short-story-mobile

মোবাইল
রাসয়াত রহমান জিকো


আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামে বড় হয়েছি। গ্রামের পথঘাট, নদী আমার চেনা। আমি কাদাপাঁকে হোঁচট না খেয়ে হাঁটতে পারি। চঞ্চলতায় ভরা জীবন আমার। শহরে চাচার বাসায় গিয়ে যখন থাকা শুরু করলাম তখন খুবই হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করলাম। এর আগে বেড়াতে গেলে টুকটাক যখন থাকতাম তখনকার বিষয়টা ভিন্ন। কিন্তু ইন্টার পাসের পর একবারে একা ভিন্ন শহরে আপাতদৃষ্টিতে পরিচিত আসলে শূন্য এক জীবনে থাকা শুরু করলাম। কেন জানি আমার তখন নিজেকে রবীন্দ্রনাথের ফটিকের মতো মনে হতে লাগল। তবে ফটিকের বয়সের থেকে আমার বয়স বেশি ছিল। ১৭-১৮ বছর বয়সের ছিলাম। ফটিক ছিল ১৩ বছরের।

গ্রাম থেকে বিদায় নেওয়ার ঘটনা আমার এখনও মনে আছে। মা বলল, ‘মাশরিকুল বাবা ভালোমতো থাকিস। আমি চাই না তুই হলে থাক। হলে নাকি পোলাপাইনদের পিটায়।’ মা আসলে ভয় পেয়েছিল আমাকে নিয়ে। কয়েক বছর আগে কি এক ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে মেধাবী এক ছাত্রকে পিটিয়েই মেরে ফেলে। মা এই ঘটনা সহ্য করতে পারে নাই। সেই ঘটনার পরেই মা মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে দেখত আমি রুমে আছি কি না। আসলে আমার মাও তো সন্তানহারা মা। আড়াই বছর বয়সে পুকুরে ডুবে মারা যায় আমার এক ভাই। যোহরের নামাজ পড়ে মা ঘুমিয়ে গেছিলেন। বাবা ছিলেন কাজে। আমার ভাইও ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ মা ঘুম থকে উঠে দেখে ভাই নাই বিছানায়। নিজের থেকেই নেমে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরে চলে যায়। বাবা ক্ষেতে কাজ করার সময়ই ঘটনা শুনে। বাসায় এসেই কোরআন শরিফ নামিয়ে খতম দেওয়া শুরু করেন। খতম শেষ করে বলেন, পৃথিবীর সব থেকে ভারি জিনিস সহ্য করার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন কিনা বুঝতে পারছি না। কষ্টে আমার শরীর কেঁপে উঠছে।

আমার পুরা নাম মাশরিকুল হুদা। স্কুলে আমার বন্ধুরা ডাকত বেহুদা। কী জন্য ডাকত বলতে পারব না। তবে আমি বেহুদা না। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি ভালো-মন্দ বিবেচনা করে চলা ছেলে। লেখাপড়া করার জন্য আমাকে কখনও কিছু বলতে হয় নাই। নিজের মতো করেই বই নিয়ে পড়তে বসি ছোটবেলা থেকেই। শিক্ষাদীক্ষা যে আমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে সেটা আমি বিশ্বাস করি। আমার চাচা যেমন অনেক বড় এক অফিসার এখন। আব্বারা দুই ভাই ছিলেন। দুইজনকেই লেখাপড়া করানোর সামর্থ্য দাদার ছিল না। উদারতা দেখান আমার বাবা। তিনি বলে ক্ষেত ক্ষামার আমি সামলাব, বোরহান লেখাপড়া করুক। আমার চাচা বোরহান তাই এখন অনেক বড় অফিসার, অনেক ক্ষমতাবানও শুনেছি। চাচা গ্রামে আসলে আশেপাশের সবাই দেখতে আসে। চাচা গ্রামের উন্নয়নের জন্যও অনেক কিছু করেছেন।

ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েই তাই উঠলাম চাচার বাসায়। উঠার পরেই বুঝলাম রবীন্দ্রনাথের ফটিকই হতে যাচ্ছি। আমার চাচি ফটিকের মামির মতোই। বই হারাইলে এই চাচি অবশ্যই বলবে আমি তোমাকে প্রতি মাসে বই কিনে দিতে পারব না। চাচাতো ভাইয়ের নাম স্যাম, চাচাতো বোনের নাম মারিয়া। স্যাম প্রথম দিনই বলে দিল, তার রুমে জানি না ঢুকি। মারিয়া কিছু বলেইনি, আপাদমস্তক আমাকে দেখে বিরক্ত হয়ে চলে গেল। তবে ডুপ্লেক্স বাসায় তাঁরা থাকে উপরে, আমি নীচে। প্রায় চাকর-বাকরদের পাশেই, তবে রুম খারাপ না। ইজ্জত আসলে যেত চাকর বাকরদের সাথে খেতে দিলে, তবে তা হয়নি। ডাইনিং টেবিলে একসাথেই বসতাম। ইজ্জত বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। যদিও আমার এমন চিন্তাও আসলে সংকীর্ণই। চাকর-বাকরও আমার মতো মানুষই। ভাগ্য তাদের গরিব বানিয়েছে। তাদের সাথে খানা খাওয়া কখনওই ইজ্জত কমার মতো কিছু না। কেবল এই শহর আমাকে কেমন করে জানি ভাবতে শিখিয়েছে।

চাচার আচরণ অবশ্য খারাপ ছিল না। হাজার হোক তাঁর আপন ভাইয়ের ছেলে আমি। লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞেস করতেন নিয়মিত। মাঝে মাঝেই মনে করায় দিতেন লেখাপড়া না করলে এই শহরে থাকার মানে নাই। এটা আসলে আমার ভালো চান বলেই বলতেন। এটা বুঝি।

চাচি আমাকে সহ্যও করতেন না আবার একবারে জীবন অসহ্য করে ফেলেছেন তেমনও না। মাঝামাঝি বলা যায় আর কী। বাসার বাজার-টাজার আর টুকটাক কাজে আসতাম এটা আসলে চাচি তাঁর বাসায় অবস্থানের বিনিময় হিসেবে দেখতেন। আমি খুশি ছিলাম। চাচি তো আর মা হবে না। কখনও হয়ও না। আশা করাও বোকামি।

স্যাম এমনিতে ভালোই ছিল তবে তার বন্ধুদের সামনে দুমদাম অপমান করে বসত। কমোড ইউজ করতে পারি কিনা এটা জিজ্ঞেস করত। এটা কেমন কথা ভাই! গ্রাম থেকে এসেছি বলে যে, কিছুই জানি না তা তো না। পড়াশোনার বিদ্যে-বুদ্ধি তো ভিতরে আছে। আমি নিশ্চিত, অ্যাকাডেমিক পড়াতে আমার সাথে স্যাম পারবে না। এখন সে এক পরিবেশে মানুষ হয়েছে আর আমি অন্য পরিবেশে। তবুও কিছু বলি না, হেসে উড়িয়ে দিই।

মারিয়ার ব্যাপার জানি না। খুব অহংকারী মনে হত তাই কথা বলতাম না। একবার শুনলাম সে কি এক মোবাইল ইউজ করে, অনেক দামি এক ফোন। আমার বাপের জন্মে নাকি আমার পক্ষে কিনা সম্ভব না। আসলে অসাবধানতাবশত একদিন ধাক্কা খাই ওর সাথে। ওর হাত থেকে সেই ফোন পরে যায়। তখন শোনা লাগে এই কথা।

মারিয়ার একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল, নাম রাব্বি। বাসায় চাচা-চাচি না থাকলে এই ছেলে লুকায় লুকায় এসে সময় কাটাত মারিয়ার সাথে। বাইরেও কয়েকবার দেখেছি মারিয়ার সাথে এই ছেলেকে।

মারিয়ার ফোন একদিন বাসা থেকেই চুরি যায়। চাচা ছিলেন বিদেশে। চাচি পুলিশ ডাকে। পুলিশ এসে সবার সাথে আমাকেও ধরে নিয়ে যায়। এক দিন ছিলাম জেলে। চাচা পরের দিন বিদেশ থেকে ফিরে আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। আমি এরপর আর কোনোদিন চাচার বাসায় যাইনি। সেদিনই চাচার বাসা থেকে হলে উঠি। চাচার বাসার এই অপমানের থেকে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে হলের পোলাপাইনের হাতে মাইর খেয়ে মরে যাওয়া ভালো বলে মনে হইল। নিজের খরচ নিজে চালাই। টিউশনি করি, আর এক বন্ধুর মোবাইলের দোকান আছে সেখানেও কাজ করি।

ভার্সিটি থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়েই বের হলাম। ভালো চাকরিও পেলাম। তবে চাচার বাসায় আর যাই নাই। বাবা অনেক জিজ্ঞেস করেছিল কী হয়েছে, কখনও বলি নাই। তারপর একদিন শুনি আমার সাথে নাকি মারিয়ার বিয়ে ঠিক করছে বাবা আর চাচা মিলে। কাজিনের সাথে কাজিনের বিয়ে নাকি জায়েজ আছে। সেটা সমস্যা না কিন্তু মূল কাহিনি তো আমি জানি। বহু বছর পর গেলাম চাচার বাসায়। মারিয়ার রুমে গিয়েই মারিয়ার সাথে দেখা করলাম।

‘কেমন আছো মারিয়া?’

‘ভালো, তুমি?’

‘আমার মতো খ্যাতকে বিয়ে করবা কেন?’

‘আমি আসলে সরি। কিন্তু তুমি এখন খ্যাত নাই আর।’

‘গ্রামের ছেলে ছিলাম দেখেই খ্যাত বলবা? না হয় বুঝতামই কম। তোমাদের মতো সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তো আর বড় হই নাই।’

‘তুমি কি কিছু বলতে আসছ?’

‘হ্যাঁ, তোমার বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করা লাগবে না। তোমার কোনো ভয় নাই।’

‘বুঝলাম না।’

‘মোবাইল আমি চুরি করি নাই। রাব্বি করেছিল। তবে লাভ হয় নাই। সে লক খুলতে পারে নাই। লক খুলতে যেখানে গিয়েছিল, সেই দোকানে আবার আমি কয়েকদিন কাজ করেছিলাম। বুঝোই তো! তোমারদের বাসা থেকে বের হয়েই কাজ পাই নাই ইনকাম তো করতে হবে।’

‘আচ্ছা।’

‘রাব্বি অবশ্য আমাকে দেখেনাই। দোকানের মালিকের কাছে মোবাইল দিয়ে গেছে। আমি পরে খুলে দেখি অবস্থা খারাপ।’

‘কী বলো?’

‘হ্যাঁ, তোমার ঐ সব ছবি-টবি সব সেখানেই ডিলিট করে দিছি। ভয়ের কোনো কারণ নাই। রাব্বি তোমাকে যে ভয় দেখাইতেছে সেগুলা সব ফাও। নিশ্চিন্তে নিজের মতো থাকো।’

‘কিন্তু আমি বাধ্য হয়ে তোমাকে বিয়ে করতে চাই কে বলল? পছন্দ করেও তো করতে পারি!’

‘আমাদের মধ্যে কখনও কোনও ভালোবাসা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কথাই বলি নাই আমরা কখনও। আমি মোবাইল চোর না, বুঝছ! যখন আমাকে তোমরা মোবাইল চোর অপবাদ দিয়ে একদিন জেলে রাখছিলা তখনও আমি গ্রামের সেরা ছাত্র ছিলাম। গরিব বা তোমার ভাষায় খ্যাত হইতে পারি কিন্তু ব্যক্তিত্ব আছে এটা বুঝাতে আসছি। এর বাইরে কিছু না। কোনও না কোনও ভালো ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হবে আমি নিশ্চিত। তোমার মোবাইল নিয়ে আসছি। রেখে দাও। বিনিময়ে একদিন জেল খাটা লাগবে না।’

গ্রামে যাচ্ছি অনেক দিন পর। চাচার মতো অফিসার হতে পেরেছি কি না জানি না। তবে হয়েছি কিছু একটা। আমার দেখেও মানুষ ভিড় জমাবে। কুশলাদি জিজ্ঞেস করবে। আমি ওদের গল্প বলবো। হলের গল্প, মোবাইল মেকানিক হিসেবে আমার জীবনের গল্প। বর্তমানে এক সরকারি অফিসারের গল্প।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “short-story-mobile

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *