short-story-uni

উনি
নিলুফা আক্তার


তাঁকে নিয়ে সবার মধ্যে টানাটানি পড়ে গেছে, আসলে টানা-হেঁচড়া। সবাই হেঁচড়ার দলে, টানার দলে কেউ নেই। যতদিন তিনি সুস্থ-সবল ছিলেন, বাচ্চা-কাচ্চাগুলোকে নিরাপদে তাঁর কাছে রেখে কেউ চাকুরি আবার কেউ ঘোরাঘুরিতে লেগে যেতেন। স্কুলের মাঠে, অভিভাবক ছাউনিতে ভাবি নামক পাতানো বান্ধবীদের আড্ডায় শাড়ি-বাড়ি-গাড়ি-গয়না-রূপ-যৌবন-প্রেম-প্রীতির মাঝখানে হঠাৎ যদি কখনো তার কথা উঠতো, আসলে তাঁদের কথা উঠত, রসালাপের সুর বেসুরে হয়ে যেত, তাল-লয়-ছন্দপতন হত তাঁর নামোচ্চারণে। কত অভিযোগ তাঁকে নিয়ে। তাঁর সময়মত খাওয়া চাই, গোসল চাই। আসলে এই দুটো চাওয়াই চক্রাকারে ঘুরে-ফিরে হাজারটা হয়ে গেছে। একসময় সবাইকে আলো দান করে মানুষটা আজকাল চোখে কম দেখেন। কেতুর জমা ঘোলাটে চোখ নিয়ে বিড় বিড় করে বলেন, মরার এই চোখ আমাকে কাবু করে ফেলেছে। সারাজীবন পরিশ্রমী মানুষটার শরীরটা এখন শক্ত-সামর্থ্য আছে অথচ অভিশপ্ত অন্ধকার তাঁকে জগৎ-সংসারের কাছে সারেন্ডার করতে বাধ্য করেছে। সকালে আগ্রাবাদ ফোন করে, টেলিফোন রিং এর অনবরত কর্কশ ধ্বনি শুনে কিটিপার্টির আসর ভেঙ্গে কুঞ্চিত কপাল নিয়ে দৌড়ে এসে খুলশী ফোন ধরে। মনে মনে বলে, এই সাতসকালে কোন পোড়াকপালী ফোন করল? খুলশী ‘হ্যালো’ বলতেই, মোবাইলের ওপাশ থেকে আগ্রাবাদ খিঁচানো কণ্ঠে বলে, ‘কী রে কেমন আছিস? কী করছিস?’
খুলশী উষ্মাভরা গলায় বলে, ‘কিছু না রে, রান্নার আয়োজন করছি।’
‘ওহ্, তুই আবার কবে থেকে রান্না-বান্না শুরু করলি?’
‘বাহ্ বেশ ভালো খবর। শেষপর্যন্ত তোর হাতের রান্না খাবার সৌভাগ্য হবে।’
আগ্রাবাদের খোঁচাখুঁচির কথাবার্তা নতুন কিছু না।
খুলশী দু’কান, মাথা গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে চটানো যাবে না। তাই বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, ‘রান্না কি আমি সাধ করে করছি রে। ছুটা বুয়ার জ্বর। বান্ধাটা বাড়িতে গেছে।’
ওপাশ থেকে হতাশ কণ্ঠে আগ্রাবাদ বলল, ‘আসলে উনাকে নেওয়ার তো সময় হয়ে গেছে, তাই ফোন করলাম।’ তারপর চড়চড়ে কণ্ঠে বলে, ‘গতবারের মতো এবারও দেখি তোর নতুন ঝামেলা উদয় হল। কাচঘেরা ড্রইং রুমের আয়না ভেদ করে কিটিপার্টির বন্ধুদের কিচির-মিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।’
খুলশী দ্রুত ডাইনিং স্পেস পার করে বেডরুমে ঢোকে। দরজাটা বন্ধ করে দেয়। যেন কোন গোপন প্রেমিকের সঙ্গে নির্বিঘ্নে দুটো সুখালাপ করবে। কিন্তু দুখালাপ দিয়েই তার কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হয়। খুলশী বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, ‘আহা! উনাকে কতদিন দেখি না। কাজের মানুষের যন্ত্রণায় বেরও হতে পারি না। মানুষ এলেই আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আর ঈদের তো বেশি দিন নাই, এবার শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে। ও কিছুতেই মানছে না। মায়ের কবরটা জিয়ারত করার জন্য ক্ষেপে ওঠেছে। মনে হয় না ঈদের আগে আনতে পারব!’ ওপাশ থেকে রিসিভার রাখার ধড়াম শব্দে নিশ্চিত হয় আপাতত ঝামেলা মুক্ত। যেন কিছুই হয়নি এমনি করে কাঁচের দেয়ালের মধ্যেকার আনন্দ উল্লাসে মত্ত হয়ে যায়।
খুলশী বেল টিপতেই উঠতি বয়সী কাজের মেয়েদুটো তটস্থ হয়ে দ্রুত হাজির হয়। রোবটের মতো দাঁড়িয়ে বলে, ‘জ্বি ম্যাডাম।’
গাল-গল্পে মগ্ন খুলশী বলে, ‘ওহ্ হ্যাঁ, তোরা এসেছিস। আমাদের জন্য কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে আয়।’
মোটাসোটা একজন উঠে বলে, ‘আমাকে সুগার ফ্রি ব্ল্যাক কফি দিও। আমি ডায়েট শুরু করেছি।’
খুলশী হাসিমুখে বলে, ‘আরে দূর, একদিন চিনি খেলে কিচ্ছু হবে না! আজকে তো এমনি সব রিচ্ ফুডের আয়োজন করেছি বন্ধু।’
ওজনদার বান্ধবী একগাল হেসে বলে, ‘আমার বডি যদি আর আধা ইঞ্চি বাড়ে, সব দোষ কিন্তু তোর। বুঝলি, ভুলবি না কিন্তু!’
ভাবলেশহীন অবয়ব নিয়ে মেয়েদুটো যে-ভাবে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
কিটিপার্টির ম্যাডামরা কারিনার জিরো ফিগার, বিপাশার সেক্সিহাল, প্রিয়াঙ্কার-ক্যাটরিনার যৌন বোম থেকে হাল আমলের নায়িকাদের রূপের আগুনে জ্বলছে। সব প্রশংসার শেষে যুক্ত হচ্ছে একটা নিন্দাবাদ। বাহারি রঙের সিল্কি চুলের বান্ধবীদের প্যাডেড ব্রা ভেদ করে উন্মুক্ত বক্ষ উঁকি দিচ্ছে। মগ্ন আলাপের উত্তেজনার তোড়ে পাতলা পোশাকের আড়ালের মাংসল দেহের ভাঁজ প্রকট হয়ে আছে। লাল চুলওয়ালা এক বান্ধবীকে উপলক্ষ্য করে খুলশী বলে, ‘দোস্ত তোকে যা লাগছে না! যে কোনও পুরুষ তোকে দেখলে গোপন শিহরণে ঘামার্ত হবে।’ বন্ধুটি মেকি লজ্জায় বলে, ‘ধ্যাৎ কী যা তা যে বলিস। যৌবন এখন ভাঁটার ঘাটে রে বন্ধু।’ গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আগ্রাবাদের স্বামী বিদেশি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরি করে। এরা যেমন বেতন দেয়, তেমন করে বাদুড়ের মতো রক্তও শুষে নেয়। সে নিজে হোম মিনিস্টার। সারাদিন এলোমেলো ভাবে ঘর-গেরস্থি সামলায় আর মনে মনে বলে, উহ্ বাবারে, কর্মজীবী মহিলারা যে কীভাবে ঘর-বাহির দুটো সামাল দেয়! আমার তো একটা সামাল দিতেই নাভিশ্বাস। ফার্নিচার মুছতে মুছতে আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে, মৃদু হেসে বলে, ‘শোনো, আমি চাকুরি না করলে কী হবে? তুমি-ই তো আমার সবচেয়ে বড় চাকুরি। এ্যাত্তো এ্যাত্তো টাকা ব্যাঙ্কে ফেলে রেখেছ কার জন্যে? ওখান থেকে আমাকে মাসোহারা কিছু দাও না।’
অন্ধপ্রায় চোখ আর কম-শোনা কান নিয়ে উনি বলেন, ‘কী? কী কস? আমি তো এখন কানে কম শুনি। ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় চোখটা তো গেলো প্রায়। জোরে ক, কিছু বুঝি নাই।’
আগ্রাবাদ ঘোলাটে দাঁত বের করে হেসে, উচ্চস্বরে বলে, ‘তোমার আর কিছু শোনার দরকার নাই। তোমার সঙ্গে কথা বলাও এক জ্বালা রে বাবা!’ খাটের কাছে গিয়ে কণ্ঠ আরও চড়া করে বলে, ‘শোনো আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। দ্যাখো একা একা খাট থেকে নেমো না কিন্তু। আমার যন্ত্রণা বাড়িও না। বাথরুম পেলে কলিংবেলটা টিপ দিও’ বলে, বেলটা ওঁর রগওঠা শীর্ণ হাতে গুঁজে দিয়ে, মাংসল শরীরটা হেলেদুলে রান্নাঘরে ঢোকে।
খুলশীর কিটিপার্টি শেষ হয় রাত বারোটায়। হয়তো আরও অনেকক্ষণ তারা সুখালাপে মশগুল থাকত কিন্তু একজন বান্ধবীর স্বামী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ক্লিনিকে ভর্তি হবার খবরটা শোনার পর তাদের পার্টি আর জমেনি। আনন্দে মত্ত কয়েকজন বেলুনের মত চুপসে যায়। কুঁচকানো বেলুনের মতো কপাল কুঁচকে একে অন্যের সঙ্গে ফিস্‌ফাস্ শুরু করে, ‘দ্যাখ তো, অসুস্থ হবার আর সময় পেল না। কত কাঠখড় পুড়িয়ে ঘর থেকে বের হলাম… উফ্ বিরক্তিকর।’ অন্যজন বলে, ‘এটা তো গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে গেল। ফোনটা আসার সময় পেল না।’ আরেকজন, অনুচ্চ কণ্ঠে বলে, ‘ওর স্বামী যখন অসুস্থ, তাহলে বাবা এখানে আসার দরকারটা কী ছিল? যত্তসব!’
পার্টি সাঙ্গ করে মধ্যরাতে ক্লান্ত উত্তেজিত শরীরটা খুলশী স্টিমবাথে ডুবিয়ে দেয়। মাথাটা সুগন্ধি জলে ভাসিয়ে রেখে খুলশী মনে মনে বলে, কালকে ও প্লেনে উঠবে। ছয় ঘন্টার জার্নি করে রাতে বাসায় ফিরবে। মানুষটা দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে জীবনটা কাটিয়ে দিল। আজও জানল না, আসলে সে কী ব্যবসা করে? বক যেমন টুপ করে মাথাটা জলে ডুবিয়ে আবার ডাঙায় তুলে এভাবে খুলশীও জলকেলীর খেলায় মগ্ন হয়ে এভাবে ভিজিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে, যা ইচ্ছা তাই করুক। আমার আরাম আর টাকা চাই।
রান্না শেষে ঘামার্ত আগ্রাবাদ গোসলে ঢুকে। ইশ কলটা নষ্ট হবার এখনই সময় হল! কমোডের পুশ শাওয়ার দিয়ে অনেক সময় লাগিয়ে বালতিটা ভরে। পানির স্পিডও কম। বাড়িওয়ালাকে কতবার বলেছে, কলের পাইপগুলো পরিষ্কার করাতে, শালা শোনেই না। মেজাজটা খিঁচিয়ে ওঠে, শালার বালের জীবন! বাল ছিঁড়তে ছিঁড়তে জীবনটা শেষ হয়ে গেল। উনি প্রায়ান্ধ চোখে মান্ধাতার আমলের নোকিয়ার বোতাম টিপে টিপে মগবাজারকে ফোন করেন। কারওর চিৎকারে উনার কমশোনা কানের পর্দা ফেটে যাবার দশা হয়। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলে ওঠেন, ‘আচ্ছা রাখি রাখি, তুই ওরে সামাল দে।’ উনার ঝাপসা চোখ আরও মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়। বর্ষীয়ান আঙুলগুলো দিয়ে দ্রুত চোখ মুছে। মনে মনে বলে, ‘চোখে জল দেখলে আবার চিল্লাচিল্লি শুরু হয়ে যাবে।’
একদিন মানুষটার কথা মনে পড়ে গেলে, ওঁর দু’চোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়তে থাকে। আগ্রাবাদ কখন যে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, ঝাপসা চোখে অন্যমনস্ক উনি দেখেন নাই। ওর কর্কশ কণ্ঠের চিৎকার শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। মেয়েটা চিৎকার করে হাত নাড়িয়ে বলতে থাকে, ‘অ্যাঁ, আমি কি তোমাকে কষ্টে রেখেছি? তুমি যে এত কানতাছ? মনে হয় জেলখানায় আছ? এত যদি কষ্টে থাকো তবে খুলশীর কাছে যাও না ক্যানে? ঐ বজ্জাতটা ফোন করলে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে কী সুন্দর দায়িত্ব থেকে কেটে পড়ে। হিপোক্রেট কোথাকার। সারাদিন শহর কুতুব হয়ে ঘুরে আর তোমার কথা বললেই পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, কোমর ব্যথা, বান্দি নাই, যত্তসব কুলাঙ্গার কোথাকার!’
শীর্ণ আঙুলগুলো দিয়ে কেতুর পড়া চোখ মুছতে মুছতে উনি বলেন, ‘আমি তো কানতাছি না। চোখে ছানি পড়ার পর থাইক্যা সারাদিন এমনি এমনি পানি পড়ে। আমি তো তোর উপর রাগ না। তুই তো আমারে শান্তি দ্যাস মা। আগ্রাবাদের দু’চোখ জলে যন্ত্রণায় জ্বালা করতে লাগল। মনে মনে ভয়ে শিউরে ওঠে, উহ্ সারাটা জীবন উনি কী কষ্টটাই না করেছেন। ঘর-বাহির একহাতে সামাল দিয়েছেন। আমাদের পড়াশুনা করানো, একহাতে কাটাকুটি করে রান্নাবান্না, চাকুরি সবি একাই করেছেন। বিয়ে শাদিতেও ওঁর ভূমিকাই ছিল মুখ্য। আর আজ ওঁকে নিয়ে কোরবানির গরুর মতো টানা-হেঁচড়া চলছে। তবে কি আমাদের কপালেও ওই দশা হবে! ভাবতেই আগ্রাবাদের ভেতরটা ভয়ে দুশ্চিন্তায় দমে যায়। সদ্য গোসল করে আসা অন্যমনস্ক আগ্রাবাদের ভিজা চুল থেকে টপ্ টপ্ করে জল পড়ে পিঠটা ভিজে একাকার। ঐ ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়েও উনি সব দ্যাখেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠেন, ‘তোর তো পিঠটা ভিজতাছে। যা যা তাড়াতাড়ি চুল মোছ, ঠান্ডা লাগব।’
আগ্রাবাদ হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে, আমাকে মাপ করে দাও, কাতরকণ্ঠে ওঁর কম্পিত হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলে, ‘বলো মাপ করেছ, বলো না মাপ করেছ!’
উনি ভেজা চুলে স্নেহের হাত বুলিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, ‘তোরা কী অন্যায় করেছিস? তোরা তো কিছু করস নাই। যা জলদি চুল মোছ, জ্বর আসব তোর।’ উনার কণ্ঠে যেন, এই জগৎ সংসারের প্রতি অদ্ভুত এক নিরাসক্তি। আগ্রাবাদের সব আবেগ বরফ হয়ে যায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অনুশোচনা, ভয় হয়ে জাপটে ধরে আছে, কিছুতেই পিছন ছাড়ছে না।
বারান্দা ঝুলন্ত গামছা দিয়ে চুল বান্ধতে না বান্ধতেই ওঁর ডাক পড়ে।
‘আমার মোবাইলটা কই, অ্যাঁ আমার মোবাইলটা কই?’
ওঁর ডাক পড়তেই নানা অশুভ চিন্তায় আগ্রাবাদ দৌড়ে ঘরে ঢোকে। হায় খোদা পড়ে গেল না তো! তাকিয়ে দেখে বিছানায় বসে থাকা মানুষটা অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজছেন? আগ্রাবাদের বুঝতে দেরি হয় না। মেজাজটা সপ্তমে চড়ে গেলেও শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কী খুঁজছ?’
খোঁজাখুঁজিতে ব্যস্ত উনি অস্থির হয়ে বলেন, ‘আমার মোবাইলটা খুঁজতাছি। এই তো, মাত্র, কে যেন ফোন করল। রিংয়ের আওয়াজ শুনছিলাম কতক্ষণ ধরে। আমার তো মনে হয় খুলশী ফোন দিছিল। গতকাইল নাকি তাইর জ্বর আইছে। তাইরে ফোনটা লাগাইয়া দে না!’
রাগে ক্ষোভে অভিমানে আগ্রাবাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলতে থাকে। মনে মনে বলে, ‘থাকছে আমার বাড়িতে। সেবা করছি আমি আর খুলশীর লাইগা পাগল।’
মনের জ্বালা মনে রেখে মোবাইলটা ওঁর হাতে ধরিয়ে দেয়। ওঁর কর্মকাণ্ড দেখার জন্য নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। বিবর্ণ নোকিয়া মোবাইলটা চোখের কাছে এনে আঙুল দিয়ে টিপে টিপে ডায়াল করে, ফোনটা কানের কাছে উল্টো করে ধরে। আগ্রাবাদ ইচ্ছে করে মোবাইলটা ঠিক করে দেয় না। উনি খুলশীকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘কী রে মা তোর শরীর কেমন? জ্বর কমছে? ওপার থেকে কোন কথা শুনতে পায় না।’ উনি বলছেন, ‘কান্দিস না মা। এতো কান্দন ভালা না। আল্লা নারাজ অইয়া যাইব। তিনি কত ভালো রাখছেন আমাদের। কান্দিস না।’
আগ্রাবাদ হঠাৎ উনার কাছ থেকে ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে খিটখিটে মেজাজ, রুক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘কী অইছে তোর? এতো কান্দনের কী আছে? কানতাছস কেন? কাল সারারাত কিটিপার্টি করে আজ কান্দনের কী আছে?’
ওপাশ থেকে খুলশী যেন মুহূর্তের জন্য চুপ মেরে যায়। তারপর দ্বিগুণ গলা চড়িয়ে বলে, ‘কী অইছে তোর, অ্যাঁ! করোনার মধ্যে সবাই ভয়ে ঘর থাইক্যা বাইর অয় না। এর মধ্যে আবার পার্টিফার্টি। মানুষেরে দোষ দেওয়ার আর জায়গা পাস না!’
আগ্রাবাদ এসব কথার কোনও জবাব দেয় না। যেন কিছুই হয়নি, এমনি কণ্ঠে বলে, ‘আচ্ছা তোর কিটিপার্টির বান্ধবীর জামাই এখন কেমন আছে? ঐ যে কাল রাইতে ক্লিনিকে ভর্তি হইছিল।’
প্রতিউত্তরে খুলশী ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলে, ‘আমি রাখি, কে যেন অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল টিপছে।’
চট্ করে লাইন কেটে দেয় খুলশী।
আগ্রাবাদ চিৎকার করে বলে, ‘শুনছ, তোমার খুলশী একটা ভণ্ড। তুমি তাইর লাইগা কাইন্দা মরতাছ আর আমি তোমার লাইগা কান্দি।’
ক্ষোভে-অভিমানে দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু না মুছেই দড়াম করে রুমের দরজা বন্ধ করে বের হয়ে যায়। চোখ মুছতে মুছতে তখনি এসে আবার দরজাটা হাঁ করে রেখে যায়। ওঁর দরজা সবসময় খোলা রাখে। যদি কিছুর দরকার হয়, না বলে বাথরুমে গিয়ে আবার পড়ে-টড়ে যায় এই ভয়ে বন্ধ রাখে না।
চরম বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে আগ্রাবাদ, সুরমাকে ফোন করে। তারপর এক নিঃশ্বাসে তাকে সব বলে যায়। সুরমা ওপাশ থেকে বলে, ‘তুই শান্ত হ, কী করবি বল? সব তো এক না। তুই ওঁর জন্য যেমন করছিস, আমরা তো করতে পারব নারে। সব নেকি তো তুই নিচ্ছিস বলে,’ অট্টহাসিতে আগ্রাবাদের কান গরম করে তুলে। সুরমার তেলমারা কথা আর দিল লাগানো হাসিতে আগ্রাবাদের মনটা হালকা হয়ে যায়। এবার মনে মনে আশান্বিত আগ্রাবাদ আসল কথায় পড়ে, ‘তোমার তো হাত-পা ঝাড়া। সরকারি চাকুরি করো। পাইক-পেয়াদারও কোনো অভাব নাই। ওঁকে কিছুদিন তোমার কাছে রাখো না। করোনার জন্য স্কুল বন্ধ তাই আমি পারছি, খুলে গেলে তো পারব না। বাড়িওয়ালা কামের মানুষ গেইটের ভেতরে অ্যালাও করে না। কাজ করতে করতে আমার জানটা বের হবার যোগাড়। তোমাদের জামাইবাবু তো অনলাইনে অফিস করে, খায় দায় ঘুমায়। এই দুনিয়াদারিতে সে নাই। মাঝে মাঝে চিৎকার দিয়ে বলবে, তোমাকে ডাকছে, যাও না কেন? এতটুকুই উনার দায়-দায়িত্ব।’
একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে, আগ্রাবাদ পুনরায় পুরানো কথায় ফিরে আসে, ‘উনাকে কিছুদিন তোমাদের কাছে নিয়ে রাখো না।’
সুরমা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, ‘আমি কী করব বল? পরের মেয়ে দায়িত্ব নিতে চায় না। জোর করলে বলে ডিভোর্স দাও, সংসার করব না। এখন আবার নতুন গান শুরু করেছে, আর কত সরকারি বাড়িতে থাকব? আমার নিজের বাড়ি চাই। ওঁকে আনার জন্য যাও বুঝিয়ে-সুজিয়ে রাজি করিয়েছিলাম। করোনার জন্য কিছুতেই আনতে রাজি হল না। বলে আসতে পারে এক শর্তে যদি কোভিড টেস্ট করান। গতকাল ওঁকে বলেছিলাম, “উনি বললেন, তোর বাসায় আসার প্রবেশপত্র যদি কোভিড টেস্টের ছাড়পত্র হয় তবে না আসাই ভালো। তোর ওখানে আমি যামু না।”’
আগ্রাবাদের শিরদাঁড়া কেমন টন্ টন্ করে ওঠে। কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা রাখছি, উনি ডাকছেন।’
লাইন কাটতে কাটতে রাগে গরগর করতে করতে বলে, ‘শালা বৌয়ের গোলাম।’
লাইন ডিসকানেক্ট হতেই আবার সুরমার ফোন আসে, ধরতেই বলে, ‘কিছু কি বলছিলি, মনে হল কিছু বলছিলি? কিছু কি বলবি?’
আগ্রাবাদ কঠিন নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে, ‘না, তোমাকে কিছু বলি নাই। ভাবছি, আজকাল গোলামেরা খুব নিমকহারাম হয়ে গেছে। নুনের কদর দেয় না।’
ওপাশ থেকে নিম্ন কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়, ‘ও!’
ওঁর সজোরে ডাকাডাকি শুনে কোনো সৌজন্যতা ছাড়াই আগ্রাবাদ লাইন কেটে দেয়। মনে মনে বলে, এই বয়সে ওঁরও বেশি বেশি! এতো ঘাওড়ামির কী আছে রে বাবা? এই বয়সে আল্লা-বিল্লা করবেন। চুপচাপ থাকবেন। কিন্তু না, ওঁরও মতামত আছে। তাও আবার শক্ত মতামত। এত শক্ত মত যে নড়ানো-চড়ানো যাবে না অথচ নিজে একা নড়াচড়াও করতে পারেন না। আগ্রাবাদ গিয়ে দ্যাখে, উনি কাপড়-চোপড়ে পেশাব করে, অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন। আগ্রাবাদকে দেখেই বলেন, ‘আমি বুঝি নাই মা, সত্য আমি বুঝি নাই। বাথরুমে যাওয়ার লাইগ্যা উঠছিলাম, কিন্তু পেশাব কন্ট্রোল করতে পারি নাই।’
আগ্রাবাদের রাগ-মায়া একাকার হয়ে দু’চোখ জলে ভরে যায়। ওনাকে সযত্নে বাথরুমে নিয়ে কোমর পর্যন্ত ধুইয়ে দেয়। মা যেমন তার ছোট্ট শিশুকে শরীর মুছিয়ে, কাপড় পরিয়ে দেয়, তেমনি করে পরিয়ে ওঁকে খাটে এনে বসায়। তারপর জমে থাকা, গড়িয়ে পড়া পেশাব ভরা ফ্লোর বালতি আর টুকরো কাপড় এনে পরিষ্কার করে। সদ্য গোসল সেরে আসা আগ্রাবাদ ওঁর কাপড় ধুয়ে আবার গোসল করে, ওঁর রুমে আসে। তাকিয়ে দেখে মানুষটা লজ্জায়, অপরাধে মুখটা মলিন করে বসে আছে। ডায়াবেটিস আছে তাই বিস্কিটের টিনটা হাতে ধরিয়ে এসেছিল। ওটা ওভাবেই হাতে ধরা।
আগ্রাবাদ উনার হাত থেকে টিনটা সরিয়ে, ওর মোলায়েম পরিপুষ্ট হাতের মুঠোয় পরম মমতায় উনার কম্পিত শীর্ণ হাতটা পুরে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে বসে থাকে। তারপর মৃদু কন্ঠে বলে, ‘তুমি ছোটবেলা কত আমাদের মল-মূত্র পরিষ্কার করেছ, গোসল করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, পড়ানো সবই তো তুমিই করছ। আজ এতো বড় করে বিয়ে শাদি দিছো। এখন আমাদের পালা।’
গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে, ‘অথচ আমরা কত নিষ্ঠুর। তুমি মুখ মলিন করে বসে থেকো না, আমার একদম ভালো লাগে না। যখন একা একা কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠি তখন না হয় মাথা ঠিক থাকে না। কিন্তু তোমায় আমি অনেক ভালোবাসি।’
উনি পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। আগ্রাবাদ তাকিয়ে দেখে, ওঁর মুখটা অদ্ভুত নিস্পৃহ, সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। মনে মনে বলে, এ আমার দেখার ভুল। আগ্রাবাদ ভাবছে, ওঁর সঙ্গে আমার একান্ত মমতার সময়গুলো এরা জানি কেমন করে টের পেয়ে যায়! নাটোর ফোন করেছে, রিংটোন কমানো ছিল। একমাত্র উপরওয়ালা জানেন, কেমন করে টের পান? মাথা থেকে হাতটা নামিয়ে হাতড়ে হাতড়ে দ্রুত মোবাইলটা হাতে নিয়ে, সবুজ বৃত্তাকার আলোতে চেপে ফোনটা রিসিভ করলেন। আগ্রাবাদ নীরবে রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে ভাবছে, ‘উহ্ খোদা, কী অদ্ভুত মানুষটা! এতো হেলাফেলা পাওয়ার পরও কেমন করে সংসারের সবগুলো ডালপালাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকেন?! কেমন করে অকাতরে ভালোবাসা বিলান? আসলেই অদ্ভুত এক জাত এরা!’
চারদিকে করোনার প্রকোপ ভয়ংকর রকম বাড়ছে। খুলশী, আগ্রাবাদ, সুরমা, নাটোর সবার বাসায় গৃহকর্মীর সংকট। এবার ওঁকে ভালোবাসার আসল চেহারাটা যেন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। সবাই উনাকে ভালোবাসেন কিন্তু ওঁর মতো করে ভালোবাসতে পারছে কই? তাই একজন অন্যজনকে ফোন করে অভিযোগের ঝুড়ি উগরে ফেলছে। এই গসিপ যেন করোনার রূপ নিচ্ছে, কেউ কি উপলব্ধি করছে? সবাই ভাবছে চোখে কম দেখা, কানে কম শোনা। মানুষটা কী আর বোঝে? অঁর দুনিয়াটা তো অন্ধ আর বধির। আমরাই তো ওঁর সব। অথচ একদিন সকালে অত্যাশ্চর্য এক ঘটনা ঘটলো, নাস্তা খাবার পর হাতড়ে হাতড়ে উনি সব কাপড়-চোপড় ব্যাগে পুরছেন দেখে, বিস্মিত আগ্রাবাদ জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কাপড়-চোপড় ব্যাগে ঢুকাইতেছ ক্যানো?’ তারপর খানিকটা রসিকতার সুরে বললো, ‘আচ্ছা বুজছি আমাদের খুলশী ম্যাডামের তাইলে হুঁশ হইছে। সময় অইছে পার্টিফার্টি বাদ দিয়া তোমার দিকে নজর দেওয়ার। বাহ্ বেশ, বেশ তো।’
এতক্ষণ নিরুত্তর উনি মৃদুকণ্ঠে বললেন, মা আমার ঔষধগুলি গুছিয়ে দে তো। আর তোর কাছে ব্যাঙ্কের যে চেক বইটা আছে আমার, ওটা দে।’ এবার আগ্রাবাদের রসিকতা উবে যায়। সর্বাঙ্গ যেন রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। দৌঁড়ে এসে উনাকে জাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘কী হয়েছে তোমার? কোথায় যাবে তুমি?’
ঠিক ঐ মুহূর্তে ডোরবেল বেজে ওঠে। আগ্রাবাদ পাগলের মত গিয়ে দরজা খুলে, অবাক হয়ে যায়! ওঁর স্কুল জীবনের বন্ধু। দীর্ঘদিন একসঙ্গে দুইজন চাকুরিও করেছেন। ওঁর বিধবা বন্ধু উজ্জ্বল রঙের একটা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রূপালী রঙের চুলের সঙ্গে শাড়িটা ভালোই মানিয়েছে। এই সমাজ এটা দেখতে অভ্যস্ত নয় কিন্তু আগ্রাবাদের ভালো লাগছে। অনেক ভালো। ওঁকে দেখে অন্ধকারে, সে যেন আশার আলো খুঁজে পায়। দ্রুত এসে ওঁর বন্ধুকে ভেতরে আনার জন্য হাতটা ধরে, বন্ধু আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বন্ধুকে দেখামাত্রই ওঁর প্রায়ান্ধ চোখে অচেনা আলোয় উদ্ভাস ছড়িয়ে গেল, পুরো মুখটা হাসিতে ভরে আছে। এই হাসি ওরা শেষ কবে দেখেছে আজ আর আগ্রাবাদের মনে পড়ে না! হতবাক সে উপলব্ধি করল, এই রুমটাতে ছোট্টবেলার দুই বন্ধু ছাড়া আর যেন কেউ নেই। ও যেন এদের সামনে অস্তিত্বহীন হয়ে দণ্ডায়মান। উনার বিছানার কোনা ধরে বসে, বন্ধু বলে, আচ্ছা সব গুছানো হয়ে গেছে নাকি? ভালো করেছিস। দেরি করা যাবে না। গাড়ি আবার ষোলশহর যাবে। আগ্রাবাদ শূন্যে দাঁড়িয়ে আছে, ওর পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। থপাস্ করে ওঁর বিছানায় সে বসে পড়ে। ওর মাংসল নিতম্ব যেন থেঁতলে গেছে এমন তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। কতদিন উনি বলেছিলেন, তোষকটা পাতলা, ঘুমাতে কষ্ট হয়, বদলে দিস, আগ্রাবাদ বেমালুম ভুলে গেছে। অথচ কতবার নিজের কেনাকাটায় মার্কেটে গেছে। তীব্র লজ্জা আর অপরাধবোধে আগ্রাবাদ দিগবিদিক শূন্য হয়ে চিৎকার করে ওঁকে জাপ্টে ধরে। অসহনীয় কান্নায় প্রায় রুদ্ধ, ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কই যাচ্ছ তুমি? বলো কই যাচ্ছ?’
পাশ থেকে বন্ধু মৃদু স্বরে বলে, ‘চিন্তা করো না। ওখানে ও ভালো থাকবে। ওর মতো ভালো থাকবে। চাকুরি অবসরপ্রাপ্ত বন্ধুরা মিলে আমরা একটা ঘর বানিয়েছি। ওখানেই সবাই মিলে থাকব। অনেক আগেই ও ওখানে টাকা ইনভেস্ট করে রেখেছে।’
হতভম্ব আগ্রাবাদের বাক্‌শক্তি কে যেন কেড়ে নিয়ে গেছে। ওঁর কথার কোন প্রতিউত্তর না দিয়ে, কম্পিত হাতে দ্রুত খুলশীকে ফোন করে। ফোন ধরে না। ওরা কেউ-ই ফোন ধরে না। ওরা সবাই কি একসঙ্গে মরে গেল নাকি? আকস্মিক এই যুদ্ধ ও একা কেমন করে সামাল দেবে? কোন লজ্জায় ওঁকে বাধা দিবে? তবুও মরিয়া হয়ে আগ্রাবাদ বলে, ‘না তুমি যেতে পারবে না। তোমাকে কিছুতেই আমি যেতে দেব না।’
ওঁর হাত সে শক্ত করে ধরে রাখে। উনি ব্যথায় ‘উহ্’ করে উঠলে, প্রচণ্ড অনুশোচনায় সে হাতটা ছেড়ে দেয়।
সমুদ্রে ডুবন্ত মানুষ যেমন শেষ খড়কুটোটা ধরে বাঁচতে চায়, তেমনি মরিয়া আকুতি নিয়ে আগ্রাবাদ বলে, ‘আমিই তো তোমার সবচেয়ে বেশি দেখাশুনা করেছি, আমার কাছেই তুমি সবচেয়ে বেশি থেকেছ। কী এমন অপরাধ করেছি, তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছো? যেতে চাও যাও, তবে আমার বাসা থেকে কেন?’
উনি মৃদু অথচ অকম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘কারও না কারও অধীন থেকে তো আমার মুক্ত হতেই হবে মা। আমাকে যেতে দে। এই টানাটানি থেকে মুক্তি দিলে আমি হয়তো আরও কয়েকটা দিন বাঁচতে পারব!’ কাতর কণ্ঠে বলেন, ‘আমাকে কি তোরা বাঁচতেও দিবি না? সমাজটাই তোদের কাছে বড় হয়ে গেল!’
আগ্রাবাদ ছিটকে দূরে সরে যায়। অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ দু’চোখে জলের বাঁধ ভেঙেছে। ও মোছে না।
জলাচ্ছন্ন ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখে, চাকুরি করে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী অথচ তাদের উপর নির্ভরশীল, ভীত মানুষটা, কী এক অমিত সাহস নিয়ে, বয়সের ভাবে ন্যুব্জ শিরদাঁড়া সোজা করে বের হয়ে গেলেন। আগ্রাবাদ ভাবছে, তাহলে কি মানুষটা সব বুঝত? টানাটানির শ্বাসরুদ্ধকর রক্তক্ষরণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই কী তিনি চলে গেলেন? কে জানে কেন গেলেন?
ওঁর শূন্য কক্ষটাতে দাঁড়িয়ে চরম অসহায়ত্ব নিয়ে আগ্রাবাদ উপলব্ধি করেন, যিনি ছিলেন তিনি শুধুমাত্র আমাদের মা। আর যিনি চলে গেলেন তিনি একজন ‘মানুষ’!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

6 thoughts on “short-story-uni

  1. এমন চমৎকার বর্ণনায় উপস্থাপিত মানসিক ক্রিয়া বিক্রিয়া বিশ্লেষণ মনস্তত্বের নিগূ়ঢ় পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করানো লেখকের উচ্চমার্গীয় দক্ষতার পরিচয়। একজন মা আর একজন মানুষ, উপলব্ধি অনন্যসাধারণ।

  2. আমার সাথে আমার প্রায় নব্বই বছরের আমার মা থাকেন তাই গল্পটা আমাকে নাড়া দিলো। তা ছাড়াও বর্তমান সামাজিক অবস্থার এমন চমৎকার এবং ধারাবাহিক বর্ণনায় আমি অভিভূত। চরিত্র গুলোর নামের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য রয়েছে। এবং এ কারণে আমাকে দুবার পড়তে হয়েছে। লেখককে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।

    1. অনেক ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক! আপনাদের পাঠানুভূতি, লেখক আমাকে সবসময় প্রাণিত করে। পাঠকই লেখকের প্রধান শক্তি ও প্রেরণা। ❤️🙏

  3. অসাধারণ! যারা নিজেদের সব উজাড় করে সন্তান দের পথ চলতে শেখান তাঁদের নিয়ে যখন টানা-হেঁচড়া শুরু হয় আপন সন্তানদের মধ্যে তখন উনাদের উপলব্ধ আত্মসম্মান বোধে প্রচন্ড আঘাত লাগে। তাই যে সন্তানেরা মা-বাবা কে বোঝা মনে করেন তাদের সান্নিধ্যে থাকার চেয়ে নিজের মতো করে থাকা শ্রেয়। তাই আমি মনে করি নিজের উপার্জন থেকে বৃদ্ধকালীন সময়ে নিজের জন্য গল্পের “উনির”-ব্যবস্থা নেয়াই উত্তম। আল্লাহ যতদিন হায়াত দিয়েছেন নিজের মতো করে,মাথা উঁচু করে শান্তিতে থাকাটাই ভাল। শেষ বয়সে এসে ঠেলাঠেলি মেনে নেয়া যায় না। প্রতিটি চরিত্রের এরিয়া ভিত্তিক নামকরণে অভিনবত্ব আছে। গল্পটা খুবই সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঘরে-বাইরে কাজ করার ফলে যথাযথ সময় দেয়াও খুব কঠিন হয়ে যায়। এটা বাস্তবতা। বর্তমান সমাজের বাস্তবতার নিরীখে লেখা গল্পটিতে যে ম্যাসেজটি আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে সেটি হলো যতোদিন বেঁচে থাকি ততোদিন,নিজের মতো করে আত্মসম্মান নিয়ে, কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে শান্তিতে বাঁচি। তবে সেজন্য দৃঢ় মনোবল এবং ব্যাক্তিত্বের অধিকারী হওয়া চাই। ধন্যবাদ লেখককে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির উপর আলোকপাত করে গল্পটা লেখার জন্য। গল্পের নামকরণটিও আমার দৃষ্টিতে যথাযথ।

    1. আমি অনুপ্রাণিত! অনেক ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক,সমালোচক। কোন লেখাকে চিন্তার স্থান থেকে মূল্যায়ন করলে তা লেখকের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও লেখার গতি বাড়িয়ে দেয়ার জন্য নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠে।❤️

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *