short-story-hoe-othar-aagey

হয়ে ওঠার আগে
নাহার মনিকা


রান্নাঘরের অনেক কিছু আমি টয়লেটে ফেলে ফ্ল্যাশ করে দেই।

পচনশীল যা কিছু, যেমন মিষ্টি কুমড়া কিংবা বীট সবচেয়ে ভারি ও ধারালো যে ছুরি চুম্বক রডে ঝোলানো, সেটাকে নামিয়ে সপাসপ কুচি কুচি করে কেটে একটা বাটিতে পানির সঙ্গে মিশিয়ে কমোডের কাছে নিয়ে যাই। বাটিটা সাদা বলে বীটের রং গুলে পানিকে রক্তিম দেখায়। এক সঙ্গে বেশি পরিমাণে ঢেলে দিলে টয়লেটের পাইপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাই আমি খুব সাবধানী। সহনীয় পরিমাণে একটু একটু করে ঢালি, একবার ফ্লাশ করে অপেক্ষা করি। পানি ভরে এলে আবার। পচনশীল দ্রব্যের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে কাঁধের ওপর চাপ চাপ ভার নেমে যায়।

‘স্ল্যামডগ মিলিওনিয়ার’ সিনেমায় কতগুলো শিশুকে ভিক্ষুক বানাবার কথা মনে আছে? একজনের চোখ অন্ধ করে দিয়ে তারপর তাকে গান শিখিয়ে ট্রেনে ভিখিরি বানানো হল। শুধু অন্ধ, বা ভিখিরি হলেই হবে না, তাকে সুরেলা কণ্ঠে ভিক্ষা চাইতে জানতে হবে। অথবা অন্যভাবে দেখলে এটা ঠিক ভিক্ষে করা না। মধুর কণ্ঠে গান শুনিয়ে এর বিনিময়ে পয়সা নেওয়া, এক রকম সার্ভিস চার্জ। সার্ভিস চার্জের কথাটা আমার না। আমার স্বামী নেয়ামুল এমন ব্যাখা দেয়। অর্থনীতির ছাত্র তো।

কী কথায় কী বলে ফেলছি! বলছিলাম, ভারী ছুরি দিয়ে পচনশীল কিছু কেটে টয়লেটে ফ্লাশ করে দেওয়ার কথা।

আমি প্র্যাকটিস করছি। নিজেকে কাটাকুটির চর্চার মধ্যে রাখতে ভালো লাগে। একদিন জীবন্ত কোনও কিছু কেটে পচনশীল বানিয়ে সিম্পলি ফ্লাশ করে দেব। চিরজনমের মতো গলে পচে একশা হয়ে যাবে। আমিও তখন আমার পরিচয়টা টয়লেটে ফ্লাশ করে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারব।

ও হ্যাঁ, আমি জাহান আরা। মাঝখানে অনেকদিন, প্রায় আট বৎসর জাহান আরা ছিলাম না। আজকে সকাল থেকে আবার হয়েছি। কেউ আবার জানতে চেয়ে বসবেন না যে কেন জাহান আরা ছিলাম না। দু’ বাচ্চার মা, ডক্টরেট ডিগ্রিধারীর বউ যদি এসবের উত্তর দেয় তাহলে একঘেয়ে, ক্লিশে শোনাবে।

তবে, আজকে আবার জাহান আরা হয়ে ওঠার আগে আমার ধারনা ছিল যে উৎকট ঘটনা শুধু সন্ধ্যাবেলায় ঘটতে হয়? এতকাল ধরে হয়েছেও তাই। কিন্তু সেদিন কেন যেন এর রদবদল হল।

কোলের মেয়েটা টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে, বড় হলঘর থেকে দু-ধাপ সিঁড়ি ছাড়ালে আমাদের বসার ঘর। করিডোর ধরে থুপ থুপ করে এগিয়ে আসছে মাইশারা। দোতলার সিঁড়ির কাছে এসে ধাপ বাইতে শুরু করল। প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। আমি সামান্য বিচলিত হই, কিন্তু নড়ি না। এই মুহূর্তে সতেরো মাস বয়েসি মেয়ে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেলেও আমার কিছু যায় আসে না। নিজেকে পানি ভর্তি চৌবাচ্চার মতো মনে হয়, উলটোদিকের জানালা দিয়ে সকাল বেলার আলো ঢুকে সে চৌবাচ্চাকে ক্রমাগত তিরতির করে কাঁপিয়ে যাচ্ছে।

যে দৃশ্য দেখার কথা না, আমি ক্রমাগত সেটা দেখছি।

বাথরুমে গিয়ে কতবার ফ্লাশ টানলাম সকাল থেকে। সুয়েরেজের মোটা পাইপ রক্ত এবং পচনশীল আর সবকিছু সুড়ুত সুড়ুত করে টেনে নেয়ার কথা। অথচ তখনও দেখি যে নেয়ামুলকে পুলিশ হাতকড়া পরায় নি। দু’জন দু’দিক থেকে বাহু শক্ত করে ধরে গাড়িতে তুলছে। আমাদের সাত বছরের ছেলে তুর্য দৌড়ে এসে বসার ঘরের জানালার কাছে ভিড়েছে। বাইরে হালকা বৃষ্টিপাত ডিঙিয়ে ওর বাবাকে পুলিশ গাড়িতে ঢোকাল, তার বাবা একবার চোখ তুলে দেখল। বাড়িটা, নাকি তুর্যকে? ওর তাকানোর মধ্যে আরও কিছু খোঁজার আকুতি ছিল কি? চারপাশে তো ভিড় জমে গিয়েছে।

আমাকে স্ট্রেচারে করে বের করা হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সের প্যারামেডিক এসে ফর্মে নাম লিখল— জাহান আরা।

তুর্য চিৎকার করে কাঁদছে। ডাকছে— ‘মা, মা।’

আমি তবুও নড়ছি না।

ওই সময় আবার নেয়ামুল ফিরে এল। বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়িতে উঠতে গাঁইগুঁই করছে।

ওর হাঁটা, নীচু স্বরে কথার মধ্যে ক্রোধ, অনুযোগ, প্রেম, অথবা চাহনির মধ্যে প্রত্যাশা কিংবা উপেক্ষার ওজন আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। অথচ আজ সকালবেলা অবধি মনে হচ্ছিল, আমি এসবের কিছুই জানি না!

সেপ্টেম্বরের বাংলা মাসটা যেন কী? এ সময় অল্প শীত ঘুষঘুষে জ্বরের মতো বাতাসে ঢুকে পড়ে। সকালে ফুলহাতা সোয়েটারের ওপর শালও জড়ানো থাকে মাঝে মধ্যে, আজকে আমার শালোয়ার কামিজের ওড়নাটারও হদিস নেই।

কোনো এক সেপ্টেম্বর মাসে আমি ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটা পড়েছিলাম। জীবনানন্দ কি কোনোদিন ভেবেছে যে তার এই কবিতা কোন পাঠক টানা মুখস্থ রাখবে! সৌমিত্রের কণ্ঠে ইউটিউবে এতবার শুনেছি যে এর মর্মার্থ মাথায় গেঁথে থকে। ও হ্যাঁ, আমি জাহান আরা আগে খুব কবিতা পাগল ছিলাম। কবিতার বিষাদ, সংরাগ, ক্লান্তি, নিরাসক্তি’র রহস্যময়তায় এক অত্যাশ্চর্য ভ্রমণের যাত্রী হিসেবে নিজেকে ভাবতে ভালোবাসতাম। সেই যাত্রার ভেতরে এখন পড়ে গেছি। ভাগ্য ভালো কবিতার কোনও শব্দ এখন আর মনে নেই আমার। কেবল সুর মনের ভেতর গুন গুন করে। কথা মনে নেই বলে অস্থিরতা ভর করে, আবার সুরটা মনে এলে সকল অস্থিরতা স্তিমিত হয়ে সেই ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে আরো এক বিপন্ন বিস্ময়ের অংশ হয়ে উঠতে চাই। ‘জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার শূন্য করে চলে যেতে চাই’— এই কথা একদিন নেয়ামুলকে বলেছিলাম।

নেয়ামুল জানত আমার কবিতাপ্রীতির কথা, কিন্তু কোনওদিন উৎসাহ দেখায়নি বলে আমারও ইচ্ছে করেনি ওকে আমার এই একান্ত ভুবনে প্রবেশাধিকার দিতে।

আমার ঘরের দেয়ালে আমাদের যুগল ছবির ফ্রেমের পেছনে আরও একটি ছবি আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। নেয়ামুল যখন বাসায় থাকত না, তখন বের করে দেখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি উৎসবে তোলা, চোখেমুখে জনসমাগমে যাওয়ার ফুর্তি। আমার পাশে লাজুক হাসি হাসতে থাকা অচেনা এক যুবক, আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওর গলার কাছে সবুজ রঙা ত্বকের দিকে তাকিয়ে আমিও দ্রবীভুত হচ্ছিলাম। ভিড়ের ছবি থেকে শুধু আমাকেই প্রকাশ করা যেত। কিন্তু আমার ইচ্ছে করেনি। বুকের ভেতরে সেদিনের প্লাবন ধরে রাখতে আমি ছবিটি বড় করিয়েছি। ওই যুবকের নাম জানা হয়নি, কিন্তু ভিড়ের ভেতরে আমাকে যত্ন করা একটি দৃষ্টি আমাকে কাবু করেছে অনেকদিন। আট বছর দীর্ঘ সময়, অথচ মনে হয় সেদিন সকাল! ‘উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে’ আমাদের এই ছবিটায় ঠাঁই নিয়েছে।

বিয়ের আগে আমি বলতাম যে রাজকুমারী ডায়ানা-ফায়ানা নয়, আমার আসলে খুব কামিলা পার্কার হতে ইচ্ছে করে। নিজের মতো বাঁচব। স্বামী সংসারে রাজত্ব করার পাশাপাশি প্রিন্স চার্লসের মতো একটা আস্ত রাজপুত্রকে পকেটে ভরে রাখব, যে আমার সঙ্গে থাকলে তার চোখে ভোরের আলোর মতো হাসি থাকবে। আমি জানব— আমাকে ছাড়া এই রাজপুত্রের জীবন অর্থহীন।

মনে মনে ওই ছবির যুবকটি আমার রাজপুত্র ছিল।

এইসব শুনতে পেয়ে কিনা কে জানে, নেয়ামুল আমাদের বিয়ের পর থেকে হাসি ভুলে গিয়েছিল। নেয়ামুল দেখতে ভালো, নম্র, বিনয়ী, সবচেয়ে বড় কথা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী পাওয়া। বাড়িতে আপত্তির কোনও কারণ নেই। ধুমধাম করে বিয়ে হল।

বাসর রাতের উপহার হিসেবে একটা চিঠি দেখাল নেয়ামুল। ক্যানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশোনার ছাড়পত্র। আগামি মাসের মধ্যেই আমরা দু’জনই চলে যেতে পারব। একেকটা সাফল্যের পালক ওর টুপিতে যুক্ত হয় আর সে গম্ভীর হতে থাকে। তখনও সে আমাদের যুগল ছবির পেছনে আমার একলার ছবিটি দেখেনি।

একবার তুর্য’র জন্য দুটো গোল্ডফিশ কিনলাম। ছেলেকে নিয়ে আমার ব্যস্ত দিন। আমরা দুই রুমের ভাড়া বাসায় থাকি। নেয়ামুলের পিএইচডি প্রায় শেষ পর্যায়ে। খুব খাটুনি, বাড়তি টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ। হিসেব করে চলি, টাকা বলতে গোনা স্কলারশিপের টাকা। তবু এক বিকেলে বড়সড় কাঁচের বয়ামে মাছ দু’টি নিয়ে এলাম। তুর্য ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে খাবার দিত, হোমিওপ্যাথির গুলির মতো মাছের আহার। সে সময় একদিন মাছের পরিচর্যা করতে গিয়ে দেয়ালের ছবি ভেঙে খান খান হলে আমার একলার ভূবন দৃশ্যমান হল। নেয়ামুল কিছুতেই জাহান আরা’র আগের জীবনের অস্তিত্ব মানতে চাইল না। রেগে গিয়ে মাছের বয়ামে পানির বদলে কয়েক পেগ হুইস্কি ঢেলে দিল।

তুর্য’র সঙ্গে বাইরে মৃতপ্রায় শীতের দিনে অ্যাকোয়ারিয়ামের সামনে বসে মাছগুলো দেখে চলমান জীবনের স্পন্দন পেতাম আমিও। সকালে পানির ওপরে ভেসে থাকা মাছ দেখে তুর্য কেঁদে আকুল হয়েছিল, আমার বুক ভেঙে গিয়েছিল কষ্টে। চারদিক সাদা বরফে ঢেকে থাকা দিনে আমরা মা-ছেলে বিষণ্ণ মনে হেঁটে পার্কে গিয়ে বরফের নীচে সমাধিস্থ করে এসেছিলাম সেই মাছ। আমাদের আদিখ্যেতায় রেগে খাবার থালা উলটে দিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল নেয়ামুল।

মাছের শোক ভুলে তুর্যের খুব কুকুর পোষার শখ হল।

কুকুরের পেছনে ব্যয়ের কথা চিন্তা করে আমি এক বাক্যে খারিজ করে দেই। তারপর সেভিং লাইভস অভ হোমলেস পেটস-এর (কুকুরের এতিমখানা) ওয়েবসাইটে পোষ্য চেয়ে দরখাস্তের ফর্ম ফিলাপ করে দেই। এসব কুকুর বিড়ালের গায়ে দাম আঁটা নেই। তাদেরকে বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও বিস্তর আনুষ্ঠানিকতা আর অঙ্গীকারে সই-সাবুদ করে আনতে হবে। ওদের থাকার জায়গা তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দরখাস্ত করে দেওয়ার জন্য নেয়ামুলকে বলতে হল। যতই বলি আমি আর তুর্য সব যত্নআত্মি করবো, সে ততই দাঁতে দাঁত ঘষে রেগে ওঠে— ‘এত্ত বড় সাহস তোমার, ফর্ম ফিলাপও করে ফেলছ!’

তখন থেকেই সম্ভবত আমি শাকসবজি বা পচনশীল কিছু কুচি কুচি করে কেটে ফ্লাশ করে দিতে শুরু করলাম।

আমাদের আর কুকুর কেনা হয় না। তিনজনের দলে নেয়ামুল সর্বপ্রধান ভেটো ক্ষমতা নিয়ে বসে থাকে। ছেলের সঙ্গে আপোষ করতে চেয়ে যখন বলি— ‘তুর্য, পাপি চাও নাকি বেবি চাও?’

নেয়ামুল আমার দিকে চট করে দেখে। আমার কোল ভরে মাইশারা আসে তারপর।

আমি ভেবেছিলাম তুর্য’র বোনের নাম তূর্ণা রাখব। কিন্তু নেয়ামুল রাজি হয় না।

ওই দিন থেকে আমাদের কেন যেন মতের মিল হচ্ছিল না। ঠিক বললাম কি? একদম ওই দিন থেকে?

উলটো করে বললে মনে হয় ঠিক বলা হবে। আসলে ওই দিন থেকে আমি আমার নিজের মত প্রকাশ করতে শুরু করেছিলাম। নেয়ামুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এবং পড়ায়। ওর বিদ্যাবুদ্ধি, বিবেচনা আমার চেয়ে বেশি, এটাই তো স্বাভাবিক। ও যা বলবে তা সঠিক, সেটাই তো স্বাভাবিক।

আমি যত বেশি তুর্য আর মাইশারাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে থাকলাম, নেয়ামুল তত বেশি ওর কম্পিউটারে ডুবে যেতে থাকল। খাওয়ার সময় ছাড়া ওকে দেখা যায় না। আবার, কখনও কখনও খাবারের প্লেট নিয়ে ও নিজের স্টাডিতে ঢুকে যায়।

আর যখন আমার কাছে আসে, ছবির ওই যুবকটিকেও সে সঙ্গে নিয়ে আসে। আরো আনে তূণভর্তি কথার তীর, যে তীরে বিদ্ধ হয়ে নির্ঘুম রাত কাবার করি আমি।

যখন সকাল হয় তখন প্রায়ই ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাই। কিন্তু সে উপায় তো নেই, তাই তুর্যকে তৈরি করি, নাস্তা করিয়ে ওর লাঞ্চ প্যাক করে, মাইশারাকে গুছিয়ে স্ট্রলারে বসিয়ে ঠেলতে ঠেলতে স্কুলে পৌঁছাই। বাসা থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। ফিরে এসে মেয়েকে খাইয়ে ঘরের কাজ সারতে সারতে আমার বেলা গড়ায়।

নেয়ামুল ফিরে এসে কার কার সঙ্গে ফোনে কথা বলে। তারপর ছবির যুবকটির সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের কারণ দেখিয়ে আমার গায়ে উচ্ছাসহীন, অদরকারি ট্যাগ জুড়ে দেয়। আমি ঘাড় বাঁকিয়ে ওই ছুরিটা দেখতে থাকি। নেয়ামুলের কথার উত্তর করি না বলে পর্যায়ে আমার গালে চড় দিয়ে বেরিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলে আমি ফ্রিজ থেকে মুরগি বের করে চপাচপ কেটে কেটে হাড়মাংসের কিমা বানাই। সাদা বাটিতে পানির মধ্যে রক্ত মাংস এক করে বাথরুমে গিয়ে কমপক্ষে তিনবার ফ্লাশ করে সব ফেলে দেই। তারপর খুব ক্লান্ত লাগে। তুর্যকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে। মাইশারা ওর বেবীকটে ঘুমায়।

কাকে ফোন করব? বিপদে পড়লে এখানে পুলিশকে ফোন করতে হয়। বাচ্চাদেরকেও সেভাবে শিখিয়েছি। সেই পুলিশ ডেকে যদি নেয়ামুলকে নিয়ে যায়, তাহলে কাকে ফোন করব!

নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারলাম কি? যেমনটা নেয়ামুল বলে— ‘আমি না থাকলে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করবি।’

রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করা কেমন? এই জীবন কি তার থেকে ভালো?

একবার আমরা কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। নেয়ামুলের পাশে আমি গাড়িতে, তুর্য আর মাইশারা পেছনের কার সিটে। খ্রিস্টমাস সিজনের বিপুল ব্যস্ততা, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম। প্রায় থেমে থাকা গাড়ির জানলা খুলে দেই, তবু অস্থির লাগে। হঠাৎ আমার সামনে একটা প্রাণী বহনকারী গাড়ি, পেছনে বড় লরি। নেয়ামুল মাঝখানের লেনে গাড়ি চালাতে ভালোবাসে। কোথায় যেন পড়েছিলাম— ড্রাইভিং মানুষের চরিত্র প্রকাশ করে। সে যে মধ্যবিত্ত, মধ্যপন্থার মানুষ, তাই কি?

হঠাৎ সামনের গাড়িটার ছোট ছোট জানালায় একটা শিং, একজোড়া চোখ দেখা গেল। মায়াময় কিন্তু অস্থিরতায় ভরা। সত্যিই তো, এই যে থেমে আছি রাস্তায়, ওরও নিশ্চয়ই বন্দিদশা লাগছে। কোথায় যাচ্ছে ও? কোন স্লটার হাউসে? নাকি কোনও গৃহস্থের বাড়ি? এখানে গৃহস্থের গরু পালার নিয়ম নেই, জানি। চোখ দেখে মনে হচ্ছে বাছুর না হলেও বাচ্চা। নধরের কদর সবখানে। ও হয়তো কোথাও স্টেক হতে রওনা দিয়েছে। পথে আটকে থাকায় কপালে হয়তো আর একটা রাত জুটে যাচ্ছে। ওই খুশি অথবা বিষাদের ভাগীদার হই, এমন শক্তি প্রকৃতি আমায় দেয়নি।

নেয়ামুল আমাদের বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে। আমার চাওয়া না চাওয়ায় ওর কিচ্ছু এসে যায় না, আমি ওর নির্দেশমতো রিয়েল এষ্টেট অফিসে গিয়েছি। খাঁচাবন্দী গরুটির মতো সই-সাবুদ দিয়েছি।

নেয়ামুল পুলিশকে বলেছে যে আমি নাকি মানসিক রোগী। এর মধ্যে একজন সরকারি ল-ইয়ার ফোন করেছিল। আমি তো চৌবাচ্চার মধ্যেকার পানির মতো স্থির বসে আছি। ফোন ধরিনি। তুর্য এখন ভসেস মেসেজ চেক করতে জানে। ও স্পিকারে দিল, যাতে আমি শুনি।

আমাকে নেয়ামুলের বিষয়ে সবকিছু জানানো হবে। সম্ভবত আমাকে পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে। তবে বাচ্চা ছোট বিবেচনায় কী করা হবে তা এখনও স্থির হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়ামুলের অফিসে গিয়েছিলাম। দোতলায় যেতে পরপর দুটো দরজা, ভারি স্টিলের হাতলের ওপরে লক বক্স কোডও আমি জানি, কার্ড ছোঁয়ালেই খোলে কোড খুলে যায় কিন্তু হাতল টেনে ঢুকতে হবে। ঠান্ডা স্টিলে হাত পড়লে ভয় করে। সিঁড়িতে দু’পাশ থেকে গা বাঁচিয়ে দোতলায় উঠি। টানা লম্বা করিডোরের দু’পাশে গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের অফিস। দু’কদম এগোলে একটা দরজায় ক্রস করে সাদা টেপ আঁটা, কাগজে লেখা— ‘ডু নট এন্টার’।

মাঝখানের করিডোরে একটা দেয়াল জুড়ে অনেকের হাতে আঁকা ছবি। সবাই একটা ছবিই এঁকেছে, রংধনু। কিন্ত শুধুমাত্র সাদা-কালো রং দিয়ে। দেখতে ভালো লাগে, মনে হয় সত্যি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কী ঠিক হবে? আমি আর নেয়ামুল তো প্রতিদিন নিজেদেরকে খুন করে চলেছি।

বাড়ি বিক্রির পর গত শুক্রবারের সন্ধ্যায় নেয়ামুল আমাদের সঙ্গে বসে রাতের খাবার খেল। তারপর হঠাৎ করে সে যদি না থাকে, তাহলে সংসার কী করে চলবে সে বিষয়ে আলাপ তুলল।

আমি বললাম— ‘বাচ্চা নিয়ে সংসার সামলানো আমার পক্ষে কী করে সম্ভব?’

নেয়ামুল বলল— ‘না পারার কিছু নাই। এখানে সরকারী সাহায্য আছে।’

কেন যেন আর প্রশ্ন করলাম না। আমার প্রস্তুতি আছে কি নেই তার চেয়ে বড় কথা আমি তো সংসারের দেখভাল করছি। বাইরে চাকরি করি না বলে বাসায় বসে থাকতে থাকতে পিঠে গাছ গজিয়ে ফেলিনি। ওর সঙ্গে কথা না বলে তুর্য’র দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসি।

‘ছোটবেলায় আমি একবার গোলকিপার ছিলাম’ বলতেই তুর্য’র চোখ বড় বড় হয়ে গেল, ‘রিয়েলি মা!’

পাড়ার ছেলেরা দলে ভারি। রোজ মাঠে ফুটবল খেলে। আমি কোণে বসে থাকি। একবার নির্ধারিত খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিতে আমাকে নেওয়া হল। মেয়েরা দৌড়-ঝাঁপ কম পারে। সুতরাং, আমি গোলকিপার।

প্রথম গোলটা দারুণ কৌশলে ঠেকিয়ে দিয়ে দুর্দান্ত বাহবা পেলাম সবার। তারপর থেকে নিয়মিত গোল ঠেকিয়েছি। গোলকিপার হওয়ার বাকি অংশ তুর্যকে বলতে বলতে নিজের ভেতর সাহস ফিরে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে জীবনের ঝড়ও ঠেকাতে পারব।

কিন্তু কিছু করে ওঠার কথা ভাবার আগে মাথা ঘুরে অচেতন হয়ে পড়ি।

ঘুমে জাগরণে তখন একটা স্প্রিং বোর্ডের চাকা কালো পিচের রাস্তায় আমাকে চালিয়ে বেড়ায়। তুর্য আর মাইশারা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। নেয়ামুলের এত টাকা, তবু আমি স্প্রিং বোর্ডে ডান পা ঠেকিয়ে বাম পা রাস্তায় ঠোক্কর দিতে দিতে চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি?

যেন যে যাচ্ছি, সে আসলে জাহান আরা না। কোনও পাহাড়ী মেয়ে। ল্যান্ডস্লাইড হয়ে দুর্ঘটনায় এতগুলো লোক মরে গেল, আমার স্বামী পাহাড় ধ্বসের নিচে চাপা পড়ে ছিল আড়াইদিন। আমি তুর্য আর মাইশারা মিলে যখন ওদের বাবাকে বের করে আনলাম, পাহাড়ের ধ্বংসাবশেষের ওপাশে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল, বর্ননাতীত আলোকচ্ছটা ধোঁয়াশা হয়ে ওর মুখে পড়েছিল। আমি ওর বুকে কান পেতে তখনো মৃদু ধীর হৃদপিন্ডের চলাচল শুনতে পাচ্ছিলাম। ছেলেমেয়ে দুটো কিছুতেই বাবাকে সমুদ্রের গভীরে ভাসিয়ে দিতে চায়নি। আমাদের এলাকার কেউ বেঁচে নেই, কোনও বাড়ি ঘর অবশিষ্ট নেই। কোন অলৌকিক শক্তির বলে আমরা বেঁচে থাকলাম এটা আমার কাছে রহস্য। এলাকায় আজকাল প্রাচীন বাতাস খেলা করে। ভাগ্যিস ধ্বসের পরে পিচঢালা রাস্তা সমান্তরাল হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। আমি গড়গড়িয়ে প্রায় দেড় দুই কিলোমিটার নেমে এলাম। চারপাশ শুনশান, এত নিঃশব্দ যে স্প্রিং বোর্ডের চাকার শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। আমাদের দূর্ঘটনার পরে এদিকে কোনও পাখিও উড়তে দেখি না! কী কাণ্ড, পাখি নেই! চরাচরের একমাত্র জীবন্ত প্রাণী আমি ছুটে যাচ্ছি। হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলে আমাকে একরাশ ত্রাস আর আতঙ্ক ঘিরে ধরে। আমার সঙ্গে কোন আলো নেই, আজ চাঁদ উঠতে দেরী হবে। অন্ধকারে সরু পীচের রাস্তায় আমার দ্রুতগামী স্প্রিংবোর্ড যদি খেই হারায়? যদি গভীর খাদে পড়ে গিয়ে পাথরের ধারালো চাঁইয়ের সঙ্গে ধাক্কা খাই? যদি আমার ছেলেমেয়ে দুটো আর আমাকে খুঁজে না পায়? যদি-র প্রশ্নবোধক তোড়ে ভেসে যেতে যেতে আমি স্প্রিংবোর্ডটা টেনে থামিয়ে দিই। নীচে নেমে যাওয়া রাস্তাটাকে একটা অজগর সাপ মনে হয়, ওপর দিকে ওর মাথাটা, আমি ওপরে উঠলে মনে হয় হাঁ করা মুখ নিয়ে কপাৎ করে গিলে খেয়ে ফেলবে। লেজের কাছে নামলে এক প্যাঁচ দিয়ে গলা জড়িয়ে আছাড় দেবে স্প্রিংবোর্ডের ওপরে, চাকার বেয়ারিং খুলে গিয়ে শব্দ হবে প্রিং প্রিং… নিজেকে এক টুকরো নিঃসঙ্গ মেঘের মতো মনে হচ্ছে।

— ‘আম্মু, আম্মু—’ তুর্য ধাক্কা দিয়ে আমাকে ওঠায়। বসে বসে আমি জীবনেও ঘুমাই না। কী আশ্চর্য আজকে ঘুমিয়ে পড়েছি।

গতরাতে নেয়ামুল আমার হাতে ডিভোর্সের ফর্ম ধরিয়ে দিয়ে বলেছে সে দেশে ফিরতে চায়। তার জন্য আরেকজন অপেক্ষায় আছে। তার পিএইচডি শেষ। এখন সে নিশ্চিন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ফেরত যেতে পারে।

আমি তখন সেই ছুরিটা নামিয়েছিলাম মনে আছে।

এতদিন মাছ-মাংসের বড় বড় হাড় কেটে কেটে হাত আমার যথেষ্ট পারঙ্গম। আমার হাত সপাসপ চলে।

ক’বছর আগে নিজেকে মিসেস নেয়ামুল বানাতে কত কসরত করতে হয়েছিল। আজ থেকে আমার জাহান আরা হয়ে ওঠার পালা। আচ্ছা, আমি কি জাহান আরা হয়ে উঠতে চাই? না কি ওই পাহাড়ি মেয়েটা? যে একটা স্প্রিংবোর্ডে ঠেলা দিয়ে পাহাড় চষে ফিরবে?

নেয়ামুলকে মোট সাঁইত্রিশবার ফ্লাশ করতে হল।

কিন্তু কী আশ্চর্য, ও পুলিশের গাড়িতে উঠছে?

আর আমিই বা কী করে ষ্ট্রেচারে শুয়ে আছি?

নেয়ামুলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার গন্তব্য কোথায়!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “short-story-hoe-othar-aagey

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *