ে গেছে। বইগুলোই তোর আত্মীয়! সেই আত্মীয় মারা যাচ্ছে বলে টাকা নিয়েছিস। তো মিথ্যেটা কোথায়?”
ভদ্রলোক একটু থামলেন, তারপর বললেন, “ছেলেটা অনেক চেষ্টা করেছিল। মাইক নিয়ে ঘুরে ঘুরে সবাইকে ডেকে বলত, লাইব্রেরীতে আসুন। বই পড়ুন। কেউ শুনল না। মেম্বার কমতে কমতে শূন্যে নামতে লাগল। শিক্ষিত পরিবারগুলো আরও সুবিধায় থাকবে বলে গ্রাম ছেড়ে মফস্বলে উঠে গেল। পার্মানেন্ট লাইব্রেরিয়ান মাকালবাবু মারা যাবার পরে নতুন কোনও লাইব্রেরিয়ান এল না। অরুণ তো লাইব্রেরীর কেউ না। ক্যাজুয়াল। হেল্পার। ওর তো লাইব্রেরী চালানোর অধিকার নেই।”
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “আপাতত নিক্রিয় লাইব্রেরী কমিটির সেক্রেটারি হিসেবে আমার কাছে ঘরের চাবিটা রয়ে গেছে। অরুণ রাতের দিকে এসে আমার থেকে চাবি নিয়ে ঘর খোলে, পরিষ্কার করে, বইয়ের যত্ন নেয়। আমার তো ওকে সাহায্য করার ক্ষমতা নেই। থাকলে পাবলিক অপমান থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম। বাবা মারা যাবার পর থেকে বড় দরিদ্র লাঞ্ছিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে ছেলেটা। আচরণও এলোমেলো পাগলাটে হয়ে গেছে। ওর ব্যবহারে কিছু মনে করো না বাবা।”
আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, নিজের কথাও আর না বাড়িয়ে ভদ্রলোক লাইব্রেরীর লোহার গেট টেনে দিয়ে চলে গেলেন ধীর পায়ে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। যেতে ইচ্ছে করছিল না। মিষ্টি গন্ধটা যেন এবার একটু চেনা চেনা লাগছিল। অরুণদার পোঁতা হাসনুহানা। আগাছার জঙ্গলের মধ্যে মিশে কোথাও জেগে আছে।
আমি গন্ধটার সঙ্গে আরও পরিচিত হতে দাঁড়িয়েই রইলাম ক্ষয়াটে চাঁদের আলোয়।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
মৃতপ্রায় লাইব্রেরি নিয়ে বড়ো মমর্মস্পর্শী এই লেখা।কান্না পায়।ধন্যবাদ দেবাশিস।
চমৎকার লেখা।অদ্ভূত এক অনুভূতি জাগল।এমন লেখা আরো হোক।