শুভমানস ঘোষ
আমার শ্যালকের শ্বশুরবাড়ি অজগ্রামে। শ্যালকের শালির নামটা ভারি অদ্ভুত, নিম। তার চেয়ে অদ্ভুত শ্যালকের শ্বশুরবাড়ির গ্রামের নাম, পেটের বন। নিমেরই বিয়েতে শ্যালক আমাদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার শ্বশুরবাড়িতে। নইলে শ্যালকের শালির বিয়েতে কারই বা নেমন্তন্ন হয়? আর ক’জনই বা যায়? এটা ঠিক সম্পর্কের পর্যায়ে পড়ে না।
সারারাত ট্রেন জার্নির পর বাস, সাইকেল-ভ্যান ঠেঙিয়ে মোটামুটি বেলা দশটা নাগাদ স্ত্রী নবনীতাকে নিয়ে পেটের বনে পৌঁছে দমেই গেলাম। মাইক নেই। ম্যারাপ নেই। লোকজন নেই। হইচই নেই। বাড়ির দরজার সামনে একজোড়া কলাগাছ ব্যস। বোঝার উপায় নেই এই বাড়িতে আজ বিয়ে।
শহরের লোক বলে আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল একটু তফাতে একটা মাটির দোতলা বাড়িতে। ওটাই গ্রামের শেষ আস্তানা। তার পরেই হা-হা করছে মাঠঘাট আর বনজঙ্গল। আগে-আগে এসব জঙ্গলে বাঘ থাকত। এখন নেই।
জার্নির ধকলে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাড়াতাড়ি স্নান-খাওয়া সেরে লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে শরীর ঝরঝরে হয়ে গেল। নবনীতা সাজগোজ করে চলে গেল বিয়েবাড়িতে। বিয়ের লগ্ন রাত আটটায়। আমি বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম দেখতে।
চমৎকার গ্রামটা। নাকে নথপরা শ্যামলা কিশোরীর মতো সব গ্রামেরই সৌন্দর্য থাকে। তার উপর ভরাবর্ষা। দুপুরে একপশলা বৃষ্টি হয়ে আকাশটা তকতকে হয়ে গিয়েছে। স্নিগ্ধতায় আর সরসতায় ছলছল করছে চারপাশ। আনন্দে মন ভরে উঠল আমার।
খুব আনন্দের সঙ্গে মৃত্যুর কোথাও যেন মিল আছে। হঠাৎ আমার মনে এক সৃষ্টিছাড়া ভাবনা উড়ে এল। কে যে ভাবনাটা পাঠাল জানি না, শহরে আমার বাড়ি, তাও মনে হল মরলে এই গ্রামেই মরব। মরার পরে গ্রামের সকলকে যেখানে সৎকার করা হয় শ্মশানটা একবার দেখে এলে বেশ হয়।
ভাবতে ভাবতে পায়ে যেন পাখা গজিয়ে গেল আমার। নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। কোথায় যাচ্ছি, কোন অনাসৃষ্টির উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছি খেয়াল-হুঁশ নেই, বড় বড় পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। একে তাকে জিজ্ঞেস করে, গ্রামের মাঠঘাট, আলপথ ভেঙে ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর সন্ধের মুখে মুখে শ্মশানের দেখা মিলল। চোখ-জুড়ানো ছোট একটা গ্রাম্য নদীর তীরে ছিমছাম শ্মশান। নদীর অপর পাড়ে ঠাসা জঙ্গল। আকাশ ছুরির মতো কেটে ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে টিয়া-বকপাখির দল। পথের পাশে ঝোপেঝাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকছে অবিশ্রাম। মনে মনে বললাম, ‘বিউটিফুল!’
কেমন বিউটিফুল? প্রথম প্রেমিকার মতো? নাকি, দাম্পত্য-অসুখী পুরুষের পরস্ত্রীর যৌবনের মতো? আনন্দ যেন উচ্ছ্বসিত ধারায় নাচতে শুরু করল আমার শরীর জুড়ে। চারিদিক নির্জন থমথম করছে। নদীর তীরে বড়-বড় গাছগুলোর গুঁড়ি বৃষ্টির জল লেগে-লেগে কালো হয়ে গিয়েছে।
আমি শিশুর কৌতুহল নিয়ে গাছের নীচে ঘাসের উপর বসে ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন আঁধার নামবে। ঘুম ভেঙে শ্মশানসুন্দরী আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসবে। আমার দিকে তৃষা-বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলবে, ‘কোথায় ছিলে এতদিন? আমায় ফেলে কোন যুবতির কোলে মুখ গুঁজে পড়েছিলে ? নাও আমায়! বুকে বড় ক্ষুধা মোর।’
তার আশ্চর্য রূপ দেখে মোহিত হয়ে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলব, ‘তোমার রূপের আগুনে ফেলে আমায় ওই গাছের গুঁড়ির মতো কালো করে দাও। তোমার বুকের মালা করে দুলিয়ে নাও!’
আস্তে আস্তে চারপাশটা মলিন ও বিষণ্ণ হয়ে উঠছে। আকাশে অগ্নিপুরুষের অন্তিম আভা অন্ধকারের বিবরে প্রবেশের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাঁড়িকুড়ি, পোড়াকাঠ, মাদুর, কাঁথাকুথার মধ্যে কাঠকয়লার গুঁড়ো আর নদীর কাদামাটি দিয়ে মাটিতে একটা মানুষের অবয়ব আঁকা হয়েছে। খুব সম্ভবত আজকালের মধ্যে তার দাহকার্য হয়েছে এখানে। আকার-আকৃতি দেখে মনে হচ্ছে পুরুষ। কে এই মৃৎপুরুষ?
ভাবতে ভাবতে আমার ভাবনার স্বর জাগল আকাশে। ‘কে? কে?’ বলে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল পাখি। হাঁড়িচাচা? না, মাছরাঙা? চমকে মুখ তুলে তাকাতে দেখলাম আকাশটা যেন মরা মানুষের চোখ হয়ে গিয়েছে। নদীর জলের আঁশটানি গন্ধও যেন মড়া-মড়া বাস ছড়িয়ে নাকে ধক করে ধাক্কা মারল। মুখ নামিয়ে নদীর দিকে চেয়ে থ হয়ে গেলাম।
একটা লোক। খালি গা। পরনে নেংটি। নদীর জল ঠেলে এগিয়ে আসছে। ঘাড়ে বড়সড় একটা বোঝা। কী আছে ওতে? আমি চেয়ে রইলাম। একটু একটু অন্ধকার হয়ে এসেছে।
নদীর মাঝামাঝি বেশ জল। লোকটার হাঁটু ছাড়িয়ে উঠেছে। কষ্ট করেই বোঝা টানতে-টানতে উঠে এল পাড়ে। তারপর ঘাড় থেকে বোঝা নামিয়ে বসে পড়ল। ক্লান্তিতে বুক উঠছে-পড়ছে। কোমরের লুঙ্গি থেকে বিড়ি-দেশলাই বের করে ধরিয়ে টানতে লাগল। আমি উঠে পড়লাম।
গাছপালার জন্য লোকটা আমাকে দেখতে পায়নি। হঠাৎ চোখে পড়তেই মুখ থেকে বিড়ি ফেলে দাঁড়িয়ে পড়ল সটান। কালো কুচকুচে রঙ। কাঠি কাঠি হাত-পা। গাল-চোখ ভিতরে-ঢোকা চোপসানো মুখ। ঠোঁটে সাদা ছোপ। শ্বেতী? না, অন্য কিছু?
‘ভয় নেই। বসো! বসো! বিড়ি ফেললে কেন?’ লোকটাকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘কী নাম তোমার?’
লোকটার ভয় গেল না। আমার চোখে চোখ। বলল, ‘এজ্ঞে সনাতন।’
‘কোথায় থাকো?’
লোকটা নদীর ওপারের জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলল, ‘ধাইমণিপুর।’
‘সেটি কোথায়?’
‘এজ্ঞে ইখান ঠেঙে তিনকোশ হবেক।’
‘বোঝায় কী আছে?’
‘এজ্ঞে আমার পরিবার বটে বাবু।’
‘কী!’ আমি অবাক।
লোকটা বস্তার মুখটা নীচে করে জোরে ঝাঁকুনি দিতেই বেরিয়ে এল একটা মৃতদেহ। কুড়ি-বাইশ বছরের একটি নারী। গায়ে জামা নেই। কালাকুলো সোমত্থ ডাগর চেহারা। ছেঁড়া শাড়ির ফাঁকে ফাঁকে হাতছানি দিচ্ছে উদ্ধত যৌবন। মাথায় একঢাল চুল ও মমতামাখা সুন্দর মুখ। একেবারে ঢলঢল করছে। দেখে কে বলবে মারা গিয়েছে? জোর করেই চোখ সরিয়ে সরে গেলাম। লোকটা মৃতদেহ সৎকার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
দেখলাম, সৎকারে অহেতুক জটিলতার বালাই নেই এদের। পুরোহিত, মন্ত্রপাঠ দূরে থাক, পোড়ানোর কাঠেরও জোগাড় নেই। শ্মশান থেকেই আধপোড়া একটা কাঠ তুলে জ্বালিয়ে মৃতদেহের উপর ফেলে চলে গেল। সারারাত ধরে তার এখন সৎকার করবে নিশাচর প্রাণীর দল।
আকাশ মরে গেলেও, চারপাশ আঁধার করে এলেও আকাশের আলোর শ্বাস তখনও মৃদু হলেও বইছে। অস্পষ্টভাবে দেখলাম, নদী পেরিয়ে লোকটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। লোকটা না ফেলল একফোঁটা চোখের জল, না দিল একটা ডুব নদীতে, না ফেলে গেল সঙ্গের বস্তাটা। কী অদ্ভুত নিরাসক্ত এরা! শিশুর মতো কান্নাকাটি করে মরি আমরা ভদ্রলোকেরা।
লোকটা অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে এগিয়ে গেলাম। উপুড় করে শোয়ানো আছে বউটির মৃতদেহ। পিঠের উপর একটু আগুন তখনও ধুকধুক করে জ্বলছে। তাতে শরীরের কিছুই পোড়েনি। শুধু উপরের পাতলা চামড়াটা উঠে সাদা দাগ হয়ে গিয়েছে। মৃৎপুরুষের পাশে পড়ে থাকা আধভাঙা কলসিটা তুলে এগিয়ে গেলাম নদীতে। জল এনে ঢেলে দিলাম বউটির গায়ে। ফোঁস করে আগুন নিভে গেল। আমি বউটাকে চিত করে অপলক হয়ে গেলাম। দেখতে দেখতে পেটের বনে এসে যৌবনের বনে পথ হারিয়ে ফেললাম।
‘খিদে লেগেছে! অ্যাঁ, খিদে? যমের অরুচি কোথাকার!’
চমকে ‘কে?’ বলে ঘাড় ফিরিয়ে যা দেখলাম নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। আশ্চর্য কাণ্ড, মৃৎপুরুষে প্রাণসঞ্চার হয়েছে। উঠে বসছেন। প্রকাণ্ড মাথা। উন্নত কপাল। পরিপুষ্ট নাসা। দীর্ঘ কান। দৃঢ় চোয়াল। চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘কে আপনি?’
ঝটকা দিয়ে মৃৎপুরুষ উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলেন। ঠোঁটে অপার্থিব ব্যঙ্গের ছায়া, ‘নিজের বাপকেই চিনতে পারছিস না?’ আমার বাবা! বাবা তো কবেই মরে গিয়েছে আমার। মা মারা গিয়েছে তারও অনেক আগে। আমি তখন ছোট। চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল আমার।
‘নজর দিস না! ও তোর মা রে বজ্জাত!’ মাটির পুরুষ গর্জে উঠলেন, ‘দূর হ! নইলে রতনমণি আস্ত চিবিয়ে খাবে তোকে।’
গলা কেঁপে গেল আমার, ‘কে রতনমণি?’
উত্তর এল নদী থেকে। ফোয়ারার মতো জল ছিটিয়ে উঠে এল ভয়াল এক কুমির। করাতের মতো দাঁতের সারি মেলে হাঁ করে ছুটে এল আমার দিকে। আমি পালাতে গেলাম। পারলাম না। হাত-পা অসাড় হয়ে গিয়েছে। মৃত্যু কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা, হারানো পথ খুঁজে পেলাম, বউটা জেগে গেল এবার। চেঁচিয়ে বলল, ‘পালা! পালা! বাপের কথা শোন! বাপের থানে ছেলেরা থাকে না। থাকতে নেই। পালারে বেটা!’
এ কার গলা? বউটার দিকে চেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আরে মাটির পুরুষ তো ঠিকই বলেছেন। গ্রামের বউ ভেবেছিলাম। এ তো আমার মা! আমার নিজের মা! খুব দুষ্টু ছিলাম বলে ছেলেবেলায় আমায় ফেলে চলে গিয়েছিল। আর দুষ্টুমি করব না মা! তোমার কথা মেনে চলব। ছি! ছি! ছি!
আমি লাগালাম ছুট। ছুটছি! ছুটছি! ছুটতে ছুটতে শ্মশান ছাড়িয়ে গ্রামের রাস্তায় এসে পড়লাম। সামনে মশাল জ্বালিয়ে হরিবোল দিতে দিতে একদল শবযাত্রী আসছে।
পেটের বনে ফিরতে রাত হল। বিয়েবাড়িটা এতক্ষণে কিছুটা বিয়েবাড়ি-বিয়েবাড়ি বলে বোধ হচ্ছে। হ্যাজাক জ্বলছে। লোকজনের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। খাবার-দাবারের গন্ধ ভাসছে বাতাসে।
আমি এখানে নতুন। পথঘাট চিনি না। শ্যালক চিন্তায় পড়েছিল। আমাকে দেখে হাঁপ ছাড়ল। নবনীতারও মুখ শুকিয়ে এতটুকু। ছুটে এসে বলল, ‘কোথায় গিয়েছিলে? ঘেমেনেয়ে গিয়েছ!’
তখনও আমি হাঁপাচ্ছি। অনুশোচনায় বুক পুড়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললাম, ‘কাছাকাছিই ছিলাম।’
‘কখন থেকে তোমার জামা-প্যান্ট বের করে বসে আছি,’ নবনীতা বলল, ‘চলো! বর এসে গিয়েছে। বিয়ে শুরু হয়েছে।’
শ্যালকও তাড়া দিল, ‘যাও! যাও! তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো।’
আমার মাথায় তখনও শ্মশানের ঘোর। শ্যালককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে ধাইমণিপুর বলে কোন গ্রাম আছে জানো?’
শ্যালকের ভুরু উঠল, ‘বরের বাড়ি তো ধাইমণিপুরেই। নিমের বিয়ের কথাবার্তা বলতে গিয়েছিলাম। কেন বলো তো?’
আমি উত্তরটা পাস কাটিয়ে উত্তেজিত হলাম, ‘কই চলো দেখে আসি তোমার শালির বরকে।’ ‘পরে! পরে! আগে এসব বদলাও?’ নবনীতা গোলমাল করে উঠল।
আমি তার কথায় কান দিলাম না। এই অজগাঁয়ে কে আমাকে দেখতে যাচ্ছে বলে ভিড় ঠেলে সোজা ছাদনাতলায় চলে গেলাম। বরবউ বসে পড়েছে বিয়ের কাজে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছে। চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন। তাদের মধ্য দিয়ে গলা বাড়িয়ে বরের মুখের দিকে চেয়ে স্থির হয়ে গেলাম। ঠিকরে গেল চোখ।
কাকে দেখছি? এ তো অবিকল সেই সনাতন! বউকে পোড়াতে এনেছিল শ্মশানে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বরটি সেজে বসে আছে। সেই ভাঙা গাল। ঢোকা চোখ। ঠোটে সাদা দাগ। এক পরিবারকে বাবার থানে শুইয়ে আবার এসে আর এক পরিবারকে ঘাড়ে করে সেখানেই বয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করছে বসে বসে! সারা পৃথিবীতে কতজন সনাতন আছে? কত লক্ষ? কত কোটি? জন্মের পর জন্ম বনে-বনে, পথে-পথে ঘুরে মরছে বেকার! আমিও সেই জুতোয় পা গলিয়ে আর একটু হলে মরছিলাম আর কী! কেন যে পুরুষকে লোভী শরীর করেই জন্ম দেয় বিধাতা! কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না! কিচ্ছু না!
কিন্তু কিছু না বলে কিছুই নেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। সব কিছু হয়েই আছে। হয়েই থাকে। সেদিনই মধ্যরাতে তা যেন বৃষ্টি হয়ে এসে হঠাৎ করে ঘুম ভাঙিয়ে দিল আমার। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। ঘন ঘন মেঘ ডাকছে। নবনীতা জেগে বসে কাঁপছে। ঘরের ভিতর নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। খাটের নীচে অল্প আঁচে হারিকেন জ্বলছিল। সেটাও নিভে গিয়েছে।
‘কী হল?’ আমি বললাম।
নবনীতা আমায় জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করল, ‘আমার ভয় করছে।’
মায়ের কথা মনে পড়ল আমার। আমার মা। মাকে যে কথা দিয়েছি। কাঠ হয়ে গেলাম।
‘অ্যাই শুনছ?’ নবনীতা কানে-কানে ভয়ের কারণটাও জানাল, ‘নিমের বরটা ভাল হয়নি। কী দেখে যে দাদারা ওকে পছন্দ করল! নিমের জন্য কষ্ট হচ্ছে, জানো?’
বৃষ্টির তোড় আরও বাড়ল। বাইরে বনে একা একা ভিজছে গাছেরা। অলক্ষে কালো হয়ে যাচ্ছে তাদের গুঁড়ি। ভিজে মাটির গন্ধ ভাসছে। সঙ্গে থেকে-থেকে কোঁ-কোঁ আর্তনাদ। সাপে ব্যাঙ ধরেছে। নবনীতাও ধরেছে আমায়। নিমের চেয়ে সে কতটা ভাগ্যবতী এখনই সেলিব্রেট করতে চায়। এখনই! কিন্তু বাবার থানে যে ছেলেরা যায় না। দমচাপা বিকট ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম।
‘এমন করে আছ কেন?’ নবনীতা বিরক্ত হল, ‘একটু আদর করো না আমায়!’
তাও সাড়া দিচ্ছি না দেখে নবনীতাই আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলল আমায়। সনাতনের কথা মনে হল আমার। পেটে তার নিষিদ্ধ খিদে। কতদিনের বাসি খিদে? কত বছরের? কত জন্মের? নিঃশ্বাস আটকে এল আমার। হাঁসফাঁস করে ঠেলে সরিয়ে দিতে যাব নবনীতাকে, ধাক্কা খেলাম। এ কী! এ কার গায়ে আমার হাত? এই কাটা-কাটা হাত, কর্কশ পিঠ কার?
মাথায় বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল আচমকা। রতনমণি! রতনমণি! বাবার রতনমণি! পাপ করেছি। পালিয়ে যাব কোথায়? ঠিক এসে ধরেছে! তার মুখের আগুনে আমার ঠোঁটদুটো যেন পুড়ে যাচ্ছে। সাদা হয়ে যাচ্ছে। আমি সনাতন হয়ে যাচ্ছিলাম! লক্ষ-লক্ষ, কোটিকোটি সনাতনের একজন! তারই মতো মৃতের বোঝা ঘাড়ে করে বেঁকে-তুবড়ে আবার আস্ত একটা জন্মের নিরুদ্দেশ যাত্রা?
‘আমায় ছেড়ে দাও!’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘নবনীতা প্লিজ ছেড়ে দাও! ভাল লাগছে না!’
সঙ্গে সঙ্গে নবনীতা স্থির হয়ে গেল। আস্তে আস্তে তার ডালপালাগুলো ফিরে গেল শরীরে। পিঠের কাঁটাগুলো মিলিয়ে এল। মরে গেল নিঃশ্বাসের আগুন। আমার বুকে মুখ রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কেন ভাল লাগছে না? কেন? আমি কি ভাল নই? ভালবাসি না তোমায়? আমার মধ্যে কিছুই নেই?’
কী আছে নারীর শরীরে বাবাই জানে। আমি জানি এই নারী কেন ভয় পায়। কেন যে কাঁদে! আমার সব অনুশোচনার ভার কেটে অপূর্ব শান্তিতে মন ভরে গেল। সর্বাঙ্গে নীল বিদ্যুতের মতো খেলা করতে লাগল আনন্দ। আনন্দ! আনন্দ! এই আনন্দে বহুজন্মের পথ ধরে হেঁটে চলে গেলেও কেউ ক্লান্ত হয় না!
পরম যত্নে নবনীতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আদরে-আদরে ভরিয়ে দিতে থাকলাম তাকে। ম ম করে উঠল যৌবনের বন। কিন্তু তাতে যে চন্দনের সৌরভ! আমি আবার পথ হারালাম!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন