দীপান্বিতা রায়
সবে তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি। মফস্বলের মেয়ে। তাই ইংরাজি সিনেম-টিনেমা দেখা মোটেই অভ্যাস নেই। কিন্তু ক্লাসের বন্ধুরা একদিন ধরে পড়ল, দারুণ নাকি একটা ইংরাজি ছবি এসেছে। দেখতে যেতেই হবে। অগত্যা নিমরাজি। নিউ মার্কেটের পিছন দিকে সিনেমা হল, যমুনা। সে হল অনেকদিন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে তখন বেশ রমরম করেই চলত। প্রথম দৃশ্যেই পাহাড়ের ঢালে দাড়িয়ে গান। এক অপরূপ মায়াবী সবুজে ঢাকা সেই পাহাড়। সিনেমার নাম সাউন্ড অফ মিউজিক। ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই মুগ্ধতার অনেকখানি জুড়ে কিন্তু ছিল ছবির অপরূপ প্রেক্ষাপট। পরে ছবিটা নিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করে যখন জানতে পারলাম সাউন্ড অফ মিউজিকের শ্যুটিং হয়েছে অস্ট্রিয়ায়, তখন থেকেই মনের গোপন কোণে একটা ইচ্ছে দানা বেঁধেছিল। যদি কোনওদিন ইউরোপ যাওয়ার সুযোগ হয়, তাহলে একবার অস্সিঁয়া যাব। এবছরের শুরুর দিকে যখন বিদেশ বেড়াতে যাওয়া নিয়ে বাড়িতে একটা হালকা আলোচনা শুরু হয়েছিল তখন তাই আমি প্রথম থেকেই ঝুঁকে ছিলাম অস্সিঁয়ার দিকে। অবশ্য ভোটাভূটি কোনও ব্যাপার ছিল না। কারণ বাড়ির অন্য দুই সদস্য, স্বামী এবং এগারো বছরের কন্যাও সাউন্ড অফ মিউজিকের প্রেমে আত্মহারা। তাই মোটামুটি সর্বসম্মিতব্রমেই অস্ট্রিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে, যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হল।
একাদশীর বিকেল। দুর্গাপুজো শেষ হয়ে কলকাতার উৎসবের আমেজে যখন সবে একটু ঝিমুনি ধরছে, তখনই আমরা চেপে বসলাম দিল্লির উড়ানে। সেখান থেকে রাত একটায় ভিয়েনার ফ্লাইট। প্লেন ভিয়েনা পৌছবে ভোর ছটায়। শুনতে যদিও পাঁচঘন্টা, কিন্তু যাত্রাপথ আসলে প্রায় নয় ঘন্টার। মাঝখানে দুই দেশের সময়ের ব্যবধানের নানা গল্প আছে।
প্লেনে লম্বা সময় যাওয়াটা ভারি বিরক্তিকর ব্যাপার। ট্রেনে যেরকম বেশ দিব্যি আরাম করে শুয়ে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায়, দিনের বেলা লোকজন ওঠে-নামে, নতুন নতুন যাত্রীর সঙ্গে আলাপ হওয়ায় সুযোগ থাকে, আকাশপথে সেসবের কোনও বালাই নেই। বিশেষ করে রাত্তির বেলা তো নিদারুণ অসুবিধাজনক। সরু সিটে কোনওরকমে কম্বল মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা। লম্বা জার্নি বলে অবশ্য দুবার খাবার পাওয়া গেল। আরও বারদুয়েক ফলের রস-চা-কফি ইত্যাদি। আধ-ঘুমে রাত কাটিয়ে এসে নামলাম ভিয়েনায়। বিমানবন্দরের সবরকম নিয়মকানুন সেরে, জিনিসপত্র নিয়ে যখন বেরোব, ঘড়িতে তখন প্রায় সাতটা। আশ্বস্ত হওয়া গেল এইভেবে, যে যাক সকাল হয়ে গেছে। অচেনা দেশে রাত থাকতে পৌছানোর অস্বস্তি থেকে খানিকটা অন্তত রেহাই। ইন্টারনেটে আগেই দেখা ছিল তাপমাত্রা মোটামুটি ১০-১৫ ডিগ্রির মধ্যে থাকবে। তাই প্লেন থেকে নেমেই একপ্রস্থ গরম জামা-কাপড় পরা হয়ে গেছিল। নিশ্চিন্তে চাকা লাগানো স্যুটকেস টানতে টানতে এয়ারপোর্টের উষ্ণ আশ্রয় ছেড়ে বেরোতেই চক্ষু চড়কগাছ।
একি! এতো প্রায় মাঝরাত। সূর্য ওঠার লক্ষণটুকুও নেই। সোনায় সোহাগার মত বৃষ্টি পড়ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া ছুঁচের মত গরম জামা ভেদ করে গায়ে বিধছে। আমাদের প্ল্যান ছিল ভিয়েনাতে নামলেও সেদিন আমরা ভিয়েনাতে থাকব না। সকালেই চলে যাব সালসবুর্গ। সেইমত হোটেলও বুক করা আছে। কিন্তু সালসবুর্গ তো যেতে হবে ট্রেনে। সেজন্য রেলওয়ে স্টেশনে যাওয়া দরকার। এয়ারপোর্ট থেকে স্টেশনে যাওয়ার নাকী বাস আছে। কিন্তু সে বাস কোথা থেকে ছাড়ে কিছুই জানা নেই। নম্বর মিলিয়ে ঠিকঠাক জায়গায় পৌছে দেখি, মস্ত একখানা বাস দাড়িয়ে আছে। তার পেটের ঢাকনাখান খোলা। কিন্তু ড্রাইভারের কোনও চিহ্ন নেই। অথচ ঘড়িতে বলছে বাস ছাড়তে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী। খানিকটা অসহায় ভাবেই জিনিসপত্র তুলে বাসের পাশে দাড়িয়ে আছি। ওমা, ঠিক এক মিনিট আগে বিশাল একখানা বার্গার চিবোতে চিবোতে ড্রাইভার এসে হাজির। ঘড়ঘড় করে স্টার্ট দিতেই হুড়মুড়িয়ে বাসে উঠে সিটে বসে পড়লাম। হেডলাইট জ্বালিয়ে বাস যখন ছাড়ল, তখনও চারপাশ অন্ধকার। এয়ারপোর্ট থেকে স্টেশনে দুরত্ব প্রায় আধঘন্টা। এরই মধ্যে ছানাধোয়া জলের মত একটুখানি আলো ফুটল। সেই কুয়াশা ঢাকা আধো অন্ধকারে আমার সঙ্গে প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় হল ভিয়েনার, ইতিহাসে যে ভিয়েনা শহরে প্রথম উল্লেখ আছে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে। সেই সময় রোমানরা এখানে একটি সৈন্যশিবির তৈরি করে, যাকে বলা হত ভিন্দোবোনা। সম্ভবত ভিয়েনা নামের উৎস এই ভিন্দেবোনা শব্দটি থেকে। কিন্তু খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকেই এই শহরের সাধারণ নাগরিকদের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেলেও, ভিয়েনা নামটির উল্লেখ আসে অনেক পরে, ৮৮১ খ্রিস্টাব্দে।
কিন্তু ভিয়েনাতে তো আমরা তিনদিন পরে ফিরে আসবই। তাই ইতিহাসের পাতা ওল্টানো আপাতত বন্ধ। আমরা পৌছলাম স্টেশনে। টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ে বসতে না বসতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। ইউরোপের ট্রেনের সুনাম সারা বিশ্বেই। উঠতেই বুঝলাম, সেই সুনামের যথেষ্ট কারণও আছে। চমৎকার গদি আটা প্রশস্ত চেয়ার। বিশাল কাচের জানলা। যাত্রীদের সামনে বই-পত্র, কফির কাপ ল্যাপটপ রাখার জন্য টেবিল। ওপরে মালপত্র রাখার ব্যবস্থা। ট্রেন ভিয়েনা শহর ছাড়াতেই বদলে গেল চারপাশের দৃশ্য। ট্রেন লাইনের দুধারে কোথাও শস্যক্ষেত। নানা ফসল ফলেছে। কিছু চেনা, যেমন গম, বাজরা, আলু, বাধাকফি। কিছু অচেনা। অনেক জায়গায় আবার শুধুই বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। সবুজ ঘাসে ঢাকা। জমি অসমতল। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঢেউয়ের মত উঠুনীচু হয়ে আছে। ছোট ছোট স্টেশন। তার চারপাশে বাড়িঘর । বহুতল বাড়ির চিহ্নটিও নেই। ছোট ছোট একতলা-দোতলা বাড়ি। সামনের বাগানের বেড়ায় গোলাপ লতা। লাল রঙের ঢালু ছাদ। রোদ পোয়াচ্ছে লোমশ কুকুর ছানা। বাহারি টুপি মাথায় দিয়ে টুকটুক করে হেঁটে যাচ্ছে বুড়ি। রূপকথার বইয়ে আঁকা ছবির সঙ্গে পার্থক্য নেই বললেই চলে।
ভিয়েনা থেকে ট্রেনে সালসবুর্গ যেতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা। তাই ট্রেন যখন গন্তব্যে পৌছল, তখন বেলা অনেকটা গড়িয়ে গেছে। কিন্তু আকাশের মুখ তখনও ভার। বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ। বেড়াতে এসে আবহাওয়া খারাপ থাকলে খুবই মুশকিলের কথা। তাই মনটা একটু ভার হয়ে গেল আমাদের তিনজনেরই। তবে একটা আশার ব্যাপার ছিল। কলকাতায় বসেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস ইন্টারনেটে দেখে এসেছিলাম। সেই অনুযায়ী পরের দিনই ঝলমলে রোদ ওঠার কথা। সেই আশায় জিনিসপত্র নিয়ে ট্যাক্সি চেপে এসে গৌছলাম ছোট কিন্তু বেশ ছিমছাম একটা হোটেলে। নাম হফওয়ার্ট। এখানে বলে রাখা ভাল, অস্ট্রিয়াতে কিন্তু পুরোদস্তুর ইংরাজি জানা লোকের সংখ্যা খুবই কম। জার্মান ভাষাতেই এখানকার লোকেরা কথা বলে। তবে স্টেশন, হোটেল, এয়ারপোর্টে যারা কাজ করেন, তারা কাজ চালানোর মত ইংরাজি বলতে ও বুঝতে পারেন। রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথোপকথনের জন্য শব্দের থেকে ইশারায় বেশি কাজ হয়। তবে মানুষ স্বভাবতই হাসি-খুশি, পর্যটকদের সাহায্য করতে তাদের কোনও আপত্তি হয় না।
আগের দিন সারারাত প্লেনে কেটেছে। তাই ক্লান্ত ছিলাম খুব। স্নান সেরে, সঙ্গে যে কেক-বিস্কুট ছিল, তাই খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়তেই গভীর ঘুম। বিকেল নাগাদ বেরোন হল শহর দেখতে। বর্তমান অস্ট্রিয়ার প্রাচীনতম এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শহর হল সালসবুর্গ। যদিও মজার ব্যাপার হল অস্ট্রিয়ার নবীনতম প্রদেশগুলির মধ্যে এটি হল একটি। ব্যাপারটা শুনেত পরস্পর বিরোধী হলেও আদতে কিন্তু তা নয় মোটেই। কারণ সালসবুর্গ আগে ছিল বাভেরিয়ার অন্তর্গত। বাভেরিয়া থেকে যে এই অঞ্চলটা আলাদা হয়ে যাবে, সেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায় মোটামুটি চতুর্দশ শতকেই। কিন্তু বাস্তবে সালসবুর্গ অস্ট্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত হয় ১৮১৬ সালে। সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও সালসবুর্গ ইউরোপের ইতিহাসকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তারমধ্যে একটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট। এই শহরেই জন্মেছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ট সংগীতবিশারদ ওলফ্যগাঙ মোজার্টি।
সালসবুর্গ শহরটা যেন ঐতিহ্য আর আধুনিকতার এক অপরূপ মেলবন্ধন। ইউরোপের শহরগুলির বোধহয় এটাই বৈশিষ্ট। তারা তাদের ইতিহাসকে অক্ষুণ্ন রেখেও আধুনিকতাকে অনায়াসে আহ্বান জানিয়েছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে তাই একটু পরে পরেই চোখে পড়বে, প্রাচীন গির্জা। তার মাথায় ঘন্টাঘর। অপূর্ব সব ঢালাই লোহার কারুকার্য করা গেট। পুরোনো কেল্লার প্রাচীর। তার পাশে পাশে আধুনিক আবাসন। কিন্তু শহরের চেহারাটা যাতে কোনওভাবেই বেখাপ্পা না হয়ে ওঠে সেজন্য সেই আবাসনের স্থাপত্যরীতি ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই। ঝাঁ চকচকে বিশ্বখ্যাত সব ব্র্যান্ডের দোকান কিংবা শপিং মল, সবই আছে ঐতিহ্যের ওড়নায় আলতো করে মুখটি ঢেকে। তবে একেবারেই যা নেই তা হল আকাশচুন্বি আধুনিক বহুতল। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু এগোলেই বেশ বড়সড় পাথর বাঁধানো চত্বর। তার চারধারে অসংখ্য দোকানপাট, খাওয়ার জায়গা। এই অঞ্চলটা পুরোপুরি পথচারীদের দখলে এখানে গাড়ি ঢোকা নিষেধ। পেডিস্ট্রিয়ান প্লাজা পেরিয়ে আরও কিছুটা গেলেই নদীর ধারে পৌছনো যায়। ছোট্ট নদী। আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা করলে খালই বলা যাবে বোধহয়। কিছুটা দূরে দূরে সাঁকো দিয়ে এপার-ওপার যোগ রয়েছে। নদীর ধার বরাবর দুটি সমান্তরাল রাস্তা। একটি সাইকেল আরোহীদের জন্য, অন্যটি অন্যান্য যানবাহনের জন্য। ততক্ষণে মেঘ কেটে গেছে। আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। নদীর ধারে বসে তাই চমৎকার সূর্যাস্ত দেখা গেল। সন্ধে নামতে দুপাশের রাস্তায় মালার মত জলে উঠল আলো। জলে তার প্রতিফলনে তৈরি হল এক অপরূপ রূপকল্প। সেই সৌন্দর্য বেশ খানিকক্ষণ উপভোগ করার পর যখন মনে হল ঠাণ্ডা ক্রমশ বাড়ছে, তখন ফেরার পথ ধরতে হল। পাথর বাঁধানো চকে পৌছে রাতের খাবারের জন্য দোকান খুঁজতে হল। ঘড়িতে তখন সবে সাড়ে সাতটা । কিন্তু ইউরোপের নিয়মমতো নৈশাহারের সময় প্রায় পেরিয়ে গেছে। তাই দেরী করা উচিত হবে না বুঝে পছন্দসই একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে বসে পড়া গেল। আমরা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, বাইরে গিয়ে ভারতীয় দোকান খুঁজব না মোটেই। ওদেশের খাবারই খাব। তাই আলু আর বেশ কয়েকরকম সবজি সেদ্ধ, মাংস আর রুটি দিয়ে খাওয়া হল দিব্যি।
সালসবুর্গে দ্বিতীয় দিনে ছিল আমাদের সাউন্ড অফ মিউজিক ট্যুর। সকাল নটা নাগাদ একটা বড় গাড়িতে আরও কয়েকজন বিদেশি পর্যটকের সঙ্গে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন কিন্তু সকাল থেকেই আকাশ পরিষ্কার, রোদ উঠেছে ঝলমলিয়ে। সাউন্ড অফ্ মিউজিক ট্যুরে ছবির বিভিন্ন দৃশ্য যেখানে যেখানে শুট করা হয়েছিল সেরকম অনেকগুলি জায়গা দেখানো হয়। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে অন্য একটা বিষয় বলে নিই।
আমরা অস্ট্রিয়া গেছিলাম হেমন্তের শুরুতে। এই সময়টাকে ইউরোপে বলে ফল্। শীতে সেখানে গাছের পাতা সব ঝরে পড়ে যায়। শুকনো ন্যাড়া ডালগুলো শুধু আকাশের দিকে মুখ তুলে অপেক্ষায় থাকে, কবে আবার বসন্ত আসবে, কবে তারা আবার নতুন পোশাকে সাজবে। ফল্ তাই প্রকৃতির নিঃশেষে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার সময়। ছোটবেলা থেকে বইয়ে পড়েছি হেমন্তের এই রূপ নাকি ভারি সুন্দর। ছবিটবিও যে দেখিনি তাও নয়। কিন্তু সে সৌন্দর্য এমন অপরূপ, এমন অপার্থিব তার কোনও ধারণাই ছিল না আমার। চারিদিকে শুধু লাল-হলুদ আর কমলার সম্ভার। মস্ত মস্ত গাছের পাতায় যেন মনে হচ্ছে রঙের আগুন লেগেছে। সবুজ ঘাসের ওপর ঝরে পড়া পাতার রঙিন নকশা। মাইলের পর মাইলের পর মাইল এমন রঙবাহারি গাছের সারি। ছবি তুলতে গেলে ক্যামেরার লেন্সের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। বর্ণনা করতে গেলে শব্দের ঘাটতি প্রকট হয়।
সাউন্ড অফ মিউজিক ট্যুরে আমরা প্রথমেই দেখলাম ক্যাপ্টেনের সেই বিশাল প্রাসাদ যেখানে সাত ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তিনি থাকতেন। প্রাসাদের ভিতর অবশ্য ঢোকা যায় না। কারণ সেটি একজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কিন্তু তার বাগান, চারপাশের লেক সবই এক কথায় অপূর্ব। দেখা হল মেপল্ গাছে ঢাকা সেই রাস্তা, কনফিডেন্স গানটি গাইতে গাইতে যে রাস্তাটি দিয়ে হাটছিলেন জুলি আন্ডুজ। সেই কাঁচের ঘর, যেখানে গাওয়া হয়েছিল ইউ আর সিক্সটিন, সেই লেক যেখানে নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে বাচ্চারা হাবুডুবু খাচ্ছিল জলে। দেখলাম সেই অবিশ্বাস্য সবুজ প্রান্তর যেখানে হয়েছিল ডো আ ডিয়ার গানের শ্যুটিং বাংলাদেশের মানুষ। সবুজ দেখে অভ্যস্ত চোখ। কিন্তু ইংরাজিতে যাকে বলে লাশ্ গ্রিন, তার যে কী অর্থ অস্ট্রিয়ার এই সবুজ প্রান্তর না দেখলে অনুমান করা কঠিন। মাথার ওপর নির্মল নীল আকাশ, রাস্তার দুপাশে ঢেউ খেলানো সবুজ প্রান্তর আর মাঝে মাঝেই রঙবেরঙের গাছের সারি। মানুষের ভূমিকা কতটা আর প্রকৃতিই বা কতটা অকৃপণ বোঝা কঠিন।
সাউন্ড অফ মিউজিক ট্যুরে আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল সেই চার্চটি যেখানে ক্যাপ্টেন আর মারিয়ার বিয়ে হয়েছিল। মধ্যযুগের এই গির্জার স্থাপত্যশৈলী অপরূপ। ভিতরে সোনালি-রুপোলি রঙের কারুকাজ। গোটা দেওয়াল জুড়ে যিশুর জীবনের নানা ঘটনার বিশাল বিশাল ফেফ্কো। বিশাল স্তম্ভের গায়ে সোনালি ডানাওলা দেবদূত। গির্জার ভিতরে অদ্ভুত এক ভাব গম্ভীর পরিবেশ। চার্চ দেখে তো মন ভাল হয়ে গেলই, উপরি পাওনা, এডেলওয়াইজের গল্প। সে গল্প শোনালেন আমাদের গাইড। সাউন্ড অফ মিউজিক ছবিটি যাঁরা দেখেছেন, এডেলওয়াইজ গানটি তাদের জানা। অস্ট্রিয়ার প্রচলিত প্রেমগাঁথা থেকে তৈরি একটি গান। এখানে এসে জানা গেল এডেলওয়াইজ আসলে একটি ফুলের নাম। পাহাড়ের অনেক ওপরে ফোটে সেই ফুল। অপূর্ব সুগন্ধে মাতোয়ারা করে দেয় চারিদিক। এক সময় নাকী অস্সিয়ায় প্রেমিকের সার্থকতা ছিল প্রেমিকাকে এডেলওয়াইজ উপহার দেওয়ায়। কোনও অজানা কারণে এই চার্চ আর তার আশপাশের অঞ্চলটাকেই বলা হয় এডেলওয়াইজ সেন্টার। চারপাশে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট স্যুভেনিরের দোকানে। তাতে এডেলওয়াইজের ছবি আঁকা কার্ড থেকে শুরু করে টেবিলক্লোথ, নেকলেস, জামা, বিছানার চাদর কোনও কিছুরই অভাব নেই। দাম অবশ্য একটু বেশি। ঘুরে ফিরে সব দেখতে দুপুর হয়ে গেল। খিদে পেয়েছে অল্প অল্প। তাই রেস্তোরাঁয় ঢুকে খাওয়া হল কফি আর ফ্রেশ আপেল পাই। অপূর্ব তার স্বাদ।
সাউন্ড অফ মিউজিকের ট্যুর শেষ হল মিরাবেল গার্ডেনে। ১৬৯০ সালে তৈরি এই উদ্যানে আছে একটি অপূর্ব ফোয়ারা। তারই সংলগ্ন ডোয়ার্ফ গার্ডেন। সাদা পাথরের অনেকগুলি বামনমূর্তি সাজানো আছে এই বাগানে। এরা নাকি বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রতীক। মিরাবেল গার্ডেন দেখে সেই বেলার মত বেড়ানো শেষ। শহরের রাস্তায় বেশ খানিকক্ষণ নিজেদের খুশিমত এলোমেলো ঘুরে আমরা ফিরলাম হোটেলে। সন্ধেবেলায় টিকিট কাটা আছে কনসার্টের। মিরাবেল প্যালেসে কনসার্টের আয়োজন। মোত্জার্টের শহরে যাব অথচ মোত্জার্ট শুনব না এতো আর হয় না। সুতরাং নৈশাহার সেরে সময়মত পৌছে গেলাম কনসার্ট হলে। প্রাসাদের ভিতর, দেওয়ালে সোনালি কাজ করা কনসার্ট হল। পিয়ানোর সঙ্গে বেহালার যুগলবন্দি। প্রায় আড়াই ঘন্টা সেই অপূর্ব বাজনা শুনে চাঁদনী রাতে যখন সালসবুর্গ স্বর্গের কাছাকাছি কোথাও সুরের স্রোতে ভেসে যাচ্ছি।
পরের দিন সকালে আমাদের গন্তব্য ছিল ঈগলস্ নেস্ট। সালসবুর্গ শহর থেকে সে জায়গাটা বেশ খানিকটা দূর। ম্যাপের হিসেবে ঈগলস্ নেস্ট অস্ট্রিয়ার সীমানার ভিতর পড়ে না। এটি আসলে বাভেরিয়ান পর্বতের ওপর অর্থাৎ জার্মানির অন্তর্ভুক্ত। তবে সালসবুর্গ থেকে এখানে যাওয়ার জন্য আলাদা ভিসার দরকার পড়ে না। সকাল নটা নাগাদ বেশ বড় একখানা বাসে আরও অনেক যাত্রীর সঙ্গে আমরাও রওনা দিলাম ঈগলস্ নেস্টের দিকে। দুধারের রাস্তার দৃশ্য অপূর্ব। সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়। রঙিন জঙ্গল। মাঝে মাঝেই ছোট ছোট নদীর ঝিরঝির। তবে আবহাওয়া তখনও পর্যন্ত তেমন ভাল নয়। মেঘলা আকাশ। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে রাস্তার দৃশ্য বদলাতে শুরু করল। সবুজ পাহাড়ের জায়গায় চোখে পড়তে লাগল পাথরে ঢাকা ন্যাড়া পাহাড়ের চুড়া। তাতে খাঁজে খাঁজে বরফ জমে আছে। বাস উঠছে পাহাড়ের গা বেয়ে। ক্রমশ রাস্তার দুপাশে পেঁজা তুলোর মত জমে থাকা বরফ চোখে পড়তে লাগল । ঈগলস্ নেস্টে পৌছে দেখা গেল চারপাশ ধবধবে সাদা। শক্ত হয়ে জমে থাকা বরফ চারধার পিছল। সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। বাস এসে থামল একটা খোলা চত্বরে। সেখান থেকে একটা সুড়ঙ্গ পেরিয়ে পৌছতে হয় লিফটের কাছে। তারপর লিফটে চড়ে সরাসরি ঈগলের বাসায়।
ইংরাজি ভাষীরা এই জায়গাটিকে বলে ঈগলস্ নেস্ট। জার্মান ভাষায় এর নাম হল খেলস্টেইনহুস। খেলস্টেইন পাহাড়ের ওপর একটা ছোট্ট বাড়ি। হিটলারের পঞ্চাশতম জন্মদিনে তার সতীর্থরা তাকে এই বাড়িটি উপহার দিয়েছিলেন। হিটলার অবশ্য এখানে থাকতেন না। তবে মাঝে মাঝে তার গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরদের নিয়ে এখানে জরুরি মিটিং করতে আসতেন। নাৎসি জমানার পতনের পর প্রথমে এটি ভেঙে ফেলা হবে ঠিক হয়েছিল। পরে এর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এটিকে দ্রষ্টব্য স্থান হিসাবে রক্ষা করা হয়। হিটলারের মিটিং হলটি এখন একটি সুন্দর রেস্ডোর। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সেখানকার গরম কফি অতি উপাদেয়।
আমরা ঈগলের বাসায় পৌছানোর একটু পরেই ঝলমলিয়ে রোদ উঠল। ঝকঝক করে উঠল চারপাশের চাদর সরিয়ে আলোর জাদুকাঠি ছোয়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠল অনেক নিচের সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকা। সে দৃশ্য অনুপম ।
আগেই বলেছি ঈগলের বাসায় পৌছতে হয় লিফটে চড়ে। সেই লিফটের বর্ণনা যদি না দিই তাহলে এই ভ্রমনকাহিনি অসম্পূর্ণ থাকবে। লিফটটি আয়তনে বেশ বড়সড় একটি ঘরের মত। ভিতরটা আগাগোড়া পিতলের চাদরে মোড়া। সেই পিতল এমন ঝকঝকে পালিশ করা যে তাতে অনায়াসে মুখ দেখা যায়। হিটলারের ক্লাউস্ট্রোফোবিয়া ছিল। ছোট চাপা জায়গায় তার দমবন্ধ হয়ে আসত। তাই বিশেষভাবে তার জন্য বানানো হয়েছিল এই বিশালাকৃতির লিফট্। যা আকার তার থেকেও যাতে বড় দেখায় সেজন্য ভিতরটা পালিশও করা হয়েছিল ওভাবেই।
ঈগলের বাসায় যতায়াতেই কেটে গেল সারাটা দিন। ফেরার পথে ছোট্ট একটা জায়গায় রাস্তার ধারের রেস্তোরাঁয়, স্থানীয় পদ দিয়ে চমৎকার দুপুরের খাবার খাওয়া হল। বিকেলে আমরা গেলাম মোজার্টের বাড়ি দেখতে। মোজার্ট জন্মেছিলেন সালসবুর্গে, মাঝমধ্যে ভিয়েনা গেলেও তিনি থাকতেন সালসবুর্গেই। এই শহরে তার দুটি বাড়ি আছে। দুটিই এখন মিউজিয়াম। ভারি যত্ন করে বাড়ি দুটির পুরোনো চেহারা অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। সেই আঠারো শতকে তৈরি বাড়ির দেওয়াল, কাঠের মেঝে, রান্নাঘরের চুল্লি সব স্বযত্নে রক্ষিত। মোজার্টের ব্যবহৃত নানা বাদ্যযন্ত্র রাখা আছে সেখানে। আছে তার স্ত্রীকে লেখা অনেকগুলি চিঠি। প্রচুর মানুষ প্রতিদিন এখানে আসেন। কিন্তু ব্যবস্থা এমন সুন্দর যে কখনোই খুব বেশি ভিড় মনে হয় না।
মোজার্টের বাড়ি থেকে যখন বেরোলাম তখন বাইরে একটা ঝলমলে সুন্দর বিকেল। সেদিন বিকেলে আমাদের একটি বিশেষ রেস্তোরাঁয় কফি খাওয়ার কথা। কারণটাও বলে নিই। আমরা ঈগলস্ নেস্টের যে ট্যুর বুক করেছিলাম তার সঙ্গে এই রেস্তোরাঁয় আমাদের তিনজনের কফি এবং প্যাস্ট্রি খাওয়ার কুপন ফ্রি পাওয়া গেছিল। সুতরাং পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা ছাড়ার প্রশ্নই নেই।
এখানে বলে রাখা ভাল, আমরা কিন্তু কলকাতার কোনও ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে অস্ট্রিয়া বেড়াতে যাইনি। গেছিলাম পুরোপুরি নিজেদের উদ্যোগে। ইন্টারনেট দেখে সর্বত্র নিজেদের পছন্দমত হোটেল বুক করেছিলাম। ট্যুরও সবই বুক করা হয়েছিল একইভাবে। তাতে লাভ হয়েছিল এটাই যে প্রায় সব ট্যুরের সঙ্গেই এরকম বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। বিদেশে বেড়াতে যাওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে যেমন সাংঘাতিক খরচসাপেক্ষ মনে হয়, নিজেদের উদ্যোগে একটু হিসেব করে বেড়ালে কিন্তু সেটা তেমন সাংঘাতিক কিছু নয়। হোটেলের বাসিন্দাদের জন্য সর্বত্রই বেকফাস্ট ফ্রি। ভরপেট খেয়ে নিলে দুপুরে হালকা ফল বা বিস্কুট খেলেই চলে। সন্ধে নাগাদ জমিয়ে ক্ষিদে পায়। ঠান্ডার জন্য তো বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে ঘোরার কোনও উপায় নেই। ফলে তখনই পেট ভরে খেয়ে হোটেলে ঢুকে স্নানটান সেরে শুয়ে পড়লেই আরামের ঘুমে রাত কাবার। আমরাও মোটামুটি সেই ফর্মুলাতে চললেও সেদিন বিকেলে চমৎকার অস্ট্রিয়ান কফি আর প্যাস্ট্রি খেলাম আরাম করে। কন্যা অবশ্য কফি খাননি। তিনি প্রতিটি চুমুকে স্বর্গসুখ অনুভব করার মত মুখভঙ্গি করে খেলেন হট চকোলেট। সেদিন রাতে একটা ছোট রেস্তোরাঁয় নৈশাহারের সময় আমরা নিয়েছিলাম অস্ট্রিয়ানদের নিজস্ব মদ। তাতে নাকি ৫০ শতাংশ এলকোহল থাকে। স্বাভাবিকভাবেই চুমুক দিতে গলা দিয়ে নামল জ্বলতে জ্বলতে। এক পান্তর খেয়েই কোট-জ্যাকেটের প্রয়োজন কমে গেল। টুপি-মাফলার হাতে নিয়ে দিব্যি গান গাইতে গাইতে হোটেলে ফিরলাম। পরের দিন সকালটা নিজেরাই পায়ে হেঁটে সালসবুর্গ শহরের এদিক-ওদিক ঘুরে টুকটাক কিছু শপিং করে, বিকেল বেলা চেপে বসলাম ভিয়েনার ট্রেনে। সন্ধের মুখে পৌছলাম ভিয়েনা। শহরের মধ্যে বেশ জমজমাট জায়গায় আমাদের হোটেল, নামটি একটু অদ্ভুত, পোস্ট। পুরোনো শহর ভিয়েনা। অনেক ঝড়ঝাপটা তাকে সহ্য করতে হয়েছে। ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ধবংস হয়ে গেছিল এই শহর। তারপর আবার ধীরে ধীরের ফিনিক্স পাখির মত জেগে উঠেছে। শহরের রাস্তাঘাটে, অলিতে গলিতে তাই ইতিহাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি।
সেদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া নেই। তাই জিনিসপত্র গুছিয়ে সন্ধে নাগাদ খেতে বেরিয়ে আমরা চারপাশটা একটু ঘুরে এলাম। পরদিন সকাল বেলায় বেড়ানোর তালিকায় প্রথমেই ছিল সনকুন প্যালেস। অস্ট্রিয়ার রাজ পরিবারের রানি মারিয়া তেরেসিয়া তৈরি করেছিলেন এই প্রাসাদ। ইতিহাস বলে প্রাসাদ যখন তৈরি হয় তখন এই এলাকাটি ছিল মূল ভিয়েনা শহর থেকে অনেকটা দূরে। লোকবসতি ছিল না। রাজারা সেখানে শিকার করতে আসতেন। অবসরের আমোদ-প্রমোদের জন্যই বারোখ স্থাপত্য রীতিতে তৈরি হয়েছিল এই বিশাল প্রাসাদ। সনব্রন কথাটির অর্থ হল সুন্দর ফোয়ারা। প্রাসাদের চারপাশে অসংখ্য ফোয়ারা থাকাতেই সম্ভবত তার এমন নাম। আপাদমস্তক মহার্ঘ মার্বেল এবং সিরামিক্সের কাজ করা এই প্রাসাদে আছে এক হাজারেরও বেশি কামরা। তার খুব অল্প সংখ্যকই অবশ্য পর্যটকরা দেখে উঠতে পারেন। ঘরগুলিতে অসংখ্য ছবি, রাজ পরিবারের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র, আসবাব, অলঙ্কারের ছড়াছড়ি।
অস্ট্রিয়ার রানি মারিয়া তেরেসিয়ার মোট ১৬টি সন্তান ছিল। তার মধ্যে ২টি ছেলে এবং ১৪টি মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে বড় দ্বিতীয় যোসেফ এবং ছোট দ্বিতীয় লিওপোল্ড। মারিয়া তেরেসিয়ায় মৃত্যুর পর প্রথমে সিংহাসনে বসেছিলেন যোসেফ। তখন ফরাসী বিপ্লব হয়ে গেছে। তার প্রভাব এসে পড়েছে অস্ট্রিয়াতেও। প্রজাদের সন্তুষ্ট রাখতে যোসেফ বহু সংস্কারমূলক কাজ করেন। কিন্তু তার অসময়ে মৃত্যু হলে সিংহাসনে বসেন লিওপোল্ড। তিনি রাজা হয়েই সেসব বন্ধ করে দেন। মারিয়া তেরেসিয়ার মেয়ে অর্থাৎ রাজকন্যাদের সবারই বিভিন্ন রাজপরিবারে বিয়ে হয়েছিল। তবে এর মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিপ্লবের পর গিলোটিন হয় মারি আতনেতের। শোনা যায় বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের দরিদ্র মানুষরা যখন এক টুকরো রুটির জন্য হাহাকার করছে, তখন মারি আঁতনেতই নাকি বলেছিলেন, ” রুটির জন্য হাহাকার কেন ? রুটি না থাকলে কেক খেতে পারে তো £” সনকুন প্রাসাদে অপূর্ব সুন্দরী সেই মারি আঁতনেতের বেশ কয়েকটি ছবি আছে।
রানি মারিয়া তেরেসিয়া ছিলেন শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। শোনা যায় বালক মোজার্ট যে আসলে সঙ্গীতের বিরল প্রতিভা সেকথা তিনি বুঝতে পেরছিলেন এবং রাজ পরিবারে মোজার্টের প্রতিভার যথেষ্ট কদরও ছিল। যুবরাজ যোসেফের বিবাহ অনুষ্ঠানের একটি বিশাল ছবি প্রাসাদে রয়েছে। সেখানে অতিথিদের মধ্যে বালক মোজার্টও আছেন তার বাবার সঙ্গে।
রাজপ্রাসাদ দেখা শেষ করে আমরা গেলাম বেলভেডেয়ার মিউজিয়াম দেখতে। ইউরোপের নবজাগরণের সময় বারোথ শিল্পরীতির উদ্ভব হয়। মিউজিয়ামের বাইরের স্থাপত্য সেই রীতিতে তৈরি। ভিতের অপূর্ব সমৃদ্ধ এক সংগ্রহের সম্ভার। বিশেষত মধ্যযুগের যেসব বিশাল অয়েলপেইন্টিং এখানে রাখা আছে তা এককথায় অতুলনীয়। এখানেই দেখার সৌভাগ্য হল ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আঁকা ছবি। আরও বহু মিউজিয়ামেই।
ভিয়েনায় ট্যুর কোম্পানি কিন্তু সনকুন প্যালেস দেখিয়ে রাস্তাতেই ছেড়ে দিয়েছিল আমাদের। সেখান থেকেই নিজেরাই খুঁজে খুঁজে দেখতে গেলাম মিউজিয়াম। তারপর আবার রাস্তা চিনে মেট্রোয় চেপে ফিরে এলাম হোটেল। বলতে ভুলেছি ভিয়েনাতে ট্যুর কোম্পানি আমাদের দুটো টিকিট দিয়েছিল। সেই টিকিটে আমরা তিনদিন বাস, ট্রাম কিংবা মেট্রোয় চড়ে, শহরের যে কোনও জায়গায়, যতবার খুশি যেতে পারতাম। কন্যার বয়স এগারো বলে সে সর্বত্র ফি।
ভিয়েনাতে প্রথমদিন কিন্তু আবহাওয়া মোটেই ভাল ছিল না। আকাশ মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ। মিউজিয়াম দেখতে বেশ কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে গিয়ে তো ভিজেই সারা। তাই সন্ধের মুখে হোটেলে ফিরে প্রথমে মনে হচ্ছিল আর কোথাও বেরোন যাবে না। কিন্তু বেড়াতে বেরিয়ে ঘরে বসে থাকতে কী কারও ভাল লাগে ? তাই ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে চাঙ্গা হয়েই আবার বেরিয়ে পড়া হল। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে, সন্ধে নেমেছে। সেদিন শনিবার। সপ্তাহ শেষে ভিয়েনা শহর রীতিমত জমজমাট। রাস্তায় মানুষের ভিড়। অপেরা হাউসের সামনে দর্শকদের লাইন। রাস্তার ধারের অসংখ্য রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডায় ব্যস্ত বহু মানুষ। অষ্টাদশ শতকের পোশাক পরে ওয়েটাররা খাবার পরিবেশন করছে, ডাকাডাকি করছে পথচলতি মানুষকে। মস্ত একটা চকের একপাশে বসে ক্লারিওনেট বাজাচ্ছে এক বুড়ো। সামনে টুপি পাতা। পথচলতি মানুষ টুপটাপ পয়সা দিচ্ছে। ভারি মিঠেসুর। ফোয়ারার ধারে বাঁধানো চত্বরে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনলাম ব্লু দানিউব। তখনও পর্যন্ত কিন্তু দানিউব নদী দেখা হয়নি। পরদিন সকালে ছিল সিটি ট্যুর। বাসে চেপে ঘোরা হল শহরের নানা দর্শনীয় স্থান। অসংখ্য গির্জা, ছোট-বড় প্রাসাদ, রকমারি স্থাপত্য। ইতিহাসবিদ না হলে তার গুরুত্ব মনে রাখা কঠিন। তবে দেখতে ভারি ভাল লাগে। সেদিন আবার আকাশ ঝলমলে। তাই বিকেল বেলা মেট্রোয় চেপে নিজেরাই বেরিয়ে পড়লাম দানিউব নদী দেখতে। দানিউব কিন্তু আমাদের গঙ্গার মত অত বড় না হলেও যথেষ্ট চওড়া নদী। নদীর দুধারে বেশ খানিকটা জায়গায় সবুজ ঘাস আর মেপল্ গাছের সারি। হেমন্তের বিকেলে তাদের কমলা-লাল রঙে উজ্জ্বল বিকেলের আলো। নদীর বুকে ধবধবে সাদা বুকের সামুদ্রিক পাখির ওড়াওড়ি। পাড়ে বসে থাকলে সময় কেটে যায় আপনা থেকেই। ক্রমশ বিকেল পড়ে আসে। নদীর বুকে হলুদ রঙের পন্টুন বিজের রঙ আরও মায়াবী হয়। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় দানিউবের জল তখন গলানো সোনা। সেই উজ্জ্বল সোনালি আস্তে আস্তে বিষণ্ণ গোলাপিতে বদলে যাওয়ার পর আমরা নদীর ধার থেকে উঠে ফেরার পথ ধরি। শহরের রাস্তায় ততক্ষণে আলো জ্বলে উঠেছে। রেস্তোরাঁর বাইরে চেয়ার পাতা। ঘর ফেরতা মানুষ পানাহারে ব্যস্ত। আরও অনেকের সঙ্গে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে আমরাও বসে পড়ি। আর একটা দিন কেটে গেল। পরের দিনের গন্তব্য বাকাও উপত্যকা ।
বাকাও উপত্যকা ভিয়েনা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বাস করে প্রথমে কিছুদূর গিয়ে,তারপর উঠতে হবে লঞ্চে। দানিউবের ওপর লঞ্চে চড়ে যাওয়া হবে প্রায় ঘন্টাখানেক। লঞ্চ থেকে নেমে সন্ন্যাসীদের মঠ। বাকাও উপত্যকায় বাসে চেপেও যাওয়া যায়। দানিউবে লঞ্চ ভ্রমণটা এখানে বাড়তি পাওনা। বেরোনো হল সকাল ৯টা নাগাদ। শহর ছাড়াতেই দুধারে সেই অপূর্ব সবুজ প্রান্তর । মাঝে মাঝে রঙিন গাছের সারি। কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পরেই সঙ্গ ধরল দানিউব নদী। ভূ-গ্রকৃতির গঠনও বদলে গেল খানিকটা। সবুজ সমতলের বদলে উচু নিচু ছোট ছোট পাহাড়। তার ঢালে আঙুরের ক্ষেত। হলুদ-সবুজ আঙুর লতায় ঢেকে আছে পাহাড়ের গা। জানা গেল এই অঞ্চলগুলি ওয়াইন তৈরির জন্য বিখ্যাত। প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পর বাসটা এসে দাড়াল দানিউব নদীর ধারে একটা জেটিতে। সেখান থেকে আমাদের লঞ্চযাত্রার শুরু। মস্ত লঞ্চের খোলা ডেকে বসে দুধারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চললাম। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে পুরোনো কেল্লা, প্রাচীন গির্জার চুড়ো আর বিস্তীর্ণ আঙুরের ক্ষেত। রোদের তেজ বেশ চড়া। কিন্তু হুহু করে শুকনো ঠান্ডা হাওয়া বইছে। সব মিলিয়ে নদীবক্ষে বেশ একটা অন্যরকম আমেজ। লঞ্চ থেকে নেমে আবার কিছুটা পথ যেতে হল বাসে চেপে। তারপর পৌঁছালাম মেক্ক আবি (৪০৮5) তে। আবি কথাটার অর্থ হল সন্ন্যাসীদের মঠ। মেক্ক আবি হল সেন্ট বেনেডিক্টের মঠ। বেনেডিক্ট একটি বিশেষ গোষ্ঠী, যাদের মূল মন্ত্র ছিল তিনটি; পরিশ্রম. অধ্যয়ন এবং প্রার্থনা। বিশাল এই মঠের স্থাপত্যশৈলী অপূর্ব। ইউরোপের বহু বিখ্যাত রাজ পরিবারের মানুষজন এখানে আসতেন। তাই রাজা-রাজড়াদের থাকার বিশেষ ব্যবস্থা আছে। এছাড়া সন্ন্যাসীদের বসবাসের জায়গা তো আছেই। বৈভব আর সৌন্দর্যের এক অপরূপ মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। এই মঠেই আছে ইউরোপের বৃহত্তম প্রাচীন গ্রন্থাগার। আছে নবজাগরণের সময়কার অসংখ্য শিল্প নিদর্শন।
দুপুরের খাওয়া সেরে মেক্ক আবি ঘুরে দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এল। শহরে যখন ফিরলাম তখন রাস্তার আলো জুলে উঠেছে। কিন্তু তখনই হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। তাই আরও বেশ খানিকক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কফি আর চকোলেট প্যাস্ট্রি খেয়ে রাত প্রায় আটটা নাগাদ হোটেলে ফিরলাম। পরের দিন সকালেই ফেরার উড়ান। তাই স্নান সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে রাতের খাওয়া সারা হল হোটেলেই।
ক্লান্ত ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ঘুম এল না। বাকী দুজন যখন অঘোর ঘুমে তখন আমি উঠে গিয়ে দাড়ালাম হোটেলের জানলায়। নিচে চুপচাপ, শুনশান পাথরের রাস্তা। বাতিস্তম্ভের আলোয় কুয়াশার ঘেরাটোপ। ওভারকোট পরা এক তরুণী হেঁটে গেল রাস্তা দিয়ে। তার টুকটুকে লাল মাফলারের রঙটি অনেকক্ষণ চোখে লেগে রইল। মন খারাপ করছিল আমার। এই ইতিহাসের গন্ধমাখা শহরটার সঙ্গে কেমন যেন একটা আত্মীয়তার টান অনুভব করছিলাম। যদিও নিশ্চিত জানি পরের দিন সকালেই রূপোলি পাখির ডানায় চড়ে পাড়ি দেব নিজের দেশে। পাথর বাঁধানো এই রাস্তাটার সঙ্গে আর কখনও আমার দেখা হবে না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন