short-story-koto-debe-ora

কত দেবে ওরা?
মোজাফ্‌ফর হোসেন


রাত ১টা। চারিদিকের কোলাহল রাতের অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে। মাঝে মাঝে গাড়ির হর্ন আর নিজের হার্টবিট ছাড়া অন্য কিছুই শুনতে পায় না সফেলা।

বাসটি তেল পাম্পে এসে ভিড়ল। সফেলার ডান পাশের লোকটি প্রস্রাব করার জন্য তড়িঘড়ি করে নেমে পড়ে, বাম দিকের লোকটি নড়েচড়ে বসে—এতক্ষণ সে সফেলার ঝুলে যাওয়া বাম স্তনটি মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছিল। এদের দুজনার সহায়তায় আজ সফেলা অন্ধকারকে গ্রাস করে চলেছে দেহ-খাদক একদল পিশাচের ক্যাম্পে। ওরা ইচ্ছেমতো ভোগ করবে তাকে—উল্টে-পাল্টে, খাবলে-খুবলে খাবে তার কাকের ঠ্যাংয়ের মতো রসকষহীন শুকনো শরীর। প্রয়োজনে থাকতেও হতে পারে কয়েক রাত—বিনিময়ে টাকা; কিন্তু কত দেবে ওরা? দেহের ওপর অনেক ধকল যাবে ভাবতেই মুখখানা শুকিয়ে যায় সফেলার। সে ধকল না হয় সহ্য করলাম, কিন্তু কত দেবে ওরা—মনে মনে ভাবে সফেলা। তাকে যা দেয়া হবে তার দুই ভাগ আবার যাবে এই দালালদের পকেটে। প্রতিটা কারবারে মধ্যস্থতাকারীরা সবচেয়ে বেশি সুফল ভোগ করে, বেশ্যাবাজারেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। দালালদের সহায়তা ছাড়া যে সফেলার পক্ষে আর কোনও পার্টি ধরা সম্ভব না! বেশ্যাবাজারে তার দাম পড়ে গেছে। একটা সময় ছিল যখন আগে থেকেই দরদাম হাঁকিয়ে পা বাড়ানো যেত। কিন্তু এখন আর তার আগের সেই রসালো গতর নেই। ফুলে রস না থাকলে মৌমাছি বসবে কেন! তাই দামাদামি করতে গেলে হটিয়ে দেয় সকলে। সফেলা নীরবে মেনে নেয় সব।

দশ বছর আগের কথা মনে পড়তেই তার মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে ওঠে। এক সাহেব গোছের মানুষ—সফেলার বয়স তখন বাইশ কি তেইশ—ভরাট যৌবন দেখে সাহেবের তো একেবারে পাগল হওয়ার অবস্থা! সাহেব হলে কী হবে—লোকটি পাজি-নচ্ছাড়, বৌ-বাচ্চা রেখে চলে আসে সফেলার কাছে—সফেলাও কম যায় না, চেয়ে বসে এক হাজার টাকা! ভদ্রলোক এক কথাতেই রাজি। সফেলা টানা নিশ্বাস ছাড়ে নিজের অজান্তেই। এ সমাজটাই হচ্ছে নচ্ছাড়। সমাজের প্রতিটি লোক বেশ্যা, অথচ ভারটা বইতে হয় সফেলার মতো গুটিকতক অসহায় নারীকে। রাত হলে সমাজের কত হর্তাকর্তা লালা ফেলতে ফেলতে মাগী বাড়ির সন্ধান করে সফেলার তা ভালো করেই জানা। ওরাই বড় বেশ্যা অথচ সকাল হবার সাথে সাথে যেন এক একজন ধোয়া তুলসী পাতা।

গাড়ির শব্দ সয়ে যায় সফেলার। ভিতরের বাতিগুলো এখন বন্ধ। সকলে বোধ হয় তন্দ্রাচ্ছন্ন। বামের সিটে বসে থাকা দালালটির হাত আর নড়ছে না। রাস্তায় হালকা আলো-ছায়া সফেলাকে ভেংচি কেটে সরে পড়ছে দ্রুত। রাতের নীরব আত্মা তাকে শাসিয়ে যাচ্ছে ঘনঘন। দিনের আলো সফেলার গায়ে কাঁটাতারের মতন বিঁধে—অপমানে, লজ্জায় কুঁকড়ে যায় তার সর্বাঙ্গ, অথচ রাতের পৃথিবীতে সে পানির মধ্যে মাছের মতন খুবই স্বাভাবিক। দিনের আলোয় যারা ভালো মানুষের মুখোশ পরে সভ্যতার নকশা তৈরি করে, রাতে তাদের নগ্ন চেহারা দেখে সফেলার খুব করুণা হয়। সফেলা তো এই সমাজেরই একজন, সমাজের প্রতিটি মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে সেও বেঁচে থাকতে চাইছে। বেশ্যা শব্দটা যদি এতটাই ঘৃণার হবে তবে আসল বেশ্যা তো ওরা, যারা ঘণ্টায় ঘণ্টায় মুখোশ পাল্টায়, রাজত্ব করে ভণ্ড সভ্যতার!

এতসব বোঝে না সফেলা। এত বোঝবার জ্ঞান তার নেই। সমাজের শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা তার কাছে জ্ঞান দিতে যায় না, যায় তাদের পাশবিক চেতনাকে উগরে দিতে।

গাড়িটা প্রধান সড়কের এক কোণায় থামল—দশ মিনিটের বিরতি। দুয়েকটি দোকান এখনও খোলা। বামপাশের লোকটি বিড়ি কিনতে নেমে যায়, সফেলা বুকের কাপড়টা ঠিক করে আলোতে মুখটা আলগে ধরে, চোখ পড়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চকচক করতে থাকা বি-গ্রেড সিনেমার পোস্টারের দিকে। অর্ধ-উলঙ্গ নায়িকাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সফেলা। এখানেও নারীর শরীর বিক্রি হয়। সমাজের এই উঁচু শ্রেণির বেশ্যাদের দেখে হিংসে হয় তার। সমাজে এদের বেশ কদর আছে, টাকাও পায় ঢের বেশি। আচ্ছা, এরা কি সুখ পায়, নাকি আমার মতো যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় পুরা শরীর? ছবির ওপরে দণ্ডায়মান ল্যাম্প-পোস্টটিকে প্রশ্ন করে সে। প্রচণ্ড সুখে যখন খদ্দেরদের মরে যেতে ইচ্ছে করে তখন আহত সফেলা খুব কষ্ট করে জানটাকে ধরে রাখে। পঁচিশ বছরের বেশ্যাজীবনে মাসিকের সময় যে শান্তিটুকু পেয়েছে সে, এছাড়া আর অবসর মেলেনি জীবনে। প্রথম যেবার মাসিক হয়, কী গালিটাই না দিয়েছিল মাসিককে! কী ভয়ানক রক্ত দলা বেঁধে শরীর থেকে নেমে আসে, ব্যথায় কুঁকড়ে যায় তলপেট, নারীজীবনে এর থেকে অভিশপ্ত আর কিইবা হতে পারে! ভেবেছে সে। তখন কি আর জানত সে—এই বীভৎস ঘটনাটাই তার জীবনে সব থেকে কাঙ্খিত হয়ে দাঁড়াবে!

রাত ২টা। সফেলার মনে হচ্ছে গাড়িটা অন্ধকারকে আঁকড়ে তরতর করে বয়ে চলেছে অজানা এক শঙ্কার দিকে। বাড়িতে তার আট ও দশ বছরের মেয়ে দুটো একা। ছেলেটা ছ’মাস ধরে জেলে। ছাড়াতে অনেক টাকা লাগবে। পুলিশের মন ভরানোর মতো বয়স ও টাকা কোনওটাই তার নেই। ছেলেটা গেছে, এখনও সময় আছে মেয়ে দুটোকে রক্ষা করার। সফেলা অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আজকের রাতটিই হবে তার বেশ্যাজীবনের শেষ রাত; ওরা যে ক’টা টাকা দেবে তা নিয়েই মেয়ে দুটোকে সঙ্গে করে এ সমাজের কোনও এক গর্তে ঘাপটি মেরে পড়ে রইবে। টাকার কথা মনে হতেই হার্টবিটটা বেড়ে যায়। বুক থেকে দালালের হাতটি সরিয়ে নিজের হাতটি শক্ত করে চেপে ধরে সেখানে যেন জানটা বেরিয়ে না যায়। আচ্ছা, কত দেবে ওরা, নাকি খালি হাতেই ফিরতে হবে? এই সংশয়টি তার সকল সংশয়কে পিছনে ফেলে পথ আটকে দাঁড়ায়। একটা সময় ছিল যখন ওরা রূপের ঝলক দেখে দু’হাত ভরে দিত। তাইতো বেশ্যাবাজারে সকলে হিংসে করত তাকে। এমনকি সতী-সাধ্বী নারীরাও আড়ালে-আবডালে সফেলার মতো হতে চাইত। অথচ আজ ঝুলন্ত আর ঢিলেঢোলা গতর দেখে সকলে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এ ব্যবসায়ে কচি দেহ বিকোয় বেশি। তাই তো সুযোগ পেলেই প্রতারণা করে সবাই, সফেলাকে সহ্য করতে হয় নীরবে—এ প্রতারণার যে কোনও বিচার নেই, আইন-আদালত নেই, আর থাকলেই বা কী এমন লাভ হতো! এদের ‘করুণাতেই’ যে সফেলারা বেঁচে থাকে!

গাড়ি এসে থামে গন্তব্যে। দালাল দুজনের পিছন পিছন সফেলাও নেমে পড়ল হিড়হিড় করে। আচ্ছা কত দেবে ওরা? ফিসফিস করে বলল নিজেকে। আঁচলের গিঁট থেকে একটা বড়ি বের করে গুঁজে দিল মুখে, দেহ অবশ করার এই কায়দাটা ওর সাথেই থাকে। বেশ কয়েক কদম হাঁটার পর পৌঁছল নরপশুদের ক্যাম্পে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, বিশ্রী রকমের গরম পড়েছে আজ। মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়েই মেঘের মধ্যে লুকিয়ে পড়ছে চাঁদ। ‘সই, তোর যৌবনের ধার একটু ধার দিবি আমাকে?’ সফেলা কতবার বলেছে এ কথা! আজ তার মেজাজটা আছে বিগড়ে। ‘মাগী, ছিনালিপনা করিস আমার সাথে? হাতের কাছে প্যালি তোর মাতার চুল ধরি স্যাটায় ধান ভাংতাম!’ সফেলা মন্ত্র পড়ার মতো বিড়বিড় করে বলে। দালালের একজন এগিয়ে যায় দরজার দিকে। অন্যজন সফেলার হাত দুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে চচ্চড় করে পেশাব করতে থাকে। কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে একটা ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘কে? কোন হ্যালায় বে এই অসময় দরজা হেটকায়?’ সফেলার বাম পাশের লোকটি একটু বিনয়ের সুরে বলে, ‘আমরা সাব, মাল লইয়া আইছি’। ভেতর থেকে আর কোনও সাড়াশব্দ আসে না। সফেলা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে জানতে চায়, ‘কত দেবে ওরা?’ ডানদিকের লোকটা আন্ডারউয়ারের ফিতে বাঁধতে বাঁধতে খিঁচুনি দিয়ে বলে উঠল, ‘চুপ কর খানকি, এত্ত ঠাপ খেয়েও কামড় মেটেনি!’ ততক্ষণে ভেতর থেকে একটা তৃপ্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘আজ আর লাগব না; আমরা কম বয়সি এক ছুড়ি পাইছি। অন্যদিন নিয়া আসিস’।

‘ধুর শালা! রাতটাই মাটি। মাগির পেছনে খরচ যা করছি তার কিছু তো উসুল করি,’ বলে সফেলার শাড়ি ধরে টান মারে এক দালাল। সফেলা দাঁড়িয়ে থাকে নিরুত্তর—আরও একটি রাতের অপেক্ষায়; কিন্তু কত দেবে ওরা?

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *