short-story-takuyamenon

টাকুয়ামেনন
সুজয় দত্ত


ছোট্ট একটা নাম-না-জানা হলুদ রঙের পাখি সামনের জুনিপার গাছটার ডালে বসে শিস দিচ্ছে মাঝে মাঝে। ব্যস, এছাড়া আর একটাই শব্দ। জলের। অনেক দূর থেকে শোনা যায়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রচণ্ড বেগে গড়িয়ে আসা এই বাঁধন-না-মানা, দুরন্ত, সফেন জলরাশি অনেকটা নীচে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে যেখানে, সেখানটা ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্ট। জলের ছোট ছোট ঘূর্ণি ইতস্ততঃ জেগে থাকা ডুবো-পাথরের মাথাগুলোকে ঘিরে। আর তারপর আঁকাবাঁকা নদী কুলকুল করে বয়ে চলে গেছে ঘন গাছগাছালিতে ঘেরা রহস্যময় বনপথে। সন্ধ্যা নেমে এল প্রায়। ধারেকাছে কোথাও কেউ নেই। একা আমি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ডুবে রয়েছি সেই জলতরঙ্গের মূর্ছনায়। এপ্রিলে এখানে বসন্ত ঠিক নয়, বসন্তের প্রস্তুতিপর্বের শুরু। দমকা, জোলো হাওয়ায় এখনো সদ্য-বিদায়-নেওয়া শীতের বরফগলা স্পর্শ। সেই হিমশীতলতা আমার মুখে, মাথায়, শরীরের অন্যত্র ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি অনুভব করছি না। ভেতর থেকে এক গভীর ভালোলাগার উষ্ণতা আমার সমস্ত চেতনাকে জড়িয়ে রয়েছে এই মুহূর্তে। ক্রমশঃ গাঢ় হয়ে আসা অন্ধকারের পটে এক নির্জন, চিরসবুজ বনানীর বুকের মধ্যে লুকোনো এই রঙীন জলপ্রপাত যেন একটা কবিতা— বারবার পড়েও পড়ার সাধ মেটে না। ইস, এই কবিতাটা যদি এক্ষুণি তাকে পাঠাতে পারতাম— যাকে নিয়ে আমার হৃদয়ের খাতায় পাতার পর পাতা কবিতা!

হ্যাঁ, রঙিন জলপ্রপাত। টাকুয়ামেননের জল যে লালচে-খয়েরি আর হলদে-বাদামি, সেটা এখানে আসার আগে জানতাম না। এর বৈজ্ঞানিক কারণ লেখা আছে কাছেই একটা বাঁধানো ফলকে, কিন্তু এই মুহূর্তে তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমি এখন শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি এক মগ্ন, নীরব চিত্রকরের নিপুণ তুলিতে আঁকা এই জলরঙের ছবির দিকে; আর আবিষ্ট হয়ে শুনছি তার নিরবচ্ছিন্ন আবহসংগীত। সময়ের খেই হারিয়ে অন্ধকারে কতক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না, একসময় পার্ক রেঞ্জারের গলা এল কানে। বন্ধ হয়ে গেছে পার্ক, যেতে হবে এবার। তীব্র অনীহা নিয়ে পা বাড়ালাম। এযাত্রা আর ফেরা হবেনা এখানে। বেড়ানোর মেয়াদ ফুরিয়েছে। কাল সকালেই অনেকটা পথ গাড়ি চালিয়ে এখান থেকে বাড়ি, তারপর এয়ারপোর্ট থেকে এয়ারপোর্টে দীর্ঘ ক্লান্তিকর উড়ানের শেষে দুই মহাদেশ পেরিয়ে পৌঁছব আমার আসল বাড়িতে — যেখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। সেখানে আমার জন্য প্রতীক্ষায় আছে আরে এক শিল্পী। না, সে ছবি আঁকে না। গান গায় ভালো। কিন্তু আমি তাকে নিয়ে মনের ক্যানভাসে এঁকে চলেছি অজস্র রঙের ছবি। আর লিখে চলেছি কবিতা। গত প্রায় বছরখানেক ধরে। ওর সঙ্গে ফোনে-ফোনে, আন্তর্জালে আলাপ হওয়ার পর থেকেই। দুজনের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল বিস্তর। তাই প্রথম পরস্পরকে কাছে পেতে লেগেছিল ছ’মাস। গতবছর মাত্র কয়েকদিনের ছুটিতে উড়ে গেছিলাম যখন। তখনই প্রথম মুখোমুখি দেখা, নিবিড় করে চেনা, আর অগ্নিসাক্ষী রেখে জীবনের পথে একসাথে চলার শপথ। বাড়ির সবাই ওকে পেয়ে তৃপ্ত, কিন্তু একবুক অতৃপ্তি নিয়ে আমাকে ফিরে আসতে হয়েছিল একা। জীবনসঙ্গিনীকে পাশে পাওয়ার আগে নিয়মকানুনের কিছু বেড়াজাল ডিঙোতে হবে, সময় লাগবে তাতে। সেই ব্যাকুল অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে এবার।

‘সত্যি, না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না জলের এমন রং হতে পারে।’

কথাটা এল আমার বুকের কাছ থেকে। ওর একরাশ সুগন্ধী চুল আমার কাঁধের ওপর ছড়িয়ে বুকে মাথা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে বসে আছে পর্ণা। পার্কের এক গাছপালাঘেরা নির্জন কোণে একটা বেঞ্চে। এখান থেকে ডানদিকে তাকালে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে জলপ্রপাতটা একটুকরো দেখা যায়। হ্যাঁ, টাকুয়ামেননের সঙ্গে গত বছরের সেই প্রথম দেখার প্রায় তেরো মাস বাদে আবার এসেছি তার কাছে। এবারে গাড়িতে পাশের সিট যেহেতু ফাঁকা ছিল না, হাসিতে-গল্পে-গানে এতটা লম্বা যাত্রাপথ কখন কেটে গেছে টেরই পাইনি। জুনের গোড়ায় এখানকার আবহাওয়া মনোরম, তাই দর্শনার্থীর সংখ্যা সামান্য বেশি, যদিও তেমন ভিড় নেই। অনেকক্ষণ কাছ থেকে সকালের রোদ-ঝিকমিক জলরাশির সেই রঙিন পর্দাকে দুচোখ ভরে দেখার পর ক্লান্ত হয়ে কোথাও বসতে চাইল পর্ণা। সেই থেকে দুজনে এই বেঞ্চে বসে বসে জলের শব্দ শুনছি। নাকি তিনজন? ওর শরীরের মধ্যে তিলতিল করে বেড়ে উঠছে যে আসন্ন অতিথি, তার কানে কি পৌঁছচ্ছে এই সলিল-সুরঝংকার? আর মাত্র কয়েকমাস পরেই তাকে দেখতে পাব— একথা ভাবলে রোমাঞ্চ লাগে।

হঠাৎ পর্ণা বাঁদিকে অনেকটা দূরে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘আরে, ওটা তোমার সেই অফিস কলিগ না? আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে।’

ঘুরে দেখি হ্যাঁ, ওই তো নীলাভ্র! ও এখানে আসছে জানতাম না তো! নীলাভ্র রায় আমারই অফিসের অন্য ডিপার্টমেন্টে। সুঠাম, সপ্রতিভ, সুরসিক। ভালো পারকাশন বাজায়, একটু-আধটু গিটারও। একদিন নেমন্তন্ন করেছিলাম বাড়িতে, পর্ণাকে নিয়ে আসার পর। ভালোই হল দেখা হয়ে আজ। একসঙ্গে দুপুরের খাওয়াটা বেশ জমবে।

‘বাবা, ক্যান ইউ ফাইন্ড মি নাও?’

কচি গলার ডাকটা কানে আসতেই চোখ বোজার ভান করে বলতে হল, ‘না তো!’

নাহলেই মেয়ের অভিমান হবে, কাঁদতে কাঁদতে এসে বলবে, ‘ইউ আর চিটিং। ওন্ট প্লে উইথ ইউ।’ কিন্তু লুকোচুরি খেলতে খেলতে ওর ওপর নজর রাখতেই হচ্ছে সবসময়। এই পার্কে প্রতিটা পিচবাঁধানো রাস্তা বা ট্রেলই ঘন গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে গেছে। আমি সত্যি চোখ বন্ধ করে থাকলে ওই ছটফটে মেয়ে কোথায় কোন গাছের আড়ালে গিয়ে লুকোবে— খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে তখন। সাড়ে চার বছরেই যা দুরন্ত হয়েছে, হিমশিম খেতে হয় সামলাতে। টাকুয়ামেনন স্টেট পার্কে এই প্রথমবার বেড়াতে এসে ও তো অতি উৎসাহে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। একবার বলছে ট্রেল ধরে জলপ্রপাতের একেবারে তলায় গিয়ে জল ছোঁবে, আবার বলছে সামনের পাহাড়টার মাথায় উঠে ফল কালার দেখবে, পরমুহূর্তেই বলছে বনের মধ্যে বুনোফুল আর প্রজাপতি খুঁজতে যাবে। অবশ্য ওকে এমন খুশীতে উচ্ছল দেখব বলেই তো লেবার ডে-র সপ্তাহান্তে এখানে নিয়ে আসা। ওর মা সঙ্গে এলে আরও মজা হত, কিন্তু তার ঠিক এই সময়েই পরপর গানের প্রোগ্রাম পড়ে গেল। মেয়ে অনেকদিন থেকে বায়না করছিল কোথাও বেড়াতে যাবে বলে, তাই পর্ণাই আমাকে বলল নিয়ে যেতে। ও নিজে এখন গাড়ি চালাতে পারে, সুতরাং অসুবিধে নেই। তাছাড়া গানের অনুষ্ঠানে তো যাবে নীলাভ্রর সঙ্গে। ওরা দু’জন আর দুই আমেরিকান ইন্সট্রমেন্টালিস্ট মিলে একটা অ্যামেচার দল বানিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে বেড়ায়। মেয়ে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এ-ব্যাপারে নিয়মিত সময় দিতে শুরু করেছে পর্ণা। নীলাভ্রও যথেষ্ট সময় আর উৎসাহ দেয়। ওর স্বপ্ন এই দলটা একদিন পেশাদার হবে, রীতিমতো অ্যাডভান্স আর পারিশ্রমিক নিয়ে অনুষ্ঠান করবে। ও তো পর্ণাকে রাতদিন বলে মেয়ে আরেকটু বড় হলে বাড়িতে গানের স্কুল খুলতে। অনেকে শিখতে চাইবে। আমি অবশ্য বলি গানটা নেশা হয়েই থাক না— শিল্পের সঙ্গে ক্যারিয়ার মেশালে তার আনন্দটা চলে যায় না? যাই হোক, এটা স্বীকার করতেই হবে যে নীলাভ্রর মতো একজন আছে বলেই পর্ণার এতো সুন্দর গানের গলাটা কাজে লাগছে।

‘বাবা, আই অ্যাম হাংরি। ক্যান উই গেট সাম লাঞ্চ?’

ব্যস, ওপরওয়ালার নির্দেশ এসে গেছে, এবার তো যেতে হবে লাঞ্চের সন্ধানে। দৌড়ে এসে আমার কোলে উঠে পড়ে তুলতুলি।

পুরু, ধবধবে বরফের এক সর্বব্যাপী, কঠিন আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে প্রকৃতির রঙিন ক্যানভাস। যেন চিত্রকরের ষ্টুডিও এখন বন্ধ কয়েক মাস। সেই লাল-খয়েরি লিকার চা আর সোনালী-হলুদ সুরার নিরন্তর স্রোত এখন রুদ্ধ, সেই অবিশ্রান্ত ধারাপাতের শব্দমুখর বন এখন স্তব্ধ। চারিদিকে এক জমাটবাঁধা শূন্যতার হাহাকার। সেই পুরনো স্মৃতিমাখা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে শীতের বৈধব্যরূপে দেখছি টাকুয়ামেননকে, আর ভাবছি এ কীসের দৃশ্য? আমার মনের ভেতরের, না বাইরের? শেষ যেবার এসেছিলাম মেয়ের হাত ধরে, তারপর দীর্ঘ এক দশকে এই টাকুয়ামেনন দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। আমার জীবননদী বেয়েও। সেদিনের সেই ছোট্ট তুলতুলি আজ হাইস্কুলে পড়া টিনএজার। তবু মাঝেমাঝে যখন আমার কাছে থাকে, অনর্গল হাত-পা নেড়ে বলে যেতে থাকে যত রাজ্যের জমা কথা— পড়াশোনার, বন্ধুবান্ধবের, এক্সট্রাকারিকুলার্সের— কোথায় যেন সেই বাবার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা আর আবদার করে কোলে চড়তে চাওয়া তুলতুলিকেই খুঁজে পাই। ইচ্ছে করে প্রতিটা মুহূর্ত ওকে আঁকড়ে থাকতে। কিন্তু না, তা আর সম্ভব নয়। ওকে যে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রায়ের কাছেও সময় কাটাতে হবে। অন্তত আইন তাই বলে। ‘অক্টেভ স্কুল অফ মিউজিক’ আর ‘মেলোডিজ অন হুইলস’ ট্রাভেলিং ব্যান্ডের দুই কর্ণধার নীলাভ্র আর পর্ণা রায় সপ্তাহের যে দিনগুলোয় কর্মব্যস্ত, শুধু তখনই আমার বাবা হওয়ার অধিকার। কয়েক বছর আগে, যখন ফাটল ধরতে শুরু করেছে কিন্তু ধস তখনও নামেনি, শৈশব-অনুত্তীর্ণ মেয়েটা মায়ের আচরণে ক্রমপরিবর্তন আর মা-বাবার সম্পর্কের বরফ-শীতলতা দেখে এক গভীর অসহায়তাবোধে কান্নাকাটি করত। কিন্তু এখন ও বয়ঃসন্ধি পেরিয়েছে, নতুন চোখে দেখতে শিখেছে জীবনকে। স্কুলে পিয়ানো আর বেহালা শেখে তো— নিশ্চয়ই বোঝে অক্টেভে-অক্টেভে না মিললে যুগলবন্দী হয় না। অনেক যত্নে সুর-বাঁধা যন্ত্রও হঠাৎ হঠাৎ বেসুরো হয়ে যায়। আজও মনে পড়ে, সেই ছোট্টবেলায় টাকুয়ামেননে গিয়ে বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে একটা নীল-হলুদ প্রজাপতি দেখে ও যখন বায়না করেছিল ধরে দিতে, বলেছিলাম ওদের ধরে রাখা যায় না রে সোনা। ওরা যার কাছে ধরা দিতে চায়, নিজেই উড়ে গিয়ে বসে তার গায়ে। জানি না সেদিন বিশ্বাস করেছিল কিনা আমার কথা। আজ হয়তো করে।

ধীরপায়ে বরফ মাড়িয়ে একটু একটু করে দূরে চলে যাই সেই রেলিং ঘেরা জায়গাটা থেকে। পিছনে পড়ে থাকে স্মৃতির ক্ষতের মতো কিছু পদচিহ্ন। আর তুষারিত টাকুয়ামেননের মৌনমুখরতা। হয়তো সে অপেক্ষায় আছে আমারই মতো— আগামি কোনো এক বসন্তের জন্য।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *